কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলো

২৩ মার্চ রাতে ঢাকা এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেখি সুনসান অবস্থা। একজন বলল, কেউ গত ৩০ বছরে এরকম দেখেনি । শুধু ক্যাথের যাত্রীদের লাইন। কানাডার যাত্রীই বেশি। হংকং পৌঁছলাম সময়মতোই। সেখানেও নীরবতা। যেখানে প্রতি পাঁচ মিনিটে একটা ফ্লাইট উড়ে সেখানে খুব অল্প ফ্লাইট চলছে। সব ক্যান্সেল। হংকং এ ১২ ঘণ্টা স্টপওভার ছিল। সুন্দর এয়ারপোর্ট। আগে কখনো আসিনি। একটা লাউঞ্জে সময় কাটালাম। তারপর হংকং সময় সোয়া ছয়টায় টরন্টোর ফ্লাইট উড়ল। স্নেহিথ আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনল। না হলে কোনো ট্যাক্সি পাওয়া কঠিন হতো। স্নেহিতের কাছে কৃতজ্ঞ। টরন্টোর রাস্তাঘাটও নীরব। হাইওয়েতে তেমন গাড়ি নাই। টরন্টো এয়ারপোর্টে দুটো ফ্লায়ার দিল ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে। এটা ম্যান্ডেটরি। টরন্টোতেও সবকিছু থমকে গেছে। পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি এটাই আমার শান্তি।

আমার কেবলই মনে হয় এই সুন্দর পৃথিবীটার প্রতি আমরা অনেক অত্যাচার করেছি। যাচ্ছেতাই ভাবে পৃথিবীটাকে ধ্বংসের কাজ করেছি। ধ্বংস করছি বৃক্ষ, পশু, পরিবেশ। বিষাক্ত করেছি নদী, সমুদ্র, আকাশ। নদী মেরে ফেলছি, বৃক্ষ ধ্বংস করছি, সমুদ্র ধ্বংস করছি। মানুষ মারছি বোমা আর মিসাইল মেরে। জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছি। পারমাণবিক বোমা বানানোর প্রতিযোগিতা করছি। কে কতভাবে মানুষ হত্যা করতে পারে সেই প্রতিযোগিতা চলছে পৃথিবী জুড়ে। অর্থনৈতিক অবরোধ করছি। দেশ দখল করছি। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে গেছি। জেলে পুড়ে দিচ্ছি বিনা দোষে। একে অপরকে ঠকাচ্ছি। লুটপাট চালাচ্ছি। নাস্তিকতা করছি। এক দেশ আর দেশের ওপর অবরোধ দিচ্ছে, মানুষ না খেয়ে মরছে। সম্পদের পাহাড় গড়ছি। পাচার করছি গরিবের সম্পদ।

প্রকৃতি এসব সহ্য করতে পারে না। প্রকৃতি তার শোধ নিবেই। চেক এন্ড ব্যালেন্স নাই পৃথিবীর। পৃথিবীর মানুষের জন্য আজ একটা শিক্ষা। আলাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এই কথাটা আমরা ভুলে গেছি। এই বিপর্যয় থেকে মানুষের শিক্ষা হোক। আলাহ তার সৃষ্টিকে ভালবাসেন। তাদের বোধদয়ের জন্য এই পরীক্ষায় ফেলেছেন। পৃথিবী আবার একদিন সুন্দর হবে। ধনী গরিবের বৈষম্য ঘুচে যাবে। কেউ কারো সম্পদ কেড়ে নেবে না। মানুষ না খেয়ে থাকবে না। সম্পদের বৈষম্য ঘুছে যাবে। কেউ কাউকে হত্যার জন্য মারণাস্ত্র তৈরি করবে না। এক নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে। ততদিন আমরা অনেকেই হয়তো থাকব না। মৃত্যু অনিবার্য। সবাইকেই যেতে হবে, যেতে হয়। আমরা সবাই যেনো সবাইকে ক্ষমা করি।

প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙে আমার। এখন অবশ্য জেটল্যাগ চলবে কিছুদিন। ফজরের নামাজ পড়ে নিজেই চা বানাই। নিজের চায়ে নিজে মুগ্ধ। আগে যেমন অরিত্রির জন্যও চা বানাতাম এখন শুধু নিজের জন্য বানাই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাবি জীবন কত অনিশ্চিত! মৃত্যুকে পরোয়া নাই। প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু অন্য সবাই ভালো থাকুক। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুরা সবাই ভালো থকুক। সুস্থ ও সুন্দর থাকুক। দুর্যোগ আসে আবার কেটেও যায়। সামনেই সুদিন অপেক্ষা করছে। বিজ্ঞান অনেক মহামারী মোকাবেলা করেছে। এটাও করতে যাচ্ছে।

সকালে ঘুম ভেঙে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। নীরব প্রকৃতি। নীরব বৃক্ষরাজি, আকাশ, বাতাস। যেনো বলতে চায় আমার ওপর তোমরা মানবজাতি অনেক নির্যাতন করেছো। এবার থামাও। সেলিব্রেটি নীতি বন্ধ করো। মন্ত্রী, এমপি, এমডি, জেনারেল, সচিব এইসব বৈষম্য তৈরি করেছো। মানুষ কেন সেলিব্রেটি তকমা পাবে! কেন ভিসা, পাসপোর্ট, ইমিগ্রেশন দরকার হবে! কেন কাঁটাতারের বেড়া! করোনা ভাইরাসের তো কোনো পাসপোর্ট ভিসা লাগে না! সে প্রিন্স সার্লস বা টম হ্যাঙ্কসকে চেনে না, বরিস জনসনকেও চেনে না। পাখির যেমন ভিসা পাসপোর্ট লাগে না। তার করোনার ভয় নেই। এই আকাশ, এই মাটি, এই সমুদ্র ভাগাভাগি করার তুমি কে! সীমানা প্রাচীর একটি ভ্রান্তধারণা।

একজন খেলোয়াড় কোটি কোটি পাউন্ড পারিশ্রমিক পায় বা একজন অভিনেতা অনেক বিলাসী জীবন যাপন করে! সুপার স্টার! কিন্তু আমিতো মনে করি চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা হচ্ছে প্রকৃত হিরো। তারাই সেলিব্রেটি, তারাই সুপার স্টার। লাল কার্পেট পেলে তারাই পাবে। এই দুর্যোগে তারাই একমাত্র ভরসা। তাদের পিছনে কত টাকা খরচ করে পৃথিবী! হাসপাতালের পিছনে কত বাজেট! পৃথিবী অন্যায় আর অনাচারে ভরে গেছে। চারিদিকে শুধু পাপ। হত্যা, মারণাস্ত্র, খুন, গুম, লুটপাট, ক্ষমতার দাপট, মিথ্যার বেসাতি। প্রকৃতি এসব সহ্য করে না।

প্রতিদিন সকাল এগারোটায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাষ্টিন ট্রুডো করোনা নিয়ে একটা ব্রিফিং দেন। সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। সেইসব প্রশ্ন তৈল মদন টাইপ না। সরকারের উদ্যাগগুলো সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। তারপর কানাডার চিফ হেলথ অফিসার, ডেপুটি চিফ হেলথ অফিসার কথা বলেন। ট্রুডো যখন কথা বলেন মনে হয় আমি একা না। আমার সাথে পুরো একটা সরকার আছে। নিজের অসহায়ত্ব কমে যায়। মাঝে মাঝে খারাপ ব্যাধি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে দোয়া "আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল বারসি ওয়াল জুনুনি ওয়াল জুযামি ওয়া মিন ছাইয়্যি ইল আসক্বাম"

প্রতিদিন যতটুকু সম্ভব বন্ধুদের খবর নেই। আত্মীদের খবর নেই। সাহস জোগাই, সাবধানে থাকতে বলি, ঘরে থাকতে বলি। এরচেয়ে বেশি কিইবা করার আছে। আমাকেও সবাই সাহস জোগায়। দোয়া করে যেনো ভালো থাকি সাবধানে থাকি। ২৫ মার্চ তারিখে পূর্ব নির্ধারিত একটা ডাক্তার এপয়েনমেন্ট ছিল আমার। এপয়েনমেন্টটা আমার জন্য জরুরি ছিল। ঢাকা বসেই শুনেছি ডাক্তার আমাকে দেখবেন তবে সরাসরি না ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। ব্যাকপেইনের জন্য এমআরআই করেছিলাম। তারাই আমাকে নিউরোসার্জনের কাছে রেফার করে। তাও প্রায় তিনমাস আগে। এবার ঢাকা যতদিন ছিলাম খুবই ভালো ছিলাম। ব্যাকপেইন আমাকে একদমই ভোগায়নি। সম্ভবত ওয়েদারের জন্য।

ছয়টার মধ্যেই ঘুম ভাঙে আমার। আজকে একবার ঘুম ভেঙে দেখি চারটা বাজে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ঢক ঢক করে পানি খাই। ওয়াশরুমে যাই। জেসমিনের ঘরের দরজার দিকে উঁকি দেই। মুদৃ নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে। আহা জীবন কত বদলে গেছে! দুটি পাখি একটি ছোট্ট নীড়ে কেউতো কারো পানে চায় না ফিরে টাইপ জীবন। কালকে অর্কের সাথে ভিডিওতে কথা বলেছি। আহা বাছাকে দেখি না ঢাকা থেকে আসার পর।

আবার ঘুমিয়ে ছয়টার মধ্যে উঠে যাই। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। বাইরে অন্ধকার। কোনো জনমানুষ নাই। অন্য সময় হলে অনেকেই এই সময়ে কাজে যায়, গাড়ির চলাচল থাকে। ওজু করে নামাজ পড়ি। নামাজে বসে মনোযোগ হারাই বারবার। মনে মনে বলি এতো ছোট্ট একটা জিনিস, অণু পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র এক চিজ সেটার ভয়ে মানুষ আজ দিশেহারা। কুকড়ে আছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। কে কখন আক্রান্ত হবে জানা নাই। অনেক চেনা মানুষের মত্যুর খবর শুনতে পাই। তখন নিজের বানানো চা বিস্বাদ লাগে।

টরন্টো আসার পর ছেলে মেয়ের কাছে যাওয়া হয়নি। ছুঁয়ে দেখা হয়নি। তারাও আসেনি কেউ। আসতে মানা। আমাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠায় ছিল অর্ক। প্রতিদিন ম্যাসেজ পাঠাত বাবা চলে আসো, যেভাবে পারো চলে আসো। সেই অর্কর সাথে আমার ভিডিওতে কথা হয়। অরিত্রি একদিন বাসার নিচে পর্যন্ত এসেছিল। সব পরিবারের জীবনে নেমে এসেছে এমন এক অবস্থা। সোশ্যাল ডিসটান্সিং। এটাই নিরাপদ পন্থা। সবারই এটা মানা উচিত। পৃথিবী এতোবড় সঙ্কটে পড়েনি আগে। তাই অভ্যস্ত হতে সময় লাগছে। সবার আর্থ-সামাজিক অবস্থাও এক না। খেটে খাওয়া মানুষদের বেশিদিন আইসোলেশনে থাকা সম্ভব হবে না। আশা করি ততদিনে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আশা নিয়ে বসে থাকি।

পৃথিবীতে কিছুই অনিবার্য না। টিভিও না, ফোনও না, সংবাদপত্রও না। সবকিছু জানতে হবে, বুঝতে হবে, দেখতে হবে এমন কোনো কথা নাই। অনেক কিছু না জেনে না বুঝেও জীবন চলে যাবে। জীবনের প্রতিকূলতা আর দুঃসময়কে যত সহজভাবে গ্রহণ করা যায় ততই ভালো। মৃত্যু নিয়ে এতো আদিখ্যেতার কি আছে। অসুখে বিসুখে, মহামারিতে না হয় সাধারণ মুত্যু হবে। মৃত্যুকে কেউ রোধ করতে পারবে না। আগে অথবা পরে দরজায় এসে কড়া নাড়বে। তা নিয়ে এতো ভেবে কি হবে। মৃত্যু একটি মহান ঘুম এর বেশি কিছু না। নিজের মনোযোগ সারাক্ষণ একটি জায়গায় নিবিষ্ট হওয়ার কারণে একটা ভীতি, একটা প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। সেই চাপ থেকে মুক্ত থাকার জন্যই টিভি, খবরের কাগজ, ফোন, ট্যাবলেট এসব গ্যাজেটস থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চাচ্ছি।

লেখালেখি করা যেতে পারে এই সুযোগে। সেজন্য লেখক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখুন। নিজের আনন্দ বেদনার স্মৃতিগুলো লিখে রাখুন। ভালো সময়ে সেইসব স্মৃতি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারবেন। যে বইগুলো এখনো অপঠিত রয়ে গেছে সেগুলো পড়ুন। অথবা পছন্দের বই বারবার পড়ুন। কবিতা আবৃত্তি করুন নতুবা গান শুনুন। সন্তানদের সাথে আরো নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলন। পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করুন, সাহস দিন। স্ত্রীকে ঘরের কাজে সাহায্য করুন। কৃচ্ছতা সাধন করুন। সামনে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সমূহ সম্ভবনা আছে। কোটি কোটি মানুষ চাকুরি হারা হয়েছে। বিত্তবানরা গরিবের পাশে দাঁড়ান, তাদের সাধ্যমতো সাহয্য করুন। এখনই সময়।

আমি আশাবাদী মানুষ। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। নেগেটিভ খবরগুলো মনকে বিষণ্ন করে তোলে তাই এড়িয়ে যাই। ভালো খবরগুলো খুব মন দিয়ে পড়ি। আনন্দ নিয়ে পড়ি। যে যা বলে তাই মন দিয়ে পড়ি। কিন্তু এড়িয়ে গেলেও অস্বীকার করতে পারি না। বুকের মধ্যে স্বল্প বেঁচে আছে বলেই জীবনটাকে আনন্দময় মনে হয়। স্বপ্ন দেখি সবকিছু সুন্দর হয়ে যাবে। আগের জীবনে ফিরে যাব। ঘুম ভেঙে হঠাৎ ভুলে যাই যে আইসোলেশনে আছি। ঘরের বার হতে পারব না। দুজন মানুষ দুই ঘরে থাকি। সকালে এক টেবিলে বসে চা খাই না। সবসময় চা আমি বানাই, এখনো বানাই কিন্তু একা একা খাই।

বাইরের দিকে তাকাই কোথাও কোনো জনমানুষ চোখে পড়ে না। প্রতিদিন খুব ভোরে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ শুধু রাস্তা ক্লিন করে। ময়লাও হচ্ছে না তেমন রাস্তাঘাট। মানুষের জন্যই তো সব। সেই মানুষ নাই কোথাও। শিশুরা খেলতে নামছে না, স্কুল বন্ধ। শিশুদের কোলাহল নাই। নীরব নিথর। হুইল কার এসে থামছে না আর। দূরে কখনো একটা দুটা গাড়ি যায় হুস করে। এক অচেনা পৃথিবী। যেনো অন্য এক গ্রহে ঢুকে পড়েছি। একজন দু’জনের হাতে বাজারের থলে, কেউ কারো দিকে তাকায় না। এলিয়েন পৃথিবী। অচেনা সব, অচেনা আত্মীয়, বন্ধু, সন্তান। সবাই সবার কাছ থেকে দূরে। জড়াজড়ি, গাড়গড়ির দিনগুলো থমকে গেছে।

এই প্রথম পৃথিবীর সব মানুষ একযোগে অভিন্ন এক ভয়ে আক্রান্ত। সেটা হচ্ছে মৃত্যু। ক্রমেই ধেয়ে আসছে! অনেকেই প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছেন। মৃত্যু কিছু নতুন ঘটনা নয়। সবারই এর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই সবাই সবার মনের অবস্থা জানি। যার সাথেই কথা হয় সেই বলে আর কি দেখা হবে! কবে এর শেষ হবে! চরম নাস্তিকরাও বুঝেছে যে এমন একটা পরাশক্তি আছে যার ওপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা কারো নাই। সবাই এখন তার করুণা প্রার্থনা করছে। তার শক্তির কাছে নতজানু হয়েছে। ক’দিন আগেও যারা এসব নিয়ে বাহাদুরি করেছে, নানা যুক্তি দিয়েছে আছে কি নেই তারা এখন চুপসে গেছে। এটা একটা পরীক্ষা। মানবজাতিকে এটা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পৃথিবীতে চেক এন্ড ব্যালেন্স নেই বলেই এমনটা ঘটেছে। সবকিছুই আবার সুন্দর হবে কিন্তু তখন আমরা অনেকেই থাকব না। তবুও ভালো থাকো, ঘরে থাকো।

কোয়ারেন্টাইনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আর দুদিন মাত্র। আজ সকালটা খুব সুন্দর। নৈঃশব্দ্য ভরা চারদিক। দূরে মাঝে মাঝে দু’একটা বাস চলাচল করতে দেখা যায়। কিছু গাড়িও চলছে। প্রয়োজনে মানুষকে বাইরে বের হতে হচ্ছে। তেমনি দু’একজন মানুষকে দেখতে পাচ্ছি। ভিজিটর পার্কিং এ আজকে কয়েকটা গাড়ি আছে। এরা রাতে হয়তো নিকাত্মীয়র কাছে ছিল । অন্য সময় পার্কিংয়ের জন্য পে করতে হয় কিন্তু এখন ফ্রি। এই দৃশ্যই ছিল স্বাভাবিক কিন্তু সবকিছু বদলে গেছে। তাও আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। এটা আমার অবচেতন মনের অনুভূতি।

টরন্টো ফিরে আসার পর থেকে এমনটা দেখিনি। আজকে সকালটাও রৌদ্রকরোজ্জ্বল। চকচক করছে চারিদিক, ঝকঝকে নীলাকাশ। মৃদু বাতাস বইছে। গাছপালাগুলো এখনো পত্র পলবহীন। ঠান্ডার প্রকোপও কমে গেছে। আজ ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চাইলে একটু হাঁটাহাঁটিও করা যায় বাইরে। একটু দূরেই ডনভ্যালি পার্কিং। ওটা হাইওয়ে। সবসময় বিজি থাকে। ঘরে বসে কান পাতলে গুমগুম গাড়ি চলার শব্দ পাই একটানা। এখন পাচ্ছি না। ডিভিপিতে ব্যস্ততা নাই তেমন।

আমার সেলফ আইসোলেশনের দ্বাদশ দিন। ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় ঘর যেনো। আর দুদিন পর একটি ঘর থেকে মুক্তি পাব। অটোয়াতে গতকাল শরিয়ত উলাহ নামে একজন বাঙালি মারা গেছেন। করোনায় প্রথম বাঙালি মারা গেলেন। টরন্টোতেও আমাদের সবার প্রিয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাম শরীফ এবং তুতিউর রহমান নামে একজন হাসপাতালে আইসিউতে আছেন। তাই মনটা আপসেট হয়ে আছে। আজকে পর্যন্ত কানাডায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃতের সংখ্যা প্রায় ২৫৪।

প্রতিটা দিন এক একটা সুন্দর দিন। স্বর্ণালি আভায় ছড়ানো এক একটা দিন। ঘুম ভেঙে আবার একটা নতুন দিন দেখতে পাচ্ছি, পাখিদের ডাক শুনতে পাচ্ছি, মৃদু সমীরণের দোলা লাগছে হৃদয় মনে তাওতো কম না। বেঁচে যে আছি এটাই বিরাট ঘটনা! প্রতিদিন রাতে জেসমিনের আগে আমি বেডে যাই। এখন আইসোলেশনে আছি বলে আমি আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ থিউরিতে চলছি। জেসমিন বসে বসে সিপি২৪ দেখে। নিউজ চ্যানেল। জেসমিনের কাজই হচ্ছে সকাল বিকাল আপডেট শোনা। জাস্টিন ট্রুডোর ব্রিফিং শোনা। কাল রাতে তখন দশটার মতো হবে, হঠাৎ সাইরেনের শব্দ। প্যারামেডিক, ফায়ারব্রিগেড এবং পুলিশ একযোগে যাচ্ছে।

রাতে আমি তখন গভীর ঘুমে। হঠাৎ গগনবিদারী সাইরেনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। রাত দেড়টা। আমাদের বিল্ডিংএ ফায়ার এলার্ম বেজে উঠল। কেন যেনো মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমন যে আগে হয়নি তাতো না! নিয়ম হচ্ছে এলার্ম বাজার ১২ মিনিটের মধ্যে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি চলে আসবে। আমি চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। এলার্ম বেজেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এই এলার্ম বাজবে। এখনো স্পিকারে কেউ কিছু বলছে না! আজ কি কেউ আসবে না! এখনতো নর্মাল সময় না হঠাৎ মনে হয় আমার। প্যারাডেমিক, পুলিশ সবাই ব্যস্ত। না। সময়মতোই চলে এসেছে। একটু পর এলার্ম থেমে গে।

হুমায়ূন আহমেদ তার এক উপন্যাসে লিখেছেন, কার্যকারণ ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না। কথাটা সত্য। নিশ্চয়ই আজকে এই পৃথিবীজুড়ে মাহামারির পিছনে কোনো কার্যকারণ আছে। হয়তো পৃথিবীর মঙ্গল অপেক্ষা করছে সামনে। এজন্য কিছুতো মূল্য দিতেই হবে মানবজাতিকে। সেই মূল্য দেওয়া শুরু হয়েছে।

এবার কার্যকারণের কথা বলি। সেটা হচ্ছে এই, যদি আমরা সোশ্যাল বা ফিসিকাল ডিসট্যান্স মানি তাহলে বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। জনসংখ্যা হ্রাস পাবে। ওভার পপুলেটেড যেমন চায়না, ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য মঙ্গলই হবে। আবার ইউরোপ আমেরিকার জন্য একটু সমস্যা হবে। জনসংখ্যা সমস্যা। উন্নত দেশগুলি তৃতীয় বিশ্ব থেকে শ্রমিক বা ইমিগ্রান্ট আনার ব্যাপারে চিন্তা করবে। হয়তো কয়েক বছর বন্ধ থাকবে। কানাডার মতো দেশে এমনতেই গত ৩৫ বছর ধরে তাদের প্রয়োজনের চেয়ে জনসংখ্যার ঘাটতি। এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলেই অনুমান করি। যেহেতু করোনার এখনো কোনো প্রতিষেধক বাজরে আসেনি অতএব সোশ্যাল ডিসটেন্সই একমাত্র প্রতিষেধক এই মুহূর্তে। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মৃতের সংখ্যাও। অতএব সাবধান! ঘরে থাকুন।

করোনা উত্তর পৃথিবী কেমন হবে তা দেখার সুযোগ পাব কিনা জানা নাই। মহামারির পর মহামন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অথনীতি ধ্বসে পড়ছে, চাকরি হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ ইতিমধ্যে। পৃথিবীর জায়ান্ট অথনীতির দেশগুলো হিমসিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। কার্যত ২০২০ সাল পুরোটাই হবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বছর। সব বড় বড় ইভেন্ট বাতিল হয়ে গেছে। স্কুল, কলেজ, অধিকাংশ ব্যবসা, অফিস শাটডাউন। উড়োজাহাজ উড়ছে না। সমুদ্র শান্ত। গাড়ির ধোঁয়ার পলুশন নাই, গ্যাসের দাম পড়ে গেছে। মানুষ গৃহবন্দী। এই বন্দিত্ব কবে ঘুচবে জানা নাই। আমার ১৪ দিনের করোনটাই শেষ। একটু স্বস্তি পেলেও জীবন স্থবির হয়ে আছে। কবে এই স্থবিরতা ঘুচে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাব জানি না। আবার কবে নির্ভয়ে বাইরে যাব, আড্ডা দেবো, ঘুরে বেড়াব পৃথিবীর নানা প্রান্ত কে জানে? তবে এটাও ঠিক পৃথিবী আর আগের অবস্থায় ফিরবে না। অনেক কিছু বদলে যাবে, নিয়ম বদলাবে, অভ্যাস বদলাবে, দূরত্ব রচিত হবে, অবারিত যাতায়াত রহিত হবে। এক নতুন পৃথিবীর দ্বারপ্রান্তে মানুষ হয়তোবা। (চলবে)


টরন্টো, কানাডা

menu
menu