ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (২ কিস্তি)

তিন

তৃতীয় জীবনে প্রবেশের আগে সোলেমনের প্রথম জীবনের কথা আরো মনে পড়ছে। কীভাবে ওর প্রথম জীবনের নাটকীয় যবনিকাপাত হয়েছিল সে কথা সে ভুলে কী করে? তখনো সে দ্বিতীয় জীবনের কথা ভাবতে পারে নি। ওর মনে পড়ে, আরাকান ছেড়ে চলে আসার কিছুদিনের মধ্যেই আশ্রয়দাতার ঠিকানায় সোলেমনের ওর পিতার পত্র আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে তখন বুঝে নিয়েছিল, নাসাকা বারবার তালাশ করে ওকে ঘরে না পেয়ে প্রশ্ন করলে ওর পিতা-মাতা সদুত্তর উত্তর দিতে পারবে না। নাসাকার প্রশ্নের জবাবে একদিন হয়তো ওর পিতাও বলতে বাধ্য হবে, তার ছেলে আর বেঁচে নেই। অথবা বলবে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বললে বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। নাসাকা বারবার তালাশ করতে আসবে। যতবার নাসাকা বাড়িতে আসবে ততবারই কিছু না কিছু খেসারত দিতে হবে। অর্থকড়ি দিতে পারলেও খালি হাতে, কারো বাড়ি থেকে কিছু না নিয়ে তারা ফেরে না। আর রোহিঙ্গা ছেলে বাড়িতে না ফিরে আসাও অপরাধ। কেন আসে না, কোথায় গেছে, এনে ক্যাম্পে হাজির করতেও বলবে। সোলেমনের বেলায় ওর পিতার তো কোনো সদুত্তর নেই। উত্তর দিতে না পেরে শেষে ‘মরে গেছে’ বলবে। তখন নাসাকার লোক পরিবার পরিচিতি তালিকা থেকে ‘স মং খা’ নামটা কেটে মন্তব্যের ঘরে ‘মৃত’ লিখে দিয়েছে। তারপর পর কি আর আরাকানে ফিরে যাওয়ার পথ থাকে? এর পর সশরীরে ওর পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। মৃত ব্যক্তি আর কখনো পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারে না। যে নাম মৃত বলে খাতায় লেখা হয়ে গেছে সে জীবিত আছে এমন প্রমাণ করার আর কোনো সুযোগ থাকে না। পরিবার ঘোষিত মৃত ব্যক্তিকে জীবিত প্রমাণ করতে পারবে না কেউ। ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখার কোনো অজুহাত চলে না। একটা মানুষের নাম আর পারিবারিক ঠিকুজি তার বসবাস, ঠিকানা, জাতীয়তা, নাগরিকত্ব এসব কিছুর সঙ্গে জড়িত, যা আবার একটি ভূখণ্ড আর ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিরও বিষয়। সোলেমনের ঠিকুজিরই এখন আর বালাই নেই। সে যে পৃথিবীতে আছে সে কি ওর দেশে কখনো সে প্রমাণ দাখিল করতে পারবে? এভাবে সোলেমনের প্রথম জীবনের সমাপ্তি ঘটে। 

সোলেমন এখন জানে, পৃথিবী জুড়ে যত মানুষ তাদের স্বদেশ হারায় তাদের মধ্যে যারা নিজেদের দেশে ফেরত যেতে চাইলেও সকলেই যেতে পারে না। এমন কি, ইউএনএইচসিআর শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরত যেতে সহযোগিতা করলেও সকল উদ্বাস্তুকে কি তাদের নিজ নিজ মাতৃভূমিতে কখনো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে? পারে নি। 

সোলেমন মনে করতে পারে, একজন বাঙালি কবি লিখেছেন, ‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি।’ কবি আরো বলেছেন, ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা।’ কবিতাটা ছোটোবেলায় মাদ্রাসায় ওদের পাঠ্য ছিল। সোলেমন ভেবে অবাক হয়, বাঙালি কবি চিন্তায় কত উদার আর মানবিক। আর মাদ্রাসায় হুজুরও এমন চমৎকার করে কবিতাটা পড়িয়ে ছিলেন যে সোলেমনের মনে হতো যে কেউ কেবল এ কবিতা থেকেই বিশ্বাস করতে পারবে—মানবজাতি প্রকৃতই একক জাতি। হুজুর পবিত্র কোরানের আয়াত থেকেও বয়ান করতেন। কেবল ইসলাম নয়, সকল ধর্মই একক মানবজাতির কথা বলে। সকল ঐহিক ধর্মগ্রন্থে আদম আর হাওয়া মানবজাতির পিতামাতা বলে স্বীকৃত। পবিত্র কোরানে মানবজাতিকে এক জাতি বলেই আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। ইসলামের নবী বিদায় হজের বাণীতেও পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন, অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে মুসলিমদের সদাচরণ করতে বলেছেন। পৃথিবীর মানুষ যখন আরো বেশি কাছাকাছি এসেছে তখন সে দেখতে পাচ্ছে মানুষ যেন মানুষের নিকট থেকে বরং আরো দূরে সরে যাচ্ছে, দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। শুধু দূরে সরিয়ে দিয়েই সে থেমে থাকছে না, কী করে যাদের সে পছন্দ করছে না তাকে আরো বেশি কষ্ট দেয়া যায় সে অস্ত্র সেটা সামরিক বা মানবিক হোক প্রয়োগ করছে। আর এ মারণাস্ত্র সেটা যুদ্ধাস্ত্র হোক কিংবা বাণিজ্যিক কৌশলাস্ত্র হোক সেটা সাধারণ অসহায় মানবগোষ্ঠীর ওপরও কেবল ক্ষমতার দাপট দেখানো জন্য হলেও প্রয়োগ করছে। আর তাতে করে পুরো ভূগোলজুড়ে কোথাও কোথাও মানুষ আরো বিপন্ন হয়ে পড়ছে, ঘরবাড়ি, বসত এমন কি দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। সোলেমন বিশ্বাস করত, এখনো ওর বিশ্বাস অটুট আছে—মানুষের মধ্যে বিভেদ আর হানাহানি মানুষেরই সৃষ্টি। পৃথিবীর কোনো দেশ কিংবা নৃগোষ্ঠী পৃথিবীর সকল মানুষকে একক মানবের উত্তরসূরী বলে কখনো ভাবতে পারে নি, এখনো পারছে না। যদিওবা কখনো বর্ণ, কখনো ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেছে। অথচ কত কত বর্ণ আর রক্তধারা সহস্র নদীর ধারা মতো বৃহত্তর মানবসমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। আবার পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ আজ যারা সেসব দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ, এখন যে দেশটাকে তাদের নিজের বলে দাবী করছে সে দেশে এক সময় তারাই ছিল আগন্তুক, অভিবাসী, বহিরাগত। ইতিহাস বলে তারা সেখানে গিয়ে সেখানকার আদিবাসীদের বন্যপশুর মতো হত্যা করেছে। তাদের সম্পদ দখল আর লুট করেছে, ভূমি কেড়ে নিয়েছে, দাস বানিয়েছে, এমন কি স্থানীয় লোকবিশ্বাস আর লোকধর্মও পাল্টে দিয়েছে। তারাই আবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিয়েও কথা বলে। এটা যে তাদের এক ধরনের ভণ্ডামি সেটাও পণ্ডিতরা না বোঝার ভান করছে। পৃথিবী কখনো কোনো একক নৃতাত্ত্বিক মানবগোষ্ঠীর যেমন ছিল না তেমনি তামাম গোলকে বসবাসরত ভিন্ন ভিন্ন মানব গোষ্ঠী কখনো একই স্থানে বসবাস করত না। নৃতত্ত্বের ইতিহাসে এমন সাক্ষ্য প্রমাণ মেলে না। যারা এখন অন্যদের নিজেদের দেশে আসতে বাধা দেয়, কোনোভাবে এসে পড়লেও তাদের তাড়িয়ে দেয় সে দেশটা একসময় তাদের ছিল না। দেশের মাটি না বদলালেও দেশের সীমানাও যুগে যুগে বদলেছে। মানববসতির ভূগোলের এই বদলেও লোভী মানুষের ক্ষমতার প্রয়োগ সর্বযুগেই ছিল। কোনো ভূখণ্ডের সম্পদ লুণ্ঠন আর দখলই এই সীমানা বদলের মূল কারণ। একটা ভূখণ্ডকে বিজয়ীরা নিজেদের দেশ বানিয়েছে, আর বিজেতারা নিজের দেশে বসবাস করলেও অন্যদেশের নাগরিক হতে বাধ্য হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর বেলায়ও তাই হয়েছে। মানব-ইতিহাসের ধারায় কালক্রমে কতবার পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টেছে তার কি হিসেব আছে?
    
সোলেমন অতীত ভাবনা থেকে নিজের বর্তমানে ফিরে আসে। আর তখন আবার মায়ের মুখটাই মনের ভেতরে দেখতে পায়। সে ভাবে, হয়তো এ কারণেই সে মাকে দেখতে পায় যে সোলেমনের মা ওকে এখনো মৃত বলে মেনে নিতে পারে নি। ওর মা কখনোই যে ওকে মৃত মনে করেনি। মা ওর জন্য প্রতীক্ষায় ছিল। প্রতীক্ষা করে করে ১৯৯২ সালে শরণার্থীর বেশে বাংলাদেশে গিয়েছিল ওকে তালাশ করতে। তবু ওকে পায় নি। আর সে পেয়েও মাকে হারিয়ে ফেলল। যদি সোলেমন মাকে সেদিন পেয়ে যেত সে কী করত? ওর কী করার ছিল তখন? সে মাকে ফিরিয়ে নিতে পারত। কিন্তু সে তো মাকে নিয়ে দেশে ফিরতে পারত না। মৃত সন্তান তো জীবিত মায়ের সঙ্গে ফিরতে পারে না। সে তো মৃতের জীবন নিয়ে মায়ের পিছু পিছু আরাকান যেতে পারত না। এ কথা ভাবলে সোলেমনের তখন রুবিনার কথা মনে পড়ে। সে জোর দিয়ে বলেছিল, একদিন সে ওর মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে। সে ওর জন্মভূমি ফিরে পাবে। ওর আবার নতুন জন্মলাভ হবে। রুবিনার কথাও যদি সত্য হয়, তাহলে এটা সোলেমনের তৃতীয় জীবন।
      
আরাকানের সরকারি খাতায় ওর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সোলেমন বাংলাদেশের নতুন পরবর্তী জীবন পেয়েছিল। সেই পরজীবন নিয়ে বড় হতে হতে সোলেমন আরাকানের দাপ্তরিক মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ঘোষিত পারিবারিক মৃত্যুটাও মেনে নিয়েছিল। ফেলে আসা জীবনটার কথা ভুলে থাকতে ওর কৈশোরকেও সে বিসর্জন দিয়েছিল। দ্বিতীয় জীবনটার কথাও সোলেমন কিছুতেই ভুলতে পারবে না। ওর আশ্রয়দাতা মানুষগুলোকে ভুলতে পারবে না। একটা অসহায় কিশোরকে একটি পরিবার আশ্রয় দিল। ওর মা বাবা আর বোনের কথা ভুলে থাকতে আশ্রয়দাতা মামা-মামি আর তাদের সন্তানদের সঙ্গেও কথা বলতে চাইত না। অথচ তারা সবসময় ওকে পাখির ছানার মতো আগলে স্নেহের আগলে রাখত। শিমুল আর ফাতেমা ওর সঙ্গে গল্প করতে চাইত। কারো সঙ্গে কথাও বলতে চাইত না। সে কেতাবের পাতায় বেশি বেশি মনযোগ দিত আর প্রায়শ চোখ বন্ধ করে সবক মুখস্থ করে যেত। এমন কি পথ চলার সময় কারো দিকে তাকাত না। ওর গ্রাম আর ছোটো নদীটার কথা ভুলে থাকতে এখানকার গ্রাম কিংবা ছড়ার দিকেও তাকাত না। তবু মৃত আত্মার মতো শৈশবের জীবনটা সে নিজের ভেতরে বয়ে বেড়াত। তবু ধীরে ধীরে সেটা সে পরিত্যাগ করতে পেরেছিল। সে একটা নতুন জীবনই নয় কেবল একটা পরিবারও পেয়েছিল; যেখানে মাতা-পিতা আর বোনের মতো সদস্যরা ছিল। সে পরিবারের সদস্যের মতোই আদরযত্নে সে বড় হতে লাগল। 

দাখিল পাশ করার পর সোলেমনের আশ্রয়দাতা মামা ওকে আরেকটা জীবনে প্রবেশের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। সে যখন স্থানীয় মাদ্রসার পাঠ শেষ করল, তখন জানতে পারল ঐ পরিবারের একটি মেয়েকে ওর জীবন সঙ্গী করতে হবে। অথচ সে তখনো ওর জীবন নিয়ে কী করবে, সে বিষয়ে কিছুই ভাবে নি। নিজের জীবন নিয়ে যে ভাবে নি সে কী করে আরেকটা জীবন নিয়ে ভাববে? তবু সেকথা কাউকে সে বলতে পারে নি, এমন কি ফাতেমাকেও না। সোলেমন হেকিম আবুল হোসেনের পরিবারের আশ্রয়ে কাটানো পাঁচ বছরে বুঝতে পারে নি আসলে তিনিও সোলেমনের নতুন একটা জীবন চেয়েছিলেন। ওকে আশ্রয় দিয়ে তিনিও দিনে দিনে ওর একটা নতুন জীবন দেখার স্বপ্ন দেখতেন। ওর মনে হয়েছিল, আশ্রয়হীন একটি পশুকে পোষ মানানোর মতো, অথবা উন্মূল একটি গাছের চারাকে কোথাও রোপণ করে বাঁচানোর মতো। মানুষ কোনো প্রত্যাশা ছাড়া বুঝি কাউকে আশ্রয় দেয় না। অথবা দিনে দিনে কোনোভাবে প্রত্যাশা তৈরি হয়। একটি আশ্রিত প্রাণীও যদি কিঞ্চিত মূল্য ধারণ করে তখন তা পালনকর্তার মনে সামান্য হলেও স্বার্থপরতার জন্ম দেয়। হেকিম আবুল হোসেনের বেলায়ও সেটাই হয়েছিল হয়তো।
 
সোলেমন এখন বোঝে সেটা কোনো অন্যায় স্বার্থ ছিল না। যারা ওকে নদীর কাদা থেকে তুলে এনে লালন করেছে, তারা কি প্রতিদান হিসেবে কিছু চাইতে পারেন না? সে নিজে কি তাদের ঋণ কখনো শোধ করতে পারবে? অপরিশোধ্য ঋণের কথা মনে রেখেও তাদের মেয়ের সঙ্গে সোলেমন ওর বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিতে পারে নি। কী করে মেনে নেবে সে? যে যুবক নিজেকে জীবন্মৃত বলে মনে করে সে কেমন করে অপর একটি জীবনকে নিজের সঙ্গে জড়াবে? সে হেকিম আবুল হোসেন আর তার স্ত্রীর কোনো কসুরি দেখে না। তাদের তো ওর ভেতরের কথা জানার নয়। জীবিত মানুষের মনের কথা যেখানে মানুষ জানতে পারে না সেখানে মৃত মানুষের মনের কথা কী করে জানবেন? তাই তারা ওর কাছে প্রত্যাখাত হয়ে আহত হয়েছিলেন। স্বভাবিকভাবেই তারা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। আর তাদের মেয়ে ফাতেমাও কষ্ট পেয়েছিল।  

ফাতেমার চোখে কষ্টের আভা দেখে সোলেমন কেবল মনে মনে ওকে সান্ত্বনা দিতে পেরেছিল, জীবনহীন মানুষকে কখনো ভালোবাসতে নেই, ফাতেমা। ফাতেমা সোলেমনকে পছন্দ করত এসব ঘটনার পর সে বুঝতে পেরেছিল। সোলেমনের জন্য ফাতেমার অফুরন্ত সেবা নিবেদন আর সীমাহীন একাগ্রতা সে কেবল অনাথের প্রতি দয়া নয়, ভালোলাগার ফল্গুধারার মতো বইছিল। ওর দৈনন্দিন যত্নের মধ্যে যে ধীরে ধীরে ভালোবাসার পরশ মাখিয়ে দিচ্ছিল সেটা সে তখনো টের পায় নি। ভালোবাসা দেখার মতো চোখ আর বোঝার মতো মন ওর ছিল না। 

ফাতেমার যে ভালোবাসা সোলেমন পেয়েছিল, কিন্তু এর মর্ম বোঝে নি, মর্যাদা দিতে পারে নি। নারীর ভালোবাসা বুঝবার মতো মন অর্জন করতে হয়, বয়সের পরিপক্কতারও দরকার হয়। ভালোবাসা কী সেটা রুবিনার কাছে সে প্রথম বুঝতে পেরেছে। আর রুবিনার মধ্যদিয়েই ফাতেমা ওকে কতখানি ভালোবাসত সেটা অনুধাবন করতে পেরেছিল। কিন্তু রুবিনাকেও সে সেকথা কখনো বলে নি, বলতে পারে নি। আর ফাতেমার ভালোবাসা বুঝলেই কি তার দাম সে তখন দিতে পারত? ভালোবাসার দাম তো ভালোবাসাতেই মেটাতে হয়, আর কিছুতে তো তার বিনিময় হয় না। যদি মামা-মামির কথায় রাজি হয়ে সোলেমন ফাতেমাকে বিয়ে করত তাহলে সে পরগাছা হয়ে অনেক রোহিঙ্গা যুবকের মতো বাকি জীবনটা হয়তো বাংলাদেশে কাটাতে পারত। কিন্তু সে তো ওরকম কোনো জীবন চায় নি। সে কী যে চেয়েছিল আসলে জানতও না। কেবল এতটুকু জানত যে, ওর একটা জীবন ছিল যে জীবনে সে মৃত। ওর মা আছে, বাপ আছে, বোন আছে তবু তাদের কাছে সে মৃত। সে আর তাদের কাছে কখনো ফিরতে পারবে না। যদি একটা মাত্র নদীর ওপাড়ে গিয়ে এই মৃত জীবন থেকে পুনর্জীবন লাভ করতে না পারে তাহলে একটা পরগাছা জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কী দরকার? এমন একটা জীবনে সে কাউকে জড়াতে চায় নি। চায় নি বলেই তো সে রুবিনার ভালোবাসার মূল্যও দিতে পারে নি।  

আরো একবার পুনর্জন্ম হতে পারত সোলেমনের। প্রথমবার ওর বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা জেগেছিল যখন সে জেনেছিল ওর মা কেবল ওকে ফিরে পেতে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। ওর মা শেষ পর্যন্ত খুঁজে না পেয়ে ওর নাম ঠিকানা লেখা কাগজটা পরিবার পরিচিতির কাগজটা প্রত্যাবাসন ঘাটে শিমুলের কাছে রেখে গিয়েছিল। এবং বোটে উঠবার আগে বলে গেছে মা তার ছেলেকে খুঁজে পায় নি, যদি কেউ এ কাগজে লেখা তার ছেলেকে খুঁজে পায় তাহলে যেন ওকে বলে যে, ওর মা ওর খোঁজে বাংলাদেশে এসেছিল। সেদিন সোলেমন আবার জীবন পেয়েছিল। মায়ের কাছে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা জেগেছিল ওর। সে ছুটে যেতে চেয়েছিল মায়ের কাছে। যখন সে জেনেছিল আরাকানে ফিরে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ওর মা ওকে তালাশ করে গেছে তখন যে করেই হোক মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছু মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু সেটা যে সম্ভব ছিল না, তা ওর বস বুঝেছিল। ওর বস ওকে যেতে দেয় নি। আর তখন ওকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল রুবিনা। রুবিনা ছাড়া আর কারো কথায় সে হয়তো নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পারত না। আরাকানে তখন ফিরে গেলেও যে মায়ের দেখা সে পেত না, ওকে যে কারাবাস অথবা বাস্তবিক কবরবাসী হতে হতো সেটা সে পরে বুঝেছিল। তখন ওর মনে পড়েছিল, মৃত সন্তান তো মায়ের কাছেও ফিরে যেতে পারে না। সে বুঝেছিল মৃতদের যেমন জীবন নেই, তেমনি ওর আবেগ অনুভূতিও থাকতে নেই।
 
আর শেষবারও নতুন করে বেঁচে থাকার সাধ জাগিয়েছিল রুবিনা। তাই সে সাইপ্রাস যেতে পেরেছিল। রুবিনা বলেছিল, তুমি বাংলাদেশে থাকলে হয়তো কখনো যেতে পারবে না, যদি তুমি আরাকানে তোমার জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পার তাহলে যেতে পারবে। তুমি তোমার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য যদি কাজ করতে চাও তাহলে তাদের যন্ত্রণার কথা আন্তর্জাতিক মহলে তোমার মতো করে জানাতে চেষ্টা করো। বিশ্বের সহযোগিতা ছাড়া তুমি তোমার তোমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। সোলেমন বাংলাদেশ ছেড়ে স্বীকৃতিহীন মানুষের কথা, উদ্বাস্তু জীবনের কথা আর ওর গোত্রের কথা বিশ্বকে জানাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিশ্ব তো আরাকানের দিকে আজো তাকাচ্ছে না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বার্মিজ শাসকদের নিপীড়ন-নির্যাতন নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো কথা বলে নি। (চলবে)


সোলেমন (১ কিস্তি)

menu
menu