অন্ধ পেঁচা (বুফ-ই-কুর) সাদেঘ হেদায়াত

মুখবন্ধ : অন্ধ পেঁচা
`(Hedayat) conveys more vividly than Kafka or Poe the state of madness. … (The Blind Owl is) a terrifying whorl of incidents that turns and twists upon itself to recreate the labyrinthine movements of an insane mind. (San Francisco Chronicle)’  

      কথক মনোবৈকল্যে বিষাদিত। সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী ব্যাধি। 
স্মৃতিনাশিনী ও চেতনানাশক মাদকের ক্ষণস্থায়ী প্রভাবের অতীত। ক্লিষ্ট জীবাত্মা। 
পঞ্চত্ব আর পুনরুত্থানের  মাঝামাঝি দোদুল্যমান। ঘুম আর জাগরণের সন্ধিতে প্রতিভাত এই অসুস্থতা। তাই প্রথম উচ্চারণেই কথক ঘোষণা করলেন, 

‘চেতনেও অনেক ক্ষত থাকে 
যা কুষ্ঠ-ক্ষতের নিঃশব্দ নীরবতায় অতিনিয়ত খুঁটে খুঁটে ক্ষয়িত করে জীবাত্মা— 
বিরলে।’ 

কথকের মনোবৈকল্য-জাত এই কাহিনি 
বুফ-ই-কুর বা অন্ধ পেঁচা 
আপাতদৃষ্টিতে সাযুজ্যহীন দুই গল্পের বিদঘুটে কোলাজ। 
বাক্য এখানে গীতিময় বৈকল্যের ভুলভুলাইয়া—কিন্তু গতিহারা নয়। 
দাড়ি, কমা ইত্যাদি ইত্যাদি জনান্তিকে বিসর্জিত। 
ভাষা এখানে শৃঙ্খলহীন এলোমেলো মিশ্রণ—
কথা এখানে মৃত্যু আর রক্তের আখরে আবক্ষ নিমজ্জিত—

গল্প আছে—কিন্তু গল্প এখানে ঊন অথবা উহ্য। 
প্রথম গল্প—আসলে যা দ্বিতীয় গল্প—এক ধরনের হেঁয়ালি হ্যালুসিনেশন। 
কথক আঁকিয়ে, কলমের খাপে ছবি আঁকেন। 
আফিম খান। 
সেদিন সিজ্দাহ বে-দার (নওরোজের ত্রয়োদশ দিবস)। 
প্রকৃতি-কীর্তন-উৎসব। 

‘জনহীন পুরী, পুরবাসী সবে 
গেছে মধুবনে, ফুল উৎসবে 
শূন্য নগরী …’ 

এমনই এক একেলা দিবসে অতিথির আগমন—পিতৃব্য না পিতা—কথক নিজেও জানেন না। অতিথি-সৎকারের নিমিত্ত পানীয় খুঁজতে গিয়ে গল্পের শুরু। গবাক্ষহীন দেয়ালের ঐন্দ্রজালিক গবাক্ষপথে সহসাই সমাধিপ্রাপ্ত কথক— 

‘ঝুঁকে পড়া কুঁজো বুড়ো বসে আছে সাইপ্রেস তলে আর তার মুখোমুখি অনূঢ়া বালিকা—নাহ, তার মুখোমুখি এক স্বর্গীয় দেবদূতী, একটু ঝুঁকে, ডান হাতে কালসিটে পড়া কলমি ফুলের অঞ্জলি। আর বুড়ো একমনে চিবুচ্ছে তার বাম তর্জনী।
  
মুখোমুখি বালিকা। 
উদাসীন। 
আশপাশ ও প্রতিবেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনাসক্ত। 
উদাসীন দৃষ্টি। 
প্রেক্ষণহীন নেত্রপাত। 
ঠোঁটে জমে থাকা স্মিত হাসি।’ 

উন্মোচিত হলো গল্পের পট— 
গল্পের অশরীরী উপদেবী— 
অতিশয় অপার্থিব।  

প্রথম খণ্ডে বিবৃত হয়েছে আফিম-আসক্ত কথকের ভয়ংকর কল্প-দর্শন। 
দেবী এখানে যুগপৎ জীবিত ও মৃত—কোয়ান্টাম সুপারপজিশন— 
আর পর্যবেক্ষক আমাদের মনো-বৈকল্য-ক্লিষ্ট কথক— 
মৃতের গলিত গতরে জ্বলে উঠে ভুতুড়ে চোখের সর্বদর্শী ডাগর চাহনি— 
অতঃপর বাক্সবন্দি খণ্ড দেবীর শরীর—

দ্বিতীয় খণ্ডে কথকের পুনর্জন্মের অথবা পূর্বজন্মের আখ্যান বিবৃত হয় 
অতিপ্রাচীন রে নগরীর প্রেক্ষিতে। 
দ্বিতীয় খণ্ডের ঘটনার বিভ্রান্তিকর ঘনঘটায় 
অবশেষে অন্তত আংশিকভাবে উন্মোচিত হয় 
প্রথম খণ্ডের হেয়ালিপনা ও রহস্যের।    

গল্প  
অন্ধ পেঁচা‘র আপাত-অবিকশিত কাহিনি বিবৃত করে পাঠকের গল্প-পাঠের আনন্দ-নষ্ট অতিশয় গর্হিত বলেই বিবেচিত হবে। অধিকন্তু উপন্যাসিকায় বিবৃত ঘটনাপ্রবাহ গুছিয়ে বলার কর্মটি প্রায় দুঃসাধ্য ।

সেই একই কল্পদৃশ্য বারংবার আবর্তিত হয়েছে বৃত্তাকার কাহিনির বাঁকে বাঁকে।
বাস্তবতা ও কালজ্ঞান রহিত এক নিঃসঙ্গ কথকের ব্যক্তিগত গল্প—বিবৃত হয়েছে অস্পষ্ট খোয়াবের এলোমেলো বিন্যাসে। প্রথম সংক্ষিপ্ত পরিচ্ছদ প্রারম্ভিক। দীর্ঘ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ উপন্যাসিকার দুটো মূল খণ্ডের প্রথম খণ্ড। তৃতীয় পরিচ্ছেদ প্রথম পরিচ্ছেদের মতোই সংক্ষিপ্ত, এবং চতুর্থ পরিচ্ছেদ বা দ্বিতীয় খণ্ডের সঙ্গে ট্রান্স-টেম্পরাল বা কাল-অতিক্রান্ত সংযুক্তির ওয়ার্মহোল। পঞ্চম বা শেষ প্ররিচ্ছের কথক প্রথম খণ্ডে বর্ণিত একলা ঘরে ফিরে আসে।  

নামহীন নায়ক কলমের খাপে ছবি আঁকেন। নিবাস নামহীন নগরীর নির্জন উপকণ্ঠে। প্রারম্ভিক পরিচ্ছদে তিনি বলে দিয়েছেন;  জীবনের একটি বিশেষ ও বিষাক্ত অনুচ্ছেদের কথা—যতটুকু মনে পড়ে তাই লিখে যাবেন। “আমি রচনা করি আমার প্রতিচ্ছায়ার জন্য; সে প্রদীপের মুখোমুখি— দেয়ালে নিক্ষিপ্ত—আমি এখন আমাকে খুলে ধরব আমারই প্রতিচ্ছায়ার সম্মুখে। 

কথক কলমের খাপে প্রতিনিয়ত একই ছবি এঁকে যাচ্ছেন : হাতাহীন কোট আর পাগড়ি পরিহিত কুঁজো বুড়ো, সাইপ্রেস বৃক্ষের নিচে—কৃষ প্রবাহিনী—ওপারে কালো পরিচ্ছদে আবৃত অনূঢ়া সুন্দরী—ঝুঁকে আছে—হাতে তার কলমি ফুলের গুচ্ছ। একদিন এক হাতাহীন কোট ও পাগড়ি পরিহিত কুঁজো বুড়োর আগমন তার ঘরে। পিতৃব্য পরিচয়ে। কথকের বোধে এলো যে পরম্পরা-সূত্রে প্রাপ্ত এক বোতল সুরা ছাড়া আর কিছুই নেই অথিতি সৎকারের নিমিত্ত। সুরাপাত্র আনতে গিয়ে সহসাই স্বপ্ন-বিহ্বলতায় (reverie) সমাধিপ্রাপ্ত। ঘুলঘুলিহীন দেয়ালের ঐন্দ্রজালিক ঘুলঘুলি দিয়ে আবিষ্ট কথক—কলমের খাপে আঁকা ছবি যেন প্রাণ-প্রাপ্ত—এরকম দৃশ্যপট।

অনূঢ়া সুন্দরীর নেশা-জাগানিয়া উন্মাদক ডাগর চক্ষুযুগলে কথক প্রত্যক্ষ করলেন তার নিজস্ব সর্বনাশ। দৃশ্যপট অদৃশ্য হলেও কথকের চিত্তবিভ্রমের উপশম হয় না—প্রতি রাতে বিকারের ঘোরে তিনি পাড়াময় ঘুরে বেড়ান—কৃষ প্রবোহনী, সাইপ্রেস বৃক্ষ ও অনূঢ়া সুন্দরীর সন্ধানে। নিতান্তই নিষ্ফল। 

এক রাতে ঘরে ফিরে কথকের চক্ষু চড়কগাছ—অনুঢ়া সুন্দরী বসে আছে বারান্দায়। আগল খুলতেই সে সটান ঘরে ঢুকে শয্যায় শুয়ে পড়ল। সত্বর প্রতীয়মান হলো যে অনূঢ়া সুন্দরী ঘুমন্ত নয়—আসলে মৃত। অনেক দিনের মৃত শব—পচন ধরেছে—উপচে পড়ছে কিলবিল কীটের দঙ্গল। ছবি-আঁকিয়ে কথক—তার মুখমণ্ডলের ছবি আঁকার পৌনঃপুনিক প্রয়াস প্রতি বারেই ব্যর্থ হচ্ছে। মোম পুড়ছে—বুড়ো হচ্ছে রাত। সহসাই যেন প্রাণ সঞ্চারিল—যেন ‘নয়ন মেলে দেখি আমায় বাঁধন বেঁধেছে’—এতটুকু ক্ষণ, তাতেই কথকের ছবি আঁকা সম্পন্ন। 

একটা পচা শব নিয়ে কী করবে—বুঝতে পারছে না কথক। সে চায় না ব্রাত্য-জনেরা দেখে ফেলুক এই অনিন্দ্য সুন্দর স্বর্গের দেবদূতীর গলিত অবশেষ। অবশেষে শব টুকরো টুকরো করে কেটে স্যুটকেসে ভরে গোপনে কবর দেয়ার পরিকল্পনা—আর ঠিক এই সময়ে ঘোড়ায় জুড়া শব-শকট নিয়ে আবির্ভুত হলো সেই কুঁজো বৃদ্ধ, এবার মুর্দা-ফরাস রূপে। তার হাসিতে সেই একই লোম-খাড়া-হওয়া শুষ্ক কর্কশতা। কবর খনন-কালে প্রাচীন রাজেস নগরীতে তৈরি এক চকচকে মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হলে, কুঁজো বুড়ো পাত্রটি কথককে উপহার দেয়। রাজেস রে নগরীর ধ্রুপদী অভিধা— খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে প্রাচীন পারস্য-মিডিয়ার প্রধান জনপদ। গল্পের ভৌগোলিক চারণক্ষেত্রের প্রথম ইঙ্গিত এলো এখানেই। 

ঘরে এসে মৃৎপাত্রে আঁকা ছবি দেখে কথকের চক্ষু আবার চড়কগাছ। বিস্ময়ে সে লক্ষ্য করল যে মৃৎপাত্রে আঁকা ছবি আর তার নিজস্ব আঁকা ছবি এক ও অভিন্ন। বৈকল্য-চিত্ত কথক আবার আফিমে নিমজ্জিত—প্রথম খণ্ডের যবনিকায় কথক স্বপ্নাতুর—ও প্রায়-চেতনা-রহিত। 

প্রথম-খণ্ড-পরবর্তী তৃতীয় পরিচ্ছদে প্রায়-চেতনা-রহিত কথক পূর্বজন্মে অথবা পুনর্জন্মে আবার কথকরূপে ফিরে আসেন অবশিষ্ট গল্প বলার নিমিত্ত :

‘যে নব চরাচরে আমি জাগরিত হলাম তার প্রতিবেশ ও পরিস্থিতি আমার একান্ত পরিচিত—এতই পরিচিত যে  পূর্ব-জীবন ও তার প্রতিবেশ-পরিস্থিতি হতে এখানেই আমি অধিক স্বচ্ছন্দ—যেন এটাই আমার জীবনের ঋত প্রতিবিম্ব—ভিন্ন বচরাচর অথচ কী ঘন-সন্নিহিত ও অবাধ—যেন আদি অধিবাসে প্রত্যাবর্তন—যেন আবার জন্ম হয়েছে এক অতি প্রাচীন পৃথিবীতে—অতি প্রাচীন অথচ একই সঙ্গে আত্ম-ঘনিষ্ঠ ও স্বাভাবিক।’ গল্পের ক্ষেত্র এখন অতি প্রাচীন রাজেস বা রে নগরী।

কথক এখানে নগরীর উপকণ্ঠে একাকিত্বে নির্বাসিত নয়। দুধ মাতা আর ব্যভিচারিণী স্ত্রীর সঙ্গে একত্র বসবাস। নিদারুণ পীড়ায় আক্রান্ত প্রায়-চলন-হীন ও পঙ্গু কথক। কফিন-সদৃশ ছোট্ট প্রকোষ্ঠে অবসন্ন দিন কাটে—অপ্রশস্থ জানালা গলিয়ে চোখে পড়ে টুকিটাকি-পণ্য-বিক্রি-করা বুড়ো ফেরিওয়ালা আর কসাই দোকানের কসাই—এই দুজনায় নিরন্তর কুরে কুরে খায় কথকের বিক্ষুব্ধ সাইকি (আত্মা)— 
সঙ্গমে প্রত্যাখ্যাত কথক স্ত্রীকে ছিনালী বেশ্যা বলে অভিহিত করে। সে বিশ্বাস করে যে তার স্ত্রী বহুগামী। ভালোবাসে এবং ঘৃণা করে। হারানোর ভয় তাকে নিরন্তর পীড়িত করে। এক সময় সে জানতে পারে যে বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা তার স্ত্রীর অন্যতম নাগর। অবশেষে বৃদ্ধ ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে, চাদরের আড়ালে অস্থি-হাতল খঞ্জর নিয়ে সে তার স্ত্রীর ঘরে যায়। উন্মাদ ও হিংস্র যৌন-দৃশ্য—কথক অসাবধানতাবশত খঞ্জরাঘাতে হত্যা করে তার স্ত্রীকে। 

গল্পের শেষে কথক আয়নায় তাকালে টুকিটাকি-পণ্য-বিক্রি-করা বুড়ো ফেরিওয়ালা ফেটে পড়ে কর্কশ ও অতি বিরক্তিকর অট্টহাসিতে — ‘I went in front of the mirror but I covered my face with my hands because of the intensity of fear—I saw that I looked like, no, as a matter of fact, I had become the old peddler—As I held my hands in front of my fave I involuntarily started laughing, a laugh much harder than the first one that shook my soul, a deep laugh such that it was uncertain from which forgotten crevice of my body it came out of, an empty laugh that just echoed in my throat and came out of the emptiness—I had become the old peddler.’

কালিক বন্ধনহীনতা (trans-temporality) 
অন্ধ পেঁচা কালিক বন্ধনহীন—ট্রান্স-টেম্পোরাল।  দ্বিতীয় খণ্ড অর্থাৎ গল্পের আদি পর্ব উন্মিলিত হয় ইসলাম-পূর্ব প্রাচীন পারস্যে। আর প্রথম খণ্ড অর্থাৎ গল্পের দ্বিতীয় পর্ব আবর্তিত হয় বিংশ শতকের ক্ষয়িষ্ণু পাহলাভী শাসনামলে—সাদেঘ হেদায়াতের সমসাময়িক তেহরানের উপকণ্ঠে। দার্শনিক জ্যাসন রেজা জ্বরজানি অবশ্য খুঁজে পেয়েছেন স্থান-কালের সীমানা ছাড়িয়ে ব্যাপ্ত এক  তৃতীয় অতি-মাত্রার—                       that it takes place in a third time as well, namely the Future or Futural (in a quasi-Heideggerian sense), that is a timeless place of no place, equally accessible to the past and present. This is the strange futuristic city that the narrator repeatedly wanders into, often in an altered state of consciousness, both in modern Tehran and medieval city of Rey— 
জ্বরজানির মতে  অন্তত পাঁচবার কথক এই কালিক তৃতীয় মাত্রায় বিচরণ করেছেন। প্রথম বিচরণ শাহ আব্দুল আজিম কবরস্থানে যাওয়ার পথে—
‘জাগরণে বা স্বপনে যা কখনো দেখিনি এমনই এক নবতর ভূদৃশ্য উন্মোচিত হলো আমার প্রেক্ষিতে। বন্ধুর পাহাড়। রাস্তার দুপাশে অবিদিত, রোগাতুর উর্বিরূহ—অভিশপ্ত। দৃশ্যমান ধূসর গৃহ—ত্রিভুজাকার, ঘনাকার অথবা প্রিজমাকার—হোঁতকা, অন্ধকার ও আয়নাহীন বাতায়ন—জ্বরতপ্ত বিকার-ক্লান্ত চোখের মতোই এইসব বাতায়ন। জানি না কী দিয়ে নির্মিত হয়েছে এইসব গৃহের প্রাচীর—যে মানুষের হৃদয়ে সহসাই ভীতি জাগানিয়া। এ গৃহ যেন প্রাণময় জীবের জন্য নয় —হয়তো এ গৃহের নির্মাণ বায়বীয় অপচ্ছায়ার নিমিত্ত।’

এবং দ্বিতীয়বার শাহ আব্দুল আজিম থেকে ফিরার পথে : 
‘হাওয়ায় চাবুকের শব্দ; ঘোড়া ছুটছে; ঘন নিশ্বাস। পূর্ণ ও স্বচ্ছন্দ কদমে ছুটছে—পায়ের খুর ভূমি স্পর্শ করছে আলতো নিঃশব্দতায়।  গ্রীবায় ঝুলানো ঘণ্টার ধ্বনি ভ্যাপসা বাতাসে মিশে তৈরি করেছে এক অনাসৃষ্টি সুরের। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান নক্ষত্র যেন জমাট রক্ত হতে উত্থিত আলোকোজ্জ্বল চক্ষুর মতো তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। এক বিস্ময়কর অনুভব ব্যাপ্ত হলো আমার সমুদয় স্ত্তায়। বুকে চেপে আছে মৃত দেহের মতো গুরুভার ঘড়া। যূথবদ্ধ তরুরাজি তাদের পাকানো মোচড়ানো শাখা প্রশাখা দিয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে জড়িয়ে তমসায় দাঁড়িয়ে—অন্যতায় তারা যেন থুবড়ে পড়বে ভূতলে। রাস্তার দুপাশে ছমছমে গৃহের সারি—টুকরো টুকরো জ্যামিতিক ঢং—পরিত্যক্ত কৃষ্ণ বাতায়ন। গৃহের দেয়ালগুলো জোনাকির মতো আবছা এক ধরনের অসুস্থ অর্চি ছড়াচ্ছে।

 ভীতিপ্রদভাবে বিন্যস্ত বৃক্ষরাজি অলক্ষে পিছু হটছে সারে সারে ঝোপে ঝোপে—অথচ মনে হচ্ছে পাদপ-পদ যেন কলমি লতার বিজড়িত জটে জট পাকিয়ে ন্যুব্জ।  মৃত্যুর গন্ধ ও পঁচা-গলা মাংসের গন্ধে আমার চৈতন্য অবদমিত। বোধ হচ্ছে আমি যেন জন্মাবধি মৃত-গন্ধে সুসিক্ত—সারাটা জীবন যেন শায়িত আছি কোনো অসিতবর্ণ শবাধারে,  আর আমার চারপাশে এক কুঁজো বুড়ো—মুখাবয়ব যার চির-অগোচরে—আমাকে বহন করছে বৃত্ত থেকে বৃত্তে—প্রচ্ছায়া আর কুহেলিকার পাদটীকায়।’

Novel Folklore - On Sadegh Hedayat’s Blind Owl গ্রন্থে জ্বরজানির অতি উচ্চমার্গের দার্শনিক বিশ্লেষণ চিত্তাকর্ষক ও অতিশয় গূঢ় এবং একই সঙ্গে যথেষ্ট দুর্বোধ্য !  

কাফ্কায়েস্ক
অন্ধ পেঁচা কাফ্কায়েস্ক। হেদাযাতের অন্ধ পেঁচা বা কাফকার রূপান্তর (The Metamorphosis) আপাত-সহজ মনে হলেও কোনো কিছুই সহজ নয়। প্রতীকী গল্পের স্তরে স্তরে গুহ্য সংকেতলিপির পাঠোদ্ধার বহুমুখী-বিধায় বিভিন্ন পাঠকের প্রতীতি ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। হেদায়াতের নিজস্ব উপলব্ধি মুখ্য সত্য হলেও হতে পারে, কিন্তু একমাত্র সত্য নয়। “আপন মনের মাধুরী মিশায়ে”—পাঠকের মনোজাত উপলব্ধি—অন্য যেকোনো উপলব্ধির সম্পূর্ণ সমান্তরাল।

অবশেষে 
হেদায়াত নৈরাজ্যবাদী, হেদায়াত ধর্মদ্রোহী, হেদায়াত ইসলাম-পূর্ব জোরোয়াস্ত্রিয়ান সাসানীয় পারস্যের প্রতিভূ, অথবা আফিম/মদাসক্ত অতীব উপদ্রুত মাতাল কথক—যে ভাবেই ভাবা হোক না কেন—শেষ বিচারে অন্ধ পেঁচা চিত্তহারী ও উত্তীর্ণ । 

অন্ধ পেঁচা সহজ-পাঠ্য নয়। 
দ্রুত পঠনে বা এক পঠনে অন্ধ পেঁচা’র সফল মন্থন সম্ভব নয়। 
গুণিতক পঠনেই শুধু ঋদ্ধ হওয়া সম্ভব।  

সাদেঘ হেদায়াত 
ফেব্রুয়ারি ১৭, ১৯০৩ থেকে এপ্রিল ৯, ১৯৫১। 
আপন অক্ষে বসুধা মাতার মাত্র ১৭,৫৮৩ আবর্তনের সমান সামান্য আয়ু নিয়েও 
সাদেঘ হেদায়াত যথেষ্ট আয়ুষ্মান, 
এবং অন্তত আধুনিক ফার্সি গদ্য সাহিত্যের প্রেক্ষিতে এক মৃত্যুঞ্জয়ী ঈশ্বর। 
অর্থ ও আভিজাত্যে জন্ম। 
তেহরানে ফরাসি ক্যাথলিক স্কুলে পড়াশোনা শেষে প্রথমে ফরাসি দেশে তারপর বেলজিয়ামে— 
কিন্তু দন্তবিদ্যা বা প্রকৌশলবিদ্যায় বুৎপত্তি লাভের নিমিত্ত 
যথেষ্ট হৃদয়-জাত অভিরুচি তার ছিল না। 
মোহভঙ্গে ক্লিষ্ট হেদায়াত ১৯২৭ সালে ‘মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান’ বলে 
মার্নের জলে ঝাঁপ দিলেন— 

মরণ কি এতই অনায়াস? 
—তবে মোহমুক্তি ঘটল।  
বিজ্ঞান বিসর্জন করে সাহিত্যে সমর্পিত। 
এডগার অ্যালেন পো, ফ্রানজ কাফ্কা, ফিওদোর দস্তয়ভস্কি, আন্তন চেখভ, সার্ত্রে  এবং আরও অনেক পশ্চিমা-সাহিত্য-দিগগজ তার মনোজগৎকে আলোড়িত করে। 
কাফ্কার অনেক কাজ তিনি ফার্সিতে অনুবাদও করেছেন।
চার বছরের পশ্চিম-প্রবাসের পর ১৯৩০ সালে হেদায়াত ফিরে আসেন তেহরানে।
তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ছোটগল্পের (১৯৩০, জেন্দেহ বে গোর, জীবন্ত প্রোথিত), 
তারপর হেদায়াত ক্রমাগত লিখেছেন নাটক, গদ্য সাহিত্য  
এবং অচিরেই তিনি তেহরানের আঁতেল সাহিত্যিক সম্প্রদায়ের মধ্যমণি। 
ইরানিয়ান লোকসাহিত্যের প্রতি হেদায়াতের আকর্ষণ ছিল প্রগাঢ়। 
ওসানেহ ও নিরাংগেস্তান প্রকাশিত হয় ১৯৩১ ও ১৯৩৩ সালে। 
ইসলাম-পূর্ব পারস্যের ইতিহাস, পাহলাভী ভাষা ও প্রাচীন জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্ম ছিল 
হেদায়াতের হৃদয়ের একান্ত পাশপাশি। 

রাজতন্ত্র ও ইসলামবিরোধী লেখক চক্রে (রাবেহ) তার সংশ্লিষ্টতা ছিল সরব। 
এজন্য একসময় তাকে তেহরান ছেড়ে বোম্বাই চলে যেতে হয় (১৯৩৬-১৯৩৭)। 
সেখানকার পারসি গোষ্ঠিতে থেকে প্রাচীন ভাষা ও ধর্ম সম্মন্ধে যথেষ্ট ঋদ্ধ হন তিনি। 
অনেক হেদায়াত-বেত্তার মতে অন্ধ পেঁচা’র রচনা শুরু হয়েছিল প্যারিসে; 
কিন্তু শেষ পোঁচ বা চূড়ান্ত সম্পাদনা হয়েছিল বোম্বাই নগরে। 
অন্ধ পেঁচা  প্রথম প্রকাশিত হয় বোম্বাইতে ১৯৩৭ সালে— 
মাত্র পঞ্চাশ মাইমিওগ্রাফ কপি— 
শুধু বন্ধুদের কাছে বিলি করার জন্য।
প্রথম পাতায় গোটা গোটা করে লিখা ছিলো,
এই পুস্তক ইরানে মুদ্রণ ও বিক্রির জন্য নয়”,  
তেহরানে তখন শাসন করছেন রেজা শাহ পাহলোভী। 
নিষিদ্ধ অন্ধ পেঁচা। 

১৯৫০ সালে হেদায়াত প্যারিসে ফিরে যান। 
রান্নাঘরের বিষাক্ত গ্যাসের আবেশে আত্মহত্যা করেন ১৯৫১ সালের এপ্রিলে। 

প্যারিসের জল একটু ছুঁয়েছিল শুধু। 
প্যারিসের গ্যাস কিন্তু ছুঁয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি— 
নিয়ে গেল!  

অনুবাদকের কথা 
অনুবাদ বড়জোর একটা প্রতিধ্বনি (জর্জ হেনরি বরো)—
আর অনুবাদ যখন অনুবাদের অনুবাদ—প্রমাদ তখন গুণিতক। 
সাদেঘ হেদায়াতের বুফ-ই-কুর বা অন্ধ পেঁচা বা The Blind Owl ফার্সিতে রচিত। ফার্সি আমার অজানা। অনুবাদ করা হয়েছে মূল গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ থেকে। তিনটা অনুবাদ বাজারে সহজলভ্য। ডি. পি. কস্টেলোর অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। ডি. পি. কস্টেলো সুখপাঠ্য ও সহজপাঠ্য ও সর্বাধিক পঠিত। শাসান তাবাটাবাইর অনুবাদ প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন ২০২২ সালে। নাভীদ নূরী’র অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ইরাজ বাসিরী’র অনুবাদ বাজারে খুঁজে পাইনি। আমি কস্টেলো, তাবাটবাই ও নূরীর অনুবাদ পড়েছি। কিন্তু অনুবাদের জন্য আমার প্রথম অবলম্বন ছিল নূরী। যথেষ্ট সাহায্য নিয়েছি কস্টেলো থেকেও। তাবাটাবাই থেকে সাহায্য নিয়েছি কদাচিৎ। ইউটিউবে ফার্সি মূলগ্রন্থের বাচিক উপস্থাপনা শুনেছি গভীরভাবে—শব্দের ও ছন্দের দ্যোতনা উপলব্ধির নিমিত্ত।  

    প্রথম বোম্বাই সংস্করণের ওপর ভিত্তি করে অনূদিত হয়েছে নূরীর অন্ধ পেঁচা। মূল রচনার দীর্ঘ বাক্য-বিন্যাস ও প্রচ্ছন্ন তারতম্য (nuance) সংরক্ষণের প্রয়োজনে নূরী এম-ড্যাস বা দীর্ঘ ড্যাস ব্যবহারে কার্পণ্য করেননি। আমিও তাই দীর্ঘ বাক্য দীর্ঘ রাখার জন্য কমা, সেমিকোলন ও ড্যাস ব্যবহার করেছি প্রচুর। আর শব্দচয়নে গতিময়তার চেয়ে গীতিময়তাকে প্রাধান্য দিয়েছি—আর তাতে যদি পাঠকের বিড়ম্বনা বাড়ে—ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আগেভাগে।

উপন্যাসিকার অনুবাদ এখনো অসমাপ্ত। এই সংখ্যায় প্রথম বা প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদ এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছদ প্রকাশিত হলো। অবশিষ্ট অংশটুকু ঘুংঘুরের পরবর্তী সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিতব্য।          

অন্ধ পেঁচা 


১ 

চেতনেও অনেক ক্ষত থাকে যা কুষ্ঠ-ক্ষতের নিঃশব্দ নীরবতায় 
অতিনিয়ত খুঁটে খুঁটে ক্ষয়িত করে জীবাত্মা— 
বিরলে। 

এই অন্তর্বেদনা প্রকাশের নয়, কেননা বোধাতীত এই ক্লেশের জন্ম 
অন্য কোনো অদ্ভুত ও ক্বচিৎ ঘটনার সংশ্লেষে। 
আর যদি কেউ তা কথায় প্রকাশ করে বা লিখে রাখে; 
সাধারণ মানুষ—তাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে সন্দেহ করবে  
অথবা উপহাসের হাসি ছুড়ে দেবে। 
মানুষের কাছে এখনো এর কোনো চিকিৎসা নাই। 
স্মৃতিনাশিনী সুরা, আফিম অথবা অন্য চেতনানাশক মাদক ছাড়া 
আর কোনো কার্যকরী ভেষজ নাই। 
হায়, এইসব ওষুধের প্রভাব সাময়িক, 
প্রভাব-সময় শেষ হলে উপশম উবে যায়; 
ক্লেশ আসে খরতর প্রবলতায়।  

জীবাত্মার ছায়ার বিম্বন— 
পঞ্চত্ব আর পুনরুত্থানের মাঝামাঝি দোদুল্যমান 
ঘুম আর জাগরণের সন্ধিতে প্রতিভাত এই অসুস্থতা। 
এমন দিন কি আসবে যেদিন কেউ একজন খুঁজে পাবে 
এইসব অতিপ্রাকৃত ব্যাধির অন্তঃশীল ব্যাখ্যা? 

বক্ষমান রচনায় আমি বিবৃত করব এই সর্বগ্রাসী ব্যাধির দৃষ্টান্ত— 
এ আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ—
এ আমাকে এতই উদ্বেলিত করেছিল যে বিস্মৃতি অসম্ভব। 
এর  অশুভ ছাপ হলাহলে পূর্ণ রাখবে আমার আমৃত্যু জীবন— 
সৃষ্টির আদি থেকে উপলব্ধির অতীতে। 
আমি বলি ‘সকলি গরল ভেল’, 
কিন্তু আসলে আমি বলতে চাই—  
আমি বহন করি—চিরজীবন বহন করব 
উত্তপ্ত ইস্ত্রির মতো তাতানো এই দগ্ধ চিহ্ন।  

চেষ্টা করব, 
স্বরণে যা আছে তা সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ করতে। 
জায়মান বিভিন্ন ঘটনার আন্তঃসংযোগ-সাপেক্ষে 
মনোমাঝে হয়তো কোনো ধারণার উদ্রেক হবে— 
নতুবা কোনো আশ্বাস; 
অথবা আত্মপ্রত্যয়— 
কারণ, 
অন্য কেউ বিশ্বাস করল কি না করলো তা নিয়ে আমার কোনো মর্ম ব্যথা নাই 
একমাত্র ভয় যে আত্মপরিচয়ের প্রাক্কালেই আমার অবধারিত মৃত্যু— 
আগামীকাল। 
জেনেছি স্বগোত্রীয়দের সাথে আমার ফারাক ভয়ংকর; 
এটাও বুঝেছি অযথা অজস্র উচ্চবাচ্য না করে শ্রুতির অগোচরে থাকাই বাঞ্ছনীয়

মনোবাঞ্ছা থাক মনের গোপনে— 
এই যে আমার রচনা, 
এত আপনাকে আপনার প্রতিচ্ছায়ার সম্মুখে উপস্থাপিত করার প্রয়াস মাত্র।  
প্রাকারে প্রতিচ্ছায়ার বক্র বিম্বন— 
আমি যতই রচনা করি— 
ততই সে গ্রাস করে চক্রবৃদ্ধি ক্ষুধার তাড়নায়। 
এই প্রতিচ্ছায়াকে আরও ভালো করে জানার জন্য, 
আরও ভালো করে নিরীক্ষার নিমিত্ত, 
গোত্র-বিচ্ছিন্ন একাকী সময়ে আমি খুঁজে বেড়াই 
আমার আমাকেই। 

অর্থহীন শূন্য ভাবনা— 
হয়তোবা তবু এই শূন্য ভাবনাগুলোই যেন বাস্তব থেকে অধিকতর নিপীড়নকারী। 
এই লোকগুলো—যারা আমার সদৃশ;  
ওদের প্রয়োজন এবং চাওয়া কি আমারই মতো? 
প্রতারণা করাই কি ওদের নিমিত্ত নয়? 
ওরা কি গুটিকয় অপচ্ছায়া নয়, 
যাদের জন্মের হেতুই হলো 
আমাকে উপহাস করা ও প্রতারিত করা? 
আমি যা অনুভব করি, ভাবি ও অবলোকন করি 
তা কি সম্পূর্ণ বাস্তবতা বর্জিত নয়?

আমি রচনা করি আমার প্রতিচ্ছায়ার জন্য; 
সে প্রদীপের মুখোমুখি—দেয়ালে নিক্ষিপ্ত  
আমি এখন আমাকে খুলে ধরব 
আমারই প্রতিচ্ছায়ার সম্মুখে।        

২     

অধঃপতিত, অপকৃষ্ট এ সংসারে, 
নিঃসঙ্গ ও অভাবগ্রস্ত এ সংসারে, 
এই প্রথম মনে হলো 
অংশুমালী যেন একগুচ্ছ অংশু-প্রভা নিয়ে এলো আমার জীবনে। 
হায়! এ তো সূর্যের অম্লান দীপ্তি নয়; 
এ যে হীনবল মিটমিটে জীর্ণ আলো; 
রমণী-দেহে-মূর্তমতি-খসে-পড়া-তারা, 
না দেবদূত—দৃষ্টিতে ভেসে উঠল আমার জীবনের যতসব অশিব দুর্দশা; 
নিজেই আপ্লুত হলো আপনার প্রসারতা ও জৌলুসে; 
ঘনান্ধকার আবর্তে তার বিলুপ্তি। 
নাঃ, আমি ধরে রাখতে পারিনি ক্ষণিক আলোর এই কিরণধারা। 

তিন মাস— 
না, দুই মাস চার দিন হলো আমি তাকে হারিয়েছি,
তার সম্মোহক লোভ-জাগানিয়া ঝিকিমিকি চোখ এখনো গেঁথে আছে হৃদয়ে— 
এতই ওতপ্রোত—বিস্বরণ—সেকি সম্ভব?  

না, আমি কখনো তাঁর নাম উচ্চারণ করব না— 
তার ঋজু বায়বীয় সৌষ্ঠব আর তাঁর বিস্ময়কর দুই ডাগর চোখ 
যার তাড়নায় অতি মন্থরে 
দ্রবীভূত হচ্ছে, ভষ্ম হচ্ছে 
আমার ক্লিষ্ট জীবন। 
সে এখন এই হতচ্ছাড়া পতিত পৃথিবীর কেউ নয়— 
মলিন সংসারে অযথা সম্পৃক্ত করে কোনোমতেই কলুষিত করা নয় 
তাঁর নাম ও শুদ্ধ সুখ্যাতি। 

ওকে হারানোর পর আমি লৌকিক সঙ্গ থেকে সম্পূর্ণ সরে পড়লাম— 
মূঢ় ও পয়মন্ত সবার সঙ্গে থেকে, 
আর বিস্মৃতির নিমিত্ত মত্ত হলাম আফিম ও সুরায়— 
ঘরের চার দেয়ালের বৃত্তে আমার দিবস ও রজনি— 
আমার সমস্ত জীবন—সারাদিন ধরে একটাই কাজ, 
কলমের খাপের প্রচ্ছদ অঙ্কন—
কলমের খাপের প্রচ্ছদ অঙ্কন আর অবসরে সুরা ও আফিম— 
সময় কাটাই। 
কলমের খাপের প্রচ্ছদ অঙ্কনের এই করুণ বৃত্তিটি নিয়েছি 
নিজেকে বোকা বানিয়ে সময় ক্ষেপণের নিমিত্ত। 

আমার বাস শহর ছাড়িয়ে— 
নির্ঝঞ্ঝাট প্রশান্ত এলাকায়— 
জনতার তোলপাড় ও কোলাহল অনেক দূরে— 
সীমানা স্পষ্ট আর চারদিকে ধ্বংসাবশেষ।  
পয়োনালির ওপাশে জীর্ণ মাটির ঘর—ওখান থেকেই শহরের শুরু— 
জানি না কোন বিরস বিকৃতবুদ্ধি প্রাচীন মাতাল নির্মাণ করেছে এইসব দরদালান— 
চোখ বুঝলে এইসব কোন আর কুলুঙ্গিই শুধু দেখতেই পাই না, 
স্কন্ধে অনুভূত হয় তাদের সমুদয় গুরু ভার— 
এরকম দরদালানের চিত্র অঙ্কিত হতে পারে শধু মাত্র অতি প্রাচীন কলমের খাপের প্রচ্ছদে। 

আমার সব লিখে রাখতে হবে—
আমি নিশ্চিত হতে চাই যে এ আমার কল্পনাবিলাসী ভ্রম নয়। 
দেয়ালে নিক্ষিপ্ত ছায়াকে আমার সব বুঝিয়ে দিতে হবে। 
হ্যাঁ, এতদিন একটা মাত্র কাজই আমাকে আনন্দ দিতো— 
চার দেয়ালের ঘরের বন্দিত্বে  আমি কলমের খাপে ছবি আঁকতাম। 
সময় বয়ে যেত অর্থহীন এক বিপন্ন অভ্যাসে, 
কিন্তু ওই চোখ দুটো দেখার পর, 
ওকে দেখার পর সকল গতিবিধি ও সকল সক্রিয়তা পরমভাবে অর্থহারা— 
আর আশ্চর্য, আমি জানি না— 
সেই প্রথম থেকে কেন সেই একই পট এঁকে যাচ্ছি কলমের খাপে— 

কুঁজো, 
হিন্দুস্থানি যোগীর মতো, 
গাত্রে ঢোলা আঙরাখা, 
মাথায় পাগড়ি, 
চিরহরিৎ সাইপ্রেস বৃক্ষের নিচে উবু, 
ঠোঁঠে বাম তর্জনী রেখে উদভ্রান্ত বিস্ময়— 
আর তার সম্মুখে অনূঢ়া বালিকা,  
দীর্ঘ কালো ভূষণে আবৃতা, 
হাতে কলমি ফুলের অঞ্জলি, 
একটু ঝুঁকে— 
কারণ মধ্যখানে বহমান ঝরনা—

আমি কি কোথাও দেখেছি এ দৃশ্য? 
না স্বপ্নে দেখা? 
জানি না। 
শুধু জানি প্রতিনিয়ত আমি এঁকে চলেছি একই প্রসঙ্গ ও একই দৃশ্য, 
আমার হাত এঁকে যাচ্ছে অনিচ্ছাকৃতভাবে।  
আশ্চর্য খরিদ্দারদেরও আগ্রহের কমতি নেই। 
পিতৃব্য মারফত, এই কলমের খাপগুলো আমি হিন্দুস্থানেও পাঠিয়েছি, 
বিক্রি করে সে আমায় অর্থ পাঠাত। 

এ দৃশ্য একাধারে অন্তরঙ্গ ও দূরবর্তী। 
ঠিক মনে পড়ছে না। 
এইমাত্র মনে পড়ল। 
বলেছিলাম লিখে রাখব স্মৃতি-কথা। 
এই ঘটনা কিন্তু ঘটেছে অনেক পরে 
এবং ছবির সাথে সম্পর্কহীন। 
এবং এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই তুলে রেখেছি ছবি আঁকার তুলি— 
দুই মাস আগে—দুই মাস চার দিন হলো। 

‘সিজদাহ বে দার’—নওরোজের ত্রয়োদশ দিবস। 
শহর ছেড়ে সবাই চলে গেছে গ্রামে—দেহাত অঞ্চলে। 
বাতায়ন এঁটে দিয়েছি—
ছবি আঁকার মত্ততায় যাতে বাধা না পড়ে। 
সন্ধ্যা। 
নিমগ্ন অঙ্কনে। 
সহসা খোলা দুয়ার। 
পিতৃব্যের প্রবেশ। 
পিতৃব্য— 
সে নিজেই বলেছে যে সে আমার পিতৃব্য।  
আমি তাকে কখনো দেখিনি।  
আমার বাল্য থেকেই সে দূরদেশ যাত্রী—বিদেশি।  
হয়তো জাহাজের কাপ্তেন।  
আমার অনুমান, আমার সাথে ওর কিছু লেনদেন আছে।  
শুনেছি সে একজন ব্যবসায়ী—
সে যাই হোক, 
আমার পিতৃব্য এক ঝুঁকে পড়া কুঁজো বৃদ্ধ, 
তার মাথায় হিন্দুস্তানি পাগড়ি, 
পরিধানে জীর্ণ হলদে কুর্তা, 
গলায় পেঁচানো শাল, 
খোলা গলবন্ধের আড়ালে দৃশ্যমান লোমশ বক্ষ— 
শালের নিচে থেকে উঁকি দিচ্ছে শ্মশ্রু, 
গোনা যাচ্ছে এক এক করে, 
দ্বিধাবিভক্ত ঠোঁট, 
চোখের পাতা পচনশীল ও লাল। 
আমার সাথে কোথায় যেন এক দূরবর্তী 
ও হাস্যকর সাদৃশ্য। 
যেন আমার প্রতিবিম্ব বিম্বিত হচ্ছে কোনো এক বিকৃতকারী পরকলার অভ্যন্তরে। 
সব সময় আমি আমার বাবার চেহারা এভাবেই কল্পনা করতাম। 

ঘরে ঢুকার সাথে সাথেই সে একটেরে কোণে উবু হয়ে বসল। 
কিছু আপ্যায়ন করা উচিত—বাতি জ্বালালাম, 
অন্ধকার কুঠুরিতে হাতড়িয়ে দেখলাম কিছু পাওয়া যায় কি না—
যদিও আমি জানতাম ওখানে কিছুই নাই—
আফিম বা সুরা কিছুই নাই—
সহসাই দৃষ্টি পড়ল উপরের তাকে— 
যেন এক উন্মোচন, বিস্ময়কর প্রকাশ, এক বোতল প্রাচীন সুরা— 
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া—
হয়তো আমার জন্মোৎসবের নিমিত্ত তৈরি—
একেবারে উপরের তাকে— 
এ রকম প্রতীতি হৃদয়ে আসেনি আগে, 
এ রকম কিছু যে একটা ঘরে থাকতে পারে এ ছিল বিস্বরণের পরপারে—

উপরের তাক নাগালে পাওয়ার জন্য একটা টুল আনলাম। টুলে দাঁড়ালাম।  সুরার বোতলটা হাতে নেয়ার মুহূর্তে দৃষ্টি উড়ে গেল বাতায়নে — বহির্দেশে—আমার ঘরের পশ্চাতে, মাঠে। ঝুঁকে পড়া কুঁজো বুড়ো বসে আছে সাইপ্রেস তলে আর তার মুখোমুখি অনূঢ়া বালিকা—নাহ, তার মুখোমুখি  এক স্বর্গীয় দেবদূতী, একটু ঝুঁকে, ডান হাতে কালসিটে পড়া কলমি ফুলের অঞ্জলি। আর বুড়ো একমনে চিবুচ্ছে তার বাম তর্জনী। 

মুখোমুখি বালিকা। 
উদাসীন—আশপাশ ও প্রতিবেশ সম্পর্কে 
সম্পূর্ণ অনাসক্ত। 
উদাসীন দৃষ্টি। প্রেক্ষণহীন নেত্রপাত। 
ঠোঁটে জমে থাকা স্মিত হাসি। 
ভাবছে অবর্তমান কারও কথা। 
ভয়ংকরী অথচ মায়াবিনী চক্ষু। 
চক্ষুর তীব্র ব্যঙ্গ অস্থির, বিস্ময়কর। 
যুগপৎ ভীতিপ্রদ ও আশাব্যঞ্জক। আমার সমুদয় জীবনীশক্তি নিমজ্জিত ও নিলীন ওই ইঙ্গিতপূর্ণ উজ্জ্বল অক্ষিকোঠরে। সর্বগ্রাসী এক সম্মোহনী দর্পণ শুষে নিচ্ছে আমার সমস্ত সত্তা। 
নিস্তেজ মনন। তির্যক তুর্কি চোখ অতিপ্রাকৃত ও উন্মাদক।  
একই সাথে আকর্ষিত ও ভীত। 
যেন সে পর্যবেক্ষণ করেছে আধিভৌতিক ভয়ানক দৃশ্য— 
যা সাধারণ্যে অদৃশ্য। 

উন্নত চোয়াল, চওড়া ললাট, চিকন যুক্ত ভ্রু, অর্ধ-অবারিত পূর্ণ অধর— 
যেন গভীর উষ্ণ চুম্বন হতে এক্ষুনি বিযুক্ত। 
এখনো অতৃপ্ত। 
এলোমেলো কালো চুলে ঢেকে রেখেছে জ্যোৎস্নাক্রান্ত আস্য-প্রান্ত। 
আর অলকগুচ্ছ স্তব্ধ ঝুলে আছে একটেরে ললাট-প্রদেশে। 
তার অঙ্গ-লাবণ্য ও আসা-যাওয়ার মুক্ত-চটুল ইথারীয় চারুতা যেন 
পলকা অনিত্যের ইঙ্গিতবাহী— 
হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী ছাড়া আর কার থাকতে পারে 
এরকম লীলায়িত অঙ্গভঙ্গিমা। 

বিষণ্ণ বদনে ফুটে ওঠা বিষাদবিধুর আনন্দে সে অসাধারণ— 
পার্থিবতার অতীত। 
যেন আফিম-সিক্ত স্বর্গধাম থেকে নেমে এসেছে  অনন্যা— 
অনন্য তার সৌন্দর্য মাধুরী। 
ম্যানড্রেকি শিকড়-জাত আদি রসের মতো সে জাগ্রত করেছে—আমার শরীর। 
কৃশতনু দিঘল অঙ্গ— 
স্কন্ধ থেকে স্তন— 
বাহু-বক্ষ থেকে নিতম্ব—
নিতম্ব থেকে পা—পায়ের পাতা— 
আহা! 
যেন এখনই তাকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে অতৃপ্ত-দয়িত-সঙ্গম হতে— 
সে যেন এক্ষুনি-প্রিয়-সঙ্গ-বিচ্যুত এক মাদী-ম্যানড্রেকি। 

কুচি দেয়া কালো জামা শরীরে লেপ্টে আছে। 
দেখে মনে হচ্ছে সে খালটা পেরুতে চায়— 
যেতে চায় কুঁজো বুড়োর কাছে, কিন্তু পারছে না। 
সহসাই কুঁজো বুড়ো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। 
এমন কর্কশ ও শুকনো হাসি যে গায়ের লোম কাটা হয়ে ওঠে— 
অলক্ষুণে, রূঢ় ও বিদ্রূপভরা হাসি, অথচ অপরিবর্তিত ভাবলেশহীন মুখাবয়ব— 
যেন একটা প্রতিধ্বনি উদ্গত হচ্ছে কোথাও কোনো বিশাল শূন্যতা হতে। 

ভীতসন্ত্রস্ত, হাতে সুরাপাত্র— 
লাফ হয়ে নামলাম টুল হতে—শরীরে কাঁপুনি—আতঙ্কিত পুলক— 
যেন এইমাত্র আমি জেগে উঠেছি 
ভয়ঙ্কর অথচ সঞ্জীবনী এক স্বপ্নের বিবর থেকে। 
সুরা পাত্র মেঝেতে রেখে ঝিম ধরা মাথায় হাত রাখলাম— 
কতগুলো মিনিট না কতগুলো ঘণ্টা বয়ে গেছে—জানি না। 
চেতন ফিরার সাথে সাথে সুরাপাত্র হাতে কুঠুরি থেকে ঘরে ফিরলাম। 
ততক্ষণে গৃহত্যাগ করেছেন— 
মৃতদেহের খোলা মুখের মতো আধখোলা দরজা হাঁ করে আছে— 
আমার শ্রবণে তখনো রণিত হচ্ছে কুঁজো বুড়োর শূন্যগর্ভ উচ্চহাসি। 

আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে, ধোঁয়া ছড়াচ্ছে প্রদীপ — 
আতঙ্কিত পুলকের কাঁপুনির রেশ এখনো ভরে রেখেছে শরীরের সমস্ত ভাড়ার— 
সন্ধিক্ষণ—আবর্তন-লগ্ন—আমার জীবনের।  
শুধু এক পলকের নেত্রপাত— 
আর তাতেই ইথারীয় স্বর্গীয় কুমারী আমার অজান্তে রেখে গেছে 
তার অস্তিত্বের অমোচনীয় ছাপ আমার অস্তিত্ব জুড়ে। 

বিস্মৃতিতে সমাহিত— 
যুগ যুগান্তর সে আমার চিনা— 
আমি তার নাম জানি। 
তার চোখের দ্যুতি, 
তার গাত্র বর্ণ, 
তার সৌরভ, 
তার অঙ্গভঙ্গি—
সবই যেন আমার অতি চেনা— 
যেন কোনো পূর্বতন স্বপ্নময় জীবনে আমাদের সহবাস ছিল আত্মায় আত্মায়— 
যেন আমরা একই শিকড় ও উৎস থেকে জাত— 
আমরা যে পুনর্বার মিলাব-মিলিব তা ছিল অবশ্যম্ভাবী। 
একটু যে ছুঁয়ে দেখব, এমন অভিপ্রায় কখনো চেতনে আসেনি। 
আমাদের শরীর নিঃসৃত অদৃশ্য দ্যুতির পরস্পর আলিঙ্গনই কি যথেষ্ট স্পর্শ নয়। 
প্রথম পলকেই তাকে অদ্ভুতভাবে একান্ত আপনার মনে হয়েছে— 
দয়িত দয়িতারা কি এরকমই অনুভব করে না— 
কোনকালে কোথায় যেন দেখেছি— 
এক ধরনের নিগূঢ় বন্ধনে তারা অনন্তর আবদ্ধ? 
এই হীন সংসারে আমি শুধু তার ভালোবাসা চেয়েছিলাম; 
আর তাই যদি না পাই, আমি আর কারও ভালোবাসার প্রত্যাশী নই। 
সে ছাড়া অন্য কেউ আমার হৃদয়ে ছাপ রাখবে—সে কি সম্ভব?  
কিন্তু কুঁজো বুড়োর শূন্যগর্ভ কর্কশ হাসি—অলক্ষুণে অট্টহাসি  
ভেঙে খানখান করেছে আমাদের মিলন বন্ধন। 

রাতভর আমি এসবই ভেবেছি। 
বারংবার বাতায়ন-পথে উঁকি দিয়ে খুঁজে দেখার কথা ভেবেছি। 
কিন্তু পারিনি কুঁজো বুড়োর অট্টহাসির ভয়ে। 
পরদিনও একই ভাবনা। ওকে না দেখে আমি কি থাকতে পারব? 
অবশেষে তৃতীয় দিবসে, তীব্র শঙ্কা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিলাম— 
সূরাপাত্র উপরের তাকে রাখতেই হবে। 
কিন্তু যখন পর্দা সরিয়ে কুঠুরির দিকে চোখ রাখলাম— 

অন্ধকার কালো দেয়াল— 
আমার জীবন-চাপা কালো অন্ধকারের মতো দেয়াল— 
বাতায়নের কোনো চিহ্ন নাই— 
বাতায়নের চৌকো মুখ সম্পূর্ণ মুছে গিয়ে কেবলই দেয়াল— 
যেন বাতায়ন এখানে কখনো ছিল না। 
টুলে দাঁড়িয়ে হাতের মুঠো দিয়েই অনেক ঠোকাঠুকি করলাম— 
কান পেতে শুনতে চাইলাম— 
প্রদীপের আলোয় পরখ করলাম— 
বাতায়নের সামান্যতম চিহ্নও পেলাম না। 
হাতের সজোর ঠোকায় পুরু ও শক্ত দেয়ালে কোনো বিকার নাই— 
যেন সিসার দেয়াল। 

ওকে আরেকবার দেখার প্রত্যাশা কি আমি ত্যাগ করতে পারি? 
এ আমার হাতের বাইরে। 
অতঃপর আমার আত্মা নির্যাতিত। 
নিষ্ফল আমার সমস্ত চাওয়া ও প্রতীক্ষা। 
পাড়ার প্রতি বর্গহাত জমি আমি বারবার খুঁজে দেখেছি— 
খুনি যেমন বারবার ফিরে আসে বধ্যভূমিতে— 
এক দিন নয়, দুই দিন নয়, দুই মাস চার দিনের প্রতি সন্ধ্যায় 
মাথা-কাটা মোরগের মতো আমি ঘুরে মরেছি এখানে ওখানে। 
প্রতিটি নুড়ি পাথরের হাদিস জেনেছি— 
হাদিস পেলাম না সাইপ্রেস বৃক্ষের, 
অথবা কৃশকায় ঝরনার অথবা দুটো মানুষের, যাদের দেখেছিলাম— 

কত রাত আমি নতজানু হয়েছি উচ্ছ্বলিত চন্দ্রিমায়— 
হাত পেতেছি, 
সনির্বন্ধ মিনতি করেছি পাদপ, পাষাণ ও শশীর কাছে— 
কারণ সেও তো তাকাতে পারে চাঁদের পানে— 
আনুকূল্য চেয়েছি ঈশ্বরের প্রতিটি সৃষ্টির কাছে—
অথচ তার কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। 
অবশেষে হৃদয়ঙ্গম হলো, 
অর্থহীন এই সব প্রচেষ্টা— 
কারণ সে তো অপার্থিব, এ ধরার সাথে সম্পূর্ণ সংস্রবহীন— 

যেমন : 

কোন নহরের জলধারায় সে কেশ ক্ষালণ করে, 
কোন মায়াময় গিরিগুহা থেকে নেমে আসা— 
আহা, সেই অবিদিত নহরের নাম জানা নিষিদ্ধ— 
তার পরিহিত বসনের তন্তু আর সুতো সাধারণ পশম আর কার্পাসের নির্মাণ নয়— 
পার্থিব কোনো হস্তের তৈরি নয়— 
সে সম্পূর্ণই অন্য—অনন্য— 
জানলাম তার হাতের কলমি ফুল সাধারণ কলমি ফুল নয়— 
আমি নিশ্চিত পার্থিব জলের স্পর্শে এলে বিবর্ণ হবে তার মুখশ্রী— 
আর সে যদি তার সরু ও দীর্ঘ অঙ্গুলি দিয়ে 
সাধারণ কোনো কলমি ফুল তুলে আনে— 
আর্ত ফুলদলের মতোই নেতিয়ে পড়বে তার সমুদয় করাঙ্গুলি। 

এ সবই আমার বিদিত।  
এই বালিকা— 
না, এই দেবদূতী আমার হৃদয়ে প্রকাশিত এক অনির্বচনীয় বিস্ময়— 
অলীক ও অতীব নিগূঢ় তার উপস্থিতি। 
আমার সত্তায় সে নিয়ত জাগরিত প্রার্থনার উপলব্ধির মতো। 
অপরিচিত ও সাধারণ মানুষের নেত্রপাতে, 
আমি নিশ্চিত, 
সে হবে অপচিত ও বিবর্ণ।  

যে মুহূর্ত থেকে ওকে হারিয়েছি, 
যে মুহূর্ত থেকে সেই মুক্ত বাতায়ন রুদ্ধ হয়েছে— 
এক গুরুভার সীসার দেয়াল যেন আমাদের পৃথক করেছে— 
জীবন যেন চিরতরে বিনষ্ট— 
পথভ্রষ্ট পথিক। 
যদিও আমার সোহাগী দৃষ্টি 
ও আমার গভীর আনন্দিত প্রেক্ষণ ছিল সম্পূর্ণ একপেশে ও প্রতিদানহীন— 
ও তো আমাকে দেখেনি— 
আমি অলক্ষিত—হয়তো তাই। 
ওই দৃষ্টি আমার চাই। 
ওর চোখের এক পলকে জট খুলতে পারে 
তাবৎ দার্শনিক জিজ্ঞাসা ও দৈব জটিলতার— 
এক পলকের চাহনি, 
আহা, নিগূঢ়তম সকল রহস্যের সমূহ নিপাত। 

আফিম আর সুরা সেবনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলাম। 
হায়! 
এইসব হতাশা-নাশী মাদকও 
আমার হৃদয়ক অনুভূতিসমূহকে অসাড় বা অবশ করতে পারেনি। 
বরং দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মিনিটের পর মিনিট— 
তার ধ্যান, তার শরীর, তার মুখশ্রী আমার মননে আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। 

কী করে কখনো বিস্মৃত হতে পারি— 
নেত্রপল্লব না বোজানো না উন্মোচিত— 
নিদ্রিত না বিনিদ্ৰ — 
সতত সে প্রতিভাত। 
কোঠরির খোলা বাতায়ন পথে দেখা 
তামসী রাত্রি যেভাবে প্রচ্ছন্ন করে রাখে মনন ও বুদ্ধি— 
সেভাবে সতত সে প্রতিভাত আমার দৃষ্টির দোয়ারে। 
কি করে কখনো বিস্মৃত হতে পারি। 
স্বস্তি— 
সে আমার জন্য নিষিদ্ধ। 
কেমন করে স্বস্তি খুঁজে পাব আমি?

সূর্য ডোবার প্রাক্কালে 
সান্ধ্যভ্রমণ এখন আমার প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। 
জানি না কী কারণে অথবা কেন নিদারুণভাবে খোঁজে ফিরি 
সেই শীর্ণ নহর, 
সেই সাইপ্রেস বৃক্ষ ও কলমিলতার বাগান— 
আফিমে আসক্তির মতোই প্রগাঢ় এই সান্ধ্যভ্রমণের আসক্তি— 
যেন এক অদেখা শক্তি আমাকে নিরন্তর ঠেলে দিচ্ছে— 
সারা পথ শুধু তার কথা ভেবে ভেবে সারা হই— 
মনে পড়ে সেই প্রথম নেত্রপাতের কথা— 
বাসনা হয় খুঁজে পেতে সেই স্থানাঙ্ক— 
যেখানে তাকে দেখেছিলাম 
নওরোজের ত্রয়োদশ দিবসে— 
যদি খুঁজে পেতাম, 
যদি ক্ষণিকের জন্যেও বসতে পারতাম সাইপ্রেস বৃক্ষের তলায়— 
নিশ্চিত স্বস্তি পেত এই তাপিত হৃদয়— 
কিন্তু হায়! 

কাঁটা, তপ্ত বালুকা, মৃত ঘোটকের বক্ষের অস্থি, আর বর্জ্য-স্তূপে 
ক্ষুধিত লুব্ধকের তন্ন তন্ন খাদ্যানুসন্ধান— 
কিন্তু যখনই কেউ বর্জ্যের ময়লা ডালা নিয়ে আসে— 
ত্রাসে পলায়িত সারমেয়— 
অতঃপর আবার ফিরে আসে বর্জ্য-স্তূপে 
এক গ্রাস সুস্বাদু খাবারের প্রয়োজনে— 
আমারও এমনই দশা— 
আমার কাছে সে ছিল বর্জ্য-স্তূপে নিক্ষিপ্ত 
একগুচ্ছ বিশুদ্ধ পুষ্পস্তবক। 

সান্ধ্যভ্রমণের শেষ অভ্যস্থ সন্ধ্যায় 
আকাশ ছিল সমাচ্ছন্ন, মেঘবিধুর, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি— 
কুহেলিকা-ঢাকা চরাচর— 
মিহি বৃষ্টিতে ভিজে সন্ধ্যার অস্তরাগে এসেছে কমনীয় তারল্য 
আর দৃশ্যমান দিগঙ্গনে ঝাপসা অস্পষ্টতা— 
এক ধরনের মুক্ত প্রশান্তিতে ভরে উঠল আমার অনুভব— 
যেন বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে হৃদয়ের কালিমামাখা চিন্তাধারা। 
এমন যামিনী— 
কথা ছিল না— 
তবু এলো। 

প্রতিবেশ-চেতনা-রহিত-বেভুল-পথচলা— 
ওই নিঃসঙ্গ একলা ঘণ্টাগুলো—মিনিটগুলো— 
কে জানে কতক্ষণ— 
তার ভীতি জাগানো মুখাবয়ব, 
ঝাপসা—যেন মেঘ আর কুয়াশার অন্তরাল থেকে উদ্ভাসিত— 
অভিব্যক্তিহীন ও নিস্পন্দ নিথর— 
কলমের খাপে আঁকা পটের মতো 
অধিকতর স্পষ্টভাবে মূর্ত হয়ে উঠল আমার দৃষ্টির গোচরে। 

যখন ঘরে ফিরলাম, 
যামিনীর বৃহদাংশ সময়ই তখন যাপিত— 
জেঁকে বসেছে গভীর কুজ্বটিকা— 
এতই গভীর যে পথচলার সময় পা ফেলার জায়গাটাও ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। 
তা সত্ত্বেও অভ্যাসবশত, 
এবং অন্তর্নিহিত আত্মায় জাগরিত এক ধরনের বিশেষ চেতনের তাড়নে— 
দ্বারপ্রান্তে আসামাত্র চোখে পড়ল এক মানবিমূর্তি — 
অসিতবর্ণ পরিচ্ছদে আবৃত— 
ঘরের পাশে রাখা লম্বা আসনে উপবিষ্ট। 

তালার চাবি ঘোরানোর গর্ত খোঁজার জন্য দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালালাম— 
কিন্তু অজান্তে অনিচ্ছকৃতভাবে চোখ ঘুরে গেল 
অসিতবর্ণ পরিচ্ছদে আবৃত মানবিমূর্তির দিকে,  
না তাকিয়েও  আমি চিনতে পারলাম— 

দুই তির্যক আঁখি—  
দুই ডাগর কালো আঁখি—  
চাঁদের উপচানো আলোয় ভাত পাণ্ডুর আস্যে গাঁথা— 
পূর্বে যদি না-ও দেখতাম, তবুও চিনতে পারতাম ঠিকই—  
না বিভ্রম নয়, 
কালো পরিচ্ছদে আবৃত মানবীমূর্তি অবশ্যই 
‘সে’— 
আমি চলৎশক্তিহীন— 
আমি হতবুদ্ধি বিহ্বল— 
আমি যেন সেই স্বপ্ন-বিভোর— 
যে জানে সে স্বপ্ন দেখছে—  
সে স্বপ্ন-ভেঙে জাগতে চাইছে— 
অথচ পারছে না— 

দেশলাইয়ের কাঠি পুড়ে পুড়ে আঙুল পোড়ালে সহসাই মোহমুক্ত হলাম। 
তালায় চাবি ঘোরালাম, দরজা খুলল, আমি ভিতরে পা রাখলাম— 
সে আসন থেকে ওঠে, 
যেন এ ঘরের অন্ধিসন্ধি তার আঙুলের ডগায়, 
অন্ধকার করিডর ধরে হেঁটে আমার কক্ষের দরজা খুলে প্রবেশ করল— 
আমি তার পিছু পিছু। 
আনাড়ি হাতে বাতি জ্বালালাম, 
সে আমার বিছানায় গিয়ে সটান শুয়ে পড়ল— 
তার মুখ আলো-আঁধারির ছায়ায়। 
আমি জানি না ও আমাকে দেখতে পাচ্ছে কি না—শুনতে পাচ্ছে কি না। 
মনে হচ্ছে ওর মনে কোনো ভয় নেই— 
প্রতিরোধের কোনো ইচ্ছে যে আছে, তাও মনে হচ্ছে না।  
তবু কী যেন জানান দিচ্ছে, সে নিজে থেকে আসেনি, তার আগমন অনৈচ্ছকৃত। 

ও কি ব্যাধিগ্রস্থ? 
ও কি পথ হারিয়েছে? 
উদাসীন ইচ্ছে—স্বপ্নচর, সে এসেছে— 
সেই মুহূর্তে আমার অনুভবের আতিশয্য কেউ বুঝবে না। 
এক অনির্বচনীয় ও উদ্দীপক ব্যথা ডুকরে উঠল বুকের মাঝে। 
না—বিভ্রম নয়, এ সেই একই রমণী যে নীরব বিস্ময়হীনতায় এসেছে আমার ঘরে। 
কল্পনায় সতত ভেবেছি, এভাবেই হবে আমাদের প্রথম সম্মিলন। 
আমার মনের অবস্থা অন্তহীন সুপ্তির গভীরতায় নিমজ্জিত স্বপ্নচারীর মতো—
এমন স্বপ্নদেখার নিমিত্ত এরকম অন্তহীন নিমজ্জন ছাড়া কোনো ব্যত্যয় নাই—
আর এই নীরবতা যেন এক অনন্ত জীবনের অনুষঙ্গ, 
অনন্ত জীবনের আদি নেই, অন্তও নেই
তাই নীরবতা-হন্তা শব্দও নেই। 

সে মানবী—অথচ মানবতার অতীত। 
ওর মুখের দিকে তাকালে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে অন্য 
আর সব প্রাকৃত মুখের স্মৃতি তলিয়ে যায় বিস্মৃতিতে। 
কম্পিত শরীর—হীনবল জানুসন্ধি। 
ওর বিশাল অক্ষির নিগূঢ় নিবিড়তায় আমি মুহূর্তেই দেখতে পেলাম আমার সারা জীবনের দুর্ভাগ্যের ও হীনাবস্থার হিসাব। 
আর্দ্র আঁখি—বিশাল কালো দুই হীরকখণ্ডের মতো জ্বলজ্বল করছে অশ্রুজলে।  
তার আঁখি, তার কালো আঁখি, নিশ্চিদ্র আঁধারের অনন্ত অমানিশা— 
আমি সে অন্ধকারের অন্বেষী 
এবং আমি নিমজ্জিত সেই বিমুগ্ধ করাল নারকীয় তমসায় 
যেন আমার অভ্যন্তর থেকে শুষে নেয়া হচ্ছে বিশেষ কোনো ক্ষমতা। 
পদতলে কম্পিত ধরণী— 
যদি নিপতিত হতাম ধরাপৃষ্টে—পেতাম অনির্বচনীয় পুলকের উচ্ছ্বাস। 

নিশ্চল হৃদয়।
রুদ্ধ নিশ্বাস। 
ভয় হচ্ছিল — 
নিশ্বাসের আঘাতে সে যদি উবে যায় ধূম্রজাল বা মেঘের মতো—
তার নির্বাক ভাব অপার্থিব ও অতিপ্রাকৃত। 
যেন ওর আর আমার মধ্যিখানে জেগে উঠেছে আস্ত প্রাচীর— 
আমি শ্বাসরুদ্ধ, সেই মুহূর্ত, সেই ঘণ্টা, সেই অনন্ত সময় থেকে    
যেন সে দেখেছে নৈসর্গিক কোনো জ্যোতি— 
যা আর কারও দৃষ্টির অতীত—যেন সে প্রত্যক্ষ করেছে 
উৎক্রান্ত মৃত্যু—
শ্রান্ত নেত্র শ্লথ নিমীলিত 
আর আমি ভীত ডুবন্ত মানুষের মতো 
ভেসে থাকার প্রাণান্ত প্রচেষ্টার পর জন্যে ভাসা 
জ্বরের উচ্চ তাপে কম্পিত 
জামার আস্তিনে মুছে নিলাম ললাটের ঘন স্বেদবিন্দু। 

তার মুখমণ্ডলে এখনো সেই একই জড়তামাখা নিস্তব্ধ অভিব্যক্তি;
কিন্তু মনে হচ্ছে অধিকতর কৃশ ও জরাগ্রস্ত।
শুয়ে শুয়ে বাম হাতের তর্জনী চিবুচ্ছে— 
তার মুখের রং চন্দ্র-প্রভা-সদৃশ 
অঙ্গে আঁকড়ে আছে অতি সূক্ষ্ম ও কমনীয় কালো ভূষণ;
আমার চোখে ফুটে উঠছে তার দেহরেখা—
পা, পায়ের গুল্ম, দুবাহু, কুচ ও অখণ্ড দেহবল্লরী। 

একটু ঝুঁকে আমি তাকে আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম।
নিমীলিত নয়ন—যতই দেখি সে যেন ততই দূরবর্তী—অপার। 
সহসাই মনে এলো, 
ওর হৃদয়ের কন্দরে যে গোপনের বসবাস আমি তার কিছুই জানি না—
আমাদের দুজনের মাঝে কোনোদিনই কোনো বন্ধন বা সাযুজ্য ছিল না। 

কিছু বলতে ইচ্ছা হলো—ভয় হলো— 
আমার মুখনিঃসৃত শব্দ যদি তার শ্রবণে অশনি হয়ে আঘাত করে— 
তার অতিসংবেদনশীল শ্রব—সে তো শুধু দূর থেকে ভেসে আসা 
স্বর্গের মৃদু সংগীতের তরে তৈরি।

ওর ক্ষুধা বা তৃষ্ণা পেতে পারে মনে হতেই আমি ক্লোসেটের তাকে 
কিছু খুঁজতে গেলাম—যদিও জানি কিছুই নেই— 
তখনি সহসা কি যেন এক অদ্ভুত প্রেরণায় প্রতিভাসিত হলো—
উপরের তাকে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক বোতল বয়সী সুরা এখনো আছে। 
টুলের উপরে উঠে সুরার বোতল নামালাম— 
পদাঙ্গুলির ডগায় ভর দিয়ে অতি সন্তর্পণে নিঃশব্দে বিছানার কিনারে দাঁড়ালাম— 
ক্লান্ত অবসন্ন ছোট্ট বালিকার মতো ঘুমুচ্ছে— 
গভীর নিদ্রামগ্ন— 
মখমল-সদৃশ দীর্ঘ ভুরু বোজানো— 
বোতলের ছিপি খুলে এক পেয়ালা সুরা সাবধানে ঢেলে দিলাম তার মুখগহ্ববরে। 

জীবনে এই প্রথম বারের মতো সহসাই আমি 
অন্তর্গত প্রশান্তিতে আপ্লুত— 
যে পিশাচ নিরন্তর কুরে খাচ্ছে  
অথবা যে ক্লেশকীর্ণ অপচ্ছায়া প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত করছে আমার সমুদয় সত্তা— 
ওই নিমীলিত আঁখির মায়ায় তারাও যেন কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঘুমিয়ে পড়েছে। 
চেয়ার টেনে নিলাম বিছানার পাশে— 
তাকিয়ে থাকলাম—স্থির দৃষ্টি— 
কী শিশুসুলভ মুখশ্রী— 
কী অপার্থিব অভব্যক্তি। 
ইহা কি সম্ভব যে 
এই মানুষী, 
এই বালিকা 
অথবা এই ক্লিষ্ট দেবদূতী 
(কারণ ওকে কী নামে অভিহিত করব তা আমার জানা নাই)— 
এও কি সম্ভব যে সে দ্বৈতপ্রকৃতির— 
এত শান্ত— 
এত নিরুদ্বেগ!

এখন আমি অনুভব করতে পারছি তার দেহের উত্তাপ 
এবং গন্ধ পাচ্ছি তার ভেজা ঘন কালো কেশগুচ্ছের।  
কী যেন এক অজানা শক্তির প্ররোচনায় হাত ওঠালাম — 
কম্পমান হাত— 
আমার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে— 
হাত রাখলাম ললাটে লুটানো অলকগুচ্ছে। 
আঙুল ছড়িয়ে দিলাম চুলের গভীরে— 
স্যাঁতসেঁতে ও শীতল— 
হীম— 
হিমশীতল— 
যেন মৃত—বেশ কয়দিন মৃত— 
বিভ্রমের অবকাশ নেই, নিশ্চিত মৃত— 
জামার নিচে হাত গলিয়ে অনুভব করলাম— 
সামান্যতম হৃদস্পন্দনও অনুভূত হলো না। 
নাসিকার সামনে আরশি রাখলাম— 
জীবনের ক্ষীণতম চিহ্নও অনুপস্থিত। 

শরীরের উত্তাপ দিয়ে আমি তাকে উষ্ণ করতে চাইলাম, 
নিজের সমস্ত উত্তাপ তার শরীরে সঞ্চালিত করে আমি গ্রহণ করতে চাইলাম 
মৃত্যুর হিম-শীতলতা— 
হয়তো এভাবেই তার শরীরে প্রবাহিত হতে পারে আমার অন্তরাত্মা। 
নিজেকে পরিচ্ছদ-মুক্ত করে তার পাশে শুয়ে পড়লাম— 
ম্যানড্রেক শিকড়ের মতোই জড়াজড়ি—সংযুক্ত। 
ওর শরীর যেন এক মাদী ম্যানড্রেক—যে ভালোবাসার আসক্ত আলিঙ্গন থেকে বিযুক্ত; 
তার শরীরময় উন্মাতাল ম্যানড্রেক-জাত গভীর আসক্তি; 
তার মুখগহ্বর শশার বোঁটা-প্রান্তের মতো ঝাঁঝালো ও তিক্ত। 
তার পরিপূর্ণ শরীর শিলাবৃষ্টির শিলার মতোই শীতল— 
আমার শিরায় যেন জমাট বেঁধেছে ফেনায়িত শোণিত— 
মনে হলো এক সর্বব্যাপী শৈত্য-প্রবাহ পৌঁছে গেছে আমার হৃদয়ের গভীরতম কন্দরে— 
বিফল আমার সমস্ত প্রচেষ্টা। 
বিছানা থেকে নেমে জামা পরলাম। 
না, এটা কোনো মায়া বা বিভ্রম নয়।  
সে সত্যিই এখানে, আমার ঘরে, আমার বিছানায় এসেছে— 
এবং সমর্পণ করেছে তার নশ্বর দেহ 
ও অবিনশ্বর জীবাত্মা।

এই নারীই বিষময় করেছে আমার আস্ত জীবন— 
অথবা জীবনের হেতুই হয়তো বিষময় হওয়া— 
অন্যরকম জীবন যাপন আমার জন্য সম্পূর্ণ আয়ত্ত —  
এখানে এখন এই ঘরে সে আমাকে সমর্পণ করেছে তার কায়া 
ও তার জীবাত্মার মায়ার ছায়া— 
তার ক্ষণস্থায়ী ঠুনকো আত্মা— 
যার সাথে সামান্যতমও কোনো পার্থিব সংশ্রব নেই— 
কুঁচি দেয়া কালো বসনের অন্তরাল থেকে প্রস্থান করেছে সে জীবাত্মা— 
দেহ তাকে শুধু যন্ত্রণাক্ত করেছে— 
সে এখন চরাচরে ঘুরে বেড়ানো বাউণ্ডুলে প্রচ্ছায়ার ভুবনে। 
হয়তো সে হাতিয়ে নিয়েছে আমার জীবাত্মাও। 
শুধু তার দেহ নিথর পরে আছে—প্রাণহীন—নিশ্চেতন। 
তার শিথিল পেশী, শিরা ও অস্থি ক্ষয়ের অপেক্ষায়— 
মৃত্তিকাগর্ভবাসী কীট আর ইঁদুরের জন্য উত্তম ভোজনোৎসব। 
এই জীর্ণ, দীন ও আনন্দহীন ঘর— 
গোরসদৃশ — 
অনন্ত অমানিশার ঘন তমসা যেন বিদ্ধ করেছে গোরের প্রাচীরগাত্র— 
শবের সান্নিধ্যে আমাকে যাপন করতে হবে এই কালো দীর্ঘ রাত— 
তার শবের সান্নিধ্যে— 
যতদিন আমি আছি, যতদিন পৃথিবী আছে— 
মনে হলো আমি, আর এই অনুভবহীন নিশ্চল শব— 
এই অন্ধ প্রকোষ্টে আমরা সমান্তরাল।

আমার চিন্তন তখন ভোঁতা। 
এক অনন্যসাধারণ সত্তার জন্ম হলো আমার অভ্যন্তরে। 
আমার আত্মা যেন চৌদিকের সমস্ত জীবাত্মার সাথে সংযুক্ত— 
চৌদিকের সমস্ত কম্পমান প্রচ্ছায়া ও মায়ার সাথে গ্রন্থিবদ্ধ। 
এক অলঙ্ঘনীয় ও অতীব অন্তরঙ্গ সুতায় আমি যুক্ত হয়েছি 
বাইরের সর্বময় প্রাণী ও প্রকৃতির সাথে— 
এক জটিল পরিবাহী পদার্থ যেন আমাকে গভীরভাবে ব্যাপৃত করেছে 
প্রকৃতির সকল শক্তির সাথে— 
যেকোনো ভাব ও ধারণা আমার মননে আজ অসংগতিপূর্ণ মনে হচ্ছে না। 
আমি খুব সহজেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি চিত্রকরদের গূঢ় কৌশল— 
দুর্জ্ঞেয় দর্শনের রহস্য— 
প্রাচীন শ্রেণি ও বিন্যাসের মূর্খতা। 
সেই একক মুহূর্তে আমার অন্তর প্রসারিত :
 
স্বর্গ-মর্ত্যের আবর্তন রহস্যে, 
বৃক্ষ-বীজের অঙ্কুরোদগমে, 
জীবজগতের অনির্দিষ্ট চলাচলে। 
ভূত ও অনাগত, 
অদূর ও অতিদূর 
যেন আমার আত্মায় জড়াজড়ি 
ও জায়মান। 

এইরূপ সময়সন্ধিতে 
সকলেই তাদের নিজস্ব প্রিয় অভ্যাসের আতুরাশ্রমে আশ্রয় খোঁজে; 
মদ্যপ মাতাল হয়; 
যে গ্রন্থকার—সে লিখে; 
ভাস্কর খোদাই করে প্রস্তর। 
আক্রান্ত হৃদয়ের ভার লাঘবের এই প্রক্রিয়ায় 
অকৃত্রিম ও নিপট শিল্পী নির্মাণ করে তার শ্রেষ্ঠতম শিল্পকর্ম। 
আমি একান্তই প্রতিভাহীন ও অসহায়— 
কলমের খাপের ছবি-আঁকা সামান্য চিত্রকর— 
কী আর করতে পারি আমি? 
ঐসব শূন্যগর্ভ, চকচকে ও অন্তরাত্মাহীন— 
সতত অভিন্ন চিত্রপট— 
কী আমি আঁকতে পারি যা হতে পারে শ্বাশত ও উত্তীর্ণ— 
আমার ভেতরে কি সে সংগতি আছে? 
কূলপ্লাবী উদ্বেল হৃদয়— 
অবর্ণনীয় ও অব্যক্ত প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ— 

নিয়ত-নিমীলিত তার দুচোখের ছবি 
কাগজে ধরে রাখার ইচ্ছে হলো। 
এবং এই ইচ্ছার প্রবল চৈতন্যমগ্নতা আমাকে প্ররোচিত করল— 
অপ্রতিরুদ্ধ সে ইচ্ছা— 
শবের সাথে ঘরবন্দি শিল্পী— 
আমার চৈতন্যে এক ধরনের পরমানন্দের বিকাশ অনুভূত হলো। 

অবশেষে কালিমাখা প্রদীপ নিভিয়ে 
তার শিয়রে একজোড়া মোমবাতি জ্বালালাম— 
মোমবাতির দপদপ ঝিকিমিকিতে 
তার অবয়বে এক ধরনের প্রশান্তি নেমে এলো— 
আলো-আঁধারির মায়ায় তার মুখশ্রীতে ফুটে উঠল বায়বীয় ও বোধাতীত অভিব্যক্তি— 
ছবি আকার কাগজ আর রং-তুলি হাতে নিয়ে বিছানার পাশে গেলাম— 
এই বিছানা এখন থেকে তার বিছানা— 
ঠিক করলাম ধীরে সময় নিয়ে আমি এই অবয়বের প্রতিটি রেখা কাগজে এঁকে রাখব— 
যে অবয়ব অনিবার্য নিশ্চয়তায় ক্রম-ক্ষয়মান অনন্তর শূন্যতায়— 
আপাতনিথর এই আননে অনন্যসাধারণের দ্যোতনা— 
পটে সেইসব রৈখিক স্ফুরণ চাই—যা আমাকে প্রণীত করেছে। 
সরল বা সংক্ষিপ্ত হলেও— 
পটে থাকতে হবে তার নিজস্ব প্রতীতি ও সত্তা— 
কিন্তু আমি তো কলমের খাপের গতানুগতিক ছবি-আঁকা অভ্যস্ত পটুয়া— 
আমাকে এখন চিন্তা করতে হবে, 
মুখের রূপ-কল্পনার জন্য অলীক কল্পনায় বোধ হতে হবে— 
এক পলকের দৃষ্টিপাত— 
তারপর চোখ বুজে ছবিতে 
‘আমার মনের মাধুরী মিশায়ে’ 
রেখার পর রেখার সংযোগ— 
আঁকতে আঁকতে আমি সেই আফিমের খোঁজে 
যা স্বস্তি দিবে আমার পীড়িত আত্মাকে— 
এবং অবশেষে আশ্রয় খুঁজি 
রেখা আর মূর্ত বিন্যাসের এক নিথর ভুবনে। 

আমার চিত্রকর্মের বিষয় মৃত নারী— 
একটা অদ্ভুত নৈকট্য আছে— 
আমি তো আসলেই মৃত মানুষের ছবি আঁকিয়ে বই কিছু নয়। 
এখন আমার প্রধান জিজ্ঞাসা : 

ওর উন্মিলিত চোখ চাহনি দেখা কি আবশ্যক— 
যে চোখ চির নিমীলিত? 
অথবা তা কি ইতোমধ্যেই আমার হৃদয়ে যথেষ্ট স্বচ্ছতা নিয়ে ভাত?
রাতভর জানি না কতবার এঁকেছি— 
ফিরে ফিরে এঁকেছি তার একই মুখের প্রতিকৃতি— 
হৃদয় ভরেনি—
না, এঁকেছি আর ছিড়েছি — 
অবিশ্রান্ত — 
ভ্রুক্ষেপহীন সময় ক্ষেপণে। 

ফিকে হয়ে আসছে রাতের তমসা— 
জানালার শার্সি গলিয়ে ঘরে থুবড়ে পড়ল এক ফালি ধূসর আলো। 
আমি নতুন করে আঁকা ছবি নিয়ে মগ্ন—উত্তম—কিন্তু চোখ? 
কোথায় সেই অনুযোগ-ভরা চোখের ব্যঞ্জন— 
যেন অ-ক্ষমার্হ কোনো অধর্ম-কর্মে কলুষিত— 
আমি তা কোনোভাবেই ফোটাতে পারছি না আমার অক্ষম অঙ্কনে। 
সে চোখের স্বরূপ যেন আমার স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত। 
বৃথা অকিঞ্চন। 
হাজার নিরীক্ষণেও খুঁজে পাচ্ছি না তার চোখের সঠিক 
দ্যোতনা। 

সহসা তার কপোলে সঞ্চারিত হলো প্রাণের উদ্ভাস— 
গাঢ় লালচে বাদামি অর্চি— 
কসাইখানায় ঝুলে থাকা মাংসের রঙে রং— 
আর তার বিস্ময়কর খোলা আয়ত নেত্র— 
যে চোখে ভর করেছে প্রাণশক্তির তাবৎ প্রভা— 
যে জ্বলজ্বল করছে কী যেন এক অসুস্থ আলোয়— 
ক্লিষ্ট তিরস্কার-ভরা চোখ উন্মিলিত হলো ধীরে— 
অতি ধীরে— 
এবং চেয়ে দেখল আমাকে— 
এই প্রথম আমি তার চেতনায় বর্তমান— 
এই প্রথম আমি তার দৃষ্টিতে গোচর— 
অতঃপর আবার নিমীলিত নয়ন। 

হয়তো ক্ষণিকের ঘটনা— 
কিন্তু আমার শিল্পীসত্তার জন্য ছিল যথেষ্ট— 
তার চোখের গূঢ় অভিব্যক্তি স্বরণে গেঁথে গেল— 
আমি আঁকলাম। 
তুলির টানে আমি তুলে আনলাম মঞ্জরিত ব্যঞ্জনা— 
এবং এবার আর ছবি ছিঁড়ে ফেলার গভীর প্রয়োজন অনুভব করলাম না। 

তারপর উঠে দাঁড়ালাম। 
সন্তর্পণে তার বিছানার সন্নিহিত। 
প্রাণময়— 
সে ফিরে এসেছে জীবনের কাছে, সে আমারই প্রেমের প্রবল আসঙ্গে— 
আমার প্রেম তার মৃত কায়ায় সঞ্চার করেছে চেতনা। 
কিন্তু ঘন নৈকট্য থেকে আমি মৃত-গন্ধের আভাস পাচ্ছি— 
গন্ধ পাচ্ছি ক্রমশ পচনের। 
কিলবিল করছে কীট— 
মোমবাতির আলোয় চক্কর দিচ্ছে সবুজাভ মাছির দঙ্গল। 
ও যথেষ্ট মৃত। 
তবে কেন এবং কেমনে উন্মিলিত হলো ওই বিস্ময়কর দুই আঁখি? 
সত্য না আমার দৃষ্টির বিভ্রম—

এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না করলেই বাধিত হব। 
কিন্তু মুখ্য উপজীব্য ছিল তাঁর মুখমায়া— 
নাহ, মুখমায়া নয়— 
বরং নয়ন তারা— 
আর সে তো এখন আমার পূর্ণ অধিকারে— 
পটের অঙ্কনে আমি বন্দি করেছি তার কনীনিকা— 
দেহের প্রয়োজন এবার ফুরিয়েছে— 
অবধারিত ক্ষয় যে দেহের নিয়তি— 
যে দেহ কুরে কুরে খাবে কবরের কিলবিল পোকা আর ধেড়ে ইঁদুর। 
এখন থেকে আমিই প্রধান— 
আমি তার প্রভাবমুক্ত।  
ইচ্ছে হলেই আমি ভোগ করতে পারব তার আঁখির আলো। 
যতটুকু সম্ভব যত্নসহকারে আমি ছবিটা ওঠালাম— 
রাখলাম টিনের বাক্সে যে বাক্সে থাকে আমার অর্থ ও মূল্যবান সম্পত্তিসমূহ— 
তারপর তুলে রাখলাম ঘরের পিছনে রাখা আলমিরায়। 

অতি সন্তর্পণে—মৃদুপদে—যামিনী বহমান। 
যামিনী যেন অনেক ক্লেদ ও ক্ষয় স্খলন করে এবার যাবার জন্য তৈরি। 
ভেসে আসছে দূরবর্তী ক্ষীণ শব্দ— 
অঙ্কুরিত ঘাসের শব্দের মতো 
অথবা স্বপ্নডানায় উড্ডীন পরিযায়ী পাখির শূন্যধাবন শব্দের মতো— 
বিবর্ণ নক্ষত্ররাজি ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে মেঘের আড়ালে। 
প্রভাতের মৃদু শ্বসন আমার মুখে প্রতিভাত হলে 
দূরে কোথাও ডেকে উঠল ভোরের মোরগ। 

ইতোমধ্যেই বিযোজিত, 
এ লাশ আমি কোথায় রাখব? 
প্রথমে ঘরের ভিতরেই সমাহিত করার কথা ভাবলাম— 
টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে কালশিটে-নীল কলমি শোভিত কোনো ঝরনায় ফেলার চেয়ে ঘরেই ভালো—কিন্তু সকলের সম্পূর্ণ অগোচরে এ কাজের নিমিত্ত যথেষ্ট পরিকল্পনা, প্রয়াস ও নৈপুণ্যের প্রয়োজন! তার ওপর আমি চাই না অবাঞ্ছিত কারও নজর তার ওপর এসে পড়ুক— 

সবকিছু আমাকে নিজহাতে করতে হবে—তাতে কী আসে যায়? 
ওকে ছাড়া আমার জীবনের কি অন্য কোনো হেতু আছে? না, কদাচ না— 
আমার দৃষ্টি  ছাড়া আর কোনো ব্রাত্য-দৃষ্টি যেন না পড়ে তার জীবাত্মাশূন্য দেহের ওপর। 
সে আমার ঘরে এসেছে এবং আমার কাছে সমর্পণ করেছে তার নিথর শরীর ও ছায়া— 
যাতে সে আর কারও নজরে না পড়তে পারে— 
যাতে সে কলুষিত না হয় অবাঞ্ছিত দৃষ্টিপাতে। 

অবশেষে মাথায় এক বুদ্ধি এলো— 
যদি তার পার্থিব শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে আমার পুরানো স্যুটকেসে পুরে— 
লোকচক্ষুর অন্তরালে— 
বহু বহু দূরে— 
কোথাও সমাহিত করি— 

এবার আর কোনো দ্বিধা নেই। 
ঘরের পিছনে রাখা ক্লোসেট থেকে অস্থি-হাতল ছোরা আনলাম। 
অতি মোলায়েম যে কালো আবরণ তাকে ঊর্ণনাভ জালের মতো জড়িয়ে আছে—  
অতি সন্তর্পণে  তা ছিন্ন করলাম প্রথম। 
এটাই ছিল তার একমাত্র আবর— 
মনে হলো ওর শরীর যেন আরেকটু পূর্ণতাপ্রাপ্ত—আরেকটু দিঘল। 
তারপর মুক্ত করলাম মস্তক— 
গ্রীবা থেকে ঝরে পড়ল কিছু জমাট-হীম রক্ত।  
তারপর তার বাহু, ঊরু ও পা— 
তারপর খুব সুচারুভাবে তার শরীরাংশগুলো স্যুটকেসে রাখলাম 
এবং তার পরিচ্ছদ—সেই একই মোলায়েম কালো আবরণ—দিয়ে ঢেকে স্যুটকেসে তালা দিয়ে চাবি পকেটে নিলাম।
কাজ শেষ হলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে স্যুটকেসের ওজন দেখলাম। 
অনেক ভারী। এক প্রবল ক্লান্তি আমাকে পেয়ে বসলো— 
নাহঃ — এ স্যুটকেস বহনের শক্তি আমার নেই। 

ঘোমটা আবহাওয়া। 
কুয়াশা—সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। 
স্যুটকেস বহন করতে সাহায্য করবে এমন কাউকে খুঁজতে বের হলাম। 
কেউ নেই। আরও খুঁজলাম। 
হঠাৎ দেখলাম এক কুঁজো বুড়ো একটু দূরে সাইপ্রেস বৃক্ষের নিচে বসে আছে কুয়াশায়। 
কণ্ঠে জড়ানো বিস্তীর্ণ উত্তরীয়— 
গোচরে আসছে না তার মুখের নির্ণয়।
ধীর পায়ে গেলাম তার পাশে। 
আমি কিছু বলার আগেই কুঁজো বুড়ো ফেটে পড়ল শূন্যগর্ভ, কর্কশ ও অশুভ অট্টহাস্যে— 
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল— 
বলল, 
‘তোমার যদি মুটের প্রয়োজন হয়—বান্দা হাজির। 
আর হ্যাঁ, লাশ বহনের যানও আছে। 
প্রতিদিনই আমি শাহ আব্দুল আজিমে লাশ নিয়ে যাই, সমাহিত করি। 
শবাধারও তৈরি করি— 
যেকোনো মাপের— 
চুল পর্যন্ত নিখুঁত মাপের— 
প্রস্তুত— 
এক্ষুনি।’

আবার নিনাদিত হাসি— 
হাসির তোড়ে কম্পিত স্কন্ধ। 
আমি আমার ঘরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলাম; 
আমাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই বললো, 
‘থাকে গে, কিছু বলতে হবে না।  
আমি জানি তুমি কোথায় থাকো।  
আমি এক্ষুনি আসছি।’

ও উঠে দাঁড়াল।  
আমি ঘরে ফিরলাম। 
শোবার কক্ষ থেকে শব-সংবলিত স্যুটকেস কষ্টেসৃষ্টে দুয়ারের চৌকাঠের কাছে নিয়ে এলাম। চোকাঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম কঙ্কালসার একজোড়া ঘোড়ার সাথে জুড়া 
অতি জীর্ণ শবশকট । 
হাতে দীর্ঘ ছড়ি—কুঁজো বুড়ো বসেছে চালকের আসনে। 
আমার দিকে চেয়েও দেখল না। 
কোনোমতে স্যুটকেস শকটে উঠিয়ে 
লাশ বহনের নির্দিষ্ট নিচু ক্ষেত্রে স্থাপন করে আমিও উঠে পড়লাম। 

পথযাত্রার দৃশ্যাবলি দেখার জন্য সরু তাকের ওপর মাথা রেখে  
শুয়ে পড়লাম লাশের পাশে— 
তারপর স্যুটকেস বুকের কাছে টেনে এনে দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম।

হাওয়ায় চাবুকের শব্দ— 
ঘোড়া ছুটছে মৃদুগামী দীর্ঘ কদমে— 
সঘন শ্বসন— 
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি— 
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে অশ্ব-নাসিকা-উত্থিত ধূম্র হাওয়া। 
ওদের কৃশ পা— 
তস্করের ফুটন্ত তেলে ডোবানো কর্তিত করাঙ্গুলির মতো— 
উঠছে অতিমন্থরে— 
আবার নেমে আসছে মৃত্তিকায়, অরবে। 
গলায় ঝুলানো ঝুনঝুনির শব্দ 
পরিব্যাপ্ত স্যাঁতসেঁতে বাতাসের সাথে মিশে তৈরি করেছে 
এক অদ্ভুত ঐকতানের। 
এক অকারণ ও অনির্বচনীয় স্বস্তিতে আমি নিষিক্ত হলাম আপাদমস্তক— 
শকটের চলার ঝাঁকুনিতে আমার পাকস্থলির তরল সামান্যতমও তরঙ্গায়িত হলো না। 
বুকের পাঁজরে শব-সংবলিত স্যুটকেসের বোঝাই শুধু অনুভূত হচ্ছে। 
তার দেহের— 
তার মৃত দেহের গুরুভার যেন নিয়ত নিপীড়ন করছে আমার বুকের আকর।  

ঘন কুয়াশায় আবৃত পথ। 
শব-শকট বিস্ময়কর দ্রুততা ও স্বাচ্ছন্দ্যে পার হয়ে যাচ্ছে পাহাড়, সমতল 
ও বিবিধ পয়স্বিনী। 
জাগরণে বা স্বপনে যা কখনো দেখিনি 
এমনি এক নবতর ও অপ্রতিম ভূদৃশ্য উন্মোচিত হলো আমার প্রেক্ষিতে। 
বন্ধুর পাহাড়। 
রাস্তার দুপাশে অবিদিত, রোগাতুর উর্বিরূহ—অভিশপ্ত। 
দৃশ্যমান ধূসর গৃহ— 
ত্রিভুজাকার, ঘনাকার অথবা প্রিজমাকার— 
হোঁতকা, অন্ধকার ও আয়নাহীন বাতায়ন— 
জ্বরতপ্ত বিকার-ক্লান্ত চোখের মতোই এইসব বাতায়ন। 
জানি না কী দিয়ে নির্মিত হয়েছে এইসব গৃহের প্রাচীর— 
হৃদয়ে সহসাই ভীতি জাগানিয়া। 
এ গৃহ যেন প্রাণময় জীবের জন্য নয়— 
হয়তো এ গৃহের নির্মাণ বায়বীয় অপচ্ছায়ার নিমিত্ত।

বাহ্যত চালক প্রবর কোনো উপপথ অথবা নিজস্ব কোনো যাত্রাপথ ধরে যাচ্ছিল— 
কোনো কোনো স্থানে দুপাশ জুড়ে শুধুই তরু-কাণ্ড 
এবং বিকৃত/মোচড়ানো তরুবীথি — 
অতিক্রান্ত অনতিদূরে গৃহসমূহ— 
কোনটা হোঁতকা মোটা, কোনোটা উন্নতকায়— 
জ্যামিতিক— 
নিখুঁত অথবা ভোঁতা মোচাকৃতি — 
বাতায়ন সংকীর্ণ ও বাঁকাচোরা। 
কলমির কালশিটে নীল ফুল বাতায়ন থেকে নেমে এসে 
জড়িয়ে আছে প্রাকারে ও দুয়ারে। 
তারপর সহসাই দৃশ্যপট অদৃশ্য হলো গাঢ় কুজ্বটিকার 
নিগূঢ় অন্তরালে।

জলভরা ভারী মেঘ পাহাড়ের চূড়া আচ্ছন্ন করে নেমে এলো। 
হাওয়ার তোড়ে মিহি বৃষ্টি-বিন্দু তাড়িত ধূলির মতো অকারণ ছোটাছুটিতে মাতোয়ারা। 
অনেকক্ষণ পর শব-শকট এক ঊষর পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামল— 
সবুজের ছিটেফুটোও নেই। 
স্যুটকেস বুকের কাছ থেকে সরিয়ে নেমে পড়লাম। 

পাহাড়ের অপরপাশে এক টুকরো শান্ত সবুজ নিরালা জমি— 
কখনো দেখিনি তবুও কেমন চেনা চেনা— 
যেন আমার হৃদয়ের আরশিতে সতত উপাগত। 
গন্ধহীন কলমির নীল লতায় আবৃত। 
মনে হলো অদ্যাবধি মানুষ্য পদচিহ্নরহিত। 
স্যুটকেস নামিয়ে ভূমিতে রাখলাম। 
বুড়ো কুঁজো শকট চালক মুখ ঘুরিয়ে বলল, 

‘আমরা শাহ আব্দুল আজিম থেকে খুব দূরে নই। 
তোমার প্রয়োজনের নিমিত্ত এর থেকে উত্তম জায়গা আর কোথাও পাবে না। 
খেঁচরও চরে না এই শূন্য তল্লাটে— 
নাহ।’ 

চালককে তার পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য পকেটে হাত দিলাম। 
পকেটে মাত্র দুই গেরান আর এক আব্বাসী। 
চালক শূন্যগর্ভ ও কর্কশ হাস্যে ফেটে পড়ে বলল,

‘ঠিক আছে। 
এ নিয়ে ভাবতে হবে না। 
আমি পরে নেব। 
আমি তোমার ঠিকানা জানি। 
আর কিছু কি করতে হবে? 
আমি কবর খননও করতে পারি। 
পারদর্শী না, তাতে কি—এতে লজ্জার কিছু নাই। 
চলো, ওই নদীর তীরে সাইপ্রেস ছায়ায়— 
তোমার স্যুটকেসের মাপে একটা গর্ত খুঁড়ে দেই— 
তারপর আমি খালাস।”

বুড়োটা লাফ দিয়ে নামল তার আসন থেকে— 
এত দ্রুত যে আমি ভাবতেও পারিনি। 
আমি স্যুটকেস হাতে। 
হাঁটতে হাঁটতে একটা শুষ্ক নদীগর্ভে এক মৃত বৃক্ষের কাছে এলে সে বলল,

‘উত্তম ক্ষেত্র’

উত্তরের অপেক্ষা না করে সে একটা ছোট্ট কোদাল আর শাবল নিয়ে খুঁড়তে শুরু করল। স্যুটকেস নামিয়ে রেখে বোধহীন জাড্যতায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। 
অতিরিক্তভাবে কুঁজো হয়ে পেশাদারি নৈপুণ্যে সে কাজ করে চলল। 
খুঁড়তে খুঁড়তে চকচকে ঘড়ার এক পাত্র বেরিয়ে এলো। 
ঘড়াটা একটা ময়লা রুমালে মুড়িয়ে সে বলল, 
‘এই নাও তোমার গর্ত, 
স্যুটকেসের জন্য যথাযথ আকার ও আয়তন— 
হ্যাঁ।’

চালককে তার পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য পকেটে হাত দিলাম। 
পকেটে মাত্র দুই গেরান আর এক আব্বাসী। 
চালক শূন্যগর্ভ ও কর্কশ হাস্যে ফেটে পড়ে বলল,

‘ঠিক আছে। 
এ নিয়ে ভাবতে হবে না। 
পরে নেব। 
আমি তোমার ঠিকানা জানি। 
উপরন্তু আমি এই ঘড়াটা পেয়েছি। 
এতেই চলবে। 
এ একটা রাজেহ ফুলদানি; 
প্রাচীন রে নগরী থেকে এসেছে। 
হ্যাঁ।’ 

বক্র নুয়ে-পড়া— 
দাঁড়িয়ে আবার সে অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ল, 
তার দুই স্কন্ধ কম্পিত। 
ঘড়াটি ময়লা রুমালে মুড়িয়ে বগলদাবা করে শবশকটের  দিকে পা বাড়াল। 
অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সে চালকের আসনে লাফিয়ে উঠে বসল। 
বাতাসে চাবুকের স্বনন—
ছুটল ঘোটক— 
নাসিকায় ঘন নিশ্বাস। 
সোঁদা বাতাসে গলার ঘণ্টায় বাজলো অদ্ভুত ঐকসুর। 
ক্রমে ক্রমে তারা মিলিয়ে গেল ঘন কুয়াশার অন্তরালে। 

একলা হওয়ার সাথে সাথে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম; 
যেন এক দুর্বহ গুরুভার নেমে এসেছে বক্ষস্থল হতে— 
এবং এক বিস্ময়কর বোধ বিহ্বল করেছে আপাদমস্তক আমার সমস্ত সত্তা। 
চারদিকে চেয়ে দেখলাম। 
যে ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি তার প্রান্ত ঘিরে কেবলি কালো পাহাড় 
ও ছোট ছোট টিলার সমাহার। 
শৈলশ্রেণি জুড়ে প্রচুর প্রাচীন ভগ্নাবশেষ ও ভারী ইটের স্থাপনা— 
অদূরে জলশূন্য নদীগর্ভ— 
এ এক দূরবর্তী আরামপ্রদ শান্তি-নিলয়। 
হৃদয়ে এক গভীর আনন্দ নেমে এলো—
যখন ওই দুটো ডাগর আঁখি ঐহিক নিদ্রা থেকে জেগে উঠবে; 
দেখবে তার নতুন আলোয় প্রকৃতি ও স্বভাবের জন্য যথোপযুক্ত ও সমন্বয়পূর্ণ। 
অধিকন্তু ইহলোকে সে যেমন অন্যান্য জীবলোক থেকে পৃথক ছিল; 
ঠিক সেভাবে মরণের ওপারেও সে থাকতে পারবে জীবিত ও মৃত 
সকল মনুষ্যকুল থেকে তফাতে। 

যত্নসহকারে স্যুটকেস উঠিয়ে গর্তে রাখলাম— 
যথাযত আয়তন, তিল পরিমাণ ব্যত্যয় নেই। 
শেষবারের জন্য আবার সুটকেসের ভিতর দেখতে চাইলাম। 
জনশূন্য চৌদিক। 
পকেট থেকে চাবি খুলে স্যুটকেস খুললাম— 
কালো জামার কোনো সরাতেই দেখতে পেলাম জমাট বাঁধা রক্ত 
আর কিলবিল কীটের প্রেক্ষিতে ভাত দুই ডাগর আঁখির 
অভিব্যক্তিহীন নিস্পলক দৃষ্টি। 
ত্বরায় স্যুটকেসের ডালা বন্ধ করে আলগা মাটি দিয়ে ঢেকে দিলাম। 
তারপর ধামসানো মাটির চারদিকে রোপণ করলাম 
সৌরভহীন কিছু কালশিটে নীল কলমির চারা। 
তারপর বালি আর নুড়ি নিয়ে এসে এমনভাবে ছড়িয়ে দিলাম 
যাতে কবরের চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে অগোচর হয়। 
এতই ভালোভাবে কাজটা সম্পন্ন হয়েছে যে 
আমি নিজেই কবর থেকে অন্য জমির পার্থক্য বুঝতে পারছি না। 

কাজ শেষ হলে নিজের দিকে নজর দিলাম। 
কর্দমাক্ত ছিন্ন জামা; 
ছোপ ছোপ জমাট কালো রক্ত; 
ভোঁ ভোঁ করে পাক খাচ্ছে এক জোড়া সবুজাভ মাছি; 
কিলবিলে জামায় লেগে থাকা কীট— 
জামা থেকে রক্তের দাগ মুছতে চাইলাম; 
থুথু দিয়ে মুছতে যতই চেষ্টা করি, ততই গাঢ় হয়ে ফুটে ওঠে রক্তের রং; 
অনন্তর শরীরময় ছড়িয়ে গেল এই রক্তের ছোঁয়া; 
সর্বত্র একটা শীতল চটচটে অনুভবে আমি আর্ত হলাম। 

প্রায় সন্ধ্যা, হালকা বৃষ্টি, 
আপনার অজান্তে শবযানের চাকার চিহ্ন ধরে হাঁটছি। 
অন্ধকার সমাগমে শবযানের চিহ্ন হারালাম। 
গভীর ঘন অন্ধকার ভেঙে ধীরে পথ চলছি— 
গন্তব্যহীন; উদ্দেশ্যহীন, অবচেতন— 
জানি না যাত্রা কোথায়— 
তাকে হারানোর পর— 
জমাট রক্তে ভাসা বিশালাক্ষী স্থির দৃষ্টি— 
অন্ধ তিমিরে একাকী ভ্রমণ— 
নিবিড় গভীর তিমিরে— 
ওই পথ-আলো-করা দুটো আঁখি— 
এখন চিরতরে নির্বাপিত— 
এবং এক্ষেত্রে এই আমি— 
আমি কি কোথাও পৌঁছতে পারব,  
না পারব না।

সর্বত্র নিপাট সুনসান। 
মনে হচ্ছে আমি মনুষ্য-পরিত্যক্ত। 
জড়ো প্রকৃতিই আমার অবলম্বন। 
বস্তু-বিশ্বের স্পন্দন ও আমার আত্মায় অবতীর্ণ গভীরতম তমসার সাথে 
আমার কী যেন এক যোগসূত্র আছে।
নীরবতাও যে এক ধরনের উচ্চারিত ভাষা যা আমাদের বোধের অতীত।  
এক ধরনের মাদহোস আনন্দে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। 
দুর্বল জানু—
বিবমিষা— 
অন্তহীন ক্লান্তি এসে বাসা বাঁধল শরীরে। 
পথের পাশের কবরস্থানে গিয়ে বসলাম এক সমাধি-প্রস্তরের ওপরে। 
দুহাতে মাথা চেপে ধরে ভাবতে চেষ্টা করলাম আমার চিন্তার বর্তমান অবস্থান। 
সহসাই এক শুষ্ক ও কর্কশ উচ্চ হাসিতে সংবিৎ ফিরে এলো। 
মাথা ঘোরাতেই চোখে পড়ল এক মানব-অবয়ব— 
প্রবরণে ঢাকা আনন—রুমালে মোড়ানো কিছু একটা হাতে; 
বলল,

‘নিশ্চয়ই নগরে যেতে চাও, 
কিন্তু মোক্ষম পথহারা, হ্যাঁ।
হয়তো ভাবছ, রাতের এই প্রহরে আমি এখানে কী করছি—কবরস্থানে— 
ভয় পেয়ো না— 
মৃতের সাথেই আমার কারবার— 
আমি মুর্দাফরাস— 
কবর খুঁড়ি— 
নেহায়েত মন্দ কাজ না—হ্যাঁ? 
এই জায়গার প্রতিটি অলি গলি খানা খন্দক আমার হাতের পাতায়— 
আজকেই আমি কবর খুঁড়তে গিয়ে এই ঘড়াটি পেয়েছি। 
তুমি জানো,  এ একটা রাজেহ ফুলদানি; প্রাচীন রে নগরী থেকে এসেছে— 
হ্যাঁ। তুমি এটা নাও, 
এমন কিছুই না। 
আমি তোমাকে ঘড়াটি দিচ্ছি যাতে তুমি আমাকে স্মরণ করতে পারো।’

পকেটে হাত দিয়ে দুই গেরান আর এক আব্বাসী বের করলাম। 
লোম খাড়া হওয়া শূন্যগর্ভ শুষ্ক হাসি হেসে সে বলল,

‘না, না।  এটা কিছু না। 
আমি তোমাকে চিনি। 
কোথায় থাকো—তাও জানি— 
আমার শববাহী শকট কাছেই আছে। 
আসো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই— 
এই তো দুপা এগুলেই।’ 

আমার কোলে ঘড়া রেখে সে দাঁড়াল—হাসির তোড়ে কম্পমান স্কন্ধ। 
ঘড়া তুলে নিয়ে আমি বুড়োর কুঁজো ছায়ার পিছন পিছন। 
রাস্তার বাঁকে কৃশকায় দুই কালো ঘোড়ায় জোড়া এক নড়বড়ে শবযান। 
অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় লম্ফো দিয়ে সে আসনে বসল। 
আমি শকটে উঠে শবাধার রাখার নিচু জায়গায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে মাথা রাখলাম উঁচু তাকে যাতে বাইরের দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। 
ঘড়া বুকের ওপর রেখে হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। 

হাওয়ায় চাবুকের শব্দ; 
ঘোড়া ছুটছে; ঘন নিশ্বাস। 
পূর্ণ ও স্বাচ্ছন্দ্য কদমে ছুটছে— 
পায়ের খুর ভূমি স্পর্শ করছে আলতো নিঃশব্দতায়। 
গ্রীবায় ঝুলানো ঘণ্টার ধ্বনি ভ্যাপসা বাতাসে মিশে তৈরি করেছে এক অনাসৃষ্টি সুরের। 
মেঘের ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান নক্ষত্র যেন জমাট রক্ত হতে উত্থিত 
আলোকোজ্জ্বল চক্ষুর মতো তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। 
এক বিস্ময়কর অনুভব ব্যাপ্ত হলো আমার সমুদয় সত্তায়। 
বুকে চেপে আছে মৃত দেহের মতো গুরুভার ঘড়া। 
যূথবদ্ধ তরুরাজি তাদের পাকানো মোচড়ানো শাখা প্রশাখা দিয়ে 
একে অন্যকে জড়িয়ে জড়িয়ে তমসায় দাঁড়িয়ে— 
অন্যতায় তারা যেন থুবড়ে পড়বে ভূতলে। 
রাস্তার দুপাশে ছমছমে গৃহের সারি— 
টুকরো টুকরো জ্যামিতিক ঢং— 
পরিত্যক্ত কৃষ্ণ বাতায়ন। 
গৃহের দেয়ালগুলো জোনাকির মতো আবছা এক ধরনের অসুস্থ অর্চি ছড়াচ্ছে। 
ভীতিপ্রদভাবে বিন্যস্ত বৃক্ষরাজি অলক্ষে পিছু হটছে সারে সারে ঝোপে ঝোপে— 
অথচ মনে হচ্ছে পাদপ-পদ যেন কলমি লতার বিজড়িত জটে জট পাকিয়ে ন্যুজ্ব। 
মৃত্যুর গন্ধ ও পঁচা-গলা মাংসের গন্ধে আমার চৈতন্য অবদমিত। 
বোধ হচ্ছে আমি যেন জন্মাবধি মৃত-গন্ধে সুসিক্ত— 
সারাটা জীবন যেন শায়িত আছি কোনো অসিতবর্ণ শবাধারে, 
আর আমার চারপাশে এক কুঁজো বুড়ো— 
মুখাবয়ব যার চির-অগোচরে— 
আমাকে বহন করছে বৃত্ত থেকে বৃত্তে — 
প্রচ্ছায়া আর কুহেলিকার পাদটীকায়। 

শবযান থামল। 
ঘড়াটা তুলে লাফ দিয়ে নামলাম।
সামনেই গৃহ। 
ত্বরিতে গৃহে ঢুকে ঘড়াটা টেবিলে রেখে লুকানো টিনের বাক্স আনতে গেলাম ক্লোজেটে। 
টিনের বাক্স আসলে আমার সিন্দুক। 
অর্থের বদলে শবযানের বুড়ো চালককে আমি এই সিন্দুকটি দিতে দুয়ারে গিয়ে দেখি সে সম্পূর্ণ লাপাত্তা— 
চালকের বা শবযানের সামান্যতম চিহ্নও নেই— 
আরেকবারের মতো আমি বিমর্ষভাবে কামরায় ফিরে আলো জ্বালালাম, 
ঘড়া হতে জড়ানো রুমাল খুললাম, হাতের আস্তিনে মুছলাম ধুলোবালি। 
ঘড়ার গায়ে ম্লান হয়ে যাওয়া স্বচ্ছ বেগুনি প্রলেপ— 
যা এখন শুকিয়ে যাওয়া সবুজাভ মাছির গুঁড়োর মতো।
ঘড়ার পেটের একপাশ হিরোকাকৃতি— 
কালসিটে পড়া কলমিলতায় খচিত কিনার— 
এবং তার ভিতরে …

রুহিতনাকৃতি ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিকৃতি 
এক নারীর মুখাকৃতি— 
যার অক্ষিযুগল বিশাল ও কৃষ্ণবর্ণ— 
অস্বাভাবিক ও অসাধারণ— 
ভর্ৎসনা-পূর্ণ স্থির দৃষ্টি— 
যেন আমি কোনো অক্ষমার্হ অধর্ম করেছি— 
এখনো যা আমার নিজের কাছেই ব্যাখ্যাতীত।  
ভয়ঙ্কর অথচ মোহন— 
উত্কণ্ঠা ও বিস্ময়— 
আশ্বাস ও তরাশ— 
যুগপৎ ভীতিপ্রদ ও লোভনীয়— 
এক অতিপ্রাকৃত ও নেশা-জাগানিয়া রোশনাই বিচ্ছুরিত হচ্ছে 
সেই অক্ষিগোলকের অন্তঃস্থল থেকে—
উন্নত চোয়াল ও প্রশস্ত ললাট— 
চিকন ভুরু যা মধ্যবিন্দুতে এসে সংযুক্ত— 
পুরুষ্ট অধর অর্ধ অবারিত— 
বিস্রস্ত কেশগুচ্ছ— 
ললাটপার্শ্বে এলায়িত একটি কুন্তল।

পূর্ব রাতে আমি যে ছবিটি এঁকেছি তা টিনের বাক্স থেকে বের করে ঘড়ার পৃষ্টে অঙ্কিত ছবির সাথে মিলিয়ে দেখলাম। এক কণা পরিমাণ ফারাক নেই। যেন মুকুরে বিম্বিত বিপ্রতীপ। অবিকল। অভিন্ন। একই শিল্পীর কৃত—লেখনীর খাপের এক ভাগ্যহত অলংকারক। আমি যখন ছবিটি আঁকি, এই ঘড়ার চিত্রকরের আত্মা হয়তো ভর করেছিল আমার আত্মায়—চালিত করেছিল আমার পটুয়া পাণি। পার্থক্য করা অসম্ভব—শুধু আমার আঁকা চিত্র কাগজে আর ঘড়ায় আঁকা চিত্র আচ্ছাদিত এক অতি পুরাতন অচ্ছ প্রলেপে—যার জন্য তা পেয়েছে অতিপ্রাকৃত, উদ্ভট ও গুহ্য পরিবৃতি। 

চোখের গভীরতায় দুষ্ট দহনের স্ফুলিঙ্গ। 
না, এ বিশ্বাসের অতীত— 
সেই একই অনবহিত বিশাল চক্ষুদ্বয়, 
একই সাথে সংযত এবং অকুণ্ঠিত! 
আমার অভ্যন্তরে যে কী অনুভবের সঞ্চসার হয়েছিল তা অনুধাবন করা একান্তই দুরূহ। 
আমার আপনার থেকে পলাতক হতে ইচ্ছে হলো— 
এরকম সমাপতন কি বোধগম্য? 
জীবনের সকল হীনাবস্থা আবার ফিরে এলো আমার চোখের মুকুরে। 
একজনের দুই চক্ষুই কি আমার এক জীবনের জন্য যথেষ্ট ছিল না? 
এখন দুইজন আমার দিকে তাকাচ্ছে সেই একই চক্ষু থেকে— 
যে চক্ষু আসলে তারই চক্ষু! 

নাহ, এ অসহ— 
যে চোখ এই আমি নিজে প্রোথিত করেছি মৃত্তিকায়— 
পাহাড়ের সানুদেশে— 
শুষ্ক সাইপ্রেস সন্নিহিত শূন্যগর্ভ শৈবলিনী— 
কলমির নীল ফুল— 
থিকথিকে জমাট রক্ত— 
কিলবিল কীট— 
এবং ভোজন-উৎসব-মত্ত বিকৃতমূর্তি জীবের সান্নিধ্যে— 
এবং তরুমূল, 
যা এখন তার অক্ষিকোঠর ফুঁড়ে চোখের সমুদয় নির্যাস পানে উদ্বত—

সেই চোখ— 
দেখো টইটম্বুর জীবনীশক্তিতে তাকাচ্ছে অপলক— 
আমারি বরাবর। 

নিজেকে কখনো এত অভাগা ও অভিশপ্ত ভাবিনি আগে। 
অভ্যন্তরে লুক্কায়িত অপরাধবোধের মধ্যে থেকে হৃদয়ে জেগে উঠল 
এক অনির্বচনীয়ের আয়েশ। 
জানলাম আমার বিষাদেরও আছে এক প্রাচীন অংশভোগী। 
এই প্রাচীন পটুয়া যে শত শত— 
হয়তো সহস্র সহস্র বৎসর আগে— 
অলংকৃত করেছে এই ঘড়া— 
সে কি আমার সকল বিষাদের অংশভোগী নয়? 
সে কি আমারি মতো পারমার্থিক বোধের ভিতরে অবগাহন করেনি? 
অদ্যাবধি এককভাবে নিজেকেই সৃষ্টির সবচেয়ে দুর্ভাগা ভেবে কষ্ট পেয়েছি। 

এখন আমার প্রতীতি সিদ্ধ। 
উপলব্ধি করেছি—  
এইসব শৈল-কন্দরে— 
এইসব কাদা-নির্মিত পরিত্যক্ত দেহাত গৃহে বসত করত এক প্রাচীন জনগোষ্ঠী।  
তাদের অস্থি ক্ষয়িত— 
তাদের শরীরের অণু এখনো প্রবহমান কালসিটে পড়া কলমির ধমনি ও শিরায়— 
সেই জনগোষ্ঠীতে বাস করত এক দুর্ভাগা পটুয়া— 
এক অভিশপ্ত পটুয়া— 
হয়তো সেখানে ছিল— 
আমারি মতন এক বেচারা— 
লেখনীর-খাপে-ছবি-আঁকা পটুয়া— 
অবিকল আমারি মতো 

এখন বুঝতে পারছি—পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারছি যে—
সেও ঠিক আমারি মতো 
দুই কৃষ্ণ-কালো আয়ত আঁখির গভীরে পুড়েছে ও দ্রবীভূত হয়েছে ঠিক আমারি মতো— 
এ-ই আপাতত আমার ঘনিষ্ঠ প্রতীতি 
ও প্রবোধ। 

অবশেষে আমার আঁকা ছবি ঘড়া-গাত্রে আঁকা ছবির পাশে রেখে 
আফিম সেবনের পাত্রে অঙ্গারে আগুন দিলাম। 
অঙ্গার প্রদীপ্ত হলে আফিম-পাত্র ছবি দুটোর সামনে রেখে আফিমে টান দিলাম। 
ফুরফুরে উচ্ছ্বাস-সহ নিষ্পলক চেয়ে থাকলাম দুই ছবির পানে— 
কারণ আমি আমার চিন্তাকে একমুখী করতে চাই— 
এবং তজ্জন্য আফিমের ইথারীয় ধূম্রই মানসিক স্থিতাবস্থা অর্জনের 
একমাত্র মার্গ।            

আফিমের পুরো মজুতই আমি সেবন করলাম 
এই আশায় যে এই বিস্ময়কর মাদক নিরাময় করবে আমার সমুদয় সমস্যাসমূহ— 
যারা আমাকে ত্যক্ত করছে নিরন্তর— 
অপসারিত করবে চোখের সামনে ঝুলে থাকা অবগুণ্ঠন— 
এবং দূরীভূত করবে স্মৃতির দুরস্ত ও ধোঁয়াটে উপচিতি— 
আমি উদ্দিষ্ট পারমার্থিক আত্মিক সমাধিতে উপনীত— 
প্রত্যাশারও অতীত সেই সমাধি;
আমার চিন্তায় এলো ঐন্দ্রজালিক সূক্ষ্মতা ও  মহিমা— 
আধো তন্দ্রা ও আধো অচৈতন্যের সমদূরত্বে ত্রিশঙ্কু। 

অতঃপর মনে হলো একটা গুরুভার বোঝা যেন বুক থেকে নেমে গেছে—  
রহিত হয়েছে মহাকর্ষের সর্বপরিব্যাপ্ত নিয়মাবলি— 
শূন্যমার্গে আমার চিন্তা ও বিচরণ অবাধ ও স্বচ্ছন্দ— 
চিন্তার প্রসার বহুবিধ, বুদ্ধিদীপ্ত ও যথাযথ। 
অনির্বচনীয়ের গূঢ় আনন্দ আচ্ছন্ন করেছে আমার সত্তা। 
কায়া থেকে বিযুক্ত—আমি নির্ভার। 
ক্রমশ আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব যেন উদ্ভিদতুল্য জড়ত্বে নিমজ্জত হচ্ছে— 
নিথর পৃথিবী— 
অথচ উদ্দীপক ও মোহনীয় রং-রূপে টইটম্বুর— 
তারপর ওই রং-রূপে আমার চিন্তা প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত ও দ্রবীভূত—  
ইথারীয় স্ফীত ঊর্মিমালায় আমি ডুবুডুবু। 
আমি শুনতে পাচ্ছিলাম আমার হৃদয়ের কম্পন, 
অনুভব করতে পারছিলাম ধমনির বিচলন। 
অস্তিত্বের তাৎপর্য ও পরমানন্দে পরিপূর্ণ উন্নত চৈতন্য-দশা। 

বিস্মৃতির গভীর সুপ্তিতে নিজেকে সমর্পণ করার বাসনা 
জাগ্রত হলো হৃদয়ের অন্তঃস্থলে; 
বিস্মৃতি যদি সম্ভব হতো; 
যদি নিত্য হতো; 
চোখ বুজলেই যদি অনায়াসে সুপ্তি-অতিক্রান্ত হয়ে 
এক অস্তিত্বহীন সমাধি-দশায় উপনীত হতে পারতাম; 
সমগ্র সত্তাকে যদি এক পোছ মসি-পাংশুর সাথে মিশিয়ে দিতে পারতাম— 
কোনো সংগীত অথবা কোনো বর্ণময় অংশু প্রভার সাথে— 
অনন্তর এইসব ঊর্মিমালা ও মূর্ত-বিন্যাস সঞ্চারিত হতো, বিস্তারিত হতো—  
হতে হতে এক সময় বিবর্ণ এবং অবশেষে বিলীন— 
আর তখনই শুধু পরিপূর্ণ তৃপ্ত হতো 
আমার সমুদয় অভিলাষ। 

ধীরে একধরনের বিবশ সংবেদন ও আলস্য আমাকে পেয়ে বসল— 
যেন কোনো আয়ুপ্রদ শ্রান্তি 
অথবা কোনো সূক্ষ্ম তরঙ্গ-লহরা বিকীর্ণ হচ্ছে আমার দেহ হতে। 
তারপর মনে হলো জীবন প্রবাহ যেন উল্টো পথে ছুটছে। 
বিগত বিজ্ঞত্ব; চৈতন্যের বিবিধ বিগত দশা; শৈশবের বিলুপ্ত স্মৃতি ফিরে এলো একে একে। 
শুধুই ফিরে  আসা নয়— 
স্মৃতির প্রাণবন্ততায় আমার অবগাহন ছিল সম্পূর্ণ। 
ক্রমে ক্রমে আমি ছোট হচ্ছি— 
ফিরে যাচ্ছি শৈশবে— 
তারপর সহসাই আমার চিন্তা প্রবাহ মিশে গেল বিবর্ণ আঁধারে— 
মনে হলো আমার চৈতন্য যেন কুয়োর অন্ধ গভীরে ঝুলে আছে বাঁকা অঙ্কুশে। 
পরমুহূর্তে আমি অঙ্কুশ-মুক্ত—নিক্ষিপ্ত স্থানকালের কৃষ্ণ গহ্বরে— 
পাক খাওয়া-ডিগবাজি— 
অন্তরায়হীন পতন— 
অনন্ত রাত্রির গর্ভে নিহিত অতল পাতাল।
অতঃপর আমার চোখের পর্দায় ক্ষণপ্রভার মতো ঝলকে উঠল 
সারি সারি বিস্মৃত স্মৃতির পরম্পরা— 
সমাধি-অবসানে যখন নিজেকে ফিরে পেলাম, 
আমি তখন একটা অপরিসর কক্ষে 
এবং বিশেষ এক মনোগত দশায়— 
যা যুগপৎ অবিদিত ও সহজাত। 
 
 


মোহাম্মদ জামান অনুবাদক এবং চিকিৎসক। প্রকাশিত বই : গিলগামেশের কাব্য। তিনি সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করেন।

menu
menu