ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন
লেখকের কথা
এই উপন্যাসটি, অর্থাৎ সোলেমন লিখতে হবে এই তাগিদ ২০১০ সাল থেকে অনুভব করছিলাম। এই উপন্যাসের আগে লিখেছিলাম উদ্বাস্তু। প্রসঙ্গত বলি, আমার প্রথম উপন্যাস উদ্বাস্তু ২০০২ সালে লিখে শেষ করি, তখনই লেখক হিসেবে আমার আশঙ্কা ছিল, আমি উপন্যাস শেষ করলেও খুব শিগগিরই হয়তো রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু জীবনের অবসান হবে না। কারণ, ১৯৯৪ এর মে থেকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর সময়কালে যখন আমি রোহিঙ্গা শিবিরে দায়িত্ব পালন করছিলাম, তখন আমরা যে দু লাখেরমতো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে পেরেছিলাম, তাদের অভিজ্ঞতার বয়ান, মুখের অভিব্যক্তি আর আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ আমাকে সন্দেহপ্রবণ আর শঙ্কিত করে তুলছিল। তখনই আমার মনে হতো এই জনগোষ্ঠীর ক্রান্তিকাল সহসা কাটবে না। এর বহিঃপ্রকাশ আমরা ২০১২ থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, এদের সংকট ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভাবতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়, দুটি দেশের মধ্যে সীমিত কূটনৈতিক উদ্যোগ আর আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান নাও হতে পারে। লেখক হিসেবে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের একটা প্রচেষ্টা ছিল ২০১৪ সালে উদ্বাস্তু উপন্যাসের ইংরেজি রূপান্তর, A Tale of Rohingya । ইংরেজি উপন্যাসটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে আরাকানে যা ঘটার আশঙ্কা ছিল তা ঘটে গেছে। সরকারি নীতিগ্রহণের বিষয়ে একজন লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনা বা মতামত প্রদানের সুযোগ নেই। তবে কোনো বিষয়ে একজন লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনা তার লেখার মাধ্যমে বৃহত্তর পাঠকের কাছে সেটা পৌঁছাতে পারে। এ রকম ভাবনা থেকে গত দশ বছর আরাকান ও রোহিঙ্গাদের সমস্যার ওপর আমার নিরবিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন পঠনপাঠন চলতে থাকে। এই পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান, তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ, অনুধাবন আর পর্যালোচনার ফসল সোলেমন উপন্যাস। অবশ্যই বলে রাখা উচিত, আমি কোনো জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস রচনা করি নি, ইতিহাসে আমার অফুরন্ত আগ্রহ থাকলেও আমি কখনো নিরেট ইতিহাস চর্চা করি নি। তবে আমার সাহিত্য রচনা যেহেতু স্থানকাল নির্বিশেষে মানব জীবন ও তার যাত্রাপথের পূর্বাপর অনুসন্ধানের একটি অনুসন্ধিৎসা থাকে সেহেতু মানব সমাজ আর তার সময়কে সাহিত্যে ধারণ করবার জন্য একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবে খানিকটা ইতিহাসের আশ্রয় আমাকেও নিতে হয়েছে। ইতিহাস কিংবা এর বাইরে যা যা পাঠ করেছি, সে কেবল আমার অজ্ঞতা দূর করা এবং বোধের পরিধি বাড়ানোর জন্য, কোনো ইতিহাসের লেখককে প্রশ্ন বা তার তথ্য খারিজ করার জন্য নয়। সোলেমন উপন্যাস এবং এর পূর্বভাগ উদ্বাস্তু উপন্যাসে যতটুকু ভূগোল, অর্থনীতি বা ইতিহাসের ব্যবহার আমি করেছি তার উৎস ও সংক্ষিপ্ত তথ্যসূত্র পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে উপন্যাসের শেষে উল্লেখ করেছি। পরিশেষে আমি বিশ্বাস করি, সোলেমন উপন্যাসও এর পূর্বভাগ উদ্বাস্তু উপন্যাসের মতো পাঠক কথাসাহিত্য বলেই সাদরে গ্রহণ করবেন।
এক
আকাশে ভাসতে ভাসতে সে মনে মনে একটি গ্রাম, গাছপালায় ঘেরা গুচ্ছ গুচ্ছ ঘরবাড়ি, একটি আঁকাবাঁকা নদী, স্বচ্ছ জলের তলে চকচকে ছোটো মাছ আর ফসলের মাঠ দেখতে পাচ্ছে। মাঠে কৃষকেরা ধান কাটছে। একটি বালক ওর পিতার সঙ্গে মাঠে ধান কেটে চলেছে। সে দেখে, উঠোনে রাশি রাশি ধান। ওর মায়ের মুখের বরণ পাকা ধানে। ধানের ক্ষেতে বাতাস ঢেউ খেলে যেন মৃদু বাতাসে উড়ে মায়ের শাড়ির আঁচল। সে আরো দেখে, একটা ছোটো নদী এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। এর বাঁকে দহের স্বচ্ছ জলের তলে চকচকে পুঁটিমাছ। একটি কিশোর ছিপ হাতে বরশিতে তুলে আনছে। আর ওর পাশে একটি কিশোরীর মুখ, খুশিতে ঝলমল। ওর শরীর জড়িয়ে আছে খোলসে মাছের রঙমাখানো রঙিন থামি। তারপর ...
সে যখন কৈশোরে ফিরে গেছে, যখন ভুলে গেছে দুই যুগ পেছনে চলে গেছে তখন সিটবেল্ট বেঁধে নেবার জন্য যাত্রীদের অনুরোধ করা হয়। জানানো হয়, আর ত্রিশমিনিট পর প্লেনটা মাটি স্পর্শ করবে।
অ্যারোম্যাপে গন্তব্যের স্থানিক অবস্থান আর পৌঁছানোর সময় দেখা যাচ্ছে। প্লেনের গন্তব্য নির্দেশক ম্যাপে প্লেনটি একটি রেখা তৈরি করে ইয়াঙ্গুন থেকে গাঢ় সবুজ আর সুনীল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অপর একটি বিন্দুর কাছে পৌঁছেছে। কিছুক্ষণ পরই এই বিন্দুতে প্লেনটা অবতরণ করবে। এই বিন্দুটি সিটোয়ে। মানে আকিয়াব বন্দর, নাম বদলে ফেলায় এখন সিতোয়ে। যেমন রেঙ্গুন বদলে ইয়াংগুন।
পথরেখার বিন্দু থেকে আরেকটি একটি সাদা আঁকাবাঁকা পথের মতো রেখা আরো উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে যেতে আরো পীতাভ সবুজের ভেতর হারিয়ে গেছে। রেখাটির দু’পাশে পর্বতমালার চিহ্ন। সোলেমন চিনতে পারছে, রাজপথ-সদৃশ রেখাটি আসলে কালাদন নদী। দুটি বিশাল পর্বতশ্রেণির মধ্যদিয়ে প্রবাহিত এ নদীটা আরাকানের চারটা বৃহত্তর নদীর একটা। মূলত আরাকানি সভ্যতা এ নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে।
বাইরের তাকিয়ে সোলেমনের মনে হতে থাকে, প্লেনটা যতই মাটির কাছে নেমে আসছে সে ক্রমশঃ মায়ের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। মায়ের মুখটাও সোলেমনের মন থেকে মুছে যাচ্ছে না। ওর মনে এরকম বোধ জাগে যেন প্লেন থেকে নামলেই মায়ের কাছে ছুটে যেতে পারবে, দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে।
সোলেমন জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বিস্তীর্ণ সবুজে ছাওয়া কালাদন উপত্যকা। সুউচ্চ মন্দির-চূড়ার মতো পাহাড়গুলোর চূড়া যেন আকাশের গায়ে গিয়ে ঠেকতে চাইছে। ধীরে ধীরে ওর চোখের সামনে মায়ু পর্বতমালা আর উপত্যকা পরিষ্ফুট হয়ে উঠছে। আঁকাবাঁকা পথের মতো প্রবাহিত নদীটার বিস্তীর্ণ দু’পাশে পীতাভ অন্ধকার। যতদূরে চোখ যায় গাঢ় সবুজ অধিকতর গাঢ় হতে থাকে। একসময় মাথার উপর নীলছোঁয় সফেদ মেঘের ভেলা স্থির ভাসতে থাকে। এর পর গাঢ় সবুজ পর্বতমালার উপর দিয়ে অ্যারোপ্লেনটা চক্কর দিতে থাকে। সোলেমন একটা সুবিস্তৃত পর্বতমালা দেখতে পায়।
অতঃপর প্লেনের ভেতর আলো জ্বলে উঠল। প্রথমে বার্মিজ তারপর ইংরেজি ভাষায় ঘোষণা করা হয়, আমরা সিটোয়ে এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে যাচ্ছি। মায়ানমারের ঐতিহাসিক পুরার্কীতিসমৃদ্ধ রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় বাণিজ্য নগর সিতোয়েতে তোমাকে স্বাগতম।
পর্বতের চূড়ার বদলে প্রাচীন প্যাগোডার চূড়া ঝলকমাত্র দৃষ্টি ছুঁয়ে হারিয়ে গেল। তার পর কাছের পাহাড়গুলো চোখের আড়াল হয়ে গেল। সাগরের বুকে অফুরন্ত নীলের উপর বিশালাকার জলকপোতের মতো অসংখ্য ভাসমান জলযান দেখা গেল। তার পর আরো নিচে সারি সারি বৃক্ষরাজি দ্রুত দৃষ্টিসীমা থেকে সরে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেনটা রানওয়ে স্পর্শ করল। ছুটতে ছুটতে একসময় ধীরে ধীরে স্থির হয়। টার্মিনাল থেকে খানিটা দূরে খোলা চত্বরে প্লেনটা মাথা ঘুরিয়ে থেমে গেলে দরোজা খুলতে না খুলতেই যাত্রীরা উঠে দাঁড়িয়ে মাথার উপরের ক্যারিয়ার থেকে যার যার ব্যাগেজ নামিয়ে নিতে থাকে।
ভিড় এড়ানোর জন্য অথবা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সোলেমন অপেক্ষা করতে থাকে। প্লেনটা প্রায় খালি হয়ে গেলে, বলা যায়, সব যাত্রীর শেষে সে উঠে দাঁড়ায়, ক্যারিয়ার থেকে ব্যাগটা নমিয়ে দরোজার দিকে এগিয়ে যায়। বিমানবালাগণ সর্বশেষ যাত্রী হিসেবে ওকে ধন্যবাদ জানাতে পারল।
বার্মিজ আর ইংরেজি ভাষায় ‘স্বাগতম’ লেখা কাচের দরোজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সোলেমন একবার পেছন দিকেও তাকাল। এয়ারপোর্ট সীমানার বাইরে, দূরে, সারি সারি পাহাড়, তারপর পীতাভ পর্বতমালা। পর্বতশৃঙ্গের উপর ঝলমল করছে রোদ।
ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে যেতে থাকে সোলেমন। নিজেকে ছাড়া প্লেন থেকে অবতরণকারী স্বল্পসংখ্যক যাত্রীদের সবাইকে বার্মিজ অথবা নিকটবর্তী কোনো এশীয় দেশের নাগরিক বলে মনে হয়। প্লেন থেকে নামবার পর প্লেনের ভেতরে বসে যা ভাবছিল সেটা ঝেড়ে ফেলতে চায়। সে একজন বিদেশি নাগরিক, এর বাইরে ওর মনে আর কোনো ভাবনা স্থান দেবার উপায় নেই। তবু সে যা ভাবছিল সেটা ওর মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না। বিশেষ করে উঠোনে দাঁড়ানো মায়ের মুখটা ওর মনের ভেতর দাঁড়িয়ে তখনো হাসতেই থাকে। যেন মা ওর প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এয়ারপোর্টে নেমে এ দেশটাকে বিদেশ ছাড়া আর কিছু ভাবতে যাওয়া ওর জন্য খুবই বিপদজ্জনক হবে, সে বোঝে। সে সেকথা নিজেকেও বোঝায়। পাসপোর্টটা পকেট থেকে বের করে হাতে নিয়ে নেয়, এটাই প্রমাণ করবে সে কে এবং এগিয়ে যায় কাউন্টারের দিকে।
বিদেশি, অফিসিয়েল পাসপোর্টধারী যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে কোনো যাত্রী নেই। কাউন্টারের ভেতর একজন নারী অফিসার কর্তব্যরত। সে কাউন্টারের কাচের তলের ফোকর গলিয়ে ওর পাসপোর্ট এগিয়ে দেয়। ওর পাসপোর্ট হাতে নিয়ে অফিসার একবার ওর মুখের দিকে তাকায়। তারপর পাসপোর্টটা নাড়াচারা করতে করতে জিজ্ঞেস করে, মিস্টার সালিম খ, হোয়ার আর ইউ ফ্রম?
—আ’ম ফ্রম ফ্রান্স।
—আর ইউ ফার্স্ট টাইম ইন রাখাইন, আই মিন সিটোয়ে?
—সে একটা ধাক্কা খায় এবং সামলে নিয়ে উত্তর দেয়, ইয়েস।
—হোয়াটস ইউর পারপাস অব ভিজিট?
—ফরেইন এমপ্লয়মেন্ট।
—হু ইম্পলয়েড ইউ?
—ইউএনডিপি।
—আর ইউ এন ইউএন এমপ্লয়ি?
—ইয়েস।
—হাউ লং উইল ইউ স্টে হেয়ার?
—টিল অথরিটি ডিজায়ার।
—হু ইজ দি অথরিটি?
—ইউএনডিপি এন্ড ইউর গভর্নমেন্ট অলসো।
—ওকে, ওয়েট।
—ওকে।
পাসপোর্ট হাতে নিয়ে নারী অফিসার আরেকটা কাউন্টারে যায়। আরেকজনের সঙ্গে কিছু একটা পরামর্শ করে। এর পর সেই সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে অন্য কোথাও, দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। তাহলে কি ওকে সন্দেহ করছে? সোলেমন ভাবে তবু নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে থাকে। এয়ারপোর্টে অনেক যাত্রীকেই এমন বিড়ম্বনায় পড়তে দেখা যায়। পর্যটকসুলভ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সে আশপাশ দেখতে থাকে।
পরপর তিনটা কাউন্টার। পাশের কাউন্টারে যে দু’একজন পাসপোর্ট হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, অফিসার উঠে গেছে দেখে তারা পরের কাউন্টারে চলে গেছে। যাত্রীদের চেহারা আর পরিচ্ছদ দেখে সে আন্দাজ করে সকল যাত্রীই হয়তো বার্মিজ নাগরিক। তাদের কেউ কেউ দূর থেকে ওর দিকে খেয়ালও করছে। কেউ কেউ যে ওকে নিয়ে বার্মিজ ভাষায় কথা বলছে স্পষ্ট না হলেও কিছু শব্দ ওর কানে আসছে। তারা ওর চেহারা আর লেবাস নিয়ে কথা বলছে।
কেউ একজন বলছে, সাংবাদিক হতে পারে।
আরেকজন তার উত্তরে বলছে, বিদেশি কোনো সাংবাদিককে এ রাজ্যে প্রবেশ করতে দেয়ার কথা না।
এখন তো আর বিদেশি নাগরিকের এখানে আসতেও বাধা নেই। তাহলে অত সন্দেহ করবার কী আছে!
লোকটাকে দেখে তো এশীয় কোনো দেশেরই মনে হচ্ছে। সে এখানে কী করতে এসেছে?
কোনো বিদেশি সংস্থায় হয়তো কাজ করে।
ভারতীয় হতে পারে।
হতে পারে।
এদের কথার ধরন, চাহনি আর ইমিগ্রেশন অফিসারের আচরণ থেকে সোলেমন আন্দাজ করে এখানে তারা কোনো বিদেশি আসাটা প্রত্যাশা করে না। অথবা আসতে দেখে না। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে আর আলাপচারিতার ধরন দেখে ওর মনে হচ্ছে তারা ওকে একটা উটকো ঝামেলা বলেই হয়তো বিবেচনা করছে।
এমনটা হবে সোলেমন ভাবে নি। বিদেশিদের ব্যাপারে এখন আর ওদের এত রক্ষণশীল আচরণ করার কথা নয়। দেশটি সামরিক শাসনামলের রক্ষণশীল নীতি পরিত্যাগ করে উদারনীতি গ্রহণ করেছে। প্রচারমাধ্যমে এমনটাই এখন প্রচার চালাচ্ছে। আর বিদেশি পত্রপত্রিকায়ও এর সপক্ষে নানারকম সাফাই খবর প্রচারিত হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে ক’বছর যাবতই মায়ানমারের শাসকদের উদার উন্নয়ন নীতির প্রশংসা করে অর্থনীতি আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকগণ নানারকম নিবন্ধ লিখছেন। বিশ্বব্যাংক আর এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইতিধ্যেই মায়ানমারে প্রচুর অর্থ লগ্নি করছে। এদের মধ্যে ইতিমধ্যেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে কে কীভাবে এবং কত বেশি পরিমাণ অর্থ এখানে বিনিয়োগ করবে। চীনের বিনিয়োগ এখানে আগে থেকেই ছিল। মায়ানমারের সেনাবাহিনী চীনের অনুগত বাহিনীর মতোই আচরণ করে। সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে মায়ানমারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। অংসান সু চির দল সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির পর লাভজনক বিনিয়োগ করতে পাশ্চাত্যের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন। দেশটির শিক্ষা উন্নয়নে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম জোরদার করেছে। এসব দিক বিবেচনা করলে বিদেশিদের আসতে বাধা দেবার কথা নয়।
দুই
সোলেমন ফরাসি পাসপোর্ট নিয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা হয়ে এ দেশে কাজ করতে এসেছে। আইন ও নীতিগত দিক থেকে ওকে বাধা দেবার সঙ্গত কোনো কারণ নেই। ওকে ফিরিয়ে দেবার কথা নয়। ফিরিয়ে দিলে বিদেশি পত্রপত্রিকায় সমালোচনা হবে, মায়ানমারের বিনিয়োগ আগ্রহ সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিতে পারে। বরং ইউরোপের লোকজনের আগমন সহজভাবেই গ্রহণ করার কথা। তাহলে কি ইউরোপ সম্পর্কে এদেশের প্রশাসনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির এখনো পরিবর্তন ঘটে নি? আবার এমনটাও ভাবে সোলেমন, হয়তো সে যা ভাবছে বিষয়টা আসলে সেরকম নয়। বিশ্বের সব দেশেই এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের কড়াকড়ি চোখে পড়ে। নয়-এগারোর সন্ত্রাসী হামলার পর কেবল পাশ্চাত্য নয়, প্রাচ্যের দেশগুলোও স্ব স্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নীতি গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের নিরাপত্তা নীতির প্রভাব এশিয়াতেও পড়েছে। এখন কেউ আর কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। জঙ্গিবাদী আক্রমণ কোথায় কীভাবে কার পরিচয়ে হবে কে বলতে পারে? আর মায়ানমার তো বহু আগে থেকেই বিদেশিদের ঢুকতে দেয়ার ব্যাপারে অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। আসার আগে এসব বিষয় ভেবে চিন্তেই সোলেমন মায়ানমার এসেছে।
কিন্তু লেবাস আর নাম বদল হলেও সোলেমন তো বদলায় নি। বাইরের বদল কি ওর নৃতত্ত্ব আর অতীত আড়াল করে রাখতে পারবে? ভেবে ভেবে কিছুটা বিচলিত বোধ করতে থাকে সে। আর তখন কে যেন ভেতর থেকে ওকে বলে, এমন করে ভাবলে হবে না। তুমি আর স মং খাঁ নও। তুমি সালিম খ। একজন ফরাসি নাগরিক।
সোলেমন ভেবেছিল, মায়ের দেয়া স মং খা যখন একবার মরেছে, তখন পিতার দেয়া সোলেমনও না হয় আবার মরল। সোলেমন সালিম খ হয়ে গেলেও ওর কিছু করার ছিল না। ওর তো কেবল নাম নয়, জীবনও দুবার বদল হয়েছে। এবার সে তৃতীয় জীবনে সে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
সাইপ্রাসের মিশন শেষে সোলেমন ফ্রান্সে চলে গিয়েছিল। ফরাসি নাগরিকত্ব পাওয়ার সুবিধার্থে সাইপ্রাসের ইউএন মিশন থেকে পাঠানো কাগজপত্রে ওকে একজন ‘বাধ্যতামূলক দেশান্তরী হওয়া উদ্বাস্তু যুবক’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। ‘মানবিক আশ্রয় দরকার’ লিখে ফরাসি সরকারের কাছে ওর আশ্রয়ের সপক্ষে জেনেভা থেকে সুপারিশও করেছিল। আর এভাবেই ওর ফ্রান্সে আশ্রয় লাভের সুযোগ হয়েছিল। সোলেমনের আফ্রিকান ইউএন বস ওকে পরামর্শ দিয়েছিল, ফ্রান্সে গিয়ে কিছু একটা করতে চেষ্টা করো, আর কোনো কাজ জোটাতে না পারলে অগত্যা কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাবে। এ জন্য কিন্তু ইংরেজি জানলেই হবে না, তোমাকে অন্য কোনো একটি ইউরোপীয় ভাষা, সম্ভব হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফরাসি অথবা হিস্পানি শিখে ফেলতে হবে।
ফ্রান্সে প্রাথমিক আশ্রয় লাভের পর কাজ জোটাতে না পারলেও মানবিক কারণে আশ্রয় লাভের সুযোগ পাওয়ায় সরকার থেকে একটা ভাতা মঞ্জুর করা হয়েছিল। বেকার জীবনে ফরাসি ভাষা শেখায় সে মনযোগ দিয়েছিল। একবছর ফরাসি শেখার পর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাধ্যতামূলক দেশান্তর ও এর কার্যকারণ’ বিষয়ে গবেষণার জন্য আবেদন করলে সোলেমন দেশান্তর ইতিহাস বিভাগে গবেষণার সুযোগও সহজেই পেয়ে যায়। অচিরেই এই বিষয়ে দু’একটি লেখা শরণার্থী বিষয়ক খ্যাতিমান জার্নালে পাঠালে সেগুলো প্রকাশিত হয়। নিবন্ধগুলো মানবাধিকার ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা ও গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। যদিও প্রবন্ধগুলো সে তেমন কসরত করে লিখে নি। সে অন্যদের মতো তথ্য তুলে ধরে ভারাক্রান্ত করতে চায় নি। বরং নিজের জীবন আর শরণার্থী শিবিরে কাজ করার অভিজ্ঞতা সে সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরেছিল মাত্র। এসব লেখা ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করলে সে অবাকই হয়েছিল। আর প্রবন্ধ প্রকাশ হওয়ার পর পরই শরণার্থী সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য টেলিভিশন থেকেও ওর ডাক আসতে শুরু হয়। কেন লোকজন তাদের নিজ দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রথমেই নিজের কথা ওর খুব করে মনে পড়ত। সে ওর অভিজ্ঞতার আলোকে সে কথা বলত। সে ওর স্মৃতি থেকে প্রশ্নের জবাব দিত।
প্রথম যেদিন সোলেমন কথা বলছিল, ওর চোখের সামনে সেদিন সেই ছোটো নদীর তীরের পাহাড়ের পাদদেশের একটি গ্রাম ভেসে উঠেছিল। কিন্তু নিজের অতীত আড়াল করে রেখেই বিষয়টাকে বৈশ্বিক সমস্যার প্রেক্ষাপটে সরলীকরণ করে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিল। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর মর্মবেদনা শ্রোতা আর দর্শকের সামনে তুলে ধরেছিল। কোনো বিশেষজ্ঞের মতো নয়, একজন গল্পকারের মতো হৃদয় থেকে তুলে আনা সরল কথকতায় সাবলীল ভাষায় সে ওর অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছিল। যার সারকথা হলো : নৃতাত্ত্বিক আর ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন হলে এ যুগেও কোনো একটি ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠের বৈরিতার শিকার হয়। ইহুদিদের বেলায় যা ঘটেছিল অন্যদের বেলায় পৃথিবীর কোথাও কোথাও এখনো তাই ঘটছে। ভূগোল আর ধর্মভেদেও এই নৃতাত্ত্বিক বৈরিতার ধরন একই রকম দেখা যায়। অতীতে যা ছিল নৃতাত্ত্বিক এখন তা ধর্মীয় মতবাদের আশ্রয়ে উগ্ররূপ ধারণ করছে। মুক্ত চিন্তার বিকাশ কেবল পণ্ডিতদের চর্চার ক্ষেত্রে সীমিত হয়ে যাচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুসারীরা ধর্মের মর্মবাণী উপলব্ধি মানবকল্যাণে কীভাবে আরো বেশি এর তাৎপর্য তুলে ধরা যায় সে প্রয়াসের স্থলে সংঘবদ্ধ ধর্মাচরণের মধ্যদিয়ে ধর্মকে রাজনীতিকীকরণের দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়ছে। এমন কি এশিয়ায়, যেখানে রাজনীতির ধর্মীয়করণ ঘটে গেছে বহু আগেই, দলের নেতৃত্ব যা সাধারণের আচরণের মধ্যে প্রয়োগ করতে শুরু করেছিল ঔপনিবেশিক যুগের শেষ দিকে তা আবার দেশে দেশে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বিশেষ করে, আগে যা ভারতীয় উপমহাদেশে সীমিত ছিল এখন সেটা মহাদেশে ব্যপ্ত হয়েছে। সম্প্রদায় বিশেষের ওপর রাষ্ট্র খড়গহস্ত আচরণ করছে। লালপতাকাধারী চীনও এখন আর জাতিগত ও ধর্মীয় নিপীড়নে পিছিয়ে নেই। উঁইগর সম্প্রদায়ের ওপর চীন যে নির্যাতন চালাচ্ছে সেটা তো ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ধ্বজাধারী প্রকৃতির। তার প্রভাব পড়ছে মায়ানমারের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী আর আস্তিক সম্প্রদায়ের অবৌাদ্ধিক জনগোষ্ঠীর ওপর। ইউরোপেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না, যদিও ইউরোপ রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছিল, কিন্ত শেষ পর্যন্ত পারে নি। পারে নি যে, এর নগ্নতম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল বসনিয়া-হারজেগোবিনায়। আর আমেরিকা তো কখনই অসম্প্রদায়িক ছিল না। সে তো সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য তামাম দুনিয়ায় ধর্মকে ব্যবহার করছে, মধ্যপ্রাচ্যে তো তেলের চাইতে ধর্মের মশাল মিসাইল হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশ্চাত্য-পণ্ডিতদের মুক্তচিন্তার প্রভাব রাজনীতিতে এখন আর নেই। এমন কি প্রাচ্যবাদ নামে যে নতুন চিন্তা নিয়ে এসেছেন কেউ কেউ তাও হালে পানি পায় নি। এসব কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে মুখরোচক খাবারের মতো উপাদেয় হয়ে আছে। এক সময় ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের প্রচেষ্টা ছিল ধর্মের আচ্ছাদন থেকে চিন্তাকে বের করে নিয়ে আসা। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। যারা ধর্মের অনুসারী তারা ধর্মের বাইরে গিয়ে দর্শন চর্চা করতে রাজি হয় নি। আর যারা দর্শন চর্চা করে তারা ধর্মকে বর্তমান জমানায় দর্শন হিসেবে পুরোনো বলে গণ্য করে। এই দ্বান্দিক অবস্থানের কারণে পৃথিবী প্রধানত দুভাগে, এর পর নানা ধর্মের বিশ্বাসের ভিত্তিতে বহুধা বিভাজিত হয়ে আছে। ফলে মানব সমাজ আর পৃথিবীও বিভক্ত হয়ে আছে। আর এ সঙ্কট মানুষে মানুষে আস্থার সঙ্কট তৈরি করেছে। এসব বিষয় নিয়ে সোলেমন কথা বলে। কোনো পক্ষে না গিয়েও অতিসরল ভাষায় সে বিষয়গুলো উপস্থাপন করে। না করেও ওর উপায় নেই। কারণ, সে ভালো ফরাসি জানে না। এমন কি ইংরেজিও না। আবার সে খেয়াল করেছে, দর্শক-শ্রোতার কাছে ওর মতো একজন বিদেশির মুখে ভাঙা ভাঙা ফরাসি উচ্চারণে অভিজ্ঞতালব্ধ বক্তব্য বেশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল। টেলিভিশন প্রযোজকও ওর স্টাইলটা বেশ ভালোভাবেই নিয়েছিল।
ফ্রান্সে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করলে সোলেমনের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ওর উকিল আদালতে উপস্থাপন করেছিল যে, আক্ষরিক অর্থেই সোলেমন এক উদ্বাস্তু। সে যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছে, মায়ানমারের রাজধানী থেকে অনেক দূরের একটা রাজ্য আরাকানে লক্ষ লক্ষ মানুষ শত শত বছর ধরে বসবাস করেও উদ্বাস্তু হয়ে আছে। সেখানে তারা জন্মগ্রহণ করে, আরাকানের মাটিতে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে, সেখানেই তারা মৃত্যুবরণ করে। সে ভূমি ছাড়া তাদের আর কোনো মাতৃভূমি বা দেশ নেই। তবু যুগ যুগ ধরে তাদের নাগরিকত্ব নেই, জন্মভূমির মাটি আকড়ে থাকতে চাইলেও তারা সেখানে শেকড় মেলতে পারে না, সে মাটির অধিকার তারা পায় না। তাদেরই একজন সোলেমন, সামরিক জান্তার অত্যাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। স্বদেশে ফিরে যাওয়া ওর পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। আর এরকম বাধ্যতামূলক স্বদেশ ছেড়ে আসা লোকদের মানবিক আশ্রয় দেয়া ফ্রান্সে আইন-স্বীকৃত।
আদালত আদেশে বলেছিলেন যে, যত দিন না সালিম খ ওর নিজদেশে ফিরে যেতে পারে, অথবা স্বেচ্ছায় অন্য কোনো দেশে চলে না যায় ততদিন যেন ওকে ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত করা না হয়। আর সে যদি ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী যথা সময়ে নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করে ওকে যেন পাসপোর্ট দেয়া হয়। ফরাসি পাসপোর্টে সোলেমন খান হয়ে গেল সালিম খ। (চলবে)
কথাসাহিত্যিক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৬৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ৬ টি। ভোরের জন্য প্রতীক্ষা, উত্তরসূরিগণ, রবীন্দ্রনাথ উপমা এবং আমি, মরণ চাঁদের রবীন্দ্রনাথ, মাননীয় মন্ত্রীর জন্য মানপত্র, পুষ্পিত ফাগুন সায়াহ্নের আগুন। উপন্যাস ৮ টি। উদ্বাস্তু, কেচো, জাল থেকে জালে, মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল, বিল ডাকিনি, A Tale of Rohingya, অচেনা নগরে অর্বাচীন কিশোর, দায়ভাগ, থাকে শুধু অন্ধকার। প্রবন্ধগ্রন্থ ১ টি। ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ। গবেষণা গ্রন্থ Traditional Medicine in Bangladesh.