মাহমুদ দরবিশ-এর কবিতা

[মাহমুদ দারবিশ (১৯৪১–২০০৮) ফিলিস্তিনের অন্যতম প্রভাবশালী ও বহুল পঠিত কবি, যাঁকে ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দারবিশ ফিলিস্তিনের আল-বিরওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা ১৯৪৮ সালের নাকবার সময় ধ্বংস হয়ে যায়। শৈশবে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তিনি সারা জীবন নির্বাসিত ছিলেন—লেবানন, মস্কো, প্যারিস ও রামাল্লায় কাটানো এই দেশহীনতার বেদনা ও স্মৃতি গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছে তার লেখায়। দারবিশের কবিতা তাই যতটা ব্যক্তিগত, ততটাই রাজনৈতিক। ফিলিস্তিনের যন্ত্রণা ও পরিচয়ের সংকটকে একটি বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় রূপ দিয়েছে মাহমুদ দারবিশের কবিতা। 

১৯৬০-এর দশকে, ইসরায়েলি সেন্সরের অনুমতি ছাড়া কবিতা আবৃত্তি ও গ্রামান্তরে যাতায়াতের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার ও গৃহবন্দী করা হয়। দারবিশের লেখা  কবিতা আইডেন্টিটি কার্ড একটি প্রতিবাদী গানে পরিণত হলে তাঁকে ‘প্রতিরোধের কবি’ আখ্যা দিয়ে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। ১৯৭০-এর দশকে তিনি বৈরুতে প্যালেস্টিনিয়ান অ্যাফেয়ার্স পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং ১৯৮১ সালে নিজেই আল-কারমেল  নামে একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা ও সম্পাদনা করেন। ১৯৮৮ সালে দারবিশ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়া লেখেন, যা রাষ্ট্র গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার (পিএলও) নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন।

দারবিশ ৩০টিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ এবং ৮টি গদ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন, এবং সাহিত্যকর্মের জন্য বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। শুধু প্রতিরোধই নয়, মাহমুদ দারবিশের লেখা উদ্বাস্তু জীবনের ব্যথা-বেদনা, আত্মজিজ্ঞাসা ও অস্তিত্বের এক ধ্রুপদী দলিলও বটে।]


আমার মাকে

আমার মায়ের রুটির জন্য আমি আকুল হয়ে থাকি,
আকুল হয়ে থাকি মায়ের কফির জন্য
মায়ের স্পর্শের জন্য
আমার ভেতর শৈশব জেগে ওঠে 
দিনের পর দিন
আর আমি জীবনকে গভীর ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরি—
যদি মরে যাই  
মায়ের চোখের জল আমাকে লজ্জায় ফেলে দেবে।

আমায় থাকতে দিও, যদি কোনো একদিন ফিরে আসি,
তোমার চোখের পাপড়ির ওপর এক টুকরো চাদর হয়ে,
তোমার হাতে ছড়িয়ে দিও ঘাস আমার শূন্য অস্থিতে,
তোমার পায়ের ছোঁয়ায় আমার প্রান্তর যেন হয়ে ওঠে পূণ্যভূমি।
 
আমাদের বেঁধে রেখো তোমার একগুচ্ছ চুলে,
গেঁথে রেখো তোমার জামার ঝুলন্ত ফিতের বাঁধনে।
আমি হয়ে উঠতে পারি দেবতুল্য,
দেবতুল্যই হব আমি 
যদি একবার ছুঁতে পারি তোমার হৃদয়ের অতলতা ।

রেখে দিও, ফিরে এলে কোনো এক দিন
তোমার উনুনে জ্বালানি করে
যেন তুমি রান্না কর আমার তাপে
অথবা করে নিও ছাদে জামা শুকানোর দড়ি 
তোমার দু’হাতে টানটান।
নিত্য তোমার প্রার্থনা ছাড়া
দুর্বল আমি, থেমে যাই ধীরে। 

আজ বয়স হয়েছে আমার—
তাই ফিরিয়ে দাও আমার ছেলেবেলার নক্ষত্র সব
যাতে ফিরতি পথটা ভাগ করে নিতে পারি 
ঘরে ফেরা পাখিদের সাথে
ফিরে যেতে পারি তোমার অপেক্ষার নীড়ে।


টিনা নন্দী অনুবাদক, গবেষক ও শিক্ষক। এক যুগেরও বেশি সময় তিনি সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস-এর ইংরেজি ও মানবিক বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যুক্ত আছেন।

menu
menu