গ্যাস চেম্বার

হ্যাঁ, আমি রণেন মুস্তাফি। আমিই। তাতে কোনো সন্দেহ আছে?

রণেন মুস্তাফির বয়স ষাটের অধিক। খর্বকায় মানুষ। তামাটে গাত্র বর্ণ। চোখ ছোট। কিন্তু তীক্ষ্ণ নাশা। ধুতি পাঞ্জাবি পরেন। প্যান্ট শার্টও। পায়ে চপ্পল থাকে। আবার বেল্ট বাঁধা কাবলির মতো জুতোও। রণেন বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন। রাত জেগে বই পড়েন। ব্লগ লেখেন। কোনো কোনোদিন পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে রাত প্রায় ফুরিয়ে আসে। রণেনকে নিয়ে এই বৃত্তান্ত। রণেন বললেন, আপনি তো সব জেনেই এসেছেন, আমিই রণেন মুস্তাফি, আবার জিজ্ঞাসার হেতু? 

লোকটি বলল, আমি ভাবছি আপনি কী করে সেই ঘটনা ঘটাবেন? 

লোকটি স্বাস্থ্যবান। দীর্ঘকায়। বয়স বছর চল্লিশের উপর। গৌর বর্ণ। চোখে দামী চশমা। শার্ট প্যান্ট। বুকে দামি পেন। হাতে বড় একটি মোবাইল। রণেন একটু সতর্ক হলেন। তাঁর কন্যা বেরিয়ে গেল চাকরিতে। জিনস এবং কুর্তি। মেয়ে কথাবার্তায়  অভ্যাসে রণেনের মতোই হয়েছে। কিন্তু লম্বা। মায়ের মতো গড়ন। ছিপছিপে। ওর নাম সুচরিতা মুস্তাফি। মেয়ের অভ্যাসও বই পড়া। তার সঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ারকিং সাইটে লেখা। ব্লগ লেখে। শিল্প সাহিত্য এবং দেশকাল। ধর্মাধর্ম। জাতিসত্তা। কলম না অস্ত্র, একটি পেজ খুলেছে। রণেন সেখানে একবার লিখেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম?

লোকটি একটি কার্ড এগিয়ে দিল। এস, কেশরীলাল। কোনটা নাম? আদ্যাক্ষর এস, না কি কেশরীলাল? কেশরীলাল সেন? সিংহ? নাকি কেশরীলাল ওঁর পদবী। এস হলো নাম। অনুক্ত রাখতেই আদ্যাক্ষর ব্যবহার। স্বপন, সুখেন, সুজয়, সাধন… এমনি কোনো একটা। কেশরীলাল কি পদবি হয়? হতেই পারে। কেশরীলাল। সিংহপুত্র। আজকাল পদবি বর্জন করে। রণেনের মনে পড়ে তাঁর কাকিমার ভাইয়ের নাম ছিল, বলদর্পী সিংহ। আরেক ভাই ছিলেন  মহাদর্পী সিংহ। এই নিয়ে খুব হাসাহাসি হতো। তারা ওপারে ছিল বড় জমিদার। এপারে এসে ট্রানসপোর্টের বিজনেস করত। তখন সেই পঞ্চাশের দশকে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা সব শিখদের হাতে। বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টর থেকে মালিক সব তাঁরা। রণেনের মনে আছে, বাসের গায়ে চাপড় মারতে মারতে, এই ডিগা ডিগা ডিগা… করতে করতে বাস ছুটিয়ে নিয়ে যেত শ্যামবাজার থেকে হাসনাবাদ। ৭৯-সি ছিল সেই বাসের নম্বর। এখন নেই। আর আশ্চর্য, কলকাতা থেকে ধীরে ধীরে শিখেরা নিজেদের গুটিয়ে নিল পরিবহন ব্যবসা থেকে। ট্যাক্সি, বাস, ট্রাক—কোথাও নেই তারা। শোনা যায় পাঞ্জাবের সবুজ বিপ্লব টেনে নিয়েছে তাদের। আর জাতপাতে দীর্ণ উত্তরভারত থেকে এসেছে তাদের বিকল্পরা। আর বাঙালিও নেমেছে এই ব্যবসায়। রণেন অন্য মনস্ক হয়েছিলেন। মুখ তুলে দেখলেন কেশরীলাল সিংহ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। পলক ফেলছেন না। তিনি বললেন, আসুন চা খাই।

চা? কেশরীলাল বললেন, চা খেয়ে আমরা কাজ আরম্ভ করব। 

কী কাজ? রণেন অবাক হলেন। এখন তিনি পড়তে বসবেন। ইহুদিদের নিয়ে একটি বই দিয়েছে মেয়ে, প্রাচীন পৃথিবী, আদিম ধর্ম, সিনাইয়ের মরু প্রান্তর, কথা, কিংবদন্তি, জেরুজালেম নগর, ডুবে আছেন। বইটি তাঁকে টানছে। যদিও ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনি, কিন্তু অনেক ব্যাখ্যা আছে। আর একটি বই টানছে, জনৈক সম্বিত সরকারের কবিতা। ছেলেটি তাঁকে পোস্টে পাঠিয়েছে বইটি। তিনি খুব ভালো পড়ুয়া। পড়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান সোশ্যাল মিডিয়ায়। ব্লগে লেখেন। কখনো টুইট করেন। তাঁর পাঠ প্রতিক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লোকে মান্যতা দেয়। সমস্তজীবন ধরে যে বই সংগ্রহ করেছেন তিনি, এখনো যা সংগ্রহ করে যাচ্ছেন, তা-ই তাঁর সঙ্গী। রণেন বললেন, আপনার কত সময় লাগবে? তা একটু লাগবে। এস কেশরীলাল বলল, আপনি তো সারাদিন বেকার। বেকার কিন্তু অবসর নেই, আমার তো অত সময় নেই। রণেন বললেন, যা করার তাড়াতাড়ি করুন।  
কেশরীলাল বললেন, একটু দিতে হবে সময়, আপনি তো এখন বাড়িতেই থাকেন।
থাকি। সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন রণেন। 
রিটায়ার করেছেন পাঁচ বছর।
হ্যাঁ, করেছি। জবাব দিলেন রণেন। 
৩১শে জানুয়ারি, ২০১৩, তাই তো।
রণেন বললেন, আপনি তো জানেন সব।
কিন্তু আপনার রিটায়ার করার কথা ৩১শে আগস্ট, ২০১২, তাই তো?
রণেন বললেন, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
কেশরীলাল বললেন, আপনার মতো আমিও চা ঠান্ডা করে খাই।                                
রণেন অবাক হলেন, তাঁর এই অভ্যাসের কথা লোকটি জানল কী করে?  আরও জানে। কেশরীলাল বলছে, আপনি ল্যাপটপ খুলে বসেন চায়ের কাপ নিয়ে, কিন্তু লিখতে লিখতে এতই মগ্ন হয়ে যান যে চা ঠান্ডা জল হয়ে যায়, আপনি চা নিন, আসুন আমরা চা শেষ করে কথা আরম্ভ করি।

রণেন চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝলেন, দুটিতেই চিনি দিয়েছে কাজের মাসি রুকসানা। নাকি বদল হয়ে গেছে কাপ। চিনি ছাড়া লিকার চলে গেছে কেশরীলালের কাছে। রুকসানা মাসি অনেকদিন এ বাড়িতে আছে, তার এমন ভুল হয় না। কেশরীলাল বলল, আপনি চিনি ছাড়া লিকার খান, আজ ভুল হয়ে গেছে?
আপনি?
আমার দুটিই চলে, তবে চিনি ছাড়া লিকারই পছন্দ বেশি। বলল কেশরীলাল। এর অর্থ ওর কাপেও চিনি দিয়েছে রুকসানা। রণেন চিন্তিত হলেন। চিনিতে তাঁরও বিশেষ আপত্তি নেই, কিন্তু চায়ে চিনি নেন না। ভুল করেছে রুকসানা মাসি। ভুল করে না। খুব ভাল জানে তাঁর সব অভ্যাস, তবু ভুল করল কেন? দুটি চায়ে চিনি দেওয়ার অর্থ মাসি অন্যমনস্ক। তাহলে কি মাসির মেয়েটিকে চাকরি ছাড়তে হলো? মেয়ে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়েছে রুকসানা মাসি। তার মেয়ে কুলছুম সেলাই করে একটি কারখানায়। পাঞ্জাবিতে বোতাম পরায়। স্বামী খুব মারধোর করে। সে অনেক কাহিনি। কেশরীলালের সামনে তা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। লোকটা নিশ্চয় রুকসানা বিবির খোঁজ নিয়ে আসেনি।  
কেশরীলাল বলল, পাঁচ মাস বাদে রিটায়ার করে আর চাকরি করেননি।
আমার ডেট অফ বার্থ ঐটিই ছিল হায়ার সেকেন্ডারিতে, বদল করা হয়নি।
কেশরীলাল বললেন, আমারও অমন আছে, দেড় বছর কমানো, এর ফলে আমি দেড় বছর বেশি চাকরি করব, বলুন।
কী বলব? আচমকা অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন রণেন। 
কেশরীলাল বলল, আমরা এবার কাজ আরম্ভ করি।

রণেন চুপ করে থাকলেন। একটা কাজ নিয়ে এসেছে লোকটি। কিন্তু কাজটা কী তা তিনি বুঝতে পারছেন না। এখন তাঁকে বইটি টানছে। সেই ইহুদি পুরাণ। ইহুইদের নিজস্ব দেশ অন্বেষণ। তিনি মনে করতে চাইছিলেন আব্রাহাম, আইজ্যাক, জোসেফ এবং জেকব ইত্যাদি ইহুদি কুলপতিদের। মহামতি মোজেসের  এক্সোডাস পর্বের কথা। সেই মহা নিষ্ক্রমণ। ফারাওয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে বারোটি যাযাবর গোষ্ঠীকে নিয়ে মোজেসের মিশর ত্যাগ। প্রমিসড ল্যান্ডের সন্ধানে বেরিয়েছে তারা। আজ সকালে তাঁর আর একটি পরিকল্পনা ছিল, টেন কম্যান্ডমেন্টস ছবিটি আবার দেখা। ফারাও-এর অগণিত দাসের মনুষ্যেতর জীবন যাপন। সপাং সপাং চাবুক।  বড় বড় প্রস্তরখণ্ড বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রীতদাসের দল। প্রাসাদ, পিরামিড নির্মাণ করছে তারা। লোহিত সাগর পার হচ্ছেন মোজেস, পিছনে দেশহীন দাসত্বমুক্ত মানুষ। সাগর দুভাগ হয়ে তাঁদের রাস্তা করে দিল। সহর্ষে দর্শকরা গর্জন করে উঠল। ফারাওয়ের বাহিনী যখন সেই পথে নামল সাগর জুড়ে গিয়ে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তাঁর ভাবনার ভেতরে প্রবেশ করল কেশরীলাল, জিজ্ঞেস করল, আপনি এখন কী বই পড়ছেন? 
আপনি কি বই পড়েন? রণেন জিজ্ঞেস করলেন। 
কেশরীলাল হাসে, আপনার কী মনে হয়?
আমার কিছুই মনে হয় না, কী করে জানব পড়েন কি পড়েন না, যদি পড়ে থাকেন কী বই পড়েন। 
কেশরীলাল বলল, না, আপনি জানতেই পারবেন কথা আর একটু হলে, আমি পড়ি, পড়তে হয় সমস্ত সন্দেহজনক পুস্তক, তা বাদে বই পড়ার কোনো মানে নেই, নো ইউটিলিটি ।
মৃদু হাসলেন রণেন, আপনি কি বইয়ের সেন্সর বোর্ডের কর্তা? আঁজ্ঞে না, কর্তারা বই পড়েন না, তাঁর সাব-অরডিনেটরা পড়েন। বলল কেশরীলাল, তারপর কর্তাকে অবহিত করতে হয়। 

রণেন চুপ করে থাকলেন। তাঁর যেন আর বলার কথা নেই। বলতে ইচ্ছেই হচ্ছিল না। কথায় কথা বাড়ে। লোকটাকে তিনি বের করে দিতে পারেন না। অতিথি তো। মনে হয় সরকার নিযুক্ত এজেন্সি থেকে এসেছে। সরকার এখন তার অনেক কাজই বাইরের এজেন্সি দিয়ে করাচ্ছে। এর নাম বেসরকারিকরণ। তাতে সরকারের নাকি অনেক ঝামেলা কমেছে। সরকার উন্নয়নের কাজ আরও ভালোভাবে করতে পারছে। কিন্তু নিন্দুকের দল বলছে, এতে অবস্থার অবনতি হচ্ছে ক্রমাগত। উন্নয়ন মানে কি ঝাঁ চকচকে রাস্তা, আর প্রচুর সংখ্যক মোটর গাড়ি? গাড়ির সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে রাস্তা পার হওয়া কঠিন। গাড়ির পর গাড়ি। গাড়িই যেন দেশকে সামনে টেনে নিয়ে চলেছে বলদের মতো। নিন্দুকে আরও বলছে উন্নয়ন মানে কি মোবাইল ফোন আর এয়ার কন্ডিশনার? মানুষের জন্য সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা কি হয়েছে? মানুষের সকলের কি ঘরবাড়ি আছে? সকলের জন্য অন্ন আর শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে? শৌচাগার হয়েছে কিন্তু শৌচাগারে ব্যবহার করার মতো জল নেই। উন্নয়নের জন্য যারা উচ্ছেদ হচ্ছে তারা যাচ্ছে কোথায়? তাদের ভবিষ্যত কী? কয়েকদিন আগেই তিনি একটি ব্লগ লিখেছেন এইসব প্রশ্ন তুলে।  
কেশরীলাল বলল, আপনি সারাদিন কী করেন? 
কেন? রণেন জিজ্ঞেস করলেন। 
না, এই যে দীর্ঘ একটা দিন, তারপর রাত, আপনার কাটে কী করে? নিরীহ মুখে প্রশ্ন করে কেশরীলাল, টিভি সিরিয়াল দ্যাখেন, বউ কথা কও কিংবা হলুদ পাখি?  

তিনি চুপ করে থাকলেন। লোকটা কেন এসেছে তা ধরা যাচ্ছে না। অথচ তিনি লোকটাকে যে অগ্রাহ্য করবেন তার উপায় নেই। লোকটা যে তাঁর ফ্ল্যাটে তাঁর সামনে বসে আছে। এমন মানুষ তো আসেই তাঁর কাছে। বিশেষত সন্ধ্যাবেলায়। সকালে কেউ আসে না রবিবার ছাড়া। সকলেরই তো সারা সপ্তাহে কাজ-কম্মো থাকে। আসবে কী করে? কাজের দিন সকালেই এই কেশরীলাল এসেছে। আজ শুক্রবার। শনিবার অনেকের ছুটি থাকে। একদিন দেরি করে এলে ধরা যেত সে এসেছে তাঁর ব্লগ কিংবা টুইটে আকৃষ্ট হয়ে। অথবা সোশ্যাল নেটওয়ারকিং সাইটে তাঁর স্ট্যাটাস দেখে। তবে দিন সাতেক তিনি সোশ্যাল নেটওয়ারকিং সাইটে নেই। সময় খেয়ে নেয়। তার পঠনে বিঘ্ন ঘটায়। অনেকে আক্রমণও করে। ইদানীং এই সব হয়েছে। কেউ বিপক্ষ মত সহ্য করতে পারছে না। অস্ত্র শানিয়েই আছে। চোদ্দপুরুষ তুলে গালাগালি আর বিদ্বেষপূর্ণ মেসেজ আসছে। শান্ত  সমাজটা ভেঙে যাচ্ছে যে সকলের অলক্ষ্যে, তা তিনি বুঝতে পারছেন। 

চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। অর্ধেক খাওয়া চা পড়ে আছে। তিনি ভাবছিলেন রুকসানা মাসিকে বলবেন আবার চা দিতে। কিন্তু না। মাসি মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। জামাই তালাক দেবে না, অথচ পেটাবে। বারবার বলছে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে যেতে। বিজনেস করবে। মেয়ে পালিয়ে এসে কাজে ঢুকেছে। সেখানে চলে যাচ্ছে জামাই। সে কুলছুমের মালিক। তার কথায় সব হবে। চাকরি সে করুক বাপের বাড়ি থেকে, কিন্তু বেতনের টাকা স্বামী নেবে। বস্তিতে সালিশি হবে খুব শিগগির। সেই সালিশির দিকে চেয়ে আছে রুকসানা। রণেন চুপ করে আছেন দেখে কেশরীলাল আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিতে রণেন বললেন, আপনার সমস্ত দিন কাটে কী করে ?
কেশরীলাল বলল, এই যে এইভাবে।
সমস্ত দিন? 
বলতে পারেন।
এক জায়গায়? জিজ্ঞেস করলেন রণেন। 
কেশরীলাল বলল, যদি প্রয়োজন হয়, না হলে ঘুরে ঘুরে।  
রণেন বললেন, আপনি কী করেন?
আমার কার্ড দিলাম তো। 

রণেন বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। অদ্ভুত এক একটা লোক আসে মাঝে মধ্যে। ছমাস আগে একটা লোক এসেছিল তাঁর কাছ থেকে বই নিতে। সে বই সংগ্রহ করে বেড়ায়। তার নিজের একটা বাড়ি আছে বেলডাঙায়। সেই বাড়িতে একটা লাইব্রেরি করেছে সে। বই নিয়ে গেল তাঁর সংগ্রহ থেকে। পরে একজন কলেজ স্ট্রিট ফুটপাথ থেকে বইটি কিনে এনে তাঁকে দেখিয়েছিল। স্যার, আপনার বাড়ির বই কলেজ স্ট্রিটের ফুটপথে গেল কী করে? বইটি তাঁকে উপহার দিয়েছিল এক বাল্য বন্ধু। বাংলার মাছ। কত রকম মাছের কথা ছিল তাতে। নোনা জলের মাছ, মিষ্টি জলের মাছ। খাল বিলের মাছ, পুকুরের মাছ। যে সব মাছ হারিয়ে গেছে তাদের কথা। ছোট ছোট মাছকে খেয়ে নিয়েছে বড় বড় মাছ। খাল বিল নেই প্রায়। জমিতে কীটনাশক, ফলে বর্ষার ধানবনের কই, ভেটকি, পুঁটি, খলসে আর নেইই প্রায়। যে কই বাজারে মেলে, তা চাষের কই। পুষ্টি জুগিয়ে অতি বৃহৎ। স্বোয়াদ নেই। বইটি জোর করে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে গেল দাড়িওয়ালা লোকটি। তিনি আবার কিনলেন বইটি। সেই বই কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে। তার মানে লোকটি বেচে দিয়েছে। লোকটি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে লাইব্রেরির নামে বই উপহার নিয়ে বেচে দেয়। কিন্তু তাঁর কথা কল্যাণ মাইতি বিশ্বাস করল না। কল্যাণ মাইতি তাঁর মতো পড়ুয়া। অধ্যাপনা করতেন। এখনো নানা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার করে বেড়ান। বিদেশেও যান। বললেন, এমন হতে পারে, বেলডাঙার লাইব্রেরি থেকে বইটি অন্য কারো হাত ধরে বেরিয়ে গেছে। কল্যাণ রসিকতা করেছিলেন, ডোবার মাছ ডোবা ছেড়ে দিঘিতে যেতে চেয়েছিল।

কল্যাণের কথার মানে কী? তাঁকে বিদ্রুপ করেছিল নাকি? কল্যাণ তাঁর ব্লগ কিংবা টুইট নিয়ে কথা বিশেষ বলেন না। মনে মনে হয়তো ঈর্ষা আছে, তিনি বোঝেন না। কিন্তু কল্যাণ ইদানীং যে সব কথা লিখছে ব্লগে, কিংবা টুইট করছে যে সমস্ত বিষয় নিয়ে তা দেখে তিনি অবাক। একদিন ফোন করেছিলেন, হ্যালো, তুমি যা লিখছ তা কি তুমি বিশ্বাস করো?
কল্যাণ জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমিও যা লিখছ, তা কি তোমার বিশ্বাস থেকে লেখা, মেয়েদের কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া, আর কোনো কাজ কি তার চেয়ে বড় হতে পারে?
রণেন বলেছিলেন, জিন্স টপ পরা একটি মেয়েকে পিটিয়েছে কিছু যুবক, তুমি বলেছ বারণ করা সত্ত্বেও কেন পরেছিল, এবার থেকে আর পরবে না, তুমি কি এইটা বিশ্বাস করো?
কেশরীলাল জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বিশ্বাস করেন বইয়ে যা লেখা থাকে তা সত্যি?
কেন বলুন তো?
একটা লোক এত বই পড়বে কেন, বইই যদি পড়ে কাজ করবে কখন? 
রণেন বললেন, আমার কাজ এইটাই।
কাজটা আপনাকে কে ঠিক করে দিয়েছে? কেশরীলাল জিজ্ঞেস করে। 
আমি নিজে ঠিক করে নিয়েছি। রণেন বললেন। 
কেশরীলাল জিজ্ঞেস করল, নিজের কাজ কি নিজে ঠিক করা যায়?
যায়, দেখছেন তো আমি করেছি এখন। রণেন বিরক্ত হলেন। 
কেশরীলাল বলল, মনে রাখবেন প্রত্যেকের বস থাকতে হবে, আর সুপ্রিম বস ভগবান।
রণেন কোনো মন্তব্য করলেন না। 
কেশরীলাল জিজ্ঞেস করল, আপনি কি টেলিভিশন দ্যাখেন না?
দেখি। সংক্ষিপ্ত উত্তর রণেনের। 
কী দ্যাখেন?
রণেন বললেন, চ্যানেল সার্ফ করে যেটি পছন্দ হয়, কী দরকার জেনে?
কেশরীলাল বলল, তাতো জানি না, সব কথার কি কোনো উদ্দেশ্য থাকে? 
তিনি বললেন, থাকে। 
কেশরীলাল বলল, থাকতে পারে কিন্তু আমি বুঝি না, আপনি কী পড়ছেন এখন?
আপনি বুঝবেন? বিরক্ত রণেন বললেন।
বলুন না শুনি?
আমি কবিতা পড়ছি।
কার কবিতা ?
রণেন বলতে কেশরীলাল বলল, এই নামটি আমি শুনিনি, এমন অদ্ভুত কবির কবিতা পড়েন কেন? 
রণেন বললেন, কী পড়ব তা কি আপনি সাজেস্ট করবেন?
ইয়েস স্যার, তাইই, একবার পড়ে দেখুন না, নিজের নির্বাচন ভুল তো হতে পারে, সব ভুল কি আমরা ধরতে পারি, না বুঝতে পারি, আপনি কি বদল দেখতে পাচ্ছেন না, আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড...।  
                                              

লোকটাকে ব্রেকফাস্ট দিতে হলো। ব্রেড, বাটার এবং ওমলেট। রুকসানা কিন্তু ডিমের ওমলেটে লবন দিয়েছে বেশি। রণেন বুঝলেন, রুকসানা মাসি মেয়েকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছে। আজ কাজে মন নেই। সালিশি যে কোনোদিন বসবে। কিন্তু রুকসানা তাঁর মেয়ে সুচরিতাকে বলেছে, অনেকবার সালিশি হয়েছে, সবাই কুলছুমকে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে বলে। কুলছুম যায় আর মার খেতে খেতে পালিয়ে আসে। থানায় গিয়েছিল মাসি, থানা বলেছে মিটিয়ে নিতে। শ্বশুরবাড়িতে অমনি হয়। 

কেশরীলাল বলল, সে একটু বেশিই নুন খায়, তার অসুবিধে হচ্ছে না, কিন্তু কথাটা হয় তো সত্য নয়। অনেকটা নুন দিয়েছে রুকসানা মাসি। কেশরীলাল তাইই খেয়ে নিচ্ছে। তাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। সে বলল, স্যার আপনার পক্ষে নুন বেশি, আপনার হাই ব্লাড প্রেশার, আপনার হেলথ রিপোর্ট আছে আমাদের কাছে, এ কেমন কুক, ছাড়িয়ে দেবেন।
ও একটা প্রব্লেমে আছে। বললেন রণেন মুস্তাফি।   
রুকসানা কিচেন থেকে বলল, দুধ কর্নফ্লেক্স খাও দাদাবাবু, দিচ্ছি।  

তাইই হলো। রণেন ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন গতকাল রাতে সালিশি বসেছিল কি না? সালিশি মানে প্রায় সমস্ত রাত। রাতভর দুপক্ষের কথা, সাক্ষী, মুরুব্বিদের অভিমত ইত্যাদি হয়েই যায়। তবে সকলেই যে এক পক্ষে তা নয়। কুলছুমের পক্ষেও আছে কেউ কেউ। কিন্তু মেয়েদের পক্ষে বেশি পুরুষ থাকে না। রুকসানা মাসি বলছিল, তাদের অহংকারে লাগে দাদাবাবু, মেয়েছেলে সব সময় পায়ের তলায় থাকবে, সালিশি যতই হোক, মেয়ে হারবেই, দোষ তার পড়বে। 
কেশরীলাল জিজ্ঞেস করে, এই কাজের মেয়ে এমনই করে সব সময়?
তিনি বললেন, ও মেয়েকে নিয়ে খুব সমস্যায় আছে। 
কেশরীলাল জিজ্ঞেস করে, কেন, কেউ কিছু করেছে?
না, তা নয়, আবার নয় যে তাও বলা যায় না।  
কেশরীলাল জিজ্ঞেস করে, তাহলে কী হয়েছে, পেছনে লেগেছে কেউ?
না, থাক। রণেন বলতে চাইলেন না। মাসি তো তাকে বলে কম, যা বলে তাঁর মেয়ে সুচরিতাকে। 
আচ্ছা, আমি তা শুনতে চাই না, আমার কাজ আপনাকে নিয়ে, কিন্তু আপনি ওকে রেখেছেন কেন?
রেখেছি মনে হয়েছে রাখা যায়, খুব যত্ন করে, অনেক বছর আছে।
উঁহু, খুব সহজ নয় এই মেয়েটি, এত নুন দিল ওমলেটে, ওর মেয়ে কী করেছে, প্রেগন্যান্ট হয়েছে?
বিরক্ত হলেন রণেন, জিজ্ঞেস করলেন, সবই কি শুনতে হবে?  তারপর খবরের কাগজ টেনে নিলেন। তা দেখে কেশরীলাল বলল, আমার আজকের ডিউটি এখানে, আমি চাই আপনি আমি নানা বিষয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করি, এই আড্ডা আর কী, এই কাজের মেয়ে কতদিন আছে? 
মনে নেই। রণেন বললেন। 
আপনি রেগে যাচ্ছেন, আমি কিন্তু আড্ডাই দিচ্ছি, জেরা করছি না। বলল কেশরীলাল। 
রণেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ইহুদিদের কথা জানেন?
তখন ফোন বাজল রণেনের। তিনি ফোন হাতে ভেতরের ঘরে গেলেন। মেয়ে ফোন করেছে। সে অফিসে পৌঁছে গেছে। পরের মেট্রোতেই একজন সুইসাইড করেছে। একটু দেরি হলেই আটকে যেত। হ্যাঁ, বাবা, যে সুইসাইড করেছে সে নাকি একটি মেয়ে, হাত ব্যাগে হসপিটালের বিল, প্রেস্ক্রিপশন, রিপোর্ট।
তোকে কে বলল?
ফেসবুকে চলে এসেছে সব। বলল সুচরিতা, ফোটো পর্যন্ত।
ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দিয়েছে, ইস, না দিলে কী হতো? রণেন বললেন। 
জানি না বাবা, মনে হয় হসপিটালে যেতে গিয়ে সুইসাইড, আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে বাবা। সুচরিতা বলল, রুকসানা মাসিকে বলো না, মেয়ে যে কাজেই ঢুকছে, বরটা হাজির। 
না বলার কী আছে, খারাপ খবর শেয়ার করতে ভয় লাগে। রণেন বললেন। 
কিন্তু এই সুইসাইড কতজন শেয়ার করছে বাবা। সুচরিতা বলল। 
তুই দেখিস না ফেসবুক। বললেন রণেন, অফিসে আছিস যে।
বন্ধ করে দিয়েছি খুলেই, বাবা ওই লোকটা কি চলে গেছে? সুচরিতা জিজ্ঞেস করল। 
লোকটা যায়নি শুনে সুচরিতা বলল, সকালটা নষ্ট হলো তো। 
তিনি ফিরে এলেন। তখন কেশরীলাল বলল, আপনি ফোন সুইচড অফ রাখতে পারেন কিংবা সাইলেন্ট মোডে, আপনার তো আরও অনেক ফোন আসতে পারে।  

তিনি কিছু বললেন না। কিন্তু তখনই আবার ফোন বাজল। এবার অবশ্য নেটওয়ার্ক কোম্পানি থেকে। কত রিচার্জ করলে কত লাভ হতে পারে। কল চার্জ রিডিউজ করা যাবে কত রিচার্জ করলে ইত্যাদি ইত্যাদি। রণেন তা শুনতে লাগলেন। যেন অনন্ত সময় ধরে শুনছেন। কেশরীলাল তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। অপেক্ষা করছে। নেটওয়ার্ক কোম্পানির বচন শেষ হলো। কেশরীলাল বলল, কথা আরম্ভ করুন। 
আমার তো কোনো কথা নেই। রণেন বললেন। 
বাহ, আপনি কী একটা নিয়ে কথা বলছিলেন যেন। কেশরীলাল বলল, কী নিয়ে যেন কথা এগোচ্ছিল?  
ভুলে গেছি। বললেন রণেন মুস্তাফি। 
তাহলে যে কথোপকথন আবার নতুন করে আরম্ভ করতে হয়। বলে কেশরীলাল সিংহ নিজের মাথায় হাত রেখে যেন স্মৃতি জাগরণে ব্রতী হলো। কিন্তু এ তো সদ্য ঘটতে থাকা আলাপ। কোথায় তা শেষ হয়েছিল তা খুঁজে বের করা। না পেরে সে বলল, আপনি জানেন, কিন্তু বলছেন না।
হাসলেন রণেন মুস্তাফি। বললেন, আমি সব মনে রাখতে পারি না। 
দেখুন ভোরে আমি স্বপ্ন দেখেছি একটা, সেইটা নিয়ে কি কথা বলছিলাম?
কী স্বপ্ন? রণেন মুস্তাফি জিজ্ঞেস করলেন। 
মাছের, অনেক মাছ। লোকটা বলল, স্বপ্নটা কিন্তু মনে আছে। 
রণেন মুস্তাফি বললেন, ভালো স্বপ্ন, শুভ, শুভ কাজে মাছ দরকার হয়, বিবাহে, গাত্র হরিদ্রায়।
মাথা নাড়তে লাগল কেশরীলাল, বলল, নো স্যার মাছের স্বপ্ন মানে মৃত্যু, একজন কিংবা অনেকজন মারা যাবে, আমি তাইই জানি।
কে বলল? রণেন জিজ্ঞেস করলেন। 
আমি জানি স্যার, এক সময় আমি প্রায়ই মাছের স্বপ্ন দেখতাম, তারপর তো ভয়ানক হলো, অনেক মানুষ মরল, ছুরি, রিভলবার, তলোয়ার, চাপাতি… দাঙ্গা আরম্ভ হতে স্বপ্ন দেখা বন্ধ হলো, মায় এক্সপেরিয়েন্স, ইন দ্য ইয়ার ২০০২, ২০০৭…। 

আমি মাছের স্বপ্ন দেখলে সুসংবাদ আসে, বিবাহ হয়, শিশু জন্মায়, বধূ গর্ভবতী হয়। রণেন মুস্তাফি মগ্ন স্বরে বললেন, আমার কন্যা জন্মের আগে আমি মৎস্য কন্যার স্বপ্ন দেখেছিলাম। নেমে এলো যেন কাক ডাকা ভোরের অব্যবহিত আগের নীরবতা। তা ভেঙে দিল কেশরীলাল সিংহ, বলল, হতেই পারে না, আমার স্যার বলেছেন হিটলারের প্রিয় স্বপ্ন ছিল মাছের, উনি দেখতেন নদীর মাছের স্বপ্ন, ইয়েস স্যার, দিস ইজ ফ্যাক্ট, রাইন নদী ভরে গেছে অসংখ্য মাছে, তিনি ঘুম থেকে উঠে অর্ডার করতেন, ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে পাঠাও, ওহ, মি. মুস্তাফি মনে পড়ে গেছে, আমরা মহান হিটলারের কথা বলছিলাম, মাছের স্বপ্ন ফিরিয়ে দিল হিটলারকে।  
ইহুদিদের কথা আপনি জানেন মি. কেশরীলাল? 
জানি, হিটলারের গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে ইহুদি নিকেশ করতে চেয়েছিলেন হিটলার।
না না, ইহুদিদের ইতিহাস?
কেন, গ্যাস চেম্বারে মরা কি ইতিহাস নয় ?
আপনার কি মনে হয় হিটলার ঠিক করেছিল? আলটপকা জিজ্ঞেস করলেন রণেন।
কেশরীলাল হাসে, এ কি একটা প্রশ্ন হলো স্যার, হিটলারকেও যদি জিজ্ঞেস করেন, তিনি বলবেন ঠিক হয়নি, কিন্তু সব কিছুই আবার নতুন করে ভাবা হচ্ছে, কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক, জার্মানিতে নিও নাৎসি গ্রুপ খুব সক্রিয়, তারা বলছে…।  
ঠিক হয়নি কিন্তু দরকার ছিল, তাই তো?
কেশরীলাল বলল, না তারা বলছে ঠিক হয়েছিল, হিটলার তাদের হিরো।
আপনি কী বলেন, হিটলার ঠিক করেছিল? রণেন জিজ্ঞেস করলেন। 

আমাকে আপনি কোনো প্রশ্ন করতে পারেন না স্যার, গ্যাস চেম্বার নিয়ে কোনো কথা বলতে তো আসিনি আমি। কেশরীলাল বলল মোবাইল খুঁটতে খুঁটতে, পৃথিবীতে অনেক কাজই আরম্ভ হয়েছিল, কিন্তু শেষ করা যায়নি, পরে সেই সব কাজ অনুসরণ করা হয়েছে।   
তখন রণেন মুস্তাফি মনে করতে চাইছিলেন ঈশ্বর নির্দেশিত পুণ্যভূমির কথা যার খোঁজে মোজেস মিশর ফারাওয়ের দাসদের মুক্ত করে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিলেন। লোহিত সাগর পার হয়ে সিনাই মরুভূমিতে, পাহাড়তলীতে ঘুরে মরেছে যাযাবরের দল। কিন্তু তার ভেতরেও ব্যভিচারের জন্য একটি নারী ও একটি পুরুষকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে যাযাবরের দল। ঈশ্বরের নির্দেশ। কিন্তু তাঁর চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটছিল। তিনি স্থিত হতে পারছিলেন না। তিনি সম্বিত বসুর কবিতার কথা ভাবতে চাইছিলেন, কিন্তু মনে করতে পারছিলেন না। এরকম ঘটে এক একদিন। সেই যে একটা লোক এসেছিল তাঁর কাছে, সে একটা দার্শনিক তত্ত্ব খুঁজে পেয়েছে। খুঁজে পাওয়া মানে, ছিল কিন্তু হারিয়ে গিয়েছিল। সে আবার উদ্ধার করেছে ভেবে ভেবে। লোকটা খুব ভাবে। নাম বলেছিল ভাবুকচরণ। সেই ভাবুকচরণকে তিনি কোথাও দেখেছেন মনে হয়েছিল। থাকে ডানকুনির দিকে। এখন নানা রকম বাস হয়েছে। তারই একটায় চেপে শ্যামবাজারে নেমে অটোতে চেপে ঠিক খুঁজে খুঁজে তাঁর ফ্ল্যাটে চলে এসেছিল। তারপর কী বকবকানি। থামেই না। আর সে কথা বললে খুব থুতু ছেটায়। দুটি দাঁতের ভেতরে ফাঁক আছে অনেকটা। আজগুবি কত কিছুই না ভেবেছে। সেই যে সেই কার্তিকচন্দ্র পালের মতো প্রায়। পৃথিবীর চারপাশেই সূর্য ঘোরে। পৃথিবীতে মানুষের বাস। মানুষই শ্রেষ্ঠ প্রাণী। সুতরাং পৃথিবী সচল হবে কেন, হিমালয়ের মতোই অনড়। সূর্য তাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে। সেই লোকটা বলেছিল, আর একটা নক্ষত্র আসছে পৃথিবীকে ঘিরে পাক দেওয়ার জন্য, সূর্য আর তার ভেতরে সংঘর্ষ লেগে গেলে পৃথিবী সাময়িক অন্ধকার হয়ে থাকবে, তখন অবশ্য চাঁদের আলো থাকবে…। পনের দিন ভুতুম রাত্রি, আর পনের দিন পেলব জোছনা। কে বলেছে এই সব কথা? গড। আগডুম বাগডুম গল্প। তাঁকে শুনতে হয়েছিল। কিন্তু আনন্দ হয়েছিল  শুনে। কত রকম ভাবতে পারে মানুষ। এখন দুধের শিশুও কি বিশ্বাস করবে এই গল্প?  কিন্তু রুকসানা মাসি বলেছিল, এই গল্প তো ডর লাগিয়ে দেয় দাদা, এমন কি হতে পারে সত্যি?

রুকসানাকে বুঝিয়ে ছিলেন তিনি। বুঝেছিল। তারপর বলেছিল, গল্পটা শুনতে ভালো, কিন্তু গা ছম ছম করে, আচ্ছা, চাঁদের আলোয় কি কাপড় শুকাবে, শীতকালে রোদ না-থাকলে কি ভালো হবে দাদা? এমনি যেন না হয়। 
কেশরীলাল জিজ্ঞেস করল, আপনি এখন ইহুদি-ইতিহাস পড়ছেন কেন?
ইচ্ছে হলো নিজের জানাকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া, সব মনে আছে কি না পরখ করে নেওয়া।  
দাস, মুক্তি, মহানিষ্ক্রমণ, এতো সকলেই জানে, আপনি জানেন না?
রণেন বললেন, আপনি কি এই সব কথা বলতে এসেছেন?
কথা তো কথার পিঠে জন্ম নেয়, স্যার আপনি কি গান শোনেন?
রণেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি শোনেন না ?
কানে যা আসে শুনি, আপনি কী গান শোনেন? 
রণেন বললেন, বাজাই বরং।
কী বাজাবেন? কেশরীলাল জিজ্ঞেস করে। 
রণেন বললেন, বড়ে গুলাম আলি খান, শুনবেন?
না, গান মানুষকে দুর্বল করে দেয়, না শুনলেই ভালো। কেশরীলাল বলল। 
গান অন্তরকে শুদ্ধ করে দেয়। রণেন মুস্তাফি বললেন।
অন্তর শুদ্ধ হওয়া তো দুর্বলতার লক্ষণ, গান শোনা মানে সময় নষ্ট। 
রণেন বলল, মিউজিক শুনুন বরং। রণেন উঠে মিউজিক প্লেয়ারের সুইচ অন করলেন। গতকাল অনেক রাত অবধি শুনেছেন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি। তা বেজে উঠতেই, কেশরীলাল বলল, থাক স্যার কথা বলতে অসুবিধে হবে।
লো ভলিউমে বাজুক। বললেন রণেন মুস্তাফি। 
নো স্যার, তাহলে আমি আমার প্রশ্নগুলো ভুলে যাব, ইদানীং তা হচ্ছে। কেশরীলাল বলতে লাগল, বাঁশি আরও বিপজ্জনক, মাথার ভেতরে ধোঁয়া ঢুকিয়ে দেয়, সব কাজ পণ্ড করে দেয়। 
                               

 
সময় যাচ্ছে। বেলা বেড়ে গেছে অনেক। লোকটার কথা কম নয়। ভেবে এসেছে সব। সেই ভাবুকচরণের মতো। যা বলা হয়, সে বলে, গড বলেছে তাকে। কোন গড? গড ইজ গড। রাত্রে একা যদি চারতলা বাড়ির ছাদে বসে থাকেন, আর মনে করেন ভগবান আপনার সামনে এসে দাঁড়াবেন, কিছু শুনে যাবেন, কিছু বলে যাবেন, তবে তাইই হবে, হবেই। এই কেশরীলালেরও জবাব লেগে আছে মুখে, শ্রীকৃষ্ণ যে বাঁশি বাজিয়ে রাধাকে ঘর থেকে বের করে আনতেন তা শুনে সে বলল, ভগবানের কথা আলাদা স্যার, মানুষ কি ভগবান হতে পারে, ক’দিন আগে ব্যভিচারের অভিযোগে একটা বউকে মাথা মুড়িয়ে বিবস্ত্র করে গাঁয়ে হাঁটিয়েছে মুরুব্বিরা, জানেন না? 
আপনি সমর্থন করেন?
সমর্থন অসমর্থনের কিছু নেই স্যার, সমাজ এই ভাবে চলে। 

রণেন জানেন। দলিত বধূ। তার স্বামী দুহাত জোড় করে নিজের স্ত্রীর পিছনে হেঁটে যাচ্ছে। মোবাইলে সেই ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেছে। এরপর পুলিশ যায়। সরপঞ্চ উধাও। তিনি তাঁর একটি ব্লগে উল্লেখ করেছেন ঘটনাটি। আসল ঘটনা অন্য। যুবতীকে যাঞ্চা করেছিল বুড়ো সরপঞ্চ। সে রাজি না-হওয়ায় তাকে সর্বজনের সমুখে বিবস্ত্র করে চুল কেটে দেওয়া হয়। তাঁর ব্লগের পর অনেক শাসানি, চোখ রাঙানি এসেছিল। সেই ঘটনার পরিণতি কী হয়েছে তা আর জানা নেই।   
রণেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আর কী জানতে চান?
কেশরীলাল বলল, একটা পাহাড় লিজ দেওয়া হচ্ছে বক্সাইট থেকে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশনের জন্য, ট্রাইবালরা আটকে দিচ্ছে, আপনার কী মত?
আমি ব্লগে লিখে দিয়েছি। তিনি জবাব দিলেন।                                                                                  
সমুদ্রতীরে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প হবে, আপনার কী মত?
এই ব্লগ ছাপিয়েছে একটা ছোট পত্রিকা, আর চেরনোবিল চাই না, আপনার কী মত? 
কেশরীলাল জিজ্ঞেস করল, আমার কোনো মত নেই স্যার, আমাকে আপনি প্রশ্ন করতে পারেন না, আচ্ছা ধর্মের পক্ষ ও বিপক্ষ, আপনি কোন দিকে?
আমি ব্লগে লিখেছি, গাড়ির পিছনে ঘোড়া জুড়তে চাই না আমি। রণেন মুস্তাফি বললেন। 
এর মানে কী, ক্লিয়ার করে বলুন স্যার। কেশরীলাল বললেন। 
আমিও ঠিক জানি না এর মানে। বললেন রণেন মুস্তাফি। শুনে কেমন ভ্যাবলা হয়ে গেল কেশরীলাল সিংহ, বিড়বিড় করে বলল, গাড়ির পিছনে ঘোড়া, বুঝতে পারছি আবার পারছি না, মানে?
মনে এল বললাম, সব কিছুর মানে হয় না। বললেন রণেন মুস্তাফি। 
আপনার স্ত্রী নেই, একটিই কন্যা তো?
হ্যাঁ, কেন? রণেন অস্বস্তি বোধ করলেন। 
শি ইজ টোয়েন্টি ফাইভ, বিয়ে দেননি কেন? 
আপনাকে জবাব দিতে হবে নাকি?
রেগে যাচ্ছেন কেন স্যার, আমি কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করেছি, আপনি উত্তর দিতে পারেন, নাও পারেন, আমার কাজ রিপোর্ট দেওয়া। কেশরীলাল নিরীহ মুখে বলল। 
তখন একটা ফোন এলো। আবার সুচরিতা। ফোন নিয়ে রণেন মুস্তাফি উঠে গেলেন ভেতরের ঘরে। সুচরিতা বলল, বাবা, লোকটা চলে গেছে?
না, কেন? জিজ্ঞেস করলেন রণেন। 
এতক্ষণ থাকবে কেন সে, তোমার কাজ নষ্ট, লোকটাকে আমার পছন্দ হয়নি প্রথমেই।
রণেন বললেন, ইন্টারেস্টিং, ওকে কেউ পাঠিয়েছে।
কে? সুচরিতা বলল, আমি ওর ছবি নিয়ে এসেছি, ও জানেই না মোবাইলে কোন ফাঁকে তুলে নিয়েছি, ফেসবুকে আপলোড করে দেব?
কেন, ফেসবুকে দিয়ে কী হবে? রণেন জিজ্ঞেস করলেন। 
আমি ওর পরিচয় জানতে চাই বাবা, হু ইজ হি? 
ফেসবুক থেকে জানতে পারবি?
কেউ না কেউ চিনবেই, বলে দেবে, আমি পাবলিক করে দেব ছবিটা, তোমার পারমিশন নিচ্ছি বাবা, পরে কিছু বলবে না। বলে হাসল সুচরিতা। 
বরং ক্যাপশন দে, ‘আজ সকালের অতিথি’।
ওক্কে, থ্যাঙ্ক ইউ বাবা, লোকটার পরিচয় জানতে হবে। সুচরিতা ফোন কেটে দিল। রণেন ফিরে এলেন। তখন কেশরীলাল বিরক্ত হয়ে বলল, এত ফোন এলে কথা হয় না, কার ফোন?
আপনি চিনবেন না। রণেন বললেন। 
আপনার কল লিস্ট থেকে জানা যাবে, এখন কোনো কিছুই প্রাইভেট না স্যার। বলল কেশরীলাল, মেয়ে ফোন করেছিল?
রণেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পুত্র না কন্যা?
আঁজ্ঞে, দুই কন্যার পর এক পুত্র, আমার একটিই পুত্র, মেয়েরা জন্মায়নি।
হিম স্রোত বয়ে গেল যেন শিরদাঁড়া দিয়ে, রণেন সোজা হয়ে স্বাভাবিক হতে চাইলেন, বললেন, জেন্ডার ডিটারমিন করেছিলেন?
কেশরীলাল জবাব দিল না। 
আপনার কষ্ট হয়নি? রণেন মুস্তাফি জিজ্ঞেস করলেন। 
কেশরীলাল বলল, কী যে বলেন আপনি, যারা জন্মায়নি, মানে জন্মাতে দিইনি, তাদের জন্য কিসের দুঃখ, যাকগে, বললেন না মেয়েকে বিয়ে দেননি কেন?
আপনি অধিকার ছাড়িয়ে যাচ্ছেন, আপনি যা করেছেন তা হত্যাকাণ্ড। রণেন বললেন। 
কেশরীলাল বলল, আমার কর্তা যা বলবেন, আমাকে তাই করতে হবে, আমার নিজস্ব কোনো দুঃখ নেই, উদ্দেশ্য নেই মি. মুস্তাফি, আচ্ছা আপনি কী মনে করেন, হত্যা আর ধর্ষণই ভয় দেখাবার প্রকৃষ্ট উপায়, এতেই বেয়াদবি বন্ধ হয়। 
আমি ব্লগে লিখেছি। রণেনের শির দাঁড়া সোজা হয়ে উঠল। 
গ্যাস চেম্বার যে ঠিক হয়েছিল, স্বপ্নে মৎস্য মানে মৃত্যু, সেই বিশ্বাস আবার ফিরে আসবে, তিনিই হিরো অফ দ্য পাস্ট সেঞ্চুরি, আপনি তা নিয়ে ব্লগ লিখুন, সব কিছু পাবেন স্যার। কেশরীলাল মোবাইল খুঁটতে খুঁটতে বলল, আপনাকে আমরা তুলে ধরব, শ্রেষ্ঠ ভাবুক।  
আপনি কেন এসেছেন? রণেন উঠে দাঁড়িয়েছেন, আপনি কে?  

আই অ্যাম আ শ্লেভ স্যার, দিস ইজ দ্য সেঞ্চুরি অফ শ্লেভারি, আপনার  ব্লগ মুছে দিয়ে নতুন ব্লগ লিখে দিতেই আমার আসা স্যার। বলতে বলতে লোকটা কাশতে লাগল, আপনার এবং মেয়ের পাসওয়ার্ড দিন, সব ব্লক করে দেব, উফ, কী পুড়ছে, আপনাদের নামে নতুন কথা আমরাই লিখে দেব…, উফফ, কী পোড়াচ্ছে আপনার ওই কিচেনে, চোখ জ্বলে যাচ্ছে মি. মুস্তাফি।            

তখন রান্নাঘর থেকে তীব্র একটা ধোঁয়া উৎকট গন্ধ কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। সে যেন হিরোসিমার আকাশে তেজস্ক্রিয় মেঘ। রন্ধ্রপথে মারণ গ্যাস। বোঝ কেমন লাগে। ঘিরে ফেলল ফ্ল্যাট। শুকনো লঙ্কা আর মশলা এক সঙ্গে পুড়িয়েছে মেয়ে কুলছুমকে নিয়ে  উদ্ভ্রান্ত রুকসানা মাসি। তিনি নাকে রুমাল দিলেন। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। কেশরীলাল ভয়ানক কাশতে আরম্ভ করল। এইটা কী মি. মুস্তাফি, এ কী হচ্ছে, বেয়াদপ মেয়েছেলে জানে না লঙ্কা পোড়ালে কী হয়।   

বিব্রত রণেন মুস্তাফি ডাকলেন, রুকসানা মাসি, কী করছ, শুধু ভুল করছ, কুলছুমের সালিশি হলো?  না এলেই পারতে আজ।
রুকসানা সাড়া দিল, তুমি বসো, আমি চা দিচ্ছি, মেয়েকে আমি বুঝে নিচ্ছি দাদাবাবু, কিন্তু...।

লোকটি ছুটে ফ্ল্যাটের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শীর্ণকায়া রুকসানা মাসি লগবগে পায়ে বেরিয়ে এসে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, আমি যা বুঝি, তুমি বুঝছ না কেনে দাদাবাবু, বারবার সাবধান করছি, লোকটা তুমারে ভয় দেখাতে আর তুমার সকাল নষ্ট করতে এসেছিল, সকালটা নষ্ট হলে সারাটা দিন কি ভালো যাবে, মেয়েরে সাবধান করে দাও, বুঝতি পারছনি কেডা এয়েছিল, আমার মেয়ে নিয়ে আমি তো যুঝেই যাচ্ছি দাদাবাবু, তারে ও কী করবে, নুন ঠেসে দেব না মুখি। 


অমর মিত্র কথাসাহিত্যিক। তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অশ্বচরিত উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার,গাঁওবুড়ো গ্রন্থের জন্য ও’ হেনরি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বসবাস করেন।

menu
menu