বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতা : উপাদানসমূহ (২য় পর্ব)
দুই.
আর একটা বিষয়। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা। জীবনে প্রথম জেল খেটেছেন ‘হিন্দু মহাসভা’র সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়ি থেকে তাঁর সহপাঠী আবদুল মালেককে মুক্ত করে আনার অপরাধে। বঙ্গবন্ধুর দিক থেকে এ ঘটনার সাম্প্রদায়িক চরিত্র নেই। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতার প্রতি তাঁর দায়বোধ আছে। তিনি বলছেন [শেখ মুজিবুর (২০১৪, ১১)], “ হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়াআড়ি চলছিল। গোপালগঞ্জ শহরের আশেপাশেও হিন্দু গ্রাম ছিল। দু’একজন মুসলমানের উপর অত্যাচারও হল।” এ সময় তাঁর সহপাঠী আবদুল মালেককে ধরে নিয়ে আটকে রাখা হয়। তাঁকে খন্দকার শামসুল হক (পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি) বলেন, … তোমার সাথে ওদের বন্ধুত্ব আছে বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস।” বঙ্গবন্ধু জানান, আমরা দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে নিয়ে আসি। ঔপনিবেশিক বিচার প্রক্রিয়ায় তিনি দেখছেন দারোগা হিন্দু, ম্যাজিস্ট্রেট হিন্দু। তারা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সে সব সিদ্ধান্ত তাঁর বিপক্ষে যাচ্ছে। পরে হিন্দু মুসলমানে যখন সমঝোতা হলো তখন মামলা আর চলছে না। এ ঘটনার তাৎপর্য কম নয়। তিনি বলছেন [শেখ মুজিবুর ( ২০১৪, ১৩]):, ‘এই আমার জীবনে প্রথম জেল।’ এ ঘটনার কাছাকাছি সময়ের আরেকটি ঘটনার স্মৃতি তাঁকে পীড়িত করেছে [শেখ মুজিবুর (২০১৪, ২৩)] :
একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকিমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদ কাঁদ অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, “ননী কি হয়েছে?” ননী আমাকে বলল, “তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।” বললাম, “যাব না, তুই আসিস।” আরও অনেক হিন্দু ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমাকে কোনোদিন একথা বলে নাই। অনেকের বাবামা আমাকে আদরও করেছে। এ ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে। শহরে এসেও এ ব্যবহার দেখেছি।
এ ঘটনা আসলে সে সময়কার একটা নিষ্ঠুর বাস্তবতা। জয়া চ্যাটার্জি এ সময়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণা করেছেন। আমরা সময়টা উপলব্ধি করতে, জনমনস্তত্ত্বের স্বরূপটা বুঝতে তাঁর শরণ নেবো। সাধারণভাবে মনে করা হয়, বাংলায় অস্পৃশ্যতার সংকট প্রবল ছিলো না। জয়া চ্যাটার্জি এ সময়ের হিন্দু সমাজের প্রবণতা সম্পর্কে বলছেন [জয়া (২০১৪ : ৪১-৪২)] : “ত্রিশ দশকের প্রথম দিকে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙলার উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা বর্ণভিত্তিক সমাজের পুরোহিততন্ত্রের কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। উপমহাদেশের অন্য কোনো অংশের লোকদের চেয়ে তারা এ ব্যাপারে কম রক্ষণশীল ছিলেন—এ ধরনের দৃষ্টান্ত প্রায় নেই। বরং ১৯৩৩ সালে কেন্দ্রীয় আইন সভায় এম. সি. রাজা অস্পৃশ্যতা বিল (Untouchability Abolition Bill) উত্থাপন করলে বাঙলার প্রত্যেক হিন্দু সদস্য ঐ বিলের বিরুদ্ধে প্র্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।“ পরে বিলটি জনমত যাচাইয়ের জন্য গেলে গভর্নর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাঙলায় ‘ঐ বিলের বিরুদ্ধে জনমত বিস্ময়করভাবে অধিক প্রবল’।” জয়া চ্যাটার্জি নানান উদাহরণের মাধ্যমে বলেন, “পবিত্রতা, শুদ্ধতা, ও পুরোহিততন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালি সমাজে খুব গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত বলে প্রতিভাত হয়।” স্বাভাবিকভাবেই আমরা বলতে পারি, কৈশোরেই এ ধরনের বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি নিজে উদারনৈতিক মানবতাবাদী হিসেবে গড়ে উঠছেন। কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন না, বরং কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় তার শিক্ষা নিচ্ছেন। ননীর বাড়িতে তিনি যাবেন না তবে ননীকে তিনি আসতে বলছেন। এটা তাঁর চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। তিনিও পাল্টা সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠছেন না। বরং নিজের দিক থেকে উদারনৈতিক মানবিক হয়ে উঠছেন। তাঁর মনে হয়েছে, [আনিসুজ্জামান (২০১৯, ৬৮)], হিন্দু-মুসলমান বিরোধের অন্তর্নিহিত কারণ যেমন করে রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষ বসু অনুধাবন করেছিলেন, আর কেউ তেমনটা করেন নি।
এভাবেই আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতায় তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হলো। ধর্মীয় বিভাজনের ভেদনীতির সমস্যার কীভাবে সমাধান হবে সেটা তিনি ভেবে রেখেছিলেন পাকিস্তান হওয়ার আগেই। এটা খুবই মূল্যবান মনে হয়েছে আমাদের কাছে। তিনি বলছেন [শেখ মুজিবুর (২০১৪, ২২]):
পাকিস্তান দুইটা হবে লাহোর প্রস্তাবে ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পুর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে—পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান। ওখানেও হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু থাকবে তবে সমান নাগরিক অধিকার পাবে হিন্দুস্তানের মুসলমানরাও।
সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আস্থা নিয়েও ভগ্নাংশের (fragments) নাগরিক জীবনের সমান অধিকারের বিষয়টি তাঁর ভাবনায় ছিলো বোঝাই যায়। এ ক্ষেত্রে মুসলিম লীগকে কীভাবে গণ-মানুষের সংগঠনে পরিণত করবেন, প্রান্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করবেন—তা-ও তাঁর ভাবনায় পরিষ্কার ছিলো। আবুল হাশিমের (১৯০৫-৭৪) ম্যানিফেস্টোতে ‘জমিদারী প্রথা’ বিলোপের প্রতিশ্রুতিতে তিনি ছিলেন সবচেয়ে উৎসাহী। যদিও উপদলীয় কোন্দলের কারণে এটি প্রচারিত হতে পারে নি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উপদলীয় দ্বন্দ্বে তিনি মোহাম্মদ আকরম খাঁ-খাজা নাজিমউদ্দীনের ‘প্রতিক্রিয়াশীল অংশে’ না গিয়ে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের পক্ষে অবস্থান নেন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের উপদলকে তিনি ‘প্রগতিশীল’ মনে করেছিলেন। তিনি বলছেন [শেখ মুজিবুর (২০১৪, ১৭)] :
শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের লীগে পরিণত হয় নাই। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কাউকে লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের লোকেরাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল।
৭ই মার্চ ১৯৬৪ সালে কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের প্রদেশের নাম “বাংলাদেশ” রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাবন্ধিক আবদুল হক সে সময়েই এর প্রতিবাদ করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। আবদুল হক বলতে চেয়েছেন, [আবদুল (২০১৫, ১২৭)] পূর্ব পাকিস্তানের সুদূর অতীত অবধি ইতিহাস প্রসারিত। এখানকার অধিবাসীরা ‘বাঙালী’ এদের ভাষা ‘বাংলা’, এরা বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ ভূমির অধিকারী। সুতরাং ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মাতৃভাষার নাম অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ রাখাই সাধারণ নিয়ম। আবদুল হকের এই প্রস্তাবনার অনেক আগে বঙ্গবন্ধু ‘বাংলা’ নামের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণ পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন, [শেখ মুজিবুর ( ২০১৭, ২৬৯-৭০)]:
স্যার, আপনি দেখবেন ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে তারা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কি না।
এ বক্তব্যের কেন্দ্রে জনগণ অবস্থান করছে। এটাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ভাবনার শক্তি, যার মৌল প্রেরণা জনগণের মতে গভীর আস্থা। (চলবে)
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতা : উপাদানসমূহ (১ম পর্ব)
• ড. মো. মেহেদী হাসান, অধ্যাপক এবং প্রাবন্ধিক, কোটবাড়ি, কুমিল্লা