প্রোমোশন

-    কাজটা তোমায় করতেই হবে।
-    আমি তার কোনও দরকার দেখছি না।
-    দ্যাখো গোডবলে, মিসেস কর্ণিক ছুটিতে আছেন। আজ এই প্রোপোজালটা শেষ করতেই হবে। যদি কাজটা না করো তাহলে কিন্তু...
-    চাইলে আপনি আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতেই পারেন। কিন্তু আমি হাজারবার বলেছি, এখনও বলছি এটা আমার কাজ নয়।
-    বসের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় শেখো।
-    আপনি আমার বস হতে পারেন। কিন্তু আমি আপনার সিনিয়ার, এটা মাথায় রাখবেন।
-    গেট আউট।

একঢোক জল গলায় ঢেলে বাঘমারে একটা সাদা কাগজ টেনে নিলেন। গোডবলের বিরুদ্ধে একটা রিপোর্ট পাঠাতেই হবে। মনে মনে মুসাবিদা করতে করতে মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মত বদলালেন। গোডবলে সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠিয়ে কোনও লাভ নেই। কিছুই হবে না। পুরো ডিপার্টমেন্ট জানে সে যোশি সাহেবের পা-চাটা। প্রতি মাসে ভেট দিয়ে সাহেবকে তুষ্ট রাখে। তাই পারতপক্ষে কেউ গোডবলেকে চটাতে সাহস করে না। তবুও রিপোর্ট করে রাখা ভালো। প্রোপোজাল পাঠাতে দেরি কেন হল, দরকারে সেটার একটা সঙ্গত কারণ দেখাতে পারবেন।
বেল বাজিয়ে পিয়নকে ডাকলেন। দুটো একশ বিশ বানারসী পান আনতে বললেন। সঙ্গে বলে দিলেন আওয়াল সাহেবকে চায়ের জন্যে তাঁর ঘরে ডেকে দিতে। পিয়ন চলে যাবার পর কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। তারপর আবার বেল বাজালেন। যদি মিস্টার সিং-এর পিয়নটা আসে। দুবার বেল বাজানোর পরও কেউ এল না দেখে নিজেই উঠলেন। বাইরে এসে মিসেস কর্ণিকের টেবিল থেকে খুঁজেপেতে ফাইলটা বের করলেন। গোডবলে নিজের চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে বসেই আছে। তাঁকে দেখেও নড়েচড়ে বসার কোনও ব্যাপার নেই। কাজটা কাকে দেওয়া যেতে পারে? কাজের ভারে আর সবাই নুইয়ে পড়েছে। সত্যি বলতে কী, এটা গোডবলেরই করা উচিত। এ ব্যাপারে ওর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আর ওর হাতে কাজও তেমন নেই। 
নিজের কেবিনে ফিরে ফাইলে মুখ ডুবিয়ে বসেছেন, এমন সময় স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাট করে দরজা খুলে আওয়াল হাজির হলেন।
“খুব ব্যস্ত যে।” – বসতে বসতে আওয়ালের মন্তব্য।
“আর বোলো না। ওই গোডবলে কাজ করবে না। আর আমায় খেটে মরতে হবে।”
“চুলোয় যাক। ওর কাজ তুমি কেন করতে যাবে? ডেকে ভালো করে ঝাড় দাও। ঠিক কাজ করবে।”
“ধুর! আমার কোনও কথাই ও শোনে না।”
“তুমি তো মহা ডরপোক হে। নাকি কান্না না কেঁদে ওর হাতে একটা মেমো ধরিয়ে দাও। মনে রেখো রিজার্ভড ক্যাটাগরিতে প্রোমোশন দিয়ে কেউ তোমার মাথা কিনে নেয়নি।”
“মাথা কিনে নেওয়ার ব্যাপার নয়। এতে সম্পর্ক খারাপ হবে।”
“এখন গোডবলে তোমায় পাত্তা দেয়?”
“সেটাই স্বাভাবিক। আমি জুনিয়ার হওয়া স্বত্তেও এ্যাসিসটেন্ট পারচেজ অফিসার হয়ে বসে আছি।”
“দ্যাখো। এখন আমরা ৩৩% রিজার্ভেশানের দৌলতে অফিসার হয়েছি ঠিকই। কিন্তু ওরা যে এতদিন ১০০% সুবিধা পেয়ে এসেছে তার কী? তোমার মাথায় এসব কেন ঢোকে না কে জানে।”
“ধুর! ছাড়ো ওসব।”
“হুম! ছাড়ব তো বটেই। যেদিন হাতে হ্যারিকেন হয়ে যাবে, সেদিন তোমার হুঁশ ফিরবে।”
ইতিমধ্যে চা এল। চা শেষ করে আওয়াল বিদায় নিলেই ভালো। বাঘমারে নিজের জাত নিয়ে সমস্যায় পড়লে আওয়াল সবসময় পাশে এসে দাঁড়ান বটে, কিন্তু মনটা আরও বিষিয়ে দিয়ে যান। চায়ের পর পান চিবোতে চিবোতে আওয়াল জিজ্ঞাসা করলেন— “তুমি প্রিন্টারের ব্যাপারটা দ্যাখো?” বাঘমারে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন— “হ্যাঁ। কেন?”
“বেশি কিছু না। ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশানের ক-টা চাঁদার বই ছাপতে হবে। আম্বেদকার জয়ন্তীর জন্যে।”
“না। না। ফালতু ঝামেলা হবে।”
“তোমার পারচেজ ডিপার্টমেন্টে কী চলছে তা জানো তুমি? পুরো রেলওয়ে লুটে যাচ্ছে। আর তুমি ক-টা চাঁদার বই ছাপতে ভয় পাচ্ছ।”
“ভয় পাওয়ার ব্যাপার নয় এটা। কিন্তু...”
“ছাড়ো। যাক গে, তুমি আমাদের ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস অ্যাসোসিয়েশানের মিটিং-এ আসছ না কেন? আমাদের স্টাফরা এই নিয়ে বেশ রেগে আছে।”
“ও নিয়ে পরে কথা হবে। আমায় এখন এই প্রোপজালটা শেষ করতে হবে।”

প্রথম ড্রাফট শেষ করতে প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গেল। কাল সকালে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তারপর টাইপ করতে পাঠানো যাবে। আবার গোডবলের কথাটা মাথায় এল। কিন্তু আওয়ালের কথায় নেচে ওকে ঝাড় দিয়ে কিছু লাভ নেই। শুধু শুধু তাঁকেই হয়তো অপদস্থ হতে হবে সবার সামনে। বাঘমারে নিজেকে বোঝালেন, এখন তিনি অফিসার। নিজের সম্মান নিজেকেই ধরে রাখতে হবে। হঠাৎ তেষ্টায় চিন্তার সুতোয় টান পড়ল। পিয়নের জন্যে বেল বাজালেন। 
“স্যার, আসতে পারি?” দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন মিস গোডাম্বে।
“আসুন।”
“সোমবার থেকে আমার তিনদিনের ছুটি দরকার।”
“এখন কী করে হবে? মিসেস কর্ণিক জয়েন করুন। তারপর ছুটি নিন।”
“না স্যার। আমায় এখনই নিতে হবে।”
“কেন? হঠাৎ কী হল?”
“আমরা শিরডি যাচ্ছি।”
“ওহ! আগে বলবেন তো। ঠিক আছে। ছুটি নিন। আর শুনুন।” নিজের পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বাঘমারে বললেন – “আমার জন্যেও অভিষেক দেবেন।”
“টাকা দিতে হবে না স্যার। আমি অভিষেক দিয়ে আসব।”
“কিন্তু আপনার নিজের টাকায় সেটা করলে পুণ্যি তো সব আপনার খাতায় যাবে।” বাঘমারে রসিকতার চেষ্টা করলেন।
মিস গোডাম্বে হাসিমুখে বিদায় নিলেন।
জলের গ্লাস নামিয়ে রাখতে না রাখতেই ফোন বেজে উঠল।
“হ্যালো। অ্যাসিসটেন্ট পারচেজ অফিসার বাঘমারে।”
“সাহেব, আমি চুনিলাল এ্যান্ড সন্স থেকে বলছি।”
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। আপনার কাজ হয়ে যাবে। আপনি এদিকে আসছেন কবে?”
“সাহেব, আপনি নিজেই চলে আসুন আজ। লোক পাঠাব?”
“না না। আজ নয়। পরের সপ্তায় হবে।”

গোডবলেকে ভুলে বাঘমারে এখন বেশ খুশি হয়ে উঠলেন। পাঁচটা বেজে গেছে। অফিস খালি। পাঁচটা পাঁচের লোকালটা ধরা যেত। কিন্তু বাঘমারে সেটাতে যাবেন না। পাঁচটা পাঁচের লোকালে তাঁর সব পুরনো সহকর্মী সেকেন্ড ক্লাসে যায়। এখন তিনি অফিসার, তাই ফার্স্ট ক্লাস পাস পেয়ে গেছেন। আর আওয়ালকে দ্যাখো। ফার্স্ট ক্লাস পাস থাকা সত্ত্বেও তিনি সেকেন্ড ক্লাসেই সব বন্ধুদের সঙ্গে ভিড়ভাট্টায় যান। শুধু তাই নয়। নির্লজ্জের মতো ট্রেনের আওয়াজের ওপর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গল্পও করেন। বাঘমারে যখন ক্লার্ক ছিলেন, তখন ওঁর এক বন্ধু ছিল গাইকোয়াড়। দেখা হলেই সে চেঁচাত— “জয় ভীম। কেমন আছেন বাঘমারে সাহেব?” যেন ‘জয় ভীম’টা আস্তে বলা যায় না। গাইকোয়াড় ‘জয় ভীম’ বলে চেঁচালেই বাঘমারের মনে হত আর সবাই যেন তাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখছে।
পাঁচটা পনেরোর লোকালে বাঘমারে জানালার ধারের সিটটা পেয়ে গেলেন। এমন সময় সান্ধ্য কাগজ হাতে নিয়মিত এক সহযাত্রী তড়িঘড়ি এসে বসলেন তাঁর মুখোমুখি। একচিলতে হেসে বললেন, “ওহ! আপনি রোজ ওই জানলার ধারের সিটে। জায়গাটা আপনার জন্যে রিজার্ভড করা মনে হচ্ছে।”
‘রিজার্ভড’ শব্দটা কানে যেতেই বাঘমারে সতর্ক হয়ে উঠলেন। কোনোভাবে এই লোকটা জানেন তিনি সিডিউল্ড কাস্ট? পরমুহূর্তে নিজেই নিজেকে বোঝালেন, তাঁর পরিচয় জানা ওই লোকটার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বাঘমারের মনে হল পদবিটা পালটে নেওয়া বোধ হয় নিরাপদ হবে। আকোলকার রাখলে হয়। তিনি আকোলার লোক যখন।

রেলওয়ে কোয়ার্টারে পৌঁছতে পোঁছতে ছ-টা বেজে গেল। আজ টিভিতে মারাঠি একটা সিনেমা আছে। বাঘমারে জোরে পা চালালেন।
বাড়ি পৌঁছে দেখলেন সিনেমাটা শুরু হয়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী আর বাচ্চার সঙ্গে তিনিও সোফায় বসে পড়লেন। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক। তাঁর স্ত্রী গিয়ে দরজা খুলে একজন মহিলাকে নিয়ে এল, সঙ্গে দুটো বাচ্চা। মহিলার পোশাক মলিন। বাচ্চাদুটোও বেশ নোংরা। 
“এসো, সিনেমা শুরু হয়ে গেছে।” তাদের বসতে দিলেন। বাঘমারের মুখটা তেতো হয়ে গেল।
সিনেমা শেষ হতে মহিলা বললেন, “কুসুম এবার আমি আসি।”
“চা খেয়ে যাও।”
“না। না। এতক্ষণে ও উঠে পড়েছে। আজ নাইট শিফট।”
মহিলা আর বাচ্চা দুটো চলে গেল।
বিরক্ত বাঘমারে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন— “ওই মেয়েটা কে?”
“উনি? সম্পর্কে মাসি হন। আমাদের কোয়ার্টারের পাশের বস্তিতে থাকেন।”
“তা এত ঘটা করে ডেকে এনেছ যখন, একটু যত্নআত্তি করলে না!”
“শোনোই না কী হয়েছে। বাজার যাচ্ছিলাম, হঠাৎ রাস্তায় দেখা মাসির সঙ্গে। কত্ত বছর পরে... ছোটবেলায় কী যে আদরযত্ন করেছে এই মাসি। জানতামই না এত কাছে থাকে।”
“বেশি আদেখলাপনা কোরো না তো। আমরা কি বিডিডি-র চালায় থাকি? ক-দিন পরে বস্তির সমস্ত লোক উঠে আসবে তোমার ঘরে টিভি দেখতে। এদের দেখে পাড়া-প্রতিবেশী কী ভাববে সেটা ভেবে দেখেছ?”
“ওরকম করছ কেন? মাসি এসে কি আমাদের কিছু ক্ষতি করছে?”
“ফালতু বোকো না। স্ট্যাটাস মেনটেন করতে শেখো। তুমি এখন একজন অফিসারের স্ত্রী।”
কুসুমের চোখ ফেটে জল এল। বেচারা মাসি তাকে কতই না ভালোবাসত। কারণে-অকারণে একটু বেশিমাত্রায় প্রশ্রয়ই দিত বলা যায়। মাসিরা কবে যে বোম্বে এল কে জানে। কুসুম আগে যদি জানতে পারত ওরা অত কাছে থাকে...
“খেতে-টেতে দেবে তো, নাকি!”
আচমকা মাসির স্মৃতি চারদিকে ছত্রখান হয়ে পড়ল। কুসুম তড়িঘড়ি রাতের খাবারের বন্দোবস্ত শুরু করল।
ডাইনিং টেবিলের দিলে নজর চালিয়ে বাঘমারে প্রশ্ন করল— “ফল কেনোনি?”
“না।”
“কেন? তুমি তো বললে বাজারে যাচ্ছিলে। মাসিকে দেখে ভুলে গেছিলে সব?”
“বাজারে গিয়েছিলাম। ফলের দাম দেখে আর কেনার ইচ্ছে হয়নি।”
আবার সোফায় ফিরে এসে বাঘমারে ছেলেটাকে কাছে টেনে নিল। পাঁচ বছরের আদুরে ছেলে। বাবার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। ছেলের হাঁটুর ওপর একটা সদ্য-কাটা দাগ বাঘমারের নজরে এল।
“পায়ে লাগল কী করে রে পাপ্পু?”
“প্রমোদ আছে না? সে-ই যাদের বাড়ি বড় গণেশ মূর্তি আছে। তার ঠাকুমা আমায় ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।”
“কেন? তুই প্রমোদকে মেরেছিলি?”
“না, খেলতে খেলতে আমি ওর ওয়াটার বটল থেকে জল খেয়েছিলাম।”

বাঘমারের চোখের সামনে গোডবলের মুখটা ভেসে উঠল। প্রমোশনে গজিয়ে ওঠা তার নতুন ডানাটা কে যেন দুমড়ে মুচড়ে দিল। অসহায় নশ্বরের মতো পাণ্ডুরঙ সত্ব বাঘমারে নিচের পৃথিবীর দিকে ধাবিত হল।
(অর্জুন ডাংলে খ্যাতনামা মারাঠি সাহিত্যিক। দলিত সাহিত্যে তাঁর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। )


• মাসকট, ওমান

menu
menu