শেষ পাতাটি

সু এবং জনসি দুজন শিল্পী। একই ফ্ল্যাটে থাকে। তাদের ফ্ল্যাটটি একটি পুরনো বাড়ির তৃতীয় তলায়।  নভেম্বরে জনসি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লো। সে নিউমোনিয়ায় ভুগছিলো। একদৃষ্টে জানালার বাইরে তাকিয়ে অসাড় শরীরে বিছানায় পড়ে থাকলো সে। তার বন্ধু সু খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। ডাক্তার ডাকলো সে। যদিও ডাক্তার প্রতিদিনই আসতো জনসির অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। একদিন ডাক্তার সুকে আড়ালে নিয়ে জানতে চাইলো, 

'আচ্ছা, কোন কিছু কি জনসিকে উদ্বিগ্ন করছে?'

সু উত্তরে জানালো, 'না'। 'কিন্তু এ প্রশ্ন কেন?'

ডাক্তার বললেন, 'মনে হচ্ছে, জনসি ধরেই নিয়েছে  সে আর কখনো সেরে উঠবে না। যদি সে বাঁচতে না চায় কোনো ওষুধ তাকে বাঁচাতে পারবে না।'

সু যথাসাধ্য চেষ্টা করলো জনসিকে তার চারপাশের জিনিসগুলোর প্রতি আগ্রহী করে তুলতে। পোশাক-পরিচ্ছদ ও ফ্যাশন নিয়ে কথা তুললো সু কিন্তু জনসি কোনো উৎসাহ দেখালো না। জনসি অনড় হয়ে তার বিছানায় পড়ে রইলো। 

সু তার ছবি আঁকার বোর্ডটি জনসির কক্ষে নিয়ে এলো এবং ছবি আঁকতে শুরু করলো। জনসির মনকে তার অসুস্থ অবস্থা থেকে সরাতে ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে  সু পাখির মতো শিস দিয়ে সুর ভাঁজলো। হঠাৎ সু শুনলো জনসি কিছু একটা ফিসফিস করছে। সে দ্রুতই তার বিছানার কাছে গেলো এবং শুনলো জনসি উল্টো দিক থেকে গুনছে। সে জানলার বাইরে তাকিয়ে গুনছে, 'বারো'। কিছুক্ষণ পর সে ফিসফিস করে বলছে, 'এগারো', তারপর 'দশ', 'নয়', 'আট', 'সাত'। উৎকণ্ঠা নিয়ে সু জানলার বাইরে তাকালো। সে দেখলো তাদের জানলার ওপারের ইটের দেয়াল বেয়ে একটা বুড়ো আইভি লতা আধাআধি ওঠে এসেছে। বাইরের ঝোড়ো হাওয়ায় লতাটির পাতা ঝরছে। 

সু জানতে চাইলো, 'কী হচ্ছে, সোনা।'

'ছয়' ফিসফিস করে বললো, জনসি। 'এখন তারা খুব দ্রুত ঝরছে। তিন দিন আগে প্রায় একশোটা পাতা ছিলো। আর মাত্র পাঁচটা বাকি।'

সু বললো, 'এখন হেমন্ত' 'এবং পাতা ঝরবেই।'

'যখন শেষ পাতাটি ঝরে পড়বে, আমি মারা যাবো, ' চূড়ান্ত নিশ্চয়তা সহকারে বললো জনসি। 

'বিগত তিন দিন ধরে আমি এই অবস্থাটা দেখছি।' 

উত্তরে সু বললো, 'কী যে বাজে বকছো!'

'তোমার সুস্থ হয়ে ওঠার সঙ্গে এই বুড়ো আইভি লতার কী সম্পর্ক আছে? ডাক্তার নিশ্চিত যে, তুমি সেরে ওঠবে।'

জনসি কিছুই বললো না। সু ভেতরে গেলো এবং তার জন্য এক বাটি সুপ নিয়ে এলো। 

'আমি কোন সুপ চাই না' জনসি বললো। 'আমি ক্ষুধার্ত নই...এখন মাত্র চারটি পাতা অবশিষ্ট আছে। আমি চাই অন্ধকার হয়ে আসার আগেই শেষ পাতাটি ঝরে পড়ুক। তখন আমি চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বো।'

সু জনসির বিছানায় বসলো। তার হাতে চুমু খেয়ে বললো, 'তুমি মরবে না। আমার আলো দরকার। আমি জানলার পর্দা টেনে দিচ্ছি না। আমাদের কিছু টাকা দরকার। আমি ছবিটি আঁকা শেষ করতে চাই।'

বন্ধু আমার, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, সু জনসিকে বললো, 'প্রতিজ্ঞা করো আমার ছবি আঁকার সময় তুমি জানালার বাইরে তাকাবে না।'

'ঠিক আছে', উত্তরে বললো জনসি। 'দ্রুত তোমার আঁকাআঁকি শেষ করো, আমি শেষ পাতাটির ঝরে পড়া দেখতে চাই। অপেক্ষায় অপেক্ষায় আমি অবসন্ন হয়ে পড়েছি। আমাকে মরতে হবে, কাজেই এই মন্দভাগ্য ক্লান্ত পাতাদের একটির মতো আমাকে শান্তিতে চলে যেতে দাও।’

'ঘুমুতে চেষ্টা করো', বললো সু। 'আমাকে একজন বুড়ো খনিজীবীর ছবি আঁকতে হবে। আমি বেরম্যানকে আমার ছবির মডেল হবার জন্য ডেকে আনবো।'

সু দ্রুত নিচে গেলো। নিচতলায় বেরম্যান থাকেন। 

বেরম্যান ষাট বছরের প্রবীণ এক অঙ্কনশিল্পী। সেরা ছবিটি আঁকার স্বপ্ন ছিল তার জীবনভর। কিন্তু সে স্বপ্ন এতদিন তার কাছে অধরাই রয়ে গিয়েছিল। সু তার সমস্ত উদ্বেগের কথা অবলীলায় বেরম্যানকে জানালো। সু বেরম্যানকে জানালো –জনসি নিশ্চিত বিশ্বাস করে যখন শেষ পাতাটি ঝরে পড়বে, তখনই সে মারা যাবে। 

'সে কি নির্বোধ নাকি?' বেরম্যান জিজ্ঞেস করে। 'কীভাবে সে এতোটা বোকা হতে পারে?'

'সে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে' অসুখের কথা জানালো সু। 

'সে কিছুই খাচ্ছে না, কিছুই পান করছে না, এ বিষয়টি আমাকে বেশি উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে।'

'আমি তোমার সঙ্গে আসছি, জনসিকে দেখবো', বেরম্যান বললো। 

তারা পা টিপেটিপে তার কক্ষে এলো। জনসি ঘুমুচ্ছিল। সু পর্দা টেনে দিয়ে পাশের কক্ষে গেলো। সে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে আইভি লতায় আর একটি মাত্র পাতা দেখতে পেলো।
আর একটি মাত্র পাতা ছিল আইভি লতাটিতে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল বাইরে। হিমশীতল বাতাসও বইছিল। মনে হচ্ছিল এখন যেকোনো মুহূর্তে পাতাটি ঝরে পড়বে। বেরম্যান একটি কথাও বললো না। সে তার কক্ষে ফিরে গেলো। 

পরদিন ভোরে জনসি ঘুম ভেঙে জেগে ওঠলো। অস্ফুট স্বরে জানলার পর্দাটা সরিয়ে দিতে বললো সুকে। সু বিচলিত বোধ করলো। সে অনিচ্ছাভরে পর্দাটা সরিয়ে দিলো।
যখন সে লতাটির দিকে তাকালো সু বিস্ময়ে উল্লসিত হয়ে বলে ওঠলো – 
'দেখো, লতাটিতে এখনো একটি পাতা রয়েছে। কেমন সজীব ও সতেজ দেখাচ্ছে পাতাটি। বৃষ্টি এবং প্রচণ্ড ঝড় সত্ত্বেও এটি ঝরে পড়ে নি।'

জনসি বললো, 'গত রাতের ঝড়ের শব্দ আমি শুনেছি। আমি ভেবেছিলাম পাতাটি হয়তো ঝরেই গেছে। নিশ্চিতই এটি আজ ঝরে পড়বে। তারপর আমি মারা যাবো।'

'তুমি মারা যাবে না' সু খুব জোরের সঙ্গে বললো। তোমার বন্ধুদের জন্য তোমার বেঁচে থাকতে হবে। তুমি যদি মরে যাও, আমার কী হবে?'

জনসি মৃদু হাসলো। চোখ বুজলো। প্রতিঘণ্টা অন্তর সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় এবং পাতাটিকে স্থির ওখানটায় দেখতে পায়। মনে হচ্ছিল লতাটিকে আঁকড়ে ধরে আছে পাতাটি।

সন্ধ্যায় আরেক দফা ঝড় হয়ে গেলো কিন্তু পাতাটি ঝরে পড়ে নি। পাতাটির দিকে তাকিয়ে জনসি দীর্ঘ সময় শুয়ে থাকলো। তারপর সে সুকে ডাকলো।

'আমি মেয়ে ভালো নই। এতো ভালোবেসে তুমি আমার যত্ন-আত্তি করছো অথচ আমি তোমাকে কোনো সাহায্যই করছি না। আমি নিরাশ এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়ে আছি। শেষ পাতাটি আমাকে দেখিয়েছে আমি কতোটা খারাপ। আমি উপলব্ধি করছি যে, মরতে চাওয়াটা পাপ।'

সু জনসিকে ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরলো। সে তাকে প্রচুর গরম সুপ এবং একটা আয়না দিলো। জনসি তার চুল আঁচড়ালো এবং চারদিক আলো করে হাসলো। 

বিকেলে ডাক্তার এলো। তার রোগীর পরীক্ষা শেষে সে সুকে বললো, 'জনসির এখন বাঁচার সাধ জেগেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে শিগগিরই সেরে ওঠবে। আমাকে অবশ্যই নিচতলায় বেরম্যানকে দেখতে যেতে হবে। সেও নিউমোনিয়ায় ভুগছে। কিন্তু আমি দুঃখিত, তার কোনো আশা নেই।'

পরদিন সকালে সু এলো। জনসির বিছানায় বসলো। জনসির হাত নিজের হাতে নিয়ে সে বললো, 

'তোমাকে আমার কিছু বলার আছে। আজ সকালে বেরম্যান নিউমোনিয়ায় মারা গেছেন। দুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। দারোয়ান প্রথম দিন তাকে বিছানায় দেখেছিল। তার জাম-জুতো ভেজা ছিল এবং সে কাঁপছিল। ঐ ঝড়োরাতে সে বাইরে ছিল। 
তারপর, তারা দেখলো তার বিছানার পাশে একটা মই (সিঁড়ি) পড়ে আছে। আর পড়ে আছে তখনো জ্বলছিল এমন একটা লণ্ঠন। মই ঘেঁষে মেঝেতে পড়ে আছে সবুজ আর হলুদ তরল রং এবং একটা তুলি।

'প্রিয় জনসি' সু বললো, জানালার বাইরে তাকাও। আইভি পাতাটার দিকে তাকাও। তুমি কি বিস্মিত হচ্ছো না দেখে, জোরে বাতাস বইছে, অথচ পাতাটা নড়ছে না। এটি-ই বেরম্যানের জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। সেরা অর্জন।

যে রাতে শেষ পাতাটি ঝরে পড়েছিল ওই রাতে সে এটি এঁকেছিল।


[ দ্য গিফট অব দ্য মেজাই-খ্যাত বিশ্ববিশ্রুত মার্কিন গল্পকার ও. হেনরি। নানান দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত সারল্যের মূর্তপ্রতীক উইলিয়াম সিডনি পোর্টার নামের এই মানুষটি ৩০,৬৬৪ নম্বর কয়েদি হিসেবে চার বছর ধরে জেলে আছেন। জেল-হাসপাতালের ডিসপেনসারিতে কাজ করছেন। মাথায় চেপে আছে গল্প লেখার ভূত। জেলের কয়েদি তো আর নিজের নামে লিখতে পারে না। তাই সে ও. হেনরি নাম নিয়েছে। ১৯১০ সালের ৫ জানুয়ারি হাসপাতালে সিডনি পোর্টারের মৃত্যু হলো। হাসপাতালে ভর্তি হবার জন্য যে সামান্য কটা টাকার দরকার তাও কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী চাঁদা তুলে দিয়েছিল। ঢাকা Residential মডেল  কলেজে দ্য গিফট অব দ্য মেজাই গল্পটি পড়াতাম। গল্পটির শুরুর দিকের একটা বাক্যকে প্রবাদপ্রতিম মনে হতো—
'Life is made up of sobs, sniffles and smiles, with sniffles predominating.' The Heart of O. Henry গ্রন্থে Dale Kramer সিডনি সম্বন্ধে অনেক ভ্রান্ত ধারণা অপনোদন করে প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছেন।]

• চট্টগ্রাম

menu
menu