রহস্যময়ী কবি এমিলি ডিকিন্সন : জীবন ও  কাব্য

উনিশ শতকের আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত ও অসাধারণ কবি, এমিলি ডিকিন্সন তার জীবদ্দশায় এক রকম রহস্য নিয়েই কাটিয়ে গেছেন তার সমসাময়িক কবি ও বন্ধুদের মাঝে। কবি এমিলি এলিজাবেথ ডিকিন্সন আমেরিকার ম্যসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের অ্যামহার্স্ট-এ ১৮৩০ সালের ১০ ডিসেম্বর অন্যতম এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মা এমিলি নরক্রস ও বাবা এডওয়ার্ড ডিকিন্সন। তার বাবা ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট, একজন সার্থক আইনজীবী এবং কংগ্রেসম্যান ছিলেন। তার বাবা-মা তাকে সংস্কৃতিমনা খ্রিষ্টান হিসেবে গড়ে তোলেন যেন ভবিষ্যতে তিনি তার নিজের পরিবারের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন। তবে অদ্ভুত জীবনযাপন ও অন্তর্মুখিতার কারণে পাড়া প্রতিবেশী থেকে পরিচিত-বন্ধুদের কাছে রহস্যময়ী হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছিলেন এমিলি। শৈশবে এমিলি ও তার বোন লাভিনিয়া ১৮৪০ সালে অ্যামহার্স্ট একাডেমিতে পড়াশোনা করেছিলেন। সেখানে সাত বছরে এমিলি ইংরেজি, ধ্রুপদি সাহিত্য, ল্যাটিন, উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, ইতিহাস, মানবিক দর্শন ও অঙ্ক শিক্ষা করেন। অ্যামহার্স্ট একাডেমির শেষ বর্ষে একাডেমির তৎকালীন নতুন ও তরুণ অধ্যক্ষ লিওনার্ড  হামফ্রের সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর ১৮৪৭ সনে, মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ম্যাসাচুসেটস এর সাউথ হ্যাডলিতে মেরি লায়ন্স প্রতিষ্ঠিত ‘মাউন্ট হলিওক ফিমেল সেমিনারিতে’ উচ্চশিক্ষার জন্য পড়তে যান। কিন্তু সেখানে তিনি মাত্র দশ মাসের জন্য অবস্থান করেছিলেন। এমিলির মাউন্ট হলিওক থেকে শিক্ষা শেষ না করে বাড়ি ফিরে আসা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কারো মতে তখন তার স্বাস্থ্য ভালো ছিল না অথবা তিনি গৃহকাতরতায় ভুগছিলেন। আবার এমনো তথ্য আছে যে, তার অসুস্থ মায়ের শুশ্রূষা করার জন্যই তার বাবা তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। আবার অন্য মতোও রয়েছে, যেমন এমিলি সেমিনারির শিক্ষকদের বাঁধাধরা অনুশাসনকে ঠিক মেনে নিতে পারেননি। এমনকি সেখানকার ইভানজেলিক্যাল মতাদর্শের বিরোধিতাও করেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। কারণ তার পরিবার থেকে তিনি পিউরিটানিক মতাদর্শে দীক্ষা পেয়েছিলেন।
ছেলেবেলা থেকেই এমিলি মৃত্যু নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি ও ভীতিকর অবস্থায় কাটিয়ে ছিলেন। ১৮৪৪ সালে  টাইফয়েডে কাজিন সোফিয়ার মৃত্যু হলে এমিলি মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন। বাধ্য হয়ে তার বাবা তাকে বস্টনে এমিলির মায়ের পক্ষের আত্মীয়দের কাছে পাঠান শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হবার জন্যে। বস্টন থেকে তিনি এমহার্স্ট একাডেমিতে ফিরে আসেন এবং এ সময় তার বেশ কিছু বন্ধুও গড়ে ওঠে যারা আমৃত্যু তার বন্ধু এবং তার যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে গেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন, এ্যাবি উড, জেইন হামফ্রে ও সুজান হানটিংটন গিলবার্ট। পরবর্তী কালে সুজানের সঙ্গে এমিলির বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়, তবে তাদের বন্ধুত্ব চিরকালই অক্ষুণ্ন থাকে। তবে এমিলির রোমান্টিক জীবন এবং শেষ বয়সে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন, বাড়ির বাইরে না বেরোনো, মানুষের সঙ্গে মেশায় অনিহা, সবকিছু মিলে এক ধরনের রহস্যপূর্ণ আবহের সৃষ্টি হয়েছিল তাকে ঘিরে। তিনি ও তার বোন ১৮৫৫ সালে একবার মাত্র ওয়াশিংটন ডিসিতে কংগ্রেসম্যান বাবার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং সেবারই পেনসিলভানিয়ায়ও বেড়াতে যান। সে সময় এমিলির সঙ্গে পেনসিলভানিয়ার প্রেসবাইটেরিয়ান চার্চের ধর্মযাজক চার্লস ওয়াডসওয়ার্থের দেখা হয় এবং প্রথম দেখাতেই তার তাকে ভালো লেগে যায়। যদিও ওয়াডসওয়ার্থ তার চাইতে ষোল বছরের বড় ও বিবাহিত ছিলেন, তবুও তাদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ওয়াডসওয়ার্থ মাঝে মাঝে এমহার্স্টে এমিলিদের বাড়িতে বেড়াতেও আসতেন। তাদের মাঝে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হতো যার বেশির ভাগেই ধর্ম ও দার্শনিক বিষয় উঠে আসত। শেষ জীবনে যখন এমিলি কারোর সঙ্গে দেখা করতেন না, সে সময়ও তিনি কখনো চার্লস ওয়াডসওয়ার্থকে ফিরিয়ে দেননি। চালর্স ওয়াডসওয়ার্থ যখন ১৮৬২ সালে স্যান ফ্রান্সিসকো চলে যান, তখন এমিলি বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। 
    ১৮৪৭ সালে মাউন্ট হলিওক ফিমেল সেমিনারি থেকে বাবার বাড়ি ফিরে আসার পর এমিলি প্রথম কবিতা লেখা শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি পড়াশোনায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে একাকী অনেকটা সময় কাটালেও  সে সময় আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে তিনি বেশ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। উনিশ শতকে যে সময় এমিলি নিজেকে শুধুমাত্র সংসারের চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন, সে যুগে তাদের মতো সম্ভ্রান্ত পরিবারে সাধারণত এমন ঘটত না। সে সময়ে তার মতো মেয়েরা বিয়ে করে সংসারি হয়েছেন কিংবা বাইরে গেছেন চাকরি করতে। তবে তখন তিনি তার বাবার বাড়িটিকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিলেন সুদৃশ্য এক বাগান তৈরির মাধ্যমে। এরপর সেখানে প্রতি বছর তিনি এমহার্স্ট কলেজের বর্ষ শুরুর অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন এবং গৃহকর্তী হিসেবে তার বিশেষ ও উল্লেখযোগ্য উপস্থিতিও ছিল সে অনুষ্ঠানে। সেসব অনুষ্ঠানেই বরাবর যাদের আপ্যায়ন করা হতো তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন বিখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক রাল্ফ ওয়ালডো এমারসন এবং ‘স্প্রিংফিল্ড রিপাবলিকান’ পত্রিকার সম্পাদক স্যামুয়েল বোলস, প্রমুখ। পরবর্তীকালে এরা তার বিশেষ বন্ধুতেও পরিণত হন এবং তাদের কেউ কেউ আবার তার কবিতার বিষয়ও বনে যান। ১৮৬২ সালে “এটলান্টিক মান্থলি” পত্রিকার সম্পাদক টমাস ওয়াডসওয়ার্থ হিগিন্স তাকে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য কবিতা পাঠানোর অনুরোধ করেন। টমাস হিগিন্স তার লেখা কবিতায় কিছু সংস্কার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এমিলি রাজি হননি। তবে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ঠিকই অটুট ছিল। অনেকেই ধারণা করেন টমাস হিগিন্সের জন্য এমিলির হয়তো কোনো ধরনের রোমান্টিক অনুভূতিও ছিল। তবে এমিলির জীবনে আসা পুরুষ মানুষরা ছিলেন তার বন্ধু, বিশ্বস্ত ও গোপন বন্ধু, ও পরামর্শদাতার ভূমিকায়ই। 
    ১৮৬৪ সালের আগ পর্যন্ত বেশ ভালোই কাটতে থাকে এমিলির জীবন। ১৮৬৪-৬৫ এ সময়টাতে তিনি বোস্টনে তার নানার বাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে থেকেছেন চোখের চিকিৎসার জন্যে। সে সময়টাতে তার বই পড়া ও লেখালেখির ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেটাই ছিল তার শেষ বারের মতো বাড়ির বাইরে কোথাও যাওয়া। ১৮৭০ সাল থেকে তার অসুস্থ মা একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন, এমিলি ও তার ছোট বোন লাভিনিয়াই তার দেখাশোনা করতেন। এছাড়াও কখনো এমিলির সঙ্গে তার  মায়ের সহজ ও স্বাভাবিক আবেগের সম্পর্ক ছিল না। একবার এমিলি তার মা সম্পর্কে বলেছিলেন যে তার মা এমন একজন মানুষ যার কাছে যেকোনো সমস্যা নিয়ে দৌঁড়ে যাওয়া যায় না। ১৮৭৪ সালে হঠাৎ তার বাবা মারা যান, বাবার মৃত্যুর পর আর কখনো এমিলি বাড়ির বাইরে বা জন সম্মুখে যাওয়া বন্ধ করে দেন। তবে তখনো তিনি যোগাযোগকারিদের মাধ্যমে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। তখন থেকে এমিলি তার সাদামাটা শোবার ঘরে বসে লিখতেন আর মাঝে মধ্যে বাড়ির বাগানে ঘুরে আসতেন।  
এদিকে ১৮৭৮ সালে এমিলির বন্ধু স্যামুয়েল বোলস মারা যান। ১৮৮২ সালে অন্য শ্রদ্ধেয় বন্ধু চার্লস ওয়াডওয়ার্থ মারা যান এবং সেই বছরই তার মাও মারা যান। এর এক বছর পর পাশের বাড়িতে বসবাসরত তার একমাত্র ভাই অস্টিনের ছেলে গিলবার্টও মারা যায়। এতগুলো মৃত্য তাকে গভীর শোকে আচ্ছন্ন করে তোলে। এছাড়াও তার নিজেরও বেশকিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। এসব বহুবিধ কারণে তিনি একাকী ও নিঃসঙ্গ এবং বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবনযাপন করতে থাকেন। এমনকি তিনি তার মৃত্যুর পর যেন কোন চার্চ সার্ভিস অনুষ্ঠিত করা না হয়, সে রকম ইচ্ছেও প্রকাশ করেন। এমনকি তার ইচ্ছে মতো তাকে তার শেষ জীবনে বহুল ব্যবহৃত একটা সাদা পোশাকে সমাহিত করা হয় এবং তার ইচ্ছে অনুসারে তার বোন লাভিনিয়া তার জামার কলারে ভায়োলেট ফুল পিন দিয়ে লাগিয়ে দেন। ১৮৮৬ সালের ১৫ মে রহস্যময়ী  কবি এমিলি ডিকিনসন অনন্তের পথে যাত্রা করেন।
এমিলির জীবদ্দশায় তার অনেক বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে কবিতা প্রকাশের ব্যাপারে উৎসাহ দেন, কিন্তু খুবই নগণ্য সংখ্যক কবিতা প্রকাশিত হয়। আবার যাও প্রকাশিত হয়েছে, তাও অজ্ঞাতনামা কবির কবিতা হিসেবেই প্রকাশিত হয়। যদিও তিনি ১৮০০ এর বেশি কবিতা রচনা করেন, তবে তিনি কোন বই প্রকাশ করেননি। তার মৃত্যুর পর বোন লাভিনিয়া এমিলির শয়ে শয়ে কবিতা আবিষ্কার করেন যা এমিলি নিজ হাতে ছোট ছোট বান্ডিল আকারে সেলাই করে রেখেছিলেন। এগুলোর  অনেকগুলোই ছিল পেন্সিলে লেখা, দাগ লাগা কিংবা অসম্পূর্ণ কবিতা। তার অনেক কবিতায় তিনি তার সমকালীন রচনা রীতিকে অনুসরণও করেননি, এমনকি কোথাও কোথাও কবিতার চরণের শেষে এক বা একাধিক ড্যাস (—) এর ব্যবহার করেছেন। কবির  জীবদ্দশায় পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনের সম্পাদরা তার এসব লিখনরীতিকে সংশোধনের চেষ্টা করেছেন, সম্ভবত একারণেও এমিলি তার কবিতা প্রকাশের ব্যপারে নিস্পৃহ ছিলেন। কবির মৃত্যুর পর তার ছোট বোন লাভিনিয়া, টমাস হিগিন্স ও ম্যাবেল লুমিস টড, এদেরকে দায়িত্ব দেন এমিলির কবিতা সম্পাদনার। এরাও সম্পাদনার সময় কোথাও কোথাও পরিমার্জন বা সংশোধন করেছেন। তবে তারা সেটা করেছেন কবির প্রতি যথাযথ সম্মান ও ভালোবাসা অক্ষুণ্ন রেখেই। তারা মোটামুটি রচনার সময়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এমিলির কবিতার প্রথম সংকলন, সিরিজ-১ প্রকাশ করেন ১৮৯০ সালে। এরপর ১৮৯১ সনে সিরিজ-২ প্রকাশিত হয় এবং সব শেষ সঙ্কলন প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে এমিলির সংরক্ষণ করা ১৮০০ এর বেশি কবিতা ও কিছু চিঠি পাওয়া যায় যা তিনি ১৮৬০ এর দিকে গুছিয়ে রাখেন। ১৮৬৪-৬৫তে তার চোখের অসুখ ধরা পড়বার পর তাকে কয়েকবার ক্যাম্ব্রিজ যাতায়াত করতে হয়, ফলে এ সময়ে রচিত তেমন বেশি কবিতা পাওয়া যায়।
১৮৫৮ সাল থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত সময়কালেই সর্বাধিক সংখ্যক, প্রায় ১১০০ কবিতা রচনা করেন এমিলি। তার বেশিরভাগ কবিতাই ষোল লাইনের বেশি ছিল না। তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, মৃত্যু এবং স্রষ্টা। এমিলির কবিতায় তার সমসাময়িক কবিদের চাইতে তার রচনারীতি শুধু ভিন্নই ছিল না, ছিল নতুন ধারার। এমিলির  তার পড়া বাইবেল, পুরাণ, ধ্রুপদি সাহিত্যের জ্ঞান, এমনকি সেক্সপিয়ারের রচনার দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন যার প্রকাশ দেখা যায় তার কবিতায়। এমিলির কবিতায় মৃত্যু ও পরকাল একটা বেশ বড় স্থান দখল করে নিয়েছিল। এমিলি জন কিটসের যে খুব ভক্ত ছিলেন, তার কবিতায় তার অনুরণনও পাওয়া যায়। সত্য ও সুন্দরকে নিয়ে কিটসের মত একই ধারণাই ব্যক্ত হয়েছে তার কবিতায়। তার কাব্যে সমমর্মিতা ও সহানুভূতির চমৎকার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। পরকাল, মৃত্যু, স্বর্গ, এগুলো বিষয় বারবার ফিরে এসেছে এমিলির কাব্যে।  স্বর্গ, মৃত্যু, অনন্তকাল  ইত্যাদির চমৎকার বর্ণনা বা দৃশ্যকল্প পাওয়া যায়। কবির কল্পলোকের স্বর্গের বর্ণনা আমাদেরও ভাবিত করে তোলে অচেনা অজানা প্রতিশ্রুত স্বর্গালোককে নিয়ে। কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কের কোনো এক মন খারাপ করা বিকেলে ডিকিন্সনের কবিতা পড়ে অভিভূত হয়ে যাই। কৌতূহলবশে বেশকটি ভালোলাগার কবিতার অনুবাদও করে ফেলি। সেই অনূদিত কবিতা থেকে পাঁচটি কবিতা এখানে সংযোজিত করছি। 

একশ বছর পর
(After a hundred years)

একশ’ বছর পর
কেউ চিনবে না এই জায়গাটা,
কি তীব্র যন্ত্রণা ঘটেছিল সেখানে
তা রইবে শান্তির মতো নিশ্চল।
সারিবদ্ধ আগাছারা রইবে বিজয়দৃপ্তে,
ইতস্তত পার হওয়া আগন্তুক হবে সম্মোহিত
মৃত বয়োবৃদ্ধের বানান পদ্ধতি দেখে।
গ্রীষ্মের মেঠো বাতাস
মনে করিয়ে দেবে পথ,
সহজাতভাবে তুলে নেবে সেই চাবি
যা হারিয়ে গিয়েছিল বিস্মৃতিতে।


আমি মারা গিয়েছিলাম সৌন্দর্যের জন্যে
(I died for beauty, but was scarce)

আমি মারা গিয়েছিলাম সৌন্দর্যের জন্যে, 
কিন্তু কবরে তা বিন্যস্ত করার জন্যে ছিল অপ্রতুল,
যখন ঠিক পাশের ঘরেই একজন শায়িত হলেন,
যিনি মারা গিয়েছিলেন সত্যের জন্যে।
সে মিষ্টি করে প্রশ্ন করেছিল, 
কেন আমি পরাজিত হয়েছিলাম?
বলেছিলাম, ‘সুন্দরের জন্যে’।   
‘আর আমি সত্যের জন্যে—আর এ দু’টোই এক; 
আমরা সহোদর, ‘সে বলেছিল।  
এবং তারপর, যেমন আপনজন নিশীথে একান্তে মিলিত হয়,                             
আমরা দু’কক্ষের মধ্যে কথা বলেছিলাম,
ততক্ষণ যতক্ষণে মস আমাদের ঠোঁট 
ও আমাদের নাম ঢেকে ফেলেছিল।’


আমি যদি একটি  হৃদয়কে ভাঙন থেকে ঠেকাতে পারি
(If I can stop one heart from breaking)

আমি যদি একটি হৃদয়কে ভাঙন থেকে ঠেকাতে পারি,
তাহলে আমি নিরর্থকভাবে বাঁচব না;           
যদি একটি ব্যথিত জীবনকে প্রশান্তি দিতে পারি,          
কিংবা একটা ব্যথাও প্রশমিত করতে পারি,                          
অথবা মূর্ছা যাওয়া একটা মাছরাঙাকে  
নীড়ে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত সাহায্য করতে পারি,         
তবেই আমার বাঁচাটা নিরর্থক হবে না।

৪ 
আমি স্বর্গে গিয়েছিলাম
(I went to heaven—)

আমি স্বর্গে গিয়েছিলাম—  
ওটা ছিল একটা ছোট্ট শহর,
যা নীচের দিকে লটকানো  
একটা চূনি দিয়ে আলোকিত করা, 
শিশিরাচ্ছন্ন মাঠ থেকেও     
তা নিশ্চুপ,
এমন ছবির মতো সুন্দর
যা মানুষ কখনো আঁকেনি।
মানুষগুলো মাকড়শার জাল জড়ানো  
ম্যাকলিন ফ্রেমে রাখা                    
পতঙ্গের মতো,
আর প্রায় সন্তুষ্ট হবার মতো
সুন্দর নাম তাদের।
আমি যদি এমন একটা 
অন্যন্য সমাজের  মাঝে থাকতাম।

৫ 
যেহেতু আমি মৃত্যুর জন্যে থামতে পারিনি
(Because I could not stop for death)

যেহেতু আমি মৃত্যুর জন্যে থামতে পারিনি,
মৃত্যই দয়া করে আমার জন্য থেমেছিল,
সেই ঘোড়ার গাড়িতে কেবল জায়গা হয়েছিল আমাদের
আর অমরত্বের।
আমরা ধীরে ধীরে যাচ্ছিলাম—সে জানতো না কোন তাড়া 
আর আমি সরিয়ে রেখেছিলাম
আমার পরিশ্রম আর অবকাশ       
তার সৌজন্যে।
আমরা পেরিয়ে গিয়েছিলাম সেই স্কুলটা, যেখানে ছেলেমেয়েরা 
বিরতির ঘণ্টা শুনে ধস্তাধস্তি করছিল—                                  
পেরিয়ে গিয়েছিলাম দেখার মতো ফসলের মাঠগুলো— 
পেরিয়ে ছিলাম অস্তাচলগামী সূর্যও।
অথবা সেই আমাদের পেরিয়ে গিয়েছিল—                                   
শিশির নিয়ে এসেছিল হাড়কাঁপানো শীত— 
আমার গায়ের মাকড়শার জালের মতো সুতোয় বোনা                     
আজানুলম্বিত বস্ত্রে— 
আমরা একটা বাড়ির সামনে থেমেছিলাম যাকে দেখে মনে হচ্ছিল—      
সেটা বুঝি ভূমি ফুঁড়ে ফুলে রয়েছে
ওটার ছাদটা সামান্যই দেখা যাচ্ছিল—   
আর কার্নিশ মাটির ভেতরে— 
সেই থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেছে— 
এখনো মনে হয় তা যেন একটি দিনের চেয়েও ছোট                   
আমি প্রথমেই অনুমান করেছিলাম ঘোড়াগুলোর মাথা
অনন্তকালের দিকেই ছিল— 


• কবি ও অনুবাদক, যুক্তরাষ্ট্র।

menu
menu