জাতিয়াত

(দুনিয়া কাঁপানো গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মাকের্সের দেশের আধুনিক লেখকদের মধ্যে উজ্জ্বল একটি নাম রদলফো লারা মেনদোসা। মূলত কবি হলেও গল্পে তার উপস্থিতি উপেক্ষা করা অসম্ভব। তাঁর গল্প আধুনিক গল্পের মান শুধু ধরেই রাখে না কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অতিক্রম করতে চায়। একদিকে যেমন আছে তাঁর শিল্পকুশলতা তেমনি অন্যদিকে আছে সহজ সরল ভাষার মধ্য দিয়ে পাঠকের সঙ্গে খেলার এক অদ্ভুত নিপুণতা। প্রায় সবসময়েই আপাত বয়ান করা গল্পটার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা গল্পটাই পাঠকের অংশগ্রহনে পরে মুখ্য হয়ে উঠে তার লেখনিতে। তিনি জায়গায় জায়গায় শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখেন ইঙ্গিতগুলোকে। ইঙ্গিতগুলোকে পুজি করে তাঁর চারপাশে জাল বিস্তার করে নতুন গল্প বানানোই হচ্ছে পাঠকের কাজ। আর সেই কাজটি নিজের অজান্তেই করে চলেন তার পাঠক স্বতঃস্ফূর্তভাবে।)

যে রাতে ওর পনেরতম জন্মদিনে উৎসব হবে না শুনে আমার মেয়ে কাঁদে সেই রাতেই আমি কাজটি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সঙ্গে সঙ্গেই মোচুয়েলোকে ফোন করি। না, কোনো দ্বিধা নিয়ে নয় কারণ দিন কয়েক আগেই আমি ওই কাজটি করতে রাজি হইনি। যেহেতু বলেছিলাম ভেবে দেখব, তাই সে খুব আগ্রহভরে কলটি ধরে। তাই পরেরদিন সকাল সকাল ওর অফিসে হাজির হই। অফিসটি ছিল স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালের এক ভবনের চারতলায়। মোচুয়েলো রিসিপশনে এসে দুহাত ছড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করে। 

অফিসে ঢুকে আমাকে জানায় যে কাজটা খুবই বড়। যদি সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয় তাহলে কমপক্ষে এক বছর আর আমাকে অর্থের জন্য ভাবতে হবে না। যেটা আমার জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও আমি অবসর নিতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু তারপরও স্ত্রীর জন্য, মেয়ের জন্য কিছু করা দরকার। সত্যিকার অর্থে মেয়ের পনেরতম জন্মবার্ষিকীটাই ছিল আসল প্রেরণা কারণ গতরাতে তখনো ও খাবার শেষ করেনি যখন আমি আমাদের আর্থিক সঙ্গতির কথা জানাই আর সে খাবার থালা আস্তে করে এক দিকে ঠেলে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে আর আমার ইচ্ছে জাগে কিছু একটা করার। যখন মুখ ফেরায় তখন মনে হচ্ছিল সে হাসছে কিন্তু আসলে কাঁদছিল। আমি আশ্চর্য হইনি কারণ কখন ওর চোখে জল দেখিনি; ও ছিল আমার মতো, কোনো কিছুতেই আমার কান্না আসত না। এমনি এমনিই স্ত্রী আমাকে বলত না যে আমি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সনবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলছি। কিন্তু এই মেয়েটি যে ছিল আমার সর্বস্ব, আমার জীবন ভেলা, সংবেদনশীলতার মরুদ্যান, তার কান্না দেখে বুঝতে পারি যে এ বিশ্বে শুধু এই একটি জিনিসই আমাকে ভেঙে ফেলতে পারে। তাই হয়তোবা ওর মতোই আমারও হাসি মাখা কাঁদা উচিত ছিল। কিন্ত সত্যিকার অর্থে কীভাবে যে হাসব তাও ভুলে গেছি।

মোচুয়েলো যখন আমাকে কাগজগুলো দিচ্ছিল তখন আমি এসবই ভাবছিলাম। ওখানে সবমিলিয়ে চারটি দলিল ছিল যাতে এক ব্যাঙ্কারের সই বসাতে হবে। দলিলগুলোর সঙ্গে আর একটি কাগজ ছিল যাতে ছিল ব্যাঙ্কারের পরিচয়, ঠিকানা, সাধারণত কোথায় তার যাতায়াত আর সঙ্গে তার সম্পর্কে অন্যান্য তথ্যাদি। যদিও এই ধরনের কোনো কাজে এসমস্তের প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু কাজ আরম্ভ করতে এটাই ছিল আমার প্রধান শর্ত। প্রথম দিকে এটি নৈতিকতার প্রশ্নে এই সব চাইলেও পরে ভালোভাবে কাজ করার জন্য এসব তথ্য অনিবার্য হয়ে পরে। আমার আত্মপ্রকাশের শুরু হয় ভিডিও গেমে আসক্ত এক সহচরের মা’র চেক জালের মধ্য দিয়ে। মোচুয়েলো কোনোভাবে এই দক্ষতার কথা জানতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হাজির হয়। ওর হাতে ছিল অধিকর্তাদের মিটিংয়ের এক সংশোধিত কার্যাবলীর ফর্দ (অনিলিখন)। ওর ভাষায় সেটা কোনো প্রতারণা ছিল না কারণ মিটিংটা ঠিকই হয়েছে আর পাশের শহরে গিয়ে অধিকর্তাদের সই নেয়ার ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্যই সে কাজটি করছে। ওকে বলি হাত মকশ করার জন্য দিন দুয়েক সময় দিতে, কিন্তু সে বলে হাতে সময় নেই। ফলে এক নজর আসল সই’র দিকে তাকিয়ে যে কলমটি বাড়িয়ে দিয়েছিল সেটি নিয়ে কোনো কিছু চিন্তা না করেই সই করে দিই। মোচুয়েলো একবার নকলটির দিকে একবার আসলটির দিকে তাকায়। এভাবে অন্তত চারবার তাকানোর পর আমি নিজেই যখন নকলটির গুণাগুণ সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পরি তখন নিজের আবেগ ধরে রাখতে না পেরে অদ্ভুতভাবে অভিনন্দন জানায়। বলে যে আমার জন্মই হয়েছে অবৈধ রাস্তায় চলার জন্য। কারণ আমি হচ্ছি জালিয়াতদের গুরু আর এতে করে আমার ভেতরে পরস্পরবিরোধী অনুভূতির সৃষ্টি হয়। এক দিকে সে আমাকে শুধুমাত্র প্রচুর অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা দেখায়। কিন্তু অন্যদিকে সত্যিকার অভাবি কোনো মানুষের অর্থ আমরা নিয়ে নিচ্ছি এ কথা ভাবতেই ধাক্কা লাগে। সেটাই ছিল সেই নিয়ম  বাস্তবায়নের শুরু। তখন থেকেই বিবেককে শান্ত রাখতে ক্ষতিগ্রস্থদের তথ্য চাইতে শুরু করি। আর তার সঙ্গে তাদেরকে পর্যবেক্ষণও করতে থাকি।

প্রথমদিকের কাজগুলোর একটিতে জানতে পারি সই’র মালিক হচ্ছে বাঁহাতি। ওকে অনুসরণ করতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পাই তার চুল আঁচড়ানোর দিকটা। আর নিজের অজান্তেই ওর মতোই চুল আঁচড়াতে শুরু করি, একই খাবারের অর্ডার দেবার অনুসরণ করি রেস্তরাঁ পর্যন্ত, আর একই ধরনে ছুরি কাঁটাচামচ চালাই। তার পরে ওর মতো করে সই করতে পারব কিনা এ নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু ওর মতো কয়েকদিন একই জীবনযাপনের পর আমাকে আশ্চার্য করে দিয়ে সইটা সাবলীলতার সঙ্গে বেরিয়ে আসে। তখনই বুঝতে পারি জাল শিল্পের নিগূঢ় কথাটা। সইটা যদিও হাত দিয়ে বেরিয়ে আসলেও আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে আত্মার, যা বারেবারে পুনরাবৃত্তির ফলে অভ্যাসে পরিণত হয়ে পরিপূর্ণতা পায়। ফলে এই জীবিকার জন্য আমার জীবনের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্থদের জীবনযাপন করা ছিল একেবারেই আবশ্যিক। ওদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার খুঁটিনাটিও ছিল একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। সে কি ধূমপান করত বা জুয়া খেলত। মদ্যপায়ী নাকি সম্পূর্ণরূপে মদ ছোঁয় না। তার কি সঙ্গিনী ছিল নাকি হস্তমৈথুন করত। নাচত নাকি শুধুমাত্র স্নান ঘরে গান গাইত। একবার যখন সব জানতে পারতাম তখন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তা অনুকরণ করতাম। আর এটাই ছিল আমার সাফল্যের মূলমন্ত্র।

বারেবারে এই ধরনের অনুশীলনের ফলে মানব চরিত্রের একাংশ আমার সামনে উৎঘাটিত হয়। আর এভাবেই মোচুয়েলো আমাকে কাগজগুলো দেবার সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে এমনকি অনুসরণ করার আগেই বুঝে ফেলি ব্যাঙ্কার ছিল নিঃসঙ্গ আর নিঃসঙ্গতা তাকে পীড়া দিচ্ছিল।

দুসপ্তাহ ধরে অনুসরণ করি তাকে আর এই সময়ে ওর মতো একই খাবার খাই, একই চলচ্চিত্র দেখি আর রেস্তরাঁতে দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে খাবার আসা পর্যন্ত মারগারেট দুবার যে উপন্যাসটি পড়ত সেটির আনুমানিক একই পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়তাম। এখানে বলে নেয়া ভালো যে সন্দেহ এড়াতে আমি বইটির আলগা প্রচ্ছদ পাতা হুয়ান হোসে মিয়্যা লিখিত এক উপন্যাসের প্রচ্ছদের সঙ্গে বদলে নিয়াছিলাম।

ওই দীর্ঘ দুসপ্তাহে রাতের খাবারের পর ওরই মতো করে কিছুকক্ষণ হেঁটে এসে প্লাসার এক রেস্তরাঁতে কফি নিয়ে বসতাম। পরে ওর মতো একই ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে একইরকম হাতের ভঙ্গি করে ট্যাক্সি থামিয়ে ট্যাক্সিওলাকে বলতাম এএম কম্পাঙ্কের বোলেরো বাজত এমন এক রেডিও স্টেশন ধরতে। এভাবেই অলিম্প কারদেনাস বা বিয়েনবেনিদো গ্রান্দা বা আল্বেরতো বেলত্রানের গান গুনগুন করতে করতে স্ত্রীর ইস্তফা দেয়া দৃষ্টির সামনে দিয়ে সচরাচর সময়ের থেকেও দেরি করে বাড়ি ফিরে অতিথিঘরে দরজা লাগাতাম আর ঘুমোবার আগে কারও প্রতিচ্ছবি মনে না এনেই হস্তমৈথুন করে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণতার ভান করতাম। সত্যিই ভীষণভাবে বিষণ্ণ হয়ে পড়তাম।  

দুসপ্তাহ শেষ হবার পর তখনো মেয়ের জন্মদিন উৎসবের এক সপ্তাহ বাকি; চারটে দলিলই সই করি। ওটাই ছিল আমার করা শেষ জাল, আমার অবসর নেয়া। কলমটা দূরে ছুড়ে দিই আর একই সঙ্গে কেবল করা কাজটার জন্য আর এযাবত করা কাজের অপরাধবোধ। পরের দিনগুলোতে ওকে অনুসরণ করি কোনো কারণ না জেনেই। আসলে কোনো কারণই ছিল না অনুসরণ করার। কিন্তু কিছু একটা ছিল যা আমকে চঞ্চল করত, কিছু একটা যা আবিষ্কার করেছি ওই দিনগুলোতে, যা খুবই পরিচিত। সেটা নিশ্চিত কিছুই ছিল না, ছিল না কোনো ক্রিয়া বা কোনো অঙ্গভঙ্গি, ছিল প্রান্তিক কিছু একটা যা কিনা কোনো কিছু হয়ে ওঠার একেবারে কিনারে এসেও হয়ে ওঠে না, যেন জিহ্বার ডগায় আসা কথা কিন্তু উচ্চারণ করতে পারা যায় না।

ওই দিনগুলোতে যখন মেয়ের উৎসবের খুঁটিনাটির সমন্বয় করছিলাম, ওকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করি আর ওর অভিব্যক্তির মধ্যে দেখতে পাই এক পরিবর্তন। আত্মসাতটা যে এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়ে গেছে তা বলাই বাহুল্য আর এটাও ঠিক যে ওই কারণেই সে ভালো রকমের হাতাশার ধাক্কা খেয়ে প্রচণ্ড বিষণ্ণ হয়ে পরেছে। এতে যে আনন্দ পেয়েছি তা বলব না তবে বিমর্ষও হইনি। মেয়ে যে আনন্দিত হবে সেটাই ওই মুহূর্তে আমার জন্য ছিল যথেষ্ট। আর সে আনন্দ সত্যিকারের আনন্দ, হাসির ছলে বিষণ্ণতা নয়।

উৎসবের আগের দিন ওর সঙ্গে যখন দুপুরের খাবার শেষ করেছি তখন স্ত্রী এসে হাজির হয় রেস্তরাঁতে। ভেবেছিলাম আমার ওপর খুব রাগ ঝাড়বে কারণ আমার ওই আচরণের কোনো ব্যখ্যাই সে পায়নি। কিন্তু আমাকে আশ্চার্য করে দিয়ে আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে সে সোজা ব্যাঙ্কারের টেবিলের দিকে যেয়ে আন্তরিকভাবে সম্ভাষণ জানায় আর বসে পরে। আমাকে আড়াল করে রাখা টেবিলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই প্যাশন থেকে নয় বরঞ্চ মমতা নিয়ে ওর হাত ধরে। বর্তমানে যে তারা প্রেমিক প্রেমিকা ছিল না তা ছিল স্পষ্ট, কিন্তু এটাও স্পষ্ট ছিল কোনো কালে তাদের মধ্যে প্রেম ছিল। ভাবি, এখন আর এর কোনো গুরুত্ব নাই। মেয়ের উৎসবের মাত্র এক দিন বাকি, আর যে আমাকে এই লম্বা পনের বছর যা দিয়েছে তাই পরিস্থিতি মেনে নেবার জন্য যথেষ্ট। গতকাল ওদের মধ্যে যাই ঘটে থাকুক না কেন; হঠাৎ করে এমন কিছুই ঘটতে পারে না যা কিনা আগের সম্পর্ককে পুনরুজ্জিবিত করবে আর আমাকে স্পর্শ করবে। আমাদের প্রেম এযাবৎ আমি যেমন করে এসেছি জাল করা যায় এমন কোনো কিছুর মতো ঠুনকো নয়।  তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হচ্ছে আমাদের মেয়ে। এর থেকে নিখাদ ভালোবাসার প্রমাণ আর কি হতে পারে? স্ত্রীর ওপর রাগ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ শুধু একটাই থাকতে পারে আর সেটা হচ্ছে কেন সে এতদিনেও এই লোক সম্পর্কে কিছু বলেনি। না এটাও ঠিক না কারণ দুজনেই নিজেদের মধ্যে ঠিক করেছিলাম অতীত সম্পর্ক নিয়ে কথা না বলার। 

যখন এসব ভাবছিলাম তখনই ব্যাঙ্কার এক সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় পরে। স্ত্রীকে কিছু বলার জন্য ওকে ঠোঁট নড়াতে দেখি। সে দেয়ালের দিকে মুখ ফেরায় আর কিছুক্ষণ পর আবার এদিকে ঘুরালে বুঝতে পারি কাঁদছে। কিন্তু এ কান্না যে সে কান্না নয়। ওর কান্নাটা ছিল হাসির মতো যেটা আমার পরিচিত ছিল। ওইসব দিনগুলোতে যখন ওর পেছনে গুপ্তচরগিরি করতাম তখন বুঝিনি। আজ সেটা স্পষ্ট হয়। আমার বধূ ওর কাছে গিয়ে কাগজ তোয়ালে দিয়ে অশ্রু মুছে দেয়। গলার ভেতর এক গিট্টু নিয়ে আমার নিজের কান্নার ধরনটা মনে করার বিফল চেষ্টা করি।


আনিসুজ্জামান, অনুবাদক, যুক্তরাষ্ট্র

menu
menu