অড্রে লর্ডের কবিতা

কবি, লেখক এবং অ্যাকটিভিস্ট অড্রে লর্ড ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ সালে হারলেম-এ জন্ম নেন, দ্বীপ রাষ্ট্র গ্রেনাডা থেকে আসা ক্যারিবিয়ান-আমেরিকান অভিবাসী বাবা-মা’র ঘরে। তিন মেয়ের মধ্যে পরিবারের তৃতীয় মেয়ে লর্ড হারলেমের ভীষণ বর্ণবাদদুষ্ট এলাকাতে বেড়ে উঠেন, বর্ণবাদ কি বুঝে উঠার আগে তাঁর অভিজ্ঞতা হয় বর্ণবাদের। বুদ্ধিদীপ্ত লর্ড হাইস্কুলেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। ক্লাস আসাইনমেন্টে তাঁর একটি কবিতা প্রত্যাখ্যাত হলে লর্ড তা সেনভেন্টিন ম্যাগাজিনে জমা দেন, যেটা হয়ে উঠে তাঁর প্রথম পেশাদার প্রকাশিত কবিতা। 
কবি লর্ড তাঁর কবিতা এবং লেখনীর মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ করে গেছেন নাগরিক অধিকার, মৌলিক মানবিক অধিকার ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায়। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল তাঁর কবিতার বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন স্ব-ঘোষিত সমকামী। লর্ড তাঁর মায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। বিশ্বকে তিনি পরিবর্তিত বাস্তবতায় কল্পনা করতেন যেখানে কোনো মানুষ পিষ্ট হবে না, নিপীড়িত হবে না তাদের বর্ণ বা দারিদ্রতার কারণে। লর্ড বলতেন, ‘যদি তুমি বাস্তবতা বদলাতে না পারো, বাস্তবতা সম্পর্কে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাও।’ নিপীড়নমূলক সমাজ, রাজনীতির বাস্তবতাকে পুনঃনির্ধারণের এই প্রচেষ্টাই লর্ডের কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে শেষপর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ছিল। তিনি জীবনকে যাপন করেছেন তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রেমের কবিতাতেও ফুঁটে উঠেছে লড়াইয়ের ছাপ। প্রেম ও রাজনীতি তাঁর কবিতায় হয়েছে একাকার। 
লর্ডের মতে সকল নিপীড়নই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জাতি, শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ, যৌনতা বিষয়গুলোকে স্বীকৃতি না দিয়ে কেউ নারীবাদ সম্পর্কে কথা বলতে পারে না।  তিনি বিশ্বাস করতেন—‘পরিবর্তনের জন্য অবস্থান নেয়া এবং আপনার আওয়াজ শুনতে পাওয়া দরকার।’ লর্ডের বিখ্যাত মন্তব্য, ‘আপনার নীরবতা আপনাকে রক্ষা করবে না।’ লর্ড আরও বলেছেন, অনুভূতি হলো জ্ঞানের একটি রূপ, আর অনুভূতিই অ্যাক্টিভিজমকে বেগবান করে। কষ্ট বা যন্ত্রণাকে তিনি অবজ্ঞা করেননি, বরং বলেছেন দুঃখ, কষ্ট আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়, কারণ এইসব বেদনাই আমদের চালিত করে মুক্তির পথে।  
কবি অড্রে লর্ড একটি ক্যাথলিক এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ালেখা করেন, যেখানে তিনি ছিলেন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ। এরপর হান্টার কলেজে পড়ালেখাকালীন সময়ে তিনি কবিতা লেখায় বিশেষ মনোনিবেশ করেন, এই কলেজ থেকেই লর্ড ইংরেজি সাহিত্যে এবং দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৯ সালে। ১৯৬১ সালে তিনি লাইব্রেরি বিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লর্ড তাঁর লেখক জীবনে ৯টি কাব্যগ্রন্থ, ৫টি প্রবন্ধ সমগ্র প্রকাশ করেন। হান্টার কলেজ, অবারলিন ও হেভারফরড কলেজ থেকে লর্ডকে দেয়া হয় সন্মানসূচক ডক্টরেট। কবি লর্ডকে নিউইয়র্ক স্টেটের কবি লরেট ভূষিত করা হয়। ১৪ বছর স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান। লর্ডের জীবন তাঁর রাজনীতির বাইরে ছিল না, তিনি যা বিশ্বাস করেছেন, তাই জীবনে চর্চা করে গেছেন। কবিতার মধ্যে দিয়ে তিনি নানাবিধ বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন, আলোড়িত করেছেন, উৎসাহিত করেছেন বঞ্চিতদের, এরকম এক জীবনের প্রতি যেখানে কোনো বঞ্চনা, অবজ্ঞা থাকবে না—যেখানে থাকবে মানুষের কথা বলার, নিজের মতো বেঁচে থাকার অধিকার। লর্ডের কবিতা শুধু পাঠকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না, ছিল তাঁর অনুভূতির আউটলেট।         

ইয়েমাঞ্জার বাড়ি থেকে

আমার মায়ের দুইটা মুখ আর একটা ভাজার হাঁড়ি ছিল
যেখানে তিনি তার কন্যাদের রান্না করে মেয়ে বানাতেন 
আমাদের নৈশভোজ তৈরির আগে। 

আমার মায়ের দুইটা মুখ 
আর একটা ভাঙা ভাণ্ড ছিল
যেখানে তিনি একটি নিখুঁত কন্যাকে লুকিয়ে রাখতেন 
যেটা আমি ছিলাম না

আমি সূর্য এবং চাঁদ এবং চির ক্ষুধার্ত
তাঁর চোখের জন্য।

আমি আমার পিঠে দুইজন নারীকে বহন করি 
একজন কালো এবং ধনী এবং 
অপর মায়ের হস্তীদন্ত ক্ষুধার ভেতরে লুকানো 
ভূতের মত বিবর্ণ
তবুও স্থির এবং চেনা 
ঘুমের ভেতরে
আমাকে রুটি এবং শঙ্কা এনে দেয় 
মধ্য রাতের ঝড়ে
তাঁর স্তনযুগল উত্তেজিত বিস্তীর্ণ নোঙর। 
এসব হয়েছে আগে
আমার মায়ের বিছানায়
সময়ের কোনো বোধ নাই 

আমার কোনো ভাই নেই 
এবং আমার বোনেরা নিষ্ঠুর। 
মা আমার প্রয়োজন 
মা আমার প্রয়োজন 
মা তোমার কালোময়তা আমার প্রয়োজন এখন 
অগাস্টের দুনিয়ায় যেমন বৃষ্টির প্রয়োজন  
আমি 
সূর্য এবং চাঁদ এবং চিরক্ষুধার্ত 
রাত ও দিন যে ধারালো তীরে মিলিত হয় 
এক হবার জন্য নয়।

ঝুলন্ত আগুন 

আমি চৌদ্দ
আর আমার চামড়া আমার সাথে প্রতারণা করেছে 
যে ছেলেটাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না 
এখনো তাঁর বুড়া আঙুল চোষে
গোপনে
কীভাবে আমার হাঁটুগুলো 
সবসময় ছাইয়ের মতো 
যদি আমি সকাল হবার আগেই 
মরে যাই 
আর মা দরজা বন্ধ করে 
শোবার ঘরে। 
কীভাবে নাচতে হয় আমাকে শিখতে হবে 
পরের পার্টির  জন্য 
আমার ঘরটা আমার জন্য খুবই ছোট 
ধরো আমি গ্রাজুয়েশনের আগেই যদি মরে যাই 
তারা বিষাদগীতি গাইবে 
কিন্তু শেষপর্যন্ত 
আমার সম্পর্কে সত্য কথাটা বলবে  
কিছুই করতে চাই না আমি 
এবং অনেক কিছু 
যা করা দরকার 
এবং মা দরজা বন্ধ করে 
শোবার ঘরে। 
কেউ একবারও থেমে 
আমার দিকটা ভাবে না 
আমার অঙ্কের টিমে থাকা উচিত ছিল 
তার চেয়ে আমার নম্বর ভালো ছিল 
আমাকেই কেন  
পড়তে হয় 
দাঁতের বন্ধনী
কাল আমার পড়ার কিছু নাই 
আমি কী যথেষ্ট দীর্ঘদিন বাঁচবো 
বড় হবার জন্য 
এবং মা দরজা বন্ধ করে 
শোবার ঘরে।

যদি তুমি আসো মৃদু পায়ে 
 
যদি তুমি আসো ধীরে ধীরে 
যেমন করে বাতাস গাছের ভেতর
হয়ত তুমি শুনবে যা আমি শুনি
দেখবে বেদনারা যা দেখে।
 
যদি তুমি আলতো করে আসো
কুয়াশা-সুতার মতো
তোমাকে আনন্দের সাথে নেবো
আর বেশি কিছু চাইবো না তোমার।
 
তুমি আমার পাশে বসতে পারো
নিঃশ্বাসের মতো নীরবে
যারা মৃত তারাই শুধু
মৃত্যুকে মনে রাখবে।
 
এবং যদি তুমি আসো আমি নীরব থাকবো
এমনকি কোনো রুঢ় কথা তোমাকে বলবো না।
আমি তোমাকে প্রশ্ন করবো না কেন এখন।
কিংবা কীভাবে, বা তুমি কি করো।
 
আমরা এখানে বসে থাকবো, নীরবে
দুই ভিন্ন সময়ের নিচে 
আর আমাদের মাঝে সম্পদশালীরা  
পান করতে থাকবে আমাদের চোখের পানি।


 • লেখক, অনুবাদক, টিভি ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্র।

menu
menu