এখলাস হোসেন প্রোপাইটার

এখলাস হোসেন যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, সেটা প্রথম লক্ষ্য করল তরিক। তরিক এই অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার, কারণে, কখনো অকারণে ও তাকে ছাদে আসতে হয়। যখন সে ছাদে আসে, অধিকাংশ সময়, চিলেকোঠায় এখলাস হোসেনের ঘর, সে এখলাসের ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যায়। এই নিয়ে এখলাস হোসেনের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি কম হয়নি। এখলাস নানাসময় বিরক্ত হয়ে বলেছে—অই তরিক, এই দিক দিয়া গেলেই তোমার ভেতরে উঁকি দেওয়া লাগে ক্যান!
চোখ চইলা যায়। জানালা এমন পুরা খুইলা রাখছেন।
তো কী করব!
জানালা বন্ধ রাখবেন।
এই ঘরে তোমার জানালা কয়টা? একটা। দরজা কয়টা? একটা। সব যদি বন্ধ রাখি, ভেতরে আলো বাতাস নাই, ঘর কবর হইয়া যাইব না?
গেল। আপনার প্র্যাকটিস এইটা।
এইসব, কিংবা আরও বেশি কিছু তরিক এখলাস হোসেনকে বলার সাহস পায়, কারণ, সূচনায় সামান্য হাসি-ঠাট্টা করে দেখেছে সে, এখলাস হোসেন গায়ে মাখে না। ফলে ক্রমশ তার মুখ খুলেছে। এদিকে আবার, প্রতি অ্যাপার্টমেন্টের হাড়ির খবর তার জানা থাকলেও, একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ছাদে যে কম্যুনিটি রুম, সেখানে তার সঙ্গে সময় কাটাতে-কাটাতে বি-ফাইভের আঞ্জুমান বলেছিল—বাড়ির কর্তার জিনিসটা নাকি চিনাবাদামের সমান। শুনে তরিকের হো হো হাসি—তরে দেখাইছে?
দেখাইছে মানে! সুযোগ পাইলেই চিনাবাদাম নিয়া গুতাইতেই আছে।
শুনে, আঞ্জুমান যদিও তার কোলে, তরিকের ঈর্ষা হয়—অ, আছ আরামে।
এইভাবে বলবা না। মাইয়া মানুষ যদি গরিব হয়, সারেন্ডার দেয়, তয় ভালো সে বাসে একজনরেই।
তা তুমি কী দেইখা আমারে ভলোবাসছ?
যে কথা হচ্ছিল, সব অ্যাপার্টমেন্টের সবার হাড়ির খবর তার কাছে, তবে এই এখলাসের কোনো খবর তার কাছে নেই। একা থাকে, কখনো ঘর সংলগ্ন রান্নাঘরে, যেটা এতই ছোট যে এপাশ থেকে ওপাশ হওয়া কঠিন, টুকটাক রান্না করে, অধিকাংশ সময় খাবার আসে হোটেল থেকে, কখনো টিভি দেখে কখনো খবরের কাগজ পড়ে, ইদানীং, মাঝেমাঝে ঘর থেকে মোড়া নিয়ে দুপুরের ছাদে গিয়ে বসে। ঘণ্টা খানেক রোদে বসলে নাকি ভিটামিন ডি, আকাশ থেকে গায়ে পড়ে, স্বাস্থ্যের উপকার হয়, বিশেষ করে করোনার এই সময়ে।
এখলাস হোসেন নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করে। একদিন তাকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে মেঝের ওপর বসে থাকতে দেখে তরিক হেসে ফেলেছিল, আর, এখলাস রেগে গিয়েছিল—তরিক, তুমি হাসলা ক্যান?
হাসি নাই তো, আমি বেশি হাসি না।
তোমারে তো আমি সবসময়ই বিতলা হাসি দিতে দেখি।
ঠিক না। এই সংসারে হাসির বিশেষ কিছু নাই।
নাই তো নাই। এখন যাও।
এইটা কী করতেছেন?
যোগ ব্যায়াম।
অ। শুনছি। সুস্থ থাকা যায়।
শরীরটা ভালো না।
তাইলে এই শরীরে ব্যায়ামের দরকার কী! এই চিপাঘরের মধ্যে আরও অসুস্থ হয়া পড়বেন।
তরিক, তুমি যাও, আমার বুঝ আমারে বুঝতে দাও।
এইসব বাদ। জিমে যান। সিক্স-এর রাজন সাহেবরে দেখছেন, জিমে যায়, বয়স পঞ্চাশ, দেইখা মনে হয় বত্রিশ।
একত্রিশ না, তেত্রিশ না, বত্রিশ?
আচ্ছা, ধরেন পঁয়ত্রিশ। চেহারা চকচক করে। তার মিসেস বাপের বাড়ি গেলেই, কত-কত পঙ্খি যে আসে! যারা, দেখলেই বোঝা যায়, কেউ তাদের আত্মীয় না।
এইসব দেখা ছাড়া তোমার আর কোন কাম নাই?
আছে তো। কামের ফাঁকে-ফাঁকে এইসব চোখে পইড়া যায়।
আচ্ছা, বুঝলাম। এইবার তুমি যাও।
এই যোগ ব্যায়ামটা করতেছেন, এইটার নাম কী?
মনে নাই। এইসব নাম মনে রাখা কঠিন।
সেজন্যই জিগাইলাম।… কী হইছে আপনার?
জ্বর।
বেশি?
বেশি।
কাউরে খবর দিব?
এখলাস হোসেন তার যোগ ব্যায়াম ছেড়ে সোজা হয়ে বসল—কারে খবর দিবা?
সেইটা তো আপনি বলবেন। আপনি বলবেন, আমি খবর দিব।
এখলাস হোসেন বিরক্ত মুখে তরিকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, বিরক্তির পাশাপাশি তার চেহারায় হতাশাও আছে—তরিক।
জি, বলেন।
তুমি কত বছর এইখানে চাকরি করো?
চার বছর নয় মাস।
আমি কতদিন এইখানে থাকি, জানো?
শুনছি এদিক ওদিক। মেলা দিন।
আমার কথা বাদ দাও, এই যে তুমি আছ পাঁচ বছর, আমার কাছে কাউরে আসতে দেখছ? মনে কইরা বলো।
তরিক দুপাশে মাথা নাড়ল, না, সে দেখেনি।
আমারে কোথাও যাইতে দেখছ?
তরিককে আবারও দুপাশে মাথা নাড়তে হলো।
তাইলে কারে খবর দিবা তুমি? এখলাস হোসেন জিজ্ঞেস করে চোখ না ফিরিয়ে তরিকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
তরিককে দেখে মনে হলো না সে কোনোরকম অস্বস্তিতে পড়েছে। সে বলল—খবর কারে দিব, সেইটা আমি ক্যামনে বলব।
আমি তোমারে খবর দিতে বলছি?
তরিক বলল—না, বলেন নাই।
তাইলে?
খেপতেছেন ক্যান! আমি একটা নিরীহ কথা কইছি। কাউরে খবর দিতে যদি মন চায়, প্রয়োজন বোধ করেন, আমারে বলবেন। ঢুনকে লে আয়েঙ্গা।
এখলাস হোসেন আরও রেগে গেল—তরিক, তোমার বয়স কত? তোমার বয়স কত এইটা আমারে বলো।
একত্রিশ হবো হবো করতেছে।
আমার বয়স তোমার ডবল। তুমি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মার?
ঠিক আছে, ধইরা নেন, কাউরে খবর দেবার কথা আমি জিজ্ঞেস করি নাই।
শোনো তুমি, এইসব কথা আর বলবা না?
কোনসব কথার কথা বলতেছেন?
কাউরে খবর দিবা কি দিবা না। এইসব। … এইরকম।
আপনি যখন বলতেছেন, বলব না।
মনে রাখবা। এখন কী কামে যাইতেছ যাও।
তরিক, এখলাস হোসেনের কঠিন গলা, আরেকটু অপেক্ষা করব, তারপর—কাউরে খবর দিতে হইলে বলবেন—বলে দ্রুত ছাদে চলে এলো। সে জানে, এখলাস হোসেন খেপবে বটে তবে ঘর থেকে বের হবে না। এখলাস হোসেনকে অনেকদিন দেখা হলো তার, সে জানে এখলাস কী করতে পারে কী করতে পারে না।
ছাদে অনেকগুলো ফুলের টব। ফুলও ফুটেছে অনেকগুলোয়। এসব টব অ্যাপার্টমেন্টের কমিটির নয়। এক ভদ্রমহিলার শখ, ফুলের গাছ তিনি ভালোবাসেন, ফলে প্রতিদিনই টবের সংখ্যা বাড়ছে। এত এত ফুল এদিক ওদিক, দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু অসুবিধাও আছে অনেক। কমিটির সেক্রেটারি তাকে ডেকে বললেন—তরিক।
সেক্রেটারির চেহারা দেখে তরিক বুঝল, সামনে কঠিন রাস্তা।
তোমার চোখ কয়টা, তরিক?
জি…।
তোমার চোখ কয়টা, এইটা জিজ্ঞেস করেছি।
জি, দুইটা।
দুইটাই কি তুমি পকেটে নিয়ে ঘুরো?
তরিক সমস্যাটা বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকল।
ছাদের অবস্থা দেখেছ?
দেখেছে বৈকি, ছাদে তাকে দিনের মধ্যে কয়েকবার আসতে হয়। তবে এখন কী বলা উচিত হবে বুঝতে না পেরে সে নিশ্চুপ থাকল।
ছাদে অতগুলো টব রেখেছে কে?
সি-থ্রির ম্যাডাম।
ম্যাডামকে বলবে, ছাদটা তার না। … ঠিক এভাবে বলবে না, ভালোভাবে বলবে। বলবে—ছাদ ড্যাম্প হচ্ছে।
জি, ড্যাম্প হচ্ছে।
বলবে—ডেঙ্গুর সময়, একে করোনা তার ওপর ডেঙ্গু, ডেঙ্গুর সময় এতগুলো টব ডেঙ্গু ছড়াতেই পারে।
জি, ডেঙ্গু ছড়াইতেই পারে।
এখন থেকে চোখ চোখের জায়গায় রাখবে, পকেটে না। আমার হাজারটা কাজ, তার মধ্যে এসব সাধারণ ব্যাপারে আমাকে কেন কথা বলতে হবে?
দিন কয়েক পর ছাদে এসে তরিক একটা ধাক্কা খেল। পরনে লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি, মোড়া টেনে ছাদে রোদের মধ্যে বসে আছে এখলাস হোসেন। তার উদ্দেশ্য কী বোঝার জন্য তরিক ছাদের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল কতক্ষণ। এখলাস হোসেন মোটামুটি স্থির, কখনো ডানে-বাঁয়ে দূরে-দূরে তাকাচ্ছে বটে, পেছনে ফিরছে না। এই দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখার পর পা টিপে-টিপে এগিয়ে এখলাসের পেছনে গিয়ে থামল। কিছু শব্দ হলো, ছায়াও পড়ল, এখলাস হোসেনের চমকে, চমকে না হলেও, কৌতূহলে পেছনে ফিরে তাকানোর কথা। এখলাস সেরকম কিছু করল না। সে বলল, সহজ গলায় বলল—তরিক…।
জি।… কী করতেছেন?
এই কাজটা আরও আগে শুরু করা উচিত ছিল।
সেইটা বুঝলাম। কাজটা কী? রোদ পোহান আপনে?
আরে না, রোদের মধ্যে বইসা থাকলেই রোদ পোহানো…।
রোদ গায়ে মাখেন?
এইটা ঠিক বলছ। রোদ গায়ে মাখতেছি। কেন, এইটা জানো?
কন।
রোদের মধ্যে ভিটামিন-ডি আছে। আর করোনা সামলাইতে খুব কার্যকর।
অ, স্বাস্থ্যের যত্ন নিতেছেন!
তুমিও নিবা। শরীরে ভিটামিন-ডি থাকলে করোনা…।
করোনা আমার সমস্যা না। আমার করোনা হবে না।
এইটা জাইনা বইসা আছ?
জি। করোনা হইতেছে বড়লোকদের অসুখ, আমার বেতন সাড়েবারো হাজার টাকা। আমার ক্যান করোনা হবে!
এই আজগুবি তথ্য কই পাইলা!
দেখতেছি তো। এই বাড়িতে তিন ফ্লাটে করোনা। তারা কাউরে কয় নাই। কিন্তু আমি ঠিকই টের পাইছি। দেইখাও আসছি। কই, হইসে আমার করোনা?
হইতে কতক্ষণ। কিংবা হইছে, বুঝতেছ না।…তরিক, বেশি কাছে আসবা না।
আসলাম না।
আর, আর… বলা দরকার, এই করোনার মধ্যে তুমি আর আঞ্জুমান, বিকালের পর, কিংবা যখন সময় পাও কম্যুনিটি রুমে যা করো, সেইটা ঠিক না। করোনা যাইতে দাও!
তরিককে দেখে মনে হলো না সে চমকেছে বা ভয় পেয়েছে, সে সহজ গলায় আপনে না ঘর থেইকা বাইর হন না, এইটা আপনি টের পাইলেন ক্যামনে, ওই শব্দও তো চাইপা রাখি।
তোমার লজ্জা করতেছে না, তরিক, এইসব বলতে?
আপনার বয়সের কথা ভাইবা দেখেন, আমার বয়সে আপনিও এইসব করছেন।
এখলাস হোসেন রেগে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল—শুনো, এইসব আলাপ করার সম্পর্ক তোমার-আমার না।
আপনে শুরু করছেন।
তোমাদের ভালোর জন্য। করোনার সময়।
এ-থ্রির লিলিও ইন্টারেস্ট। আমার ইচ্ছা নাই। একদিন আপনার রুমে ঢুকায়া দিব। তার বয়স কম…।
তরিক…।
এখলাস হোসেনের ধমকে তরিক দুপা পিছিয়ে গেল। একটু সময় নিল, তারপর বলল,এত রাগলেন…।
তুমি ওই টা কী বললা আমারে!
আপনে একা থাকেন…।
তাতে তোমার কী?
না, মানে, একদমই একা থাকেন…।
সেইটা তোমার সমস্যা না।
না, তা না, তবে…।
শুনো তরিক, এই নিয়া আর একটা কথা বলবা আমি তোমার আর আঞ্জুমানের বিষয়টা কমিটির সেক্রেটারিকে বইলা দেব।
তরিককে কিছুটা হতভম্ব দেখাল। আবারও সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। এইটা একটা ন্যায্য কথা বললেন…।
তুমি যা করার করো, আমারে জড়াও ক্যান!
আপনার শরীর কেমন? জ্বরের কী অবস্থা?
জ্বর বাড়ছে। দুর্বল লাগে।
করোনার সময় জ্বর…।
এখলাস হোসেন চুপ করে থাকল।
এইসব সময়… আপনি একা থাকেন ক্যান… একা ক্যান থাকেন?
এখলাস হোসেন তাড়া করার ভঙ্গি করলে, তরিক সেদিন ছাদ থেকে পালিয়েছিল। পরেরদিন সে ছাদেই ওঠেনি। এখলাস সেদিন তাকে ধরতে না পেরে চেঁচিয়ে বলেছিল, তরিককে সে দেখে নেবে, কমিটির সেক্রেটারিকে তো বলবেই, ভাড়া নিতে আসে বাড়ির মালিকের যে আত্মীয়, এখলাস তাকেও বলবে যে তরিক তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করে, আজেবাজে নোংরা কথা বলে। তরিক তাই ছাদে ওঠেনি। এখলাস হোসেন সত্যিই বলবে, তার মনে হয়নি, কিন্তু বলতেও পারে, রাগের মাথায় মানুষ অনেক কিছু করে ফেলে। তরিক তাই ছাদে যায়নি, তাকে না দেখলে এখলাস হোসেনের রাগ কমলেও কমতে পারে।
তা, তরিক ছাদে গেল না বটে, একটা প্রশ্ন, সে যেখানেই থাকুক, বারবার তার কাছে ফিরে এলো—আচ্ছা, সত্যিই কি এই লোকটার কেউ নেই!
এই একই প্রশ্ন আগেও তার কাছে বহুবার এসেছে। এই যে এখানে, এই অ্যাপার্টমেন্টে প্রায় পাঁচ বছর ধরে আছে, সে প্রায় ভেবেছে—এই মানুষটার কেউই কি নেই! একটা মানুষ দিনের পর দিন, একলা থাকে কীভাবে!
এখলাস হোসেন মারা যেতে দুদিন সময় নিলেন। ওই যে তরিক বলেছিল, এইসব সময় একা থাকেন ক্যান… একা থাকেন ক্যান?—এরপর মাঝখানে দুদিনের সময়, তারপর এক ভোরে, ভোরে বলা উচিত না, সময় নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন, কারণ এখলাস হোসেনের মৃত্যুর সময় কেউ উপস্থিত ছিল না, কেউ তাই জানেও না সময়টা কখন। ডাক্তারের কাছে নেয়া গেলে তারা হয়তো টিপেটুপে, দরকার হলে কেটেছিড়ে বলতে পারত একটা সময়, কিন্তু এ সময় তাকে কে নেবে ডাক্তারের কাছে, আর, সময় জানানোর জন্য এখন কোন ডাক্তারই-বা সময় দেবে!
ব্যাপারটা এভাবে ঘটল— সময় বের করে আঞ্জুমানের আসার কথা ছিল বিকালের পরপর। তরিক বিকাল আর সন্ধ্যা পার করল কম্যুনিটি রুমে আর ছাদে, আঞ্জুমান আর এলো না। মাঝখান দিয়ে যা হলো, সন্ধ্যার পর তার যে সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল, তরিক সেটা বেমালুম ভুলে গেল। সেক্রেটারি তাকে আচ্ছামতো ঝাড়লেন। এই যে আঞ্জুমান এলো না, এই যে সেক্রেটারি নোংরা-নোংরা কথা বলে ঝাড়লেন, রাতে ঘুম হলো না তরিকের। ঘুম যখন হলো না তরিকের। ঘুম যখন হলো না, মাথা ঠান্ডা করার জন্য তরিক ভোরবেলা ছাদে যাবে ঠিক করে এখলাস হোসেনের ঘর পার হওয়ার সময় দেখল এখলাস হোসেন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। একবার তরিক ভাবল এখন কথা বলবে না, এখন তার মেজাজ খারাপ, আবার তার এরকমও মনে হলো—এসময় কিছু হাসিঠাট্টা করলে মনটা হালকা হতে পারে। সে দাঁড়াল আর বলল— শইলের এখন কী অবস্থা?
এখলাস হোসেন উত্তর দিল না।
ঘুমাইতেছেন?
কোনো উত্তর এলো না।
যোগব্যায়াম করতেছেন? ক্যাতরায়া পইড়া আছেন ক্যান।
এখলাস হোসেন উত্তর দিল না। তরিক বলল—কী ব্যাপার, প্রশ্ন করতেছি, উত্তর দ্যান না ক্যা… তরিক তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজ মাথায় সজোরে হাত রাখল—হায় আল্লাহ!
সেক্রেটারি সাহেব বললেন—তার আত্মীয়স্বজনরে খবর দাও। বাসায় বাসায় জানায় দাও, ছাদে কেউ যাবে না।… তুমি দূরে দাঁড়াও, তরিক।
তরিক আরও দুপা পেছনে সরল—দূরেই তো।… উনার আত্মীয়স্বজন নাই।
নাই মানে! আত্মীয়স্বজন সবার থাকে।
উনার নাই। এত বছর একদিনও দেখি নাই।
আছে কি না, খবর নাও।
তরিক হতাশ গলায় বলল—আমি খবর কোথায় নিব!
ফ্লাটের যে মালিক, তাকে জিজ্ঞেস করো, নাম্বার আছে না?
এখলাস হোসেনের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কোনো পরিচিতজন কারও খোঁজ পাওয়া গেল না। ফ্লাটের মালিক বা ভাড়া নিতে আসা লোকটাও কিছু জানেন না। শুধু জানা গেল, একসময় তিনি একটা অফিসে চাকরি করতেন, সেইসূত্রে ভাড়া নিয়েছিলেন, তবে সেই অফিসের নাম এখন আর মনে নাই। জানা গেল—প্রতিমাসে নির্দিষ্ট দিনে ভাড়া দিয়া দিতেন, আমার আর আত্মীয়স্বজন বা অফিসের খবরে কী দরকার! তারে নিয়া এইখানে কোনো ঝামেলার কথাও শুনি নাই। বিপদে তো পড়লাম আমি। এই রুম কি আর কেউ ভাড়া নিব!
দাফনের ব্যবস্থা তরিককেই করতে হলো। সেটা অবশ্য কম ঝামেলার ব্যাপার ছিল না। যারা, করোনায় মারা যাচ্ছে, যারা তাদের দাফনের ব্যবস্থা করছে, তারা অনেক ব্যস্ত। তারা এসে পৌঁছাতে-পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এরমধ্যে দরজা ভেঙে তরিক ঢুকেছে সে ঘরে। এখলাস হোসেনকে সোজা করে শুইয়েছে। তার বাক্স-প্যাটরা, আলমারি খুলে দেখেছে। স্যুটকেসের নিচ থেকে সে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছে। এক হাজার টাকার পাঁচটা বান্ডিল। তরিক টাকাগুলো নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছে।
তরিক চাকরি ছেড়ে দিয়েছে মাস ছয়েক পর। সে যে এলাকায় চাকরি করত, সেখান থেকে বেশ দূরে একটা খাবার দোকান দিয়েছে, নাম—তরিকের ভাতের হোটেল। তার নিচে লেখা প্রোপাইটার : এখলাস হোসেন।
যদিও আগের এলাকা বেশ দূরে, মাসে একবার-দুবার আসে সে আগের বাড়িতে, এখানে এখনো অনেকে তার পরিচিত। আগের বাড়ির এখন যে কেয়ারটেকার, তার সঙ্গেও সে ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছে। লোকটা তাকে দেখলেই হাসে—কী ভাইজান, আজও ছাদে যাইবেন?
আপনি যদি নিতে পারেন?
তরিক এমন সময় আসে, যখন ছাদে যাওয়া নিরাপদ। নিরাপদ, কারণ ওসময় কেউ ছাদে ওঠে না। কেউ উঠলেও অবশ্য অসুবিধা নেই। এ বাড়ির প্রায় সবাই তার পরিচিত। তরিক ছাদে যায়। কোনো কোনো দিন এখনকার কেয়ারটেকার তার সঙ্গে থাকে। তরিক ছাদে পৌঁছানোর আগে একটু থামে, বলে—এখলাস হোসেনের কথা বলছি আপনারে…।
হ, ভাই বলছেন। কয়েকবার বলছেন।
তার যে কেউ ছিল না, এইটা বলছি?
এইটাও বলছেন ভাই।
অ!... ভাই, আপনার অবাক লাগে না?
কী?
এই যে একটা মানুষের কেউ নাই।
জীবন ভাই বড়ই আশ্চর্য জায়গা!... আবার ধরেন, কেউ তার থাকতেও পারে, আপনি জানেন না।
কেউ আসছিল তার খোঁজে?
নাহ। আমি এই তিন বছরে কাউরে দেখি নাই।
আমি উনার মৃত্যুর পর ছয় মাস ছিলাম। তখনো কেউ আসে নাই।
কোনো কোনো দিন এমন হয়, তরিককে ছাদে রেখে এখনকার কেয়ারটেকার কোনো কাজে যায়। তরিক তখন এখলাস হোসেন যে ঘরে থাকত, সে ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন ভাড়া নেই কেউ। তরিক শুনেছে, যারা বিভিন্ন সময় ভাড়া নিয়েছে ওই রুম, কেউই বেশিদিন থাকেনি। অথচ দেখো কাণ্ড, ওই লোকটা কি না বছরের পর বছর থেকে গেল। থেকে গেল, আর, মারাও গেল। কতজনের কাছে কত-কত জন আসে, থাকে, গল্প করে, হাসিঠাট্টা, ঝগড়াঝাটি আর সুখদুঃখের গল্প হয়! এই লোকটার কেউ ছিল না, কেউ না, ছাদের ওপর খাঁ খাঁ রোদ, শরীর জ্বলে যায়, তরিক রোদ থেকে সরে না, প্রতিবারের মতো তার মনে হয়—নাকি ছিল, নাকি এখনো আছে, একদিন হঠাৎ খবর নিতে চলে আসবে!
মঈনুল আহসান সাবের কথাসাহিত্যিক। প্রথম বই গ্রল্পগ্রন্থ পরাস্ত সহিস প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮২ সালে। তিনি অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬), ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক (২০১৯)। তিনি ঢাকায় বসবাস করেন।