আপস


গুছিয়ে লিখতে পারছিলাম না। মাথা ঠান্ডা না হলে কি লেখা যায়! কলম ধরে দুকথা লিখতে যাবো, ওমনি মাথা গরম। রাগ আর উত্তেজনার দাপটে শরীর কেঁপে উঠছিল। বিষয়টা অন্যের হলে খস খস করে গুছিয়ে লিখে ফেলতাম। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে পারছি না। মুখে বলতে পারছি। উকিলবাবুকে ঘটনাটা খুলে বলেছিলাম। উনি ব্যস্ত মানুষ। হাতে প্রচুর কেস। সব শুনে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘কেসের মেরিট আছে। বিষয়টা লিখে আমার সেরেস্তায় জমা দিন।’ 
— মুখে বললে হবে না?’ ঢোঁক গিলে মৃদু আপত্তি জানিয়ে ছিলাম।  
দু’পাশে মাথা নাড়লেন উকিলবাবু, ‘হবে না। ইংরাজি হোক বাংলায় হোক যেমন আপনার সুবিধা। পরের কাজ আমার। কেস সাজানো, আইনের ধারা রুজু করা।’ একটু থেমে আবার, ‘থানায় অভিযোগের মেমো নম্বরটাও লিখবেন।’

লিখবো কী! চেষ্টা করলেই মাথায় আগুন। শরীর কেঁপে উঠছে। উত্তেজনায় বুক ধড়ফড়। হবে না কেন! বঞ্চনা ঘৃণা হয়রানি অর্থদণ্ড চাকরি চলে যাওয়া, কোনটা ঘটেনি! কী অপরাধ আমার? নিরীহ সৎ বয়স্ক স্কুলমাস্টার কী অপরাধই বা করতে পারে! 
হয়তো অন্যায় একটা করেছি। রাগের মাথায় মুখ দিয়ে সত্যি কথা বেরিয়ে গেছে। অঙ্ক ক্লাস দেওয়া হয়েছে। অঙ্কের নতুন মাস্টার বিধুশেখরবাবু অনুপস্থিত। দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বিয়ে করতে গেছেন। তাঁর ক্লাসগুলো আমাকে নিতে হবে। 

হেডমাস্টার বিরেশ হালদার যখন খরখরে গলায় আদেশটি জানালেন, ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কী বলব ভাবছিলাম। বারো ক্লাসের ছাত্রদের ক্যালকুলাস শেখানোর এলেম নেই আমার। মাধ্যমিক অবধি সায়েন্সের যে কোনো ক্লাস নিতে পারি। এই সব ভেবে কিছুক্ষণ পর বললাম, ‘ক্লাসটা অন্য কাউকে দিয়ে দিন।’
 বিরেশ হালদার মেজাজি টাইপের। রাশভারি। বয়সে জুনিয়ার। আমার কথাটা শুনেই মুহূর্তে রেগে লাল। চিৎকার করে উঠলেন, ‘সায়েন্সে অনার্স। সরকারের মাইনে নিচ্ছেন। উঁচু ক্লাসে পড়াতে পারবেন না?’

‘আমি কেমিস্ট্রি অনার্স। অঙ্ক অত ভালো জানি না।’ টিচার্স রুমে বসে ভদ্রভাবেই সত্যি কথাটা বলেছিলাম। ছোট থেকেই সত্যি বলা অভ্যাস। বিবেকানন্দ স্কুলে পড়েছি। স্বামীজিরা বারবার বলে বিবেকানন্দের বাণী মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ‘সত্যকে সর্বদা অনুসরণ করতে হবে।’ ‘সত্যকে কোনো কিছুর জন্য বিসর্জন দেওয়া যায় না।’ 

মুখ থেকে বেরিয়ে আসা সত্যি কথাটা শুনে গর্জন করে উঠলেন বিরেশবাবু। ‘আপনারা মশায় ডিগ্রি-কেনা মাস্টার। টাকা দিয়ে পাশ করেছেন।’ 
নিরীহ মানুষ, রাগ টাগ করি না। তবু কথাটা কানে ঢুকতেই মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। জলে যেন এক টুকরো সোডিয়াম পড়েছে। ভাবলাম, একবার তো ফোঁস করা উচিত। লোকটার হাল হকিকত সবাই জানে। কয়েক লাইন ইংরাজি ঠিক করে লিখতে পারে না। অথচ এমএ বিএড। আমার স্কুলের বন্ধু, এখন মালদার অক্রুরমনি স্কুলের মাস্টার সঞ্জিত বলেছিল, ‘বিরেশের এমএ ডিগ্রিটাটা ফলস। টাকা দিয়ে কেনা। জালিয়াত লোক একটা।’
কথাটা ভুলিনি। সঞ্জিত সিরিয়াস টাইপের ছেলে। বিবেকানন্দ ভক্ত। ফালতু কথা বলে না। ওর কথাটা বিশ্বাস করেছিলাম। ওই মুহূর্তে কথাটা মনে পড়ল আর দুম করে বলে ফেললাম, ‘আপনি-ই একটা ডিগ্রি কেনা মাস্টার। জালিয়াতি করে বারো বছর চাকরি করছেন।’

—এত বড় কথা! শালা বুড্ডা, এবার দেখ। বলেই মোটা শরীরটা নিয়ে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে সোজা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টাল সামলাতে না পেরে পলকা শরীর নিয়ে চেয়ার থেকে মেঝেয় পড়ে গেলাম। সেই অবস্থায় বুকে পেটে মুখেও লাথি কষাল বিরেশ হালদার। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। অন্য টিচাররা ওকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল। আমাকে হাত ধরে তুলল। বাথরুমে গিয়ে ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে নিয়ে মুখে মাথায় জল দিলাম। এর মধ্যেই টিচার্স রুমে ঢুকে শুনলাম, আমার নামে থানায় কমপ্লেন ঠুকেছেন হেডমাস্টার। নিজের অফিস ঘরে বসে ফোন করে আইসিকে জানিয়েছেন। লিখিত অভিযোগ কখন জমা দিলেন, জানি না। তবে সন্ধ্যার মুখে ডজন খানেক পুলিশ এসে বাড়ি থেকে আমাকে গ্রেফতার করল। বৌ ঘাবড়ে গিয়ে কান্নাকাটি চিৎকার শুরু করল, ‘মেয়ে নেই বাড়িতে, এখন একা আমি কী করবো?’ 

জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে উপরের ফোলা ঠোঁট নাড়িয়ে কষ্ট করেই বললাম, ‘একটা তো রাত। সকালেই ফিরে আসবো।’ 
কিন্তু ঘটল অন্য রকম। থানার হাজতে পেচ্ছাবের গন্ধ আর মশার কামড়। সারা রাত জেগে কাটালাম। পরদিন কোর্টে কেস উঠল। জামিনে ছাড়া পাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু হলো না। বৌ উকিল মারফত জানাল, পুলিশ ইনস্পেক্টর দুই লাখ টাকা চাইছেন। দিতে পারিনি। ক্রিমিনাল প্রসিডিংস শুরু করল পুলিশ। সরকারি কাজে নাকি বাধা দিয়েছি। ঘরে ঢুকে ভাংচুর,  হেডমাস্টারের ল্যাপটপ ভাঙা, দামি সব তথ্য নষ্ট করা। ঝুড়ি ঝুড়ি অপরাধ। পুলিশ কেস সাজিয়েছে ভালো। সবগুলো ধারাই ননবেলেবল। জামিন মিলল না। পুলিশের আর্গুমেন্ট শুনে তিন দিনের পুলিশ কাস্টডিতে পাঠালেন বিচারক। শুরু হলো চাকরি নিয়ে টানাটানি। সাসপেন্ড হয়ে গেলাম। কেস চলল। শেষমেস ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের একশো ছিয়াশি নম্বর ধারায় তিন মাস জেল খাটলাম। আর জেল খাটা আসামী এই নগেন নস্কর শিখরপুর হাইস্কুলের চাকরি থেকে বরখাস্ত হলো। 

জেল-মুক্ত হয়ে বারাসাত আদালতে আমিও কেস ঠুকলাম। তিন বছর পর কেসে জিতে চাকরিটা ফেরত পেলাম। সঙ্গে তিন বছরের মাইনে। তারপর দু’বছর চাকরি করে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ষাট বছরে অবসর নিয়েছি। রিটায়ার করা ছ’মাস হয়ে গেল কিন্তু পেনশন পাচ্ছি না। স্কুল থেকে ফাইলই যাচ্ছে না পেনশন দফতরে। হেডমাস্টার বিরেশ হালদার একটা না একটা অজুহাত খাড়া করে ফাইল আটকে দিচ্ছে। আমি বিপাকে। হাতে টাকা পয়সা নেই। খাওয়া জুটছে না।

এই ঘটনাটা গুছিয়ে লিখতে গেলেই মাথায় আগুন জ্বলে উঠছে। ডিগ্রি কেনা একটা ঠগবাজ। পার্টির নেতাদের সঙ্গে দহরম। লোকটা আমার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে দিল! 
বৌ বলে, ‘তোমারই ভুল। কী দরকার ছিল সত্যি কথা বলার? এখন ক্ষমা চেয়ে মিটমাট করে নাও।’
—লোকটার জাল ডিগ্রি, জেনেও বলব না?
—না। সবাই জেনেও চুপ করে থাকে।  

মেয়ে বলে, ‘বাবা ওদের সঙ্গে পারবে না। হাতে ক্ষমতা, যা খুশি করে দিতে পারে।’ মেয়ে একমাত্র সন্তান। বিএড পড়ে প্রাইভেট কলেজে। টাকা পাঠাতে হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভরতি করেছি। পাশ করে মেয়েটা ডিগ্রি পেয়ে যাবে কয়েক মাস পর। তারপর চাকরি করবে। এখন শুনছি, ওদের কলেজটা নাকি অনুমোদন পায়নি। মেয়ের ডিগ্রিটাও বাতিল হয়ে যাবে। কী যে করি!   
কার কাছে যাব? কতদিন চলবে আমার কেস? উকিলকে টাকা যোগাবো কেমন করে? জমানো টাকার সুদে তো সংসার চলে না। তার উপর বৌ-এর ওষুধের পিছনে বেরিয়ে যায় অনেকটা। অনেক দিনের ডায়াবেটিস। ওষুধ খায় কিন্তু সুগার কমে না। ডাক্তার ঠিক ওষুধ দিচ্ছে নাকি ওষুধগুলো জাল, কে জানে! আমাকে ওষুধ খেতে হয় না। শরীর ঠিকই আছে। সুগার প্রেসার নাই। কিন্তু অর্থের টানাটানিতে জেরবার। দুশ্চিন্তায় মাথা ঘোরে। কতদিন চালাতে পারবো, জানি না।  

এখন তো আর ফিরবার পথ নেই। ক্ষমা চাইলেই মিটে যাবে, তার ভরসা কোথায়? তাই আইন আদালতের ওপরই ভরসা রাখতে হবে। উকিল পরেশ সরকার লোকটা ভালো। তেমন পয়সা পিশাচ নয়। কিন্তু ওঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে ঘটনার বিবরণটা হাতে লিখে নিয়ে। সেটাই তো চাপ হয়ে যাচ্ছে। 
উকিলের অ্যাসিস্ট্যান্টকে ধরলাম। আজকাল ওদের বলে ল-ক্লার্ক। চটপটে বয়স্ক মানুষ। উনি লিখে দেবেন। ফিজ চাইলেন হাজার টাকা। দরদাম করে আটশোতে রাজি করালাম। ভদ্রলোক টাকা পকেটে ঢুকিয়ে স্কুলের নাম, ঘটনার তারিখ কাগজের ওপরে বসিয়ে ঝট ঝট করে লিখতে শুরু করলেন। এক ঘণ্টায় লেখা শেষ। সেই লেখা পরদিন উকিলবাবুর হাতে তুলে দিলাম। দু’দিন সময় নিয়ে ড্র্যাফট করলেন। অবশ্য শুরুতেই পাঁচ হাজার ফিজ দিতে হয়েছিল। অনেকগুলো ধারায় কেস রুজু হোল বারাসাত এসডিজেএম কোর্টে। কত নম্বর ধারা, কী কেস জানি না। তবে দু’একজন কলিগ বাড়ি এসে বললেন, ‘দাদা খুব ভালো কাজ করেছেন।’ 

‘ভালো মন্দ জানি না। যা করেছি, নিজের স্বার্থেই।’ কলিগদের কথার উত্তরে এটুকু বলে চুপ করে বসে রইলাম। ওরা অনেক ভালো ভালো কথা বলল। যাবার সময় বলে গেল, ‘আপনি সৎ লোক। জয় আপনার হবেই।’ 
কেসটা কোর্টে উঠলই না। কবে হিয়ারিং কেউ জানে না। আর এখনই জয়! মনে মনে বললাম। উকিলবাবুর কথাটা মাথায় ঘুরছে। বড় একটা শ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বলেছিলেন, ‘ভেবেছিলাম কেসটার মেরিট আছে। কিন্তু জাল ডিগ্রি, প্রমাণ করবেন কী করে?’ 
কী বলবো ভাবছিলাম। নিজের উকিলের সঙ্গেও চিন্তা করে কথা বলতে হয়। বন্ধু সঞ্জিত বলেছিল, ‘বিরেশ হালদারের ডিগ্রিটা জাল। প্রতাপগড় থেকে টাকা দিয়ে কেনা।’ 

আগের হেডমাস্টারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি ফাঁকা ঘরে একটা ঢোঁক গিলে উদাসীন ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘প্রতাপ সিং শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ডিগ্রি।’ 
উকিলবাবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আজকেও আগের প্রশ্নটাই করলেন, ‘হালদারবাবুর ডিগ্রিটা জাল, তার প্রমাণ কোথায়?’ 
সঞ্জিতকে জিজ্ঞেস করলে কিছু জানা যেত। কিন্তু ওর ফোন একটু বেজেই কেটে যাচ্ছে। হয়তো আগের নম্বরটা নেই। একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘ইউনিভার্সিটির ওই সালের লিস্ট থেকে পাওয়া যাবে না?’

—পাওয়া যাচ্ছে না। লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছি। ওই সালের রেজিস্টার উধাও। 
—বলেন কী?  
—ভিসি রেজিসট্রার কন্ট্রোলার সবাইকে তাহলে পার্টি করতে হয়। কেসের ফোকাস তো ঘুরে যাবে। তাতে সুবিধা পাবে বিরেশ হালদার। 
—উকিল হিসেবে আপনি কিছু করতে পারেন না? 
—রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টে তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি লিখতে পারি।  হয়তো লিখবো। হিয়ারিংয়ের আগে প্রমাণ জোগাড় করে তৈরি হতে হবে তো! এর মধ্যে

অন্য কাজ করেছি। এক রিপোর্টার সাহায্য করেছে। ওই ব্যাচের ইংরাজি এমএ ক্লাসের এক ছাত্রের হদিশ পেয়েছে রিপোর্টার। ও জানিয়েছে, বিরেশ হালদার নামের কোনো ছাত্র ওদের ব্যাচে ছিল না। 
—এটাই তো প্রমাণ। উত্তেজিত হয়ে বললাম।  
—ওই মানুষটি তো আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসবে না। প্রমাণ হবে কীসে? 
—জজসাহেব যদি তলব করেন। বিরেশ হালদারের মার্কসশিট সার্টিফিকেট দেখতে চান। তখনই প্রমাণ হয়ে যাবে সব। দুধ কা দুধ…। 
—অত্ত সোজা নয়। ইউনিভার্সিটিকে লিখে জানাতে হবে, সার্টিফিকেটটা জাল।  
—তাইলে প্রমাণ করা যাবে না? আমার পেনশনটাও ঝুলে থাকবে? 
—দুটো আলাদা ইসু। কথাটা বলে গম্ভীর মুখে বসে থাকলেন উকিলবাবু। কিছুক্ষণ পর ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘কী করবো বলুন। আপনি সাতদিন পরে আসুন।’ একটু থেমে আবার, ‘ভেবে দেখি, ডিগ্রি চুরির কেসটা প্রমাণ করতে পারি কি না!’ 
খানিক পর স্বগোতক্তির মতো বিড়বিড় করলেন, ‘জাল ডিগ্রি মেনে নেওয়া যায় না। কোর্ট শুধু এভিডেন্স এভিডেন্স করে চ্যাঁচায়। কিন্তু… লোকটার জাল ডিগ্রি প্রমাণ করবো কী করে?’

উকিলবাবু কেসটা নিয়ে চিন্তা করছেন। আমি সেদিন ভাবতে ভাবতে চলে এসেছিলাম। সাতদিন পর উনার বাড়ি গিয়ে শুনলাম, কোনো একটা কেসের ব্যাপারে উত্তর বাংলায় গেছেন। পরের সপ্তাহেও দেখা না পেয়ে ফিরে এলাম। কী করবো বুঝতে পারছি না। দিন দিন হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। বৌ মাঝে মাঝে বলে, ‘সততা ফততা দিয়ে কি পেট ভরবে? যাও হেডমাস্টারের হাতে পায়ে ধরে মিটমাট করে নাও।’

আমি তাহলে হেরে গেলাম! সারা জীবন সততার কথা বলে ওই লোকটার পায়ে পড়ব? ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় বাজারে দেখা হয়। ওদের সামনে দাঁড়াবো কেমন করে? ‘সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়’ এগুলো কি শুধু কথার কথা? ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছি। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে এসব কথাই ভাবছি। ঘুম নেই চোখে। রাতও এমন কছু হয়নি। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। কে করতে পারে? ভাবতে ভাবতে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ফোনটা ধরলাম। আশ্চর্য! ওপারে উকিলবাবু। স্বর গম্ভীর, ‘শুনুন, দরকারি কথা আছে। কাল সকাল নটায় বাড়িতে আসুন।’

কথা বলবার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলেন। কী দরকারি কথা বলবেন, জানতে সকাল বেলায় বেরিয়ে পড়লাম। মিনিট পনের অপেক্ষা করতেই দেখা পেলাম। ‘ভিতরে আসুন’ বলে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। দুজনের জন্যই চা এলো। সঙ্গে বিস্কুট। উকিলবাবুর সাদাকালো মোটা গোঁফের নিচে মৃদু হাসি। চায়ে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আপনি কি চান? পেনসন, না ডিগ্রি-চোরের শাস্তি।’
—দুটোই। ওই লোকটা জেলে গেলে পেনসন পেয়ে যাবো। নতুন হেডমাস্টার আসবেন। তিনি কোন্‌ যুক্তিতে আমার ফাইল আটকে রাখবেন?
—নতুন লোকটাও যদি আরেকটা বিরেশ হালদার হয়?  
—আপনি কী করতে বলেন?    
—কেস করবার চিন্তা ছেড়ে দিন। 

একটু থেমে উকিলবাবু আবার বলা শুরু করলেন, ‘শুনুন মাস্টামশায়, আদালতে বিচার পাবেন কিন্তু কত দিনে? তারিখের পর তারিখ পড়বে। বিচার পিছোবে আর বাদি বিবাদি সব পক্ষই বুড়ো হতে হতে মরে যাবে।’ 
—তাহলে এখন কী করবো?    
—পেনসনটা নিয়ে নিন। বারো বছর আগের জাল ডিগ্রী। সত্যতা প্রমাণ করা অসম্ভব।   
—আমি কি তাহলে মিথ্যে কথা বলছি! লোকটার ডিগ্রি জাল নয়? 
—লোকটার ডিগ্রী জাল। প্রমাণ পেয়ে গেছি। 
কেটে কেটে বললেন উকিলবাবু। 
—কী প্রমাণ?    
—উঁচু মহলের এক অফিসারের কথায় সত্যিটা ধরে ফেললাম। 
—কী কথা উকিলাবাবু?  

পরশু রাতের একটা ফোন, ‘দাদা, আপনি কেসটা চেপে জান। আমি ওর পেনসনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ উকিলবাবু বড় একটা শ্বাস ফেলে গলা নিচু পর্দায় নামিয়ে বললেন, 
—তাহলে কেস লড়বেন না? আপনার ফিজ…।   
—শুনুন, কেস লড়লে বিপদ আছে। আপনার, আমারও।  
—অপরাধী জেনেও ছেড়ে দেবেন? জালি লোক গুলোই শুধু জিতে যাবে?   
—যুগটাই এমন। যাক্‌, আপনি আপাতত পেনসনটা নিয়ে নিন।  

কী বলবো ভাবছি। পেনসন না পেলে অর্থ কষ্টে ধুঁকতে ধুঁকতে সপরিবারে মরণ। আর লোকটার চোরাই-ডিগ্রি প্রমাণ না হলে, নিজের কাছে মরে যাবো। কে যেন ভেতর থেকে বলল, লড়ে যা। গোটা পৃথিবী বিরুদ্ধে গেলেও সত্যকে ধরে থাকবি। 
—কী ভাবছেন? পেনসন নেবেন, না কেস করে জাল-ডিগ্রি ধরবেন?’ উকিলবাবুর স্বরে বিরক্তি। 
—পেনসনটা তো দরকার।   
—পেয়ে যাবেন। ফোন করে মিটমাট করে দিচ্ছি। কালকের মধ্যে আপনার ফাইল পেনসন দফতরে পৌঁছে যাবে। আর শুনুন… আরও পাঁচ হাজার আমাকে দেবেন। 

উঠে দাঁড়ালাম। মাথা নিচু। ফুসফুস নিংড়ানো একটা শ্বাস পড়ল। তেমন গরম নয়, পাখার নিচে বসে। কিন্তু জামাটা ঘামে ভিজে উঠল। চেষ্টা করলাম কিছু বলতে। কিন্তু কথা বেরোল না। 
উকিলবাবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তাহলে রফা করে নিন।’ 
আমার মুখে কথা নেই। খানিক শুকনো জিভ আর তালু ঘেস্টে একটাই শব্দ বেরোল, ‘আ আচ্ছা।’ 
 


সৌমিত্র চৌধুরী গল্পকার ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বসবাস করেন।সৌমিত্র চৌধুরী গল্পকার ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বসবাস করেন।

menu
menu