আর্থার রিম্বাউড-এর কবিতা
(নিকোলাস আর্থার রিম্বাউড (২০ অক্টোবর ১৮৫৪-১০ নভেম্বর ১৮৯১ একজন ফরাসি কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন) তার সীমালঙ্ঘনমূলক এবং পরাবাস্তব থিম এবং আধুনিক সাহিত্য ও শিল্পকলার ওপর তার প্রভাবের জন্য, পরাবাস্তববাদের পূর্বরূপ। চার্লেভিলে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি খুব অল্প বয়সে লেখালেখি শুরু করেন এবং একজন ছাত্র হিসাবে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের মধ্যে প্যারিসে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তার কিশোর বয়সে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিত্যাগ করেছিলেন। কৈশোরের শেষের দিকে এবং যৌবনের প্রথম দিকে, তিনি তাঁর সাহিত্যিক হিসেবের প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য সিংহভাগ সময় তিনি ব্যয় করেছেন সৃজনশীল বিকাশে। রিম্বাউড তার শেষ প্রধান কাজ, আলোকসজ্জা একত্রিত করার পর ২০ বছর বয়সে সাহিত্য লেখা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেন। আর্থার রিম্বাউডকে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফরাসি কবি হিসাবে স্মরণ করা হবে। তাকে অভিহিত করা হয়—একজন ‘শিশু শেক্সপিয়ার’ নামে। তাঁর সংক্ষিপ্ত কাব্যজীবন, চার বছরের বেশি সময় ব্যয় না করে, দ্য ড্রানকেন বোট বা মাতাল তরী (১৮৭১) এর মতো দুর্দান্ত কবিতার জন্ম দেয়। ফরাসি কবি পল ভালুরি একবার লিখেছিলেন : ‘রিম্বাউডের আগে সমস্ত সাহিত্য সাধারণ জ্ঞানের ভাষায় রচিত হতো।’ বাস্তবে, অন্য যেকোনো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব বিদ্রোহী যুবককে আর্থার রিম্বাউডের মতো বর্বরতায় আবদ্ধ করে তা কল্পনা করা শক্ত। কবি হিসাবে তাঁর অবিশ্বাস্যভাবে সংক্ষিপ্ত কেরিয়ার শেষে—একটি পৌরাণিক ত্যাগ যা আজ অবধি তার অনুসারীদের প্রশংসায় ফেলেছিল—বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে মাত্র ২০ বছর বয়সে, তিনি কীভাবে আমরা কবিতা পড়ি, লিখি এবং ব্যাখ্যা করি সে সম্পর্কে ধারণাটি মূলত পরিবর্তিত করেছিল। কেবল এ কারণ নয় তিনি তাঁর বয়সের অন্যতম পরীক্ষামূলক কবি ছিলেন, তবে নিছক শ্রুতি, বেপরোয়াতা ও অস্থিরতার জীবনযাপন করেও তিনি ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। তাঁর উত্তরাধিকার জিম মরিসন, পট্টি স্মিথ, বব ডিলান, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ভ্লাদিমির নবোকভ এবং সেইসঙ্গে পরাবাস্তববাদী এবং দাদবাদীদের মতো শৈল্পিক আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত শিল্পীদের প্রভাবিত করেছে।
রিম্বাউড একজন স্বাধীনচেতা এবং অস্থির আত্মা ছিলেন, তিনি সহকবি পল ভারলাইনের সঙ্গে একটি ব্যস্ত, সময়ে-সহিংস রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন যা প্রায় দুই বছর স্থায়ী হয়েছিল। একজন লেখক হিসাবে অবসর গ্রহণের পর, তিনি তার সাঁইত্রিশতম জন্মদিনের ঠিক পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একজন ব্যবসায়ী এবং অনুসন্ধানকারী হিসেবে তিনটি মহাদেশে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। একজন কবি হিসেবে, রিম্বাউড প্রতীকবাদে তার অবদানের জন্য এবং অন্যান্য কাজের মধ্যে, এ সিজন ইন হেল, আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের অগ্রদূতের জন্য সুপরিচিত।)
মাতাল তরী
আমি কখন যে নিঃশব্দে নদীতে নেমে যাচ্ছিলাম বুঝতে পারিনি
টানা জালের আহ্বানে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম যেন
আদিম নৃবাসীগণ তাদের লক্ষ্যবস্তু দেখে উচ্চশব্দে হৈ হৈ করে উঠছিল
তারা নগ্নদেহে রঙ মাখছিল ও তাতে পেরেক ঠেসে উল্লাস করছিল।
আমি নাবিকদল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উদাসীন হয়ে তাকিয়ে ছিলাম
কয়েকজন কুলি ডাচদেশীয় গম আর বিলেতি তুলো বহন করছিল
আমি জাল টানতে গিয়ে খানিকটা থমকে গিয়েছিলাম পারিপাশ্বিক হট্টগোলে
কিন্তু আমার মন পড়েছিল নদীর গভীরতায়
যেন সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল আমার চিন্তার গভীরে।
জোয়ারের প্রবল তোপে ঢেউ আছড়ে পড়ছিল
মেরুদেশীয় চঞ্চল শিশুদের মতো উত্তালতা নিয়ে
আমি বিস্ময়ে দৌড়ালাম! এ এক অনাবিষ্কৃত উপদ্বীপ
দ্বীপ জয়ের উল্লাসে ফেটে পড়লাম যেন।
প্রবল ঝড় যেন সমুদ্র সতর্কতায় আশীর্বাদ বয়ে আনল
আমি কর্কের চেয়েও হালকা হয়ে ঢেউয়ের উপর নাচতে থাকলাম
যেন তা অন্তর্ক্ষতের বিপরীতে একবিন্দু উপশম
টানা দশরাত আমার এ বোকাচোখ আলোঘর বঞ্চিত ছিল।
বাচ্চাদের কাছে দ্বীপটি শক্ত আপেলের মাংসের চেয়েও মিষ্টি অনুভূত হতে থাকে
সবুজাভ জলে নেচে উঠছিল জাহাজের দেবদারু দেহ
আমি ধুয়ে নিচ্ছিলাম ব্লু ওয়াইনের উচ্ছ্বিষ্ট দাগ
শুকিয়ে যাওয়া বমি, জাহাজের মাস্তুল ও নোঙড় ভেড়ানোর হুক।
ঠিক তারপর থেকেই আমি কবিতায় স্নান করি
সাগরের জলে তারার আলোয় এই পোয়াতি নিশুতি রাতে,
এইসব মুহূর্তকে গ্রাস করছে কবিতার স্তবক পরমোল্লসিত স্নিগ্ধ আবরণে
জ্বল জ্বল করে জ্বলছে সমুদ্রতীর রাতের স্নিগ্ধ আলোয়
একটি চিন্তাশীল নিমজ্জিত চিত্র কখনো কখনো ডুবে যায়।
চারিদিকটা হঠাৎ নীলে নীলাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে
আমাদের প্রাত্যহিক প্রলাপগুলো নিমজ্জিত হয়েছে
পরাজিত দিনের ধীর আলোয়, প্রমত্তা স্রোতে
আমাদের রক্তিম ভালোবাসাগুলো
অ্যালকোহলের চেয়েও শক্তিশালী,
বীণার সুরের চেয়েও প্রগতিময়।
বিজলীর আলোয় ঝলকাচ্ছিল আকাশ
আর জলধারায় প্রজ্জ্বলিত হচ্ছিল সেই আলো
সার্ফ ও স্রোত যেন পাল্লা দিচ্ছিল
এ নিমগ্ন সন্ধ্যে আমার বহুদিনের চেনা
সে নেমে আসে যেনবা ঘুঘুর পালের মতো শান্ত ভোরের বেশে
মাঝে মাঝে দেখি মানুষের মুগ্ধতা, অবাক চাহনি!
এমন অতিন্দ্রীয় তীব্র বেগুনি রশ্মি সমেত ছড়ানো আলো
আমি খুব কম দেখেছি
ডুবন্ত সূর্যটি যেন আকাশের গায়ে উজ্জ্বল তিলকের মতো জ্বলছে।
ঢেউগুলো ঝিলমিল করে জ্বলতে জ্বলতে অনেক দূরে প্রবাহিত হচ্ছে
প্রাচীন নাট্যকারের মতো যেন সে মঞ্চ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
আমি একটি সবুজাভ রাতের স্বপ্ন দেখেছি
একটি নিবিড় চুম্বন সমুদ্রের বুকে জ্বলে উঠছে
অজানা প্রাণের খোঁজে সে প্রদক্ষিণ করছে
আর হলুদ ও নীল ফসফরাসসমূহ ক্রমশ জাগ্রত হচ্ছে।
অনুসৃত হচ্ছিল পোয়াতি মাসের ফুলে ফেঁপে জোয়ারের ঢেউ
খ্যাপাটে ষাঁড়ের মতো আছড়ে পড়ছিল প্রবালের প্রাচীরের ওপর
স্বপ্নহীনভাবে তার আত্মসমর্পণ মরিয়মের উজ্জ্বল পদতলে
যেন তা ষাঁড়ের লম্বাটে নাক থেকে নিসৃত হওয়া শোঁ শোঁ শ্বাসের শব্দ!
আমি আবারও থমকে দাঁড়াই ফ্লোরিডার অবিশাস্য দৃশ্যের সমুখে
ফুলের স্নিগ্ধতার সাথে মিশ্রিত হচ্ছে মানুষ ও চিতার চোখের চাহনি
নব দম্পতির উজ্জ্বল ত্বকে খেলা করছে রঙধনুর রঙসমূহ!
সাগরের দিগন্তের নিচে ঘুমিয়ে আছে সবুজের পাল!
আমি প্রকাণ্ড জলাভূমির নিচে দেখেছি খামিসমূহ—মাছ ধরার ফাঁদ
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাওয়া মাছের পাল আর তাদের ধরা পড়া
সুনসান নীরব জলে জমাট বাঁধে তুষার
আর অতল গহ্বরের দিকে বাড়তে থাকে আবছায়া দূরত্ব।
পাশাপাশি মিলেছে যেন হিমবাহ নদী,
রুপোলি সূর্য, মৌন ঢেউ আর অঙ্গারিত আকাশ
বাদামি উপসাগরের শেষে বীভৎস উপভূমি
যেখানে দৈত্যাকার সর্পকুল গিলছে ছারপোকাসমূহ
ধসে পড়া এবড়ো থেবড়ো গাছ থেকে ভেসে আসে কালো ঘ্রাণ।
আমি বরং বাচ্চাদের সানফিস দেখাতে থাকি
খেলা করতে থাকা নীল ঢেউ, সোনালি মাছ, গানের মাছ
আমার মুঠোর ভেতর দেখাতে থাকি বুদবুদ করতে থাকা পুষ্পফেনা
আমি তখন উতোল হাওয়ায় ডানা মেলে উড়তে থাকি।
শহীদের অবসন্ন দেহ ঘিরে ঘুরতে থাকে বায়ুমণ্ডল ও অক্ষাংশসমূহ
সমুদ্র, যার কান্না আমায় মৃদুমন্দভাবে আন্দোলিত করছে অহর্নিশ
অন্ধকারের দেহ থেকে সে চুষে চুষে খাচ্ছে মেঘাচ্ছন্ন হলুদ পুষ্পসমূহ
আমি তাঁর হাঁটুতে লুটিয়ে পড়ি পরাজিত নারীর মতো।
একটি দ্বীপসদৃশ স্থানে আমাদের প্রণয় সাঙ্গ করে
পাখিদের কিচিরমিচির ও হলুদপুষ্পসমূহকে পিছনে ফেলে
পালের দড়ি আলগা করে মাস্তুল তুলে আমি যাত্রা করি
পিছনে ফেলে এসেছি নিমগ্ন মানুষ
আমার ঘুমের চোখে নিয়ে যাচ্ছি কিছু অজানা সুখস্মৃতি।
আমি এখন গুহার অভ্যন্তরে পত্রপল্লববেষ্টিত
এক হারিয়ে যাওয়া নৌকো
ঝড়ের পাগলা হাওয়ায় উতোল মাতাল তরী
সৎকারহীন মৃত পশুর মতো পড়ে থাকা কোন কিছু
দিশেহীন পালতোলা নৌকোর নাবিক সর্দার।
মুক্ত বাতাস ও ঘন কুয়াশায় সিগারেটের ধোঁয়া
কুণ্ডলি পাকাতে পাকাতে শূন্যে পৌঁছে যাচ্ছে
তার সাথে আমিও যেন আকাশের প্রাচীর মাড়াতে গোত্তা খাচ্ছি
কবিগণের জন্য প্রস্তুত আছে সুস্বাদু ফলের আচার ও সুসম্বন্ধ
ভূঁইফোড় সূর্যের আলো ও আকাশি রঙের শ্লেষ্মা।
কেউ একজন ছোট্ট বৈদ্যুতিক চাঁদের কাছে দৌড়ে যাচ্ছে
একটি বুনোতক্তা কিছু সহযাত্রীদের নিয়ে
পৌঁছে যাচ্ছে কৃষ্ণকৃতির সিন্ধু অববাহিকায়
যখন জুলাইয়ের করাল বায়ুপ্রবাহ আঘাত হানছিল
তখন যেন সামুদ্রিক নীলসমূহ জলন্ত ফানেলের মতো আবর্তিত হচ্ছিল।
আমি কম্পিত হলাম পঞ্চাশের সমাবর্তিত লগ্নে
জলহস্তির মতো তীব্র শব্দে গোঙাতে গোঙাতে
উত্তাপ ছড়াচ্ছে নরওয়ের উপকূলে
অন্তর্লীন চরকায় ঘুরছে নীল নিথরতা
আহ কোথায় আমার ইউরোপের প্রাচীন প্রাচীরস্তম্ভ।
আমি দেখছি নক্ষত্রপূর্ণ আর্চিপিলোজো দ্বীপ ও তার পার্শ্ববর্তী দ্বীপপুঞ্জ
সাগরের পরিব্রাজক হয়ে যেন আকাশের কাছে বিলাপ করছি—
এই সেই নিরুদ্দেশ রাত, যে রাতে নিদ্রাযাপন করে তুমি নির্বাসিত হয়েছো
কোটি কোটি সোনালি পাখি, ছুটে যাচ্ছে কি ভবিষ্যতের ঐশ্বর্যে?
কিন্তু, সত্যি বলতে কী, আমিও অনেক কেঁদেছি!
ভোরের আলো আমার জন্য ছিল বেদনাদায়ক
প্রতিটি চাঁদ নৃশংস আর প্রতিটি সূর্য তিক্তময়
ভালোবাসার বিস্বাদময়তা আমাকে মাতাল করেছে, অসাড় করেছে।
আমার জাহাজের তলদেশ খুলে ফেল!
আমি সমুদ্রে বিলীন হতে চাই!
আমি যদি ইউরোপের জল চাই, তবে তা কালো
শীতল ঘোলাযুক্ত যেখানে মিষ্টি গন্ধের আমেজে গোধূলি নেমে আসে
একটি শিশু সকল বিষণ্ণত ভুলে উবু হয়ে বসে আছে
তার সমুখে মে’র প্রজাপতির মতো ভঙ্গুর একটি নৌকো।
আমি আর পারবো না, তোমার ক্ষোভে স্নান করতে, ওহে ঢেউ
জেগে ওঠা তুলো বোঝাই নৌকোটাকে অনুসরণ করি বরং
গর্বিত পতাকা ও অহমিত অগ্নিশিখাকে অতিক্রম করো না
কিংবা এই কারাগার জাহাজ ও ভয়ানক চোখের নিচে সাঁতার কেটো না।
(ইংরেজি ভাষান্তর : ওয়ালেস ফাওলি)
স্বপঞ্জয় চৌধুরী কবি, গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা : ১০ টি। কবিতা : পতঙ্গ বিলাসী রাষ্ট্রপ্রেম (২০১১) কালযাত্রার স্নিগ্ধ ফসিল (২০১৬, কলকাতা) দ্রোহ কিংবা পোড়ো নদীর স্রোত (২০১৮), কিশোর কাব্য : মায়ের মতো পরি (২০২০), গহিনে অরণ্য নদী (২০২১) গল্পগ্রন্থ : জলপিপিদের বসতবাড়ি (২০১৩), ডুবেছিল চাঁদ নিশিন্দা বনে (২০২১) প্রবন্ধ : নিগূঢ় শিল্পের কথাচিত্র (২০২১), অনুবাদ কবিতা : ভিনপাখিদের স্বর (২০২২)। তিনি ঢাকায় একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন।