ফিরোজ সুলায়মান-এর কবিতা
তাঁর আয়না এক নিরস্ত্র শিকারী
আজকের বিশ্বে সিরিয়ার উজ্জ্বলতম কবি ফিরোজ সুলায়মান। সিরিয়ার নামজাদা ঔপন্যাসিক, কবি ও চিত্রনাট্যকার খালেদ খলিফা মনে করেন, ‘সিরিয়ান কবিতায় ফিরোজ সুলায়মান নিরস্ত্র এবং একা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তা-ই লিখেন যা লেখা প্রায় অসম্ভব। তিনি জন্মভূমি এবং তাঁর পরিচয়কে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন, কিন্তু পারেননি।’ তাঁর একজন অনুবাদক ব্রিটিশ নাট্যকার ঔপন্যাসিক কেরি হ্যারিসন এর মতে, ‘অনেক পূর্বসূরীদের মতোই সে তাঁর সংস্কৃতির মূল উৎসকে গীতিময়তার আশ্চর্য সমাবেশ ঘটিয়েছেন যা সূক্ষ্মভাবে বাস্তব এবং বিস্ময়করভাবে পরাবাস্তবে জারিত।’ বিংশ শতাব্দীর কবিতার পাঠকের মনে কখনো পাবলো নেরুদা আসে কখনো পল এলুয়ার ভর করে। এই তুলনা মনে আসার কারণ ফিরোজের ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা। তিনি আরব ঐতিহ্যকে তার কাব্যকলায় এমনভাবে উন্নীত করেছেন যা অন্যভাষায় লেখা কবির কাজের সঙ্গে একীভূত হয়। আবার ফিরোজ সুলাইমানের কবিতাকে আরবের মূল শিকড় থেকে ছিঁড়ে ফেলাও অসম্ভব। সরলতার প্রাচুর্যে ভরা তার কবিতা পাঠে মনে হতে পারে রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতি একধরনের উদাসীন ফিরোজ, কিন্তু গভীরভাবে নিপীড়ন ও অমানবিকতার চেতনায় ভরা, যা তীব্রভাবে রাজনৈতিক। তার কবিতার ল্যান্ডস্কেপগুলি সব ভেঙে গেছে, মেরামতহীন। রয়েছে পুনরাবৃত্তি। আবেগ ও প্রেম, না নিরাময় করে না সংরক্ষণ করে; যদিও তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন ঠিক এর বিপরীতটা।
লেখক আহমতজান ওসমান এর মতে, ‘যা বলা যায় না, তার গভীরে ডুব দেয় ফিরোজের কবিতা। তিনি একই সঙ্গে তার ফিনিশীয় স্মৃতির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং তা প্রত্যাখ্যান করে সমুদ্রের গভীর বিশালতায় নিক্ষেপ করেন। জেমস বায়রন-এর ভাষায়, ‘তাঁর কবিতা নিরলসভাবে উদ্ভাবক। এর গীতিময়তা কল্পনার বিস্তার, শ্লেষাত্মক ভঙ্গিমা এবং এর কণ্ঠস্বর বহুবচনে নিঃসৃত কিন্তু সরাসরি। আজকের পৃথিবীতে সিরিয়ান কবি হিসেবে তিনি অন্যতম এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।’
ফিরোজের জন্ম ১৯৬৯ সালে। কবিতা, সংক্ষিপ্ত কল্পকাহিনি, বাণী এবং সমালোচনাসহ আরবিতে তাঁর একাধিক প্রকাশনা আছে। তাঁর রচনা বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বর্তমানে আমেরিকান স্ত্রী, লেখক, সম্পাদক এবং অনুবাদক সামান্থা কোস্টমায়ার সুলায়মানের সঙ্গে নিউইয়র্ক শহরে বাস করেন। যেখানে তার নিজেকে এখন বিদেশি লাগে না, বহিরাগত মনে হয় না।
যে কবি শুধুমাত্র নিজেকে একজন প্রাকৃতিক বহিরাগত বলে মনে করেন কেবল তিনিই এ জাতীয় কবিতা লিখতে পারেন, যে কবিতা নিশ্চিতভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদেরকে সকলের সঙ্গে সংযুক্ত করে। তাঁর HER MIRROR IS AN UNARMED HUNTER কাব্যগ্রন্থটি আরবি থেকে ইংরেজি করেছেন জেক ব্রাউন, কেরি হ্যারিসন এবং সামান্থা কোস্টমায়ার।
একটি অদ্ভুত সমাধির আবেশে দাঁড়িয়ে
আমরা স্বাধীনতার কথা বলছিলাম
আমার মা ছোট ভাইয়ের মোজার গন্ধ নাকে নিতেই
হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল
আর মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু পরিণত হল ধবংসস্তূপে
শুধু ছোট ভাইয়ের মোজাজোড়া
জামাকাপড় শুকাতে দেয়া দড়ির উপর
একখণ্ড পতাকার মতো ঝুলছিল।
২
আমাকে যুদ্ধের ভয় দেখাবেন না
আমি রক্তে অভ্যস্থ নারী;
এবং যেকোনো ধরনের অনুপস্থিতিতে
একজন পরিণত মহিলা।
৩
যাদুঘর,
যেখানে কিছুই প্রতিফলিত হয় না
কোনো কিছুর,
যেখানে সবকিছু উদয় হয়
সবকিছুর সারাংশ থেকে
আমি ম্যাচ জ্বালিয়ে কাঁদলাম
৪
কিছুই কিছু না, জীবন একটা বিস্মৃত শামুক
আর ভাষা এর চেয়ে একটু বেশি
অদৃষ্টের মতো শক্ত
ভাগ্যের গল্পের মতো একটু মোড়ানো
ফাঁকা মাথার মলাট যেন
এবং আমি...আমি হচ্ছি প্রথম শব্দ
প্রিয় পাঠক, যা আপনার মনে আসে
৫
মাদারচোদ শুভসন্ধ্যা,
আপনারা কি কেউ দয়া করে
আমার কাঁধ থেকে
বাবার হাতটা সরিয়ে দিতে
স্বেচ্ছাসেবক হতে পারেন,
যে হাত তার পাঁচটি আঙুল দিয়ে কাঁদে
শান্ত হও, কন্যা শান্ত হও
৬
প্রত্যেকটা সন্ধ্যায় আমার মৃত্যু নিশ্চিত করি;
যুদ্ধে নয়
অনাহারে নয়
বন্দিত্বে নয়
গুপ্তহত্যায় নয়
ভূমিকম্পে নয়
বন্যা কিংবা বিমান ধ্বংসের মতো
কোনো ভয়ংকর ঘটনায় নয়;
কেবল যখন বিছানার ওপাশে হাত প্রসারিত করি
আর খুঁজে পাই না তোমাকে।
৭
যেন আমি তোমার জন্য কবিতা পড়ছি
যেহেতু তুমি শুনছিলে
আর শ্রোতারা যেন কোনো
প্রাচীন দরজার শ্লাম
যদি শুধু স্মৃতি বসে না থাকতো
সামনের সারিতে।
৮
এটা একটা বড় ঘটনা,
একজন মহিলা বাড়িতে একা
অসুস্থতা তার পেট আঁকড়ে ধরে আছে,
ঈশ্বর, জনগণ এবং শূন্য রেফ্রিজারেটরের
উপর সে ক্রুদ্ধ
অতীতের মাউসকে সে ভয় পাচ্ছে
একটি কেকের উপর অংশ কুঁচকে যাওয়ার মতো
নির্মম তার ঘুম।
একজন মহিলার পক্ষে এটি আবিষ্কার করা
কোনো সাধারণ ঘটনা নয়;
তারা যা করেছে
তা থেকে সে হাত ধুতে অক্ষম।
৯
যদি আমি দরজা খুলি
এটা নিশ্চিত যে দেখতে পাব
একটি ঘোড়া, একটি কুকুর,
একজন মানুষ
যে নিজের বন্দুক পরিষ্কার করছে
এবং সিঁড়ির পাদদেশে পড়ে আছে
আমার লাশ
১০
আমি সবার প্রেমিক
কিন্তু কে আমাকে ভালোবাসতে পারে?
যেমন কাটা পায়ের সুখ
মা এবং আমার মধ্যকার দূরত্ব
মেপে ফেলতে পারে অনয়াসে;
কবিতার মতো বসে আছি
দরজার সামনে
বাড়ি ছেড়ে যেতে যেতে
এক নিংড়ানো ঘনিষ্ঠতায়
১১
আমার প্রেমিকের দাঁতগুলি সাদা
তার দাঁতের হাড়গুলি ফুলে উঠছে
সে কথা বলে না
কাছে যায় না এবং আমার মাথায়
হাত বুলিয়ে স্পর্শও দেয় না
আমি তার মৃতদেহটি কেবল সঠিক শব্দ
দিয়ে নার্সিং করি
তাকে ক্ষয় থেকে রক্ষা কর
১২
চেষ্টা করবেন না
এমনকি কোনোভাবেই চেষ্টা করবেন না
প্রেমিকের হাঁটু থেকে
আমার হাত ছিঁড়ে ফেলার
চেষ্টা করবে না;
এটা ক্রুশকাষ্ঠে যিশুর মতোই
অবিচ্ছেদ্য!
• কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সম্পাদক ও টিভি সাংবাদিক, বাংলাদেশ।