কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলো (দ্বিতীয় পর্ব)

অনুভূতি এক ও অভিন্ন
আজকে অর্ক আর খাতিজা এসেছিল। না বাসায় ঢোকেনি। গাড়ি থেকে নামলে আমি দূর থেকে দেখলাম, কথা বললাম। অর্ককে দুই মাস আটদিন পর দেখলাম। এর আগে ভার্চুয়ালি দেখা হয়েছে। আজ দেখলাম সরাসরি। করোনা আমাদেরকে কেড়েই নিচ্ছে না দূরেও সরিয়ে দিয়েছে! প্রতিদিন ১১.৩০ মিনিটে জাস্টিন ট্রুডো আসেন টিভির সামনে। তার অটোয়ার রিডো হাউজ থেকে ব্রিফিং দেন। তার সরকারের প্রতিদিন বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো জনগণকে অবহিত করেন। ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এবং হেলথ মিনিস্টার কথা বলেন। এছাড়াও অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড বা অন্যান্য কমকর্তা যেমন চিফ হেলথ অফিসার, তার ডেপুটিরা সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করেন। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন তারা।

এভাবেই দিন আসে দিন যায়। করোনা দিন। জেসমিন রাত দিন টিভির সামনে বসে থাকে। আমি টিভির সামনে দশ মিনিটের বেশি থাকি না। ইচ্ছে করে না। কী হবে বসে থেকে! জানি তো কি ঘটছে। সংখ্যাটা জানা আছে। সারা পৃথিবীতে কতজন আক্রান্ত হলো, কতজন মারা গেলো এই তো! আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য... তালিকা দীর্ঘ। এবং বাংলাদেশ। ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্ত এবং মুত্যু। অন্টারিওতে আক্রান্তের সংখ্যা কত বাড়ল গত ২৪ ঘণ্টায়, কতজন মারা গেলো বা টরন্টোতে কতজন এবং পুরো কানাডায় কতজন মারা গেলো বা আক্রান্ত হলো এই হিসাবই তো! এর বেশি কিছু না! আমি শুধু খেয়াল করি সংখ্যাটা কোথায় কোথায় কমে আসছে। শুধু অপেক্ষা। অপেক্ষা। অপেক্ষা। অপেক্ষা...! কিন্তু অপেক্ষার প্রহর ঘোচে না..।

আমি জানি এই মুহূর্তে সবারই অনুভূতি এক ও অভিন্ন। আমাদের প্রার্থনা একটাই সবাই ভালো থাকি, নিরাপদ থাকি। পৃথিবী আবার সুন্দর হোক। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। এই পরিস্থিতি খুবই অচেনা আমাদের জন্য, খুবই অপ্রত্যাশিত। কোনো দুঃখজনক সংবাদই আমরা শুনতে চাই না। কিন্তু আমাদের শুনতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাস কেড়ে নিচ্ছে আমাদের আপনজনদের। আমার বন্ধুকে, আমার চেনা মানুষকে। এই কষ্ট আমরা সহ্য করতে পারছি না। মেনে নিতে না পারলেও মেনে নিতে হচ্ছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছি। এ আমাদের জীবনে এক কঠিন পরীক্ষা। নির্মম, কষ্টকর এবং অবর্ণনীয়। 

এখন আমরা যেটা পারি সাবধান থাকতে। অন্যকে সাবধান করতে। আমরা যেটা পারি পরস্পরের পাশে থাকতে, সাহস যোগাতে, ভালোবাসতে, সহমর্মী হতে, ক্ষমা করে দিতে। আমারা মনে যত রাগ ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, প্রতিহিংসা পুষে রেখেছিলাম সব ভুলে যেতে। সব ভুলে যেতে। গোটা পৃথিবীকে এই ভাইরাস একবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। কেউ নিরাপদ না আজ। মুত্যৃ যেমন অমোঘ, যেকোনো সময়, যত বড় ক্ষমতাবানই হোক একদিন দরজায় এসে কড়া নাড়বে। এও যেনো তেমনি। একমাত্র সতর্কতাই আমাদের পরিত্রাণ দিতে পারে। একদিন আমরা এই দুঃসময় জয় করবোই। আবার সুন্দর দিনের আলো ফুটবে। জন্মদিনে শুধু এটাই প্রত্যাশা।

এক ভয়ঙ্কর দানবের সাথে লড়ছে মানুষ। লড়ছে ফ্রন্টলাইন কর্মীরা। এই দানবের কাছে হার মেনেছে পৃথিবীর সেরা মারণাস্ত্রগুলো। হার মেনেছে ট্রেসার বোম্বা, মিরভি, আইসিবিএম, এফওএবি, চিমেরা ভাইরাস, আরপিজি, ডিএসআর ইত্যাদি নামের ভয়ঙ্কর অস্ত্র। এগুলো এখন হাস্যকর হয়ে গেছে। গার্বেজে ফেলে দেওয়ার সময় হয়েছে। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, গুস্তভ ট্যাঙ্ক, ফ্লেমথ্রোয়ার, একে ৪৭ বা নিউক্লিয়ার গাইডেড মিসাইল দিয়ে থামাতে পারছে না এই দানবকে। আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি এই সঙ্কটে সত্যিকার হিরো হচ্ছে ডাক্তার, নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীরা।

২.
ডব জোহার
এখন রাত দিন সবই সমান। কোনো পার্থক্য বিশেষ নেই আমার কাছে। বাইরের দিকে তাকালে এই পৃথিবী খুউব অচেনা লাগে। এইরকম পৃথিবী কেউ চায়নি। ঘরে আছি বলে ক্ষণে ক্ষণে পত্রিকার পাতায় না হয় ফেসবুকে চোখ যায়। ফেসবুক মানেই দুঃসংবাদ, ফেসবুক মানেই মৃত্যুর খবর, ফেসবুক মানেই লাশ। এতো এতো মৃত্যু আগে কেউ দেখেনি। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই মুহূর্তে খারাপ খবরগুলো পৌঁছে যাচ্ছে। মনের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। প্রচণ্ড চাপ। শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছাব আমরা জানি না। এতো চাপ সহ্য করতে পারব কিনা তাও জানা নাই। এক ধরনের ট্রমায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সহজেই এ থেকে মুক্তি পাব না আমরা। মানুষ শোকে পাথর হয়ে গেছে। যদি বেঁচে বর্তে যাইও এরপর স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও মানুষ আর চোখের জল ফেলবে না, দুঃখ পাবে না। দুঃখের বোধগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চোখের জল শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।

ঘরে আছি বলে যে কিছু করতে পারছি তা না। লিখতে পারি না, মাথার মধ্যে কোনো লেখা কাজ করে না, বই নিয়ে বসি প্রতিদিন। অসংখ্য বই অপঠিত রয়ে গেছে। সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করি। কিছুদূর পড়ে আবার রেখে দেই। বইয়ের গভীরে যেতে পারি না। রসাস্বাদন করতে পারি না। মুভি দেখি কিন্তু দেখার জন্য দেখা। জেসমিনের সাথে স্বাভাবিক সময়ে দিনে একবার হলেও খটাখটি হতোই, সেটাই ছিল স্বাভাবিক, জীবনের স্পন্দন বোঝা যেতো। জীবন যে চলমান আছে বোঝা যেতো। ঝগড়া হতো আবার নিজেই গায়ে পড়ে কথা বলতাম, যেনো কিছুই হয়নি। এখন তাও হয় না। ঢাকা থেকে এসেছি প্রায় বাইশ দিন অথচ আশ্চর্য, দারুণ সহাবস্থান করছি। কোনো কনফ্রন্টেশন নাই। এক বাসায়ই আছি কিন্তু মনে হচ্ছে আমি যেনো জেসমিনের ভাসুর! 

রাতে যতটা সম্ভব বেশি ঘুমিয়ে নেই। ঘুমের মধ্যে যতক্ষণ থাকি ততক্ষণই মুক্তি। নয় দশ ঘণ্টা ঘুমাই টানা। অথচ নর্মালি আমি সাত ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারি না। পিঠ ব্যথা হয়ে যায়। আমি এমনিতেই ব্যাকপেইনে ভুগি সারা বছর। ফেসবুক খুললে বেশিরভাগই নিউইয়র্কের খবর। সেখানে আমাদের অনেক বন্ধু আত্মীয়রা রয়েছে। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর খবর আসছে। বাংলাদেশ থেকেও খারাপ খবর বাড়ছে প্রতিদিন। দেশে যার সাথেই কথা বলি সেই একটা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আমার অনেক পরিচিতজনরা দেশে আটকা পড়েছে, ফিরতে পারছে না।

সামাজিক দূরত্ব বা সোশ্যাল ডিসট্যান্স নতুন কিছু নয়। আজকে বিজ্ঞান যা বলছে, হাজার বছর আগেই তা পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন। অতিথি আপ্যায়নে এই প্রথা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক। আগের দিনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, লোটাদা করে জীবাণু নাশক হয়ে তবেই গৃহে প্রবেশের নির্দেশ ছিল। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব একটি প্রচলিত পন্থা। আদিবাসীদের বাড়িতে অতিথি এলে তাকে বাড়ির বাইরে দড়ির খাটিয়া, মাচুলি বা চেয়ারে বেশ কিছুক্ষণ বসতে দেওয়া হয়। তারপরে কাঁসার বাটিতে জল এনে তাকে হাত পা ধুতে দেওয়া হয়। যাকে বলে লেটাদা। ঘরের বাইরে জুতা স্যান্ডেল রেখে আসতে হয়। অতিথি বয়স্ক হলে তাকে প্রণাম করে দূর থেকে। ছোটরাও বড়দের প্রণাম করে দূর থেকে। বিজ্ঞান এখন এই আদিম পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। এটা এক ধরণের লক ডাউন। এটাকে বলে ডব জোহার।

নানা শঙ্কা আর ভয়ের পৃথিবীতে সময় কাটানোও একটা দূরহ ব্যাপার এখন। গৃহবন্দী জীবন আর মৃত্যু উপত্যকার মধ্যে বেঁচে আছি। জীবন্মৃত কি একেই বলে! সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রার্থনা করি সর্বক্ষণ। সবার মঙ্গল হোক। পৃথিবী আবার স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে আসুক। প্রতিদিন এতো এতো আক্রান্ত, মৃত্যু, রিকোভারি, লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেনটাইন, মাস্ক, গাভস, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, এম্বুলেন্স, হাসপাতাল, আইসিইউ, ভেন্টিলেশন, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মন্দা, দুর্ভিক্ষ এই শব্দগুলো বেঁচে থাকা জীবনকে অবশ করে দিয়েছে। এগুলো এখন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কম দিনতো বাঁচলাম না, যদি আর নাও বাঁচি আমাদের সন্তানরা যেনো নিরাপদ থাকে এই প্রার্থনা করি। সময় কাটানোর জন্য আমার কাছে বই হচ্ছে এখন সবচেয়ে বড় আশ্রয়। যতক্ষণ বইতে ডুবে থাকি ততক্ষণই মুক্তি। ভয়ের হাত থেকে মুক্তি, ট্রমা থেকে মুক্তি, দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থতার হাত থেকে মুক্তি।

৩.
একটি স্মৃতিকথা এবং বর্তমান বাস্তবতা
রিমন আমার চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের ছোট। সম্পর্কে আমার ছোট ভাই। বয়সে ছোট হলেও আমাদের সখ্যতা হতে কোনো সমস্যা হয়নি। দারুণ মাখামখি ছিল আমাদের। বয়স কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা একসাথে খেলতাম, ঘুড়ি উড়াতাম, নারকেল আর খেজুরের রস পেড়ে খেতাম, আমাদের পাশের বাড়ির খোয়ার থেকে মুরগি চুরি করে বনভোজন করতাম বাড়িতে। আমাদের মলিক বাড়ি, রিমনের মামা বাড়ি। বরশিাল শহরেই ওদের বাসা হলেও বেশিরভাগ সময় মামা বাড়িতেই কাটত ওর। আমি আর রিমন বাড়িতে তিন তলার চিলেকোঠায় থেকেছি অনেকদিন। বি এম কলেজে পড়ি।

তখন থেকেই আমি এক আধটু লিখতে শুরু করেছি। বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব করি। বিভিন্ন পত্রিকায় চিঠিপত্র এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন লিখি। সে সময় পঞ্চপাণ্ডব, তসলিমা নাসরিন, রফিকুলাহ এমরান (ইমু), মরমিড, মাসুদ (এমকো),পাহাড়ি কুমার, জিয়া খন্দকার, শিউ সুবর্ণগ্রাম, রজনী, লিয়াকত হোসেন খোকন-সহ আরো অনেকে বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিত।

আজকের ফেসবুকের মতোই সেটা ছিল জনপ্রিয় চ্যাটবক্স। তখন আমার অনেক পেনফ্রেন্ড ছিল। প্রতিদিন গণ্ডা গণ্ডা চিঠি আসে আমার কাছে। কখনো কখনো মেয়েরা চলে আসে বেড়াতে আমাদের বাড়িতে। কলেজে মেয়েরা আমাকে ঘিরে থাকে। পাঁচ ছয় জন মেয়ের মধ্যখানে আমি। এর মধ্যে একটি মেয়ে আমার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট। আমার ক্লাসেরই। আমাকে দৈনিকবাংলা থেকে পেপার কাটিং এনে দেয়। গল্প, উপন্যাস পড়তে দেয়। নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনী, আশুতোষ, বিমল মিত্র, শঙ্কর, আশাপূর্ণা, নিমাই এঁদের বই। কখনো কখনো বইয়ের মধ্যে চিঠিও থাকে। দারুণ সব চিঠি। বুদ্ধিদীপ্ত চিঠি। সেই চিঠিতে কখনো প্রেমের কথা থাকে না। আমিও রিপ্লাই দেই।

কিন্তু আমার সমস্যা হচ্ছে, কলেজে আসার জন্য আমার যথেষ্ট ভালো কাপড় চোপড় নাই। এক দুইটা প্যান্ট বা শার্ট, একজোড়া জুতা পড়ে প্রতিদিন কলেজে আসতে কেমন লাগে না! মেয়েরাই বা কী ভাববে! সুন্দর সুন্দর সব মেয়ে। রিমনের তখন থেকেই একটা ব্যাপার ছিল। ভালো ভালো কাপড় পড়ত। দেখতেও সুদর্শন। আমি করতাম কি, রিমনের শার্ট, গেঞ্জি পড়ে কলেজে আসতাম। সাইজ ঠিক ছিল না কিন্তু টেনে হিচরে পড়তাম। কেউ বুঝত না।

কালকে রিমনের ফোন পেলাম ম্যাসেঞ্জারে। দু’বার ফোন করেছে কিন্তু ধরিনি। ভাবলাম সুবিধামতো সময়ে করবনে। আমার একটা সমস্যা আছে। সমস্যা বিরাট। সেটা হচ্ছে ফোনে কথা চালাচালিতে আমি একদম পটু না। মানুষের সাথে আমার বেশি কথা থাকে না। অনেক দরকারি ফোনও আমি করি না। অনেকে আছে বিরামহীন কথা বলতে পারে। কোনো ক্লান্তি নাই। যেমন জেসমিন। আসলে যুগটা হচ্ছে কমিউনিকেশনের। আমার যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ বলে আমার কিছু হয় না। আমার আরো সমস্যা আছে, দু’চার কথা বলার পরই আমার কথার স্টক শেষ হয়ে যায়। তখন আমি চুপ করে থাকি। কথা খুঁজে বেড়াই। ও প্রান্ত থেকে প্রায়ই বলে, লাইনে আছ! এজন্য অনেকে আমাকে ভুল বোঝে, খারিজ করে দেয়।
রিমনকে আমি কলব্যাক করলাম। রিমন বলল,

-কেমন আছেন জসিম ভাই!

-এই তো ভালো। তুমি কেমন ভাইজান! আমি মজা করি।

-আপনার সমস্যা কী জসিম ভাই! 

-কেন কি হইছে!

-আপনি ম্যাসেঞ্জার চেক করেন না! 

-করি তো। 

-আমি যে আপনাকে এতোবার ফোন করেছি, ম্যাসেজ দিয়েছি দেখেননি! 

জানি আমি পুরাই ধরা। একটু লাজুক হাসি। বলি,  

-আমি একটু আইলসা স্বভাবের, মাইন্ড খাইও না।

-আপনাকে এ পর্যন্ত তেরো বার ফোন করেছি। 

এই বলে রিমন ডেট বলতে লাগল কবে কবে ফোন করেছে।

-আসলে হয়েছে কি দোস্ত।
আমি রিমনের মন গলানোর চেষ্টা করি, আফটার অল রিমন একজন সংসদ সদস্য। তাও সরকারি দলের! তার ফোন ইগনোর করছি! সাহস তো কম না আমার!

-শোনো ভাইয়া তোমার যখন দিন আমার তখন রাত। সময়ের হেরফেরের জন্যই...। 

-আমি জানি সেটা। আমি যখন ফোন করি হিসাব করেই করি। তখন আপনার ঘরে থাকার কথা। ফোনের রিপ্লাই দেওয়া ভদ্রতা!

আমি হেসে বলি, কথা সত্য। আবার কাজেও থাকি...।

-আপনার সাথে কতদিন পর কথা হলো জানেন! 

-বেশিদিন না। কয়েক বছর আগেই কথা হয়েছে বরিশালে! 

-তাও প্রায় দশ বছর। সব ভুলে গেছেন! 

-ভুলব কেন, কিছু ভুলিনি। মনে পড়ে, তোমার গেঞ্জি পড়ে কলেজে যেতাম! 

রিমন হেসে বলল, হ্যাঁ অনেক স্মৃতি।

-তুমি কোথায় এখন! 

-আমি ঢাকায়। ন্যাম ভবনে। এমপি হোস্টেল চেনেন! 

-নাম শুনেছি। 

-ঢাকায় আসেন একটা ফোন দেন না। আমি আপনার সব খবর রাখি। 

আমি হেসে বললাম, সরি দোস্ত এরপর ঢাকা গেলে এয়ারপোর্টে নেমেই তোমার সাথে দেখা করব।

-কতগুলো বই বের হইছে আপনার এ পর্যন্ত! 

-পঁয়ত্রিশটার মতো। 

-ফেসবুকে দাদুকে (মা কে) নিয়ে আপনার একটা লেখা পড়ে বুকটা কেমন ছ্যাত্ করে উঠল তাই ফোন দিলাম।

করোনাকালের এই মহা দুর্যোগে কানাডার প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার সব মন্ত্রী, এমপি, মেয়র, প্রিমিয়ার, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী কারো দম ফেলার সময় নাই। দিনরাত কাজ করছেন তারা। জনগণই শেষ কথা তাদের কাছে।

জেসমিন কালকে বলল, দেখেছো ট্রুডোর চেহারা কেমন হয়ে গেছে! এতো সুন্দর মানুষটা চেহারা মলিন লাগছে! কথা সত্য। প্রতিদিন জাস্টিন করোনা প্যানাডেমিক নিয়ে ব্রিফিং করেন। সাংবাদিকরা কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করেন, প্রধানমন্ত্রী শান্তভাবে, ঠান্ডা মাথায় প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেন।

বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা এই দুর্যোগে আন্ডারগ্রাউন্ডে না থেকে জনগণের পাশে থাকবেন বলে আশা করি। তাদের সাহস দেবেন, সহযোগিতা করবেন। গরিবের ত্রাণের চাল, তেল চুরি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। রিমনকে এই কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলা হলো না...।

৪.
এবার যদি বেঁচে যাই...
মৌন থাকা সকলের জন্যই ভালো। আত্মা তাতে শান্ত হয়। আমার কণ্ঠস্বরের জোর কম বলে আমি বেশিরভাগ সময় মৌন থাকি। মৌনব্রত আমার জন্য নিরাপদ। জেসমিন প্রায়ই আমার কথা শুনতে পায় না। আমি পাশে বসেই কথা বলছি কিন্তু সে বলবে, কি বলছ! আমি বলি একটা শুনছে আর একটা। হয়তো বললাম একটু চা বানাও, উত্তরে বলবে তোমার কোনো চিঠি আসে নাই। দোষ আমার ভয়েসের। আমি কখনো কোনো ইন্টারভিউ দেওয়ার পর যখন সেই ইন্টারভিউ শুনি তখন আমার নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। কণ্ঠস্বর কেমন ফ্যাস ফ্যাসে লাগে শুনতে। অথচ অনেকেই বলেছে ফোনে আমার কণ্ঠ নাকি অনেক সুন্দর। যার নয়নে যারে লাগে ভালো টাইপ...। কোথায় যেনো পড়েছি মৌন থাকলে চিন্তার ক্ষমতা বাড়ে। সমুদ্রে দিশেহারা নাবিকের মতন যখন অবস্থা হয় তখন আমার মতো গৃহীর, সঠিক দিক নির্ণয়ের জন্যে মৌনতা অবশ্যই ভালো কাজ দেয়।

এখন এই করোনাকালে আরো বেশি মৌনতায় পেয়েছে আমাকে। কথা বলার মানুষ নাই। গৃহে দু’জন মানুষ আমরা তাও কথা হয় কদাচিৎ। যেনো দুজন দুই গ্রহের বাসিন্দা। শুধু গ্রোসারি লাগবে কিনা, ফেসবুকে কে কি ট্রল করল বা ট্রুডুকে নিয়ে কোন মেয়ে ক্রাশ খেয়েছে এই রকম এলেবেলে কথা হয়। কথা না বলার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ তার পুত্রবধূ মীরাদেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “ঠিক করেছি এখন থেকে দীর্ঘকাল প্রচ্ছন্ন থাকব। কারো সঙ্গে কোনো কারণেই দেখা করব না। কেবল বুধবার দিনে নিজেকে প্রকাশ করা যাবে। আত্মীয়দের চিঠি ছাড়া পড়ব না।” এখানে আত্মীয় বলতে কবিগুরু কাদের বুঝিয়েছেন জানি না, কিন্তু মধ্যজীবনে এসে সাধক রবীন্দ্রনাথ এই কথাটি বুঝেছিলেন যে, রক্তসূত্রের আত্মীয়তাটা আসল আত্মীয়তা নয়।

সংসারের মধ্যে থেকে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিটা মানুষের নিজেকে খোঁজার দরকার আছে। নিজেকে পেতে হলে সংসার বিবাগী হতে হয়। বৈরাগ্য দরকার আছে। সংসার শুধু কোলাহল। কবিগুরু এক জায়গায় বলেছেন, “গভীরভাবে, সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়ে থাকব। যদি লেখা জমে আসে তো লিখব। পণ্ডিচেরিতে অরবিন্দর সাথে দেখা করে আমার মনে হল আমারও কিছুদিন এইরকম তপস্যার খুবই দরকার। নইলে ভিতরকার আলো ক্রমশই কমে আসবে। প্রতিদিন যাতা কাজ করে যাতা কথা বলে মনটা বাজে আবর্জনায় চাপা পড়ে যায়। নিজেকে দেখতে পাইনে।” রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে বিদেশ থেকে একবার কবি লিখেছিলেন, “দেশে গিয়ে সম্পূর্ণ নির্জনবাসের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে দীর্ঘকাল বাক্য ও কর্ম থেকে সম্পূর্ণ নিস্কৃতি নেব ঠিক করেছি।”

আমিও ঠিক করেছি এবার যদি বেঁচে যাই তাহলে নির্জনতার সন্ধান করব। নির্জনতা কখনো আমাদের শূন্য হাতে ফেরায় না। লেখাও নির্জনতার অবদান। কোলাহলে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। নিরবচ্ছিন্ন নির্জনতার সন্ধান করব। ঘোর লাগানো নির্জনতা। নির্জনতার মধ্যে না গেলে, নিজের মন নির্জন না হলে কোনো কিছু ভাবা সম্ভব না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মেন্টাল-ওয়াল্ড-এর গণ্ডির বাইরে যেতে পারে না প্রায়ই। তাই তো নির্জনতা আর জনতার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। ম্যারি এ্যান শেফার বলেছেন, I don't want to be married just to be married. I can't think of anything lonelier than spending the rest of my life with someone I can't talk to, or worse, someone I can't be silent with.(চলবে)


• টরন্টো, কানাডা

কোয়ারেন্টাইনের  দিনগুলো (প্রথম পর্ব)

menu
menu