আলেক্সান্দার পুশকিন : তিনটি প্রেমের কবিতা

(আলেক্সান্দার পুশকিন (১৭৯৯-১৮৩৭) বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে একজন বিখ্যাত রুশ কবি। তাঁকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক বলা হয়। পুশকিনের সমগ্র সাহিত্য চর্চার মধ্যে তাঁর কবিতাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। বিশেষ করে প্রেমের কবিতার জন্য তিনি তাঁর সময়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। প্রেমের কবিতা, কাব্যনাট্য, মহাকাব্য ছাড়াও পুশকিন ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর ছোটগল্প ইস্কাবনের বিবি ও উপন্যাস ক্যাপ্টেনের মেয়ে  বাঙালি পাঠকের নিকট সুপরিচিত।)

জানালা

কিছুদিন আগে কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায়
ফিরছিলাম বাড়ির পথে,
মায়াময় চাঁদের আলোয় দেখি—
জানালার ধারে বসে আছে,
একাকী একজন তরুণী।
মনে হলো গভীর চিন্তায় ডুবে আছে সে,
উদ্বিগ্ন চোখে তাকাচ্ছে বারবার
অন্ধকার উঁচু-নিচু পথের দিকে।

‘এই যে আমি!’ কে যেন বলল চাপা স্বরে,
তরুণী কেঁপে উঠল ডাক শোনে,
খুলে দিল জানালা ত্রস্ত হাতে...
তখন লুকালো চাঁদ মেঘের আড়ালে।
‘ভাগ্যবান যুবক!’ মনে মনে বললাম আমি,
‘আনন্দময় রাত আজ তোমার বরাতে।
না জানি কতদিন অপেক্ষা করতে হয় আমাকে,
কোনো এক সন্ধ্যায় এমনি কোনো জানালা খুলবে বলে।’

*কবিতাটি ১৮১৬ সালে লেখা, পুশকিনের জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত।
 
আমার জন্মভূমি

অচেনা দূর দেশের প্রতি ছিল আমার মোহ,
আমি ছিলাম স্বদেশের অক্লান্ত সমালোচক।
প্রায়ই বলতাম, ‘এই দেশে কোথায়
প্রকৃত বুদ্ধিজীবী, প্রতিভাবান মানুষ?
কোথায় মহৎ নাগরিক যিনি
আলোকিত, মুক্তিকামী, স্বাধীনচেতা?
উষ্ণ হৃদয়ের সুন্দরী রমণী কোথায়—
যার রূপের ছটায় লজ্জা পায় পূর্ণিমার আলো?
কোথায় মেধাবীদের দীপ্ত আলোচনা—
যা কিনা সমৃদ্ধ নতুন চিন্তায়?
মনের মতো বন্ধু আর বন্ধুত্ব কোথায়?’ 
জন্মভূমির প্রতি ঘৃণাই জন্মে গিয়েছিল আমার।
হঠাৎ গতকাল হাসলো গোলিৎশিনা,
আর আমি মুহূর্তেই ভুলে গেলাম
জন্মভূমির প্রতি আমার বিতৃষ্ণার কথা।

*কবিতাটি ১৮১৭ সালের ৩০ নভেম্বর পুশকিন লিখেছেন আঠারো বছর বয়সে। কবিতার গোলিৎশিনা বাস্তবে ছিলেন সেন্ট পিটার্সবুর্গ শহরের সুন্দরী বিদুষী প্রিন্সেস আভদোতিয়া ইভানোভনা গোলিৎশিনা। অভিজাত এই রমণীর গৃহে নবীন ও প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতা পাঠের আসর বসত নিয়মিত। উদীয়মান তরুণ কবি পুশকিনের তীব্র আকর্ষণ ছিল গোলিৎশিনার প্রতি। কবিতাটি পুশকিনের জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত।  

ফুল

সদ্য কেনা বইয়ের পাতার ভাঁজে
পেয়েছি আমি এই শুষ্ক শীর্ণ ফুল।
তা দেখে আমার মনে উঁকি দিলো
নানান প্রশ্ন এলোমেলো :

কোথায় ফুটেছিল এই ফুল? কখন
কোন্ বসন্তে, কতকাল আগে?
কে দিয়েছিল ফুলটি—বন্ধু, না অচেনা মানুষ?
কেনই বা বইয়ের পাতায় সযত্নে রাখা?

এ কি কোনো মধুর সাক্ষাতের স্মৃতি,
নাকি বিষণ্ন বিদায়ের স্মারক? 
অথবা চুপচাপ হাঁটছিল সে মাঠের ধারে,
নির্জন বনের ছায়ায় একা একা... কেন?

তারা দু’জন কি বেঁচে আছে আজও সুখী পরিবার?
কোথায় ছিল তাদের ঘর, তেপান্তরের কোন্ মাঠে?
নাকি দু’জনের কেউ আর পৃথিবীতে নেই আজ,
দু’জনেই মৃত, বইয়ের পাতার ভাঁজে লুকোনো ফুলটির মতো?

*১৮২৮ সালে লেখা। পরের বছর প্রকাশিত। 


খুররম মমতাজ অনুবাদক। পেশায় ভূপদার্থবিদ। ছাত্রজীবনে দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়ায় থেকেছেন। সেই সূত্রে রুশ ভাষা, সাহিত্য, সমাজ ও রাশিয়ার মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে সেই রাশিয়া এই রাশিয়া নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। তিনি দশটির বেশি বইয়ের অনুবাদক, যার মধ্যে আছে পাঁচজন বিখ্যাত রুশ লেখকের গল্প-সংকলন ‘রুশ ছোটগল্প’।

menu
menu