আপনি এবং পরমাণু বোমা
[জর্জ অরওয়েল এর এই নিবন্ধটি ১৯৪৫ সালের ১৯ অক্টোবর লন্ডনের ট্রিবিউন* সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল। নিবন্ধটি মূলত জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলার দুই মাসের মধ্যে ১৯৪৫ সালের ১৯ অক্টোবর লন্ডনের ট্রিবিউন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের ওপর ‘ফ্যাট ম্যান’** নামের আরেকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
অনুমান করা হয় যে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ লোক নিহত হয়। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক নিহত হয় এবং পরবর্তী সময়ে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করে আরও ২১৪,০০০ জন। জাপানের আসাহি শিমবুনের করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২৩৭,০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। জাপানের আত্মসমর্পণের পেছনে এই বোমাবর্ষণের ভূমিকা এবং এর প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে অধিকাংশের ধারণা এই বোমাবর্ষণের ফলে যুদ্ধ অনেক মাস আগেই সমাপ্ত হয়, যার ফলে পূর্ব-পরিকল্পিত জাপান আক্রমণ সংঘটিত হলে উভয় পক্ষের যে বিপুল প্রাণহানি হতো, তা আর বাস্তবে ঘটেনি। অন্যদিকে জাপানের সাধারণ জনগণ মনে করে এই বোমাবর্ষণ অপ্রয়োজনীয় ছিল, কেননা জাপানের বেসামরিক নেতৃত্ব যুদ্ধ থামানোর জন্য গোপনে কাজ করে চলেছিল।
অরওয়েল একই বিষয়ে যথেষ্ট লিখেছেন কিন্তু এই বিশেষ রচনাটি পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে এগিয়ে থাকা বিশ্বশক্তি সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টির বর্ণনা করার কারণে আজও ব্যতিক্রমী হয়ে আছে। এছাড়া এটা স্পষ্ট যে এই রচনা তার নাইনটিন এইটি ফোর উপন্যাসের ভিত্তি তৈরির কাজটিও সম্পন্ন করেছে। ‘আপনি এবং পরমাণু বোমা’ নিবন্ধটি পথিকৃত হয়ে উঠেছে কারণ অরওয়েল ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক যুদ্ধোত্তর পরিবেশ বোঝাতে এখানেই প্রথম ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলার মাত্র আড়াই মাস পরে প্রকাশিত অরওয়েলের ‘আপনি এবং পরমাণু বোমা’ রচনাটি পূর্বে অকল্পনীয় ও শক্তিশালী একটি নতুন অস্ত্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে গভীর বিশ্লেষণে তুলে ধরার প্রথম প্রচেষ্টা হিসাবে উল্লেখযোগ্য।
* লন্ডন থেকে প্রকাশিত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক সাময়িকী ট্রিবিউন ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন এই সাময়িকীটি বামপন্থী সত্তা নিয়ে সাধারণত লেবার পার্টিকে সমর্থন করে। সাময়িকীটির পূর্ববর্তী সম্পাদকদের মধ্যে অ্যানিউরিন বেভান (ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী যিনি জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠার নেতৃত্বে ছিলেন), লেবার পার্টির প্রাক্তন নেতা মাইকেল ফুট উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েল সাময়িকীটির সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন। ট্রিবিউনে ১৯৪৩ সালে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান জর্জ অরওয়েল। সাহিত্য সম্পাদকের ভূমিকায় ফরমায়েশি লেখা এবং রিভিউ লেখার পাশাপাশি তিনি একটি ধারাবাহিক কলাম লিখেছেন যা ‘অ্যাজ আই প্লিজ’ শিরোনামে প্রকাশিত ও প্রশংসিত হয়। অরওয়েল ১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে ট্রিবিউন ছেড়ে দ্য অবজারভার পত্রিকার যুদ্ধ সংবাদদাতা হলেও তিনি ১৯৪৭ সালের মার্চ পর্যন্ত সাময়িকীটিতে নিয়মিত অবদান রাখেন।
** হতাহত বিষয়ক তথ্যসূত্র : Downfall: The End of the Imperial Japanese Empire. By Richard B. Frank (2001), Penguin Publishing.]
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের সকলের দেহ হাজারো টুকরো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মনে হলেও সেই তুলনায় পারমাণবিক বোমা সম্পর্কে আশানুরূপ সুদীর্ঘ বিতর্ক উত্থাপিত হয়নি। সংবাদপত্রসমূহে প্রোটন এবং নিউট্রন কীভাবে কাজ করে তার অসংখ্য নকশা প্রকাশ হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য এসব ছিল একদম অপ্রয়োজনীয়। তাছাড়া, এই বোমাকে ‘আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত’ ইত্যাদি ধরনের প্রতিবেদনের পুনরাবৃত্তি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু আমাদের সর্বজনীন অতি গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের প্রশ্নটির বিষয়ে কোনো সংবাদ মাধ্যমে আশ্চর্যজনকভাবে খুব কমই উল্লেখ হয়েছে, অর্থাৎ ‘এই বস্তুটি তৈরি করা কতটা কঠিন?’
এই ধরনের তথ্য আমাদের অর্থাৎ বৃহত্তর অংশের জনসাধারণের কাছে এসেছে বরং পরোক্ষ উপায়ে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে নির্দিষ্ট গোপনীয়তা হস্তান্তর না-করা বিষয়ে রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানের সিদ্ধান্তের প্রস্তাবে। কয়েক মাস আগে বোমাটি যখন কেবল একটি গুজবই ছিল তখনো ব্যাপকভাবে বিশ্বাস ছিল যে পরমাণুকে বিভাজন কেবলমাত্র পদার্থবিদদের একটি সমস্যা। তারা এই সমস্যাটির সমাধান করলেই একটি নতুন এবং বিধ্বংসী অস্ত্র প্রায় সবার নাগালের মধ্যে থাকবে। (তাই গুজব ছড়িয়েছিল, যেকোনো মুহূর্তে কোনো পরীক্ষাগারে বসে কতিপয় নিঃসঙ্গ চন্দ্রাহত মানুষ হয়তো আতশবাজির মতো সহজেই মানবসভ্যতাকে উড়িয়ে দিবে।)
গুজবটি সত্যি হলে হয়তো হঠাৎ করেই ইতিহাসের মোড় ঘুরে যেত। বড় রাষ্ট্র এবং ছোট রাষ্ট্রের মধ্যে ভেদাভেদ ঘুচে যেত। এছাড়াও ব্যক্তির ওপর রাষ্ট্রের ক্ষমতা একদম দুর্বল হয়ে যেত। যাই হোক, রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানের বক্তব্য এবং সেই বক্তব্যের ফলশ্রুতিতে প্রকাশিত বিভিন্নজনের মন্তব্য শুনে মনে হয় যে বোমাটি কল্পনাতীতভাবে ব্যয়বহুল এবং এর উত্পাদন প্রক্রিয়াটি প্রকাণ্ড শিল্পোদ্যোগের দাবি রাখে। আর এই কারণে বিশ্বের মাত্র তিন থেকে চারটি দেশ পরমাণু বোমা তৈরি করতে সক্ষম। বিষয়টি মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ দাঁড়ায় যে পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার ইতিহাসকে পাল্টে দেয়ার নামে শুধুমাত্র গত এক ডজন বছর ধরে স্পষ্ট হয়ে আসা প্রবণতাসমূহকে তীব্র করে তুলবে।
বলা বাহুল্য যে সভ্যতার ইতিহাস মূলত অস্ত্রের ইতিহাস। বিশেষ করে, বারুদের আবিষ্কার এবং মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কর্তৃক সামন্তবাদকে উৎখাতের মধ্যেকার যোগসূত্রের উল্লেখ করা হয়েছে বারবার। যদিও আমার কোনো সন্দেহ নেই যে কিছু ব্যতিক্রম থাকতেও পারে। আমি মনে করি নিম্নলিখিত সূত্রটি সাধারণভাবে সঠিক হতে পারে : যে যুগে প্রভাবশালী অস্ত্র তৈরি করা ব্যয়বহুল বা কঠিন সেই যুগ স্বৈরাচারের দখলে যাবে। আর যেখানে প্রভাবশালী অস্ত্র তেরি করা সস্তা ও সহজ সেখানে সাধারণ জনগণ সুযোগ নিতে পারে। সেইভাবে উদাহরণ হিশেবে ট্যাঙ্ক, যুদ্ধজাহাজ এবং বোমারু বিমানসমূহকে সহজাতভাবে নৃশংস অস্ত্র বলা যায়। একইভাবে বেলা যায় রাইফেল, মাস্কেট, লং-বো এবং হ্যান্ড-গ্রেনেডসমূহ সহজাতভাবে গণতান্ত্রিক অস্ত্র। একটি জটিল অস্ত্র শক্তিমানকে আরও শক্তিমত্তা দান করে। অপরদিকে যেখানে কোনো কৈফিয়ত নেই সেখানে একটি সাধারণ অস্ত্র দুর্বলদের শক্তি দান করে।
মাস্কেট ও রাইফেলের যুগ ছিল গণতন্ত্র ও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের মহান যুগ। ফ্লিন্টলক আবিষ্কারের পরে এবং পারকাশন ক্যাপ আবিষ্কারের আগে মাস্কেটই ছিল মোটামুটি একমাত্র দক্ষ অস্ত্র। আর এটি তৈরি করা সহজসাধ্য বলেই যেকোনো স্থানে উৎপাদনও সম্ভব। এর গুণাগুণের মিশেলে মার্কিন ও ফরাসি বিপ্লবের সাফল্য ত্বরান্বিত হয় এবং একটি জনপ্রিয় আবিষ্কারকে আমাদের নিজেদের কালের তুলনায় আরও গুরুতর শিল্পে পরিণত করে। মাস্কেটের পর এল ব্রিচ-লোডিং রাইফেল।
অস্ত্রটি তুলনামূলকভাবে জটিল ছিল তবুও এটি এখন অনেক দেশে উত্পাদন সম্ভব এবং দামেও সস্তা, সহজে চোরাচালানযোগ্য এবং অস্ত্রসমূহের মধ্যে সহজলভ্য। এমনকি সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জাতিসমূহ সবসময় এক বা একাধিক উত্স থেকে রাইফেলগুলো সংগ্রহ করতে পারে। এর ফলে বোয়ার্স, বুলগার, অ্যাবিসিনিয়ান, মরোক্কান—এমনকি তিব্বতিরাও তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে। কিন্তু সেই অনুসারে সামরিক কৌশলের প্রতিটি ক্রমবিকাশ সবসময় রাষ্ট্রের পক্ষে অর্থাৎ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তেমনি এই ক্রমবিকাশের অবস্থান শিল্পোন্নত দেশের পক্ষে এবং পশ্চাৎপদ দেশের বিপক্ষে। ক্ষমতার উৎসবিন্দুর সংখ্যা নেহায়েতই কম। ইতোপূর্বে ১৯৩৯ সালে বিশাল আকারে যুদ্ধ চালাতে সক্ষম দেশ ছিল মাত্র পাঁচটি, আর এখন আছে মাত্র তিনটি—শেষ পর্যন্ত সম্ভবত থাকবে মাত্র দুটি। এই প্রবণতাটি বছরের পর বছর ধরে সংশয়াতীত ছিল এবং ১৯১৪ সালের আগেও কয়েকজন বিজ্ঞ পর্যবেক্ষক এমনটিই ইঙ্গিত করেছেন। একটি অস্ত্রের আবিষ্কারই শুধু এই অবস্থাকে পাল্টে দিতে পারে। অথবা আরও বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে শিল্প কারখানার বিশাল আয়োজন-নির্ভরতাহীন যুদ্ধের কোনো কৌশলের মাধ্যমে।
বিভিন্ন উপসর্গ থেকে সহজে অনুমিত হয় যে রাশিয়ানরা এখনো পরমাণু বোমা বানাবার গুপ্ত বিদ্যাটি রপ্ত করতে পারেনি। পক্ষান্তরে, অনেকেই আবার একটি বিষয়ে একমত বলে মনে হয় যে তারা কয়েক বছরের মধ্যে এই কৃতিত্বেরও অধিকারী হয়ে উঠবে। সুতরাং আমাদের সামনে দুই বা তিনটি দানবীয় সুপার-স্টেটের সম্ভাবনা রয়েছে, যাদের প্রত্যেকের কাছে থাকবে এমন এক অস্ত্র যেটি প্রয়োগ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব। তাদের নিজেদের মধ্যে পৃথিবীকে ভাগাভাগি করে নেবে।
বরং তড়িঘড়ি ধারণা থেকে এর অর্থ দাঁড়ায় যে এর ফলে বিশ্ব আরও বড় এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে এবং সম্ভবত এভাবেই যান্ত্রিক সভ্যতার প্রকৃত সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু মনে করা যাক, সত্যিই যদি এমন হয় যে বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ জাতিসমূহ একে অপরের বিরুদ্ধে কখনই পরমাণু বোমা ব্যবহার না করার শর্তে একটি অকথিত চুক্তি করে? অথবা ধরুন যেসব দেশ প্রতিশোধ নিতে অক্ষম তাদের বিরুদ্ধে যদি শুধুমাত্র বোমাটি প্রয়োগ করে বা প্রয়োগের হুমকি দেয়? সেক্ষেত্রে বলাই যায় আমরা আমাদের অতীতের জায়গায় ফিরে গিয়েছি, একমাত্র পার্থক্য বলতে গেলে এখনো কম লোকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত আর শাসনাধীন ও নিপীড়িত শ্রেণির ভবিষ্যত্ এখন আরও আশাহীন।
জেমস বার্নহাম তার ‘দ্য ম্যানেজারিয়াল রেভলিউশন’ লেখার পর অনেক আমেরিকানদের কাছে মনে হয়েছিল যে জার্মানরা ইউরোপীয় যুদ্ধে অবশ্যই জয়ী হবে। তাই অনুমান করা স্বাভাবিক ছিল যে রাশিয়া নয়, বিশাল ইউরেশিয়ান অঞ্চলের ওপর আধিপত্য করবে জার্মানি। অন্যদিকে জাপান হবে পূর্ব এশিয়ার প্রভূ। এই ভবিষ্যদ্বাণীটি ভুল বলে প্রমাণিত হলেও মূল যুক্তিকে প্রভাবিত করে না। বার্নহ্যামের ভবিষ্যদ্বাণী মতে নতুন বিশ্বের ভৌগলিক চিত্র সঠিক প্রতিপাদিত হতে দেখা গেছে। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্ব-নির্বাচিত অভিজাত গোষ্ঠী দ্বারা কোনো-না-কোনো ছদ্মবেশে শাসন করা তিনটি বিশাল সাম্রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠ। সীমানা কোথায় টানতে হবে তা নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি এখনো চলমান এবং আরও কয়েক বছর ধরে চলতে থাকবে। তিনটি সুপার-স্টেটের তৃতীয়টি অর্থাৎ পূর্ব এশিয়ার দেশ চীনের আধিপত্য বাস্তবের চেয়ে এখনো সম্ভাবনাময়। কিন্তু সাধারণ ঘটনাপ্রবাহ এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সুস্পষ্টভাবে সেটিকে ত্বরান্বিত করেছে।
আমাদের একবার বলা হলো যে উড়োজাহাজ ‘সীমানা বিলুপ্ত করে দিয়েছে’; প্রকৃতপক্ষে উড়োজাহাজ একটি গুরুতর অস্ত্র হয়ে ওঠার পর থেকে সীমান্তগুলো স্পষ্টভাবে অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছে। একসময় আশা করা হয়েছিল যে বেতারযন্ত্র হয়তো আন্তর্জাতিক প্রতীতি ও সহযোগিতাকে ত্বরান্বিত করবে। অথচ এটি একটি জাতি থেকে অন্য জাতিকে আলাদা করার যন্ত্র হয়ে উঠেছে। পারমাণবিক বোমাটি শোষিত শ্রেণির এবং জনগণের বিদ্রোহ করার সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেবে। সেই সঙ্গে বোমার অধিকারীদের মধ্যে সামরিক সমতাভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপন এই প্রক্রিয়াটির ষোলোআনা পূর্ণ করতে পারে। একে অপরকে জয় করতে অক্ষম কতিপয় দেশ নিজেদের মধ্যে বিশ্বের শাসনক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ধীর এবং অনিশ্চিত জনসংখ্যা-বিষয়ক পরিবর্তন ব্যতীত ভারসাম্য কীভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে তা জানা খুবই দুরূহ।
বিগত চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর ধরে মিস্টার এইচ জি ওয়েলস এবং অন্যরা আমাদের সতর্ক করে আসছেন যে মানুষ নিজের তৈরি অস্ত্র দিয়ে নিজেকে ধ্বংস করার ঝুঁকিতে রয়েছে, পৃথিবীর দখল চলে যেতে পারে পিঁপড়া বা অন্য কোন যূথচারী প্রজাতির দখলে। যারা জার্মানির ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরসমূহ দেখেছেন তারা এই ধারণাটিকে অন্তত চিন্তার বিষয় বলে মনে করেন। তা সত্ত্বেও সমগ্র বিশ্বের প্রবণতার দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি বহু দশক ধরে সেটি নৈরাজ্যের দিকে নয় বরং দাসত্বের পুনর্বহালের দিকে ঝোঁকপ্রবণ। আমরা হয়তো সাধারণ বিভাজনের দিকে না-গিয়ে বরং প্রাচীনকালের দাস সাম্রাজ্যের মতো ভয়ঙ্কর স্থিতিশীল একটি যুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জেমস বার্নহামের তত্ত্বটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও কমসংখ্যক লোকই এখনো তার মতাদর্শগত নিহিতার্থ বিবেচনা করেছেন। অর্থাৎ, বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির ধরন, বিশ্বাসের ধরন এবং সামাজিক কাঠামো প্রবল হয়ে ওঠার ফলে কোনো রাষ্ট্র একাধারে অজেয় এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধরত স্থায়ী রাষ্ট্র হয়ে উঠবে।
পারমাণবিক বোমাটি যদি দ্বিচক্রযান বা অ্যালার্ম ঘড়ির মতো সস্তা এবং সহজে তৈরি করা সম্ভব হয় তাহলে এটি আমাদেরকে বর্বরতার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে এর অর্থ হতে পারে জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত পুলিশ রাজের অবসান। যদি মনে হয় এটি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করার মতো কঠিন, বিরল এবং ব্যয়বহুল ব্যাপার তাহলে অনিশ্চিতভাবে একটি ‘শান্তি যা আদতে শান্তি নয়’ স্থাপনের মূল্যে বড় আকারের যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে।
মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র নির্মাণ, আবৃত্তি ও অনুবাদের পাশাপাশি একজন পরিব্রাজক। বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। তাঁর পৈত্রিক আদিনিবাস ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিকস্থান কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে। ভারতবর্ষে ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ গ্রন্থ চাচনামাহ্ -এর প্রথম ও পূর্ণাঙ্গভাবে অনুবাদ তার হাতে।