জড়োয়া 


বাবার মৃতদেহটা বাবার জীবদ্দশার মতোই রহস্য নিয়ে কবরে নেমে যায়। নিয়মমাফিক কৃত্যগুলো শেষ করে মৃতদেহের সঙ্গে আসা গ্রামের মুরুব্বীরা ফিরে যেতে থাকে। তাদের পাঞ্জাবির ছায়ায় লেগে থাকা নিয়মের মতো আবেগহীন নিস্তব্ধ সন্ধ্যা নামে ধীর পায়ে। নিজের একান্ত আবেগ নিজের সঙ্গী করে সবার শেষে শেষ মুঠোর মাটি খুব যত্নে কবরে ছড়িয়ে দেয় শিহাব, যেভাবে কৈশোরে একদিন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে দেখে ছিল গায়ে কাঁথা টেনে দিচ্ছে বাবা। তারপর চলে যেতে থাকা কাফেলার সঙ্গী হয় সে। পেছনে আব্দুর রহমানের কবর ঢেকে যেতে থাকে অনিবার্য অন্ধকারে, রাতের রহস্যময় অন্ধকার। একবার পেছন ফিরে তাকায় শিহাব৷ যে মানুষটাকে শুইয়ে রেখে গেল পারিবারিক কবরস্থানের সারিতে, তার সঙ্গে রেখে গেল তার এক জীবন যুদ্ধ, অপ্রকাশিত বেদনা, জীবনকে ঠিকঠাক ছুঁতে না পারার যন্ত্রনা আরও কত কী, কে জানে! 

শিহাব জানে শিহাব ছাড়া আর কেউ তলিয়েও ভাবেনি কোনোদিন লোকটাকে নিয়ে। যুবক হতে না হতেই বিদেশ যাওয়া এই এলাকার পুরুষদের তীব্রতম স্বপ্ন আর নিয়মিত স্বপ্ন ভাঙার নিয়তি। এই এলাকার ঘরে ঘরে আব্দুর রহমান আছে। দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়া যাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। উন্নত পাশ্চাত্যে যাবার কোনো যোগ্যতা যাদের নেই, মধ্যপ্রাচ্য তাদের গন্তব্য। পেট্রো-ডলারের হাতছানিতে ঘরবাড়ি বিক্রি, জমি বন্ধক, আর ফিরতে না পারা কত বেদনার ইতিহাস পুরো গ্রামের ঘরে ঘরে। আব্দুর রহমান তারই একজন বৈ তো নয়। শিহাব তাকে নিয়ে ভাবতে শিখেছে কৈশোর বেলা থেকে। বাজারে গিয়ে সাইকেলের দোকানে জুল জুল চোখে সাইকেলের দিকে তাকিয়ে থাকলে বাবা আবদুর রহমান যখন মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, সামনের বছর আইয়া কিন্যা দিমুনে, তখন শিহাব বাবার অসহায়ত্ব বুঝতো। বুঝতো বাবা যে মাসে মাসে টাকাটা পাঠায় সেটা বিদেশ নামের অচেনা স্বর্গে আকাশে উড়ে বেড়ায় না। 
তবে আর দেশে ফিরতে না পারা, আজীবন বিদেশ থেকে ঋণ শোধ করতে না পারা ইত্যাদি অনেক ভাগ্যাহতদের গল্পগাথার ভীড়ে আবদুর রহমান সৌভাগ্যবানদের একজন। বিদেশে যার বৈধ আয় ছিল। যে কয়েকবছর পর পর দেশে আসতে পারত।

দেশে তার বাবা-মা, ভাই-বোন বউ বাচ্চা সংসার নামের মায়া আর পিছুটান ছিল। তাদের প্রতি দায়িত্ব আর  দায়িত্ব পালনের তৃপ্তি কিংবা অহংকার ছিলো। দায়িত্ব মানে নিয়ম করে খরচ পাঠানো, ভাইয়ের ব্যবসা, বোনের বিয়ে, মায়ের বাতের ব্যথার চিকিৎসা। কোনো দিন অন্যথা হয়নি। বিয়ের আগে বাপ-ভাই আর বিয়ের পর স্ত্রী সন্তান সবাইকেই সন্তুষ্ট রেখেছে সে। হাসপাতালের খরচ থেকে ঈদের পোশাক।  শিহাব জানে এদের কেউ তলিয়ে ভাবেনি, ভাবার প্রয়োজনও বোধ করেনি, এই আব্দুর রহমান লোকটা মধ্যপ্রাচ্যে কী করে, কই থাকে, কীভাবে থাকে, কীভাবে টাকা পাঠায়। 

কেউই ভাবেনি কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয় হয়তো, আরেকজন নিশ্চয়ই ভেবেছে। সে শিহাবের মা আনোয়ারা। কিন্তু তার কোনো প্রকাশ কেউ কোনো দিন দেখতে পায়নি, দেখতে চায়ওনি অবশ্য।  মুখ বুজে সব বাস্তবতা আর পরিস্থিতি মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা ছিল না আব্দুর রহমানদের সংসারে। তবে আবদুর রহমানের অপার প্রেম আর টান ছিল আনোয়ারার প্রতি, সেখানে কোনো খাদ নেই। আলাদা করে কিছু টাকা পাঠানো তো বটেই সেই কবে থেকে দেখেছে শিহাব, প্রতিসপ্তাহে নিয়ম করে আনোয়ারাকে ফোন কল করত আবদুর রহমান।

মোবাইল ফোন আসার সেই প্রাথমিক যুগে আবদুর রহমান আনোয়ারার জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে মোবাইল ফোন এনেছিল। তার ছাড়া কথা বলার এই আচানক যন্ত্রটা দেখে চোখ টাটাতো পাড়া পড়শির। আর বাবার ফোন এলেই মা চলে যেতো ঘরের কোণে। ফিসফিস করে কী কথা বলতো দুজন কোনো দিন কান পেতে শোনা হয়নি, কিন্তু তারপর দিনভর রাতভর মায়ের মুখের হাসি যেন আর ফুরাতো না। আশেপাশের ঘরে ঘরে যখন চাচি ভাবিদের কথায় কথায় চড় থাপ্পড়টা খেতে দেখতো শিহাব কিংবা শরীরে স্বামীর মারের কালসিটে দাগ নিয়ে ফিরে আসতো এই ঘরের সুফিয়া ফুফু, ওই ঘরের রহিমা বুবু তখন হাজার মাইল দূরত্বে আবদুর রহমান আর আনোয়ারার প্রেম পুত্র শিহাবকে অপার আনন্দ দিতো। এই আনন্দ বুকের গহীনে সযত্নে পুষেই বড় হয়েছে শিহাব।

শিহাব জানে আনোয়ারা যে তাদের তিন ভাইবোনকে পাখির ডানার নিচে আগলে রেখে নিজের তুখোড় যৌবন আর জীবনকে চারপাশের নানা কিসিমের শকুনির থাবা থেকে রক্ষা করতে পেরেছে, সে কেবল এই দূরে থাকা আবদুর রহমানের তীব্র প্রেমের টানেই। এই যুদ্ধও আব্দুর রহমানের টাকা রোজগারের যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। বরং বেশিই কখনো কখনো। শ্বশুর, দেবর ননদদের বাক্যবাণকে যেন কিছুই নয় ভেবে অবহেলা করা, আশপাশের রোমিওদের উঁকিঝুঁকি তীব্রভাবে উপেক্ষা করা, বড় বউ হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের সব কাজে কোণঠাসা করে রাখার অবহেলাকে অগ্রাহ্য করা এসব কোনো সংসারী নারীর জন্য সামান্য যুদ্ধ নয়। কোনো কিছু নিয়েই কোনো প্রতিবাদ ছিল না আনোয়ারার। বোধ বিবেচনা হলে শিহাব বোঝে এও আবদুর রহমানেরই কৃতিত্ব। প্রেম আর টানে আনোয়ারাকে এমন মুগ্ধ করে রাখতো আবদুর রহমান কোনোদিন এই মহিলার মুখে কোনো অভিযোগ কিংবা বিরক্তি বাক্য শোনেনি শিহাব।
আব্দুর রহমানের পাঠানো টাকায় কেনা খাসির মাংস এক টুকরো বেশি চাইলে চাচিদের যে মুখ ঝামটা সহ্য করতে হতো, রাতে ঘুমানোর সময় মা মাথায় হাত

বুলিয়ে ব্যথা ভুলিয়ে দিতে দিতে খালি বলতেন, বাবারে কইস না। কী কষ্ট করে লোকটা, এইগুলা কইয়া তার কষ্ট আর বাড়াইস না। শিহাব বুঝতো বাবা নামের যে মানুষটির দায়িত্ব টাকা পাঠানোর মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বছর কয়েক পরপর দেশে আসার সময় এটা ওটা শৌখিন জিনিস নিয়ে আসা পর্যন্তই শেষ নয়, বরং ইথারে ভেসে আসা প্রেমে অসীম ভরসা ছিল বলেই মায়ের এই কঠোর লড়াই।

ঘরে ফিরে নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগে শিহাবের। দূর থেকে অস্পষ্ট দেখে ভেতর ঘরে বিরহে কাতর আনোয়ারাকে ঘিরে আছে পাড়ার মহিলারা। শোকে স্তব্ধ আনোয়ারা খাতুন বিছানায় শুয়ে আছে মৃতের মতোই। অধিক শোকে পাথর বলেই হয়তো মৃতের মতোই নিষ্প্রাণ শুয়ে আছে সে। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠা কিংবা আহাজারিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেয়ার কোনটাই করছে না সে। উপস্থিত নারীদের কাছে যেরকম প্রত্যাশা ছিল। শিহাব লক্ষ্য করে একজন একজন করে চলে যেতে যেতে খালি হয়ে যাচ্ছে আনোয়ারার চারপাশ। আনোয়ারার এই নিস্পন্দ শুয়ে থাকা তাদের আশাহত করে। তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসা সান্ত্বনা বাণীগুলো শুনানোর সুযোগ না পেয়েই হয়তো দ্রুতই ফিরে যেতে থাকে নিজেদের বাড়িতে। 

সাত সাতটা দিন মানুষটাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি। আইসিইউ থেকে সিসিইউ। আশা-নিরাশার পারদ উঠানামা। উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষা। ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে আশার বাণী শোনার আকুল তৃষ্ণা। শিহাবের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল বাবা আর কয়েকটা বছর বাঁচুক৷ মায়ের সঙ্গে সাধ মিটিয়ে সংসারটা করুক। বছর তিনেক আগে বিদেশের পাট চুকিয়ে বাবা একেবারে দেশে ফিরে এলে মা-বাবা দুজনেরই সে কী উচ্ছ্বাস। নতুন বিবাহিতের মতো দুজনে শহরে বাসা ভাড়া করল। শখ করে এটা ওটা কিনে সংসার সাজালো। মাকে এতো উৎফুল্ল আর কখনও দেখে নি শিহাব। 

ততোদিনে শিহাবের ঘর সংসার হয়েছে। বোনটার বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাইটা রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে ভবিষ্যতের সর্বনাশের গর্ত খুঁড়ে চলেছে। তবু প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া আবদুর রহমান আনোয়ারার মনে সংসার করার কী আনন্দ। যেন নববিবাহিত দম্পতি। আসলেই তো তাই। বিয়ের দু মাস পার না হতেই যে স্বামী নববিবাহিতা স্ত্রী রেখে বিদেশ চলে যায় তাদের আর সংসার করা হয় কই? মাঝেমধ্যে দেশে এলেও একান্নবর্তী পরিবারে মাস দুয়েকের মেহমানের চেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল না আবদুর রহমানের। বিয়ের পঁচিশ বছরে আনোয়ারা তাকে একবারে নিজের করে পাবার সুযোগই পায়নি। গত তিন বছরই না আসল দাম্পত্যের শুরু। হোক না চুলে পাক ধরেছে, হোক না ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। আনোয়ারার সংসার করার নারী সুলভ গোপন বাসনা যে মরে যায়নি, গত তিন বছর ধরে প্রাণ ভরে দেখেছে শিহাব। 

শিহাব নিজেও বাবার বাৎসল্য পায়নি, কিন্তু বাবা যেন সন্তানের দায়িত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, মনের গোপনে প্রবল এই বাসনা ছিল শিহাবের। যে বাবার রক্ত জল করা টাকায় শিহাবরা বেড়ে উঠেছে, বড় হয়েছে। অথচ বাবা নামের মানুষটা সংসার পরিজনহীন একলা শ্রমিক জীবন কাটিয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে। তাকে শেষজীবনটা সন্তান পরিজন সঙ্গের সুখ দিতে চেয়েছে শিহাব মনেপ্রাণে। 

কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের ইচ্ছাতো আর মানুষের ইচ্ছার অনুগামী হয় না। বাবার নাকে-মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইনের নল। ডাক্তার  বলছেন, সিচুয়েশন আগের চেয়ে বেটার। আনোয়ারা আর শিহাব আশায় বুক বাধছে, বাবাকে নিয়ে বাসায় যাবে। বাবার পছন্দের আইড় মাছ টমেটো দিয়ে ঝোল রান্না করে খাওয়াবে। আনোয়ারা বলে দিয়েছে উপজেলা সদরের বাজারে বাঘা আইড় মাছ উঠে। শিহাব আর আনোয়ারা দুজনেরই অধীর অপেক্ষা আবদুর রহমানের ফিরে আসার, আইড় মাছ কেনার, রান্নার, মানুষটাকে খাওয়ানোর। বোনটার সংসারে নাকি হাজার ঝামেলা, ফেলে আসতেই পারছে না বাবাকে এক নজর দেখতে। নিয়ম করে দিনে দুইবার বর্তমান অবস্থার খোঁজ খবর নিচ্ছে। ভাইটা নেশা করে কই পড়ে আছে কেউ জানে না। এই কয়দিনে কেবল একবার হাসপাতালে এসেছিল বাবাকে দেখতে। কিন্তু শিহাব আর আনোয়ারার আকুল অপেক্ষাতে ওদের উপেক্ষা তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। ওরা দুজন ডাক্তারের মুখের দিকে আকুল নয়নে চেয়ে থাকে আর আশায় বুক বাঁধে। মুহূর্তের জন্যও আশা ছাড়ে না। আবদুর রহমান হয়তো বুঝতে পেরেছিল তার দিন ফুরিয়ে এসেছে। 

দিনে একবার ঢোকার সুযোগে শিহাব আই সি ইউতে ঢুকলে সেদিন বাবা তার কাছে এক টুকরো কাগজ চাইল, কাগজটাতে লিখে দিল, জিনিসগুলো পৌঁছে দিও। বাবার সঙ্গে এটাই শিহাবের শেষ কথা। আই সি ইউ ছেড়ে বের হওয়ার মিনিট দশেক পার না হতেই ত্রস্ত হয়ে এটেনডেন্স তাদের ডাকল, ২ নাম্বার বেডের রোগীর অবস্থা খারাপ… তাড়াতাড়ি আসেন।

আজীবন বাবা শিহাবের কাছে এক রহস্যময় মানুষ। জন্মের পর থেকেই জানতো বাবা বিদেশ থাকে। মাস শেষে টাকা আসত। কীভাবে কার মারফত আসত ঠিকঠাক জানত না শিহাবরা। শিহাবরা মানে শিহাবসহ আরও দু ভাই বোন। এক ভাই-এক বোন। যাদের কোথা থেকে টাকা আসে নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিল না। বাজারে নতুন আসা বাইক আর মোবাইলের জন্য মায়ের ওপর চাপ দিতে যারা বিন্দুমাত্র ভাবতো না। মুখ বুজে মা সহ্য করতো সব। পারলে দিতো। না পারলে মুখ বুজে ভাইয়ের জিনিসপত্র ভাঙাভাঙি আর বোনের না খেয়ে খিল এঁটে শুয়ে পড়া সহ্য করতো দিনের পর দিন। 

আমি অতিষ্ঠ হয়ে কখনো কখনো বলতাম, মা বাবারে কও এই মাসে কিছু টাকা বেশি পাঠাইতে। মা করুণ মুখ করে উত্তর দিতেন, মানুষটা এমনেই কত কষ্ট করে দুইটা টাকার জন্য। সংসারের অশান্তির কথা কইয়া আর কষ্ট না দেই বাপ। মায়ের করুণ দৃষ্টির আড়ালের গভীর প্রেম আমি পড়তে পারতাম। ভাবতাম বছর পাঁচ-ছয় পরপর যে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয় তার জন্য এতো প্রেম সে পুষে রাখে কী করে! 

শিহাবের বাবা বিদেশ গিয়েছিল বিশ বাইশ বছর বয়সে। শিহাবের জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাবাকে দেখেছে কয়েক বছর পরপর দেশে আসা আবার ফিরে যাওয়া, চোখের সামনে ভাই বোনদের জন্ম হওয়া, একান্নবর্তী পরিবারে মায়ের অসহায়ত্ব সবকিছুর নীরব সাক্ষী শিহাব। জীবদ্দশায় বাবা আব্দুর রহমান শিহাবদের জীবনে ভীষণ ভাবে ছিলেন, না থেকেও ছিলেন। মায়ের কাছে বড় হওয়া ভাই-বোনদের কাছে না হলেও শিহাবের কাছে বাবা ছিলো জীবন্ত জীবন।

বাবা হারানোর ব্যথা ছাপিয়ে স্ত্রী সাবরিনার মুখোমুখি হওয়ার আতঙ্কে শিহাবের কাছারি ঘর ছেড়ে অন্দরের দিকে যেতে ইচ্ছে করে না। গ্রামের মুরুব্বিরা একজন দুজন আসছে, সান্ত্বনা দিয়ে কেউ দুচার মিনিট বসছে, কেউ চলে যাচ্ছে৷ সন্ধ্যায় একে একে পাড়া পড়শি স্বজনরা সব বিদায় নিলে একা একা বসে থাকা অর্থহীন আর দুর্বহ হয়ে উঠলে মায়ের ঘরে ঢুকে শিহাব। একাকী লড়াইয়ের জীবনটা মাত্রই শেষ হয়েছিল তার। এখনো যৌবনের লাবণ্য ধরে রাখা মায়ের বয়স মাত্র অর্ধশতক পেরিয়েছে। সংবিধান স্বীকৃত বয়সের আগেই বিয়ে হওয়া নারী টিকে এখন শহুরে পার্লারের সাজে ছেড়ে দিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কম বয়সী রোমিওরা হামলে পড়বে। বর যাদের বিদেশ থাকে তাদের নানা আলগা দোষ থাকলেও আনোয়ারা খাতুন কত সযত্নেই না নিজেকে রক্ষা করেছে আবদুর রহমানের জন্য। আজ সব চুকেবুকে গেছে।   

ঘরে ঢুকতেই সাবরিনা পাশের ঘরে টেনে নিয়ে খিল এঁটে দেয়। জড়োয়া সেটটা তার চাইই চাই। শিহাব অটল, অসম্ভব। এটা যার তাকেই পৌঁছে দিতে হবে। কথায় কথায় সাবরিনার সঙ্গে শিহাবের ঝগড়া বেধে যায়। সাবরিনার সাফ কথা, এটা নিয়ে দুই দেশে আর বাড়াবাড়ি দরকার নেই। এটা তাকেই দিয়ে দেয়া হোক। শিহাব বাবার শেষ চিরকুটটা দেখায় সাবরিনাকে, বাবার শেষ ইচ্ছা। শিহাব বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবেই। সাবরিনা কোনোভাবেই মানতে রাজি নয় এই জড়োয়া সেটটি বিদেশ থেকে আনা। জড়োয়া সেটটির ডিজাইনের সাবেকীয়ানা নাকি স্পষ্টই বোঝাই যায় বিদেশ থেকে আনা নয়। বরং দাদি নানিদের আমলের। কাজেই বাবা যে বলেছেন, তার বন্ধু আবুধাবিতে হঠাৎ মারা গেছেন, স্ত্রীর জন্য কেনা গয়না দিতে পারেননি। বাবাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন পৌঁছানোর এসবই বানানো গল্প।

এই জড়োয়া সেট নিয়ে বাড়াবাড়ির কোনো দরকার নেই, সাবরিনাই এটা নিয়ে যাক। সদ্য মৃত বাবার প্রতি এই অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে শিহাব। গয়নার প্রতি মেয়েদের লোভ চিরন্তন ভেবে সাবরিনার সঙ্গে কোনো তর্কে যায় না সেই মুহূর্তে।

বাবা যেদিন অসুস্থ হয়ে আর ফিরবেন না ভেবে শিহাবকে জড়োয়া বক্সটি হস্তান্তর করলেন সেদিন মেঘ গুড়গুড়ে করছিল আকাশে। মাও পাশেই ছিলেন। অদ্ভুত শান্ত একটা দুপুর। মায়ের চোখে জোর করে বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা বর্ষার উন্মত্ত যৌবনা নদীর মতো উপচানো জল। বাবার ক্যান্সার থার্ড স্টেজ। ডাক্তার বলেছিলেন, যে কয়দিন বাঁচেন এভাবেই। ভালো মন্দ খাইয়ে দেন। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, তার দিন ফুরিয়ে গেছে। 

দীর্ঘ ত্রিশ বছর আবুধাবি কাটিয়ে দেশে ফিরেছিলেন বাবা। একেবারে দেশে ফিরেছিলেন এবার। বেশ কিছু টাকা পয়সা আর এই জড়োয়া সেটটা। শিহাবের আম্মা চিরকাল উদাসীন অবৈষয়িক মহিলা। আগেও বর কী টাকা পয়সা পাঠায় কিছুই যায় আসেনি তার। আব্দুর রহমান যুবক বয়সে পাঠিয়েছে বাবার কাছে আর শেষ বয়সে বড় ভাইয়ের কাছে। শিহাবের মা আনোয়ারা আর তার ছেলে মেয়েরা একান্নবর্তী পরিবারে খেয়ে পরে বড় হয়েছে। কোনো দিন স্বামীর আয় রোজগার, টাকা পয়সার খবর নেয়নি। নিতে হয় এমন ভাবনাও মনে আসেনি। এবারও যখন একেবারে ফিরেছে সঙ্গে কী নিয়ে এসেছে তাতেও তার কিছুই আসে যায়নি। কিন্তু সাবরিনার উত্তপ্ত বাক্যে স্বামী হারানোর শোক সংহত করে সে গলা উঁচু করে নির্দেশ দেয়, মানুষটার শেষ ইচ্ছা। জড়োয়া সেটটা যার তাকেই পৌঁছে দিতে হবে।

মায়ের স্বরে কী এক অমোঘ আদেশ। রাগে ফুঁসলেও চুপ করে যায় সাবরিনা। তৎক্ষণাৎ শিহাব খুব দ্রুত দায়িত্বটা সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। হাতে থাকলে সাবরিনার সঙ্গে বারবার ঝামেলা বাঁধা আর ঘরের শান্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই, বাবার শেষ ইচ্ছাটাও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কিন্তু কোথায় পাবে পরিবারটির ঠিকানা, বাবাতো কোনো ঠিকানা দিয়ে যাননি। আসলে শেষ মুহূর্তে ঠিকানার ব্যাপারটা কারও মাথায়ই ছিলো না। বঙ্গভিটার পেইজটা সামনে আসে ফেসবুক স্ক্রল করলেই। ঠিকানা মিলবে কিংবা সাড়া পাওয়া যাবে তেমন কিছু গভীরভাবে না ভেবেই বঙ্গভিটা পেইজটাতে একটি পোস্ট দেয় শিহাব। নীলিমা আর তার স্বামীর নাম উল্লেখ করে আগরতলাবাসীদের কাছে তাদের সন্ধান চায় শিহাব। জড়োয়া সেটটির কথা ইচ্ছে করেই উহ্য রাখে শিহাব। সঙ্গে বাবার ফটোগ্রাফও জুড়ে দেয় শিহাব। 

শিহাবকে অবাক করে পেইজে কয়েকশো রিপ্লাই পাওয়া যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। নানাজনের নানা কথা, বেদনার, আশার, হতাশার, শুভকামনার…। এদের মধ্যে শুধু একজন জানায় তার মায়ের নীলিমা, বাবার নামও ঠিক আছে। হ্যাঁ বাংলাদেশের তার মায়ের স্থায়ী ঠিকানা ছিল গ্রাম-মুকুন্দপুর, ইউনিয়ন-ইটাখোলা, থানা…। জেলা…। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শিহাব, বোধহয় সন্ধান পাওয়া গেল নীলিমার। এবার খুব দ্রুত জড়োয়া সেটটি পৌঁছাতে হবে নীলিমার কাছে। 

 

শিলচর শহরের বুকে সাধারণ পাকা ঘরবাড়ি। বোঝা যায় খুব বেশিদিন হয়নি নির্মাণের। সামনের কক্ষে বসে ছেলের সঙ্গে চা খেতে খেতে শিহাব উসখুস করে। নীলিমার সঙ্গে দেখা করার জন্য এতোদূর আসা হলেও এখনো তার দেখা পায়নি শিহাব। মুখ ফুটে ভেতরের অস্থিরতা প্রকাশও করতে পারে না সে অতিথির সম্ভ্রম ভেঙে। খুব বেশিক্ষণ নয়। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নীলিমা নামের নারী ঘরে ঢোকেন। কাঁচাপাকা চুল, চিকন পাড়ের ঘি রঙের শাড়িতে করুণ জীবন ফোটে আছে অব্যক্ত বেদনার মতো। নীলিমা ঘরে ঢুকলে ছেলেটি বের হয়ে চলে যায়। নীলিমা তার বরের গল্প আর শিহাব তার বাবার গল্প বলে, আবুধাবিতেই পরিচয় দুজনের। একই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো দুজন। এসব গল্পই শিহাবের জানা। শিহাব জড়োয়া সেটটি বের করে দেয় নীলিমার হাতে। নীলিমার প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায় এটার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না  নীলিমা। থমকে যায় সে। বুকে জড়িয়ে ধরে নীরবে। তারপর অশ্রু গড়িয়ে পড়ে যেন হাজার বছর বয়ে চলা জলস্রোতের মতো। 

জেনে আসা গল্পের প্রাসাদ হুড়মুড় করে ভেঙে দিয়ে নীলিমা জানায় এই জড়োয়া সেটের বয়স চল্লিশ বছর। প্রথমবার বিদেশ থেকে ফিরে আবদুর রহমান বানিয়েছিলেন নীলিমার জন্য। দুজন পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কীভাবে জেনে গিয়েছিলেন নীলিমার বাবা। রাতারাতি নীলিমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ইন্ডিয়া…। আর আবদুর রহমান আবার ফিরে যায় আবুধাবি।  নীলিমা বলতে থাকে ভাগ্যের কি পরিহাস আমার উনার সঙ্গে ওখানেই দেখা হলো তার…, বাকিটা শিহাব শুনতে ভয় পায়। আজন্ম লালন করা পারিবারিক সুখের সৌধের চোরাগলি আবিষ্কারের আতঙ্ক গলা চেপে ধরে তার। একদলা কান্না গলায় আটকে যায় পাথরের মতো। বাবা, মা, নীলিমা কার জন্য কে জানে। গল্পটা হঠাৎ শুনে চমকে গেলেও মনে হয় এই গল্প তার শোনার দরকার ছিল না। মা আর বাবার যে তীব্র প্রেমময় জীবন সে দেখেছে সেখানে অন্য কোনো নারী ছিল ভাবতেই বাড়িতে রেখে আসা মায়ের জন্য মনটা টনটন করে শিহাবের। মাকে গিয়ে কী জবাব দেবে সে। আজন্ম কী বাবার ভালোবাসায় বিশ্বাস রেখে ঠকেছে তার মা! 
কয়েকদিন থাকার ইচ্ছে থাকলেও দ্রুতই দেশে ফিরে শিহাব। বাড়ি ঢুকলে আনোয়ারই জিজ্ঞেস করে তাকে, নীলিমাকে দেখে এলি? সারাজীবন এক ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করলাম। তাকে একবার দেখবার খুব সাধ আমার।
 


রুমা মোদক কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, মঞ্চাভিনেত্রী ও শিক্ষক। জীবনসংকেত প্রযোজিত তার নাটক কমলাবতীর পালা ও জ্যোতিসংহিতা দেশজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গ্রন্থ : প্রসঙ্গটি বিব্রতকর, গোল, নদীর নাম ভেড়ামোহনা ইত্যাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে যান নিজ শহর হবিগঞ্জে।

menu
menu