মেক্সিকান মেনিফেস্টো 

ওই বিকেলে আমি আর লরা সঙ্গম করিনি। চেষ্টা অবশ্য করেছিলাম; কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। এমনো হতে পারে শুধু ভেবেছিলাম। ঠিক নিশ্চিত নই। সম্ভবত মিলন হয়েছিল আমাদের। লরা সে রকমটাই বলেছিল। ওটা করবার সময় সে আমাকে গণ স্নানাগারের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিল; তখন থেকে দীর্ঘ সময় আমি আনন্দ ও খেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমটা সন্দেহাতীতভাবেই ছিল সব থেকে ভালো। নাম ছিল মন্টিজুমাস জিম। ঢোকার মুখে অজ্ঞাতনামা শিল্পীর আঁকা দেওয়াল চিত্র-আজটেক সম্রাট জলাশয়ের পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখেছেন। সম্রাটের চারপাশে ছোট করে আঁকা হাস্যোজ্জ্বল নর-নারীর চিত্র অঙ্কন করছে।  সবাইকে খুব নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে, কেবল সম্রাট ছাড়া। চিত্রের বাইরে তার দৃষ্টি, অন্ধকার বিস্ফারিত চোখে দর্শকদের তালাশ করছে যার ভেতর আমি সবসময় ত্রাস আর শঙ্কা প্রত্যক্ষ করি। জলাশয়ের পানির রঙ সবুজ। পাথরগুলো ধূসর। পশ্চাৎপটে দেখতে পাবেন পাহাড় আর ঝড়ের মেঘ। 

মন্টিজুমাস জিমে কাজ করে যে-ছেলেটি সে একজন এতিম। কথা বলার সময় প্রথমেই সে ওই কথাটা সবাইকে জানায়। তৃতীয়বার আমরা ওখানে গেলে সে আমাদের বন্ধু হয়ে যায়। তার বয়স মাত্র আঠার। একটা গাড়ি কেনার ভীষণ ইচ্ছে। খুব টাকা-পয়সা জমাচ্ছে এ জন্যে : বখশিস পায় সামান্যই। লরার মতে ও খুব ঢিলে। আমার তো মনে হয় চমৎকার ছেলে। 

গণস্নানাগারে হুজ্জোত হাঙ্গামা লেগেই থাকে সময়-সময়। ওখানে অবশ্য সেরকম কিছু দেখিনি বা শুনিনি। অজ্ঞাত কোনো কৌশল বলে ওখানকার সব খদ্দের এতিম বালকটিকে মান্য করে চলে আর তার সব পরামর্শ মেনে নেয়। যথার্থ বিচারে গেলে বলতে হয়, ওখানে খুব বেশি লোকের সমাগম ঘটে না। কখনো কখনো পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না আমার পক্ষে। জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন,

তুলনামূলকভাবে আধুনিক। আলাদা আলাদা স্টিম বাথের ব্যবস্থা আছে, আর সবচেয়ে বড় কথা সস্তা। ওখানকার দশ নম্বর স্টিম বাথে আমি লরাকে প্রথম নগ্নাবস্থায় দেখি। যা আমি করেছিলাম তখন-মৃদু হেসে তার কাঁধ স্পর্শ।  বলেছিলাম-কোন্ নব ঘোরালে বাষ্প বের হয় জানি না।  
স্টিমবাথগুলো, যদিও সংক্ষেপে বলা যায় ব্যক্তিগত কক্ষ, গ্লাসের দরজা দিয়ে বিভক্ত দুটি ক্ষুদ্র চেম্বার। প্রথমটাতে একটা ডিভান ছিল—পুরনো একটা ডিভান  মনোবিশ্লেষণের স্মৃতিবাহী আর বেশ্যালয়—একটা ফোল্ডিং টেবিল আর একটা  কোট রাখার র‌্যাক; দ্বিতীয় চেম্বারটা ছিল সত্যিকার স্টিমবাথ, সঙ্গে গরম ও ঠান্ডা পানির শাওয়ার, টালির বেঞ্চ, যার নিচে লুক্কায়িত নল যা দিয়ে বাষ্প বের হয়। এক প্রবেশ কক্ষ থেকে অন্যটাতে যাওয়ার পথ অসাধারণ, বিশেষত বাষ্প ঘন হয়ে বেরুলে একে অপরকে দেখতে পাব না। অতঃপর দরজা খুলে ডিভানসমেত চেম্বারে ঢুকতে হবে, যেখানে সবকিছুই স্বচ্ছ, আর আমাদের পেছনেই স্বপ্নের তন্তুর মতো বাষ্পের মেঘ গড়িয়ে পড়ছে আর দ্রুত উধাও হয়ে যাচ্ছে। ওখানে শুয়ে হাতে হাত ধরে আমরা জিমের বোধগম্য শব্দ শুনতে পারব, ততক্ষণে ঠান্ডার স্পর্শে আমাদের শরীর জুড়িয়ে যাবে। বস্তুত ঠান্ডায় জমে গিয়ে আর নৈঃশব্দে ডুবে শেষাবধি আমরা মেঝে আর দেওয়ালের ভেতর দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ শুনতে পাব। একদিন এখানে খুব ঘোরাঘুরি করব। গণস্নানাগারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে ওর বেশি। ও ব্যাপারে কথা না বাড়িয়ে বলা যায়, ওই ধরনের প্রতিষ্ঠানের দোরগোড়াই আমি মাড়াইনি। 

সে অবশ্য বলে স্নানাগার সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। মানে বিস্তর ধারণা নেই। এক্সের সঙ্গে বেশ ক’বার সে ওসব জায়গায় গেছে, তার আগে গেছে নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের এক লোকের সঙ্গে, তার কথা উঠলে সে রহস্যময় শব্দ ব্যবহার করে। সবমিলিয়ে অবশ্য ১০ বারের বেশি যায়নি, সব সময়ই একই বাথ—মন্টিজুমাস জিম। 

একসঙ্গে একটা বেনেল্লিতে চড়ে তারা সর্বত্র যেত তখন-আমরা মেক্সিকো  সিটির সবগুলো বাথ পরিদর্শনের চেষ্টা করেছিলাম প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে যার সঙ্গে মিশেছিল ভালোবাসা আর ক্রীড়া। কখনোই সফল হইনি এ কাজে। বিপরীত দিকে, আমরা অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা নিতেই অতল গহ্বরের দ্বার উন্মোচিত হতো-যাকে বলা হয় গণস্নানাগারের পশ্চাৎপট। থিয়েটার, পার্ক, ডক, সমুদ্র সৈকত, গোলকধাঁধা, গির্জা, বেশ্যাখানা, বার, সস্তা সিনেমা, পুরনো দালান, এমনকি সুপারমার্কেটে গণস্নানাগারের বিপুল জালে মেক্সিকো সিটির লুকানো মুখ খুঁজে পাওয়া যাবে কখনো বৈধভাবে, আধা বৈধভাবে কিংবা গোপনে। রাস্তাটা সোজা : আমি মন্টিজুমাস জিমের ছেলেটার কাছে সস্তা বাথের দিকনির্দেশনা চাইলাম। পাঁচটা কার্ড নিয়ে ডজন ডজন ভবনের নাম লিখে ফেললাম। এটা প্রথম খসড়া। তারপর আমাদের অনুসন্ধান অগণিত শাখা প্রশাখা মেলল। ভবন অনুযায়ী আমাদের সিডিউল বদলাচ্ছে। একটাতে হয়তো ঢুকি সকাল ১০ টায়, বেরিয়ে যাই লাঞ্চের সময়। হালকা পাতলা দেওয়ালওয়ালা ওইসব বাথ সবসময়ই বর্ণাঢ্য; হয়তো ভেসে আসছে কিশোরোত্তীর্ণ বয়সের ছেলেমেয়েদের হাসির শব্দ, নিঃসঙ্গ কিংবা নিখোঁজ কোনো লোকের কাশির আওয়াজ; কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ওই লোক সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে বলেরা সংগীত গাইবে। এই জায়গাগুলোর সারবস্তু মনে হয় বিস্মৃত বা অবহেলিত, একটা মৃত শিশুর মুদিত আঁখির মতো। তেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও নয় জায়গাগুলো, কিংবা দিনের শেষে ওগুলো পরিষ্কার করা হবে। অন্যগুলোতে আমরা ঢুকি বিকেল চারটা কী পাঁচটায়, অন্ধকার নেমে আসার পূর্ব পর্যন্ত অবস্থান করি। ওগুলো আমাদের নিত্য দিনের কর্মসূচি। কখনো ওই স্থান উপভোগ্য হয় অথবা বিড়ম্বনা থাকে বিস্তর; শেষ পর্যন্ত একটা স্থায়ী ছায়া তৈরি করে। একটা চাতুরি ছায়া, একটা গম্বুজ কিংবা তালগাছ, থলের মতো দেখতে কোনো জিনিস; প্রথমে আমরা এজন্য কৃতজ্ঞ ছিলাম, কিন্তু শেষ হলো যখন তখন সমাধি-ফলকের চেয়ে বেশি ওজনের কিছু একটা পাওয়া গেল। 

বাথগুলোতে সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম হয় রাত সাতটা, সাড়ে সাতটা আর আটটার দিকে। পাশের রাস্তাগুলোতে কিশোরোত্তীর্ণ বয়সের ছেলে-মেয়েরা বেসবল কিংবা পপ সংগীত নিয়ে আলাপে ব্যস্ত থাকে। হলে ঢোকার রাস্তা মুখরিত হয় শ্রমিকদের অশুভ ঠাট্টা-মস্করায়। তারা একটু আগেই কাজকর্ম সেরে তাদের কারখানা থেকে এখানে এসেছে। হলঘরে পুরনো ছাত্র বা ভবঘুরেরা রিসেপশনিস্টকে স্বাগত জানাবে ডাকনাম ধরে। হারিয়ে যাচ্ছে হলে ঢোকার পথে, অরুচিকর খাদ্যের বিষয়ে এক ধরনের অসাবধানতা লালন করছে। খোলা অথবা অর্ধ ভেজান দরজা, ভূমিধ্বসের মতো, মাটির ফাটলের মতো অনুরাগী দর্শকদের কাছে তুলে ধরছে সত্যিকার পেইন্টিং : দলে বিভক্ত নগ্ন লোকজন নড়াচড়া বন্ধ করে নিজেদের সঁপে দিচ্ছে বাষ্পে, শাওয়ারের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে কিশোর-কিশোরী পথভ্রষ্ট জাগুয়ারের মতো। ক্রীড়াবিদ ও বডি বিল্ডারদের ছোট ছোট কিন্তু ভয়াবহ অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কুষ্ঠরোগীর জামাকাপড় ঝুলে আছে, টার্কিস বাথের কঠোর মেঝের দিকে ঝুঁকে ছোট্ট এক বুড়ো পান করছে মদিরা, তার মুখে কোমল হাসি। এখানে বন্ধু বানানো সহজ ব্যাপার, আমরাও বানালাম। করিডোরে কিছু সময় কাটানোর পর দম্পতিরা ভাবল এখন একে অপরকে স্বাগত জানান উচিত। এটা এক ধরনের বিষমকামজনিত সংহতির ফল, অনেক বাথেই নারীরা সংখ্যালঘিষ্ট, আর এখানে তাদের ওপর হামলা ও নাজেহাল করার গল্প শোনাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়; যদিও সত্যি কথাটা হচ্ছে ওইসব গল্প বিশ্বাসযোগ্য নয়। 

এই ধরনের বন্ধুত্ব অবশ্য একসঙ্গে মদ্যপানীয় কিংবা বিয়ার সেবনের মতো অন্তরঙ্গতার বাইরে যায় না কখনো। বাথে দেখা হলে হাই হ্যালো বলি, তারপর যে যার মতো অন্য কোনো বাথে ঢুকে পড়ি। প্রথমে যার স্নান শেষ হয় সে বাথের দরজায় টোকা দেয়, তারপর কোনো জবাবের প্রতীক্ষা না করে কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে অপেক্ষা করে। ওখানে দেখা হলে বিয়ার কিংবা মদ্যপান চলে একসঙ্গে, তারপর শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে যায়। কখনো কোনো দম্পতি হয়তো আপনার আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়, লোকটি কিংবা মেয়েটি, বিশেষত তারা যদি বিবাহিত হয়। তারা তাদের জীবনের গল্প বলে, আপনি তা শুনে মাথা নাড়বেন, বলবেন ওটাই তো প্রেম, ওটা একটা লজ্জা, ওটাই ভাগ্য, ওটা সন্তান। শ্রুতিমধুর, কিন্তু বিরক্তিকর। অন্য যে-বন্ধুত্বটা হয় তা এর চেয়ে খানিকটা উদ্দাম। তারা হয়তো আপনার শয়নকক্ষ অবধি পৌঁছে যাবে, প্রথমটার মতো এটাও বিরক্তিকর, তবে অপেক্ষাকৃত বিপজ্জনক। না জানিয়েই এসে হাজির হবে, শুধু দরজায় একটুখানি টোকা দেবে, অদ্ভুত, দ্রুত টোকা-ঢাকার অনুমতি চাইবে। কম সময়ই একা আসবে, প্রায়শই জনা তিনেক, দুই পুরুষ, এক নারী অথবা তিন পুরুষ-তাদের আগমনের কারণ  মনে হবে অবোধ্য কিংবা খুবই বিশ্বাসযোগ্য : একটুখানি গঞ্জিকা সেবন, যা কিনা দলবদ্ধ স্নানের সময় করা যায় না, অথবা কিছু একটা বিক্রির ধান্ধা। 

লরা সব সময়ই ওদের ঢুকতে দেয়। প্রথম প্রথম কয়েকবার আমাকে তা উত্তেজিত করেছে, লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়েছি ও মেঝেতে রক্ত ঝরাতে চেয়েছি। যুক্তিগ্রাহ্য যে-ব্যাপারটার কথা হিসেব করেছি তা হচ্ছে তারা আমাদেরকে ডলাইমলাই করতে চায় কিংবা লরাকে, এমনকি আমাকে পর্যন্ত ধর্ষণ করতে চায়। আমার রক্ত মাথায় উঠে যাওয়ার অবস্থা। দর্শনার্থীরা জানত একথা। যে কোনোভাবেই হোক নিরস্ত করত আমাকে, যখন প্রয়োজন দেখা দিত কিংবা ভালো ব্যবহার দিয়ে তা এড়ানো সম্ভব হতো। এর সব বিষয়ই করা হতো লরার সঙ্গে-আলাপ-আলোচনা, ডিল, ফিসফিসানি ইত্যাদির মাধ্যমে। সে-ই তো ওদের ঢুকতে  দিত, জিজ্ঞেস করত কী চায় ওরা, ডিভান অবধি যেতে দিত ওদের। (আমি কেবল বাষ্পের ভেতর থেকে শুনতাম, দেখতাম তারা কেমন করে বসে, প্রথম জন, দ্বিতীয় জন, তারপরের জন-লরার পশ্চাৎ স্থির, বাথের চেম্বার বিভক্তকারী জলে আচ্ছন্ন  কাচটার ভেতর দিয়ে, যা কিনা হঠাৎ করেই রহস্যে ঢাকা পড়ে যেত।) শেষে আমি উঠে দাঁড়াতাম, তোয়ালে জড়িয়ে ভেতরে ঢুকতাম। আমাকে দেখে পুরুষটা, ছেলেটা কিংবা মেয়েটা দ্বিধার সঙ্গে হাত নাড়াত, যেন সব নিয়মের বাইরে গিয়ে আমাদের দুজনকে না শুধু লরাকে প্রত্যাশা করেছে। যেন তারা শুধু লরাকে খুঁজেছে। ডিভান থেকে তাদের দৃষ্টি শুধুমাত্র লরার দিকে বর্ষিত হতো। আর তাদের নিজ নিজ হাত ব্যস্ত থাকত গাঁজার সিগারেট তৈরির কাজে।  

তাদের আলোচনা চলত এক ধরনের সাংকেতিক ভাষায় যা জানা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে-ভাষা সেই সময়ে প্রচলিত কিশোর-কিশোরীদের ভাষা ছিল না। ওগুলোর গুটিকতক প্রকাশভঙ্গি কেবল স্মরণ করতে পারি এখন; কিন্তু অলক্ষুণে ও স্ল্যাংগুলোর প্রতিটি ক্রিয়াপদে বা প্রতিটি বাক্যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বা গোরের একটা ছোঁয়া থাকত। হয়তো একটা—বায়ু বিবর। হতে পারে নির্মল একটা গোর। হতে পারে আবার নাও হতে পারে। যাই হোক। আলোচনায় ঢুকে পড়েছিলাম আমি, অথবা চেষ্টা করেছিলাম। সহজ ছিল না ব্যাপারটা, তবে চেষ্টা করেছিলাম খুব। কখনো কখনো তারা মদের বোতল খুলত। ওগুলো বিনে পয়সার মাল ছিল না, আমরা অবশ্য কখনো দামটাম দেইনি। ওই দর্শনার্থীদের ব্যবসা ছিল গাঁজা, হুইস্কি, কাছিমের ডিম ইত্যাদি বাথগুলোতে বিক্রি করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও অনুমোদন থাকত না। তবে কেউ-না-কেউ তাদেরকে ওই কাজে আশ্রয় প্রশ্রয় দিত। অবিবাহিতরা থাকে এ রকম জায়গাতে তারা প্রাইভেট থিয়েটার শোর আয়োজন করত।  

এমন কোম্পানিগুলোর নাট্য-গান নগণ্য আর বহুবিচিত্র হলেও নাটকীয় দৃশ্যাবলি একই রকমের হতো : বয়স্ক লোকটা ডিভানে বসে আছে (ধরা যাক), একটি মেয়ে আর একটি ছেলে কিংবা দুটি ছেলে স্টিম চেম্বারে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তিকাল আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার এক-তৃতীয়াংশ সময়ের বেশি হতো না, দর্শকরা কখনো অংশ নিত কখনো তাদের অংশগ্রহণ থাকত না। সময় শেষ হয়ে গেলে ডিভানে বসা লোকটা দরজা খুলত তারপর সম্মানিত জনতার সামনে কাশতে কাশতে ঘোষণা করত, আর অন্য রুমে গিয়ে ঢুকত, ওটাই ছিল সমাপ্তি। পুনরায় অনুষ্ঠানের অনুরোধ আসত কদাচিৎ, যদিও তা মাত্র ১০ মিনিট স্থায়ী হতো। ছেলেরা দ্রুত স্নান সেরে লোকটার কাছ থেকে নিজেদের কাপড়চোপড় তুলে নিত। শরীর ভেজা থাকতে থাকতেই কাপড়চোপড় পরে ফেলত তারা। ক্লান্ত ও হতাশ তবে উদ্যোগী শিল্পী ও পরিচালক শেষ মিনিটের সুযোগ নিত যাতে সে তার ঝুড়িতে থাকা হুইস্কি (কাগজের কাপে পরিবেশন করা হতো) আর লেবু ও মরিচ মাখানো কাছিমের ডিম বিক্রি করতে পারে।

আমাদের ব্যক্তিগত রুমে অবশ্য ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। তারা বেশ নরম স্বরে বাতচিত করত। ফস করে গাঁজা ধরাত। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে সময় অতিবাহিত হতে দিত। তাদের মুখমণ্ডলে তখন জমে উঠত বিন্দু বিন্দু ঘাম। কখনো কখনো একে অপরকে স্পর্শ করত—আমাদেরও ছুঁয়ে দিত অনিবার্য ভক্তির  ভাব ছাড়াই, যখন ডিভানে বসে পা ঘষতাম, কিংবা হাত, যখন সব কিছু বেদনাময় হয়ে উঠত। সেক্সের ব্যথা নয়, অমার্জনীয়ভাবে হারিয়ে যাওয়া অথবা আশার শেষ ভাঙা টুকরো যা ঘুরে বেড়াচ্ছিল অসম্ভব দেশটাতে।  

জানাশোনা থাকলে লরা নিজেই ওদের আমন্ত্রণ জানাত কাপড়চোপড় খুলে স্টিম বাথে অংশ নিতে। তারা অবশ্য সে আমন্ত্রণে সাড়া দিত। তারা ধূমপান, মদ্যপান আর গল্প শুনতেই বেশি ভালোবাসত। কিংবা একটুখানি আরাম করতে চাইত শুধু। কিছুক্ষণ পর বাক্স-পেটরা গুটিয়ে চলে যেত। তারপর ওই বিকেলেই দু-তিনবার আসত। একই রুটিন মানত। ভালো মুডে থাকলে লরা ওদের ঘরে ঢুকতে দিত, তা না থাকলে কষ্ট করে বলারও প্রয়োজন বোধ করত না-চলে  যাও। 

একটা দুটো খুচরো ঝগড়াঝাটি ছাড়া সম্পর্ক ভালোই ছিল বলতে হবে। কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে, লরার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই ওরা তাকে মূল্যবান বলে বিবেচনা করেছে। এক রাতে তো বুড়ো লোকটা (তারা তিনজন ছিল, বুড়ো আর দুটি ছেলে) আমাদেরকে শো দেখবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমরা অবশ্য দেখিনি। কত খরচ পড়ত? জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিছুই না। লরা তাদেরকে ভেতরে যেতে বলেছিল। স্টিম রুমটা ছিল ঠান্ডা। শরীর থেকে তোয়ালে খুলে লরা স্টিমের সুইচ টিপে দেয় : সমানে বাষ্প গড়িয়ে মেঝেতে পড়তে থাকে। আমার মনে হয়েছিল আমরা নাৎসি-স্নান করছি, আর তারা আমাদেরকে গ্যাসের ভেতর নিয়ে ঢোকাচ্ছে, অনুভূতিটা আরও বেশি তীব্র হলো যখন দেখলাম দুটি চর্মসার আর কালো ছেলে প্রচণ্ড নোংরা দুটি আন্ডারপ্যান্ট পরে আছে। লরা হেসে ফেলেছিল। তার দিকে তাকিয়ে ঈষৎ লজ্জিত ভঙ্গিতে তারা রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। তখন তারাও হেসেছিল। তার অদ্ভুত আন্ডারপ্যান্ট না সরিয়েই বুড়ো লরা আর আমার মধ্যবর্তী স্থানে বসেছিল। শুধু দেখতে চান, না দেখতে দেখতে অংশগ্রহণও করতে চান? আমি বলেছিলাম-শুধু দেখতে চাই। আমরা দেখব শুধু, বলল লরা। ছেলে দুটো, যেন কোনো হুকুম পেয়েছে, হাঁটু গেড়ে বসে একে অপরের গোপনাঙ্গে সাবান মাখতে শুরু করল। তাদের হাবভাব আর অঙ্গভঙ্গিতে শিক্ষা আর যান্ত্রিকতার ছাপ। বোঝাই যায় তারা কী পরিমাণ ক্লান্ত আর তাদের ভেতরকার কম্পন স্পষ্ট প্রমাণ করে লরার উপস্থিতি। 

সময় বয়ে যায়। রুমটিতে আবার বাষ্পের ঘনত্ব ফিরে আসে। অভিনেতারা, যদিও নিশ্চল, আবার তাদের ভঙ্গিমায় ফিরে এসেছে, তবে জমে গেছে : হাঁটু ভেঙে বসে আছে মুখোমুখি হাস্যকর রকমের শিল্পীত ভঙ্গিমায়, বাম হাত দিয়ে একে অপরের হস্তমৈথুন করছে আর ভারসাম্য রক্ষা করছে ডান হাত দিয়ে। পাখির মতো লাগছে তাদেরকে। পাখিদের ধাতব খোদাই কাজ। ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, ওটা ওপরে তুলে রাখতে পারছে না, বৃদ্ধ লোকটা বলল। যদিও, সাবান মাখানো পুরুষাঙ্গ দুটি নিস্তেজ হয়ে একটুখানি ওপরের দিকে তুলে ধরা। ছেলেরা, ঝুলে পড়তে দিও না ও দুটিকে, বুড়ো বলল। লরা আবার হাসতে লাগল। এরকম করে যদি সারাক্ষণই হাসেন তাহলে কাজে মনোযোগ দেব কী করে? ছেলেদের মধ্য থেকে একজন বলল। লরা উঠে দাঁড়াল, তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্লান্ত অভিনেতারা এখন আমাদের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে। বোধে এলো, সময় আমার ভেতরে ছিড়েফুড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বুড়ো বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। আমি তার দিকে তাকালাম। চোখ বন্ধ করল সে, মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছে। এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে, সঙ্গীর পুরুষাঙ্গটি ছেড়ে দিয়ে বলল দুটি ছেলের একটি। তার দিকে তাকিয়ে লরা হাসল। আমার পাশেই বুড়ো লোকটা নাক ডাকাচ্ছে। ছেলে দুটিও হাসল, তাদেরকে বেশ নির্ভার লাগছে, সে আরও আরামের ভঙ্গিমায় দাঁড় করাল নিজেকে। তাদের হাড় ফোটার শব্দ পেলাম। বালকদের একজনকে লরা বলল, তুমি বড্ড বেশি চর্মসার হে। আমাকে বলছেন? তুমি তো বটেই, সে-ও। সত্যি কথা বলতে কী আমরা সবাই চর্মসার!

বাষ্পের হিসহিসানি কখনো কখনো কণ্ঠস্বরকে আচ্ছন্ন করে ফেলল, যদিও তা ছিল খুব ধীরগতির। লরার সারা শরীর ঘামে আচ্ছন্ন : নাক দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ছে, ঘাম ঝরছে গলা দিয়ে, আচ্ছন্ন করে ফেলছে স্তনযুগল, তরুবীথির মতন। তার যৌনকেশ গড়িয়ে তা মেঝেতে পড়ছে টপ টপ করে। আমরা গরমে গলে যাচ্ছি, বিড়বিড় করে বললাম আমি, আর হঠাৎ বিষাদাক্রান্ত হলাম। লরা মাথা নাড়ল। তাকে খুব মিষ্টি লাগল তখন! আমরা কোথায় এখন? ভাবলাম। হাতের চেটো দিয়ে কপাল আর চোখের পাতায় জমে থাকা ঘাম মুছে ফেললাম। এত ঘাম যে, দেখতেই পাচ্ছিলাম না। ছেলেদের একজন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভীষণ ক্লান্ত আমি। বলল সে। অ্যাই ঘুমাও না। লরা হুকুম করল তাকে। আশ্চর্য ব্যাপার : মনে হলো আলো নিভে আসছে। অনুভূতির তীব্রতা আসছে কমে। ভয় হলো-মূর্ছা যাব  নাকি? তখন মনে হলো অতিরিক্ত বাষ্পের কারণে রঙ পরিবর্তিত হচ্ছে, এখন আরও বেশি অন্ধকার এখানে। মনে হলো সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করছি এখানে, অভ্যন্তরে, জানালা ছাড়াই। ভাবলাম আমি। হুইস্কি আর মেরি জেন উত্তম সহচর নয়। যেন মনের পাঠ নিচ্ছে, লরা বলল—ভয় পেও না, সব ঠিক আছে, চমৎকার আছে। সে  আবার হাসতে শুরু করল, মস্করার হাসি নয়, এমন নয় নিজে নিজে খুব উপভোগ করছে, চরম অবস্থায় পৌঁছলে যে রকম হাসি আসে, গেরো দেওয়া হাসি, সৌন্দর্যের অনুভূতি আর দুঃখের মাঝে কোথাও, যদিও সৌন্দর্য আর দুঃখ অপরিহার্য; তবে খানিকটা সৌন্দর্য আর খানিকটা দুঃখ, কূটাভাসমূলক বামন, ভ্রমণশীল আর দুর্বোধ্য বামন। লরা বলল, আরাম কর, বাষ্প ছাড়া আর কিছু নয় এটা। ছেলে দুটো লরার কথা অকাট্য রূপে গণ্য করে সবকিছু মেনে নিতে প্রস্তুত। তারা বারবার সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। তখন একজন নিজেকে মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়তে দিল, হাতের ওপর মাথা রাখল ও ঘুমিয়ে পড়ল। বুড়ো লোকটা যাতে জেগে না ওঠে এরকম সতর্কতা অবলম্বন করে উঠে পড়লাম আর লরার কাছ ঘেঁষলাম। তার পাশে বসে ওর ভেজা ভেজা সুগন্ধ ভরা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলাম। অনুভব করলাম লরা তার আঙুল দিয়ে আমার কাঁধ ডলাইমলাই করছে। কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম লরা খুব ধীরে ধীরে খেলছে, সত্যিই এটা ছিল খেলা : তার কনিষ্ঠ আঙুল আমার কাঁধে সূর্য স্নানরত, তখন তার অনামিকা নেমে আসবে, উভয় আঙুল একটা চুমু দিয়ে একে অপরকে স্বাগত জানাবে, তারপর আসবে তার বুড়ো আঙুল, তখন তিনটি আঙুল নেমে যাবে আমার বাহুতে। বুড়ো আঙুল তখন আমার কাঁধের রাজাধিরাজ, ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়বে; মনে হলো ওটা সেখানে জন্ম নেয়া একটুখানি সবজি খাবে, আঙুলের নখ আমার মাংস খামচে ধরবে যতক্ষণ না কনিষ্ঠ আঙুল আর অনামিকা ফিরে আসে। মধ্যমা আর তর্জনী মিলে বৃদ্ধাঙ্গুলিকে উতলা করে তুলবে। সে লুকাবে একটা কানের আড়ালে, ওখান থেকে অন্য আঙুলের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালাবে, এটা না বুঝেই কেন সে ওখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে, অপর দিকে অন্যরা নৃত্য করবে কাঁধের ওপর, পান করবে, সঙ্গম করবে, মাতাল হয়ে যাওয়ায় নিজেদের ভারসাম্য হারাবে, খাড়া পাহাড় থেকে নিচে পড়ে যাবে, এই দুর্ঘটনার কারণে লরা আমাকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ নেবে, আমার ঠোঁটের সঙ্গে তার ঠোঁট ছোঁয়াবে। এই সময় চারটি আঙুল আবার উঠে আসবে, থেতলে দেবে আমার শরীরের মাংস। 
তোমার মুখমণ্ডল ঝকমক করছে, ফিসফিস করে আমি বলি। ঝকমক করছে তোমার স্তনের বোঁটা। লরা বলল, তোমাকে যদিও কিঞ্চিৎ ফ্যাকাসে লাগছে, তবে সবমিলিয়ে ঝকমকে। ঘামের সঙ্গে বাষ্প মিশে এমন হয়েছে। বালকদের একজন নীরবে দেখছিল আমাদের। ওকে কি সত্যিই ভালোবাসেন? সে লরাকে জিজ্ঞেস করল। তার চোখগুলো ভীষণ বড় বড় আর কালো। আমি মেঝেতে বসেছিলাম। লরা বলল, হ্যাঁ বাসি তো। তিনিও নিশ্চয়ই আপনাকে খুব ভালোবাসেন, জিজ্ঞেস করল ছেলেটি। গৃহবধূর মতো হাসল লরা। বলল, নিশ্চয়ই। বালক বলল, সঙ্গত কারণেই। হ্যাঁ, সঙ্গত কারণেই বললাম আমি। তুমি কি জানো কোনো বাষ্প ঘামের সঙ্গে মিশলে কিসের মতো স্বাদ লাগে? প্রতিটি বিশেষ মানুষের ব্যক্তিগত প্রাণের ওপর তা নির্ভর করে। 

চোখ বন্ধ না করে ছেলেটি তার সঙ্গীর পাশে শুয়ে পড়ল, তার কপাল ঠেকেছে টাইলস। তার লিঙ্গ এখন দৃঢ়। হাঁটু দিয়ে সে লরার পা স্পর্শ করল। আসুন, একটুখানি সঙ্গম করা যাক আপনার সঙ্গে, বলল সে। লরা কোনো উত্তর দিল না। নিজের স্বার্থেই ছেলেটি কথা বলছে বলে মনে হলো। তুমি কি জানো একটুখানি বাষ্পের সঙ্গে সামান্য একটুখানি ঘাম মেশালে কিসের মতো স্বাদ সৃষ্টি হয়? কিসের গন্ধ পাওয়া যায়? তখন এত গরম ছিল যে, আমাদের ঘুম এসে যাচ্ছিল। ঘুমন্ত বালকটার শরীর কুকড়েমুকড়ে বলের আকার ধারণ করেছে। যে-ছেলেটা জেগে আছে তার কোমরে ওর হাত। লরা উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকাল। ভেবেছিলাম ও হয়তো শাওয়ারটা খুলবে, যদি খোলে তা ঘুমন্ত লোকগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। 

অসহ্য গরম, বলল লরা। ওরা এখানে না থাকলে (ওই তিনজনের কথা বলছিল সে) বার থেকে ক’টা সোডার বোতল আনাতাম। এখনো তা পার, আমি বললাম : কেউ এত দূর আসবে না। না, ব্যাপার সেটা নয়, বলল লরা। স্টিম বন্ধ করে দেব? লরা মানা করল। বালকটির মাথা হেলানো। সোজা আমার পায়ের দিকে তাকাল। লরা বলল, সে হয়তো তোমার সঙ্গে ওটা করতে চায়। প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার আগেই ঠোঁট না নাড়িয়েই সে ছোট্ট করে বলল-না। লরা বলল, ঠাট্টা  করছিলাম। তখন সে হাঁটু গেড়ে ছেলেটার পাশে বসল আর তার নিতম্ব ডলাইমলাই করতে লাগল এক হাত দিয়ে। ভাসমান আর বিরক্তির চোখে দেখলাম, কী করে লরার শরীরের ঘাম ছেলেটার শরীরে আর ছেলেটার ঘাম লরার শরীরে চালান হয়ে গেল। বন্ধুর হাতের দীঘল আঙুল আর ছেলেটার নিতম্ব ভেজা ভেজা আর অভিন্ন হয়ে উঠল। 

লরা বলল, নিশ্চয়ই তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। বুড়ো লোকটা পাগল। কেমন করে সে প্রত্যাশা করে সে ওখানে দাঁড়িয়ে একে অপরের সঙ্গে সঙ্গম করবে? লরার হাত পিছলে গিয়ে ছেলেটার নিতম্বে পড়ল। ওটা তার দোষ নয়, ফিসফিস করে সে বলল। দুর্ভাগাটা ভুলে গেছে বিছানা জিনিসটা কী। আর পরিচ্ছন্ন আন্ডারপ্যান্টই বা কী। তার চেয়ে কিছু না পরাই ভালো। হ্যাঁ, আমি বললাম, তাতে অনেক আরাম। কম বিচ্ছিরি, ছেলেটা বলল, তবে পরিচ্ছন্ন ও সাদা আন্ডারপ্যান্ট পরিধান করা কী দারুণ ব্যাপার না? টাইট, তবে খুব বেশি টাইট নয়। লরা আর আমি হাসলাম। ছেলেটা আমাদের মৃদু ভর্ৎসনা করে বলল, হাসবেন না, এটা সিরিয়াস বিষয়। মনে হলো তার চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, রঙ ধূসর, যেন বৃষ্টিতে ভেজা সিমেন্ট। লরা দু হাত দিয়ে তার পুরুষাঙ্গটি ধরে ঝেঁকে ঝেঁকে টানতে লাগল। নিজেকে বলতে শুনলাম, স্টিমটা কি বন্ধ করে দেওয়া উচিত? কিন্তু আমার কণ্ঠস্বরটা দুর্বল ও দূরাগত শোনাল। তোমাদের ম্যানেজার ব্যাটা কোথায় ঘুমায়? লরা বলল। ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকাল। আপনি আমাকে এক ধরনের আঘাত দিচ্ছেন। ফিসফিস করে বলল সে। এক হাত দিয়ে আমি লরার গোড়ালি ধরলাম, আর এক হাত দিয়ে চোখের ওপর জমে থাকা ঘাম মুছলাম। উঠে না বসা অবধি ছেলেটা সোজা হয়ে রইল সংযত ভঙ্গিমায় যাতে তার সঙ্গী জেগে না যায়, অতঃপর লরাকে চুম্বন করল। তাদেরকে ভালোভাবে দেখার জন্য আমি মাথাটা একটুখানি নোয়ালাম : ছেলেটার পুরুষ্ট ঠোঁট চুষে যাচ্ছে। ঠোঁট বন্ধ। ওই অবস্থায় মুখে কদাচ হাসি ফোটানো যায়। বাঁকা চোখে তাকালাম আমি। লরাকে আমি কখনো এমন প্রশান্তির হাসি হাসতে দেখিনি। হঠাৎ বাষ্প তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করল যে, সে একেবারে আড়াল হয়ে পড়ল। আমি এক ধরনের বিচ্ছিন্ন আতঙ্কের ভেতর পড়ে গেলাম। ভয় হলো ওই বাষ্প লরাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। তাদের ঠোঁট বিযুক্ত হলে ছেলেটা বলল, বুড়ো লোকটা কোথায় শোয় তা সে জানে না। সে একটা হাত তার কাঁধে রেখে ফালা ফালা হয়ে যাওয়ার ভঙ্গি করল। তখন সে লরার কাঁধে ডলাইমলাই করতে করতে তাকে আরও কাছে টানল। লরার শরীর তখন আলগা হয়ে গেছে, ওই অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিল। তার চোখ দেয়ালের দিকে। মাথাটা আগানো। স্তনযুগল চরে বেড়াচ্ছে ছেলেটার বুকে, ধীরে ধীরে কাছে টানছে ওকে। বাষ্প থেকে থেকে ওদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, অদৃশ্য করে তুলছে তাদেরকে, ঢেকে রাখছে অথবা নিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের দেশে। শেষ পর্যন্ত তাদের দিকে তাকান অসম্ভব হয়ে পড়ল। একটা ছায়ার ওপর আর একটা ছায়া। তারপর আর কিছু নেই। মনে হলো বাথ চেম্বারটা বিস্ফারিত হবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিছুই বদলাল না। অন্যদিকে আমার ভেতর এই অনুভব এলো, বাষ্প ক্রমান্বয়ে আরও বেশি ঘন হয়ে উঠছে। হাত বাড়িয়ে লরার পশ্চাৎ স্পর্শ করলাম। একটা তোরণ। মনে হলো একটা শরীরের ওপর আর একটা শরীর। 

উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের দিকে দু’পা এগিয়ে গেলাম। শুনলাম লরা আমাকে ডাকছে। বললাম, কী চাও। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। আবার গেলাম, আগের চেয়ে কম সতর্কতার সঙ্গে। নিচু হলাম, ওই জায়গাটাতে নিজের পথ খুঁজে পেলাম, ভাবলাম এখানেই আছে ওরা। গরম টাইলসই কেবল স্পর্শ করলাম। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি অথবা পাগল হয়ে যাচ্ছি। হাতে একটা কামড় বসালাম, কিন্তু চিৎকার করতে পারলাম না। গোঙাতে গোঙাতে ডাকলাম-লরা, লরা। পাশেই ছেলেটার  কণ্ঠস্বর দূরাগত বজ্রপাতের শব্দ বলে মনে হলো : ছেলেটার মতে বাষ্পের সঙ্গে ঘাম মিশলে পরিষ্কার একটা স্বাদ তৈরি হয়। আবার উঠে দাঁড়ালাম, এই বার অন্ধের মতো লাথি মারার জন্য প্রস্তুত, তবে নিজেকে পরীক্ষা করে নিতে চাইলাম। লরা বাষ্পের নির্গমন বন্ধ করে দিল। বেঞ্চিটা খুঁজে পেলাম। বৃদ্ধের নাক ডাকার শব্দ কানের ওপর আছড়ে পড়ল। এখনো বেঁচে আছে লোকটা। স্টিম বন্ধ করে দিলাম। প্রথমে কিছুই ঘটল না। ছায়ামূর্তিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই কেউ একজন স্টিম চেম্বারের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। অপেক্ষা করলাম। অন্য কক্ষে যেই থাকুক না কেন একটু একটু শব্দ করছে। আমি ধীরে ধীরে লরাকে ডাকলাম। কেউ কোনো সাড়া দিল না। শেষে বৃদ্ধ লোকটাকে চোখে পড়ল-তখনো ঘুমাচ্ছে। মেঝেতে একজন পড়ে আছে মারাত্মক অবস্থায় আর একজন লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। আমি ওদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে এলাম। ডিভান আছে যে ঘরটাতে, সেখানে কাপড়চোপড় পড়ে ফিটফাট হয়ে বসে আছে লরা। কোনো কথা না বলে আমার কাপড়চোপড়গুলো ছুড়ে মারল। কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম। লরা বলল, চল যাই। 

ওই তিনজনকে আমরা আরো বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম, একবার ওই একই বাথে অন্যবার আজকাপোট-জালকোতে, লরার ভাষায় নরকের স্টিমবাথে; ব্যাপারগুলো কখনোই একরকম ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওদের সঙ্গে ধূমপান করেছিলাম, তারপর বিদায়। দীর্ঘদিন ওসব জায়গায় আমাদের যাতায়াত ছিল। যৌন সঙ্গম আমরা অন্যত্রও করতে পারতাম, তবে গণস্নানাগারগুলোর আকর্ষণ চুম্বকের মতো। অন্য ঘটনাবলিরও কমতি ছিল না অবশ্যই : ঢোকার মুখে মরিয়া কিছু লোক ধুরদার দৌঁড়েছিল, একটা ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছিল, ভাগ্যগুণে আমরা একটা আকস্মিক হামলা এড়াতে সক্ষম হই, সেটা লরার চাতুরির কারণেই সম্ভব হয়েছিল হয়তো; কিংবা স্নানকারীদের সংহতির কারণেও হতে পারে। এই সব জায়গার একটা সারসংক্ষেপ দাঁড় করালে দেখা যাবে, এটা একটা সংযোগ যা কিনা লরার হাসি হাসি মুখের সঙ্গে একটা বিভ্রান্তি তৈরি করে। আমাদের মধ্যেকার ভালোবাসার অনিবার্যতার বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন ছিলাম আমরা। সবচেয়ে উত্তম ব্যাপারটা ছিল, আমরা মন্টেজুমাস জিমেই ওটা প্রথম করি, বারবার আমরা যেখানে গেছি। সবচেয়ে বাজে জায়গাটা কাসাস আলিমান, সাধারণত ফ্লাইং ডাচম্যান বলে অভিহিত করা হতো তাকে, যেটাকে কিনা একটা লাশকাটা ঘরের মতো লাগত। ওটা ছিল একই সঙ্গে তিন লাশকাটা ঘর-স্বাস্থ্যের, সর্বহারাদের আর  মানবদেহের-কোনোভাবেই ইচ্ছে বা কামনা বাসনায় নয়।  

অতীতের দুটো স্মৃতি এখনো আমার হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে আছে। এক : লরার কিছু নগ্ন ছবির উত্তরাধিকার (সমুদ্র সৈকতে আমার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ, শাওয়ারের নিচে, ডিভানে শায়িত, চিন্তামগ্ন), স্টিম থেকে উৎসারিত জলধারা তাকে সম্পূর্ণ ঢেকে না ফেলা অবধি। তারপর কিছু ছবি-যেখানে কিছুই দেখা  যাচ্ছে না। আর দুই : মন্টেজুমাস জিমের প্রাচীর চিত্র। মন্টেজুমার চোখ-অগাধ,  অতল। সুইমিং পুলের উপরি ভাগে ভাসমান মন্টেজুমার কাঁধ। রাজসভাষদগণ (হয়তো তারা আদৌ রাজসভাষদ নন) হাসছেন আর কথাবার্তা বলছেন, সম্রাট যা দেখছেন তা উপেক্ষা করবার চেষ্টা করছেন। পশ্চাৎপটে মেঘ আর পাখি মিলেমিশে একাকার। পুলের পাথরের বড় রঙ নিঃসন্দেহে বিষণ্ন একটা রঙ—ওই জায়গাগুলোতে আমাদের অভিযানের সময় লক্ষ্য করেছি; তাকে কেবল কিছু চেহারার রঙের সঙ্গেই তুলনা করা যায় : করিডোরের শ্রমিক, যাদের কথা এখন আর মনে নেই, তবে অবশ্যই তারা ওখানে ছিল। 

menu
menu