ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (৩ কিস্তি)

চার

ইমিগ্রেশন অফিসার ফিরে এসে কাউন্টারে বসলে সোলেমন ভাবনা ঝেড়ে ফেলে। সে তার ইউনিফর্মে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো নেমট্যাগ খেয়াল করে। মা খিন, ইমিগ্রেশন অফিসার। মা খিন কম্পিউটারের বোতাম টিপে পাসপোর্টের নম্বর ইত্যাদি ইনসার্ট করে পাসপোর্টটা স্ক্যান করে তাতে তারিখসহ সিল দিয়ে সেটা সোলেমনকে ফেরত দিল।  

—থ্যাংকস, মা খিন।  
—ওয়েলকাম। মা খিন হেসে রীতি অনুযায়ী মাথা নিচু করে প্রতি-উত্তর দিল। 

একজন বিদেশি নাগরিক হিসেবে এয়ারপোর্ট অতিক্রম করতে যা যা করতে হয় সেসব শেষ করে এবং ল্যাগেজ ছাড়িয়ে নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে পার্কিং ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে সোলেমন ভাবতে থাকে কোথায় উঠবে। সে আশপাশে তাকায়। লোকজন নেই, এমন কি গাড়িও নেই। যে ক’জন যাত্রী এসেছে তারা চলে গেছে। আর যারা এ শহর থেকে অন্য কোথাও যাবার ছিল তারাও ততক্ষণে প্লেনে আরোহণ করেছে। প্লেন টেকঅফ করার জন্য তৈরি, ইঞ্জিনের শব্দ পাচ্ছে। সোলেমন ভাবে, একটা ট্যাক্সি দরকার। কোথাও ওকে উঠতে হবে। সে চারপাশে তাকায়, কিন্তু কোনো যানবাহন দেখতে পায় না। 

সহসা কোথা থেকে একটা লোক এসে উদয় হলো। লোকটাকে আপাতদৃষ্টিতে স্থানীয়ই মনে হলো। কিন্তু তার পরনে হলুদ ফতোয়া আর ঢোলা পাজামা। বার্মিজরা সাধারণত এরকম পোশাক পরে না। সে লোকটাকে কুলি বা মজুর বলে আন্দাজ করল। খুব সন্তর্পণে সোলেমনের কাছে এগিয়ে এসে লোকটা ওকে বার্মিজ কায়দায় সম্মানও দেখাল। দু’একটা ভাঙা ইংরেজি আর বার্মিজ মিলিয়ে লোকটা বলল, তুমি সম্ভবত একজন বিদেশি লোক। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

—সোলেমন ইংরেজিতে জানতে চায়, কী সাহায্য করতে পার তুমি? 
—লোকটা হাসিমুখে ইংরেজিতে কিন্তু বার্মিজ উচ্চারণে বলল, আমি একজন ট্যাক্সিচালক। তোমার নিশ্চয়ই গাড়ি দরকার? 
সোলেমন কিছুটা অবাক হলো। লোকটার দিকে তাকিয়ে সে যা ভাবছিল সেটা ভুল প্রমাণিত হলো। 
লোকটা পুনরায় কথা বলতে শুরু করল, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে আর এই শহরে গাড়ি চালাবার সরকারি অনুমতিও আছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে আমার গাড়ির নম্বর ও নাম ঠিকানা নাসাকা অফিসের তালিকাভুক্ত আছে। আমার সঙ্গে সব প্রমাণপত্র আছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করে শহরের যে কোনো স্থানে যেতে পার। আমি এই শহরের সব কিছু ভালো করে চিনি।

এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে ট্যাক্সি ড্রাইভার থামল। তারপর হাসিমুখে সোলেমনের দিকে তাকিয়ে সম্মতির জন্য অপেক্ষা করছে সে। ওর দিকে তাকিয়ে সোলেমন ভাবছে, সত্যি সত্যি কোথাও একটা আশ্রয় সন্ধান করতে হবে। ট্যাক্সি ড্রাইভার তো একটা ভালো হোটেল চিনতেও পারে। 

—তুমি কি আমাকে একটা ভালো হোটেলে নিয়ে যেতে পারবে?
—হ্যাঁ। খুব পারব। আমি এই শহরের সব হোটেলই চিনি। আর কোনটিতে থাকার খরচ কেমন তাও ধারণা করতে পারি।  —তুমি যদি কম পয়সায় ভালো হোটেলে যেতে চাও সেখানেও নিয়ে যেতে পারি। 
—তাহলে তুমি আমার এত উপকার করতেই বুঝি দাঁড়িয়ে ছিলে? 
—তা বলতে পার। আমি তোমার মতো কারো জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। 
—আমার মতো এমন যাত্রী আজ আর একজনও পাও নি বুঝি?
ড্রাইভার যেন সোলেমনের কথার মর্মার্থ বুঝেছে। সে উত্তর দিল, ঠিক বলেছো। সব যাত্রী সব ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিতে চায় না। তাই হয়তো আগে যারা চলে গেছে তাদের কেউ আমাকে নেয় নি। 

—আমাকে বুঝি তুমি বিশেষ করে চিনে ফেলেছো? আর আমিও?  
সোলেমন কথা বলতে থাকে আর এদিক ওদিক চোখ বুলায় অন্য কোনো ট্যাক্সি বা চালক দেখা যায় কি না। কিন্তু চোখে পড়ছে না। লোকটাকে নাছোর বান্দার মতো মনে হচ্ছে। সে ওকে গাড়িতে না তুলে ছাড়বে না। সোলেমনও বুঝি অগত্যা ওকে না নিয়ে পারবে না।    
লোকটা বলতে থাকে, আমি সামান্য ট্যাক্সি ড্রাইভার মাত্র। আমাকে এ শহরে আগত যাত্রীদের চেনার কথা নয়। তুমি আমার সঙ্গে মশকরা করছ, আমি বুঝতে পারছি। আজ আমি কোনো যাত্রী পাই নি এ কথা ঠিক। আমি যদি মগ হতাম তাহলে তারা আমার কোনো পরিচয় ছাড়াই গাড়িতে উঠে বসত। কিন্তু মগ না হওয়াতেও আমার কোনো দুঃখ নেই। আমার রিজিক খোদা তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। কার অছিলায় তিনি আমার পরিবারের আহার যোগাবেন, সে তিনি ভালো জানেন।
সোলেমন লোকটার কথায় সন্তুষ্ট হলো, আচ্ছা, চলো। 
লোকটা হাসিমুখে ওর লাগেজ গাড়ির পেছনে তুলে নিল। ওর খুশি দেখে সোলেমন বুঝতে পারল, সে ভাবতেই পারে নি অত সহজে সে ট্যাক্সিচালকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে। সোলেমন ট্যাক্সিতে উঠে বসল।
গাড়ি স্টার্ট করার আগে ড্রাইভারজানতে চাইল, তোমাকে শহরের কোন এলাকায় নিয়ে যাব? 

যখন সলোমন বুঝতে শিখেছিল তখন থেকে এখানে আসবার ওর ইচ্ছা। ওর বাবাও এ শহরের অনেক গল্প করতেন। বলতেন, সমুদ্রের ধারে একটা সুন্দর শহর। সারা জাহানের লোকের এখানে আসাযাওয়া। আরাকান থেকে, কাঠ, চাল আর শুকনো মাছ পৃথিবীর কতদেশেই না যেত। সোলেমনের বাবা এ শহরের বিখ্যাত সান্দিকান মাদ্রাসায় এলেম শিক্ষা নিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, সোলেমনও এ মাদ্রাসায় তালিম নেবে। সে মস্তবড় হাকিম হবে। বার্মার সামরিক সরকার তা হতে দেয়নি। কিন্তু সে তো অতীত, বরং বলা ভালো প্রথম জনমের সাধ। সেই অতীত যেমন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, সেই জীবনও নয়। এমনকি সে ওর দ্বিতীয় জীবনে মৃত না হলেও সে জীবনে ও কোনো প্রবেশাধিকার রাখে না। ওসব ভাবনা পরে ভাবা যাবে, আপাতত ভাবনা, সোলেমন এখন ট্যাক্সিচালককে কী বলবে, কোথায় নিয়ে যেতে বলবে। 

—সোলেমন ভেবেচিন্তে বলল, তুমি আমাকে সমুদ্রের ধারে কোনো একটা হোটেলে নিয়ে চল। মানের দিক থেকে ভালো, কিন্তু ভাড়াও বেশি হবে না।   
—ঠিক আছে। কোনো চিন্তা নেই। আমি অবশ্যই তোমাকে তোমার পছন্দমতো জায়গায় একটা ভালো হোটেলে নিয়ে  যাচ্ছে। 

সোলেমনকে অভয় দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। গাড়িটা বেশ পুরোনো, চলতে শুরু করার আগেই ইঞ্জিনের গড় গড় শব্দ চারদিক মাতিয়ে তুলল। তবে চলতে শুরু করলে শব্দ কমে এল। আর এয়ারপোর্ট এলাকা ছাড়িয়ে কিছুদূর গেলে পর নীরব পরিবেশে গাড়িও নীরবেই চলতে লাগল। 

সোলেমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে এতক্ষণে বুঝতে পারছে দুশ্চিন্তায় ছিল। নিজেকে আরো হালকা করতে অথবা এয়ারপোর্টের ভাবনার বিষয়টা মন থেকে একদম মুছে ফেলতে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপটা চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবল। এতক্ষণ পর ড্রাইভারের নামটা জানবার কথা ওর মনে এল।    

—তোমার নাম কী? 
—গাড়ি চালাতে চালাতে মুখ ফিরিয়ে হাসিমুখে ড্রাইভার ওর নাম বলল, মহদং। 

বার্মিজ জানলেও সোলেমন এই নামের অর্থ মনে করতে পারল না। লোকটা কোন নৃগোষ্ঠীর সেটা চেহারা দেখে আন্দাজ করাও যাচ্ছে না। আয়নায় ওর মুখ যতখানি দেখা যায় তার থেকে একটা ধারণা নেবার জন্য সে দু’একবার তাকাচ্ছেও। একবার মনে হলো সে রাখাইন আবার মনে হচ্ছে তা নয়। ওর কথার ধরন থেকে আবার মনে হচ্ছে এরকম উচ্চারণ আর কথার ধরন সোলেমনের চেনা। হঠাৎ লোকটার চোখে চোখ পড়ে গেলে মনে হয় লোকটাও যেন ওর চেহারা খেয়াল করছে। বিব্রতকর অবস্থাটা সহজ করার জন্য সোলেমন আবার ওর নাম জিজ্ঞেস করল।    

—তুমি কী নাম বললে যেন।
—মহদ অং।  

সোলেমনের হঠাৎ মনে পড়ল, মহদআলি। মানে মহম্মদ আলি। আর এ লোকটা নাম বলল, মহদ অং। এবার যেন সোলেমন তার নামের অর্থটা বুঝতে পারছে। লোকটা মুসলিম আর রোহিঙ্গা নয় তো? 
ট্যাক্সিটা আরো প্রশস্ত রাজপথে নেমে এলে সোলেমন নীরবে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। 
সিটোয়ে শহরে এমন আধুনিক সড়ক আছে সোলেমন ভাবে নি। সবুজেরও অভাব নেই। প্রশস্ত পথের দুপাশে বিশাল বিশাল বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। অনতিদূরে প্রাচ্যস্থাপত্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে নাতিউঁচু দৃষ্টিনন্দন ভবন। আকাশে সাদা মেঘের পাশে কোথাও কোথাও বৌদ্ধমন্দিরের চূঁড়া চোখে পড়ছে। 
ট্যাক্সি ড্রাইভার বেশ হাসি হাসি মুখ করে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় সে কথা না বলে আর পারল না।

—আমার নাম, তোমাকে আগেই বলেছি, মহদং। তুমি আরও কিছু জানতে চাইলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পার। 
সোলেমন কী জিজ্ঞেস করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভেবে পেলেও ওর কাছে জানতে চাওয়া উচিত হবে কি না ভাবছে। সে চুপ করে পেছন থেকে মহদং-এর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মাথার চুল কালো, মাথার খুলি মঙ্গোলীয়। সে মহদং-এর চোখ দেখতে পাচ্ছে না। সহসা আয়নায় চোখ পড়লে দেখতে পায় মহদং সোলেমনকে পর্যবেক্ষণ করছে। ওর চোখে চোখ পড়লে চোখ সরিয়ে নিয়ে মহদং ফের কথা শুরু করল।     

কী করতে তুমি মগের মুল্লুকে এসেছো, আমি জানি না। জানতে চাইও না। জানতে চাওয়া অভদ্রতা হবে। তুমি আমাকে সন্দেহ করতে পার। তবে আমি তোমাকে জানাতে চাই যে, আমি খারাপ লোক নই। আমি নাসাকা বাহিনীর চর নই। তুমি চাইলে প্রতিদিনই তোমাকে আমি শহর ঘুরিয়ে দেখাতে পারব। তুমি যেখানে যেতে চাও নিয়ে যেতে পারব। যে কোনো জায়গায় তোমাকে নিয়ে যেতে পারব। আর বেড়াতে এসে থাকলে যেখানে যেতে চাও আমি নিয়ে যেতে পারব। ভাড়া আমি বেশি নেব না। আমি হারাম খাই না। অন্যরা যা নেয় তার থেকে কম নেব। একজন বিদেশি হিসেবে তুমি পথঘাট আর লোকজন না চিনে ভুল করতে পার। এ ছাড়া কোথাও না কোথাও তোমার বিপদও হতে পারে। তুমি তো এদেশের লোক চেন না, এমন কি যারা দেশ চালাচ্ছে তাদেরও না। আমার সহযোগিতা নিলে এদেশে তোমার ঠকবার আশঙ্কা নেই।

এবার সলোমন বুঝতে পারল মহদং অন্তত মগ বা রাখাইন নয়। তবে কি ওর অনুমান সঠিক, সে মুসলিম?    
গাড়ি চালাতে চালাতে মহদং কখনও বার্মিজ কখনও আধা-ইংরেজি আধা-বার্মিজ মিশেল দিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। সে খেয়াল করছে না, হয়তো বুঝতেও পারছে না, একজন বিদেশি ওর সব কথা নাও বুঝতে পারে। তার কথা আমলে নাও নিতে পারে এমন কি বিরক্তও হতে পারে।  

সোলেমন অবশ্য মহদং-এর সব কথাই বুঝতে পারছে। আর বুঝতে পারছে বলেই হয়তো বিরক্ত হচ্ছে না। অথবা দীর্ঘকাল পর এমন মধুর কথা শুনতে পেয়েছে বলেই ওর আরো তেষ্টা বেড়ে গেছে। কতদিন পর সে এ ভাষায় কথা শুনছে! কিন্তু মহদং যে শব্দ চয়ন করেছে তাতে ওর মনের ভেতরটা যেন সোলেমনের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, সোলেমনের কানে হারাম শব্দটা আলাদা করে ধরা পড়েছিল। আর তখন সে সোলেমন সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চায়।  
মহদং হঠাৎ করেই শুদ্ধ ইংরেজিতে জানতে চায়, দয়া করে বলবে কি, তুমি কোন দেশের নাগরিক?
—আমি একজন ফরাসি নাগরিক। 
মহদং গাড়ি চালাতে চালাতে সোলেমনের মুখের দিকে ফিরে তাকায়। তাকিয়ে আবার গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দেয়। সোলেমন ভাবে, তবে কি সে সন্দেহ করছে! এয়ারপোর্টে যখন সে পার পেয়ে গেছে, একজন ট্যাক্সিওয়ালা কেন সন্দেহ করবে? তবে কি মহদং গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য সরবরাহকারীদের কেউ একজন? 

সোলেমন মনে মনে সতর্ক হবার কথা ভাবে। ট্যাক্সিওয়ালার নাম, বার্মিজ ভাষায় যার কোনো অর্থ সোলেমন উদ্ধার করতে পারে না, নামটার অর্ধেক মুসলিম নামের অপভ্রংশ আর অবশিষ্টাংশ বার্মিজ হওয়ায় সে ধরে নেয়, হয়তো এটা ওর আসল নাম নাও হতে পারে।  

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভার আবার মুখ খোলে, তোমাকে দেখে ফেরাই মনেই হয় না। তোমার চেহারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ানদের মতো। তোমার চুল কালো, চোখ কালো, গায়ের রং তামাটে, আর নাকটাও ফেরাইদের মতন না। বলা যায়, তোমার চেহারা অনেকটা আমাদের চেহারার মতনই।

সোলেমন এবার নিজের চেহারা সম্পর্কে নতুন করে সজাগ হয়ে যায়। মহদং-এর পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা দেখে মনে মনে সে অবাকই হয়। একজন ট্যাক্সি চালকের কাছে সে এতটা নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান প্রত্যাশা করেনি। তবে ওর বিশ্বাস জন্মে যে, এই এই ট্যাক্সিওয়ালা নানাজাতের লোককে ওর গাড়িতে চাড়িয়েছে। তা না হলে ফেরাই শব্দটির এমন সঠিক প্রয়োগ সে করতে পারত না। সে জানে, ফেরাই বলতে প্রকৃত অর্থে ফরাসিদেরই বোঝায়। অবশ্য বার্মিজরা ইউরোপের সাদা ত্বকের সব মানুষকেই ফেরাই বলে আখ্যায়িত করে। তবে তাদের কাছে ইউরোপের জাতভেদ স্পষ্ট না হওয়ায় সোলেমন স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু ইউরোপ ছাড়া এশিয়ার মানুষকে বার্মিজরা আলাদা করে চিনতে পারার ব্যাপারটা ওর নিজের জন্য শঙ্কার। মহদং একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়ে থাকলে চিনতে পারলেও তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু সে যাদের সঙ্গে কাজ করব, ওঠাবসা করবে তারা যদি সন্দেহ করে তখন কী করবে? 

সোলেমন চুপ করে ভাবতে থাকে আর পথের দু’পাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ দেখতে থাকে। আসার আগেও সে ইউরোপীয়দের আদবকায়দা আরো বেশি বেশি কসরত করে এসেছে যাতে ওকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। এমন কি ইংরেজি উচ্চারণও ফরাসিদের মতো করতে চেষ্টা করেছে। সে ভাবে, ইমিগ্রেশন যখন ওকে চিনতে পারে নি তবে অন্যরাও চিনতে পারবে না। বিদেশি নাগরিকরা এদেশে এসে কী রকম সমস্যা মোকাবিলা করে বা কোন কোন দেশের নাগরিকদের এখানে সমস্যা হয় সোলেমনের মনে এমন কৌতুহল জাগলেও সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, মহদং-এর কাছে সে এসব বিষয়ে কিছু জানতে চাইবে না।  

কিন্তু মহদং নিজে থেকেই বলল, ব্রিটিশরা ছিল বামারদের দু’চোখের বিষ।
সোলেমন জানে, বার্মারা ১৭৮৪ সালে রাখাইনরাজকে পরাজিত করে আরাকান দখল করেছিল। আর ব্রিটিশরা আরাকানিদের সহায়তায় কেবল আরাকান নয়, বার্মাও দখল করেছিল। বার্মিজরা এখনো সে স্মৃতি ভুলতে পারে নি। কিন্তু বার্মিজরা রাখাইনদের পরাজিত করে আরাকান যে দখল করে নিয়েছিল সে ইতিহাস রাখাইন জাতি ভুলে গেল কেন? কেন ভুলে গেল, আরাকানের স্বাধীনতা উদ্ধারে মুসলমানরা তাদের পাশে ছিল। মুসলমানরা তো সবসময় আরাকানকে তাদের দেশ ভাবত। যদি না ভাবত, মোগলদের কাছে দেশটা তুলে দিতে পারত না? আরাকান যখন স্বাধীন ছিল তখন তো মুসলমানরাই আদতে দেশ চালাত। এমন কি বিদেশ থেকে আগত মুসলিম সৈন্য আর আমাত্যরাও কখনো আরাকানের স্বাধীনতা নস্যাৎ হতে দিতে চায় নি। আরাকানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে বোধপায়ার বিরুদ্ধে তারা মরণপণ লড়াই করেছিল, লক্ষ লক্ষ মুসলিম সৈনিক প্রাণ দিয়েছিল।            

গাড়িটা চতুর্মুখী রাস্তার সিগন্যাল বাতির সামনে এসে থামল। সামনে পথের ওপর বার্মিজ ভাষায় বিভিন্ন জনপথের নির্দেশনা দেয়া আছে। রাথেদং, বুথিদং, মংডু কোন শহরের দূরত্ব কত লেখা আছে। সোলেমন সেসব দেখতে থাকে। তখন মহদং-এর গাড়ির পাশে একটা সেনাবাহিনীর জিপ এসে ক্যাচ শব্দ করে ব্রেক কষল। আর ট্যাক্সিটার পেছনে আরো দু’একটা গাড়ি। মহদং আড়চোখে সেনাজিপের দিকে একবার তাকাল, তাকিয়ে মুখে কলপ এঁটে দিল। সবুজ বাতি জ্বলার পর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলে সেনা জিপটা দ্রুত টান দিয়ে আর সব গাড়িকে বুড়ো আঙুল দেখানোর ভাব নিয়ে সাঁ সাঁ গতিতে চলে গেল। মহদং ধীরে ধীরে গতি বাড়াল এবং পুনরায় কথাও বলা শুরু করল। 

আমার গাড়িটা নতুন নয়। তোমার হয়তো কষ্ট হবে। কিন্তু দৈনিক ভাড়া করার জন্য তুমি নতুন গাড়ি পাবে কই? এদেশে নতুন গাড়ি কেনা বড় ঝামেলার কাজ। অর্থ থাকলেই তুমি গাড়ি কিনতে পারবে না। নতুন গাড়ির জন্য কর ছাড়াও নাসাকার লোকদের যে পরিমাণ ঘুষ দিতে হয় তা দিয়ে আরেকটা গাড়ি কেনা সম্ভব। এখানে চকচকে গাড়ি বাড়ি যা দেখবে সবই সেনাবাহিনীর। আর এখানে পর্যটকও তেমন আসে না। আসবে কী? আসতে দিলে তো আসবে। চীনা ছাড়া সরকার অন্যদের সহজে আসতে দেয় না। তাও যারা আসে তাদের এ শহরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। অথচ দেশটা কত সুন্দর। পাহাড়, সমতল, সমুদ্র কত নদী সরোবর। তুমি কী না দেখতে পারবে! দেখে তোমার চোখ জুড়িয়ে যাবে। তাছাড়া কত প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন এখানে রয়েছে। বৌদ্ধ যুগের কত কত চিহ্ন আছে। প্রাচীন রাজাদের বাড়িগুলো আছে। তুমি প্রাচীন আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এর নাম শুনে থাকবে। সেখানে কতকিছু দেখার আছে। পাহাড় আর সমুদ্রের এমন মিলন কোথায় আছে বল? এমন শহরে সব সময় পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকার কথা। আর আকিয়াব বন্দরও কি আজকের বন্দর? শত শত বছর আগেও এ বন্দরকে পৃথিবীর সব দেশের সওদাগররা এক নামে চিনতো। আরব সওদাগররা কি এ শতকে এসেছে এদেশে? এসেছিল বহু শতাব্দী আগে, ইসলামের আবির্ভাবেরও আগে। তবে ইসলামের বিস্তার লাভের পর ধর্মের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমদের আসাও শুরু হয়েছিল। নবী নিজেই তো বাণিজ্য পছন্দ করতেন। আর তাঁর অনুসারীরা বাণিজ্য পছন্দ করবে না? তারা এসে বার্মিজ উপকূলে বড় বড় নৌযান ভেড়াত, এদেশের পণ্য যেমন মসলা, কাঠ এসব নিয়ে ভারত সাগর পাড়ি দিয়ে আরব সাগরের তীরের দেশগুলোতে বেচত। তারাও কত কি না এদেশ থেকে রপ্তানি হতো। বাণিজ্যের সূত্রেই মুসলিম ব্যবসায়ীরা তখন থেকেই এদেশে বসতি করতে শুরু করে। পুরো বার্মাজুড়ে এত এত মসজিদ কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল? ব্যবসায়ীরাই তো। আর স্থায়ীভাবে বসতি না করলে কেউ মসজিদ বানাবে কেন? সেসব মসজিদ সেনাবাহিনী ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। যাক, সেসব কথা তোমাকে বলে কী হবে? তুমি একজন ফেরাই। তোমার তো মসজিদে কোনো আগ্রহ থাকার কথা নয়। তবে আমি এটা বুঝতে পারছি যে, তুমি একজন মান্যবর ব্যক্তি, তা না হলে তোমাকে এদেশে ঢুকতেই দিত না। চাইলেই যে কেউ এদেশে ঢুকতে পারে না। আর কোনো কোনো দেশের লোক তো এদেশে আসা একেবারেই নিষেধ।
  
মহদং একনাগারে অনেক কথা বলল। সে এত কিছু ভাবতে পারে, এত পেছনের ইতিহাস জানে ভেবে সোলেমন নির্বাক থাকে। সে তার মতের সঙ্গে একমত। কিন্তু সে নিজে কোনো মতামতও দেয় না, মন্তব্যও করে না। এমন ভাব নিয়ে যেন ওর কথা শোনে আর চুপ করে থাকে বসে থাকে যেন এসস প্যাচালে ওর কোনো আগ্রহ নেই। সোলেমন বরং এ প্রসঙ্গ থেকে মহদংকে সরিয়ে আনতে চায়। 

—তাহলে তুমি আমাকে কোন হোটেলে নিয়ে যাচ্ছ?
—হোটেল মারমেইড।

হোটেলের নামটা সোলেমনের পছন্দ হলো। নামটা শুনে ওর চোখে সমুদ্রের ঢেউ ভেসে উঠছে আর কানে তার কলরোল বাজতে থাকে। সমুদ্র উপকূলের একটি শহরের হোটেলের নাম এরকম হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। সে কল্পনা করে সাগরতটে অবস্থিত সেই হোটেলের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে ঢেউ এসে আছরে পড়ছে সৈকত। 

মারমেইড খুব ভালো হোটেল। অনেক পুরোনো, কিন্তু অভিজাত। 
মহদং-এর কথায় সোলেমন সম্বিত ফিরে পায়। সে জানতে চায়, হোটেলটা কোথায়? (চলবে)


ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (২ কিস্তি)

menu
menu