সমকালীন ফিলিস্তিনি দুটি গল্প

ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত গাজার আকাশের নিচে বেঁচে থাকা
মূল : হায়া আবু নাসের
 
[উই আর নট নাম্বার্স অনলাইন ম্যাগাজিনের সম্পাদকের কথা : কল্পকাহিনি (ফিকশন) এমন অনেক সত্য প্রকাশ করে, যা বাস্তবতাকে দুর্বোধ্য করে তোলে এবং শিশুশ্রম বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। এই ছোটগল্পে লেখিকা একজন ফিলিস্তিনি শিশুর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

হায়া আবু নাসের একজন ফিলিস্তিনি নারী লেখক, কবি ও মানবাধিকার কর্মী। তাঁর পরিবার মূলত ডিয়ার-স্নেইড থেকে এসেছেন। তিনি ২০২০ সালে ইংরেজি সাহিত্য এবং মানবিক বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি ফিলিস্তিনের বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে কাজ করেছেন। তাঁর গল্প ও কবিতা বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যেমন—অগ্নি, স্কাউন্ড্রেল টাইম, এভারগ্রিন রিভিউ, দ্য নরমাল স্কুল, দ্য রাম্পাস, এয়ারলাইট, দ্য ম্যাসাচুসেটস রিভিউ এবং অ্যাপোজি। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ার লিংকন ইউনিভার্সিটি কলেজে আন্তর্জাতিক বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। 

গল্পসূত্র ও সার কথা : ‘ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত গাজার আকাশের নিচে বেঁচে থাকা’ গল্পটি হায়া আবু নাসেরের ইংরেজিতে ‘সারভাইভিং বিনিথ গাজা’স টেমপেস্ট স্কাইস’ গল্পের অনুবাদ। ইংরেজিতে গল্পটি উই আর নট নাম্বার্স অনলাইন ম্যাগাজিনে ২৮ জানুয়ারি ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।]


আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, একশো দিনের যুদ্ধ এবং মৃত্যুর পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা শক্তিশালী এক আত্মা। আমি এবং আমার পরিবার চল্লিশ দিন আগে চতুর্থবারের মতো গৃহহীন হয়েছি এবং অবশেষে আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় একটি খালি সাদা তাঁবুতে বসতি স্থাপন করেছি। আমরা গ্রীষ্মের সময় পাতলা পায়জামা পরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম এবং বোকার মতো ধরে নিয়েছিলাম যে, শীতের ঠান্ডা শুরু হওয়ার আগেই এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ত্রিশ হাজারেরও বেশি গৃহহীন মানুষকে স্বাগত জানিয়েছে এবং মাঠটিকে শিক্ষার স্থান থেকে রূপান্তরিত করে শরণার্থী শিবির বানিয়েছে। নৃশংস হামলায় বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে চার হাজার শিক্ষার্থী এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে হারিয়েছে।

এক বিষণ্ন রাতে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছি এবং মাথার ওপরে সামরিক বিমানগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি। যুদ্ধ বিমানের ক্রমাগত গুঞ্জন স্মরণ আমাকে করিয়ে দিয়েছে যে, তারা নৃশংসভাবে আমাদের সন্তান, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। তারা আমাদের সীমাহীন দুঃখ-শোকের সাগরে নিমজ্জিত করছে। যখন তারা যুদ্ধ বিমান নিয়ে আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে যায়, তখন তাদের ছোড়া রকেট ও মিসাইল জ্বলজ্বলে তারার মতো উজ্জ্বল দেখায়। প্রতিটি যুদ্ধ বিমান আমাদের স্বপ্ন আর জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।

আমি আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দেই এবং আমার পায়ের নিচে শক্ত মাটি অনুভব করি। যখন আমি উঁচু গোড়ালির জুতা পরে এবং জুঁই ফুলের সুগন্ধি মেখে কাজে যাচ্ছিলাম, তখন আমি যুদ্ধ আর দুর্ভোগের ভয়াবহ মুহূর্ত থেকে দূরে সরে গিয়েছি এবং তাজা বাতাসের গন্ধ অনুভব করেছি, আমার বন্ধুদের হাসি-তামাশা, সমুদ্রের ঘ্রাণ এবং ভোরের শিশিরের কথা স্মরণ করেছি। সকালে আমি অফিসে বসে গরম কফির গন্ধ পেয়েছি। এমনকি আমি আমার প্রতিবেশীদের চিৎকার করে তাদের বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য জাগিয়ে তোলার বিরক্তিকর ডাকাডাকির অনুপস্থিতি অনুভব করেছি। আমাদের পরিচিত এলাকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং আমাদের উদার মনের প্রতিবেশীরা নিহত হয়েছেন।

আমাদের তাঁবুর গায়ে আলতো পরশ বুলিয়ে দেওয়া বাতাসের একটানা শব্দ সেসব স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, যখন আমি বৃষ্টির দিনে সমুদ্রের ধারে বসে প্রেম, জীবন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে লিখেছিলাম এবং যখন মর্মরধ্বনির তরঙ্গ এসে বালিতে আঘাত করেছিল। তাঁবুর মাঠ, নর্দমার ময়লা পানির উৎকট গন্ধ আর বাচ্চাদের কান্না আমার অলীক সুখের কল্পনাকে বাধন দেয়। আমাদের কথা ভুলে গিয়ে পৃথিবীর বাকি অংশ কীভাবে চলতে পারে? আমরা গাজা উপত্যকায় ক্ষুধা এবং তীব্র শীতে ভুগছি এবং আমাদের হাড় কাঁপছে। আমরা যে মৃত্যু ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছি, তা জানার জন্য কেউ কি আমাদের দুর্বিষহ জীবনকাহিনি পড়বে? তারা কি আমাদের খবর শোনার কিংবা আমাদের সম্পর্কে জানার সময় পাবে?

একটি শিশুর কণ্ঠস্বর আমার চিন্তায় বাধা দেয়। সে কম্পিত গলায় ডাকে, ‘কফি, কফি, গরম কফি আর চা আছে।’ তার এক হাতে বড় জগ এবং অন্য হাতে ছোট আকৃতির কাপ। তার মাথা মোটা কাপড় দিয়ে আবৃত এবং সে সন্ধ্যার অন্ধকারে তাঁবুর মধ্যে ঘুরে চা ও কফি বিক্রি করে। দুষ্প্রাপ্যতা ও ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে কফির গন্ধ পাওয়া এখন খুবই দুষ্কর। কফির সঙ্গে আমাদের, গাজার মানুষের, রয়েছে গভীর বন্ধুত্ব; আমরা কেউই এ বন্ধুত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত নই। বিয়ে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং নবজাতকের কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে আমরা দুধ বা চিনি ছাড়াই কফি পান করি। এখন আমি ও আমার বন্ধুরা সাহিত্য এবং সংগীতের মধ্যে আগামী দিনের আশা খুঁজে পেয়েছি। তাই আমাদের কাছে কফির সুগন্ধ নস্টালজিয়ায় পরিণত হয়েছে। আজ এই হিমশীতল শিবিরে শিশুটির কণ্ঠ দুঃখে ভরা।

জীবন এখানে বিরক্তিকর নিয়মে উন্মোচিত হয়—নীল ঠোঁট নিয়ে খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, রান্না কিংবা পানি গরম করার জন্য আগুন জ্বালানো এবং পানি, খাবার ও বিদ্যুতের জন্য নিরলস অনুসন্ধান করা। আগের দিনে যা সাধারণ দৈনন্দিন কাজ ছিল, তা এখন দীর্ঘ লাইন ও মৌলিক চাহিদা পূরণের সঙ্গে জড়িত এবং রীতিমতো এক ধরনের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। খুব সকালে শিশুরা তাদের পরিবারের জন্য ভারী পানির ভরা পাত্র বহন করে। ছয়টি পরিবার সাধারণ জায়গায় অবস্থিত একটি মাত্র শৌচাগার ব্যবহার করে এবং বয়স্ক মানুষদের দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করার বিষয়টি সত্যি দুঃখজনক। সহানুভূতি এখন এক ধরনের বিলাসিতা, যা আমরা খুব কম দেখাতে পারি। দিনের শেষের দিকে গাধার গাড়িতে চড়ে ইন্টারনেট কেন্দ্রে পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে আমরা আমাদের ফোন চার্জ করি, যাতে আমরা উত্তরে বসবাসরত আমাদের ক্ষুধার্ত ও বিচ্ছিন্ন আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।

যে বাড়ি, চাকরি এবং মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য পড়াশোনার সুযোগটি আমি হারিয়েছি, তা স্মরণ করা খুবই দুঃখজনক। এই হতাশাজনক যুদ্ধের মাঝে আমি সেসব মহৎ আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেছি। এখন আমি শুধু ফলমূল, হালকা গরম পানিতে গোসল করা, পান করার জন্য স্বচ্ছ পানি ও দেওয়াল ঘেরা নেওয়ার একটি বিছানার আকাঙ্ক্ষা করছি। আমি আমার মায়ের উষ্ণ রান্নাঘরে সদ্য তৈরি রুটি, দুধ এবং দারুচিনির সুঘ্রাণের স্বপ্ন দেখি।

ক্রমাগত সহজ পদ্ধতি এবং প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন মেনে চলার পরেও মৃত্যুর আসন্ন হুমকি থেকে কাউকে রক্ষা করবে না; যেকোনো মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে। জীবন এবং মৃত্যু একাকার হয়ে যায়, যখন কেউ যেকোনো সময় একাকার হয়ে যাওয়ার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকে। একদিন রাতে আমরা শব্দ শুনতে পাই যে, ট্যাংকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে আসছে। চারদিক থেকে গোলাগুলি আমাদের ঘিরে ফেলছে, আমাদের মধ্যে আতঙ্ক এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। লোকজন তাঁবুর পরিবর্তে বিভিন্ন ভবনের মধ্যে আশ্রয় নিতে পালিয়ে যায়। সারা রাত আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, লাশগুলো চেপে ধরে একে অপরকে এবং শিশুদের বুলেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ থেকে রক্ষা করি। কোলাহল আর ভয় আমাদের সারারাত জাগিয়ে রাখে। ভোরের দিকে আমরা দেখতে পাই ট্যাংকের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে চারজন নিহত হয়েছে। বিস্মিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে আমরা আবার পালিয়ে যাই, বেঁচে থাকার পরিচিত বিভিন্ন উপায় অনুসরণ করে।

ধূসর আকাশের নিচে খান ইউনুস থেকে রাফাহ পর্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত লোকজন রাস্তায় হাঁটছে। পরের মুহূর্তে বেহেশতে আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হবো কিনা, তা নিয়ে আমরা অনিশ্চিত। আমার ছোট ভাতিজা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি? কোথাও কোনো নিরাপদ জায়গা নেই।’ জবাবে আমি বললাম, ‘আমি জানি না, তবে বেঁচে থাকাই এখন আমাদের জরুরি কাজ।’ তার তরুণ মনের জন্য আমার জবাব কঠিন শোনাল।

তবুও আমি এই বিশ্বাসে অটল থাকি যে, আমাদের অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে এবং এই ঝড়ের মধ্য দিয়ে দিক নির্দেশ করতে হবে, যতক্ষণ না আমরা নীল তিমিটিকে সমুদ্রে স্বাধীনভাবে নৃত্য করতে দেখি। তিমিটি তার প্রজাতির কাহিনি বর্ণনা করবে, আমাদের বলবে বিলুপ্তির হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার ঘটনা, ঢেউ খেলানো ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে স্পন্দিত হওয়ার গল্প, ভয়ঙ্কর ঝড়ের আবহাওয়ার কিচ্ছা। আত্মসমর্পণ কোনো বিকল্প নয়; আমি ততক্ষণ পর্যন্ত অবিচল থাকব, যতক্ষণ না আমি নীল তিমির পাশে সূর্যের আলোতে সাঁতার কাটব। আর আমি তখন উঁচু গলায় ঘোষণা করব যে, আমিও গণহত্যা এবং অগণিত সমস্যা ও বিপদ-আপদ পরাজিত করে কঠিন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হয়েছি।

পাদটীকা : মূল গল্পে নেই, পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো—অনুবাদক।
১. নীল ঠোঁট — লোহিত রক্তকণিকায় অক্সিজেনের মাত্রা কম হওয়ার কারণে হতে পারে। এছাড়া এটি হিমোগ্লোবিনের একটি অস্বাভাবিক রূপও বোঝায়।


বাইরে বৃষ্টি, ভেতরে ঝড়
মূল : ইমান আবু হেলাল

[‘বাইরে বৃষ্টি, ভেতরে ঝড়’ গল্পটি ইমান আবু হেলালের ইংরেজিতে ‘রেইন আউটসাইড, স্টর্ম ইনসাইড’ গল্পের অনুবাদ। ইংরেজিতে এই গল্পটিও উই আর নট নাম্বার্স অনলাইন ম্যাগাজিনে (২৪ মার্চ ২০২২) প্রকাশিত হয়েছে।
ইমান আবু হেলাল একজন ফিলিস্তিনি লেখিকা এবং অনুবাদক (ইংরেজি থেকে আরবি)। তিনি উই আর নট নাম্বার্স অনলাইন ম্যাগাজিনের একজন শৌখিন লেখিকা। তিনি গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনুবাদ বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। তাঁর স্বপ্ন লেখালেখি ও অনুবাদের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হওয়া।]


প্রিয় দিনলিপি
আবারও গাইথ এখানে, তবে এবার এসেছে প্রচণ্ড ঠান্ডা নিয়ে। সেদিন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং তখন সেলাই দোকানের মালিক আমাকে আগামী সপ্তাহের কাজের জন্য কিছু সূঁচ এবং সুতা কিনতে বলেছিলেন। যদিও বাজার অনেক দূরে ছিল, কিন্তু আমাকে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে। সুতরাং আমার পা দুটির কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল এবং তার জন্য আমার এখন ভয়ানক ঠান্ডা লেগেছে। আমার মনে হচ্ছিল রাস্তায় চুপিসারে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে, তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম না; তাই স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করেছি। বাজারে আমি যথারীতি সেলাইয়ের জিনিসপত্র খুঁজে পেয়েছি, দাম জিজ্ঞেস করার চেয়ে পাঁচ টাকা কম, কারণ আমি বাজারে একজন নিয়মিত ক্রেতা ছিলাম এবং দোকানে কাজ করা লোকটি আমাকে খুব ভালো করে জানত। সত্যি কথা বলতে কী, আমি আমার সাপ্তাহিক ‘মজুরি’-র সঙ্গে সেই বেঁচে যাওয়া টাকা আমার জীর্ণ পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত ছিলাম—খুবই  সামান্য পরিমাণ টাকা—যদিও সেই বেঁচে যাওয়া টাকা সম্পর্কে দোকানের মালিকের কোনো ধারণা ছিল না!

আমার অন্তরে একটা কণ্ঠস্বর ছিল, যা আমাকে সব সময় এই অভ্যাসকে বন্ধ করতে বলেছে। কারণ এ অনৈতিক বিষয়টি আমি বাড়ি এবং স্কুল উভয় ক্ষেত্রেই শিখেছি। যাহোক, প্রতি সপ্তাহে বাড়তি ঘণ্টা কাজ করার জন্য বৃদ্ধের কাছে বারবার জিজ্ঞেস করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। তবে আমি একমাত্র জায়গাটি ছাড়তেও চাইনি, যা আমাকে আশার আলো দেখিয়েছিল, যা ছিল আমার স্কুল।
আমি এখন বিশ্বাস করি যে, একজন লোক আমাকে সাবধানে পর্যবেক্ষণ করছে! আমি আমার ক্রয় করা জিনিসপত্র তুলে নিয়ে চটজলদি দোকান থেকে বেরিয়ে আসি। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি থেমে গেছে। তাই আমি শুকনো অবস্থায় দোকানে ফিরে যাওয়ার আশা করেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি দ্রুত বুঝতে পারি যে, আমার হিমশীতল সঙ্কুচিত পায়ের সব আঙুল আবারও কর্দমাক্ত মাটির মধ্যে ডোবাতে হবে, কারণ রাস্তা কাদামাটির ঘোলা পানি নদীতে পরিণত হয়েছে। আমি সাধারণত গ্লাস অর্ধেক পূর্ণ দেখার চেষ্টা করি, তাই আমি বাইরের আর্দ্র মাটির গন্ধ প্রত্যাশা করে নিজেকে উত্সাহিত করি, যা আমার নাসারন্ধ্রের মধ্যে প্রলম্বিত হবে এবং আমার ফুসফুসকে তাজা বাতাসে পূর্ণ করবে।

‘তুমি আজ কঠোর পরিশ্রম করেছ; এখন বাড়ি যেতে পারো,’ আমি বাজার করে ফিরে আসার পরে মালিক বললেন। আমি এতটাই খুশি হয়েছি যে, মনে হয়েছে আমার পা দুটি হঠাৎ ওজনহীন হয়ে গেছে, যেন আমি উড়তে পারি; আমি এই ভেবে স্বস্তি পেয়েছি যে, পরিবারের জন্য কিছু রুটি কেনার মতো আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা আছে। বেকারিতে ঢুকে সামনের লম্বা লাইনে দাঁড়াই। আমি যখন তাজা সেঁকা পাউরুটির সুস্বাদু গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমার পালার জন্য অপেক্ষা করছি, তখন একজন দীর্ঘদেহী লোক আমার পেছন থেকে এসে খপ করে আমার জীর্ণ সুতির শার্ট ধরেন। আমার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে এবং আমার মুখ প্রবালের মতো লাল হয়ে যায়; আমি ভয় পেয়ে যাই, কারণ তিনি আমার ওপর একের পর এক প্রশ্নের বিশাল বোমা ফেলে যাচ্ছেন।

‘এই ছেলে, এদিকে এসো! তুমি কী করছো? এই টাকাকড়ি তুমি কোথায় পেলে? তোমার আচরণের জন্য তুমি কি নিজেকে অপরাধী মনে করো না?’
আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনি কে ছিলেন—সেলাই কর্মশালায় আমার নতুন সহকর্মী।
‘আমি তোমার চুরির কথা মালিকের কাছে অভিযোগ করব এবং তুমি নিশ্চয় জানো এর অর্থ কী, তাই না? তুমি তোমার চাকরি হারাবে। আমি শপথ করে বলছি!’ তিনি আমার প্রতি চিৎকার করছিলেন এবং আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমার কিছু বলার ছিল না, কারণ তিনি ঠিকই বলেছিলেন।
‘অনুগ্রহ করে আসুন, আমরা একটু কথা বলি,’ ভিক্ষা করার ভঙ্গিতে আমি তাকে অনুরোধ করলাম। ‘আপনি আমাকে অথর্ব মনে করেন, তাই না?’
‘তুমি কীভাবে মনে করো যে, তোমার মতো আচরণ করা একজন লোককে আমরা বর্ণনা করতে পারি? একজন সজ্জন ব্যক্তি?
‘আমি মহৎ কিংবা খারাপ ছেলে নই, তবে... আপনি কি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন যে, আমার মতো একটি ছোট্ট শিশু কেন তার সমবয়সীদের সঙ্গে খেলা করে সময় উপভোগ না করে কাজ করছে?’

তিনি মাথা চুলকাতে শুরু করেন এবং হাত জোড় করে অপেক্ষা করতে থাকেন কখন আমি নিজেই আমার প্রশ্নের জবাব দেবো!
আমি আমার ভুলকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই না—আমি বিশ্বাস করি সবার মতো এ কাজটিও ভয়ঙ্কর। কিন্তু আমি দশ বছর বয়সী এতিম, যে কিনা অবরোধের মধ্যে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। আমার প্রিয় মা কর্কট রোগে ভুগছেন এবং আমার দুই বোন আমার চেয়ে ছোট। আমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে অর্থ উপার্জন করতে পারে! আমি স্কুলের পরে প্রতিদিন রুটির দোকানে চার ঘণ্টা কাজ করি, কিন্তু বৃহস্পতিবার পুরো দিন বৃদ্ধ লোকটিকে সাহায্য করার জন্য আমাকে বাধ্য করা হয়, যেদিন তিনি আমাকে আমার সাপ্তাহিক মজুরি দেন। আর আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, যাতে স্কুল না ছাড়ি।

আমার সহকর্মী আমার চোখের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন, যেন আমার চোখ দুটি আয়না যেখানে তার শুকিয়ে যাওয়া মন এবং ছিন্নভিন্ন হৃদয় প্রতিফলিত হয়েছে! সহকর্মী যেন হঠাৎ আমার মধ্যে নিজেকে দেখতে পেলেন।

‘আবারও,’ আমি বললাম, ‘আমি বলছি না যে, আমার আচরণ ঠিক হয়েছে, তবে বাকি টাকা নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। সুতরাং দয়া করে আমার পরিবার এবং আমি অনাহারে থাকার কারণ হবেন না!’
‘হৃদয় বিদারক!’ লোকটি বললেন এবং সেই সময় তাঁর চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। ‘আমি কথা দিচ্ছি যে, তুমি যদি ওয়াদা করো আর কখনো এ কাজ করবে না, তাহলে আমি আমাদের মালিককে বলব না! আমার অবস্থা তোমার চেয়ে ভালো নয়! দুর্ভাগ্যবশত অনেক গাজাবাসী এমন দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে,’ তিনি শান্ত গলায় বললেন এবং কণ্ঠস্বর তাঁর গলায় আটকে যায়। ‘কিন্তু আমরা যতই কষ্ট পাই না কেন, এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা চিন্তা করা মোটেও উচিত নয়। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন সব সময় বাবা আমাকে বলতেন, ‘দুটি ভুল করলে কখনই সঠিক হয় না! সৎ ও সহজ মানুষ হওয়াই এই দুঃসহ জীবনে বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ উপায়।’
‘আমি ওয়াদা করছি!’
দিনলিপি, আমি সূর্য ওঠার অপেক্ষায় আছি, যা আমার মুখমণ্ডল আলোকিত করবে, আমার ঘাড়ে তার উষ্ণ হাতের আলতো পরশ বুলিয়ে দেবে।
বিনীতভাবে,

পাদটীকা : মূল গল্পে নেই, পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো—অনুবাদক।
১. গাইথ — আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘বৃষ্টি’। নামটি আরব বিশ্ব এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়, যেখানে এই নামের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাত্পর্য রয়েছে। কেননা এই নাম সমৃদ্ধি, আশীর্বাদ ও জীবনদায়ী শক্তির ইতিবাচক ধারণা বহন করে।


ফজল হাসান অনুবাদক, ছোটগল্প লেখক, ছড়াকার, ভ্রমণ গদ্য ও নন-ফিকশন লেখক।  পোশাকি পরিচয় একেএম আফজল হোসেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সপরিবারে বসবাস করছেন ক্যানবেরায়।

menu
menu