উপেক্ষিত কাভাফির অর্জুন ও আমরা

সি পি কাভাফির কবিতার সঙ্গে আমার লিপ্ততা দিয়েই লেখাটা শুরু করছি বলে মার্জনা করবেন, তবে এই উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই ব্যক্তিগত অবতারণা। সি পি কাভাফির কবিতা শীর্ষক একটা অনুবাদ গ্রন্থ বেরিয়েছিল ১৯৯২ সালে, তার মানে গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো অনূদিত হয়েছিল আরও অন্তত দুএক বছর আগে। তখনো পর্যন্ত কাভাফির কোনো কবিতার তর্জমা-গ্রন্থ বাংলাভাষায় প্রকাশিত হয়নি। গ্রিক চিরায়ত সাহিত্যের প্রতি আমাদের প্রধান লেখক-অনুবাদকরা মনোযোগী হলেও, আধুনিক গ্রিক সাহিত্যের প্রতি তারা খুব বেশি উৎসাহী ছিলেন বলে কোনো নজির পাওয়া যায় না। অথচ আধুনিক যুগের দুজন গ্রিক কবি, জর্জ সেফেরিস ও ওডেসিয়ুস এলিটিস নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়া সত্ত্বেও এই ভাষার কবিতা সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল খুব একটা দানা বাঁধেনি। সত্য বটে জর্জ সেফেরিসের নির্বাচিত কবিতা শিরোনামে প্রয়াত শিশির কুমার দাশের একটি অনুবাদ গ্রন্থ বেরিয়েছিল নব্বুইয়ের দশকের প্রথম দিকে বোধহয়। কিন্তু এলিটিসের বাংলা তর্জমা বোধ হয় এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। হয়েছে কী? সেফেরিস এবং এলিটিসেরও পূর্বসূরি কাভাফি, যিনি মৌলিকতায় ও কাব্যিক গুরুত্বে আরও বেশি শীর্ষ পর্যায়ের, তার কবিতার ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘ নীরবতাকে আমার কাছে খানিকটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল তখন। ওই নীরবতার পুকুরে আমার বইটি ছিল একটি বুদবুদ মাত্র। আমি ধরে নিয়েছিলাম পরে কেউ যোগ্য হাতে কাভাফির কবিতা অনুবাদ করবেন, করেছেনও দেখলাম। ১৯৯৭ সালে পুস্কর দাশগুপ্ত মূল থেকে অনুবাদ করেছেন। কিন্তু তিনি অনুবাদ করার পরেও কেন আমি আবার কাভাফির ‘চিরন্তন’ (নিচে দেখুন) কবিতাটি অনুবাদ করছি? প্রথম কথা হলো, এই কবিতাটি তিনি অনুবাদ করেননি। কেন করেননি জানি না। এর কোনো হদিস কি আগে জানা ছিল না? মনে হয় জানা ছিল না কারোরই। এই কবিতাটি, কাভাফির ইংরেজিতে যেসব অনুবাদ গ্রন্থ সহজলভ্য—জন মাভরোগর্দাতো, এডমান্ড কিলি, ফিলিপ শেরার্ড বা রায়ে ডালভেনের অনুবাদে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কবিতাটির হদিস পাওয়া গেল ২০১২ সালে প্রকাশিত ড্যানিয়েল ম্যান্ডেলসন-এর Complete poems by C. P. Cavafy নামক গ্রন্থে।

সি পি কাভাফি
চিরন্তন

সদাশয় কোমলহৃদয় ভারতীয় রাজা অর্জুন

নরহত্যা ঘৃণা করতেন। যুদ্ধে তিনি যাননি কখনো।
কিন্তু ভয়ংকর যুদ্ধদেবতা তাতে বিরক্ত ভীষণ
(যেহেতু গৌরব তার লুপ্ত হতে থাকে, মন্দিরগুলো তার শূন্য হয়ে গেছে)
সীমাহীন ক্রোধ নিয়ে অর্জুনের প্রাসাদে গেলেন।
ভয় পেয়ে রাজা বললেন, ‘মহান দেবতা,
মার্জনা করবেন যদি আমি অপারগ নরহত্যায়।’
ঘৃণাভরে উত্তরে দেবতা বলেন, ‘তুমি কি নিজেকে ভাবো
আমার চেয়েও বেশি ন্যায়পরায়ন? দোহাই, হয়ো না প্রতারিত।
এ অবধি কোনো প্রাণ হয়নি হরণ। জেনে রাখ তবে
জন্মে না যারা, তারা মরে না কখনো। ’

এবার এই কবিতাটি সম্পর্কে আমার অনুভূতির কথাটা বলি। কাভাফির কবিতার সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন তিনি কবিতায় উপজীব্য করেছেন মূলত গ্রিক পুরাণ, ইতিহাস, সমকাম ইত্যাদি বিষয়। কখনো কখনো মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সরাসরি ভারতীয় পুরাণ বা ইতিহাসের চরিত্র কখনো দেখা যায়নি তার কবিতায়। কখনো কখনো দুএকটি কবিতায় ভারতীয় পুরাণের কোনো কোনো চরিত্র বা ঘটনা উপমা বা উৎপ্রেক্ষা হিসেবে এসেছে বটে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোনো কবিতা বোধ হয় এই ‘চিরন্তন’ই। Indian image বলে তার আরেকটি কবিতা আছে যেটি জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত ছিল, সেটি শিরোনামে ভারতীয় বলে উল্লেখ থাকলেও খাঁটি ভারতীয় কিছু ওতে কতটা আছে তা নিয়ে আমার সন্দেহ ঘোচেনি। পিটার জেফ্রিস-এর Reframing Decadence: C. P. Cavafy’s Imaginary Portraits ( কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৫) নামক বইটির সূত্রে জানা যাচ্ছে যে Indian image কবিতাটি তিনি একটি চিত্রকর্ম অবলম্বনে লিখেছিলেন। কিন্তু সেটা Indian image শিরোনাম ধারণ করলো তা আমার কাছে এখনো রহস্যময়। যাইহোক, যে-‘চিরন্তন’ কবিতাটির সূত্রে এই কথার বিস্তার, সেটার দিকে আবার ফিরে আসা যাক। মজার ব্যাপার হলো কাভাফি বিষয়ের দিক থেকে মূল প্রবণতার বাইরে গেলেও তার যে আলংকারিক বৈশিষ্ট্য, আমাদের অলংকারশাস্ত্র যাকে ব্যাজস্তুতি (Irony) বলে অভিহিত করে, তা এই প্রবণ-ছুট কবিতাতেও অটুট আছে পুরো মাত্রায়। অর্জুনকে নরহত্যায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য যে যুক্তি যুদ্ধের দেবতা দেখাচ্ছেন তা আমাদেরকে হকচকিয়ে দেয় না কি?

দোহাই হওনা প্রতারিত।
এ অবধি কোন প্রাণ হয়নি হরণ।
জন্মে না যারা, তারা মরে না কখনো।

কিন্তু কাভাফি এই যুক্তিকে তার নিজস্ব ব্যাজস্তুতির স্মারকচিহ্নে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে কবিতাটি পুরোপুরি পুরাণের প্রাচীন খোলস থেকে আধুনিকতার কাল-সরণিতে এসে হাজির হয় কৌতুককর মেজাজসহ।
বাংলা ভাষায় কাভাফির উপস্থিতির ক্ষীণতা লক্ষ্য করার ফলে আমার কাছে যে প্রশ্নগুলো ঘুরঘুর করতে থাকে তার একটা হলো এই যে কাভাফির কবিতা কি এমনই যে তা মৌলিকতা ও অনন্যতা সত্ত্বেও আমাদের মনোজগতের স্ফূর্তিকে জাগিয়ে তোলে না, কারণ তা আমাদের কাব্যরুচির কোনো অভিমুখকেই উদ্দীপ্ত করে না বলে? নাকি তার প্রবণতাকেই আমরা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করিনি বলে উদ্দীপক সব গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও অপরিচয়ের অন্ধকূপের বাসিন্দা হয়ে পড়ে আছেন তিনি? জানি, এসব প্রশ্নের উত্তর গবেষণাসাপেক্ষ। কিন্তু এতো সত্যি যে পৃথিবীর বহু ভাষার প্রতিভাবান লেখককে যিনি তার কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ করেছেন তিনি কেন আমাদের প্রধান লেখকদের স্পর্শ করতে পারেননি? বুদ্ধদেব বসু, যিনি আধুনিকতার মানচিত্রকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আঁকার চেষ্টা করলেন, সেখানে কাভাফি তো দূরের কথা, আধুনিক গ্রিক কবিতার কোনো নিঃশ্বাসই তাতে শুনতে পাই না :“এ-কথাও স্মর্তব্য যে বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে, যখন পর্যন্ত তিমিরলিপ্ত ইঙ্গ-দ্বীপতটে দুই মার্কিন ত্রাতা এসে পৌঁছননি, তখনই ইয়েটস ধীরে-ধীরে ইংরেজি ভাষায় আধুনিক কবিতা সম্ভব করে তুলেছেন; আর প্রায় একই সময়ে এক কৃশতনু জর্মান ভাষার কবি প্যারিসে বসে রচনা করছেন ‘মাল্টে লাউরিড্জ ব্রিগগে’ নামক গদ্যগ্রন্থ, যার কোনো-কোনো অংশে বোদলেয়ারের স্তবগান ধ্বনিত হলো। আর তার পর থেকে পশ্চিমী কবিতায় এমন কিছু ঘটেনি, সত্যি যাতে এসে যায় এমন কিছু ঘটেনি, ”(শার্ল বোদলেয়ার:তাঁর কবিতা, অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রকাশকাল : জুন ১৯৮১, পৃ-২) তাহলে কাভাফি কোনো ঘটনা নয়? কিংবা তারও আগে কস্টিস পালামাস, তিনিও কেউ নন? অথচ আমাদের তাকাবার সুযোগ ছিল আধুনিক পর্বের গ্রিক সাহিত্যের দিকে, কেন না রবীন্দ্রনাথের আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে Golden book of Tagore নামে যে বইটি বের হয়েছিল সেখানে কস্টিস পালামাস রবীন্দ্রনাথকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রাচ্যের প্রতি তার কৌতূহল ও সংযোগকে মূর্ত করে তুললেন। কিন্তু আমরা এই সংযোগের সূত্রটিকেও সাহিত্যিক কৌতূহলের সূচনা হিসেবে গ্রহণ করিনি অবহেলাবশত। কাভাফি এরও খানিকটা পরে তার প্রবল স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আবির্ভূত হলেও আমাদের উপেক্ষার শিকার হয়ে থেকে গেছেন বহুদিন। অথচ প্রতীচ্যের প্রধান ধারার সংস্কৃতির প্রবল ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় পুরাণের প্রতি কৌতূহল ও একে তার কাব্যব্যক্তিত্বের বৈশিষ্টপূর্ণ ব্যবহার করে অপূর্ব ব্যঞ্জনায় মূর্ত করে তুললেও আমরা বিমুখ থেকেছি তার প্রতি। 
আজও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়নি এমন আরও কিছু কবিতার সঙ্গে বাংলাভাষী পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এখানে হাজির করা হলো। ‘চিরন্তন’ নামক কবিতাটির অনুবাদের ক্ষেত্রে আমার মূল নির্ভর ছিল Daniel Mendelsohn-এর C P Cavafy: Complete Poems ( Alfred K. Knope, 2012) বইটি। আর ‘বোড়ে’ কবিতাটির ক্ষেত্রে আমি নির্ভর করেছি Rae Dalven কর্তৃক অনূদিত The Complete Poems of Cavafy: Expanded Edition(Mariner Books; First edition, October 4, 1976) বইটির ওপর। আর অন্য দুটি কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি নির্ভর করেছি Edmund Keeley আর Philip Sherrard-এর অনুবাদ এবং George Savidis কর্তৃক সম্পাদিত C P Cavafy : Collected Poems ( Princeton University Press, 1992) বইটির ওপর।

তুমি বুঝতে পারনি

আমাদের ধর্মীয় ঈমান বিষয়ে—
নির্বোধ  জুলিয়ান বলেছিল , ‘পড়েছি, বুঝেছি আমি,
আর ওটা ফালতু ভেবেছি ।’ যেনবা সে, নির্বোধ, ‘ফালতু ভেবে’ 
আমাদের ধুলিস্যাৎ করে দিল খুব। 

কিন্তু  ওই  ঠাট্টা তার খ্রিষ্টানেরা করি না কেয়ার ।
আমাদের তড়িৎ জবাব :  ‘পড়েছ যদিও তুমি বোঝনি কিছুই,
বুঝতে যদি, ফালতু তবে ভাবতে না একে।’

বোড়ে

যখনই লোকজন দাবা খেলে, আমি প্রায়ই লক্ষ্য করি 
কীভাবে নিজের পথ একটু একটু করে তৈরি করে বোড়ে 
এবং সময়মতো পৌঁছে যায় শেষ ঘরটিতে। 
এমনই উদ্যম নিয়ে শেষ প্রান্তে পৌঁছায় যেন তুমি হয়তো ধরে নেবে
এই তো তার যত সুখ, তার যত এনামের শুরু হবে নিশ্চিতভাবে।
কত না কঠিন বাধা পার হলো পথে যেতে যেতে।
পদাতিক সৈন্যরা আড়াআড়ি ছুঁড়েছে আঘাত;
প্রশস্ত দেহ দিয়ে কিস্তি আঘাত করে তাকে;
দ্রুতগতি অশ্বারোহী নিজের আড়াই চালে 
কৌশলে চেষ্টা করে থামাতে বোড়েকে, 
এদিক সেদিক থেকে আছে ভয় তির্যক আক্রমণের;
শত্রু শিবির থেকে অন্য এক বোড়ে এসে হয়েছে উদয়।

পেরিয়ে সকল বাধা সময় মতন 
অবশেষে চূড়ান্ত গন্তব্যে এসে দাঁড়ালেন।

বিজয়ীর বেশে ঠিক সময় মতন 
কত না ভয়ংকর শেষ প্রান্তে আসা, 
কী প্রবল স্বেচ্ছায় এসেছেন মৃত্যুর দ্বারে!

এখানেই মৃত্যু হবে তার 
শুধু এই জন্যেই সকল আজাব তিনি পেরিয়ে এলেন।
আমাদের বাঁচাবে যে-রানি, 
গোর থেকে বাঁচাতে সে রানিরাজ্ঞীকে
দাবার পাতাললোকে পতিত হলেন।

পোসেডনীয় (১৯০৬)

. . . like the Poseidonians in the Tyrrhenian Gulf whom it befell that,
Although of Greek origin, they became utterly barbarized, becoming Tyrrbe-
Nians or Romans, and changing their language along with many of their
customs. Yet to this day they observe a certain Greek holiday, during which
thay gather together and recall the ancient names and customs; after which,
lamenting loudly to each other and weeping, they depart.  

                                                                              —ATHENAEUS


টিরহেনীয়, লাতিন ও অন্যান্য বিদেশি জাতির 
সাথে বহু শতবর্ষ মিশ্রণের পর 
ভুলে গেছে গ্রিক ভাষা পোসেডনীয়রা।
এখনো যা টিকে আছে পূর্বপুরুষের 
তা কেবল ফুলমাল্যে, প্রতিযোগিতায়,
বাঁশি আর লায়ারে ও স্নিগ্ন আচারে 
সুশোভিত গ্রিক উৎসব।
উৎসবের শেষ দিকে তাদের স্বভাব ছিল 
নিজেদের সুপ্রাচীন প্রথা নিয়ে একে অপরের
সাথে কথা বলা, আরও একবার গ্রিক যত নামধাম
বলে যাওয়া যা কেবল অল্পকজনই জানতেন।
এর ফলে উৎসব শেষ হতো বিষাদে সর্বদা,
কারণ তাদের মনে পড়ে যেত একদিন তারা ছিল গ্রিক,
তারাও একদা ছিল নাগরিক মহান গ্রিসের;
আজ তারা কোথায় নেমেছে, কী তাদের পরিণতি আজ,
গ্রিক জীবনের ধারা থেকে তারা নিদারুণ বিচ্ছিন্ন হয়ে
বেঁচে আছে, কথা বলে বর্বর মানুষের মতো। 


• কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক, বাংলাদেশ।

menu
menu