অন্নপূর্ণা মন্ডলের শেষ চিঠি

[বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকের ভারতীয় হিন্দি সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সুধা অরোরা। ১৯৪৬ সালের ৪ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতবর্ষের লাহোরে তাঁর জন্ম। সেখানে স্কুলশিক্ষার পর্ব শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় আসেন। বিএ (অনার্স) এবং এমএ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদকসহ সুধা এই দুটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মাত্র ২৩ বছরে বয়সে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ এই দু’বছর কলকাতার দুটি মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গে অস্থায়ীভাবে যুক্ত ছিলেন।

সুধার প্রথম গল্প ‘মরী হুই চীজ্’ ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জ্ঞানোদয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বছর দুয়েক পর, ১৯৬৭-তে বের হয়েছিল ওয়াগ্যার তরাশে হুয়ে তাঁর প্রথম গল্পসংকলন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি মুম্বইয়ের সরকারি কর্মপ্রকল্পে যুক্ত ছিলেন এবং সেই সূত্রে সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।

বারোটি গল্পসংগ্রহ, একটি কাব্যগ্রন্থ, একটি উপন্যাস এবং দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ নিয়ে সুধা অরোরার সৃষ্টিজগৎ। এছাড়া অনুবাদ, গ্রন্থসম্পাদনা, কলাম নিবন্ধ রচনাতেও তিনি সার্থক। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার পাশাপাশি বহু বিদেশি ভাষাতেও তাঁর লেখালিখি অনূদিত এবং সংকলিত হয়েছে।উত্তরপ্রদেশ হিন্দি সংস্থান প্রদত্ত বিশেষ পুরস্কার (১৯৭৮), ‘ভারত নির্মাণ সম্মান’ (২০০৮), ‘প্রিয়দর্শিনী পুরস্কার’ (২০১০), ‘উইমেন্স অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড’ (২০১১), ‘মহারাষ্ট্র রাজ্য হিন্দী অকাদমী সম্মান’ (২০১২), ‘বাগমণি সম্মান’ (২০১৪) সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কারে সম্মানিত সুধার কলম এখনও সৃষ্টিশীল।]

শ্রীচরণেষু বাবা ও মা, 
সর্বপ্রথমে তোমরা আমার প্রণাম নিও। জানি বাবা, ওপরে আমার হাতের লেখা দেখে খামটা খোলার সময় তোমার  হাত কাঁপছিল। চিঠি যাতে ছিঁড়ে না যায়, তাই খুব সাবধানে ওটা খুললে। একবছর পর হঠাৎ তোমাদের চিঠি লিখছি কেন, সেটাই ভাবছ, না? কখনো পোস্টঅফিস থেকে তুমি, কখনো অফিস থেকে বাবলা বা বউদি ফোন তো করেই। তাহলে চিঠি? না, ভয় পেও না। নতুন কিছু ঘটেনি। অবশ্য নতুন কি-ই বা হওয়ার আছে?      

চিঠি লিখতে বসেও, সপ্তাহখানেক ধরে বারবার নিজেকে থামিয়ে দিয়েছি। কেন? তুমি তো জানোই বাবা, বম্বেতে এখন বর্ষা চলছে। মনে মনে খুব… খুব চাইছিলাম যত দেরি করে পারে বৃষ্টি নামুক, কিন্তু সময়ের আগেই সে এসে হাজির। আর যা ভয় পাচ্ছিলাম তা-ই হলো। বৃষ্টিতে পার্কের থকথকে মাটি মেখে পিচরাস্তা বেয়ে সেই লাল কেঁচোর ঝাঁক বাড়ির ভেতরে পর্যন্ত ঢুকে গেছে। রান্নাঘরে গেলে দেখি ওরা নর্দমার কোণ থেকে মুণ্ডু উঁচিয়ে উঁকি মারে, স্নান করতে গিয়ে চোখে পড়ে বালতির তলায় ওরা নিশ্চিন্তে লেগে রয়েছে। কখনো পায়ের তলায় হঠাৎ নরম কিছু ঠেকলে ভয় হয়, আমার চাপে কোনো কেঁচো আবার থ্যাঁতলে গেল না তো?   

আমাদের বাঁকুড়ার বাড়ির (দেখ, এখনো ওই বাড়িকেই নিজের ভাবছি) কথা এবার ভীষণ মনে পড়ছে। সেই স্মৃতিই তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হল। বাবা, তোমার বা বাবলার মনে আছে নাকি জানি না... বৃষ্টির জন্য আমরা কি অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছি। বছরের প্রথম বর্ষার ধারা দেখে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাকে খবরটা দিতে যেতাম। সত্যি! ওই জলের ফোঁটা শুধু যেন আমরাই দেখতে পাই, আর কেউ নয়। পাতার ওপর টপ টপ টপ করে বৃষ্টির শব্দ আর তার সঙ্গে হাওয়ায় মেশা ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ আমাদের পাগল করে দিয়েছে। খবরের কাগজ ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে পুকুরে ভাসাতাম। মা শুধু হাঁচি দিত আর আমরা সারাদিন পুকুরের ধারে, উঠোনে নুনের পুঁটলি হাতে বর্ষার কেঁচো খুঁজে বেড়িয়েছি। আমাদের চোখ এড়িয়ে সেগুলো দলা পাকিয়ে এদিক-সেদিক লুকোত, খুঁজে খুঁজে মারতাম। নুন দিলে ওদের লাল রঙ কীরকম বদলে যায়! কেঁচোগুলো যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কুঁকড়ানো দড়ির মতো হয়ে যেত। বাবলা আর আমি রেষারেষি করতাম, কে কত কেঁচো মেরেছি। বাবলা তো এক-একটার ওপর মুঠো মুঠো নুন ছেটাত।

মা, তোমার মনে পড়ে, বাবলাকে কত বকাঝকা করতে... খোকা, এত নুন দিস কেন রে? তবে প্রতিবার তো ও-ই জিতত... ওর মারা কেঁচোই সংখ্যায় বেশি। বাবা, পোস্টঅফিস থেকে ফিরে জানতে চাইতে... অ্যাই খুনিরা, তোরা আজ ক’জনকে মারলি? পরে কাছে বসিয়ে আদর করে আমায় বোঝাতে... বাবলা যা করে তুইও তা-ই করিস কেন? তুই তো মা অন্নপূর্ণা, দেবীস্বরূপা, জীব-জন্তু মারা কি তোকে মানায়? ভগবান পাপ দেবে রে।

তুমি সেদিন ঠিকই বলতে বাবা, আজ বুঝতে পারি। প্রাণ নেওয়া... সে মানুষ হোক বা জীবজন্তুর... খুন মানে খুনই। সেই পাপের শাস্তি দিতেই কি, বাঁকুড়ার বাঁশপুকুর থেকে এত দূরে... বোম্বের অন্ধেরির মহাকালী কেভস্ রোডের ফ্ল্যাটে আসার পরও, যে কেঁচোগুলো পুকুরপাড়ে নুনচাপা দিয়ে মেরে ফেলেছি... তারা আমায় ঘিরে ভয় দেখায় বাবা?               

আমার বিয়ের পর এটা পঞ্চম বর্ষা। বৃষ্টি নামার ঠিক আগেই তুমি বিয়েটা দিয়েছিলে। বাঁকুড়া থেকে বোম্বের দিকে যখন রওনা দিই, তোমাদের সবার কান্নাভেজা চোখেও তখন একটু আলো নাচছে, মেয়ে যেন কোন পরীর রাজ্যে চলল... ওখানে স্বর্গের অপ্সরারা তাকে আপ্যায়ন করতে ফুলের থালা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোনোদিন স্বপ্নেও যে পরীর দেশ দেখনি, রূপ আর কপালজোরে তোমার মেয়ে সেখানে যাচ্ছে। নাহলে অন্নপূর্ণা বা তার পিওন বাপ শিবু মণ্ডলের সাধ্য কি যে রেলের স্থায়ী চাকুরে সুদর্শন ছেলেকে তারা পাবে? এমন জামাই পেয়ে মা আর তুমি, দুজনেই সাংঘাতিক গদগদ হয়ে বিএ’র ফাইনাল পরীক্ষায় আমাকে বসতে দিলে না; উলটে ট্রেনের সেকেণ্ড ক্লাস কামরায় (সংরক্ষিত) চড়িয়ে বিদায় করলে। নিজের নতুন শাড়ি-গয়নাগাঁটি সামলে যখন পরীরাজ্যের সিংহ দরজা দাদার স্টেশনে নামলাম, মনে হল সাঁতার কাটতে ভুলে গেছি। এত লোক তো আমাদের গোটা গাঁয়েও দেখিনি। এখানে স্টেশনের তুমুল ভিড়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মনে হলো হাওয়ার ঠেলায় গাছের শুকনো পাতার মতো সবাই একদিকে উড়ে যাচ্ছি। বাবলা আর আমি কলকাতার চিড়িয়াখানায় বনমানুষকে যেভাবে দেখতাম... পাড়াগেঁয়ে লাল শাড়িতে, তোমার সারাজীবনের সঞ্চয়ে গড়ানো গয়না আর কাপড়ের বাক্স নিয়ে ওর সঙ্গে অন্ধেরির ট্রেনে উঠলে... সবাই ঠিক তেমনভাবে আমার দিকে চাইছিল। মহাকালী কেভসে্র বাড়ির জং ধরা তালা খুলতেই দোরগোড়ায় কে প্রথম বধূবরণ করেছে জানো? দরজার ফাঁক-ফোঁকরে লুকিয়ে থাকা, গুটলি পাকানো, ঘাড়-মাথা উঁচিয়ে থাকা লাল কেঁচোর পল্টন। সেদিন আমি ভীষণ খুশি হই। মনে হলো, আমার আঁচলে গিঁট বেঁধে বাঁকুড়া সঙ্গে এসেছে। আনন্দে হেসেছিলাম। কিন্তু আমার স্বামী ওগুলোকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। চপ্পল তুলে চটাখ্ চটাখ্ করে সব ক’টাকে পিষে দেয়। একঘায়ে একটা সাবাড়। এই প্রথমবার কেঁচোদের জন্য মায়া হল। ওদের এভাবে চিঁড়েচ্যাপটা হতে দেখে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল।

আমাদের দুজনকে একান্ত সময়-সুযোগ করে দিয়ে শাশুড়ি-ননদ নিজেদের শোবার ঘরে চলে যায়। তখন থেকে রান্নাঘরেই পর্দা টেনে শুই। সে ঘরের নর্দমা যতই বুজিয়ে দাও না কেন, কেঁচোর আসাযাওয়া বন্ধ হয় না। কাজের জন্য স্বামী প্রায়ই বাইরে বাইরে কাটায় আর আমি রান্নাঘরে। ওখানে অগুনন্তি কেঁচো। মনে হতো, আমি যেন মায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি; সারা জীবন হেঁশেলের দেওয়ালের ঘেরে কেঁচোর সঙ্গেই থাকতে হবে। একদিন আমার চোখ এড়িয়ে একটা কেঁচো রান্নাঘরের বাইরে চলে গেলে শাশুড়ির নজরে পড়ে। তক্ষুণি রাগে ওনার চোখ লাল। কেটলিতে চায়ের জল ফুটছিল, কিলবিলিয়ে বেড়ানো কেঁচোদের চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে উনি সেই ফুটন্ত জল ওদের ওপর ঢেলে দেন। সত্যি বলছি বাবা, আমার সারা গায়ে যেন ফোসকা পড়ে গেল, ওই জল ওদের ওপর নয়, যেন আমার গায়েই ঢালা হয়েছে। ওরা সঙ্গে সঙ্গে মরে গেল, একটাও বাঁচেনি। আমি কিন্তু মরলাম না। বুঝে গেলাম, বাঁকুড়াকে ছাড়াই এবার থেকে দিন কাটাতে হবে। তবে কেঁচোকে ভয় লাগত, এরকম কেন হলো বাবা? এরপর থেকে ওরা আসলে আর মারতাম না, আবার নর্দমায় ফেলে দিতাম। তখনকার চিঠিতে এসবই লিখেছি, কিন্তু তুমি কখনোই আমার চিঠি পাওনি। হয়তো এটাও পেলে না। কিংবা পেয়েও বললে যে পাওনি। ফোনে আমি জিজ্ঞাসাও করেছি... চিঠি পেলে? তুমি অবিশ্বাসের সুরে বললে... পোস্ট করেছিলি তো নাকি...। আমি হেসে ফেলেছি... আসলে নিজের কাছে রাখব বলে একটুখানিই লিখেছিলাম। তুমি আর কিছু বলনি। ব্যাস কথা শেষ।

ফোনে এত কথা কি বলা যায়? ফোনের তার বেয়ে আমার গলা তোমার কাছে পৌঁছে গেলেই ভাবো সব ঠিকঠাক আছে। বেঁচে রয়েছি, এটাই যেন আমার ঠিক থাকার প্রমাণ। এদিকে আমি অস্থির হয়ে যাই, কিছুতেই বোঝাতে পারি না, যা শুনলে সেগুলোই সব নয়। ফোনে শুধু আমার ভালো খবরই জানতে চাও, কেঁচোর ব্যাপারে কী করে বলি? বলতে গিয়ে খুব ইচ্ছে করলেও তো তোমার গলা জড়িয়ে ধরতে পারব না। তখন এই সতেরোশো কিলোমিটারের দূরত্ব আমায় দগ্ধে মারে। এত দীর্ঘ দূরত্ব পেরিয়ে দেড় বছর আগে যখন বাঁকুড়া গেলাম, মনে হলো, অচেনা অজানা কোন এক গাঁয়ে এসে পড়েছি। আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে, ভেবে বাপের বাড়ি আসার সুখ ভোগ করতে পারিনি। তাই হেলাফেলায় খবরটা দিলাম... আমার তিন মাস চলছে। আর কিছু বলার আগেই তোমরা সবাই আহ্লাদে ভেসে গেলে। বুকে জড়িয়ে ধরে মা’র সে কি আদর, কপালে বউদির চুমু। আমি কেঁদেছি, চিৎকার করেছি, হাতে পায়ে ধরেছি... এই বাচ্চা আমার চাই না, ওই বাড়িতে বাচ্চাদের কলকলানি শেষে কান্না হয়ে যাবে; কিন্তু তোমরা কোনো কথাই কানে তুললে না। চারজনে আমায় ঘিরে ধরলে... প্রথম বাচ্চাকে নষ্ট করে নাকি, প্রথম সন্তান নষ্ট করলে পরে আর হতে চায় না, মা হলেই মেয়েদের জীবন ভরে ওঠে, মা হওয়ার পর সব ঠিক হয়ে যায়, মেয়েরা বেঁচে থাকার রসদ পায়। নিজের মতো আমাকেও তুমি পরিপূর্ণ সংসারী দেখতে চাইছিলে, মা। সেকথা মেনে নিয়ে তোমাদের প্রত্যেকের স্বপ্নকে সযত্নে গর্ভে সাজিয়ে আমি ফিরে আসি।

আবার ফেরত আসা। গুহার মতো মহাকালীর সেই ফ্ল্যাটে। ওই কেঁচোদের কাছে। তফাৎ শুধু এই যে, এখন ওরা ঘরের মেঝে থেকে সরে আমার শরীরের ভেতর ঘুরছে। ন’মাস ধরে নিজের পেটে একটা আতঙ্ককে চাক বাঁধতে টের পেয়েছি। পাঁচ মাসে সেই পিণ্ড নড়াচড়া শুরু করলে ভয়ে আমার কাঁপন লেগে যেত। মনে হতো, বর্ষার সেই কেঁচোগুলোই পেটে কিলবিল করছে, এপাশ ওপাশ পিছলে যাচ্ছে। অবশেষে একদিন আমার শরীর থেকে ওরা বেরিয়ে এলো। অনেকক্ষণ অজ্ঞান থাকার পর চোখ মেলে, পাশে শোয়া কুঁচকানো চামড়ায় ঢাকা যমজ মেয়েকে দেখে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম, সত্যি বলছি মা। সেই হড়হড়ে লাল কেঁচোগুলোর মতো ওদের গায়েও অজস্র ভাঁজ।  আমিতো মাকে বলেও ছিলাম... দেখো মা, এই দুটো কী কুচ্ছিত দেখতে, সরু সরু নড়বড়ে হাত-পা, কালো, কেমন নেতিয়ে রয়েছে। তুমি বলেছিলে... কি বোকারে তুই, কেমন কথা বলছিস, সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-সরস্বতী একসঙ্গে তোর ঘরে এসেছে। মেয়ের কাছে আসবে বলে তোমরা কলকাতায় গিয়ে আমাদের জন্য গাদাখানেক কেনাকাটা করেছিলে, বউদি নতুন সোনার সেট দিয়েছিল। সে সব জিনিসপত্র (নাকি দানসামগ্রী?) নিয়ে এখানে এসে চল্লিশ দিন ধরে তুমি বাচ্চাসহ আমার আর শ্বশুর বাড়ির সবার সেবাযত্ন করে ফিরে গেলে। লক্ষ্মী-সরস্বতীদের সঙ্গে আমাকে জুড়ে দিয়ে তুমি বাঁকুড়ার বাঁশপুকুরে চলে যাওয়ার পর আমাকে বারবার শুনতে হয়েছে... এক অলক্ষ্মীকে হাসপাতালে পাঠিয়ে ছিলাম, আর ওদুটোকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে।

বাবা, লক্ষ্মী-সরস্বতীর মতো এই নাতনীদের জন্য তোমাকে অভিনন্দন। কখনো ইচ্ছে হয়, মেয়ে দুটোকে বেঁধে তোমার কাছে পার্সেল করে পাঠিয়ে দিই... আমি এদের সামলাতে পারি না; কিন্তু প্রতিবারই এদের পিটপিটানো চাউনি আমায় বাধা দিয়েছে। মা আমার খালি মনে হয়, তোমার মতো একজন ভালো মা কখনো হতে পারব না; যে সারাজীবন পাকশালার চার দেওয়ালে আটকে থেকে বাবলা আর আমার জন্য অপূর্ব সব রান্না করেছে, পক্ষাঘাতে পঙ্গু ঠাকুমার বিছানা ধুয়েছে কেচেছে। তোমার নাতনীরা চোখের বুলি দিয়েই আমার কাছে যা চায় সেইসব কোনোদিনই আমি ওদের দিতে পারব না।

এই পাঁচ-সাত মাসে কখন দিন হয়েছে বা রাত নেমেছে, টেরই পাইনি। এবারের বৃষ্টি এসে আমার সমস্ত ঘোলাটে চিন্তা-ভাবনা পরিষ্কার করে দিল। এরা দুজন হামা দিতে শিখে গেছে। সারাদিন নোংরা কাদামাটি লাগা কেঁচো নিয়ে খেলে। হাঁটু ঘষে ঘষে ওদের চলন দেখে বুকে ভর দিয়ে কেঁচোর হাঁটা মনে পড়ে আর বাইরে রাস্তায় মাঠের গলা মাটিতে চঞ্চল কেঁচোদের চেহারার সঙ্গে দুই বাচ্চার মিল পাই। সবসময় কেমন ভয় হয়, আমার স্বামী বাড়িতে এসেই চটাখ্ চটাখ্ করে এদের ওপর এলোপাথারি চপ্পলের ঘা না বসিয়ে দেয় কিংবা শাশুড়ি কেটলির ফুটন্ত জল না ঢেলে দেয়। জানি, এসব আমার অযৌক্তিক ভাবনা... এর কোনো ওষুধ নেই, কিন্তু এই বাতিকের বোঝা আর বইতে পারছি না। পারলে তোমাদের কাছে মেয়ে দুটোকে নিয়ে যেও। বাবলা আর বউদি হয়তো মেনে নেবে। শুধু এটুকুই চাই যে, আকাশ ছোঁয়া অসম্ভব জেনেও, বড় হয়ে ওরা যদি ছুঁতে চায়, তবে বাধা দিও না।

এই দুজনকে দিলাম, মানে তোমার মেয়েকে সুদে মূলে ফেরত পেলে। হয়তো এদের মধ্যেই আমাকে খুঁজে পাবে। বাবা, তুমি বলতে... আত্মা অমর। এই বিরাট মহাকাশে, শূন্যে শান্ত হয়ে সে ভেসে বেড়ায়। সেই শান্তি পেতে চাই। আমি বড্ড পরিশ্রান্ত বাবা। প্রতিটি মানুষই একটা সময়ে ক্লান্ত হয়। আমি তাড়াতাড়ি হলাম, এ আমারই দোষ। তোমরা দুজনে পারলে আমায় ক্ষমা কোরো।

ইতি  
তোমাদের অতি বাধ্য মেয়ে অন্নপূর্ণা মণ্ডল


শম্পা রায় অনুবাদক, ভারত

menu
menu