এবং কথা
শীতটা আসি আসি করছে…। এমন সময়টা খুব ভালো লাগে। আসলে আমি গরম সহ্য করতে পারি না। অথচ দেশের সবচেয়ে গরম শহরটাতে আমার বাস। বৈপরীত্য চারপাশেই। কীভাবে যেন শিখে গিয়েছিলাম মেনে নেওয়াই জীবন। ঘণ্টাকয়েক আগে যেমন মেনে নিলাম মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্টাকে। এই বড়ো সত্যটার সঙ্গে বাকি সময়টুকু ভালোই ভালোই কাটিয়ে দিতে পারলে হয়তো একটা মেনে নেওয়ার গল্প ফুরোবে…
রাতে ঘরের মধ্যে কেমন যেন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছিল। বাইরে বেরিয়ে এলাম। রিকশা নিয়ে সোজা নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ের প্রিয় জায়গা বটতলায় গিয়ে বসলাম। প্রথম সিঁড়িটায়। এই সিঁড়িটা অনেক দূর অবধি নেমে গেছে। পানি কম থাকায় অনেকগুলো ধাপ দেখা যাচ্ছে। দূরে ওপারে সারি সারি আলো জ্বলছে। অন্ধকারের মধ্যে পানির ভেতর আলোর সার জীবনের গল্প এঁকে চলছে যেন। স্বপ্নের মতো লাগছে। একটা কেমন সোঁ সোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। অনেকটা গুমরানোর মতো আবার একটু রাগী রাগী ভাবও মিশে আছে ওর মধ্যে। বাতাসে একটু উষ্ণতার আভাস। আবার শীতলতাও আছে। দু-চারফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। ঘন আর নিবিড় অন্ধকার আকাশের বুক চিরে চঞ্চলা বিজলি মেয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। চারপাশটা যেন ঘোরলাগা। মোহগ্রস্ত আমি এই রাত্রিটাকে বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রাখতে ব্যাকুল হয়ে উঠছি যেন। মনে হচ্ছে এক্ষুণি সব ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু আমাকে ধরে রাখতে হবে। এই ভালোলাগার মূল্য আমি জানি। সবটা অদ্ভুত লাগছে। আমার ক্রমশ শূন্যতাবোধে অবসন্ন হৃদয়ের আকুলতা, এক পৃথিবীসমান অস্থিরতা, বিষাদ-খিন্ন-দীর্ণ অনুভব আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমি এই রাত্রির সবটুকু কোমল নির্যাস আকণ্ঠ পান করে তৃপ্ত হতে চাই। কী গভীর তৃষ্ণা!
মনে হচ্ছে সেই অনাদি কাল থেকে আমি এখানে বসে আছি। আমার শেকড় নদীর তলদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। কী এক নিবিড় আচ্ছন্নতা আমাকে পেয়ে বসেছে! খুব ভালো লাগছে। কতদিন পর এমন লাগছে? গুনে দেখার চেষ্টা করলাম। না… অনেকদিন এভাবে নিজের সঙ্গে বসা হয়নি, অঅঅননননেকদিন! কয়েক ধাপ নিচে নেমে গিয়ে পানির কাছাকাছি বসলাম। আমার পা জোড়া পানিতে। হালকা স্রোতের মৃদু স্পর্শ পা বেয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। কোথায় যেন কিছু একটা ঘটে গেল। কেমন করে সবকিছু অন্যরকম হয়ে উঠল। উপরের অন্ধকার একটু একটু করে সরতে শুরু করেছে। আমি চোখ বন্ধ করলাম।
কে যেন আমার কানে কানে গুনগুনিয়ে গেল—এই সুন্দর, স্বচ্ছ, মৃদু, কোমল, মনোরম প্রকৃতি তোমার জন্য। তুমি আছো বলেই না সবটা এত সুন্দর। তুমি দেখবে বলেই আজকের এই আয়োজন। মন খারাপ করো না মেয়ে। দেখো তোমার জন্য নদীর বুকে কাঁপন জেগেছে যেমন তোমার বুকের জমিনে কাঁপছে একটা আস্ত আকাশ। সত্যিই তো! আমি এই সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন অসীম মুগ্ধতায় হারিয়ে যেতে বসেছি। মনে হচ্ছে, এটা কোনো নদী নয়, আমি সাগরের তীরে বসে ঢেউ গুনছি। অজস্র হাসি, কোলাহল আর আলোকরাশি আমার চারপাশে। মেডিক্যাল, টেস্ট, রিপোর্ট—এসবের কোনো সংযোগ আমার সঙ্গে নেই। সব স্বাভাবিক। আমি ঠিক আছি। আমার সমুদ্রবিলাস ঠিক আছে। আমাকে চিরকালীন অভাবিত মাদকতায় আচ্ছন্ন করে রাখা সমুদ্র ঠিক আছে। তার উন্মাতাল হাওয়ায় আমি ভেসে যাচ্ছি…
জীবন সত্যিই মনোরম! এই রাতের মতো মায়াময়। আসলে সমগ্র বিশ্বচরাচর তো এই মায়ায় আচ্ছন্ন। এই মায়ার ভেতর থেকে আমরা জেগে ওঠি, খেলাঘর সাজাই, দিনান্তে আরেক মায়ার জগতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নির্ভার হই। কী বিচিত্র সবটা! মেঘ কেটে গিয়েছে অনেকক্ষণ। কয়েকটা নক্ষত্র ইতিউতি উঁকি মারছে। কখন ও পাশে এসে বসেছে টের পাইনি। আলতো করে কাঁধে হাতটা রেখে বলল—'চলো, এবার ফিরি নইলে বাতাসে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।' ওর এই স্পর্শটুকু মনের অন্দরে আবেশ ছড়িয়ে দিল আর কথাগুলো অর্কেস্ট্রার মতো বাজতে থাকল আমার চারপাশে। আমি আবেগে ভেসে যাচ্ছি। আমার ভেতর আরেকটা দুকুলপ্লাবী পদ্মা বইছে। কে বলবে—এই আমি… না, ঠিক আছি।
ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলাম। কয়েকটা অল্পবয়সী ছেলে বসে আছে। ওরা বলছে দূরের ওই আলোটা গুচ্ছ গ্রামের। ওর ওপারে বড়ো একটা নদী আর তার ওপারে ভারত। ওদের কণ্ঠ ঝরনার মতো স্নিগ্ধ, উচ্ছল। জীবনরসে ভরপুর এই কিশোরদের কথাগুলো নদীর পাড়ের নিস্তব্ধতার মাঝে ঝমঝম করে কানে বাজছে। না, কথা নয় আসলে স্বর… ওদের স্বরের মধ্যে কিছু একটা আছে যা এই রাতের মতো মায়াময়। কিংবা আমার সকল ইন্দ্রিয় এভাবে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে…
সবকিছুই গভীর ভালোলাগায় ছেয়ে রয়েছে। ও হাত ধরে রেখেছে আমার। মমতামাখানো কণ্ঠে বলছে—'সাবধানে পা ফেলে এসো, ঘাসগুলো কেমন ভিজে আছে। পিছলে যেতে পারো।' আমি পরম নিশ্চিন্তে ওর হাত ধরে পা টিপে টিপে নদীর পাড় থেকে রাস্তায় উঠলাম। আর একটু একটু করে অনুভব করলাম—বুকের অলিন্দে ভালোবাসা, ভালোলাগা গুঞ্জন তুলেছে। পৃথিবীর প্রতি জমে থাকা অভিমানগুলো বাষ্প হয়ে উবে গেছে। আমি নির্ভার ঠিক জন্মের ক্ষণের মতো…
মন বিছিয়ে দিই হাতের দিকে—আমার দুহাতের মুঠোয় পুরা অনেকগুলো রংধনু আর কয়েকশত গৃহত্যাগী জোছনা, শস্যের ঘন কালচে সবুজ, শরতের মন কেমন করা বাতাস, বাতাবী লেবুর মৌ মৌ ঘ্রাণ। আমার চোখের তারায় লেগে আছে অলকানন্দার হলুদ। দূরের ওপারে পাখিরা গাইছে, কামিনী, বেলি, জুঁই, হাস্নাহেনারা সুবাস ছড়াচ্ছে। একটা জোনাকির সবুজাভ আলোয় আমি অনুভব করলাম এখনো বিকেলের নরম আলোয় গল্প আঁকতে পারি, সকালের সোনারোদ আমাকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তোলে, দুপুরে জানালার পাশে অবিশ্রান্ত ডেকে চলা পাখিটা আমাকে স্বপ্ন দেখায়—জীবনের স্বপ্ন। দুচোখে স্বপ্নের বীজ বুনে চলি অবিশ্রান্তভাবে আমি এক অতি সৌখিন চাষীর মতো। সেবার গ্রামে ভুঁইচাঁপাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বেশ লেগেছিল আর বাবুই পাখির ঝুলে থাকা ঘরটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছিলাম। আর চেয়েছিলাম একদিন আমিও…। কিছুতেই আঁশ মিটছিল না। ঝুড়িনামা বটগাছটা কেমন বোধিবৃক্ষের মতো মায়া আর ছায়া দুইই ছড়িয়ে চলেছে চারপাশে। আর ফুলে ফুলে বিপুল উৎসবে মেতে ওঠা জারুল গাছটা… দিঘির পারের চোখধাঁধানো কাঠগোলাপ গাছটা এমন হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়েছিল যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সুন্দর সব! আরও কত এমন সুন্দর দেখার বাকি রয়ে গেছে। না, আজ সেসব থাক। কেবল এটুকু অনুভব সঙ্গে থাকুক একজন্মে বহুজন্মের সাধ পেয়েছি... জীবনকে ভেঙেছি মনের আকাঙ্ক্ষায়। তাই আয়োজন প্রায় শেষ। ভেতর থেকে আমূল এলোমেলো আমি কেমন গুছিয়ে নিলাম নিজেকে মাত্র কয়েকঘণ্টায়! নাকি গুছানোর নামে আরও ছড়িয়ে দিলাম…
একসময় কেবল শৈশব ছাড়িয়েছি… খুব করে হারিয়ে যেতে সাধ জেগেছিল। সবাই আকুল হয়ে আমাকে খুঁজছে—এটা ভাবতে যা মজা লাগত! আজ যদি সেদিনটা চলে আসে, যদি চলে যেতে হয়, যদি জীবনের গল্পটা এখানেই থেমে যায়—কোনো আপসোস নেই। জানি, এই পৃথিবী থেকে আমার গল্পেরা কোনোদিন একেবারে হারাবে না। কোথাও না কোথাও রয়ে যাবে, কোনো মনের অন্দরে অতি সঙ্গোপনে আমি থাকব, ইথারে ভেসে বেড়াবে আমার ইচ্ছেরা, স্বপ্নেরা, ভালোলাগারা আর অপূর্ণ সাধগুলো। ওরা হয়তো একা একা জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা বলবে। আর আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো এত এত ভালোবাসা, এত এত সুন্দরের ছোঁয়া, দুচোখে আমার ভালোলাগার কাজলপরা, এই রাত্রি, এই অপার্থিব মুহূর্ত, এই মেঘলা আকাশ, ওই দূরের আলো, নদীর বুকে পানির মাতামাতি, প্রিয়সান্নিধ্য—
‘আমার মতন সুখী কে আছে।’
নূর সালমা জুলি প্রাবন্ধিক এবং গল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থ : কথাশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ, যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের । তিনি রাজশাহীতে থাকেন।