হোজ্জার সংসার
একবার বাজারে গিয়ে হোজ্জা কাপড়ের দোকানে এক কুমারী নারীকে দেখে পছন্দ করে ফেলে। মেয়েটার পিছে পিছে সে তার বাড়ি পর্যন্ত চলে যায়। মেয়ের মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার একান্ত ইচ্ছের কথা জানায়। মেয়েটার মা জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি আগে আর বিয়ে করেছো, তুমি কি অবিবাহিত? হোজ্জা বরাবরই সত্যবাদী। সে শপথ করে বলে, আমার চার শিশু সন্তানের নামে কসম খেয়ে বলছি, আমি আগে বিয়ে করি নি।
আমরা হোজ্জার বিয়ের আগের গল্প দিয়ে এ পর্ব শুরু করলাম যদিও হোজ্জার বিবাহ-পূর্ব গল্পটা কেমন যেন সন্দেহজনক। তার চেয়ে বরং হোজ্জার বিয়ের আসরেই আমরা প্রবেশ করি। সেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হোক।
মোল্লার বিয়ের দিন। সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। মোল্লা বিয়ের আগে একবারের জন্যও নববধূর মুখ দেখেনি। বিয়ের পর সে প্রবল আগ্রহে নববধূর চেহারা দেখলো। সে বুঝতে পারলো তার বৌ তার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি কুৎসিত! তার খুব মন খারাপ হলো। নববধূর চেহারা দেখে বিমূঢ হয়ে পড়া অবস্থায় মোল্লা-বৌ জিজ্ঞেস করে বসলো, “তুমি আমার প্রাণ-প্রিয় স্বামী, আমার ভালোবাসা, আমার প্রাণ,-এখন আমাকে বলো, কার কার সামনে আমি পর্দা করবো, মুখ ঢেকে রাখবো আর কার কার সামনে আমি চেহারা দেখাতে পারবো?
হতাশ, বিমর্ষ মোল্লা বললো, যাকে ইচ্ছে তাকে তোমার চেহারা দেখাইও কোনো অসুবিধা নাই কেবল আমার সামনে চেহারাটা ঢাইকা রাইখো বুঝতে পেরেছো?
স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে হাস্যরসের গল্প করা একটু কঠিন। কারণ এ ধরনের গল্পগুলো সব সময় স্ত্রীদের বিপক্ষে চলে যায়। এর কারণও আছে। হাস্য-রসের শিল্পী তারাপদ রায় মনে করেন, এর কারণ দুটি। এক. এসব গল্পের রচনাকাররা হলেন পুরুষ, এ কারণে এগুলো পুরুষ সমাজেরই গল্প। দুই. ‘স্বামীদের বা পুরুষদের সম্পর্কে মহিলামহলে হয়তো কিছু কিছু গল্প থাকতে পারে অতিশয় বিপজ্জনক এবং চনমনে কাহিনীমালা যা পুরুষদের কখনোই কর্ণগোচর হয় না’। এসব গল্প লোক-গোচরে না-আসার কারণ তারাপদ রায় বলেন নি। তবে আমার মনে হয় পুরুষতন্ত্রের ভয়। পুরুষতন্ত্র হয়তো কঠিন সাজা দিয়ে বসবে। ঐ যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘বাতাসি বাতাসি’ কবিতাটার মতো, “কিংবা ছেলেটা , যে ট্রাম-স্পটে দাঁড়িয়ে পাশের/ মেয়েটিকে অদ্ভুত কঠিন স্বরে বলেছিলো,/ “চুপ করো, না হলে আমি/ সেই রকম শাস্তি দেব আবার...” কে জানে/ “সেই রকম মানে কি রকম।” থাক, নীরেন্দ্রনাথবাবু যেটা জানেন না সেটা আমাদের জানায় কাজ কি! তার চেয়ে বরং আসুন হোজ্জার হাস্য রসে আবার ঢুকে পড়ি।
আমরা মনে হয় সংসারজীবনে গোবেচারা, স্ত্রী-শাসিত স্বামীদের নিয়ে নানাধরনের গল্পও কম নয়। হোজ্জার গল্পগুলো ঠিক এগুলোর কোনোটির সঙ্গে শতভাগ মিলে যায় না। এগুলোকে পুরুষতান্ত্রিক গল্প যেমন বলা যায় না তেমনি এগুলোর তলও খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার গোবেচারা স্বামী-সদৃশ গল্পগুলোর সঙ্গেও মেলানো যায় না। এগুলো একেবারেই হোজ্জার নিজস্ব ধরনের গল্প। হোজ্জাতো বলে বেড়ান, ‘আমি আবোল-তাবোল ধরনের মানুষ’। বরং তাঁর ধরনটা বোঝার জন্যে একটা বিখ্যাত সংলাপ এখানে জুড়ে দিতে পারি। একবার এক লোক হোজ্জার কাছে আজ কী বার জানতে চাইলো। এমনতো আমরা হরহামেশা সময়, বার বা তারিখ জানতে চাই। রাস্তা-ঘাটে বের হলেই এমন প্রশ্ন হাতে ঘড়িধারীকে যে কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে। হোজ্জা কী বলেছিলো জানেন? হোজ্জার উত্তরটা ছিলো, “ভাই এ এলাকায় আমি নতুন এসেছি, এরা কোনবারকে কী বার বলে আমি তো জানি না।” এমন লোকের সংসারও যে আবোলতাবোল হবে সে আর বলতে! কেমন ছিলো হোজ্জার দাম্পত্য-জীবন, সংসার? গল্পগুলোতে তার চিহ্ন রাখা আছে।
একবার এক প্রতিবেশী মোল্লাকে উপদেশ দিতে এলো—
: তোমার স্ত্রী যেন কেমন মোল্লা। সারাক্ষণ এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। মেয়েদের এমন বেগানা চলাফেরা তো ঠিক না? ওকে একটু শাসিয়ে দিও। মোল্লা বললো—
: আপনার উপদেশ অতিশয় মূল্যবান। যদি কখনো সে আমার বাড়িতে আসে তাহলে অবশ্যই আপনার কথা বলে দেবো।
এ গল্পটার সঙ্গে আগের গল্পের একটা ধারাবাহিকতা পাই। মোল্লাতো তার স্ত্রীকে অনুমতি দিয়েই রেখেছে। এর সঙ্গে তার ডিভোর্স নিয়ে করা গল্পটাও প্রাসঙ্গিক হবে।
নাসিরউদ্দিন গ্রামের কাজীর কাছে গেল ডিভোর্সের আবেদন নিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবে কাজী তার স্ত্রীর নাম জানতে চাইলো। নাসিরউদ্দিন বললো, আমি তো তার নাম জানি না।
কাজী খুব অবাক হলেন, তারপর নাসিরউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে বিয়ে করেছো কতদিন হয়েছে?
: এই ধরেন, পাঁচ বছর। কাজী নাসিরউদ্দিনের এ কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন, তুমি কি আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বলছো যে, তুমি পাঁচ বছর সংসার করার পরও স্ত্রীর নাম জান না?
: এটাই ঠিক, হুজুর। নাসিরউদ্দিন জবাব দিলো।
: কেন ঠিক হবে মোল্লা আমাকে বলো? কাজী আবার জিজ্ঞেস করলেন।
: কারণ আমার সাথে তার সামাজিক সম্পর্ক নেই।
করোনাকালে সামাজিক আর শারীরিক দূরত্ব বিষয়ে যে বাদানুবাদ চলছে নাসিরউদ্দিনের জবাবটা তাদের জন্যে একটা শিক্ষা হতে পারে। পাঠক হয়তো বলতে পারেন নাসিরউদ্দিনের সংসার নিয়ে বলতে গিয়ে শুরুতেই ডিভোর্স নিয়ে টানাটানি করলে সংসারটা কেমনে হবে। সে জন্যে সংসারী গল্পই একটা বলি।
মোল্লা নাসিরউদ্দিন বাজার থেকে দুই কেজি খাসির মাংস এনেছেন। স্ত্রীকে রাঁধতে দিয়ে বললেন, ‘অনেকদিন খাসির গোশত খাইনি গো। ভালো করে রাঁধো’। অনেকদিন ঘরে খাসির মাংস রাঁধা হয় নি, তাই খুব স্বাভাবিক মোল্লা-স্ত্রীও অনেকদিন খাসির মাংস খায়নি। রান্নার পর মাংসের খুশবু বের হলো। মোল্লা-স্ত্রী একটু চেখে দেখলো। তার খুব মজা লাগলো। সে আবার একটু চেখে দেখলো। এভাবে সবটাই এক সময় শেষ হয়ে গেল। মোল্লা খেতে বসে দেখলো কোনো খাসির মাংস নেই। মোল্লা-পত্নী খুব শান্ত স্বরে বললো, ‘আজ তোমার বরাতে কোনো গোশত নাই গো। বিড়ালে সবটুকু খেয়ে ফেলেছে’। নাসিরউদ্দিন দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। দু-সের গোশত বিড়াল একাই খেলো? নাসির উদ্দিন বিড়ালটাকে ধরে দাঁড়িপাল্লায় মাপ দিলো। দেখে ২ কেজি। এখন সে স্ত্রীকে প্রশ্ন করলো, ‘মাংস যদি বিড়ালে খায় তাহলে বিড়াল গেলো কই?”
এ প্রশ্নের উত্তর নাসিরউদ্দিন-স্ত্রী কী দিয়ে ছিলেন তা আর গল্পে লেখা হয় নি। তবে তাঁর স্ত্রীর খাবারের প্রতি বাতিক থাকতে পারে। একবার নাসির উদ্দিনের স্ত্রীর খুব গাভীর দুধ খাবার ইচ্ছে হলো। স্বামী দুধ রোজ করতে চাইলো। স্ত্রী মানে না। তার এক কথা। গাভী কিনতে হবে। ঘরের গাভীর দুধ খেতে চায় সে। এদিকে গোয়াল ঘরে জায়গা কম তাই মোল্লা গাভী কিনতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর দাবিতে নতি শিকার করে মোল্লা গাভী কিনতে বাধ্য হলো। কিন্তু আগে থেকে গাধা একটা থাকায় গরুকে জায়গা দিতে গাধাকে বাইরে রাখতে হতো। তার প্রিয় গাধার এ দুরবস্থা সইতে না পেরে মোল্লা খোদার কাছে প্রার্থনা করলো, ‘ হ খোদা, দয়া করে গরুটাকে মেরে ফেলো, যাতে আমার গাধাটা আরাম করে ঘরের ভেতর ঘুমাতে পারে।’ এদিকে গাধাটা বাইরে থাকতে থাকতে দুর্বল হয়ে সে রাতেই মরে গেল। সকালে মোল্লা ঘুম থেকে উঠে দেখে গাধাটা মরে পড়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে মোল্লার খুব মন খারাপ হলো। সে বললো, হে খোদা তোমার কাছে আমার কোনো অভিযোগ নেই, খালি জানতে চাই সারা জাহানের মালিক হয়েও তুমি কি কোনটা গাধা আর কোনটা গরু পার্থক্য করতে পারলে না!” এ গল্পে মোল্লা গিন্নীর সংসারে যে আধিগত্য কেমন ছিলো তা জানা যায়। মোল্লাকে এখানে স্ত্রৈণ বলেই মনে হয়। শুনেছি, সৈয়দ মুজতবা আলীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো স্ত্রীর অনুগত স্বামীকে স্ত্রৈণ বলে কিন্তু স্বামীর অনুগত স্ত্রীকে কী বলে? তিনি জবাবে বলেছিলেন, এমন স্ত্রী জগৎ-সংসারে পয়দা হয় নি, তাই এ শব্দ অভিধানে পাওয়া যায় না। আমি অবশ্য নিশ্চিত নই এটা কেউ সৈয়দ সাহেবের নামে চালিয়ে দিয়েছেন কি না! কিন্তু হোজ্জার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে গল্প কম নয়। একটা এখানে জুড়ে দেই।
নাসিরউদ্দিনের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর এক বছর পর এক বিধবাকে বিয়ে করলো সে। একদিন মনোরম সন্ধ্যায় দুজনে এক বিছানায় শুতে গেলো। স্ত্রী খুব আন্তরিকতার সঙ্গে স্বামীকে বললো, তুমি কি জানো আমার প্রথম স্বামী ছিলেন অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। নাসিরউদ্দিন নতুন স্ত্রীর মুখে প্রথম স্বামীর গল্প শুনে খুব বিরক্ত হলো। বললো, তুমিও কি জানো আমার প্রথম স্ত্রী ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর ও আকর্ষণীয়। নতুন স্ত্রীতো কম যায় না। এবার সে বললো, তা হতে পারে। তবে আমার প্রথম স্বামীর কোনো তুলনা হয় না। তিনি ছিলেন পোশাক-আশাকে অত্যন্ত বনেদি রুচির।
: আমার প্রথম স্ত্রী খুব ভালো রাঁধুনি ছিলেন। বললো হোজ্জা।
: আমার প্রথম স্বামী ছিলেন মেধাবী গণিতবিদ। স্ত্রী বললো।
: আর আমার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ভালো সংগঠক। সংসার গুছিয়ে সাজাতে তার তুলনা ছিলো না।
: আমার প্রথম স্বামী ছিলেন নায়কদের মতো সুদর্শন আর বলবান।
এভাবে দুজন দুজনের প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রীর প্রশংসা করতে করতে এক পর্যায়ে নাসিরউদ্দিন ধৈর্য হারালো। সে তার স্ত্রীকে ধাক্কা মেরে খাট থেকে ফেলে দিলো। তার স্ত্রীর বাম হাত গেলো ভেঙে। মোল্লা-পত্নী এ ব্যাপারে এতো মনঃক্ষুণ্ন হলো যে, ডিভোর্সের আবেদন করলো স্থানীয় কাজী অফিসে। কাজী বিস্তারিত শুনে মোল্লার কাছে জানতে চাইলেন তার বক্তব্য। মোল্লা বললো, “হুজুর আমাদের যে বিছানাটা আছে সেটাতে দুজন মানুষ আরামে ঘুমাতে পারে। কিন্তু সেটাতে ঘটনার দিন আমরা দুজন শোয়ার পর আমার প্রথম স্ত্রী ও আমার বর্তমান স্ত্রীর প্রথম স্বামী এসে শুয়ে পড়লো। আপনিই বলুন হুজুর, চারজনের জায়গা কি দুজনের খাটে হতে পারে? এদের দুজনকে নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে দুর্ঘটনা ঘটে গেল, হুজুর।“
অনেক তো কেবল হোজ্জা আর হোজ্জা—গিন্নি নিয়ে হলো। এবার ওদের সন্তান-সন্ততির খবর নেই না কেন।
হোজ্জা-গিন্নির বাচ্চা-কাচ্চা হবে। যখন তখন অবস্থা। রাতে হোজ্জা ঘুমিয়ে পড়েছে, স্ত্রী কাতর স্বরে বললো, ওগো, আমার ডেলেভারি এখনই হবে মনে হয়। স্ত্রীর গলার আওয়াজে হোজ্জা বুঝলো অবস্থা গুরুতর। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে মোমবাতি জ্বালালো। তারপর বাচ্চার জন্ম হওয়ার অপেক্ষায় থাকলো। একটা বাচ্চা হলো। সে বাচ্চাকে তুলে পাশে রাখলো হোজ্জা । এরমধ্যে লক্ষ করলো আরেকটা বেরিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি সেটাকে তুলে নিতে না নিতেই আরেকটার মুখ। এবার সে তাড়াতাড়ি বাতিটা নিবিয়ে দিলো। “এটা কী করলে? এখন কী হবে?” হোজ্জার অদ্ভুত আচরণে হোজ্জা-গিন্নির আর্ত চিৎকার করে উঠলো। এটা শুনে হোজ্জা বললো, চিন্তা করো না। মোমবাতি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখছো না একটার পর একটা বাচ্চা আসতে শুরু করেছে। তাই বাতি নিবিয়ে দিলাম। দেখ চার নম্বরটা আসা বন্ধ হয়ে যাবে।
এরপর চার নম্বরটা আর হয়েছিলো কি না গল্পে পাই নি। তবে আমার কেন জানি সন্দেহ হয় বাচ্চা আসলে তিনটাই ছিলো। বাচ্চা নিয়ে হোজ্জার আরেকটি গল্প বড়ই মর্মান্তিক! হোজ্জা এক বিধবাকে বিয়ে করেছেন। বিয়ের এক সপ্তার মধ্যে নতুন বৌ একটা ছেলে-সন্তানের জন্ম দিলো। হোজ্জা সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে স্কুলের ব্যাগ বই কিনে নিলো। তারপর গেলো দর্জির কাছে। দর্জি তার পূর্ব-পরিচিত। বললো, ছেলের জন্য স্কুল ড্রেস বানাতে হবে। দর্জিতো অবাক! বললো, বাচ্চার বয়স তো মাত্র একদিন হলো। এতো তাড়াতাড়ি স্কুলের জামা দিয়ে কী হবে? জবাবে হোজ্জা বললো, আমার বাচ্চা যদি দশ মাসের সফর ৭দিনে শেষ করে তাহলে কে বলতে পারে সে কাল থেকে যদি স্কুলে যেতেও কান্না জুড়ে দেয়? সংসারে এক সাথে থাকতে গেলে ঝগড়াঝাটি হয়। ঝগড়াঝাটি নিয়ে আরেকটি গল্প আমরা এখানে দিতে পারি।
কোনো কারণে মোল্লা-স্ত্রী তার ওপর মহাখাপ্পা। সে মোল্লার জন্যে খুব গরম স্যুপ নিয়ে এলো। তার আশা গরম স্যুপে মুখ দিয়ে জামাইয়ের মুখ পুড়ুক। কিন্তু স্যুপের বাটিটা টেবিলে রাখতে না রাখতেই মোল্লা-গিন্নি নিজের প্রতিজ্ঞা নিজেই ভুলে বাটিতে মুখ দিয়ে, ঠাণ্ডা না করে এক মুখ স্যুপ তুলে নিলো। মোল্লা-গিন্নির চোখে পানি চলে এলো। কিন্তু তখনো সে আশা করছিলো মোল্লাও হয়তো বাটিতে মুখ দেবে।
: তুমি কাঁদছো কেন? মোল্লা-গিন্নিকে মোল্লা জিজ্ঞেস করলো।
: আমার দুঃখিনী মা, তিনি এ রকম স্যুপ পছন্দ করতেন এ স্যুপ খেতে গিয়ে তাঁর কথা মনে করে চোখে জল এসে গেলো গো। মোল্লার স্ত্রীর জবাব। নাসিরউদ্দিন স্যুপের বাটিটা টেনে নিলো এবং এক মুখ স্যুপ তুলে নিলো। মোল্লারও দুচোখে পানি চলে এলো এবং চিবুক গড়িয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
: তাহলে নাসিরউদ্দিন, তুমি কেন কাঁদতে শুরু করলে গো? মোল্লা-গিন্নির প্রশ্ন।
: হ্যাঁ, আমারও চোখে পানি চলে এলো কারণ তোমার হতভাগিনি মা মরার সময় তোমাকে নিয়ে মরে নি। তোমাকে জ্যান্ত রেখে গেছে সে জন্য।
হোজ্জার গল্প-সম্ভারে এ গল্পটা একটু ভিন্ন রকম। সাধারণত হোজ্জার গল্পে জাতপাতের বিভাজন নিয়ে খুন একটা নড়াচড়া করতে দেখা যায় না। এ গল্পে আরব আর কুর্দি দুপক্ষ। মাঝ থেকে হোজ্জা আর হোজ্জা-পত্নীকে আমরা চরিত্র হিসেবে পেয়ে যাই। যে দিক থেকে এ গল্পের এখানে জুড়ে বসাটা প্রাসঙ্গিক বলা যায়।
নাসিরউদ্দিন একদিন ভাবলো একটা পরিপূর্ণ আরব-পোশাক পরে বেরুবে। যখন সে বাড়িতে ফিরে এলো স্ত্রীতো দেখে অবাক! তার জামাটার জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। শরীরও দুএকজায়গায় আঘাত প্রাপ্ত।
“কী হয়েছে, তোমার? কেউ কি মেরেছে?”
“হ্যাঁ”। নাসিরউদ্দিন জবাব দিলো। “এই পোশাকের জন্য।”
“কিন্তু কেন?” স্ত্রী আবার জিজ্ঞেস করলো। “এটা কি কোনো কারণ হতে পারে একটা লোককে শুধু পোশাক পরার জন্যে এভাবে মারতে পারে?”
“সেটা ঠিক।” নাসির উদ্দিন বললো, “তবে এটা তোমার বলা উচিত কুর্দিদের যারা আরবদের মারার জন্যে খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
হোজ্জা ও হোজ্জাপত্নীকে নিয়ে লেখা গল্পের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। আমাদের এপিসোডের পরিসর ছোট করতে কমিয়ে দিলাম। ভবিষ্যতে হোজ্জার সংসার-২ এ আমরা ফিরে এলে ভালো হবে। আপাতত এটুকুই থাকুক। কিঞ্চিত শিবরাম চক্রবর্তী দিয়ে শেষ করি। একবার শিবরাম বাবু নাকি স্ত্রীকে প্রশংসা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। খুব সাজ-গোজ করে স্ত্রী সামনে এলে তিনি গদ গদ হয়ে বলেছিলেন, তোমাকে এতো এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে, তুমি আসলে পরস্ত্রীর মতো সুন্দর। সুইটি সুইটি!” এর প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিলো আমি জানি না। তবে হোজ্জাকে এমন বোকামি করতে কখনো দেখা যায় নি। (চলবে)
• কোটবাড়ী, কুমিল্লা