লেখকের দেনাপাওনা
কথা হচ্ছিল সুহৃদ এক কবির সঙ্গে। তিনি হঠাৎ মন্তব্য করলেন, লিখে কী হয়? পাল্টা জানতে চাইলাম, না লিখে কী হয়? তখনকার মতো বিষয়টা ধামাচাপা পড়লেও প্রশ্নটা পিছু ছাড়ল না। মনের মধ্যে সুচতুর আততায়ীর মতো উঁকিঝুকি দিতে দিতে সে আরো ডালপালা মেলল। সমাজে ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষক, আইনজীবী, শ্রমিক ইত্যাদি পেশাজীবীর চাহিদা আছে। এমনকি পেশাদার রাজনীতিবিদও হয়তো দেশ ও দশের কাজে লাগে কিন্তু লেখকের কি কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে?
পাঠ্যবইয়ে যতই থাকুক—অসির চেয়ে মসীর জোর বেশি, বাংলাদেশের অধিকাংশ মা-বাবা চান : আমার সন্তান মসীজীবী না হয়ে বরং অসিধারী হোক। কখনো কি শুনেছেন যে, স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় Your aim in Life বিষয়ে প্যারাগ্রাফ বা নিবন্ধ রচনার সময় কেউ লিখেছে : আমি বড়ো হয়ে একজন কবি হতে চাই? গল্পকার হতে চাই? আজ অব্দি আমার পরিচিত বলয়ে এমন কোনো মা-বাবা পাইনি যিনি স্বপ্ন দেখেন, তার সন্তান বড় হয়ে একদিন রবিঠাকুরের মতো কবিতা লিখবে কিংবা তলস্তয়ের মতো ঔপন্যাসিক হবে। প্রায় সবাই খোয়াব দেখে, তার সন্তান মোটা বেতনের একটা চাকরি করবে। আর চাকরিটা সরকারি হলে সোনায় সোহাগা। আজকাল বিয়ের বাজারেও নাকি চাহিদা তালিকার শীর্ষে বিসিএস ক্যাডার পাত্র। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরি থেকে শুরু করে জাতীয় আর্কাইভের রিডিং রুমেও (স্বচক্ষে দেখা) বিসিএস গাইডে মুখ গুঁজে থাকা তরুণদের উপচে পড়া ভিড় কেবলই বাড়ছে।
গূঢ় কোনো রহস্য অনুসন্ধান করার দরকার নেই। যে দেশে কারও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের মানদণ্ড হলো তার ক্রয়ক্ষমতা বা অপরকে শায়েস্তা করার ক্ষমতা, সেখানে একজন কবি বা গল্পকার পেছনের সারির মানুষ। বিশ্বাস না হলে, লেখক পরিচয়ে ঢাকা শহরে বাসা খুঁজতে বেরোন। বাড়িওয়ালা বিস্তর গাঁইগুই করার পর হাস্যকর কোনো অজুহাত দেখিয়ে আপনাকে বিদায় করে দেবে। তবে অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি যদি লেখালেখি করেন, ‘এক্সট্রা’ খাতিরযত্ন পাবেন। এসব নানাবিধ কারণে বাংলাদেশে যারা লেখালেখি করেন তাদের ৯৯.৯৯ শতাংশের ভিন্ন একটি পেশাগত পরিচয় থাকে।
সমাজে কবি সাহিত্যিকদের সম্পর্কে বিচিত্র সব ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন, এরা পরিশ্রমবিমুখ ভাবালু প্রজাতির মানুষ। অথচ একটি ভালো গল্প/ উপন্যাস/কবিতা/নিবন্ধ নির্মাণ করতে একজন লেখক কী পরিমাণ মেহনত করেন তা সাধারণের অগোচরে থেকে যায়।
প্রথমত, শব্দের পর শব্দ গাঁথার জন্যে দীর্ঘসময় মনোসংযোগ ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। নতুন বইয়ের প্রস্তুতি শুরু করার পর মনোসংযোগ নিশ্চিত করার জন্যে হারুকি মুরাকামি যে রুটিন অনুসরণ করেন সেটা একরকম সারভাইভাল ট্রেনিং। তিনি প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠেন ভোর ৪টায়। টানা ৫/৬ ঘণ্টা লেখেন। দুপুরে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে ১০ কিলোমিটার দৌড়ান বা দেড় কিলোমিটার সাঁতার কাটেন। কেন এই কঠোর নিয়ানুবর্তিতা? জনপ্রিয় এই ঔপন্যাসিক জানেন, স্রষ্টাপ্রদত্ত যত প্রতিভাই থাকুক, জীবনযাপনে খামখেয়ালি হলে খুব বেশিদিন লেখালেখি করা যায় না।
মার্কিন সাহিত্যের তিন দিকপাল কুর্ট ভনেগার্ট, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও মায়া অ্যাঞ্জেলু—এদের প্রত্যেকেই দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কিংবা খুব ভোরে কলম হাতে নিতেন। এরপর মগ্ন তাপসের মতো অন্তত ৪/৫ ঘণ্টা ধরে চলত তাদের করোটির গভীর থেকে শব্দমালা সেঁচে আনার কসরত। লেখকমাত্রই জানেন কাজটি তৃপ্তিদায়ক হতে পারে কিন্তু মোটেই আরামদায়ক নয়।
তাবড় তাবড় লেখকদেরও প্রথম খসড়া নাজুক হয়ে থাকে। আসল কাজ তাই শুরু হয় প্রাথমিক খসড়া দাঁড় করানোর পর। যিনি যত ভালো লেখক, তিনি নিজের লেখাকে তত নির্মমভাবে ঘষামাজা করেন। কেবল তখনই কাহিনির কোথায় খেই হারিয়ে গেছে তা চোখে পড়ে, আলগা সুতোগুলো জোড়া লাগে, শব্দগুলো দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। মনের মতো একটি কাহিনি দাঁড় করানোর জন্যে ভালো লাগুক বা না লাগুক, লেখককে নিয়মিত লেখার টেবিলে বসতে হয়।
তলস্তয় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ওয়ার অ্যান্ড পিস লেখা ও সম্পাদনার কাজে ব্যয় করেছিলেন দীর্ঘ ১৩ বছর। প্রায় পৌনে ৬ লক্ষ শব্দের এই বিশাল উপন্যাসটির আগাপাশতলা তিনি বদলেছিলেন মাত্র ২৬ বার! রবিঠাকুর তার ৩৭ পৃষ্ঠার রক্তকরবী নাটক লেখার জন্যে ৯১৯ পৃষ্ঠা খসড়া তৈরি করেছিলেন। ভাবতে গেলেও তো হিমশিম লাগে।
লিখে কিছু যদি না-ই বদলায়, তবে এত পরিশ্রম করে লেখালেখি করে লাভটা কী? এই প্রশ্ন সৃষ্টিশীল মানুষকে কখনো না কখনো তাড়া করে। এ নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের একটি মজার অভিজ্ঞতা আছে।
আমি ফেরি পার হচ্ছিলাম। যাচ্ছিলাম বোধহয় যশোর। ফেরির ওপরে বসে আছি। তো তখন দুই-আড়াই ঘণ্টা সময় লাগত পার হতে। তখন এক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, তিনি আমাকে চিনতে পেরে সালাম দিলেন। দেখলাম ভদ্রলোক কথাবার্তায় বেশ গোছানো। তার সঙ্গে আলাপের এক পর্যায়ে আমি বললাম, ভালো কথাই তো বলে গেলাম সারা জীবন, তারপরও দেশটা এরকম কেন? তাহলে আমি কি কোনো কাজেই লাগলাম না?
তখন তিনি আমাকে একটি কথা বলেছিলেন, যেটা আমি সব জায়গায় বলি। কথাটা হলো—না, হক সাহেব, এটা আপনি ঠিক বলেন নি। নদী পলিমাটি নিয়ে আসছে, পলিমাটি জমা হচ্ছে, উপর থেকে দেখা যায় না। কিন্তু একদিন দেখবেন হঠাৎ জমি জেগে উঠেছে। পরের বার এসে দেখবেন সেখানে সবুজ ঘাস গজিয়ে উঠেছে। কিন্তু আগের দিন পর্যন্ত দেখা গেছে ছলছল করে শুধু পানি। এই পলিমাটি বহনটুকু বৃথা নয়। (সৈয়দ শামসুল হকের কলমের সঙ্গে সংসার)
লেখক নিজেও হয়তো জানেন না, তার কলম কখন কীভাবে বদলে দেয় জীবন। কানাড়া ভাষার লেখক সুধা মূর্তি একবার এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছেন। দেখলেন এক কিশোরী খেতে বসেছে। এক মধ্যবয়সী নারী এসে তাকে বলল, তুমি এই টেবিল থেকে প্লিজ উঠে যাও। তোমার তো শ্বেতী রোগ। অন্য বাচ্চারা তোমাকে দেখে ভয় পাবে। অপমানিত মেয়েটি কাঁদতে শুরু করল। করুণ এই ঘটনা সুধা মূর্তিকে এত নাড়া দিল যে, তিনি শ্বেতী রোগে আক্রান্ত মেয়েদের কষ্টকে উপজীব্য করে মহাশ্বেতা উপন্যাসটি লেখেন। এর বহু বছর পর তিনি আরেকটি বিয়ের প্রোগ্রামে গেছেন। তাকে দেখে মঞ্চ থেকে বর নেমে এসে বলল, আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আপনার উপন্যাসটা পড়ে শ্বেতী রোগ সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে গিয়েছিল। আজ আমি যাকে বিয়ে করছি তার শ্বেতী আছে।
মুদ্রার অপর পিঠও আছে। বহু খাটুনির পর জন্ম যে রচনার, তা হয়তো কেউ পড়লই না। তখন? এ ব্যাপারে নবনীতা দেবসেনের দাওয়াই শোনার পর থেকে আমি বেশ নির্ভার আছি।
বৃক্ষের কর্তব্য ফলগুলিকে নিখুঁতভাবে গড়ে তোলা, স্বাদে, গন্ধে, রসে পূর্ণ করা। তারপর পাকা ফলটি যখন বৃন্ত থেকে খসে পড়বে মাটিতে, সেই থেকেই সে গাছের পর। ঝরা-ফলের কথা গাছ ভাবে না। ভাবে পরের ফলটি তৈরি করার কথা। তেমনি কবির কাজ কেবল কবিতাটি প্রস্তুত করা। একবার প্রকাশিত হয়ে গেলে সেই কবিতার ওপরে কবির আর প্রভুত্ব কীসের? তখন সে পাঠকের সম্পত্তি। পাঠক-সমালোচক কবিকে বকুক-ঝকুক, আর মাথায় তুলে নাচুক, তাতে কবির বিকার ঘটা উচিত নয়। পাকা ফলটি বনের মাটিতে পড়লে, সে ফল যে পায় তার। সেটি গো-ব্রাহ্মণের হিতে লাগল, না শেয়ালে-শুয়োরে মাড়িয়ে গেল, গাছের তাতে কী এসে যায়? (নবনীতা দেবসেনের নটী নবনীতা)
২.
কিন্তু একজন কবি বা গদ্যকারের মূল দায়িত্বটা কী? তিনি কি সমকালের বিশ্বস্ত লিপিকর মাত্র? পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তো একজন ইতিহাসবিদও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। দুজনের মধ্যে তাহলে তফাৎ কোথায়?
১৯৬৮ সালে স্বাধিকার ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রত্যাশায় উত্তাল প্রাগে আকস্মিকভাবে আগ্রাসন চালায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। অভিযানের শুরুতেই অদ্ভুত একটি কাজ করে সোভিয়েত সৈন্যরা। তারা রাস্তার সমস্ত কুকুর ধরে একটা একটা করে মেরে ফেলে। দিনদুপুরে প্রকাশ্যে। এটা ছিল একধরনের মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণ। অবলা পশুর প্রতি সাম্যবাদী সেনাবাহিনীর নির্মম আচরণের উদ্দেশ্য ছিল, সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে ফেলা। দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, ট্যাঁ-ফোঁ করার সাহসও যেন কেউ না করে। এই কুকুরনিধন যেহেতু অত গুরুত্বপূর্ণ নয়, ইতিহাসের বইতে সচরাচর স্থান পায় না। আমি ইন্টারনেটে বেশ খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি। গল্পটা শুনেছিলাম কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের মুখে। ইতিহাসবিদ না-লিখলেও একজন সাহিত্যিক ঠিকই তার কবিতা বা গল্পে এই ঘটনাটি তুলে আনবেন। তিনি এটাকে জনস্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে দেবেন না।
আরেকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রচলিত ইতিহাসের কোনো পাঠ্যপুস্তকে কি নূরলদীন বা পূর্ববাংলার কৃষক বিদ্রোহের বিবরণ আছে? সৈয়দ হক যদি নূরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাট্যটি না-লিখতেন, ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে রংপুরের দুঃসাহসী কৃষক সংগ্রামের মূল্যবান ইতিহাস আমরা বেমালুম ভুলে যেতাম। সন-তারিখ-উপাত্ত-সারণির পেছনে লুকিয়ে থাকে রক্তমাংসের মানুষ ও সজীব জনপদ। সেই ছবিটি ফুটিয়ে তোলার গুরুদায়িত্ব বহন করেন কবি ও কথাসাহিত্যিকরা।
কোথাও দাঙ্গা লাগলে খবরের কাগজ ও টেলিভিশন বড়জোর তথ্যউপাত্ত দিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে। দাঙ্গার আগুন নিভলে সবাই একসময় বাড়ি ফিরে যায়। তারপর দাঙ্গা কবলিত জনপদে কী ঘটে, আক্রান্ত মানুষ জীবনের সঙ্গে কীভাবে পুনরায় সমঝোতা করে, সেটা তো সংবাদপত্রে বা টিভির পর্দায় পাওয়া যায় না। সেই বিবরণ মেলে উপন্যাস ও গল্পে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাহিত্যিক নাদিন গর্ডিমার নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের উদাহরণ দিয়ে বলতেন, রাশিয়ার টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ফরাসিদের পিছু হটার সামরিক ব্যাখ্যা ইতিহাসের বইতে অবশ্যই পাওয়া যাবে কিন্তু অবরুদ্ধ অবস্থায় রুশদের প্রতিদিনকার সংগ্রাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস উপন্যাসটাই ভরসা।
ইতিহাসে বহু নজির আছে, ঘোর মুসিবত ঘনীভূত হওয়ার আগেই কীভাবে যেন টের পেয়ে যান লেখকরা। বেখেয়াল জনগণকে প্রাণপণে তারা সতর্ক করেন। ‘যখন বিরামহীন জ্বরে এবং প্রলাপে ঘোলাটে হয়ে ওঠে সভ্যতার মুখ, আর সময়ের হাতে-পায়ে-পিঠে রক্তে-পুঁজে পেকে ওঠে নানাধরনের ফোঁড়া-ফুসকড়ি-কার্বঙ্কল, সেই সব ক্ষয়-ক্ষতি-ক্ষতের বিষয়ে এবং বিরুদ্ধে কবিরাই ভাসিয়ে দেন প্রথম কণ্ঠস্বর, যেন দৈববাণী, যেন অপ্রিয়-সতর্কতার সাইরেন।’ (কবিতার ঘর ও বাহির, পুর্ণেন্দু পত্রী) অবশ্য এই সাইরেন বাজানোর মাশুল তাদের কখনো কখনো চুকাতে হয় আপন প্রাণ দিয়ে। এই একুশ শতকেও।
২০২১ সালে মায়ানমারে অভ্যুত্থানের পর সামরিক জান্তা প্রথম সুযোগেই ৩০ জন কবিকে গ্রেফতার করে। তাদের দুজনকে গুলি করে হত্যা করে। এর প্রতিবাদ করে এক কবি লেখেন :
ওরা মাথা তাক করে গুলি ছোড়ে
কিন্তু ওরা জানে না
বিপ্লবের ঠিকানা হৃদয়ে।
বার্মিজ জান্তা তাকেও খুন করে। একই পরিণতি হয়েছিল স্পেনের ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, গুয়াতেমালায় অটো রেনে কাস্তিলো, এবং সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজায় রিফাত আলারির।
৩.
মহৎ সাহিত্য আমাদের আশা জোগায়। আরেক পৃথিবীর সন্ধান দেয়। এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো তার বুক অব এমব্রেস বইতে এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন। যে মানুষটা দিনের বেশিরভাগ সময় বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দেয়। কানাঘুষো ছিল, তার বাড়িতে গুপ্তধন রয়েছে। একদিন কতিপয় চোর সম্পদের লোভে বৃদ্ধের আস্তানায় হানা দিল। পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে তারা চিলেকোঠায় একটা সিন্দুক পেল। ওটা নিয়ে তারা পালিয়ে গেল। সিন্দুকের তালা ভেঙে চোরেরা তো হতভম্ব। সেটার ভেতর শত শত চিঠি। সবই প্রেমপত্র।
এই দীর্ঘ জীবনে বৃদ্ধ যত প্রেমপত্র পেয়েছে সব সে সযত্নে জমিয়ে রেখেছে। প্রথমে তারা ভাবল, চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলবে। তারপর নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে ঠিক করল, বুড়োকে তার চিঠিগুলো ফেরত দেয়া হবে। তবে একটি একটি করে। প্রতি সপ্তাহে একটি চিঠি পাঠানো হবে।
সেই থেকে প্রতি সোমবার দুপুর হলেই দেখা যেত, নিঃসঙ্গ বুড়ো বাড়ির দরজায় ডাকপিয়নের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। চিঠি হাতে গলির মাথায় ডাকপিয়ন উদয় হওয়া মাত্র বুড়ো দুদ্দাড় করে দৌড়। মহল্লার দুষ্ট ছেলেপুলের দল বলত, ভালোবাসার নারীর কাছ থেকে চিঠি পাবার আনন্দে বুড়োর হৃদয়ে যে তড়পানি উঠত, তার আওয়াজ স্বর্গ থেকে সেন্ট পিটারও নাকি শুনতে পেতেন!
ওই চিঠিগুলো বহু বছর ধরে বুড়োর কাছেই ছিল। স্রেফ চিলেকোঠায় বাক্সবন্দী হয়ে। পুরোনো সেই চিঠি যখন সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে ডাকপিয়ন মারফত ফেরত আসতে লাগল, বুড়োর জীবনে সেগুলো নতুন আনন্দের খোরাক হয়ে উঠল। একজন দক্ষ লেখকও একইভাবে নিত্যদিনের ব্যবহার ও অভ্যাসের স্পর্শে জীর্ণ হয়ে পড়া পরিচিত ঘটনার খোলনলচে বদলে ফেলার জাদু জানেন। বহুকালের পরিচিত দৃশ্য, স্থান এবং মানুষও নতুন চেহারায় পাঠকের সামনে হাজির হয়। তার নেতিয়ে পড়া আত্মা অজান্তেই তরতাজা সজীব হয়ে ওঠে। সাহিত্যের এই নিরাময় শক্তির বিস্তর উদাহরণ আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান বোমারু বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত নির্বিচার বোমাবর্ষণে তছনছ হয়ে যায় টোকিও নগরী। সাড়ে তিনঘণ্টায় নিহত হয় এক লক্ষ মানুষ। সেই বীভৎস হামলায় ১৪ বছরের কিশোর কাজুও আজুমা তার ১২০ জন শিক্ষক ও বন্ধুকে হারায়। শহরজুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। সহপাঠী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সে-ও মৃতদেহ সরানোর কাজে অংশ নিয়েছিল।
এদিকে খাদ্যসংকট দেখা দিল। চাল নেই, নুন নেই, সবজি নেই। স্রেফ বাঁচবার তাগিদে সে ঘাস খেতে শুরু করল। দীর্ঘ অনাহারে সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলো। গুরুতর অসুস্থ হয়ে প্রায় একবছরের জন্যে সে ঘরবন্দী হয়ে গেল। একদিন তার হাতে এলো জাপানি ভাষায় অনূদিত নাটক ডাকঘর।
কিশোর আজুমা অমলের সঙ্গে নিজের আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পেল। অমলের মতো সেও অসুস্থ। বাইরের জগৎ অমলকে যেমন হাতছানি দেয়, তাকেও হাতছানি দেয়। ধীরে ধীরে আজুমা শোকের আঘাত ও রোগের ছোবল সামলে উঠলেন। রবীন্দ্রনাথের নাটকটি তাকে নতুন করে বাঁচার শক্তি জোগাল। কাজুও আজুমা পরবর্তী সময়ে বিশ্বভারতীর নামকরা অধ্যাপক হন এবং বাংলা থেকে জাপানি ভাষায় বহু গ্রন্থ অনুবাদ করেন।
একটি অনুপম কবিতা, নাটক, উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ অস্তিত্বের গভীরে পৌঁছে কোথায় যেন বদলে দেয় আমাদের। জীবনের দিকে ভিন্ন চোখে তাকাতে বাধ্য করে। একজন বিশুদ্ধ লেখক অনেকটা যেন বৌদ্ধ সাধু হো তেইয়ের মতো। সবসময় হাসিখুশি হো তেই পিঠে বিরাট বোঝা নিয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন তাকে এক লোক জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা একটু বুঝিয়ে বলুন তো, জেন মানে কী। হো তেই হো হো করে খানিকক্ষণ হেসে পিঠ থেকে বোচকা নামিয়ে মাটিতে রাখলেন। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, জেন-এর শীর্ষ স্তর কোনটি? হো তেই তার বোচকা আবার পিঠে তুলে হাসিমুখে রওনা হলেন।
সাহিত্যও একইভাবে প্রবল শোক কিংবা আশাভঙ্গের কালে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বিষম বোঝাটা নামিয়ে বুক ভরে দম নেবার ফুরসত দেয়। বাকি পথ পাড়ি দেয়ার রসদ হিসেবে যা সামান্য নয় মোটেই। পথচলা তখন আর ক্লিষ্টমুখে নয়, হয় প্রসন্নচিত্তে।
রেজওয়ানুর রহমান কৌশিক প্রাবন্ধিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে গবেষণা কাজে নিযুক্ত আছেন।ঔপনিবেশিকতা ও বিশ্বায়নের প্রভাবে সমাজ, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির পালাবদল সম্পর্কে তার আগ্রহ রয়েছে। তিনি ঢাকায় থাকেন।