কানাকড়ির মূল্য

সকালে অনিকার গলার ঝনঝনানি শুনে ঘুম ভাঙল দীপনের। অনিকা দীপনের মাকে বকা দিচ্ছে। দীপনের মা ঈশানী পারকিনসন্সের রোগী। হাঁটাচলা করতে পারেন না। ভোর ছ’টায় তাকে ঘুম থেকে তুলে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিতে হয়। সেখানে বসে তিনি টেলিভিশনে সকালের খবর শোনেন।
কী এমন মহামূল্যবান জিনিস যে ওটার জন্য বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি শুরু করেছেন। একটা কাজের জিনিস হয় তবু একটা কথা ছিল। একটা অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা ছাড়া তো কিছু না।
দীপন ঠিক বুঝে উঠতে পারল না সকালে এমন কী ঘটনা ঘটল আর তাই নিয়ে এমন তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার মেজাজটা আরও একটু খারাপ হলো। সবে সাতটা বাজে। তার ঘুম থেকে ওঠার অ্যালার্ম বাজবে আরও এক ঘণ্টা পরে। এখন অনিকার অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার সময়। বেরনোর মুখে কিছু একটা অনাসৃষ্টি ঘটেছে। মুড ভালো থাকলে বেরনোর সময় ঘুমন্ত দীপনের মুখে সন্তর্পণে চুমু দিয়ে বিদায় নেয়। মাঝেমধ্যে দীপন সেটা বুঝতে পারে। কোন কোন দিন একটু জড়িয়ে ধরে। তখন অনিকার সময়ের খুব তাড়া। বলে, এখন ছাড়ো, সোনা! একদম সময় নেই। একটু দেরি করলে ওদিকে খচ্চর বসটার ঝাড়ি শুনতে হবে। অথবা অনুযোগ করে বলে, ‘সব সময় শুধু এক ধান্দা। এখন কোন ধান্দাবাজি চলবে না। ‘এইসব ভাবনার ভেতরে আবার অনিকার গলা শোনা গেল।
তুই বা কেন ওটাতে হাত দিতে গেছিস? সকালে উঠে আর কোনো কাজ পাসনি?
আমার কী দোষ। আমাকে পরিষ্কার করে দিতে বলল তাই সাবান দিয়ে ধুচ্ছিলাম। হাত পিছলে নিচে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে খানখান হয়ে গেল। এবার ফুলমনির গলা শোনা গেল। সে বছর পাঁচেক হলো এ বাড়িতে আছে। দীপনের মা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর সার্বক্ষণিক একজন মানুষ তাকে দেখাশোনা করার জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল। তখন অনেক খোঁজাখুঁজি করে বারো-চৌদ্দ বছরের কিশোরী ফুলমনিকে পাওয়া গিয়েছিল। তখন তার হাতে থেকে পড়ে হরহামেশা বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙত। এখন বয়সে, মাথায়, সবদিক দিয়েই বেশ বেড়েছে। ভাঙাভাঙিটা সেই অনুপাতে কমেছে। তবে আজ ঠিক কী জিনিসটা ভেঙেছে তা দীপনের কাছে বোধগম্য হলো না। একবার ইচ্ছে হলো ওঘরে গিয়ে দেখতে, কী ভেঙেছে আর মায়ের ওপর এমন আক্রমণ হচ্ছে কেন? পরক্ষণেই ইচ্ছেটার গলা টিপে ধরে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে দীপন।
ভেঙে গেছে বেশ হয়েছে! এখন হাত-পা কাটার আগে ভালো করে ঝাড়ু দিয়ে তুলে ফেলে দিয়ে আয়।
না, না ফেলে দিস না। একটা ব্যাগে পুরে আমাকে দে। আমি তুলে রাখব। এত দিনের একটা পুরোনো স্মৃতি…। দীপনের মায়ের কথা শেষ হলো না। অনিকা আবার ঝাঁঝিয়ে উঠল, ওটা নিয়ে আপনার অনেক আদিখ্যেতা দেখেছি। এখন এই ভাঙা জিনিসটা সিন্দুকে তুলে রাখার তো কিছু নেই!
ধাম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। শব্দের মাত্রা শুনে বোঝা গেল অনিকার রাগটা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বেশ একটা নীরবতা নেমে এলো। মাঝেমধ্যে ফুলমনির বাসন মাজার ঘটর-মটর টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। আজকে যে অফিসে বেরনোর সময় অনিকা কোনো ভালোবাসা জানাতে আসবে না সেটা দীপন আগেই বুঝেছিল। ভালো সময় আর রাগের সময় অনিকা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ। হয়তো সবারই এমনটা হয়, কিছুটা কম আর বেশি। তবে কেউ কেউ বুকের গভীরে রাগ পুষে রাখতে পারে। পোষা প্রাণীর মতো সে রাগ বেয়াড়া হয়ে ওঠে না। মন যখন যেমন করে প্রকাশ করতে চায় সেই ভাবে তা প্রকাশ পায়। দীপনের রাগ বড্ড অবাধ্য আর বেয়াড়া ধরনের। সেকথা অফিসে আর বন্ধু-বান্ধব মহলে সবাই জানে। শুধু বাড়ির ভেতরে ওই বেয়াড়া রাগটাকে গলা টিপে বাগে রাখতে হয়। ঘরে যার মা অসুস্থ, পঙ্গু, তার রাগ করার কোনো অধিকার নেই। মায়ের জন্য সবার অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে থাকতে হয়। এমনকি ফুলমনিকেও চড়া গলায় কোনো কথা বলতে পারে না। তার প্রতিক্রিয়া হয় মায়ের ওপর। এই শিক্ষাটা সে পেয়েছে ছোটবেলায় গরুর রাখাল হারুর কাছ থেকে। হারুকে বাড়িতে কেউ বকা দিলে তার প্রতিক্রিয়া হতো গরুর ওপর। মাঠে গিয়ে হারুর সব রাগ ক্ষোভ গরুকে পিটিয়ে উসুল করে নিত। এখন মাঝেমধ্যে ভুল করে অনিকা কিংবা ফুলমনিকে চড়া গলায় কিছু বলে ফেললে মা মুখ তুলে দীপনের দিকে তাকায়। মায়ের চোখে তখন কোন রাগ ক্ষোভ অভিযোগ অনুযোগ খুঁজে পাওয়া যায় না। দীপনের চোখে ছোটবেলায় দেখা সেই ধবলা গাভীটির করুণ চোখ ভেসে ওঠে।
আটটায় অ্যালার্ম বাজলে দীপন আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে ওঠে। প্রতিদিনের মতো মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্যান্য দিন মা অপেক্ষা করে টয়লেটে যাওয়ার। দীপন হুইল চেয়ার ঠেলে টয়লেটে নিয়ে যায়। হুইল চেয়ার থেকে তুলে কমোটে বসায়। আজ তার ঘরে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ফুলমনির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে।
দেখ দীপু, ওই ফুলিটা আমার কতবড় সব্বনাশটা করল।
সব্বনাশের আবার কী হলো? কী করেছে ফুলমনি?
আমার এতদিনের আয়নাটা আজ ওই ফুলি ভেঙে ফেলল।
ফুলি জবাবদিহি করার ভঙ্গিতে বলল, আমি কি ইচ্ছা করে ভেঙেছি? হঠাৎ হাত পিছলে পড়ে গেল। তো আমি কী করব?
তুই আরও সাবধানে কাজ করবি। তোর হাত থেকে এত জিনিস পড়ে কেন?
এরপর দীপনের মা শুরু করল তার স্মৃতিকথা। জানিস তো দীপু, এই আয়নাটা কিনে দিয়েছিল তোর বড় মামা। বুধপাড়ার মেলা থেকে। বুধপাড়া হলো কাঁসা পিতলের জিনিসের জন্য বিখ্যাত। সেই মেলায় মানুষ যায় পিতলের ঘড়া, কলস আর কাঁসার থালা-বাসন কিনতে। তোর মামাতো এই আয়না দেখে মহাখুশি। বলে, আয় ঈশানী, তোর জন্য একটা আয়না কিনি। আমিও খুব খুশি। গোল, ছোট্ট ওই আয়নাটার সঙ্গে পিতলের একটা হাতল লাগানো। একেবারে রূপকথার বইয়ে যেমন রাজকন্যাদের হাতে আয়না থাকে তেমন আয়না। আমাদের বাড়িতে তো তখন ড্রেসিং টেবিল ছিল না। টিনের ফ্রেমে বানানো চৌকোনা আয়না ছিল বাড়িতে। সে আয়না আবার আমাদের মতো ছোটদের ধরতে দিত না। সেই সময়ে আমি একটা আয়নার মালিক হয়ে গেলাম। স্কুলে নিয়ে গিয়ে সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলাম। আয়নার মালিক হয়ে আমারও কদর বেড়ে গেলে। অনেকেই বাড়ি থেকে নাড়ু, মোয়া, ছাঁচ, বাতাসা নিয়ে এনে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে খাওয়ায় আয়নায় একটু মুখ দেখবে বলে।
দীপন তার মায়ের মুখে এই গল্প অসংখ্যবার শুনেছে। যখন তার মুখে বোল ফোটেনি সেই সময় থেকে মা তাকে এই গল্প শুনিয়েছে। মুখের সামনে আয়না ধরলে দীপন খিলখিল করে হেসে উঠত। গল্পের এই অংশটুকু যখন সে বলে তখন তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দীপনের চোখে তার মায়ের কিশোরী বেলার মুখোচ্ছবি ভেসে ওঠে। এরপরেই গল্পের বিয়োগাত্মক পর্বটি শুরু হয়। একটা ছোট্ট বিরতি দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাহাকার করে ওঠে। বলে, হায়, হায়, হায়। আমার সবকিছু শেষ করে দিল ওই এক শকুনে। কোথা থেকে এক শকুন এসে বসল চালে আর তার দু’দিন পরেই তোর মামা হারিয়ে গেল। তাকে আর কোথাও খুঁজেই পাওয়া গেল না। আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। তখন কেবলমাত্র আমার বিয়ে হয়েছে। ভাইয়ের স্মৃতি বলতে ওই আয়নাটাই তো ছিল। আয়না দিয়ে কিছুই দেখা যেত না তবু ওটা হাতে নিলে পুরোনো সব কথা মনে পড়ে যেতো। আজ সেটাও শেষ হয়ে গেল। কথাগুলো বলতে বলতে ঈশানী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, শকুনটা আর কোথাও মরার জায়গা পেল না।
তোমাকে এর আগেও অনেকবার বলেছি, ওসব শকুন-টকুন কিছু না। তোমাদের জমি-জায়গার ওপর কিছু মানুষের নজর পড়েছিল।
দীপনের কথা শেষ করতে পারল না। ফুলমনি বলল, ওকথা বলবেন না। শকুনের দৃষ্টি পড়লে ওরকম অঘটন ঘটে। আমাদের পাড়াতেও শকুনের দৃষ্টি পড়েছিল। তারপর রাতের বেলা ডাকাতরা এসে পাড়ায় আগুন দিল। টুকু আর পানুকে ধরে নিয়ে গেল।
দীপন বলল, তুই শকুন দেখেছিস? কীভাবে দৃষ্টি দিল তোদের পাড়ায়?
আমি দেখিনি তবে শুনেছি।
থাক, শোনা কথা নিয়ে আর বাহাদুরি করতে হবে না। একটু মন দিয়ে সাবধানে কাজ করলে তো আর জিনিসপত্র ভাঙে না।
ফুলমনি কান্না জড়ানো গলায় বলল, আমি তো সব সময় সাবধানেই কাজ করি। তবু কীভাবে যেন ভেঙে যায়!
ফুলমনির অনুশোচনাটা দীপনকে খুব স্পর্শ করল। শুধু স্পর্শই করল না, হঠাৎ মনে পড়ল মাসতিনেক আগে এমন অফিসে বেরনোর সময় একটা শো-পিচ শোকেসে রাখতে গিয়ে সে নিজেও অনিকার পুতুলটাকে ভেঙে ফেলেছিল। হয়তো অফিসে বেরনোর একটা তাড়া ছিল। তবু দীপন বেশ সাবধান ছিল যাতে কোনকিছু পড়ে না যায়। হঠাৎ পুতুলটা শুধু পড়েই গেল না, ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গেল। দীপন বিষয়টা অনিকাকে না জানালেও পারত। তবে অফিস থেকে ফিরে সে নিজের থেকে জানিয়েছিল। সে জানত এই পুতুলটার সঙ্গে অনিকার একটা বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে আছে কিন্তু পরিস্থিতি যে এতটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছাবে তা সে বুঝতে পারেনি। প্রথমেই অভিযোগ করা হলো, ‘তুমি ইচ্ছা করে আমার পুতুলটাকে ভেঙেছ। আমি আগে থেকেই জানতাম তুমি ওই পুতুলটাকে কতটা হিংসা কর। সেজন্যই তো আমি ওটাকে বেডরুম থেকে ড্রয়িং রুমের শোকেসে তুলে রেখেছি।’ পুতুল ভাঙার শাস্তি হিসেবে এই অভিযোগটুকুই হয়তো দীপনের জন্য লঘুপাপে গুরুদণ্ড তুল্য ব্যাপার ছিল। তবে অনিকা ওইটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়নি। প্রতিশোধ হিসাবে দীপনের দুটো প্রয়োজনীয় জিনিস ভাঙতে হয়েছে, মোবাইল ফোন ও টেলিভিশনের রিমোট।
ছোটবেলায় অনিকা তার ছেলে-পুতুলের বিয়ে দিয়েছিল কনিকা নামে তার এক বান্ধবীর মেয়ে-পুতুলের সঙ্গে। তারপর পুতুল খেলার শৈশব পেরিয়ে কৈশোর কিংবা যৌবনে এসে হয়তো পুতুলের কথা ভুলেই গিয়েছিল। এরমাঝে তার ছেলে পুতুলটাও হারিয়ে গেছে। তবে বিয়ের পর বাবার বাড়ির শাড়ি গহনার সঙ্গে কনিকার মেয়ে পুতুলটিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল শোকেসে রাখার জন্য। তখন সেটা ছিল একটা ছোটবেলার স্মৃতিচিহ্ন। তবে সেই পুতুলটি বিশেষ মূল্য লাভ করে যখন কনিকা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার হঠাৎ আবিষ্কার করে কনিকার ক্যান্সার, ফোর্থ স্টেজ। বড়জোর আর ছ’মাসের আয়ু। খবর পেয়ে অনিকা ছুটে গিয়েছিল কনিকার বাড়ি। কনিকা যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল অনিকা তখন অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়েছে। কনিকার তখন এক বছরের একটি মেয়ে। অনিকা বান্ধবীর সেবাযত্ন করেছে, পরম স্নেহে কনিকার মেয়ে মাম্পিকে দেখাশোনা করেছে। অনিকার তখন বিয়ের বয়স পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। নিজের কোন বাচ্চা নেই। ডাক্তাররাও বাচ্চা হবে বলে কোন আশার আলো দেখাতে পারেনি। কনিকা হাসপাতালের বেডে শুয়ে অনিকার আশার সলতেতে একটু আলো জ্বালিয়েছিল। একদিন অনিকা আর দীপন হাসপাতালে গিয়ে দেখে মাম্পি খুব কান্নাকাটি করছে। কনিকার স্বামী চঞ্চল কোনভাবে তাকে শান্ত করতে পারছে না। অনিকা গিয়ে কোল তুলে নিতেই সব কান্নাকাটি ভালো হয়ে গেল। কনিকার তখন প্রায় শেষ সময়। অনিকা আর দীপনের কাছে আকুতি জানিয়েছিল, আমার মাম্পিকে তোদের নিজের মেয়ে মনে করে মানুষ করিস। মাম্পিকে তোদের কাছে রেখে আমি একটু শান্তিতে মরতে চাই। চঞ্চলও সেদিন সম্মতি জানিয়েছিল কনিকার কথায়। যদিও কনিকার মৃত্যুর পরে চঞ্চল সেকথা রাখেনি। অনিকার বুকে আশার সলতেটা দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গিয়েছিল। সলতের সেই পোড়া ক্ষতটা বুকে নিয়ে তখন অনিকা আঁকড়ে ধরেছিল সেই পুতুলটাকে। অযত্নে রেখে দেয়া সেই পতুলটিই হয়ে উঠল মাম্পি সোনামনি। আদর যত্ন ভালোবাসা দিয়ে তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হলো। নতুন জামা-কাপড় পরানো হলো। বেশ কিছুদিন সেটার জায়গা হলো বিছানায়। মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুমায়, কথা বলে, গল্প শোনায়। পরিস্থিতি বেশ জটিল হতে থাকল। কোনো কোনো সময় পুতুল কোলে নিয়ে অনিকা কান্নাকটি করতে থাকল। মেয়েকে নিয়ে অবান্তব সব কথাবার্তা বলা শুরু করল। দীপন বেশ ভয় পেয়ে ওর বন্ধু ডাক্তার পলাশের সঙ্গে কথা বলল। পলাশ সবকিছু শুনে বলল, পরিস্থিতি তো আসলেই জটিল। খুবই সেনসেটিভ ইস্যু। অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের কেস মনে হচ্ছে। ভালো একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখাতে পারিস। খুব টেকনিকেলি হ্যান্ডেল করতে হবে। টার্গেট করতে হবে অবসেসড আইটেম হিসেবে ওই পুতুলটাকে অনিকার কাছ থেকে সরিয়ে ফেলার। তবে কোনো রকম মানসিক আঘাত যাতে না-পায় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
দীপনের নিজেরও একটা আবেগ ছিল মাম্পি সোনার প্রতি। সে মাঝেমধ্যে পুতুলটাকে দেখিয় বলত, তোমার মেয়েতো বেশ দ্রুত বড় হয়ে উঠছে। অনিকা সংশোধন করে দিয়ে বলেছিল, ‘তোমার মেয়ে বলবে না।’ বলবে আমাদের মেয়ে। দীপন একদিন বলল, আমাদের মেয়েটা কিন্তু যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। ওর আলাদা রুমে ঘুমানোর অভ্যাস করা উচিত। অনিকা কথাটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বলেছে, ও আমার সঙ্গেই ঘুমাবে। তোমার অসুবিধা হলে অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমাও। একদিন রাতে বেশ অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দীপন নিজেকে গুটিয়ে নিল। অনিকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হলো? এমন করছ কেন?
দেখ না, আমাদের মেয়েটা কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
একটু অপেক্ষা করো। ওকে ঘুম পাড়িয়ে দেই।
কয়েকদিন পরে একদিন দীপন অফিস থেকে ফেরার পর অনিকা কাছে আসতেই বলল, একদম কাছে আসবে না। এখন কিন্তু ঘরে আমরা শুধু দুজন নই। মেয়ে আছে ঘরে।
এভাবে বাধা পেয়ে অনিকার বেশ মন খারাপ হয়েছিল। সেই সঙ্গে একটা চিন্তার কালো মেঘ তার মনে জমাট বাঁধতে শুরু করল। দীপন কি পুতুলটাকে নিয়ে কোনো মানসিক অসুস্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? অনিকার এমন চিন্তার পেছনে আরেকটি কারণ সে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে। সে জানে এসব ক্ষেত্রে কী করতে হয়। পরদিন দীপন অফিস থেকে ফেরার আগেই অনিকা পুতুলটাকে সরিয়ে শোকেসের ভেতরে রেখে দিয়েছিল। বিষয়টা দীপনের নজরে এসেছিল কিন্তু কিছু বলেনি। বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পর দীপন একদিন মাম্পির প্রসঙ্গটা তুলেছিল। অনিকা বেশ কায়দা করে অল্পকথায় এড়িয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, তুমি ওই পুতুলটার কথা বলছ তো! ওটাকে শোকেসে তুলে রেখেছি।
সেদিন ফুলমনির কথায় দীপনের মনে পড়ল, সাবধান হলেই সব বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। কিছু মানুষের বিপদ পোষা বেড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে। দীপন সেই ভাঙা পুতুলের টুকরোগুলো প্রীতমকে দিয়েছিল। প্রীতম দীপনের বন্ধু, আর্ট কলেজ থেকে পাস করে ইকিগাই নামে একটা প্রতিষ্ঠান চালায়। সেখান থেকে নানান রকম শিল্পকর্ম বিদেশে রপ্তানি করে। দীপন বলেছিল তার পুতুলের টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে আগের মতো করে দিতে। ছোট্ট একটা হাতের কাজ। অথচ সাত দিন পেরিয়ে গেল। প্রীতমের কোন খবর নেই। বাড়িতে অনিকার রাগ কমে এলে পুতুলের ভাঙা টুকরোগুলো খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে। মোবাইল ফোনের টুকরো, রিমোটের টুকরো সব আছে। নেই শুধু পুতুলের টুকরোগুলো। অনিকার ধরণা ফুলমনি ওগুলো ফেলে দিয়েছে। তাই সংসারে বেশ কয়েকদিন অশান্তি চলল। দীপন কিছুই বলতে পারে না। প্রীতমকে বারকয়েক ফোন দিয়েছে। কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। একদিন বলল, যে কর্মচারীকে সে কাজটা দিয়েছিল সে ছুটিতে গেছে। আবার একদিন বলল, ‘কাজটা হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না। পরে তোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ নানান তালবাহনার পর একদিন প্রীতম দীপনের অফিসে এসে হাজির। পুতুলটা ফেরত দিয়ে বলল, খুব খুশির একটা খবর আছে। তোর ওই পুতুলের ডিজাইনটা জাপানের একটা কোম্পানিকে পাঠিয়েছিলাম। ওরা একটা বড় অঙ্কের অর্ডার দিয়েছে। তোর ওই পুতুলের ডিজাইনের ভেতর একটা অ্যান্টিক ব্যাপার আছে। দীপন শুনে বলেছিল, তাহলে তো সেলিব্রেট করতে হয়। প্রীতম বলল, সে আমি প্রিপারেশন নিয়েই এসেছি। চল, আজ অফিস ছুটির পর শাকুরাতে বসি। কতদিন একসঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করা হয় না।
সেদিন সে পুতুলটাকে নিয়ে অফিসের ড্রয়ারে ফেলে রেখেছিল। বাড়িতে এনে অনিকাকে আর দেয়া হয়নি। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ইচ্ছা করেনি। সেদিন মায়ের আয়না ভাঙার প্রতিক্রিয়া দেখে দীপনের মনে হলো স্মৃতির এই প্রতীকগুলোর একটা আলাদা মূল্য আছে। সেটা যার স্মৃতি সে ছাড়া অন্য কারও পক্ষে মূল্যায়ন করা সম্ভব না। সেইসব সাত-পাঁচ ভেবে অফিসের ড্রয়ার থেকে পুতুলটা এনে অনিকাকে একটা সারপ্রাইজ দিয়েছিল। অনিকা বাকরুদ্ধ হয়ে পুতুলের সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দেখে বলল, দেখেছ, কোথাও একটু জোড়ার দাগ পর্যন্ত নেই। একদম নতুনের মতো। তারপর মাম্পি সোনা বলে বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, প্রীতমকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও। দীপন প্রীতমের খুশির খবরটা অনিকাকে বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। এমন হাজার হাজার পুতুল তৈরি করে প্রীতম ব্যবসা করবে সেই খবরটা অন্যদের জন্য আনন্দের হলেও অনিকার জন্য সেটা নাও হতে পারে। দীপন বলল, প্রীতম এমনিতেই মহাখুশি। তোমার জন্য সে একটা কাজ করতে পেরেছে সেটা কী তার কম পাওয়া! অনিকা চটুল চোখে দীপনের দিকে তাকাল কিন্তু তার কথার কোন উত্তর দিল না। বলল, একটা ভাঙা জিনিস যে এভাবে জোড়া লাগানো যেতে পারে সেটা আমার মাথায়ই আসেনি।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। দীপন অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই দেখে সেলফি তোলা চলছে। মা হাসিমুখে আয়নাটা হাতে নিয়ে বসে আছে। পাশে দাঁড়ানো ফুলমনি। অনিকা সেলফি তুলছে। দীপনকে ঢুকতে দেখেই বলল, তাড়াতাড়ি এসে হুইলচেয়ারের পেছনে দাঁড়াও আর তোমার নতুন মোবাইলটা দাও। ওটাতে ভালো ছবি আসবে। দীপনের মা ঈশানী খুব খুশি হয়ে বললেন, বৌমা আয়নাটাতে নতুন কাচ লাগিয়ে এনেছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে! সবকিছু যেন আগের মতো। দীপন আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই তো! একটা ছোট্ট মেয়ে ফুলবেনী করে চুল বাঁধা। হাতে বই। রেলের স্লিপারে পা দিয়ে দিয়ে ব্রিজ পার হয়ে স্কুলে যাচ্ছে। ওই মেয়েটার নাম কি ঈষানী? দীপনের কথা শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। ক্লিক ক্লিক ক্লিক।
স্বপন বিশ্বাস কথাসাহিত্যিক। পেশায় কৃষি বিশেষজ্ঞ। প্রকাশিত গল্পের বই : এক জোড়া কৃষ্ণচূড়া গাছ। তিনি আমেরিকার নিউইয়র্কে বসবাস করেন।