মুনতাজ জ্বলে, জ্বলে মুনতাজ...

গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ। বাতাস আর রোদে মিলে মেতে উঠেছে চমৎকার এক ঢেউ খেলানো খেলায়। ধূ-ধূ করছে কাণীবাওড়ের মাঠ। পানি চলাচলের সরু ড্রেন। সোজা চলে গেছে ধানক্ষেত, মশুরিক্ষেত হয়ে গমক্ষেত। আরেকটু এগোলে সামনে স্যালো মেশিন। ফুরফুরে বাতাসে মনের সুখে দোল খাচ্ছে গমক্ষেতের পাতা। আড়াল থেকে হঠাৎ দুটি কিশোর মুখ বাড়িয়ে বলে ওঠে—

— মুনতাজ জ্বলে..., জ্বলে মুনতাজ...           

 গমক্ষেতের আড়ালে বসে হাগছিল মুনতাজ। কোনো রকম দাঁড়িয়ে পাল্টা জবাব দেয় সেও।

— খানকীর ছেলেরা, তোদের মা’র জ্বলে, বুনির জ্বলে, তোদের চোদ্দ গুষ্টির জ্বলে...

হাসতে হাসতে দৌড়ে পালায় কিশোর’রা। আবারও হাগ্তে বসে সে। গনগনে দুপুরে কাণীবাওড়ে বইছে সুনসান বাতাস। রোদে চিক্মিক্ করছে বাওড়ের পানি। পাশেই কোল ঘেষে মস্ত বড় শিশু গাছটা একলাই রাজত্ব করছে মাথা উঁচিয়ে। মগডালে এক ঘুঘু ডেকেই চলেছে বিরতিহীন। শিকারের খোঁজে অপেক্ষমান এক মাছরাঙা চিকন বাঁশের মাথায় বসে পুচ্ছ দোলাচ্ছে। গমক্ষেতের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় অদ্ভুত সুরে আওয়াজ করে চলে যায় একদল বক। বাতাসে প্রতিধ্বনি হয়ে মুনতাজের কানে ফিরে ফিরে আসে সেই আওয়াজ। হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে সে-

— ওরে শালার বক, তুরাও আমার জ্বলে বল্লি...।

হাতের বদনাটা আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারে মুনতাজ। শোঁ শোঁ করে উপরে উঠে ঘুরতে ঘুরতে আবার মাটিতেই ফিরে আসে বদনাটা। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় পূর্ব পাড়ার আলতাফ। কিরে মুনতাজ ভাই, বক’রাও কি তোকে জ্বলে বলচে..? বলেই ফিক্ করে হেসে ফেলে সে।

তেড়ে আসে মুনতাজ। মা-বাপ তুলে গালাগালি করে আলতাফকে। তার কথা না শুনেও শোনার ভান করে আলতাফ নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়।

২.

সুপ্রিয় পাঠক, আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি। তা প্রায় ৩০ দিন হলো বাড়ি ছেড়েছে মুনতাজ। এই ৩০ দিন সে বদনা হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাণীবাওড়ের আশে পাশে। আপনাদের জানানো দরকার যে, মুনতাজের বর্তমান অবস্থার জন্য সে কিন্তু একা দায়ী নয়। সেই ঘটনা বলার আগে অল্প কথায় বলে রাখি, মুনতাজের পুরো নাম মমতাজ বিশ্বাস। বাড়ি যশোর জেলার শার্শা উপজেলার অন্তর্গত স্বরূপদহ গ্রামে।

এবার চলুন মূল গল্পে প্রবেশ করি। মুনতাজ’রা সাত ভাই। গ্রামে তাদেরকে বলা হয় সাতভিয়ে গোষ্ঠী। অবশ্য ঢালী গোষ্ঠী নামে আরও এক গোষ্ঠী রয়েছে স্বরূপদহে। মুরুব্বিরা বলে, ঢাল-তলোয়ার নিয়ে মারামারি করার কারণেই নাকি তাদেরকে ভূষিত করা হয়েছিল এই পদবিতে। আরো লম্বা কাহিনি আছে এই বিষয়ে। সেটা এই গল্পে অপ্রয়োজনীয়। মুনতাজ’রা সাতভাই মিলেমিশে আছে তা প্রায় অনেক দিন হল। জমিজমাও তাদের অনেক। এক কথায় তারা গৃহস্থ চাষী পরিবার। পারিবারিক অবস্থা ভালো হওয়া সত্ত্বেও লেখাপড়ায় মুনতাজ ব’কলম। নিজেদের জমিতে চাষবাস করে দিনগুলো তার ভালোয় যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন পশ্চিম পাড়ার মসজিদের ইমাম মুনতাজকে ডেকে বলল-

— তুই তো জীবনে লিকাপড়া কিছুই শিক্লিনে মুনতাজ। তো এক কাজ কর। আল্লার কালাম কুরআন শরীফ পড়াডা একটু শিকে নে। নাইলি কিন্তুক বেহেস্তে  যাতি পারবিনে।

বেহেস্তে যাবার লোভেই হোক। আর খোদা-তায়ালার ভয়েই হোক। মুনতাজ একে একে আরবি, আমপারা এবং শেষ পর্যন্ত কোরআন শরীফ পড়াটা শিখে নেয়। তারপর থেকে সে সারাদিন মসজিদ-নামাজ, নামাজ-মসজিদ।

মুনতাজের বয়স ৫২। শেষ বয়সে মানুষের আবার বেশি ঝোঁক থাকে ধর্ম কর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার। তাছাড়া মুনতাজ কিছুটা ছন্নছাড়া গোছের। সংসারের প্রতি তার একটু খেয়াল কম। বাকি ছয় ভাইয়ের উপর সংসার ছেড়ে দিয়ে সে নিশ্চিন্তে পড়ে থাকে মসজিদে। গ্রামের লোকেরা বলে, ‘মুনতাজ একন্ আল্লা আলা লোক।’ যৌবনে তার বউটা ছিল খাসা। কাঁচা হলুদের মতো ছিল গায়ের রঙ। পুরো শাড়িতেও লুকিয়ে রাখা যেত না উঁচু বুক, নিতম্বের ভাজ ও মসৃণ তলপেট। ছেলেমেয়ের সংখ্যা পাঁচ। তাদের সবার নাম রাখা হয়েছে কোরআন হাদিসের আলোকে। এই মুহূর্তে সবার নাম মনে পড়ছে না। আর গল্পটা যেহেতু মুনতাজকে নিয়ে, সকলের নাম জানাটাও সেহেতু মনে করছি না খুব বেশি দরকারি। গল্পের মূল কাহিনি থেকে সরে আসার কারণে আমরা পুনরায় যথাস্থানে ফিরে যেতে চাই। মুনতাজ সারাদিন পড়ে থাকে মসজিদে। এই সুযোগে তার ভাইয়েরা আত্মসাৎ করে নেয় সব জমি। তারা এখন সোজা জানিয়ে দিচ্ছে স্বজ্ঞানে সব সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দিয়েছে মুনতাজ। সব দখল হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই মুনতাজের মাথায় আগুন ধরে যায়। সারা শরীর তেঁতে ওঠে। মজা দেখার জন্য বাড়িতে পূব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, সব পাড়ার মানুষ এসে গিজ্গিজ্ করছে। মুনতাজ মাথায় হাত দিয়ে পাছা লেপ্টে বসে আছে উঠোনের মাঝখানে। মাথার চুলগুলো খামচে খামচে তুলছে আর বলছে—

 — তুরা আমার কি কল্লি। আমার যে জ্বলে গ্যালো...

 ‘ আমার যে জ্বলে গ্যালো’ বাক্যটি ছড়া কাটার মত বলতে থাকে মুনতাজ। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল পশ্চিম পাড়ার আকবার আলীর ছেলে মুকুল। অনেকক্ষণ ধরে মুনতাজের এই বাক্যটি শুনে শুনে মুখস্ত করে ফেলে সে। আর বিপদটা ঘটে সেখানেই। মুকুলও বার বার বলতে থাকে-

— তুরা আমার কি কল্লি, আমার যে জ্বলে গ্যালো...

প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় মুনতাজ। ঠাস করে একটা চড় বসায় মুকুলের গালে। মুকুলের বাবা সঙ্গেই ছিল। ব্যাপারটা মীমাংসা হবার আগেই সে বলল-

—কিরে মুনতাজ ভাই, তোর কি জ্বলছে? তুই আমার ছেলের গালে চড় মারলি ক্যান্?

মুনতাজ আরও রেগে যায়। ব্যাস তারপর থেকেই তার নামের শেষে জ্বলে শব্দটার স্থায়ী বসবাস। একের পর এক গ্রামের সবাই বিদায় নেয়। সকাল গড়িয়ে দুপুর পার হয় হয় ভাব। দুপুরের খাবার মুনতাজের পেটে পড়েনি এখনো। হট্টগোলে মুখে তিক্ততা আসাতে সারাদিন কিছুই মুখে তুলতে পারেনি মুনতাজ। দিনের শেষ ভাগটা কেমন জানি ঘোরলাগা। বাড়ির সামনেই মসজিদ। মসজিদের সামনে পুকুর। পুকুর পাড়ে নারকেল গাছ। গাছের নিচে বসে আছে মুনতাজ। শোঁ শোঁ শব্দ করছে দক্ষিণের বাতাস। বিচলি গাদা থেকে কয়েকটা বিচলি পুকুরের ভেতর পড়ে ঘুরপাক খেতে খেতে হারিয়ে যায় পানির নিচে। ঘূর্ণয়মান এই দৃশ্য দেখে মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে ওঠে মুনতাজের। পুকুরের বাম দিকে একটি মাটির রাস্তা। রাস্তার ১০০ গজ সামনে প্রকা- এক গোগ্। সময়টা সন্ধ্যা। সবার ঘরে ফেরার সময়। বিশেষ করে প্রাণীকুলের। গোগ্ থেকে দল বেঁধে যার যার বাড়ি ফিরছে রাজহাঁস, পাতিহাঁস। আর জানেন-ই তো মানুষের মত দল বেঁধে চলতে পছন্দ করে অনেক প্রাণীই। তুমুল উত্তেজনায় হাঁসগুলো তাদের স্বভাবসুলভ প্যাঁক প্যাঁক শব্দ ওঠাতে ব্যস্ত। মুনতাজ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ঘূর্ণয়মান বিচলির দিকে। আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। পাঠকবৃন্দ আপনাদের ভেতর যাদের আঁড়িপাতার অভ্যাস আছে। তারা হলে নিশ্চয় মুনতাজের এই বিড়বিড়ের অর্থ উদ্ধার করে ছাড়তেন। হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে মুনতাজের দিকে। হঠাৎ একটা ইটের টুকরা নিয়ে মুনতাজ তাড়া করে হাঁসগুলোকে। ইট হাতে মুনতাজ ছুটছে আর হাঁসগুলো দৌড়ে পালাচ্ছে।

— এই মাদারচোদ হাঁস। দাঁড়া তোদের জ্বলে বলাচ্চি...

তাড়া খেয়ে হাঁসগুলো দ্বিগুণ উল্লাসে প্যাঁক প্যাঁক করে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। শব্দগুলো বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করে মুনতাজের বুকে শুলের মত বিঁধে। বেশ কিছুক্ষণ গালাগালির পর ক্ষান্ত হয় সে। সন্ধ্যার বাতাসে ধুলোগুলোতে ভ্যাপসা গন্ধ। মুনতাজ এই গন্ধে প্রায় মাতাল। বাড়িতে তার বউ হাঁস-মুরগি ঘরে তুলছে। তার ছোট ছেলে রসূলও গরু নিয়ে বাড়িতে ঢোকে এই সময়। মাটিতে খট্খট্ শব্দ হচ্ছে গরুর খুরের আঘাতে। হঠাৎ দলভেঙে লাল গরুটা হাম্বা হাম্বা করে দৌড়ে গিয়ে মুনতাজের পিঠের উপর বসিয়ে দেয় এক গুঁতা। ও মাগো! বলে মুনতাজ চিৎপটাং। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি বাবাকে মাটি থেকে টেনে তোলে রসূল।

৩.

কোমরটা বোধ হয় ভেঙে গেছে মুনতাজের। হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে বারান্দায় চিৎ হয়ে শুয়ে কাত্রাতে থাকে সে।

— ওই, কই গেলি রে রসূলের মা। চালডা ধর। এতো দেকচি ঘুরচে। পড়ে যাবেনে তো।

প্রলাপ বকতে বকতে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে যায় মুনতাজ। আর ঘুমাবেই বা না কেন? সারাদিন তো আর দেহের ওপর কম ধকল গেলো না। ঘুমের ভেতর মুনতাজ দেখে, লাল রঙের যে গরুটা তাকে গুঁতা মেরেছিল। গোয়াল ঘর থেকে সেই গরুটা বলছে—

— মুনতাজ জ্বলে, জ্বলে মুনতাজ...

লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে মুনতাজ।

— তবে রে শুমুন্দির বাচ্চা। আমাকে নাড়িস...

বারান্দার চাল থেকে পাঁচুনি নিয়ে এক দৌড়ে গোয়াল ঘরের দিকে ছুটে যায় সে। দমাদম্ বসিয়ে দেয় গরুটার পিঠের উপর কয়েক ঘা। গরুটা হাম্বা হাম্বা করে ছটফট করতে থাকে। হাম্বা শব্দটা জ্বলেতে রূপ নেয়। মুনতাজ পাঁচুনিটা দূরে ছুঁড়ে মারে। সেখানেও একটা শব্দ হয়—

—মুনতাজ জ্ব...লে

রাগে দুঃখে ছেলেকে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় মেরে ঘরে টুকেই খাটের উপর ধপাস্ করে শুয়ে পড়ে সে। রাত্রি দ্বিপ্রহর। চারদিকে ঝিঁ-ঝিঁ ও ঘুর্ঘুর পোকাদের সম্মিলিত সংগীত। ওদিকে জ্বলে শব্দটা মুনতাজের মগজে এমনভাবে ঢুকেছে যে পৃথিবীর সব শব্দই তার কাছে এখন মনে হচ্ছে একই। জ্বলে। চাপাক্রোধ বুকে নিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করে মুনতাজ। দুই চোখে তার রাজ্যের ভয়। একবার এপাশ আর একবার ওপাশ। ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে হাবুডুবু খায় সে। পাশেই তার বউ শুয়ে কানের কাছে শুধু ঘ্যানর-ঘ্যানর করে—

— তুমার কারণেই আজ সংসারের এই অবস্থা। সংসারের দিকে তুমার কোনো খ্যাল নেই। ফাঁক পেয়ে তুমার ভাইরা সব ভূঁইগুলো লিকে নিয়েচে।

মুনতাজ আর সহ্য করতে পারে না।

— এই মাগী চুপ কল্লি। নাইতো কিন্তুক পানিকোকে লাতি মেরে পেট ফাটিয়ে দিবানি।

বউও কম যায় না।

— খান্কির পেটের ছেলে। আমি বল্লি তুমার জ্বলে। ওদিকে যে পাড়ার নাঙেরা সব বলে বেড়াচ্চে। তাতে কিচু হচ্চে না।

— চুপ কল্লি খান্কি মাগি। আমার জ্বলে ক্যান্ তুই বুজিস্ না।

কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ধাম্ করে একটি লাথি মারে বউয়ের পানিকোকে।

ও মাগো! ও মাগো রে! আমার মেরে ফেল্লে রে.. বলেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে মুনতাজের বউ।

টিনের চালের আঁড়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মুনতাজ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাঁশের উপর কে যেন বসে আছে। মুনতাজকে লক্ষ্য করে সে যেন বলছে—

— কিরে মুনতাজ, তোর জ্বলে নাকি?

কিছু একটা বলতে গিয়েও মুনতাজের মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। সে গোঙাতে থাকে। সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে জব্জব্। মুনতাজ বুঝতে পারে তার ‘মুখচাপায়’ ধরেছে। চোখ দিয়ে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে বুকের মাঝ বরাবর। চোখের সামনে বৃত্ত আকারে নৃত্য করে লাল-নীল-বেগুনি রঙের আবরণ। নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে মুনতাজ জ্বলে, জ্বলে মুনতাজ পরিবেশিত হয়। প্রচ- ভয় পেয়ে বউকে ডাকে সে।

— কই, শুন্চো, এই ওটো।

কয়েকবার ধাক্কা দিয়েও কাজ না হওয়াতে চুপচাপ শুয়ে পড়ে মুনতাজ। ঘুমের মধ্যে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে সে। কাঠের পর কাঠ সারিসারি সাজানো। জ্বলন্ত একটা মশাল হাতে একজন দীর্ঘাদেহী লোক দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে স্তূপাকৃত কাঠের দিকে। চারদিক থেকে হরিবোল, হরিবোল ধ্বনিত হচ্ছে। জ্বলন্ত মশালটা কাঠের দিকে ছুঁড়ে মারে দীর্ঘাদেহী লোকটা। পট্ পট্ চটাচট্ আওয়াজ হয়। উপস্থিত সবাই জোরে জোরে বলতে থাকে—

— বলো হরি, হরিবোল...

সেদিকেই ছুটছে মুনতাজ। কাঠের স্তূপ জ্বলছে। বুকটা ধপ্ করে জ্বলে ওঠে তার। মসজিদ হতে আল্লাহ্ আকবর, আল্লাহ্ আকবর, মুরগীর খোপ থেকে কুক্ কুরু কুক্, গোয়াল হতে হাম্বা হাম্বা সবকিছু মিশে মুনতাজের মাথাটা দ্বিতীয় বারের মত ঘোরে। মোচড় দিয়ে ওঠে পেটের ভেতর। গড়গড় করে শব্দও হয়। লুঙ্গি খুলে বদনা নিয়ে দৌড় দেয় মুনতাজ। দৌড়াতে দৌড়াতে একেবারে কাণীবাওড়।

৪.

মুনতাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে আলতাফ। আকাশের দিকে তাকায় মুনতাজ। বেড়েই চলেছে সূর্যের ক্ষিপ্ততা। গায়ে কোনো কাপড় নেই তার। পুড়ে পুড়ে কালচে ও শক্ত হয়ে গেছে গা’টা। শরীরটা এমন লিকলিকে যে, বাতাসেও নড়ে ওঠে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে বদনা হাতে আবারও হাগ্তে বসে মুনতাজ। কাণীবাওড়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ঝিক্মিক্ ঝিক্মিক্ করছে বাওড়ের পানি। হু হু করে বইছে বাতাস। ঠিক এই মুহূর্তে মুনতাজকে দেখলে যে কেউ বলবে সে এই কাণীবাওড়ের পাহারাদার। বাওড়ের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্বটাও বোধহয় তার-ই। ওদিকে মুনতাজের গু কে ঘিরে সভা করছে মাছিরা। কে আগে ভোগ করবে এরকম এক প্রতিযোগিতা। ঠিক রাজনৈতিক নেতাদের মতো। মাছিদের ভন্ভন্ শব্দ মুনতাজের কানে জ্বলে হয়ে বাজে। জমি থেকে মুনতাজ একটা ঢেলা নিয়ে ছুঁড়ে মারে মাছিদের। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গু’র উপর পড়ে ঢেলাটা। চোখের পলকে ছানাবড়া অবস্থা। গু’র এই করুণ চেহারা হওয়াতে আরও দ্বিগুণ উৎসাহে উল্লাসে মেতে ওঠে মাছিরা। উপস্থিত মাছিদের উদ্দেশ্যে মুনতাজ যে বাক্য ব্যয় করে তা নিম্নরূপ—

— ওরে খান্কির ছেলে মাছিরা, চুপ র্ক। তোদের মা’র জ্বলে, তোদের বুনির জ্বলে...

মাছির চেয়ে বেশি ভন্ভন্ শব্দ প্রাণিকূলে আর কেউ করতে পারে কী না সন্দেহ। মুনতাজের ঝাঁড়ি শুনে কয়েকটা মাছি তার কানের পাশ দিয়ে বো বো করে উড়ে যায়। আস্তে আস্তে মেজাজ ঠান্ডা হয় তার। উঁচু একটা ঢিবি দেখে তার ওপর শুক্না পাছাটা রেখে আরাম করে বসে মুনতাজ। গুড়া কৃমির অত্যাচারে অস্থির সে এখন। বারকয়েক পাছাটা মাটিতে ঘষতে ঘষতে গরম করে ফেলে মুনতাজ। কিছুক্ষণ পরে এক মৃদুমন্দ বাতাস পাছায় লাগতেই আরামবোধ হয় তার।

৫.        

— খবর আচে?

— আচে

— কেইচা খবর?

— মোরগ

— ডানে দেকি

— মোরগ

— বামে দেকি

— মোরগ

— মদ্দি দেকি

— মোরগ

— ভোট দিবেন কন্খানে

— মোরগ মার্কার মাঝখানে

মিছিলটা দ্রুত মুনতাজের পাশ কেটে চলে যায়। মিছিলের মধ্য থেকে একটু পেছনে এসে কয়েকজন ছেলে চিৎকার করে বলে—

— কিরে মুনতাজ, ভোট দিবি কন্খানে?

মুনতাজ দাঁত কড়মড় করে উত্তর দেয়—

— খান্কির ছেলেরা, তোদের মা’র গাড়ির মাজ্খানে।

খিল্খিল্ করে হাসতে হাসতে আবার দৌড়ে গিয়ে মিছিলে যোগ দেয় ছেলেগুলো।

— এবার ভোটে জিতবে কে?

— মোরগ ছাড়া আবার কে?

মেম্বারি ভোটের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছে স্বরূপদহে। ওদিকে জর্জ বুশের পাছার ভেতর বাঁশ ঢুকিয়ে হাতে হারিকেন ধরিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে শার্শা বাজারে থানার মোড়ে। পাশে হাস্যোজ্জ্বল সাদ্দাম হোসেন। সবকিছু মিলে আবহাওয়াটাও বেশ গরম। সেই সাথে জোট বেঁধেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। রোদের প্রখরতা বেড়েই চলেছে দিনদিন। হচ্ছে না বৃষ্টি। মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। হা-হুতাশ করছে চাষিরা। কাদাখেইড় করবে বলে বাড়িতে বাড়িতে চাল উঠাচ্ছে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। সোনামুখী বিলের কাছে জল ভিক্ষা চাইছে কেউ কেউ। সোনামুখীও অসহায়। তার বুকেও জল তৃষ্ণা। শুকিয়ে রোগা হয়ে গেছে সোনামুখীর সোনামুখ। গ্রামের বধূরা সায়ের ধরেছে-

আয় বৃষ্টি ঝেপে/ ধান দেবো মেপে।

তাদের এই প্রার্থনা সংগীতের বলে আকাশের বুক চিরে বৃষ্টি নামে না। অথচ কী আশ্চর্য মুনছুরের ছেলে তাজবুলের মাথা ভিজে যায়। মাথা বেয়ে পানিটা যখন গড়িয়ে মুখ ও জিহ্বা স্পর্শ করে তখন জিহ্বার নুনতা নুনতা স্বাদ পায় তাজবুল। বুঝতে পারে ব্যাপারটা অন্যরকম। রেগেমেগে গালাগালি শুরু করে সে।

— কন্ খানকির পেটের ছেলে রে, আমার মাথার উপর মুতে দিলো।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শিশু গাছটার ডালের দিকে তাকাতেই মুনতাজকে দেখতে পায় তাজবুল। দেখেই আবারও গালাগালি শুরু করে-

— ওরে খান্কির ছেলে মুনতাজ। তোরে আজকে আমি খাইছি। জ্বলে মুনতাজ, জ্বলে...

হাতের বদনাটা ছুঁড়ে মারে মুনতাজ। শোঁ করে তাজবুলের কানের পাশ দিয়ে মাটিতে পড়ে বদনাটা। মুনতাজ হুড়মুড় করে নেমে পড়ে নিচে। ততক্ষণে তাজবুল পগার পার। শুকনো মাটিতে বদনাটা পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়। বদনাটা ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে মুনতাজ। চোখের পানি চিবুক বেয়ে লোমশ বুক ভিজিয়ে দেয় তার। ওদিকে গ্রামের যুবক ছেলেদের আজ কাদাখেইড়ের দিন। খলসেমারির বিল থেকে পানি তুলে, মাটি কেটে, কাদার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা কাদার উপর নাচানাচি করছে আর গাইছে—

— আল্লা মেক্ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই। আল্লা মেক্ দে...

সত্যি সত্যিই শুরু হয় বর্ষা। অঝোর ধারায় ঝরছে তে ঝরছেই। থামবার কোনো নামগন্ধ নেই। আবারও মোচড় দিয়ে ওঠে মুনতাজের পেটের ভেতর। প্রয়োজনীয় কাজটি নিমেষে সেরে ফেলে সে। গু’গুলো মিশে যায় কাণীবাওড়ের পানির মধে। বদনাটাও উধাও। কোনো কিছুর খেল্ বুঝতে না পেরে হঠাৎ এক খামচা গু মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় মুনতাজ। ফুলে ফেপে ওঠে পেটটা। কয়েকবার বমিও হয়। কাণীবাওড়ের পানির সঙ্গে মিশে গিয়ে মুনতাজের বড় সাধ হয় সাঁতার কাটতে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের মাঝে সে ঝপাৎ করে লাফ দেয় কাণীবাওড়ের বুকের উপর। পাতিহাঁস যেমন করে গুগ্লি খোঁজে, ঠিক তেমন করে মুনতাজ হারিয়ে যাওয়া বদনাটা খোঁজে। বৃষ্টির ঝুপঝুপ শব্দ রূপান্তর হয় তা-ধিন্-তা, তা-ধিন্-তা। এ যেন কোনো এক ঢোলক ঢুলি বাজানোর রিহার্সেল করছে। মুনতাজ সেই তালে তালে একবার ডুব দিচ্ছে আবার উঠছে। বর্ষাবরণ উৎসব চলছে কাণীবাওড়ের বুকে আজ। উৎসবের মধ্যমণি মুনতাজ। বৃষ্টিরা মাতম করে তাকে নিয়ে। গান গায়। ঢুলি বাজায়। এভাবে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। আজ রাতের শরীর অন্যরকম। বরফ মাখা চাঁদ গলিয়ে দিচ্ছে নিজেকে। জ্যোৎস্না তার বার্তা বাহক। মরণঘাতী জ্যোৎস্না ভর করেছে মুনতাজের উপর। জ্যোৎস্নার দখলে পুরো কাণীবাওড়। আর তাদের তদারকির দায়িত্ব চাঁদের। কাণীবাওড়ের ভরাট বুক ফক্ফক্ করছে চাঁদের আলোয়। মাঝখানে মুনতাজ ডুবছে আর ভাসছে। ভাসছে আর ডুবছে। অসম্ভব রকমে পেট ফুলে যায় মুনতাজের। তার গু খাওয়ার কথাটি চাঁদের কাছে পৌঁছে দেয় জ্যোৎস্না। চাঁদ মুচকি হাসে। চাঁদ জেনে যায় মুনতাজের জলকেলি খেলার খবর। গ্রামের মানুষ জানে না। অথবা গ্রামের মানুষ জেনে যায়, চাঁদ জানে না। কিংবা তারা সবাই জানে কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।

অলংকরণ ঋণ : রাজিব

menu
menu