কেন লাইব্রেরি, বই পড়া, এবং স্বপ্ন দেখার ওপরে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে

(২০১৩ সালের ১৫ অক্টোবর, রিডিং এজেন্সি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নিল গেইম্যান ‘Why our Future Depends on Libraries, Reading and Daydreaming’ শীর্ষক বক্তৃতাটি উপস্থাপন করেন।) 

কেউ একজন কোন পক্ষে অবস্থান করছে, এবং কেন, এবং সে পক্ষপাতদুষ্ট কি না—তা আপনার জানা দরকার। এটি অনেকটা সদস্যদের স্বার্থের একটি ঘোষণাপত্রের মতো। আমি আজ বই পড়া নিয়ে কথা বলবো। আমি আপনাকে বলবো লাইব্রেরি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে গল্পের বই পড়া, নিছক আনন্দের জন্য কিছু পড়া হচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি। আমি আকুলভাবে আপনাদের বুঝতে অনুরোধ করবো লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরিয়ান কারা, এবং তাদের কেন টিকিয়ে রাখা উচিত। 

নিশ্চিতভাবে, ভীষণভাবেই আমি পক্ষপাতদুষ্ট : আমি একজন লেখক, অনেক সময়ই আমি গল্প লিখে থাকি। আমি শিশু এবং পূর্ণবয়স্ক সবার জন্যই লিখি। গত প্রায় ৩০ বছর ধরে আমি আমার শব্দের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করছি, তার বেশিরভাগই বিভিন্ন কাল্পনিক বস্তু সৃষ্টি করে আর তা লেখার মাধ্যমে। তাই আমার নিজের স্বার্থেই আমি চাই মানুষ পড়ুক, তারা গল্পের বই পড়ুক, লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরিয়ানরা টিকে থাকুক এবং বই পড়ার প্রতি, আর যেসব জায়গায় বই পড়া যায়, সেসব জায়গার প্রতি মানুষের ভালোবাসা জন্মাক।

কাজেই, একজন লেখক হিসেবে আমি পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু, একজন পাঠক হিসেবে আমি আরো বেশি পক্ষপাতদুষ্ট। একজন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে আমি তার চেয়েও বেশি পক্ষপাতদুষ্ট। 

আজ রিডিং এজেন্সির পৃষ্ঠপোষকতায় আমি এখানে কথা বলতে এসেছি। এই দাতব্য সংগঠনটি জীবনে চলার পথে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। আর, তা তারা করতে চায় মানুষকে আত্মবিশ্বাসী এবং উদ্যমী পাঠক হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে। সংগঠনটি সাক্ষরতা অভিযানে সহায়তা করে, এবং খোলাখুলিভাবে, অবাধে বই পড়াকে উৎসাহিত করে। কারণ, তাদের মতে, বই পড়ার মাধ্যমে আমরা সবকিছুর পরিবর্তন ঘটাতে পারি।

এবং এই পরিবর্তন, আর বই পড়া নিয়ে কথা বলতেই আমি আজ এখানে এসেছি। আমি জানাতে চাই, পড়ার অভ্যাস কী করতে পারে, কেন এটি উপকারী।

একবার, নিউইয়র্কে, আমি বেসরকারি কারাগারের নির্মাণ বিষয়ে একটি আলোচনা শুনেছিলাম। কারাগার শিল্পকে তার ভবিষ্যৎ বিকাশের কথা মাথায় রাখতে হয়—তাদের কয়টি কক্ষ লাগবে? আজ থেকে ১৫ বছর পরে ঐ কারাগারে কয়জন বন্দী থাকবে? দেখা গেলো যে, খুবই সরল একটি অ্যালগরিদম ব্যবহারের মাধ্যমে, খুব সহজেই এই ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। তাদের শুধু খুঁজে বের করতে হবে যে, ১০ এবং ১১ বছরের শিশুদের মধ্যে কত শতাংশ পড়তে পারে না, এবং নিশ্চিতভাবেই আনন্দপাঠ করতে পারে না। 

এটি যে জোড়ায় জোড়ায় ঘটে এমনটি নয়। শিক্ষিত সমাজে অপরাধপ্রবণতা নেই, তা বলা যায় না। কিন্তু এদের মধ্যে খুবই বাস্তব পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। 

আর, আমি মনে করি এই পারস্পরিক সম্পর্কের সরলতমটি আসে খুবই সহজ একটি ব্যাপার থেকে। শিক্ষিত লোকেরা গল্পের বই পড়ে।

গল্প পড়ার দু’টি সুবিধা আছে। প্রথমত, এটি হলো পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার একটা প্রবেশপথ। এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে তা জানার তাগিদ, পৃষ্ঠা উল্টানোর ইচ্ছা, কষ্টকর হলেও চলতে থাকার একটা প্রয়োজনীয়তা, কারণ কেউ একজন কোনো বিপদে আছে, আর আপনাকে জানতে হবে এর শেষটা কীভাবে হচ্ছে... এটি খুব আন্তরিক একটা তাড়না। এটি আপনাকে নতুন শব্দ শিখতে, নতুন চিন্তা করতে, চলতে থাকা শিখতে বাধ্য করবে। এটি আবিষ্কার করা যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পড়া একটি আনন্দময় ঘটনা। একবার এটি শিখে ফেলেছেন মানে হলো আপনি সবকিছু পড়ার রাস্তায় উঠে পড়েছেন। আর পড়াটাই হলো চাবিকাঠি। কয়েক বছর আগে, অল্প কিছু কথাবার্তা উঠেছিল যে আমরা একটি শিক্ষা-পরবর্তী যুগে বাস করছি, এ যুগে লিখিত শব্দের মানে বুঝতে পারার ক্ষমতা অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু সেসব দিন চলে গিয়েছে, শব্দরা এখন অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। শব্দের সাহায্যেই আমরা পৃথিবীকে পরিচালনা করে থাকি, এবং এখন যখন পৃথিবীটা স্বচ্ছন্দভাবে ওয়েবে মিশে যাচ্ছে, যোগাযোগ করা আর যা পড়ছি তা হৃদয়াঙ্গম করার জন্য আমাদেরও তাকে অনুসরণ করতে হবে। একে অন্যের কথা বুঝতে না পারলে মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে না, যোগাযোগ করতে পারে না, এবং অনুবাদ কার্যক্রমের মাধ্যমে খুব বেশি সহায়তা পাওয়া সম্ভব নয়।

শিশুদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিটি হচ্ছে তাদের পড়তে শেখানো, আর তাদের দেখানো যে পড়া একটি আনন্দময় ব্যাপার। আর, এর সরলতম অর্থটি হলো তারা উপভোগ করে এমন বই খুঁজে বের করা, তাদের ঐ বইগুলো পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, আর তাদের সেগুলো পড়তে দেওয়া। 

শিশুদের জন্য খারাপ বই বলতে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। প্রায়ই কিছু বয়স্ক লোক কিছু বাচ্চাদের বই, বা কোনো এক ধারার বইয়ের প্রতি নির্দেশ করে বলে ওঠেন যে, এগুলো খারাপ বই, শিশুদের এগুলো পড়তে দেওয়া যাবে না। বারবার আমি এটি ঘটতে দেখেছি; এনিড ব্লাইটনকে বাজে লেখক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো, আর এল স্টাইনকেও, এমনি আরো অনেক লেখকই ছিলেন। কমিকস বই নিরক্ষরতাকে উৎসাহিত করছে, এমন সমালোচনাও হয়েছিলো। 

এটি বাজে কথা। এটি উন্নাসিকতা আর বোকামির পরিচায়ক। শিশুদের জন্য খারাপ লেখক বলতে কিছু নেই, যদি তারা ঐ বই পড়তে পছন্দ করে, পড়তে চায়, আর খুঁজে বের করতে চায়। তাদের যে গল্পগুলো পড়া প্রয়োজন, তা তারা নিজেরাই খুঁজে বের করে আনে, আর তারা নিজেদের গল্পগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসে। গতানুগতিক আর জীর্ণ কোনো ধারণা একটি শিশুর কাছে গতানুগতিক আর জীর্ণ নয়। শিশুটি এই প্রথমবার ঐ ধারণার মুখোমুখি হয়েছে। শিশুরা ভুল কিছু পড়ছে মনে করে তাদেরকে পড়া থেকে নিরুৎসাহিত করবেন না। যে গল্পের বইটি আপনি পছন্দ করছেন না, সেটি আপনার পছন্দের কোনো বই খুঁজে পাওয়ার রাস্তা করে দিতে পারে। তাছাড়া, সবার পছন্দও আপনার মতো নয়। 

ভালো করতে চাওয়া বয়স্ক লোকেরা খুব সহজেই একজন শিশুর বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা ধ্বংস করে দিতে পারেন। তাদের পছন্দের বই পড়তে না দিয়ে, অথবা, ভিক্টোরীয় যুগের “উন্নত” সাহিত্যের একুশ শতকের সমতুল্য হিসেবে আপনার পছন্দের উত্তম কিন্তু একঘেয়ে বই তাদের পড়তে দিয়ে, আপনি এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করে ফেলতে পারেন, যারা বই পড়াকে তুচ্ছ কাজ মনে করতে পারে। আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো, তারা একে নিরানন্দ একটি কাজ হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করতে পারে।

আমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের শিশুদের বই পড়ার মইয়ে তুলে দেওয়া : যা কিছু তারা পড়তে পছন্দ করে, তা তাদের ধাপে ধাপে সুশিক্ষার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। (তবে, এই লেখক যা করেছে তা ভুলেও করতে যাবেন না। তার ১১ বছরের মেয়েকে আর এল স্টাইন পড়তে দেখে সে তাকে স্টিফেন কিং এর ‘ক্যারি’ বইটি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো, তুমি এই বইগুলো পছন্দ করে থাকলে এটাও তোমার দারুণ লাগবে! হলি তার কিশোরবেলার বাকি বছরগুলো তৃণভূমিতে বসতি স্থাপন করার নিরাপদ গল্প পড়ে কাটিয়ে দিয়েছিলো, আর এখনও স্টিফেন কিং এর নাম উচ্চারিত হলেই সে আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।)

দ্বিতীয়ত, গল্পের বই সহমর্মিতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। যখন আপনি টিভি দেখছেন, অথবা একটি ফিল্ম দেখছেন, আপনি অন্য মানুষদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখছেন। গদ্য কথাসাহিত্য এমন একটি ব্যাপার যেটি ২৬টি বর্ণ এবং হাতে গোণা কয়েকটি বিরাম চিহ্নের সাহায্যে আপনি তৈরি করে থাকেন। আর, শুধু আপনিই, নিজের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে পারেন, সেখানে বসতি বানাতে পারেন, এবং ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পারেন। আপনি এমন সব কিছু অনুভব করতে পারেন, এমন সব স্থান, পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারেন, যা আপনি অন্য কোনোভাবে জানতে পারতেন না। আপনি জানতে পারেন যে, প্রতিটি মানুষের আড়ালেই আসলে একজন করে ‘আমি’ আছে। বই পড়ার সময় আপনি অন্য কারো জীবন যাপন করেন, আর যখন আপনি নিজের জগতে ফিরে আসেন, তখন আপনি কিছুটা হলেও একজন পরিবর্তিত মানুষ।

মানুষকে সংঘবদ্ধ করে তোলার একটি বড় হাতিয়ার হলো সহমর্মিতা। এটি আমাদের নিজেদের নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা ব্যক্তি না হয়ে আরো বেশি কিছু হওয়ার সুযোগ দেয়।

পড়তে পড়তে আপনি পৃথিবীতে চলার জন্য আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখে ফেলছেন। সেটি হলো :

পৃথিবীকে এরকমই হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সব কিছু অন্যরকমও হতে পারে। 

২০০৭ সালে, চীনে প্রথমবারের মতো দল থেকে অনুমোদন পাওয়া কোনো সায়েন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি সাহিত্য বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। এক পর্যায়ে আমি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, সায়েন্স ফিকশন তো একটা লম্বা সময় ধরেই অবাঞ্ছিত ছিলো। এখন এই সম্মেলন কেন হচ্ছে? আগের অবস্থার কী পরিবর্তন ঘটেছে?

তিনি বললেন যে, ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে খুবই সরল। অন্য কেউ তাদের নকশা করে দিলে, তা থেকে জিনিসপত্র বানাতে চীনারা সিদ্ধহস্ত। কিন্তু নতুন কিছু সৃষ্টিতে, উদ্ভাবনী শক্তিতে তারা অনেক পিছিয়ে। তারা কল্পনা করতে পারে না। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলো। তারা অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগলে গিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টাদের কাছ থেকে তাদের নিজেদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলো। এবং জানা গেলো যে, শিশু বয়সে তাদের সবাই সায়েন্স ফিকশন পড়তো। 

গল্পের বই আপনাকে ভিন্ন জগতের সন্ধান দিতে পারে। এটি আপনাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে আপনি এর আগে কখনও যান নি। একবার নতুন জগতে, যেমন যেখানে জাদুর ফল খাওয়া যায়, সেখানে ঘুরে আসলে, যে জগতে আপনি বেড়ে উঠেছেন সেখানে আপনি আর কখনোই পুরোপুরি সন্তুষ্ট বোধ করবেন না। অসন্তুষ্টি একটি ভালো ব্যাপার। অসন্তুষ্ট মানুষ নিজের জগতের পরিবর্তন এবং উন্নতি ঘটিয়ে সে জগতকে আরো ভালো, আর আলাদা করে তোলে। 

এই প্রসঙ্গে আমি পলায়নপর মনোভাব বা এস্কেপিজম নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। শব্দটি নিয়ে এমনভাবে তর্ক-বিতর্ক করা হয়, যেন এটি খারাপ কিছু। যেন ‘এস্কেপিস্ট’ সাহিত্য এক ধরনের সস্তা আফিম যা বিশৃঙ্খল, বোকা, আর বিভ্রান্তরাই শুধু ব্যবহার করে থাকে। এবং প্রাপ্তবয়স্ক আর শিশুদের জন্য একমাত্র যথার্থ সাহিত্য হচ্ছে সেই সাহিত্য যা একজন পাঠকের বাস্তব জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোকে প্রতিফলিত করে। 

আপনি যদি কোনো দুঃসহ পরিস্থিতিতে, কোনো অপ্রীতিকর স্থানে, আপনার ক্ষতি করতে চায় এমন কিছু মানুষের সাথে আটকা পড়ে থাকেন, আর কেউ যদি আপনাকে সেখান থেকে সাময়িক মুক্তি দিতে চায়, কেন আপনি তা গ্রহণ করবেন না? ‘এস্কেপিস্ট’ সাহিত্য হচ্ছে ঠিক তাই : যা একটি দরজা খুলে দেয়, বাইরের সূর্যের আলো দেখার সুযোগ দেয়, আপনাকে যাওয়ার জন্য এমন একটি জায়গা দেয় যেখানে আপনিই নিয়ন্ত্রণে থাকবেন, যেখানে আপনি আপনার পছন্দের মানুষদের সাথে সময় কাটাতে পারবেন (এবং, বই কিন্তু সবসময়ই একটি বাস্তব স্থান। বইকে অবাস্তব মনে করে ভুল করবেন না যেন)। আর, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যে, আপনার এই মুক্তির সময় বই আপনাকে এই পৃথিবী আর আপনার পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান দিতে পারে, আপনাকে অস্ত্র, আর বর্ম দিতে পারে : এই সত্যিকার জিনিসগুলো আপনি আপনার বন্দীশালায় নিয়ে আসতে পারেন। এসব দক্ষতা, জ্ঞান, সরঞ্জাম, আপনি বাস্তব জীবনের মুক্তির ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারেন।

জে আর আর টোলকিন যেমন আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, একমাত্র কারারক্ষক ছাড়া আর কেউই মুক্তির বিপক্ষে নিন্দায় মুখর হয় না। 

একজন শিশুর বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা নষ্ট করার আর একটি উপায় হলো তার আশেপাশে যেন কোনো ধরনের কোনো বই না থাকে, তা নিশ্চিত করা। আর, তাকে বই পড়ার জন্য কোনো একটি জায়গা না দেওয়া। আমি ভাগ্যবান ছিলাম। আমার বেড়ে ওঠার সময় আমার এলাকায় একটি চমৎকার লাইব্রেরি ছিলো। আমি এমন বাবা-মা পেয়েছিলাম, যাঁদের একটু বোঝালেই তাঁরা আমার গ্রীষ্মের ছুটির সময় অফিসে যাওয়ার আগে আমাকে লাইব্রেরিতে নামিয়ে দিয়ে যেতেন। আর লাইব্রেরিয়ানরাও এমন ছিলেন যে, প্রতিদিন সকালে একজন ছোট, সঙ্গীহীন ছেলেকে শিশুদের লাইব্রেরিতে ফেরত আসতে দেখে, কার্ড ক্যাটালগ ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখে, ভূত কিংবা জাদু কিংবা রকেটের গল্পের বই খুঁজতে দেখে, বিরক্ত হতেন না। যখন ছোটদের লাইব্রেরির বই পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো, তখন আমি বড়দের বই পড়া শুরু করলাম।

তাঁরা ভালো লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। তাঁরা বই পছন্দ করতেন, আর কেউ বইগুলো পড়ছে এটা দেখতেও পছন্দ করতেন। এক লাইব্রেরি থেকে অন্য লাইব্রেরিতে কীভাবে বই ধার আনা যায়, সেটা আমাকে তাঁরা শিখিয়েছিলেন। আমি যে বইগুলো পড়তাম সেগুলো নিয়ে তাঁদের কোনো নাক-উঁচু ভাব ছিলো না। তাঁরা সম্ভবত বড় বড় চোখের ঐ ছোট বইপাগল ছেলেটিকে পছন্দই করতেন। আমার পড়া বইগুলো নিয়ে তাঁরা আমার সাথে আলোচনা করতেন, একটি সিরিজের পরবর্তী বইগুলো আমাকে খুঁজে দিতেন, তাঁরা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করতেন। তাঁরা আমাকে একজন পাঠক হিসেবেই দেখতেন, এর বেশিও নয়, কমও নয়—এর মানে হলো, তাঁরা আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। আট বছর বয়সী আমি কারো কাছ থেকে সম্মান পেয়ে অভ্যস্ত ছিলাম না। 

লাইব্রেরির একটি দিক হলো স্বাধীনতা। পড়ার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, যোগাযোগের স্বাধীনতা। অন্য দিকগুলো হলো শিক্ষা (আমরা বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসলেই শিক্ষার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় না), বিনোদন, একটি নিজের, নিরাপদ জায়গা তৈরি করা, এবং তথ্য পাওয়ার সুযোগ। 

একবিংশ শতাব্দীর মানুষেরা লাইব্রেরি আর এর উদ্দেশ্য নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করে। এটি আমাকে চিন্তায় ফেলে দেয়। আপনি যদি লাইব্রেরিকে শুধু বইয়ের তাক হিসেবেই দেখে থাকেন, তাহলে লাইব্রেরিকে আপনার প্রাচীন, সেকেলে বলে মনে হতেই পারে, বিশেষত আপনি যখন এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছেন যেখানে প্রায় সব কাগজের বইকেই আপনি ডিজিটালি পাচ্ছেন। কিন্তু, এক্ষেত্রে আপনি মূল ব্যাপারটিই ধরতে পারছেন না।

আমার মনে হয়, তথ্যের ধরনেরও একটি ভূমিকা এখানে আছে। তথ্যের মূল্য আছে, আর সঠিক তথ্যের মূল্যও যথেষ্ট বেশি। মানব ইতিহাসের পুরোটা জুড়ে আমাদের তথ্যের ঘাটতি ছিলো, আর দরকারি তথ্য জানাটা খুবই জরুরি ছিলো, তা অনেক মূল্যবানও ছিলো। কখন শস্য রোপণ করতে হবে, কোনো একটা জিনিস কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, মানচিত্র, ইতিহাস, গল্প—এগুলো খাবার এবং সংস্থানের জন্য ভালো উপায় ছিলো। তথ্য একটি মূল্যবান বিষয় ছিলো, আর যার কাছে তথ্য ছিলো, বা যে তথ্য জোগাড় করতে পারতো, সে এর জন্য টাকা দাবি করতে পারতো। 

বিগত কিছু বছরে আমরা তথ্যের ঘাটতি সম্বৃদ্ধ অর্থনীতি থেকে এমন একটি অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছি যেখানে তথ্যের অতিরিক্ত সরবরাহ আছে। গুগলের এরিক স্মিট এর মতে, মানব সভ্যতার আদি থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত যত তথ্য সৃষ্টি করা হয়েছে, এখন প্রতি দুইদিনে তার সমপরিমাণ তথ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। আপনি যদি সংখ্যায় জানতে চান, তাহলে পরিমাণটা হচ্ছে দিনে প্রায় ৫ এক্সোবাইট ডেটা। এখন আমাদের চ্যালেঞ্জটা আর মরুভূমিতে দুর্লভ গাছ খোঁজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জঙ্গলের ভেতর থেকে একটি নির্দিষ্ট গাছ খুঁজে বের করা। এই বিপুল পরিমাণ তথ্য থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসটি খুঁজে বের করার জন্য আমাদের সহায়তার প্রয়োজন। 

লাইব্রেরি হচ্ছে এমন জায়গা যেখানে মানুষ তথ্যের জন্য যায়। বই হচ্ছে এই তথ্য-হিমবাহের অগ্রভাগ : তারা ওখানেই থাকে, আর লাইব্রেরি আপনাকে বিনামূল্যে এবং আইনসম্মতভাবে বই দিতে পারে। শিশুরা এখন লাইব্রেরি থেকে বিগত যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি বই ধার করছে। এর মধ্যে সব ধরনের বই-ই রয়েছে— কাগজের বই, ডিজিটাল বই, অডিও বই। কিন্তু, এছাড়াও, লাইব্রেরি হচ্ছে এমন জায়গা যেখানে  যাদের কম্পিউটার বা ইন্টারনেট সংযোগ নেই, তারা বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু, এখন আপনার চাকরি খোঁজা, চাকরির জন্য আবেদন করা, অথবা আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করার পদ্ধতি—সবই অনলাইন হয়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরিয়ানরা ঐসব মানুষকে এই জগতে বিচরণ করতে সাহায্য করতে পারেন। 

সব বই কম্পিউটার বা ফোনের পর্দায় স্থানান্তরিত হবে, বা তাদের স্থানান্তরিত হওয়া উচিত, এটি আমি বিশ্বাস করি না। কিন্ডল আবিষ্কৃত হওয়ার বিশ বছরেরও বেশি সময় আগে, ডগলাস অ্যাডামস যেমনটা আমাকে বলেছিলেন, কাগজের বই হচ্ছে হাঙ্গরের মতো। হাঙ্গরেরা অনেক পুরোনো : ডাইনোসররা আসার আগে থেকেই সমুদ্রে হাঙ্গর ছিলো। এবং সমুদ্রে এখনও যে হাঙ্গর আছে তার কারণ হলো, হাঙ্গর হয়ে টিকে থাকার ক্ষেত্রে হাঙ্গরেরাই অন্য যে কারো চাইতে বেশি পারদর্শী। কাগজের বই কঠিন, তাদের ধ্বংস করা শক্ত, তারা স্নান-প্রতিরোধী, সৌর-চালিত, তাদের হাতে নিতে ভালো লাগে : বই হওয়ার জন্য তারা ভালো, এবং তাদের স্থান সবসময়ই থাকবে। তারা লাইব্রেরির অন্তর্ভুক্ত, ঠিক যেমন ইতোমধ্যেই লাইব্রেরি আপনার ই-বই, অডিওবই, ডিভিডি, আর ওয়েব কন্টেন্ট খুঁজে পাওয়ার জায়গায়ও পরিণত হয়েছে। 

লাইব্রেরি হচ্ছে একটি তথ্যের ভাণ্ডার, যে তথ্যে সব নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে আছে স্বাস্থ্য আর মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য। এটি একটি সামাজিক স্থান। এটি একটি নিরাপত্তার জায়গা, পৃথিবী থেকে রক্ষা পাওয়ার আশ্রয়স্থল। ভবিষ্যতের লাইব্রেরি কেমন হবে, আমাদের এখন সে বিষয়ে চিন্তা করা উচিত। 

এসএমএস, ই-মেইল, আর লিখিত তথ্যের এই যুগে সাক্ষরতা অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। আমাদের পড়তে আর লিখতে জানতে হবে। আমাদের প্রয়োজন বৈশ্বিক নাগরিক—যারা সহজেই পড়তে পারে, যা পড়ছে তা অনুধাবন করতে পারে, অতি সূক্ষ্ম তারতম্যও ধরতে পারে, আর নিজের বক্তব্য স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে। 

প্রকৃতপক্ষে, লাইব্রেরি হচ্ছে ভবিষ্যতের প্রবেশদ্বার। তাই এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, পৃথিবী জুড়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ খরচ কমানোর সহজ উপায় হিসেবে লাইব্রেরিগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে না যে বর্তমানের ব্যয় পরিশোধ করার জন্য তারা ভবিষ্যৎ থেকে চুরি করছে। যে দরজাগুলো খোলা রাখা উচিত তা তারা বন্ধ করে দিচ্ছে।   
অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (Organisation for Economic Corporation and Development) এর একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে— লিঙ্গ, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, পেশা, ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার পর ইংল্যান্ড হচ্ছে একমাত্র দেশ যেখানে সবচেয়ে বেশি বয়সী লোকেরা সাক্ষরতা এবং সংখ্যা-বিষয়ক দক্ষতায় সবচেয়ে কম বয়সীদের চাইতে এগিয়ে আছে। 

অন্যভাবে বলতে গেলে আমাদের সন্তান, নাতি-নাতনিরা আমাদের চেয়ে কম সাক্ষর এবং সংখ্যা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কম দক্ষতাসম্পন্ন। তাদের পৃথিবী পরিচালনা করার সক্ষমতা কম, পৃথিবীর সমস্যা দূর করার জন্য একে বোঝার ক্ষমতাও কম। তাদের সহজেই ঠকানো যাবে, ভুল পথে পরিচালিত করা যাবে। নিজেদের পৃথিবীকে বদলানোর ক্ষমতা তাদের কম থাকবে, তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগযোগ্যতাও কম থাকবে। এর সবই ঘটবে। আর, দক্ষ কর্মীর অভাবের কারণে জাতি হিসেবে ইংল্যান্ড অন্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়বে।  

বইয়ের মাধ্যমে আমরা মৃতদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করি। এই উপায়ে যাঁরা আর আমাদের সাথে নেই, তাঁদের কাছ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, যে মানবতা তার নিজের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, উন্নতি করেছে, জ্ঞানকে বারবার শিখতে হয় এমন কিছু না করে ক্রমবর্ধমান করেছে। প্রায় সব দেশের চাইতেও পুরোনো অনেক গল্প আছে, যারা বয়সের দিক দিয়ে বহু আগেই যে সভ্যতা এবং যে ভবনে সে গল্পগুলো বলা হয়েছিলো সেগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

আমি মনে করি, আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্ব আছে। শিশুদের প্রতি, তারা একদিন যে পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিণত হবে তাদের প্রতি, যে পৃথিবীতে তারা নিজেদের খুঁজে পাবে তার প্রতি, আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে। এই দায় আমাদের প্রত্যেকের—পাঠক হিসেবে, লেখক হিসেবে, নাগরিক হিসেবে। এসব দায়িত্বের কিছু কিছু আজ আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।

আমার বিশ্বাস, আমাদের একান্তে এবং প্রকাশ্যে আনন্দপাঠের দায়বদ্ধতা আছে। আমরা যদি আনন্দের জন্য পড়ি, অন্যরা যদি আমাদের পড়তে দেখে, তাহলে আমরা শিখি, আমাদের কল্পনাশক্তির ব্যায়াম হয়। আমরা অন্যদের দেখাই যে বই পড়া একটি ভালো কাজ। 

আমাদের লাইব্রেরিকে সমর্থন করার দায়বদ্ধতা আছে। লাইব্রেরি ব্যবহার করা, অন্যকে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা, লাইব্রেরি বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদ করা। লাইব্রেরিকে যথার্থ মূল্য দিচ্ছেন না মানে আপনি তথ্য, সংস্কৃতি বা জ্ঞানকে যথার্থ মূল্য দিচ্ছেন না। আপনি অতীতের কণ্ঠস্বর চেপে ধরছেন, আর ভবিষ্যতের ক্ষতি করছেন।

আমাদের সন্তানদের গল্প পড়ে শোনানোর জন্য আমরা দায়বদ্ধ। যেসব গল্প তারা পছন্দ করে, তা পড়ে শোনানো। যেসব গল্প পড়তে পড়তে আমরা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি সেগুলো পড়ে শোনানো। পড়ার সময় বিভিন্ন রকম গলার স্বর করা, গল্পটিকে আরো মজার করে তোলা। আর, তারা নিজেরা পড়তে শিখে গিয়েছে, শুধু এই কারণেই তাদের পড়ে শোনানো বন্ধ না করে দেওয়া। গল্প পড়ে শোনানোর সময়টাকে সন্তানের সাথে বন্ধন গড়ে তোলার সময় হিসেবে ব্যবহার করুন, যে সময়ে কোনো ফোন চেক করা হবে না, যখন আপনার মনোযোগ নষ্টকারী সব কিছু দূরে সরিয়ে রাখা হবে।

আমাদের ভাষা ব্যবহার করার প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। নিজেদের চ্যলেঞ্জ করা, শব্দের অর্থ খুঁজে বের করা, তাদের সঠিক ব্যবহার জানা, স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করা, যা বোঝাতে চাইছি তা-ই বলতে পারা। আমাদের উচিত নয় ভাষাকে থমকে দিতে চাওয়া, এটিকে একটি মৃত জিনিস হিসেবে সম্মান করা। আমাদের ভাষাকে ব্যবহার করা উচিত একটি জীবন্ত জিনিস হিসেবে, যা শব্দ ধার করে, যা সময়ের সাথে শব্দের অর্থ আর উচ্চারণ পাল্টে যাওয়াকে সমর্থন করে। 

আমরা লেখকদের, বিশেষত শিশুতোষ লেখকদের, কিন্তু সব লেখকদেরই, পাঠকদের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। এটি হচ্ছে সত্য বলার দায়বদ্ধতা, বিশেষ করে যখন আমরা কোনো কাল্পনিক জায়গায় কোনো কাল্পনিক মানুষকে নিয়ে লিখছি। আমাদের বুঝতে হবে যে সত্য আসলে যে ঘটনা ঘটছে সেটি নয়, বরং এই ঘটনাটি আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে আমাদের কী বলছে, সেটি। সর্বোপরি, ফিকশন বা গল্প হচ্ছে সেই মিথ্যা যা সত্যটা প্রকাশ করে থাকে। পাঠকদের বিরক্তি উৎপাদন না করার প্রতি আমরা দায়বদ্ধ, তাদের পৃষ্ঠা উল্টে যেতে বাধ্য করার প্রতি আমরা দায়বদ্ধ। অনিচ্ছুক পাঠকদের জন্য মোটের ওপর সবচেয়ে ভালো চিকিৎসার একটি হলো এমন গল্প যা পড়া থেকে তারা নিজেদের বিরত রাখতে পারে না। আমরা আমাদের পাঠকদের সত্য বলবো, তাদের অস্ত্র দেবো, বর্ম দেবো, আর এই শ্যামল পৃথিবীতে নিজেদের ক্ষুদ্র জীবনে যা জ্ঞান লাভ করেছি তা পাঠকদের জানাবো। কিন্তু, একইসাথে আমরা পাঠকদের উপদেশ না দেওয়া, বক্তৃতা না দেওয়ার প্রতিও দায়বদ্ধ। পাখি মায়েরা যেমন আগে থেকে চিবিয়ে রাখা খাবার বাচ্চাদের খাওয়ায়, তেমনভাবে আগে থেকে হজম করে রাখা নীতিবাক্য পাঠকদের জোর করে না গেলানোর প্রতিও আমরা দায়বদ্ধ। এবং, কখনোই, কোনো পরিস্থিতিতে আমরা শিশুদের জন্য এমন কিছু লিখবো না, যা আমরা নিজেরা পড়তে চাইবো না।

আমাদের বুঝতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে যে, শিশুতোষ লেখক হিসেবে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি। কারণ, আমরা যদি ভজঘট পাকিয়ে ফেলি, আর নীরস বই লিখি, যাতে শিশুরা বই এবং বই পড়া থেকে দূরে সরে যায়, আমরা একইসাথে নিজেদের আর তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের মান কমিয়ে ফেলবো।  

পূর্ণবয়স্ক এবং শিশু, লেখক এবং পাঠক—আমাদের সবারই দিবাস্বপ্ন দেখার দায়বদ্ধতা আছে। আমরা সবাই কল্পনা করার প্রতি দায়বদ্ধ। এমন দাবি করাটা সহজ যে কারো একার পক্ষে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। বলা যায় যে আমরা এমন একটি পৃথিবীতে আছি যেখানে সমাজ অনেক বিশাল, যেখানে একা একজন মানুষ কিছুই নয়; একটি দেয়ালে একটি পরমাণু, বা একটি ধানের খেতে এক দানা ধানের সমতুল্য। কিন্তু, সত্যিটা হচ্ছে, একা মানুষও তাদের পৃথিবী সবসময়ই পাল্টাচ্ছে, ভবিষ্যৎ তৈরি করছে। আর, তারা এ কাজটা করছে এটা কল্পনা করার মাধ্যমে যে সবকিছু অন্যরকম হতে পারে।       

আপনার চারপাশে তাকান : আমি আসলেই বলছি। একটু সময় নিন, আর যে ঘরে আপনি আছেন তার চারদিকে তাকান। আমি এমন একটি জিনিস নির্দেশ করতে চাই, যা এতই স্পষ্ট যে আমরা অনেক সময়ই তা ভুলে যাই। সেটি হলো : আপনার চারপাশে আপনি যা দেখতে পাচ্ছেন, এমনকি আপনার ঘরের দেওয়ালটিও কোনো এক সময় কেউ একজন কল্পনা করেছিলো। কেউ একজন চিন্তা করেছিলো যে মেঝেতে বসার চাইতে চেয়ারে বসা বেশি আরামদায়ক, আর চেয়ার কল্পনা করেছিলো। আমি যে এই মুহূর্তে বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে না হয়ে গিয়েও লন্ডনে আপনাদের সাথে কথা বলতে পারছি, কোনো একজন মানুষকে এই উপায়টিও কল্পনা করতে হয়েছিলো। এই ঘর, এখানে যা আছে, এই ভবনের অন্য সব জিনিস, এই শহর, এসব কিছুর অস্তিত্ব আছে, কারণ, মানুষ বারবার এসব কিছু কল্পনা করেছে। 

আমাদের সবকিছু সুন্দর করে তোলার দায়বদ্ধতা আছে। পৃথিবীকে আমরা যেমন পেয়েছি তার চাইতে অসুন্দর করে না রেখে যাওয়া, সমুদ্রগুলো শূন্য না করে ফেলা, আমাদের সমস্যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য না রেখে যাওয়া। নিজেদের নোংরা নিজেরাই পরিষ্কার করে ফেলার জন্য আমরা দায়বদ্ধ। আমাদের সন্তানদের এমন একটি পৃথিবীতে না রেখে যাওয়ার জন্য আমরা দায়বদ্ধ, যে পৃথিবীকে আমরা নিজেদের অপরিণামদর্শীতার কারণে নষ্ট, প্রতারিত আর বিকলাঙ্গ করে ফেলেছি। 

আমরা কী চাই, তা আমাদের রাজনীতিবিদদের জানানোর জন্য আমরা দায়বদ্ধ। রাজনীতিকেরা, তা যে কোনো দলেরই হোক না কেন, যারা যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলার জন্য বই পড়ার গুরুত্ব বোঝে না, যারা জ্ঞান সংরক্ষণ আর সাক্ষরতায় উৎসাহ দেয় না, তাদের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার জন্যও আমরা দায়বদ্ধ। এটি দলীয় রাজনীতির কোনো বিষয় নয়। এটি সাধারণ মানবতার বিষয়।

আলবার্ট আইনস্টাইনকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আমাদের শিশুদের কী করে বুদ্ধিমান করে গড়ে তোলা যাবে। তাঁর উত্তরটি ছিল একইসাথে খুব সরল এবং সুবিবেচিত। তিনি বলেছিলেন, “যদি আপনি চান আপনার সন্তানরা বুদ্ধিমান হয়ে বেড়ে উঠুক, তাদের রূপকথার গল্প পড়ে শোনান। যদি আপনি তাদের আরো বুদ্ধিমান করে তুলতে চান, তাহলে তাদের আরো বেশি রূপকথার গল্প শোনান।” বই পড়া এবং কল্পনা করার উপকারিতা তিনি জানতেন। আমি আশা করি, আমরা আমাদের সন্তানদের এমন একটি পৃথিবী উপহার দিতে পারবো, যেখানে তাদের বই পড়ে শোনানো হবে, তারা বই পড়বে, কল্পনা করবে, আর অনুধাবন করতে পারবে।  


• চট্টগ্রাম   

menu
menu