বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতা : উপাদানসমূহ (৩য় পর্ব)

তিন
আমরা আরেকটা উদাহরণ দেবো পূর্ব-পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার বক্তব্য থেকে। এখানে তিনি সংবিধান ও নির্বাচনে মানুষের অধিকার প্রসঙ্গে বলেছেন। মানুষকে বিচার করতে হবে তার জন্ম পরিচয়ে, ধর্মের পরিচয়ে নয়। সে বিষয়টি বোঝাতে তিনি ১৯৫৬ সালে পূর্ব-পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় বলেছিলেন [আনিসুজ্জামান ( ২০১২ : ৭১)]:

দুই জাতির ভিত্তিতে আমাদের পাকিস্তান হয়েছে। এরপরও যদি আজকে আলোচনা করা হয় যে, পাকিস্তানে আমরা দুই জাতি, একটা হিন্দু আর একটা মুসলমান, তাহলে একটা প্রভোকেশন দেয়া হয়। আজ যদি পূর্ব-বাংলার এক কোটি হিন্দু বলে যে আমাদের আলাদা জায়গা অর্থাৎ একটা হিন্দু স্টেট দিতে হবে, তাহলে কি হবে? পাকিস্তানের খাতিরে, পাকিস্তানের ইনসাফের খাতিরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাতিরে আমি আমার বন্ধুদের অনুরোধ করবো তাঁরা যেন এই সেপারেট ইলেকটরেটের প্রস্তাব উইথড্র করেন।

এই যে গণমানুষের ঐক্যে তাঁর সুগভীর আস্থা, এ আস্থা শুরু থেকেই তাঁর ছিলো। আমরা দেখছি, অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগের কারণ হিসেবে জেল থেকে বলছেন [শেখ মুজিবুর ( ২০১৪ : ১২০)]:

“আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিৎ হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না।  এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই।” আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্ররাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ  বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধের পরিচয় ফুটে উঠেছে কারাগারের রোজনামচার একটি উক্তিতে। এটা ব্যক্তিগত উপলব্ধি তাঁর।  তিনি বলছেন, [ শেখ মুজিবুর (২০১৭ : ১৮৯)]: 

আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম। ...আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, চাকরদের জন্য আলাদা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সামন্তবাদ ছিল, তখন জমিদার, তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর শিল্প ও বাণিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনই এই রকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে। সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ।

এই যে জীবনোপলব্ধি এটাই তাঁকে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর দেখেছেন সর্বব্যাপী শোষণ। তিনি বলছেন, [শেখ মুজিবুর ( ২০১৪ : ২৪০-৪১)] : “পূর্ব বাংলার সম্পদ কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি গড়া যায় একদল পশ্চিমা নেতা ও বড় বড় সরকারি কর্মচারীরা গোপনে সে কাজ করে চলেছিল। ...শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ যে আশা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, যে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোনো নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না।” অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে চীন ভ্রমণের একটি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছেন [শেখ মুজিবুর (২০১২ : ২৩৪)]: “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে, তত দিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।” এভাবে তাঁর সক্রিয়তা আর রচনায় ঘুরে ফিরে আসে প্রান্তিকতা—সমাজের সংখ্যাগুরু শ্রেণি। এবং জীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, সাহসী রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে গিয়ে ৪৬ বছর বয়সে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা কর্মসূচী’র প্রথম দফার প্রথম অনুচ্ছেদে জনগণকে ক্ষমতার উৎস করে তুলছেন। তিনি বলছেন [ শেখ মুজিবুর (২০১৭, ৩১০)]: 

এই দফায় বলা হইয়াছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে। তাহাতে পার্লামেন্টারিপদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে। 

এ অনুচ্ছেদে গণ-মানুষের মত প্রকাশের শক্তিতে আস্থা স্থাপন করা হয়েছে। “সকল নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে” —এ দাবির ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচন হয় আরও ৪ বছর পর ১৯৭০ সালে। যে নির্বাচনে একটি কেন্দ্রের একজন প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে আনিসুজ্জামান বলছেন, [আনিসুজ্জামান (২০১৬, ১৫)]:

গণ-অভ্যুত্থানের সময় থেকে নির্বাচনের সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল এবং আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তবু জাতীয় পরিষদে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি (পরে মহিলা-আসনের সাতটির সবকটি) এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০র  মধ্যে ২৮৮টি (পরে দশটি মহিলা-আসনের সবকটি) আসন আওয়ামী লীগ পেয়ে যাবে, এমন কথা কেউ ভাবেনি। সাধারণ নির্বাচনে এতা বড়ো ম্যান্ডেট কেউ কখনো পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। অতএব ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণীত হবে এ নিয়ে কোনো সংশয়ের কারণ ছিল না। 

এ নির্বাচনই সাতই মার্চের ভাষণ অনিবার্য করে তোলে। যে ভাষণ সম্পর্কে রাজশাহী অঞ্চলের এক গ্রাম্য মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলাম বলেন [আফসান (২০১৯, ৮৩)], “১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর দেশের মানুষ সংগঠিত হওয়া শুরু করে। মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতে থাকে। সেই ভাষণ থেকে আমরা উদ্বুদ্ধ হই।” এ স্বর কামরুলের একার নয় এটা যে প্রান্তিক কৃষক-চৈতন্যের কথা আমরা শুরুতে বলেছি, সে চৈতন্যের যৌথ-স্বর। সে কারণে আফসান চৌধুরী মনে করেন [ Afsan (2020, 189)], ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে গ্রামগুলো সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। ঢাকা ক্রাক-ডাউনের পর প্রতিরোধের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রের মানচিত্র আঁকতে শুরু করে। এটাই ৭ই মার্চের ভাষণের অর্জন। একটি দেশ কেবল ভাষার ঐক্যে এক হতে পারে নি, ধর্মের ঐক্যে এক হয়েও এক থাকতে পারে নি। মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে আলাদা হয়ে গেছে। তাহলে কোন ঐক্যে এরা একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুললো? এদের আসলে মূল ঐক্য সংগ্রামশীল প্রান্তিকতায়, যার মূল সুরটা ধরতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ফলে মাত্র ২৪ বছরে সম্ভব হয়ে উঠেছিলো একটি দেশ — বাংলাদেশ। (সমাপ্ত)

 বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতা : উপাদানসমূহ (১ম পর্ব)

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতা : উপাদানসমূহ (২য় পর্ব)

গ্রন্থ ও প্রবন্ধপঞ্জি
আনিসুজ্জামান ২০১৬, আমার একাত্তর, সপ্তম মুদ্রণ, ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ
আনিসুজ্জামান ২০১২, বাঙালি সংস্কৃতি ও অন্যান্য, ঢাকা : জাগৃতি প্রকাশনী
আনিসুজ্জামান ২০১৯, সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি দশটি বক্তৃতা ,  ঢাকা :  প্রথমা প্রকাশন
আফসান চৌধুরী ( সম্পা.), গ্রামের একাত্তর, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা  ২০১৯
আবদুল হক ২০১৫, ‘ পূর্ব পাকিস্তান : বাংলাদেশ’, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ , ড. মাহবুব বোরহান ( সংকলিত), ঢাকা : 
কথাপ্রকাশ
জয়া চ্যাটার্জি ২০১৪, বাঙলা ভাগ হল , আবু জাফর (অনূদিত), ৩য় মুদ্রণ, ঢাকা : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস 
লিমিটেড
শেখ মুজিবুর রহমান ২০১৪, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রথম সুলভ সংস্করণ ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস 
লিমিটেড
শেখ মুজিবুর রহমান ২০১৭, কারাগারের রোজনামচা, ৩য় মুদ্রণ, ঢাকা : বাংলা একাডেমি
হারুন-অর-রশিদ ২০২০, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, ৬ষ্ঠ মুদ্রণ ঢাকা:  দি ইউনিভার্সিটি প্রেস 
লিমিটেড

Afsan Chowdhury 2020, Sheikh Mujibur Rahman and Bangladesh The Quest for a state (1937-71) 
Dhaka : Shrabon Prokashani
Ahmed Kamal 2016 , State Against the Nation,  First Paper Back Edition,  Dhaka: The University 
Press Limited


  ড. মো. মেহেদী হাসান, অধ্যাপক এবং প্রাবন্ধিক, কোটবাড়ি, কুমিল্লা

menu
menu