জেন গল্প 

গভীরভাবে জীবনান্বেষণের নাম ‘জেন’। প্রতিদিনের যাপিত জীবন থেকে জীবনসত্য আহরণই জেনবাদের মূলকথা। প্রকৃতপক্ষে, জীবনচর্চাই আসলে জেনচর্চা। যে কোন ধর্মের অনুসারী হয়ে এমনকি নিরীশ্বরবাদীরাও জেনচর্চা করতে পারেন। জেনবাদ ধর্মীয় পুস্তক, তত্ত্বীয় জ্ঞান, তীর্থস্থান গমন, ধর্মীয় অনুশাসনে গুরুত্ব না দিয়ে মানুষের জীবন ও হৃদয়বৃত্তির উপর জোর দেয়। কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কবিতায় জেনবাদের মর্মকথা পাওয়া যায়--‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোন মন্দির-কাবা নাই’।  

জেনের প্রবর্তক বোধিধর্ম (জন্ম : আনুমানিক ৪৪০খ্রিস্টাব্দ)। বোধিধর্মের জন্ম দক্ষিণ ভারতের পল্লভা রাজপরিবারে। পরে তিনি ভিক্ষুত্ব বরণ করে ৫২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চীনে চলে যান। চীনে তখন মহাযানী বৌদ্ধবাদ খুব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু এই বৌদ্ধবাদ ছিল আনুষ্ঠানিকতার সংস্কারে পরিপূর্ণ। বোধিধর্ম প্রাচীন তাওবাদ (Taoism) আর মহাযানী বৌদ্ধবাদের সমন্বয়ে এক নয়া জীবনবোধের কথা বললেন। এই দর্শনচিন্তার মূলকথা হলো ধ্যান। তাওবাদের প্রভাবে সংস্কৃত ‘ধ্যান’ শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে চীনে ‘চান’ (Chan)  রূপ ধারণ করল। জাপানে সূর্যপূজক শিন্টু ধর্মের প্রভাবে ‘চান’ (Chan) শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ‘জেন’ (Zen) হয়ে গেল। এভাবে জেনবাদ হয়ে উঠল বুদ্ধের অনুসারী জাপানের সাধু সম্প্রদায়ের দর্শন। পরবর্তীতে কোরিয়ায় বুদ্ধের অনুসারীগণ একে ‘সিওন’ আর ভিয়েতনামের বুদ্ধের অনুসারীরা একে ‘থিয়েন’ নাম দেন। 

নৈঃশব্দ্য মৌন ধ্যানমগ্নতাই জেন সাধনার সারকথা। নিরবতার কাছে সমর্পিত হওয়াই জেন সাধনার পাথেয়। তাও গুরু লাও জি (ষষ্ঠ শতাব্দী) একবার বলেছিলেন যে, ‘একটি ভবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্থান কেবল দেয়াল ও ছাদ নয়--যা বাস্তুনির্মাতা অনেক যতেœ নির্মাণ করেন, মূল্যবান ওর পাশের শূন্য স্থানটুকুও’। 

এই জেন সাধকদের নিয়ে অনেক বিস্ময়কর সুন্দর গল্প প্রচলিত আছে। এসব গল্পকেই বলা হয়--জেন গল্প। 


এক মার্শাল আর্টের ছাত্র তার মাস্টারের কাছে জানতে চাইল, “আমি মার্শাল আর্ট--বিদ্যা আরো ভালোভাবে রপ্ত করতে চাই। এজন্য আমি আপনার পাশাপাশি অন্য একজন মাস্টারের নিকট হতে দীক্ষা নিয়ে তার কৌশলগুলোও শিখতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?” 

মার্শাল আর্টের মাস্টার উত্তর দিল : ‘যে শিকারী একই সাথে দুটো খরগোশ শিকারের লক্ষ্য স্থির করে সে আসলে কোনটিই শিকার করতে পারে না’। 


চুয়াং জো নামে একজন প্রখ্যাত তাও গুরু স্বপ্নে দেখলেন যে, উনি একটি প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন। স্বপ্নে বিভোর হয়ে তিনি তার মানবসত্তা সম্পর্কে বিস্মৃত হলেন। তাঁর সমস্ত অনুভূতি জুড়ে শুধু একটি প্রজাপতির অস্তিত্ব। পরক্ষণেই তিনি জেগে উঠে দেখলেন, তিনি যেখানে শুয়ে ছিলেন সেখানেই তিনি আছেন। এই ঘটনার পর তিনি ভাবতে লাগলেন, ‘আমি কী সেই ব্যক্তি যে স্বপ্নে একটি প্রজাপতি হয়ে গিয়েছিল অথবা এমনো তো হতে পারে আমি বাস্তবে একটি প্রজাপতি, যে নাকি এখন স্বপ্নে দেখছে সে একটি মানুষ’।


এক গ্রামে এক প্রবীণ কৃষক বাস করত। অনেক বছর যাবৎ চাষবাস করেই তার জীবন চলছিল। একদিন তার পোষা ঘোড়াটি পালিয়ে গেল। এই খবর শুনে তার প্রতিবেশিরা এসে সান্ত্বনা দিল--‘সবই তোমার নিয়তি’! কৃষক শুনে বলল-- ‘হয়তোবা’!

পরদিন সকালে ঘোড়াটি তার মনিবের বাড়ি ফিরে আসল, আর সাথে নিয়ে আসল তিনটি বন্য ঘোড়া। প্রতিবেশিরা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ভাগ্যচক্রে কী চমৎকার ব্যাপার ঘটে গেল’! কৃষক নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল- ‘হয়তোবা’! 

পরদিন তার ছেলে বন্য ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে আঘাত পেয়ে পা ভেঙে ফেলল। তার প্রতিবেশিরা পুনরায় এসে সহানুভূতি জানিয়ে বলল-‘তোমার পোড়া কপাল’! কৃষক আগের মত বলল-- ‘হয়তোবা’!  

ঠিক পরের দিন সেনাবাহিনীর একটি টিম গ্রামের যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য তালিকা করতে এল। তারা কৃষকের ছেলেটির পা ভাঙা দেখে তার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করল না। প্রতিবেশিরা এবার তাকে বাহবা দিয়ে বলতে লাগল--‘এ যাত্রায় আপনার জন্য ভালোই হল’। কৃষক এবারও বলল-- ‘হয়তোবা’!


তানজান আর ইকিদো একটি কাদামাখা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি পড়ছিল। রাস্তার মোড়ে এসে তারা দেখল, সিল্কের কিমোনো পরিহিত এক অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে কিছুতেই রাস্তা পেরোতে পারছে না। তানজান মেয়েটিকে আহ্বান করল-‘চলে আসুন’। মেয়েটিকে তার কোলে তুলে নিয়ে সে রাস্তা পার করে দিল। ইকিদো রাতে থাকার মন্দিরে পৌছা পর্যন্ত এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই বলল না। মন্দিরে পৌছে সে আর কিছু না বলে থাকতে পারল না। সে তানজানকে বলল-- ‘আমাদেরমতো সন্ন্যাসীরা নারী সান্নিধ্য কামনা করতে পারে না। বিশেষ করে, সুন্দরী যুবতীদের তো নয়ই। তুমি কেন তখন সেই মেয়েটিকে বহন করতে গেলে’?

তানজান বলল, ‘আমি তো মেয়েটিকে বহন করে সেখানেই রেখে এসেছি। কিন্তু তুমি তো তাকে এখনও বহন করে চলেছ’। 


রিয়োকান নামে এক জেনগুরু পাহাড়ের ধারে একটি ছোট কুড়েঘরে থাকত। এক রাতে এক চোর এসে দেখল--এখানে চুরি করার মতো মূল্যবান কিছু নাই। এমন সময়ে রিয়োকান বাড়ি এসে টের পেয়ে চোরটিকে ধরে ফেলল। তিনি চোরকে বললেন, ‘তুমি নিশ্চয় অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছ। সুতরাং তোমার একেবারে খালি হাতে যাওয়া উচিত হবে না। দয়া করে আমার পরনের কাপড়গুলো উপহার হিসেবে নিয়ে যাও’। এ কথা শুনে চোরটি হতবিহ্বল হয়ে গেল। সে কাপড়গুলো নিয়ে সটকে পড়ল। রিয়োকান নগ্ন বসে মুগ্ধ নয়নে পূর্ণিমা চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। আর তন্ময়চিত্তে ভাবল-- ‘আহা, বেচারা! আমি যদি তাকে এই অপরূপ  চাঁদখানা দিয়ে দিতে পারতাম’।


চারজন ভিক্ষু ঠিক করল-তারা একপক্ষকাল একটি কথাও না বলে ধ্যানমগ্ন হয়ে কাটাবে। প্রথমদিন সূর্যাস্তের পরে তাদের ঘরে থাকা মোমবাতিটি টিমটিম জ্বলে নিভে গেল। 

প্রথম ভিক্ষু বলে উঠল, একি হল! আমাদের একমাত্র মোমবাতিটি নিভে গেল। 

দ্বিতীয় ভিক্ষু বলল, যা-ই ঘটুক না কেন, আমাদের কিন্তু কোনমতেই কথা বলা উচিত নয়!

তৃতীয় ভিক্ষু বলল, তা-ই যদি হয়, তোমরা দুইজন কেন কথা বললে?

চতুর্থ ভিক্ষু হেসে বলল, আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে নাকি এখন পর্যন্ত টু শব্দটিও করেনি!  


জাপানের মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ) নানিন নামে এক জেনগুরু এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে তার ডেরায় আমন্ত্রণ জানালেন। ওই শিক্ষক জেন সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী ছিলেন। নানিন তার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করলেন। তিনি অতিথিকে নিজে চা পরিবেশন করলেন। কাপে চা ঢালতে গিয়ে কাপ পুরে যাওয়ার পরও তিনি ঢালা অব্যাহত রাখলেন। অধ্যাপক দেখলেন চায়ের কাপ উপচে চা পড়ে যাচ্ছে। তাই তিনি বললেন, কাপ তো চায়ে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এতে আর চা ধরবে না। 

নানিন বললেন, এই কাপের মতো আপনিও আপনার পূর্ব ধ্যান ধারণার দ্বারা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন। আমি আপনাকে জেনদর্শন বোঝাতে পারব না যতক্ষণ না আপনি আপনার পরিপূর্ণ কাপ একটুও খালি না করেন।


এক সম্রাট একজন প্রবীণ জেনগুরুকে জিজ্ঞেস করলেন, একজন পূণ্যবান ব্যক্তির মৃত্যুর পর আসলে কী ঘটে?

জেনগুরু বললেন, আমি জানি না ।

সম্রাট বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি তো একজন মহান জেনগুরু!

প্রবীণ গুরু বললেন, কিন্তু আমি তো এখনো মৃত হইনি ।


একটি ঘোড়া হঠাৎ টগবগিয়ে রাস্তায় ছুটল। দেখে মনে হল--ঘোড়সওয়ার কোন জরুরি কাজে কোথাও যাচ্ছে। ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক পথিক চেচিয়ে বলল,  কোথায় যাচ্ছ হে?

ঘোড়সওয়ার উত্তর দিল, তা তো আমি জানি না। তুমি বরং আমার ঘোড়াকে এটা জিজ্ঞেস কর।

১০
সোজান নামে এক চৈনিক জেনগুরুকে তার ছাত্র জিজ্ঞেস করল, পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী?

গুরু বললেন, মরা বিড়ালের মাথা।

মাথা ছাত্র আবার প্রশ্ন করল, মরা বিড়ালের মাথা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হয় কী করে?

সোজান জবাবে বললেন, কারণ কেউ এর দাম স্থির করতে পারে না । 

menu
menu