যেভাবে জীবনানন্দ পড়তাম, যেভাবে জীবনানন্দ পড়ছি

কোথায় যেন পড়েছিলাম, দাম্পত্যসঙ্কটের গল্পে উত্তীর্ণ হওয়া অত্যন্ত জটিল—কথাটা সত্যি। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো ঢপের দাম্পত্যসঙ্কটের গল্প লেখা যায়, জীবনানন্দের গল্প/উপন্যাস লেখা যায় না, দুই তীর (ওয়ালিউল্লাহ) লেখা যায় না। পাঠকের একটু দীর্ঘশ্বাস সৃষ্টি করতে লেখকের কতটা রক্তক্ষরণ ঘটে, সে লেখকই জানেন।

দুমুখো তলোয়ারের তলায় রক্তাক্ত হতে হতে আমৃত্যু বিবাহ প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখার নাম 'সফল দাম্পত্য জীবন'।  প্রায় প্রতিটি লেখকই কমবেশি পান-থেকে-চুন-খসলেই-সর্বনাশ সাংসারিক জীবনে অচল। একসঙ্গে লেখালেখি আর সুষ্ঠুভাবে সংসার করে গেছেন এমন নজির খুব কম। হয় তোমাকে পুরুষসিংহের মতো গর্জে পত্নীকে মার্জারের মতো নির্বিষ করে রাখতে হবে, না হয় পত্নীকে হতে দিতে হবে সিংহী। তুমি মার্জারের মতো কেঁউ কেঁউ করে যাও। যদি অনুগ্রহ করে সে-সিংহী তোমাকে অ্যালাও করেন, তোমার পুরুষত্ব দেখাতে পারো প্রেমহীন আবেগহীন যৌনতায়।

কিন্তু মার্জার হয়ে তো লেখক হওয়া যায় না। লেখক সবসময় লেখার দুনিয়ায় সর্বাথসাধক স্বৈরাচারী ও যুগপৎ স্বেচ্ছাচারী।

লেখা কাজটি তো নিভৃত গোপন, প্রকাশিত না হলে ভীরুতার কাজ, জীবনানন্দ বুঝেছিলেন বলেই তাঁর ডাইরিতে টর্চার কথাটি বারবার বলছেন, দেয়ালে ঠেকে যাওয়া লোকের তখন হয় এগোনো, না হয় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তৃতীয় কোনো পথ থাকে না। তাহলে জীবনানন্দের আত্মহত্যা সংঘঠিত হয়েছে মৃত্যুর বহু আগে, স্ত্রী ও প্রেমিকাকে একসঙ্গে ডিল করতে না পেরে আশ্রয় নিচ্ছেন কবরে, ভাবছেন, ভাবনাও তো ঘটনা, ভাবনাগুলোই তো গল্প উপন্যাস হয়ে যাচ্ছে।

এভাবেই তবে জীবনানন্দ সাহিত্য পাঠ করতে হবে আমাদের? জীবনানন্দই স্বয়ং বোধহয় তাঁকে পাঠ করার তরিকাটি আমাদের বেঁধে দিয়েছেন তাঁর অনাবিষ্কৃত সাহিত্য ও ডায়েরিগুলির ভেতর। 

জীবনানন্দকে কীভাবে পড়ি বলার আগে, বলতে হয় বাক্সবন্দি জীবনানন্দ আবিষ্কৃত হওয়ার আগে, জীবনানন্দকে কেমনভাবে পড়তে শিখেছিলাম, কিম্বা অথবা কেমনভাবে জীবনানন্দ পড়তে শেখানো হয়েছিল, আমাদের। সদ্যযৌবনে কবিতা লিখতাম বলে, আমরা, হলামইবা মফস্বলের, নিবিড় কবিতা পাঠের ভেতর দিয়ে কবিতা খুঁজে গেছি এবং সেই অনুসন্ধানী পাঠপ্রক্রিয়ার ভেতর যেতে যেতে মনে হয়েছে, পরে বিশ্বাসে দৃঢ়তা পেয়েছিলাম, আমাদের আদর্শ বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ নন, হতে পারেন না। আমরা জীবনানন্দকে প্রায় বর্জন করেছিলাম আমাদের পাঠ পরিধি থেকে তারপর। কিন্তু, আমাদের অন্যান্য কবি-হতে-চাওয়া বন্ধুদের তো বর্জন করলে চলে, আমার চলে না, তারা লেখাপড়ার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করেছে, আমি টপকে যাচ্ছি বুর্জোয়া শিক্ষার সিঁড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনানন্দ একাই একটি পেপার, আমার দ্বিমত সত্ত্বেও সেইসব প্রথাসিদ্ধ বক্তৃতা শুনতে হচ্ছে, হয়তো সে সবই লিখতে হবে পরীক্ষায়, উত্তরপত্রে। তবুও আমার মতামত জানাই ক্লাসে। না, প্রশংসিত হইনি, ভর্ৎসিতই হয়েছিলাম।

আমাদের শিক্ষকেরা জীবনানন্দ পড়িয়েছেন, ইতিহাসচেতনা কালচেতনা ইত্যাদি ইত্যাদি চেতনায় বিভক্ত করে। এই রকম চেতনাযুক্ত তো সব কবিই। ছাত্রজীবনের সেই পাঠ, যে-সব বইপত্র পড়ে পরীক্ষায় পাশটাশ করতে হয়, শিক্ষকতা করতে গিয়ে দেখলাম, ওই চেতনাবৃত্তের মধ্যেই আমাদের ছাত্ররা, আমাদের জীবনানন্দ বিশেষজ্ঞরা, তাঁদের রচিত জীবনানন্দ কাব্য পরিক্রমা, তাঁদের ছাত্রপাঠ্য নোটবুক এবং অথবা থিসিস পেপারেও  আমাদের অধ্যাপকরা ঘোরাফেরা করছেন, যেমনটা আমরা করতাম, এখনো, এতসবের পরও। ফলে জীবনানন্দ পাঠপ্রক্রিয়ায় প্রথম থেকেই এক অলীক ভ্রান্তির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে ছাত্রদের। তাদের জীবনানন্দ পাঠ নয়, পুজো করতে শেখানো হয়েছে, আজ সুবিস্তৃত ভক্তবৃন্দ জীবনানন্দ রাখোয়ালি করছেন। 

এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে একমাত্র জীবনানন্দের জীবনের সঙ্গে অন্বিত করে তাঁর কবিতা পাঠ। বেলা অবেলা কালবেলা"র কবিতাগুলোকে সবচেয়ে বেশি কালচেতনায় সমৃদ্ধ বলছেন আমাদের শিক্ষক। আসলে কি তাই? আমাদের শিক্ষকদের দোষ নেই, জীবনানন্দের জীবনের সবটাই মিথ-মন্তব্যের মধ্যেই আবর্তিত। একটু আগ বাড়িয়ে আমাদের কোনো  শিক্ষক তো মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও বিচার করতে চেয়েছেন, কিন্তু সেটাও ছিল ভুল। তাত্ত্বিকভাবেও ভুল, প্রায়োগিক দিক থেকেও ভুল। জীবনানন্দ যতোটা মার্কসবাদী, তার চেয়ে অনেক বেশি ফ্রয়েডবাদী। তাঁর রাজনৈতিক চেতনা কিম্বা চৈতন্য লাথ খেতে খেতে জীবনের পাঠ। যে সমস্ত কবিতায় প্রবল সমাজ চেতনা, তীব্র কটাক্ষ, তাও আসলে ওই লাথিঝাঁটার প্রতিক্রিয়া। জীবনানন্দ কখনো হাতেকলমে রাজনীতি করেছেন এমন তথ্য পাইনি। তার প্রেমিকারা, জীবনানন্দ যাদের পেছনে ছুটে জীবনের অন্তঃসারশূন্যতাকে উপলব্ধি করেছিলেন সেখানে রাজনীতি নেই আছে একটা ছকভাঙা নারীজীবনের প্রতি টান। হতাশার ভেতর ক্রম হতাশার জন্ম দিতে দিতে জীবনানন্দের জীবন যাপিত হয়েছে। ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্বের কথাও সেই শিক্ষক বলেছিলেন, আধুনিক কবিতার লক্ষণ বলতে গিয়ে, সেই ১৯৮০-র কাছাকাছি সময়ে, হয়তো তারপরও তিনি এইসব লক্ষণগুলো ক্লাস রুমে বলে থাকবেন। কিন্তু সেদিন, আমি তখন ছাত্র ছিলাম, এইসব সাধারণীকরণের ভেতর  জীবনানন্দীয় জটিলতাকে তিনিও টেনে বের করে দেখাতে পারেননি, ওই বাক্সবন্দী রহস্য তখনো উন্মোচিত হয়নি বলে। বাক্স রহস্য উন্মোচিত হওয়ার পর জীবনানন্দ চর্চাটাই তো বদলে গেল। কবিতাকে পেছনে ফেলে তার উপন্যাস গল্পগুলোই প্রধান হয়ে উঠলো। একজন কবি, জীবনানন্দ, যেটা আমরা জেনে এসেছি এতকাল, কবিতার ভেতরে তাঁকে আর ধরে রাখা গেলো না, তিনি অন্যতর কাব্যতত্ত্বে ব্যাখ্যাত হয়ে উঠতে চাইলেন।

জীবনানন্দের কবিতা, আসলে, 'কথা ও কাহিনি’। কবিতার ভেতর থেকে কাহিনি মাথা তুলে জানান দিচ্ছে, 'আমি আছি'; কবিতাও বলছে, 'আমি আছি'। ঠিক কবিতার পরিসরে তারা ঠিকঠাক আবদ্ধ থাকতে পারছে না, কখনো বা মনে হয়েছে ঠিকঠাক সুসামঞ্জস্য ফুল চুনে চুনে মালাটি গাঁথা হচ্ছে না, গঠনশিথিল, এমনকি শিল্পিত নয় বলেও মনে হচ্ছে। আরও কম কথায় বলা যেত কবিতাটি। এ রকম শৈথিল্য তো কবিতার পর কবিতায় চলতে পারে না, সেটা কবিও জানেন। দীর্ঘদিন ফেলে রেখে সংশোধনের পর সংশোধনে তিনি কবিতাটিকে কবিতা করে ছাড়পত্র দিচ্ছেন মুদ্রণের। তাও কত কবিতাই সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারল না, কবির চিত্তদৌর্বল্যহেতু। আমরা ওটাকেই কবির মনোভঙ্গি বলে ধরে নিয়েই জীবনানন্দ পাঠের অভ্যাস গড়ে নিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, কবি নিশ্চয়ই গল্পটল্প লেখেন, তখনো, তিনি গল্প উপন্যাস লেখেন কেউ জানতাম না। কিন্তু অস্বীকার করতে পারিনি,  কবির কোথাও একটা বৃহত্তর চাপ, তা ব্যক্তিক হোক, সামষ্টিক হোক কবিকে কবিতার চৌহদ্দি থেকে টেনে আনতে চাইছে, নিবিষ্ট মনে কবিতা লিখতে দিচ্ছে না। তিনি কিছু চেপে রাখছেন, ঠারেঠোরে বলছেন, বলতে চাওয়াটা কোথাও হাত ফসকে বেরিয়েও গেছে। সেটাকেও আমরা তাঁর শিল্পপ্রবণতা বলেই ধরে নিচ্ছি, কিন্তু শিল্পে না হয়ে উঠতে পারাটাকে তো শিল্পীর গুণ বলা যায় না। তা দুর্বলতা। তা স্খলন।  কিন্তু এর কারণটি ঠিক কি, বুঝে ওঠার মতো উপাদান তথ্য উৎস কিম্বা সংকেত কিছুই আমাদের হাতে সেই যৌবনবেলায় ছিল না। 

প্রথম এভিডেন্স হাতে এলো জলপাইহাটি, শিলাদিত্য কাগজে।  আমার, আমাদের, বলা বাহুল্য, অনুমান সত্যি হলো, কবিতাগুলো পাঠের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা যুক্ত হলো। আমরা নতুন করে জীবনানন্দ পাঠ করতে শুরু করলাম। বুঝে নিতে পারছি, আজ তো স্পষ্ট, অরুণিমা, বনলতা, সুচেতনারা নানা নামে বেবিই, শোভনাই। নানা তলে তাঁর প্রিয়তমাকে ধরেছেন, নানা অ্যাঙ্গেলে তাঁকে ঝালিয়ে নিয়েছেন। তিনি আর শোভনা এই দু'জনে সেই তল, সেই বহুবিধ অ্যাঙ্গেলগুলি বুঝে নিলেই প্রেমিক জীবনানন্দের উদ্দেশ্য সফল, পৃথিবীর আর কেউ বুঝল কিনা, জীবনানন্দের মাথাব্যথা নেই। 'মর্ত্যনারকী ধাতুর সংঘর্ষ থেকে জেগে ওঠা নীল স্বর্গীয় শিখার মতো' শোভনাকে তিনি দেখলেন,

‘তোমাকে আমেরিকার কংগ্রেস ভবনে দেখতে চেয়েছিলাম,/ কিম্বা ভারতের,/  অথবা ক্রেমলিনে কি বেতসতন্বী সূর্যশিখার কোনো স্থান আছে/ তার মানে পবিত্রতা শক্তি শান্তি শুভ্রতা—সকলের জন্য!/ নিঃসীম শূন্যে কোনো শূন্যের সংঘর্ষে স্বতরুৎসারা নীলিমার মতো/ কোনো রাষ্ট্র কি নেই আজ  আর/ কোনো নগরী নেই/ সৃষ্টির মরালীকে যা বহন করে চলেছে মধু বাতাসে/ নক্ষত্রে—লোক থেকে সূর্যলোকান্তরে!’ 

জীবনানন্দ ভালো করেই জানেন, উদ্দেশ্যমূলক কোনো  কিছুই  শিল্পোত্তীর্ণ হয় না।  তবুও, না হোক কবিতা, কারণ আমার সকল গান তোমাকেই লক্ষ্য করে। আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার। ভালোবেসে নিখিল বিষকে মধু বলে পান করছেন।

যদি তাঁর গল্প উপন্যাসগুলি প্রকাশিত না হতো, যদি পড়ার সুযোগ না ঘটতো, আমাদের ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ রহস্যময় কবি বলে তিনি চিহ্নিত হতেন। গল্পকে কবিতার ভেতর কীভাবে কবিতা করে রাখতে হয় তার রেটরিক দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে যেতেন তিনি। গল্প কবিতা বিশেষত ডাইরিগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর কবিতা অনেক  সহজ হয়ে গেছে, না বলা কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাদের পুরোনো পাঠঅভ্যাস গায়েব  হয়ে গেছে, কালচেতনার ইতিহাসচেতনার আচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি পেয়ে বুঝে গেছি, তাঁর ব্যক্তি-বিষ্ফোরণই প্রধান, তিনি গদ্যে নিজেকে খুলবার  অবলম্বন পেয়ে গেছেন।

ডাস ক্যাপিটাল আর The theory of sexuality totem and tabo on narcissism, Civilization and it's discontents, Beyond the pleasure principal of the future of illusion মিলিয়ে এক অখণ্ড আধুনিক-গীতা অনবরত অনন্ত আপসহীন সর্বব্যাপী এক যুদ্ধের প্ররোচনা দিয়ে গেছে তাঁকে সারাজীবন।
প্রেম তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, হীনমন্যতায় তিনি ভুগছেন, সেই ভোগান্তি তাঁকে তীব্র তীক্ষ্ণ করছে, বিদ্রোহী করছে, আক্রমণের লক্ষ্য খুঁজে পাচ্ছেন। 

তাঁর প্রথম বিদ্রোহ, ব্রাহ্ম‌ সমাজের পরিশীলিত রুচি শিক্ষা উচ্চ পদস্থ চাকরি-মান্যতার বিরুদ্ধে।

দ্বিতীয় বিদ্রোহ, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
তৃতীয় বিদ্রোহ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে। 
সমস্ত বিদ্রোহের শ্রীমৎভাগবৎগীতা কিন্তু 'Y'।

ধরেই নিচ্ছি, লাবণ্যর ভয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন ট্রাঙ্কে, কোনোদিন স্পষ্ট করে, এমনকি ডাইরিতেও লিখে রাখতে পারেননি তাঁর প্রেমের কথা, অবদমিত কামের কথা, কামচরিতার্থের কথা, প্রেমিকার নাম-পরিচয়—প্রচলিত সমাজ বিশ্বাসে তা অনৈতিক। অপরাধের চিহ্ন সমূহ যতদূর গোপন রাখা যায়, এই অপরাধ প্রবণতাই, অপরাধের তাপচাপের ফল ওই গল্প উপন্যাস। সঙ্কেতের সাহায্য নিয়েছেন, ইশারায়-ইঙ্গিতে লিখে রেখেছেন একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। 

ডাইরিতে তো লিখতেই পারতেন খোলামেলা, পারেননি। সম্মানের কারণে পারেননি। বিশ্বদুনিয়াকে তুড়ি দেওয়া যায়, ঘরে যে অজর-দুদ্দস্যি অনিঃশেষ অসম্মানের নির্ঝরিণী স্ত্রী নামক বাঘিনী, তাঁকে এড়িয়ে যাবেন কী করে! তাঁর পিঠে বসে জীবন নির্বাহ ও যুগপৎ কলম চালানো কী-ই কঠিন, জীবনানন্দ হাড়েমজ্জায় বুঝেছিলেন। যে পুরুষ স্ত্রীর রোজগারে খায়, যাকে একটি বিড়ি কিনতেও স্ত্রীর কাছে হাত পাততে হয়, লেখার কাগজ-কলমের জন্য স্ত্রীর অনুগ্রহ-নির্ভর হতে হয়, তার আর কোনো ব্যক্তিত্বই মেরুদণ্ড পায় না, পেতে পারে না। তার ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকে না আর। স্ত্রীর মতো অনাত্মীয় পৃথিবীতে আর কেউ নেই। 

সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অর্থ রোজগারের দুনিয়ায় তিনি ছিলেন একটি অচল পয়সা। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় রোজগার ছাড়া সব মিথ্যে।  

সচল পয়সা হলেও তাঁকে মুখোমুখি হতে হতো সংঘাতের। পুঁজিবাদ সুস্থিতিকে অস্থির করে দেবার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণায় ব্যস্ত, কোনো মানুষ আর সুখী নয়। গভীর গভীরতর অসুখ ছাড়া বেঁচে থাকা মিথ্যে। নিজের মুদ্রাদোষকে একা হতে দেবার দোষে দুষ্টু বলবার যুগ পেরিয়ে গেছে। অনুভূতিপ্রবণ লেখকের জীবনে শান্তি থাকবে না। 

আসলে বিবাহ এমন একটি বন্ধন, যেখানে গোপনীয়তা আর চলে না, থাকে না। গোপনীয়তা সঙ্কট তৈরি করে। প্রকাশিত হলেও সমস্যা। প্রকাশ করলেও তুমি গেলে, গোপন করলে তো একেবারেই রসাতলে গেলে। প্রকাশ্যের ছলে গোপনীয়তাও ভয়াবহ রকমের সঙ্কট তৈরি করতে পারে যদি লেখকের স্ত্রীর মনে ঘনীভূত হয় সন্দেহ। সেই মেঘ মুহুর্মুহু বজ্রপাতে, আকাশভাঙা বর্ষণে তোমাকে, তোমার শেকড়বাকড়সহ লেখকত্বকে খড়কুটোর মতো টেনে নিয়ে যাবে অভাবিত বিনষ্টিতে। কিন্তু সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তো পুরো পুরোটাই অপরাধ। অন্যায়। তিনি যদি কবিতা গল্প উপন্যাস না লিখতেন, অনায়াসে বলা যেতে পারত জীবনানন্দ দাশ বলে মানুষটি নীতিনৈতিকতা বিহীন একটি লম্পট, মিথ্যুক, শঠ, ঢপবাজ। একটি নরকের কীট। 

যাবতীয় সাংসারিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরও যদি কেবলমাত্র একজন কবি ও সাহিত্যিক বলে জীবনানন্দকে ক্লিনচিট দিতে হয়, নিছক একজন গৃহবধূ হিসেবে, যিনি সুখী সুন্দর দাম্পত্যজীবন রচনা করতে এসেছিলেন, স্বামীর চরিত্রহীনতায় সব তাসের ঘরের মতো ভেঙে গিয়েছিল, তাঁকেও ক্লিনচিট দিতে হয়। লাবণ্যর নিত্যদিনের ভাবনাগুলি যদি জীবনানন্দের মতো ডাইরিতে লিপিবদ্ধ থাকত, লাবণ্যর প্রতিটি দিবস রজনী যদি জানা যেত, জীবনানন্দের ডাইরির এন্ট্রির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে বিচার করে নিতে পারতাম তাঁকে, তারপর না হয় লাবণ্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেত, তা তখন সম্ভব নয়, জীবনানন্দের ডাইরির এন্ট্রির কদমে কদমে চলে আমরা লাবণ্যকে বিচার করতে চাই। সেসব থেকে লাবণ্যকে কোনো কারণেও দোষী ভাবতে পারা যাচ্ছে না, বরং তাঁকে ভিক্টিম বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

একটা বিশৃঙ্খলা প্রভূত বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে পারে, সে বিশৃঙ্খলা পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও প্রভাবিত হয়। লাবণ্যর ভায়োলেন্ট মুহূর্তগুলির স্বাক্ষী কি মঞ্জুশ্রী হননি, যেমনটা বুদ্ধদেব বসু জানাচ্ছেন?

মঞ্জুশ্রীকে প্রথম দেখি জাতীয় গ্রন্থাগারের রিডিং রুমে। একগাদা বই নিয়ে বসে। সামনে গিয়ে কথা বলতে তিনি উঠে চলে গেলেন। কিছু পরে চা খেতে, আসলে বিড়ি খেতে, ক্যান্টিন পৌঁছে দেখি, মঞ্জুশ্রী চুপচাপ বসে আছেন। বিপরীত দিকের চেয়ারে বসতেই উঠে চলে গেলেন।

বাপকা বেটি! 
জীবনানন্দও সম্ভবত কাছে গেলে এমনি পালিয়ে যেতেন।
জীবনানন্দ সম্পর্কে যেকোনো জিজ্ঞাসায় অনিবার্যভাবে যদি এসে পড়ে ওইসব ভায়োলেন্ট মুহূর্তগুলির কথা, তারচেয়ে এড়িয়ে থাকাই ভালো। 

নিজের মুদ্রাদোষে আমি শুধু হতেছি একেলা, হয়তো,  মঞ্জুশ্রীর মধ্যেও নিজের মুদ্রাদোষ দেখা দিয়েছে পিতৃসূত্রে। সাউথ পয়েন্ট স্কুলে তাঁর কিছু মুদ্রাদোষ ততদিনে জেনে গেছি। তিনি এড়িয়ে চলছেন। মঞ্জুশ্রীও তাঁর বাবার মতো আতঙ্কিত। তিনিও মনে করছেন তার বাবার মতোই তিনিও টর্চার্জড।

জীবনানন্দ যদি সুউপায়ী হতেন, আমি নিশ্চিত তিনি আরও বেশি করে বিশৃঙ্খল ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠতেন। পুরুষতান্ত্রিক বহুগামিতার সর্পটি তাঁর মনে ফোঁপাচ্ছে সর্বক্ষণ। তাঁর চরিত্র দুর্বলতাটিকে এভাবে বিশ্লেষণ করে  সান্ত্বনা পেতে পারি, শিল্পী আত্মহনন ভালোবাসেন।

জীবনানন্দ কেন মরেছিলেন আমি জানি। তাঁর মৃত্যুই যেন উত্তর-লেখককে বলে দিয়ে গেছে, সমূহ পতন থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে লোক-হাসাবে তুমি! হেরোকে জিতিয়ে দিয়ে চলে যাবে।

সবচেয়ে বেশি হাসবে তোমার ছিনাল প্রেমিকা, তাকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে দিও না!

গৌতম মিত্র জানাচ্ছেন, 
‘যেখানে যেখানে শোভনা গেছেন পেছন পেছন জীবনানন্দ গেছেন। ১৯৩২! ডায়াশেসন কলেজের ছাত্রী শোভনা, কত-ই বা বয়স তখন শোভনার, ১৮-র বেশি তো নয়, জীবনানন্দ ৩৩ বছরের বিবাহিত যুবক। দারোয়ানের হাতে স্লিপ পাঠিয়ে নিচে বসে অপেক্ষা করতেন, কখনো মর্জি হলে শোভনা দেখা করতেন, কখনো করতেন না।

১৯২৯! ডিব্রুগড়ে ক্লাস নাইনের ছাত্রী শোভনা। বেকার জীবনানন্দ চাকরি খোঁজের বাহানায় সেখানে গিয়েও উপস্থিত। দরজা বন্ধ করে শোভনাকে কবিতা শোনাচ্ছেন। শোভনার মা, জীবনানন্দর কাকিমা, সরযূবালা দাস রাগ করছেন, তবুও।

সবাই মিলে শিকারে গেল, শোভনার বাবা অতুলানন্দ পেশায় ফরেস্টার, আইএফএস, জীবনানন্দ লেখাপড়ার অছিলায় শিকারে গেলেন না, শোভনাও শরীর খারাপের বাহানায় থেকে গেলেন। সারা রাত।’

হায় প্রেম! 
কে বলবে, এই জীবনানন্দ টাউন হলের কবিতা পাঠের আসর থেকে পালিয়ে যান!
কোন ভূত? 
কোন ভূত নেমে এলো!

তাহলে প্রেম, ব্যর্থপ্রেম থেকেই কবিতাগুলো জন্ম নিচ্ছে, ভেতরে ভেতরে, সুদীর্ঘ কাহিনিকে আঁকড়ে, জন্ম দিচ্ছে নব নব সাংঘাতিক লক্ষ্যভেদী শব্দের, বাক্যের?

কবিতার পরিসরে ওই বিকলিত মনোবাসনা, চরিতার্থ অথবা চরিতার্থ না হওয়া ঈর্ষা ঘৃণা ধারণ করতে সব সময় সক্ষম হয়নি, তিনি বুঝেছিলেন, কবিতা শেষ পর্যন্ত ক্লেদজ-কুসুম। চেষ্টা করেও তাকে কুসুমের ক্লেদ করে তুলতে পারা যায় না।—সেই অর্থে তো জীবনানন্দ কবি হিসেবে নিজের কাছেই ব্যর্থ। তিনি আখ্যান বলতে বলতে কবিতায় ঢুকে যাচ্ছেন, কবিতা লিখতে লিখতে আখ্যানে এসে জিরোচ্ছেন, ব্যক্তি গূঢ়তম ব্যক্তিতে প্রবেশ করতে করতে পৌছোচ্ছেন নৈর্ব্যক্তিকতায়, নৈর্ব্যক্তিকতার ভেতর যেতে যেতে তিনি ফিরে আসছেন ব্যক্তিগত আশানিরাশায়। তবুও তিনি অভীষ্ট লক্ষে পৌছাতে পারছেন না।

ফলে, আবারো নতুন দৃশ্যের জন্ম দিতে হচ্ছে। জীবনানন্দের ব্যক্তি প্রবণতা  বাংলা কবিতায় একটি মারাত্মক প্রবণতার জন্ম দিলো, হয়তো তা ক্ষতিই করেছে বাংলা কবিতার। জনমান্যতার কারণে বিশুদ্ধ কবিতা চর্চা হারিয়ে গেল, ক্লাসিক কবিতাচর্চা আর হালে পানি পেলো না।  তাঁর আপাত শিথিল সরল কবিতা-শরীর মান্যতা পেয়ে গেল বাংলা কবিতায়, যেন এটাই একমাত্র আদর্শ, রাজমার্গ। কবিতা নয়, কবিতার পেছনের কাহিনিটিই জরুরি হয়ে উঠলো, কবিতা পাঠে। ফিরে এসো চাকা-র চাকাটি 'চক্রবর্তী' কিনা,  জানতে আমাদের নিদ্রা ঘুচে গেল। আরও উত্তরসূরি তৈরি হলো। এই সময়ের শক্তিমান শ্রেষ্ঠ কবি বিষ্ণু দে অনেকটাই অন্তরালে চলে গেলেন। ব্যক্তি-আবেগ, অনুভূতির তুলনায় ঘটনা আখ্যান গল্পের গায়ে ভর দিয়ে কবিতা লেখার চল শুরু হয়ে গেল। এই জাতীয় কবিতাগুলো জনপ্রিয় কবিতার আদর্শ বলে প্রবর্তিত হলো। 

প্রকৃতপ্রস্তাবে জীবনানন্দ ব্যক্তি হতাশাকে বিচার করেছেন ভাগ্য আর পুঁজিবাদের নিষ্ঠুর প্রকৃতির প্রতি কটাক্ষে। ঔপনিবেশিক দেশভাগ ইত্যাদি রাষ্ট্রবিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে, পৃথিবীব্যপ্ত সঙ্কট তাঁর কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়েছে। মন্দার ঝাঁজ ভারতেও এসে পড়েছে, তার প্রত্যক্ষ ফল প্রায় সব মানুষকেই ভুগতে হয়েছে। তিনিও ভুগছেন। চাকরি পাচ্ছেন না। পেলেও তাঁর ব্রাহ্মসংস্কার তাঁকে প্রাথমিকভাবে রুখে দিলেও তিনি বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রথম আঘাতটি করেন ব্রাহ্মসমাজেরই বিরুদ্ধে। উচ্চ পদের গৌরবের প্রতি থুৎকার ছুঁড়ে তিনি যেনতেন একটা 'কাজ' পেতে চেয়েছেন। তাই বিরহী প্রেমের সান্ত্বনা হতে পারে না  তাঁর কবিতা। সুখী নির্ঝঞ্ঝাট মানুষের জীবনানন্দ পাঠ হবে একরকম,  তাঁর মতো বিব্রত সদা-উৎকণ্ঠিত  মৃত্যুমুখো মানুষের পাঠ হবে অন্যরকম।

এই কারণেই, লাবণ্য "মাল্যবাণ" প্রকাশে বাধা দিয়েছেন।

হতাশ ব্যর্থ, বেবির পেছনে ছুটে-মরা জীবনানন্দ, পরনির্ভরশীল জীবনানন্দ, কবিতায় সব বলতে না-পারা জীবনানন্দ,  বেবির রাইট অ্যান্ড লেপ্ট উপেক্ষাপীড়িত জীবনানন্দ, গল্প উপন্যাসে সব লিখেও জীবনানন্দ, কতদিন ট্রাঙ্ক বন্দী থাকবেন? 

'I am walking with bayonet always erect.'

আমি সবসময় বেয়োনেট খাড়া করে হাঁটি।'

কলম, পুরুষাঙ্গ ও বেয়োনেট সব একাকার হয়ে গেল। জীবনানন্দের প্রেরণার জায়গাটিকে আমরা চিনে নিলাম,  'জল রক্ত অশ্রু ঘামের মধুসুধার ভাষা'—উৎস আমাদের জানা হলো।

জীবনানন্দের মৃত্যু নিয়ে, উপন্যাস/গল্পগুলোকে ট্রাঙ্কে লুকিয়ে রাখার কারণ কী হতে পারে, এ বিষয়ে একটি আলোচনার শেষ চরণে লিখেছিলাম ‘ছিনাল প্রেমিকা’ শব্দ দ্বিত্ব। লিখেছিলাম, ‘স্ত্রীর (স্বামীর মতো) মতো অনাত্মীয় পৃথিবীতে আর কেউ নেই’। লিখেই আমি প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে যাই। প্রেমিকা ছিনাল হয় কী করে? আর যদি ছিনাল, তবে সে প্রেমিকা হয় কী করে? যদিদং হৃদয় স্ত্রী কিম্বা স্বামী পৃথিবীতে অনাত্মীয় হয় কী করে?

তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ে যায়, "নোনা মেয়েছেলে" শব্দদ্বিত্বের কথা। মনে পড়ে যায়, ‘শরীরের ফাঁস, হংসীশ্বেত রিংরসা, মহিলার মনন-নিবিড় প্রাণ, রক্ত অশ্রু ঘামের মধুসুধার ভাষা, স্নিগ্ধ স্বার্থবাহদের ঋণ’ ইত্যাদি অনেক শব্দ। এই সমস্ত শব্দদ্বিত্ব বা শব্দগুচ্ছ সৃষ্টির কি উৎস হতে পারে খুঁজতে খুঁজতে অনুসন্ধানের তাড়নায় আমার এতাবৎকালের জীবনানন্দ পাঠ মিথ্যে মনে হলো। শুধু মুদ্রিত আকারে নয়, আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি পাঠের বিরল সুযোগ পেয়েছি। 

আমার সংশয় আছে, আমার পাঠপ্রক্রিয়া কি ঠিক? দেখি সুধীজন কী বলেন, গণ-মাধ্যমে দুটি পোস্ট দিই :
১. জীবনানন্দের চোখে তাঁর পরিবার, সময়, দেশ, কাল, বিশ্ব।
২. লাবণ্য দাশের চোখে জীবনানন্দ।

প্রথম পোস্টটি প্রথাগত জীবনানন্দ চর্চার প্রায় বিপরীতে লিখিত হলেও কেউ বিরূপ মন্তব্য করেননি। বরং অভাবিত প্রশংসাই পেয়েছে। কিন্তু যেই অচরাচরিত পথে, একটু রূঢ় শব্দ ব্যবহার করা হলো, পোস্টের বিরুদ্ধে প্রায় সকলেই রৈরৈ করে ওঠলেন। অনেক সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবি-সম্পাদকও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন।

প্রথম পোস্টে পাঠক-প্রতিক্রিয়ায় আমি খুব আনন্দিত ছিলাম, বাঙালিরা জীবনানন্দকে এতটা ভালোবাসেন! ওই পোস্টের প্রতিক্রিয়া আমার মনে  কয়েকটি প্রশ্নও উস্কে দিচ্ছে, সত্যি কি, যার মাতৃভাষা বাংলা, তিনিই কি জীবনানন্দ পাঠোদ্ধারে সক্ষম?  নাকি, একটা আলগা ভালোবাসা, কতকগুলো বিক্ষিপ্ত বহু-পরিচিত লাগসই পংক্তির প্রতি প্রেমবশত (যেমন দু-দশটা গান/কবিতা দিয়ে রবীন্দ্র পরিচিতি) জীবনানন্দকে জানা? জীবনানন্দের কবিতা পাঠে একই সঙ্গে আমন্ত্রণ ও প্রত্যাখ্যান আছে, সেই সারফেস টেনশন আর ইনার সারফেস টেনশনে সত্যিই কি এখনো পাঠক পৌঁছেছেন, নাকি এখনো ঢেউয়ে লুটোপুটি খাচ্ছেন? নাকি তাঁরা জীবনানন্দকে ভুলে জীবনানন্দ পুজো করছেন? তাঁদের বিরূপতা কি আমাদেরও ওই পদ্ধতিতেই জীবনানন্দ পাঠ করতে বাধ্য করবে? নতুনভাবে পড়তে চাইলে কি এমনই বাধা পেতে হবে? নাকি পাঠক, ভক্তকুল, জীবনানন্দকে নিজের মতো করে একটা বিগ্রহ করে নেবেন? যেমনটা রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন? মিলিট্যান্সি আর মেলানকুলির বাইরে জীবনানন্দকে  কেবল মেনে নিতে হবে, তিনি ‘নির্জনতার কবি’, ‘চিত্ররূপময় কবি‘, চিরায়ত বাংলার রূপসী রূপকথার কবি?  বাংলার ভাঙন নয়, মৃত্যু নয়, কেবলমাত্র রূপকথার রাঙা-রাজকন্যার গল্পের কবি? তাঁর শব্দ-রুচির উৎস, বাক্যগঠনের মনোবিকল তবে জেনে নিতে হবে এইসব প্রচলিত মিথগুলোকে ধরেই? জীবনানন্দ এখনই, এমন এক বিগ্রহ তাঁকে অন্যভাবে দেখবার অধিকারটিও আর কারো থাকবে না?

আমি তাঁর রচনা থেকে তাঁর জীবনে যেতে চাই।

তাঁর ডাইরি চিঠিপত্রগুলোকে আমি চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে চাই। যদি এগুলোকে বিচার করে তাঁর জীবনকে পুনর্নির্মাণ করায় কারও আপত্তি, আমার অনুরোধ, লেখক কবির মৃত্যুর পরেই ওইসব ব্যক্তিগত সামগ্রী  (জীবৎকালে তো একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয় বস্তুই ছিল) চিতায় তুলে দেয়া হোক। আর যদি প্রকাশিত হবে, তাকে অবলম্বন করতে দিতে আপত্তি চলবে না। তাঁর ব্রাহ্মবোধ ও বিরোধিতা, আস্তিক্যবোধ, শূচিতা ও অশূচিতা, যৌনতাবোধ, অবদমিত কাম, কামচরিতার্থতা, সর্বোপরি ব্যক্তিগত জীবনানন্দকে—যিনি ব্যক্তিগত জীবনে মিথ্যে বলছেন, শঠতার আশ্রয় নিচ্ছেন, বেরোজগেরে জীবনে স্ত্রীর গলগ্রহ হয়ে পড়ছেন, আলস্য ভর করে আসছে, আত্মহত্যায় নিজেকে প্ররোচিত করছেন, সেই সময় তিনি কী লিখছেন, কি শব্দের জন্ম দিচ্ছেন, বাক্যের কী এবং কোথায় অদলবদল ভাঙচুর ঘটছে, জানতে আমাকে ওইসব প্রকাশিত অপ্রকাশিত চিঠিপত্র ডাইরি পড়ে কবিতা গল্প/উপন্যাসের চরণে চরণে মিলিয়ে পড়তেই হবে। তাঁর জীবনের তথ্য, ঠিকঠাক না পেলে রচনার কালানুক্রম যেমন ধরা যায় না, তাঁর ভাষা কল্পনারও তেমনি আন্দাজ পাওয়া যায় না, তেমনি তাঁর শব্দ ব্যবহারের উৎসও পাওয়া যায় না। 

প্রকৃতপক্ষে জীবনানন্দ এমন একজন বাঙালি কবি, যাঁর জীবনী নেই। আছে কতকগুলো প্রচলিত মিথ আর মন্তব্য। দু-দফায় মাত্র ১৮ বছর তিনি কলকাতায় ছিলেন, তাও আবার মেসে। মেস তো কলকাতা নামক বাংলা দেশ-বিচ্ছিন্ন শহরের ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ, সে দ্বীপ থেকে কলকাতা নামক শহরে ঢুকতে হয় প্রবল জলোচ্ছ্বাসের বাধা পেরিয়ে। নদীনালার দেশের মানুষটিকেও কি কলকাতা নাস্তানাবুদ করেনি? তাঁকে ননআর্বান কবি বলতে হয় সে বিচারে। তাঁর সম্পর্কে কলকাতা উদাসীন ছিল তাঁর জীবৎকালে। তাঁর প্রতিদিনের বেদনারাঙা দিনগুলো কেউ লিপিবদ্ধ করেননি।  তাহলে, আমরা কী করে জানব জীবনানন্দকে? 

তাহলে তো আমাদের তাঁর জীবনী পুনর্নির্মাণই করতে হবে তাঁরই লেখা কবিতা গল্প উপন্যাস চিঠিপত্র ডাইরি থেকেই।

জীবনানন্দ যখন বিয়ে করেন, স্ত্রীসহ সকলেই জানতেন তিনি দিল্লির কলেজে চাকরি করেন। বাস্তবে তো তিনি তখন সম্পূর্ণ বেকার। এই সত্যিটা প্রকাশ পেলে তিনি তো স্ত্রীর কাছে, শ্বশুরবাড়ির সকলের কাছে একটি মিথ্যাবাদী, ঢপবাজ। যুগের প্রকৃত স্বরূপটিই যেন, ক্রমাগত তারপর তিনি মিথ্যেকেই অবলম্বন করে যাবে, যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই তাদের সুপরামর্শ ছাড়া পৃথিবী অচল হবে, জীবনানন্দ বুঝে গেছিলেন। পৃথিবীতে যৌনলালসা ছাড়া সব লালসা গৌণ, যৌনতাকে ঘিরেই রচিত হবে জীবনধারণের যাবতীয় মহার্ঘতা। কর্পোরেটবিশ্ব সাফল্যকে পর্যন্ত যৌনতায় মুড়ে দিতে পেরেছে। 

অথচ, বিয়েটাও তাঁর 'দুর্ভাগ্য'। তাঁর মন পড়ে আছে Y-এর কাছে। মন আর যৌনতা তো এক নয়, শুধু যৌনতার জন্য প্রকৃতপক্ষে একটি যৌনাঙ্গসহ নারীশরীর চাই, তাতেই প্রতিষ্ঠা করা যাবে তাঁর আকাঙ্ক্ষিত যোনিটিকে।  এমন যৌনহতাশা ভারতীয় উপমহাদেশে কমন, জীবনানন্দ নতুন নয় এ জাতীয় বঞ্চনায়, কিন্তু বলতে পেরেছেন বলেই তিনি আধুনিক। তাঁর তুল্য আধুনিক তাঁর সমকালে আর কোনো কবি নন।

ভারতীয়তায়, ভারতীয় শুদ্ধতার নিরিখে তাঁকে কি চরিত্রহীন বলতে পারি না? অজাচারে আমাদের আজন্ম আকাঙ্ক্ষা আছে, জান্তব নিয়মেই আছে, ইডিপাস কমপ্লেক্স বলে তাকে ভদ্রস্থ করলেও আছে, মানুষ ও মানব বলেই তাকে নিয়মে বেঁধেছি, নীতিনৈতিকতায় বেঁধেছি, আবার মানুষ ও মানব বলেই যুগে যুগে বাঁধনও ছিঁড়েছি, তাকে নৈতিকতা দিতে মিথের পর মিথের স্বাক্ষ্যও ঢুঁড়েছি।  রেবেকা, হেরোডেটাস তো সে সন্ধানেরই প্রক্রিয়া। ‘হৃদয়ের বোন’ শব্দ দ্বিত্বের অর্থ বুঝে নিতে, রহস্য উন্মোচিত করতে  কত দিবস রজনী অপব্যয় হয়েছে ভেবে এখন মরমে মরে যাচ্ছি! —এত সরল আর অগভীর, এত স্বচ্ছ একটা আড়াল! নিজের কবিতার মিথ তিনি নিজেই চুরমার করে দিচ্ছেন তার গল্পে উপন্যাসে! তিনি নিজেই হয়তো অনুমান করতে পেরেছিলেন তিনি বাংলা ভাষার প্রধান কবি আর থাকবেন না, হয়ে উঠবেন প্রধান সাহিত্যিক। জীবনানন্দের কবিতাগুলোয় জীবনানন্দ নিজেই জল ঢেলে দিলেন, আমি আর বহুমাত্রিকতা পাচ্ছি না তাঁর কবিতায়। 

কি লিখছেন ৯ মে ১৯৩০ বিয়ের দিনের ডায়েরিতে?

'লাবণ্য ও বেবির মধ্যে তফাত : বেবিই বাস্তব কিন্তু বেবি টিকবে না।' লিখছেন, একা বিছানায় শুয়ে নিজেকে ব্যাচেলার মনে করে নিলেই হলো।

১৯৩০-এর 'দুর্ভাগ্য' (wretchedness) ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৩-এ 'জঞ্জাল'  (scrap) হয়ে ১৯৪৭-এ 'শ্বাসরোধী' (suffocating) হয়ে দাঁড়াবে।

বিয়েটা কি খুব তাড়াতাড়ি করে ফেললেন? কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই? অর্থনৈতিক প্রস্তুতি তো ছিলই না, পারিবারিক কোনো চাপে, নাকি, বেবির সঙ্গে সম্পর্কটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল বলে সাততাড়াতাড়ি বিয়ের পিঁড়িতে বসা? যেমনটা সম্মান রক্ষা করতে বাঙালি পরিবারগুলো মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে জানে বিয়েতে বসা?

লাবণ্যর কথাটা ভাবলেন না? এরকম নষ্ট চরিত্রের লোকটিকে শ্রদ্ধার আসনে কোন নারী স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবেন?

এই কথাগুলো তো তাঁর গল্পে উপন্যাসে সরাসরি এসেছে, কিন্তু কবিতায়?

১৯৩১-এ লেখা 'বিবাহিত জীবন' গল্পে অজিত বিয়ে করে সুপ্রভাকে নিয়ে ফিরছে অথচ সুপ্রভার 'নারীসৌন্দর্য' তাকে স্পর্শ করে না। অজিতের চোখ খুঁজে বেড়ায় সতীকে।

বিয়ের 'হুলুস্থুল' এড়িয়ে 'অনাবিষ্কৃত কোঠায়' বউকে তুলেও নববধূর প্রতি কোনো প্রয়োজন বোধ করছে না। বরং সতী চলে গেলে ভোজবাজি ফুরিয়ে যাবে, কেননা জাদুগুলো একমাত্র সতীই জানে। দশ বারো দিনের জন্য নয়, সারাজীবনের জন্য।

অজিত বলে এই বিয়ের প্রয়োজন ছিল না, উত্তরে সতী বলে, কেন করলে তবে বিয়ে।

শোভনা গৌতম মিত্রকে সাক্ষাৎকারেও জানিয়েছিলেন, মিলুদার বিয়ে করবার কী প্রয়োজন ছিল। সেই ৮১/৮২ বছর বয়সেও শোভনা তবে 'সতী'ই তো! মিলুদাকে ভালোই খেলিয়ে গেছেন।

বিরাম মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কবি জানতে চাইছেন, স্ত্রী যদি আপনার আমন্ত্রণে ঘনিষ্ঠ হবার প্রস্তাবে সায় না দেয় তখন কী করবেন? লিখছেন, গৌতম। যৌন কাতরতা কী দুর্বিসহ যন্ত্রণা, পাশে স্ত্রী, কিন্তু যৌনবিমুখ, তখন যে হস্তমৈথুনের সুযোগটাও থাকে না! কমলকুমার পিঞ্জরে বসিয়া শুক উপন্যাসে লিখেছিলেন, বোবা হলেও নোলা তো আছে… জীবনানন্দ সেই জিভকাটা যৌন বুভুক্ষু ভিখিরি,  লকড়ভীতিকে উপেক্ষা করেও সঙ্গম দৃশ্য দেখে যাবেনই, তাতে মৃত্যু হলেও হোক। জীবনানন্দ এখানেই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রকৃত প্রতিভূ হয়ে উঠলেন, অক্ষম পুরুষের পুং লিঙ্গটির চেয়ে গুরুভার কিছু নেই, আত্মরতি ছাড়া নান্য পন্থা ভারতীয় যৌবনের!

বোনের অনুষঙ্গে প্রেয়সী প্রতিকায়িত হচ্ছে কবিতায় কবিতায়। তিনি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মিথের আড়াল 'হৃদয়ের বোন'কে তাঁর প্রেম জানাতে। একটি বিশুদ্ধ চাকরির অভাবে যৌনকাতরতায় ছিন্নভিন্ন জীবনবাবু জীবন ও জগতের অন্য তাৎপর্য পাচ্ছেন, শিল্পী বলে তাঁকে ক্ষমা করছি, লাবণ্যও মিনমিন করে মেনে নিচ্ছেন তিনি জীবনানন্দকে চিনতে পারেননি ঠিক, তিনি অন্যায় করেছেন, প্রতিভা কী নিদারুণ ব্যক্তিঘাতী! আমি লাবণ্যর কোথাও কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। বরং মনে হচ্ছে জীবনানন্দ প্রগতিপন্থী ব্রাহ্ম হলেও তিনি সেই চিরায়ত পুরুষ, নিজে অজাচার পর্যন্ত করবেন কিন্তু স্ত্রীকে চাইবেন শুদ্ধ পবিত্র অক্ষত যোনী।

বিয়ের পরপরই ডায়েরিতে লিখছেন :
‘জেলাসিস রিকল্ড : মাইন টু ফোর।
জেলাসিস রিকল্ড : হার টু ওয়াই।'

লাবণ্যর চারজন প্রেমিক, বিয়ের পর পরই জানা, তারপর আরও তিনজন প্রেমিকের সন্ধান জীবনানন্দকে জেলাস করে তুলছে; লাবণ্যও জেলাস ফিল করছেন বেবি বা শোভনা বা ওয়াইয়ের কথা জেনে।  লাবণ্যর সঙ্গে বিয়ের আগেই যে লাবণ্য ওয়াইয়ের কথা জানতেন তা ডায়েরির সূত্রে জানা যাচ্ছে। পরে পরে আন্দাজ করেছেন লীলাময়ী বা খুন্টির সঙ্গে সম্পর্কটি।

তাহলে লাবণ্য জেনেশুনে জীবনানন্দকে বিয়ে করলেন কেন? 

এও তো সমাজে প্রতিষ্ঠিত সত্য, সোনার আংটি বাঁকা হলেও তা সোনা; অমন একটুআধটু চরিত্রদোষ কোন পুরুষের নেই? আমাদের দেশের মেয়েরা এসবে অভ্যস্থ, বিয়ের পর ও-জাতীয় চরিত্রস্খলন কেটে যায়। এ পর্যন্ত ঠিক আছে।

কিন্তু জীবনানন্দ যে মিথ্যেবাদী, তিনি যে ঢপবাজ। না পিএইচডি ডিগ্রি,  না অধ্যাপকের চাকরি আছে তাঁর, একটি ফ্রেস মিথ্যেবাদী ও ঢপবাজের সঙ্গে লাবণ্যর বিয়ে হয়েছে, এটা কোনো পতিব্রতা নারীর পক্ষেও মানা সম্ভব নয়। তার ওপর লাবণ্য তো বিপ্লবী, তদুপরি  ব্রাহ্ম ও শিক্ষিতা। স্বামী নামক অলীকের গৌরবে গৌরবান্বিত হওয়ার বাঙালিনী বাসনাটি তাঁর খানখান হয়ে গিয়েছিল বিয়ের রাতেই। বিপ্লবিনী তার শোধ নিতেই পারেন, না নিলেই তাঁর যৌবনের বিপ্লবীপন্থার অগৌরব। তাঁর আরও বেশি ভায়োলেন্ট হওয়া উচিত ছিল। বুদ্ধদেব বসুই সম্ভবত বলেছিলেন, লাবণ্য জীবনানন্দকে ঝাঁটাপেটা করতেন। স্বামী যখন শ্রদ্ধার আসনে আর থাকেন না, ঝাঁটাপেটা তখন খুব সাধারণ বিষয়! 

কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, জীবনানন্দের মতো প্রতিভাবান স্বামী পাওয়াই তো লাবণ্যর  ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা প্রাপ্তি। জীবৎকালে জীবনানন্দ লাবণ্যর জীবনে একটি বোঝা। তার কবিখ্যাতি প্রেমেন্দ্র মিত্রের তুলনায় ছিল নগন্য। আর্থিক দিক থেকে কাব্যচর্চা লোকশানের।

বিবাহের প্রথমেই যে ভুলটি জীবনানন্দ করে বসলেন, তা তাঁকে সারাজীবন স্বস্তি দেয়নি, দেবার কথাও নয়, দেবে না, তাও তিনি জানতেন।

‘জেগে উঠে সত্যেনের মনে হল, ও-রকম হবে একদিন—হবেই—শেফালিকে নিয়ে—হয়তো মাধুরীকে নিয়ে—দু'জনকে নিয়েই—অনেককে নিয়ে—অনেক প্রিয়বস্তু নিয়ে—কবরের ভিতর নয়—অনেকগুলো নক্ষত্রের মধ্যে তারা শুয়ে রইবে।' 

বিয়ের এক বছরের মধ্যে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে জীবনানন্দর ডাইরিতে লিখছেন, 'প্রধানত লাবণ্যকে ঘিরে এক হাজার একঘেয়ে পারিপার্শ্বিকতার কারুণ্য ও আইরনি এবং তার দশ হাজার প্যাথেটিক ডিটেলস।… লাবণ্যর মৃত্যু হলে বা গোপনে পালিয়ে গেলে বা ডিভোর্স হলে আমি মুক্তি পাই।'

'স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক...  খানিকটা মাংস নিয়ে, আবার সেই টাকার হিসেব নিয়ে।' তিনি অনুভব করছেন, ‘কোনও বধূকে নিয়েই আর্টিস্টের একাকী জীবনের কোনও সাহায্য হয় না। তুচ্ছ তুচ্ছ ভয় আমার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে।' 

আর রয়ে গেছে অপরিমিত কাম, সে  কামকে পরিতৃপ্তি দিতে পারে না ধর্ষিত হতে থাকা স্ত্রীও। হতাশ জীবনানন্দ লিখছেন, 'যে ক্ষুধা তাতে মাংস ডিম দুধ etc. would do something... কিন্তু চা আর বিড়ি চুরুট দিয়ে মেরে রাখতে হয়।'

'God has given man too many seed...a too much sex desire...'

লিখছেন,
'...christian literature and churches seem somehow to be a mythical and futile figure in comparison with Krishna as when masturbating may seem futile in comparison with Lila Bhattacharya, Amiya Datta, Fulu Datta, Anjali Banerjee, Soraja Mukherjee, Jharna Chatterjee,Biva Bose, Malina Banerjee.'

লিখছেন :
'যখনই ওয়াইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই—আমার শারীরিক ও অন্যান্য কদর্যতা অনুভূত হয়। আর সেই অন্যান্য কদর্যতার মধ্যে আছে বিকলাঙ্গতা, পৌরুষহীনতা ও বেকারত্ব।'
তখন তো থাকে চরিতার্থহীন কামের স্মৃতি আর কষ্ট। হৃদয়ের বোন শব্দ দ্বিত্বের অর্থ পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। পরিষ্কার হয়ে যায়, 'ব্যথার রেবেকা' শব্দ দ্বিত্বের অর্থও।

লিখছেন, 'আমার frustration-এর কারণ এই Herodias's Daughter'। 

১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৩ লিখছেন : 'সারাদিন কাঁদে... আমাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়... কি করব? আত্মহত্যা?' ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ : ‘সেই এক পুরনো প্রত্যাখ্যান... কথা বন্ধ... অনুভূতিহীন নঞর্থক।' ৩১ আগস্ট ১৯৩৪  লিখছেন : 'তিন চারদিন ধরে ভয়ঙ্কর অবস্থা... দরজা বন্ধ, নাওয়া না, খাওয়া না, শুধু মুড়ি... উপোস করে মরে যাবে... ওকে ভূতে পায় নাকি?' আর এই বছরই লিখবেন রূপসী বাংলা। কেবল বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি? 'মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হল খড় আর ঘর।' নয়?

এমন একটি অসৎ মানুষের তো ন্যায্য প্রাপ্তি

'বলির কুমড়ো', 'ড্যাকরা মিনসে', 'ইঁদুরে','ঘানির বলদ'  ‘বেহায়া মড়া' সম্বোধন। স্ত্রী কি যৌনযন্ত্র? সঙ্গমকালে নারীটি লাবণ্য হলেও তিনি তো সঙ্গমে লিপ্ত বেবির সঙ্গে, মনিয়ার সঙ্গে, লাবণ্য ধর্ষিত হবেন কেন?

এই সময়ের কবিতাগুলো পড়ুন পাঠক, দেখুন সন্ত জীবনানন্দকে।

এমন একজন মিথ্যুক, দুশ্চরিত্রের মানুষকে সারাজীবন লাবণ্য দাশ টেনে গেছেন ভালো মানুষের বিটি বলেই তো?

জীবনানন্দ কেন আমৃত্যু তাঁর গল্প উপন্যাসগুলিকে প্রকাশ করতে পারেননি, বুঝতে খুব অসুবিধে নেই তো।

সারা জীবন লাথ খেতে খেতে কোনো লাথখোর মৃত্যুর পরও লাথ খাবার মনোবাসনা নিয়ে মৃত্যু অথবা আত্মহত্যা, যে তরিকাতেই হোক, বেঁচে থাকাটাকে ফিনিস করে না। বাক্স ভর্তি অত অত এভিডেন্স, ক্রিমিনালও চেষ্টা করে যাবতীয় ক্লু মুছে দিতে, অপরাধভীত জীবনানন্দ ক্লু মুছে দেবেন না, তা হয়; সদা জাগ্রত বিড়ালের সতর্ক দৃষ্টিতে ইঁদুরের অসহায়তা নিয়ে একটি জীবন অতিবাহিত করার পরও?

মরতে তিনি চাননি, তা যতই হেতুবিহীন, এবং অথবা স-হেতু মৃত্যুর কথা বলুন। মৃত্যু মানে, সবকিছুর মৃত্যু। এত সবিস্তারে মৃত্যুকে জীবনানন্দ ভয় পেতেন। তাঁর উদ্যত আত্মহত্যার পথে বাক্স ভর্তি পাণ্ডুলিপি, ডাইরিগুলো প্যাঁচার মতো জেগে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। বাঁচিয়ে রেখেছিল Y K XZ-রা।

বেঁচে থাকার সঙ্গে মরে যাওয়ার দ্বন্দ্ব—এত ট্রাজিক মৃত্যুর গল্প  বাংলাসাহিত্য আগে পাযয়নি। কমলকুমারে মৃত্যু ছিল রেপ অব দি বিউটি, জীবনানন্দে পেলাম ফাক অব দি আগলি।

ওহো, আনমনা, জীবনানন্দকে তবে শ্লথগতির ট্রামের আগে আগে দ্রুতগতির মৃত্যুই গিলে নিয়েছে, যেমন করে তিনি বার্ধক্যে মারা যেতেন, যেমন করে একটু গুছিয়ে মরতেন, প্রায় তেমনি। 

সাহিত্যিক লুই বোর্হেস ভারী সুন্দর একটা কথা বলেছিলেন, ‘Except for mankind, all creatures are immortal, as they are ignorant of death’! 

‘জানা’ই কি তাহলে কাল হলো আমাদের? ‘এইখানে জ্ঞান হতে বেদনার শুরু’?

সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে মরাটাই যে ভারতীয় ঐতিহ্য, জীবনবাবু!!
নমঃপূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।


হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায় কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং সম্পাদক। ১৯৬১ সালের ৩ জানুয়ারি ভারতে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ সালে  ‘কমলকুমার মজুমদার : জীবন ও শিল্প’ নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। সম্পাদনা : চতুরঙ্গ, প্রতিক্ষণ, কেতকী, কিংবদন্তিরাষ্ট্রদ্রোহীরা ছাড়াও একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা।

menu
menu