অন্তর্দাহ
এরপর আর উঠার একটুও চেষ্টা করেনি। সেই থেকে ডেস্কেই বসে আছে। একগাদা কাজ তাকে নেকড়ের পালের মতো তাড়া দিতে থাকে। ওগুলো সারতে হবে আজই। এমন কাজের তাড়া সব সময়ই থাকে। তাই মোটেই পাত্তা দিলো না সে। বরং অপলক চোখ মেলে চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। গভীর মনযোগ। একটুও রা নেই। দেখতে দেখতে তার নিজেকে মনে হলো একজন ঝানু স্থপতি যে আগুন শিকার বা আধুনিক ইমারত বিদ্যার সব কায়দা কৌশল জানে। জানে কি করে সব ঠিকঠাক মতো সামলে নেয়া যায়। এমনকি জানে, কি করে আকাশের কোলে নির্ভার মাথা পাততে হয়।
মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে তার ইচ্ছে হলো যুতসই কিছু সেলফি তোলার। রাবু হক হয়তো একমনে কাজ করে যাচ্ছে। ওর কালো সতেজ চোখজোড়া পিসির স্ক্রিনে ব্যস্ত। ওর কি একটুও ওঠার সময় নেই, দু’মিনিটের জন্যে এসেই চলে যাক, কি এমন ক্ষতি হবে! লালপাড় ঘিয়ে এন্ডিকটন শাড়িতে লাল টিপে সেজেছে সে। রাবুর ছোট্ট রোদেলা মুখের হাসিটা আর মিলায় না। সে মনে মনে ভাবে, রাবু হকের তুলতুলে মুখটা পাশে থাকলে সেলফিটা বেশ জাঁকালো হতো। সাথে না হয় ইমন, মারুফ, আরও দু’চার জনও থাকতো! কিন্তু বাসায় নজরে পড়লেই গায়ে জ্বালা ধরবে শিউলির। ওই লালটিপ ছাড়া আর কোনদিকে চোখ যাবে না। শিউলির মুখটা অন্ধকার হয়ে যাবে। বিচ্ছিরি ভাবে কাটাকাটা দৃষ্টিতে তাকাতে থাকবে তার দিকে। অফিসে কলিগদের সাথে ছবি থাকা কি খুব অস্বাভাবিক, একটা ছবিই তো! কিন্তু শিউলি একটুও বুঝতে চাইবে না।
কোথায় রাবু হককে পাবে সে! ডেস্কগুলো তো খালি পড়ে আছে। পুরো ফ্লোরটা এলোমেলো, ছড়ানো ছিটানো। তবে অন্য চিন্তা করা যাক। যেহেতু সবাই সটকে পড়ছে তাই সেলফিটা হবে স্রেফ নিজেকে নিয়ে। তার সমর্পিত চেহারা, পরিত্যক্ত অফিসঘর আর ঝড়ো মেঘপুঞ্জের মতো ক্রমাগত ধেয়ে আসা কালচে ধোঁয়া। মোবাইলটা সামনে উঁচিয়ে দু’তিনটি ক্লিক দিয়ে সে ইমেজগুলো দেখলো এবং ভীষণ অবাক হলো। যাকে বলে আর্টিস্টিক, আর্ট গ্যালারিতে টানানো মডার্ন ব্লাক এন্ড হোয়াইট ছবির মতো। ফোনের পুঁতি ক্যামেরাটিও এমনভাবে ধোঁয়াকে কব্জা করেছে যে, ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো কাল্পনিক এক পৃথিবীর কথা। ব্লাক এন্ড হোয়াইট। সাগরের আধো-অন্ধকার গহীনে এক ক্লান্ত ডুবুরি থমকে আছে বিস্ফারিত চোখে। সাদাকালোয় আবছায়া এক উদ্ভট ডুবুরি।
এখন শান্ত শাদা মেঘের মতো শূন্যে ভেসে যাচ্ছে তার নানা কৌতূহল। হাত-পা ছড়িয়ে আছে সে। আর কোনো জাগতিক উন্মাদনা তাকে বিচলিত করতে পারবে না। একটু আগেও নিজেকে ভীষণ করিৎকর্মা মনে হয়েছে তাকে। আর কোনো তাড়া নেই। মনে হয় বসে থাকাটাই কাজ। স্থির, কঠিন কোনো সংকল্প নিয়ে স্ফিংসের মতো বসে থাকা। সাথে কিছু ভাবনা তো আছেই। জগতজীবনের কোনো ঠুনকো বিষয়, যা যা এই মুহূর্তের জন্যে ঠিক প্রয়োজনীয় না। ঠিক কি কি নিয়ে ভাবছে সে তা নিজেও জানে না। শুধু জানে তাকে বসে থাকতে হবে কিছু চিন্তা নিয়ে।
কিছুটা সময় কেটে যায়। এমনি করে এফ আর টাওয়ারের এই আকাশছোঁয়া ২১ তলা উচ্চতায় আলসেমিতে কয়েকটি মুহূর্ত কেটে গেলে সে অনুভব করলো অবরুদ্ধ নিঃশ্বাসে তন্দ্রা এসে ভিড় করছে অথবা তার ঘুম পাচ্ছে। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। ঠায় হাজির থাকা ভাবনাগুলো একের পর এক জড়ো হচ্ছে, ফুরফুরি তুলছে, হিজিবিজি এঁকে জটলা করছে মাথায়। এগুলো ঝেঁটিয়ে বিদায় করারও শক্তি তার নেই।
উইক এন্ড ডে বলে কি এমন অলসতা পেয়ে বসেছে তাকে! চৈত্রের এমন অলস দুপুরগুলো কখনো কখনো নিদ্রায় ঢলে পড়া রাত হয়ে যায়! শরীরের শিরাগুলো আলগা হতে থাকে, মনে হয় রক্ত চলাচলহীন। যেমন এখন নিরীহ ফড়িংয়ের মতো এই ভবনের আগালে বসে আছে। একটুও নড়াচড়া নেই। এমনকি জানে বিছানায় শিউলির গা ঘেঁষা নরম আলতো স্পর্শও তাকে এখন কামমত্ত করতে পারবে না। শিউলি বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে শোবে। মহাবিরক্ত হলে কাল সারাদিনেও মুখ খুলতে চাইবে না।
এখনো একেবারে নিথর হয়ে যায় নি। এর মধ্যেও নিঃশব্দে সবকিছু অনুসরণ করছে সে, শুধু ফাইল নাড়াচাড়া ছাড়া। হয়তো অফিসের কাউকে কোনো নির্দেশও দিয়ে যাচ্ছে আনমনে। অফিসটা টেনে টেনে চলছে। সবাই গা ঢিলা দিয়েছে। কোম্পানি লসে পড়তে থাকলে এমন হয়। পরিস্থিতি আরও দ্রুত খারাপ হতে থাকে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় কয়েকবার এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে সে। সে এখন অনুভব করছে, অফিসটাকে যে করেই হোক চাঙ্গা করতে হবে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এখন কেউ আর তাকে পরোয়া করছে না। এমনকি ছোটখাটো টি-বয় ছেলেটিও। করুণ একটা হাসিতে তার দগ্ধপ্রায় ঠোঁটদুটি আরও ফুলে উঠলো। ডেস্কে কনুই ঠেকিয়ে বাম হাতের দুটি আধাসেদ্ধ মেরুন রঙের আঙুলে নাকের ছিদ্রদুটি হালকা চেপে ধরেছে। নিজের নাক নিয়ে নতুন করে ভাবতে থাকে লোকটি। দুটি নাকেই সামান্য একটু ফাঁক, দুটি বাঁকানো সুড়ঙ্গ যা দিয়ে প্রাণটা সজীব রাখা যায়। কি উপযুক্ত ব্যবস্থা! আর একটু হাসি। সুখ নিংড়ে নেয়া এক নিষ্ঠুর হাসি তার ঠোঁট উপচে পড়তে চায়।
ধোঁয়া না ঘন কুয়াশার কুণ্ডলি--বুঝতে পারে না লোকটি? যেটাই হোক সে বুঝতে পারে ধোঁয়াটা আশপাশকে পেঁচিয়ে ধরেছে। মনে হয় শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলবে বহুতল দালানটাকে। ধোঁয়াটা ক্রমেই ভয়ানক হয়ে উঠছে। ঘন ও কালো। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের ফ্ল্যাটেও। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাস ভারি হয়ে উঠছে আর শ্বাস টানতেই ভেতরে খাঁক করে দিচ্ছে সব। রুমজুড়ে ঘাতক বাতাস। উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। দেখতে দেখতে কালো ভ্যাম্পায়ার ধোঁয়াই এখন পরিণত হয়েছে বর্ণহীন আগুনে। কালো ভ্যাম্পায়রেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সবখানে। তাদের তীর্যক কমলা চোখ পুড়িয়ে খাঁক করে দিচ্ছে সব। মানুষ পোড়ার গন্ধটা এখন ক্রমেই তীব্র। জঘন্য গন্ধটা নাকে ঢুকতেই পেটের ভেতরের সব বেরিয়ে আসতে চায়। মোচড় দিয়ে বমি করলো সে।
চারিদিক গগনবিদারী হৈ চৈ ছোটাছুটি আর্তনাদ। কে কি বলছে কিছু বুঝতে পারছে না লোকটি। কেউই কারও কথা বুঝতে পারছে না। মনে হয় কথাগুলো বলতে হয় বলে ওরা চিৎকার করে বলে যাচ্ছে। চিৎকার করতে করতে উল্কাপিণ্ডের মতো নিম্নমুখী হচ্ছে দলবদ্ধ মানুষ। ফ্লোরে সিঁড়িতে তাদের পায়ের খসখসে আওয়াজ ক্রমেই জোরালো। নানারকম শব্দ আর ধোঁয়ায় দালানটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সবাই ভবনটি থেকে বেরিয়ে পড়তে চায়। হুড়মুড় করে বোরোচ্ছে সবাই। বেরোতে গিয়ে ওরা হয়তো সরষেদানার মতো ছিটকে পড়ছে এদিক সেদিক। সিঁড়িতে বা নিচে থেতলে যাচ্ছে ওদের পোড়া শরীর। নয়তো নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে পতঙ্গের মতো। এমন কিছু একটা ঘটে চলছে যা সবার আয়ত্বের বাইরে। অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত।
চারপাশকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে সে। কিভাবে আগুন এলো, কয় তলায়? নাকি পুরো দালানেই? এখানে তো সব কালচে ধোঁয়া। আকাশছোঁয়া ফ্লাটে হুইলচেয়ারে বসে বসে সে সবকিছু ঠাহর করবে কিভাবে? তবে কোথাও আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। হয়তো আগুনটা ধোঁয়ার পিছু পিছু এদিকেই আসছে। গরম ধোঁয়ায় ক্রমে ঝলসে যাচ্ছে শরীর। কাছে কূলে কোথাও হয়তো আগুন লেগেছে, তা থেকেই এই ধাবমান কুণ্ডলি এসে ঘিরে ফেলেছে তাকে এবং পলায়নপর অফিসার ও কর্মচারীবৃন্দকে। সবাই তীরবিদ্ধ হরিণের মতো ছুটে পালিয়েছে। সে পালাবে কোথায়! শুধু বসে বসে উপলব্ধি করা যে, সে ক্রমশ অচল পয়সার মতো মূল্যহীন হয়ে পড়ছে যেখানে তার কোনো হাত নেই। আর এখন তাকে কোনো পরোয়াও করছে না কেউ।
তার খুব হাসি পায়, এই অফিসের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়, পদমর্যাদা সবকিছুই স্রেফ তামাশায় পরিণত হয়েছে। ফুটপাতে বসে থাকা পঙ্গু ভিক্ষুকের চাইতেও সে এখন বড় দুর্ভাগা। রাস্তাসুদ্ধু লোকেরা তো আর তাকে অবহেলা করে না, আবেগ বিগলিত হয়ে বাড়িয়ে দেয় দু’চার টাকা। এক নজরে দেখে নেয় তার অসহায় দশা। দয়া পরবশ হয়ে এটা ওটা বলে। এমন কিছু সম্বল যা নিয়েই পঙ্গু ভিক্ষুকেরা জীবনকে প্রতিদিনকার মতো চালিয়ে নেয়। কিন্তু তার সাথে অতটুকু সৌজন্য দেখানোর প্রয়োজন মনে করছে নো কেউ। কেউ এগিয়ে আসছে না। বরং সে যেন মহাপাতক, যুদ্ধবন্দী শত্রু। কেউ কেউ তাকে এক নজর দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। নিঃশ্বাসে ঘৃণা ছড়িয়ে সটকে পড়ছে কেউ কেউ। কারো কারো এটুকু করারও সময় নেই। বেশিরভাগের দৃষ্টিই অন্যকিছুতে ব্যতিব্যস্ত। এটা দেখে সে খানিকটা খুশি হয় যে, ঘৃণার তীরগুলো এখন তাকে বিদ্ধ না করে অন্যদিকে ছুটছে।
তাহলে তার আর কি করার থাকে? বরং সে দিনযাপনের অন্যপকেট হাতড়াতে থাকলো। তার মনে পড়ে জীবনের কথা। তার গ্রামের স্মৃতি ও শৈশব কৈশোরের মাটির সোদা গন্ধ। ভরো ভরো শীতল সোদা গন্ধ দহলে বা বিলে। খালপাড়ে বা ঈদগা মাঠে। বোয়ালিয়া গ্রাম তার সামনে আবছা ভেসে ওঠে। অনেকদিন থেকে যাওয়া হয় না সেখানে। সক্কালবেলা উঠেই মা ভাতের হাঁড়ি চাপিয়েছে চুলায়। বর্ষার ভেজা ভেজা দিন। প্রায় সারারাত অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরেছে। বাইরের চালায় ডাঁই করে রাখা খড়িগুলো ভিজে গেছে। মা’র চুলা থেকে ঘন ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে উড়ছে। মা ধোঁয়ার সাথে যুদ্ধ করছে, ক্ষণে ক্ষণে ফুঁ দিচ্ছে, কাঠি দিয়ে ভেতরে নাড়ছে। কুণ্ডলি আর থামছে না। মায়ের অপেক্ষার সময় নেই। বাবার মোকাম আর তাদের ইশকুল, মা’কে হাড়ি নামাতেই হবে। ফুঁ দিতে দিতে মা’র চোখ জবাফুলের মতো লাল হয়ে ফুটে। মা’র চোখে কান্নাও ফুটে উঠেছে, আঠালো কান্না। আঠালো বলে তা ঝরে পড়ছে না। চোখের কোনায় মলমের মতো লেগে আছে। মা প্রতিদিনকার মতো আগুন শিকার করছে।
এ ধোঁয়াকে সে কব্জা করতে পারছে কই? অফিসটা এখন জনশূন্য, ভূতুড়ে। সবাই পালালো কিন্তু এরজন্যে আজ তার দরকার হলো সীমাহীন অপেক্ষা। সে তো ওদের মতোই ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকতে পারতো, সাথে আরও দু’একজনকেও সাথে নিতে পারতো। কিন্তু উনিশ বছর আগের মতিঝিলের দুর্ঘটনা তাকে অচল পঙ্গু বানিয়েছে। এখন ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে মানুষের দঙ্গলে পিষে মরার ইচ্ছে তার নেই। বরং চেয়ারেই বসে রইলো। বসে বসে আজই সত্যি সত্যি উপলব্ধি করা গেলো মতিঝিলে তাকে আগেই হত্যা করা হয়েছিলো। দু’পেয়ে মানুষের এক পা নিয়ে নিলে হত্যা করা না তো কি সেটা! এটা সে কিভাবে এতোদিন অস্বীকার করে আসছিলো?
‘আগুন আগুন! বাঁচাও বাঁচাও!’ চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে ওরা সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়াচ্ছে। আছাড় খেয়ে পড়ছে পিছলে মেঝেতে। দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। ওরা বিকট চিৎকার করা শুরু করেছে। বেরিয়ে যাবার জন্যে মল্লযুদ্ধ শুরু করেছে। মুহূর্তেই কেমন করে ব্যস্ত কর্মস্থলটি ভয়ানক ও নিষিদ্ধ হয়ে পড়লো। প্রতিদিনকার চেনা জায়গাটিই অসময়ে ছেড়ে যাবার জন্যে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। দেখতে দেখতে আগুন শব্দটি আগুনের শিখার মতোই আছড়ে পড়ছে দেয়ালে। ওদের বাকি কথা কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। কেউ বুঝতে পারছে বলেও মনে হয় না। কারণ ওগুলোকে আর কথার আবর্জনা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। তবে ওরা এখন ওসব নিয়ে কেয়ার করছে না। আক্রান্ত ইঁদুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে সিঁড়িতে, অচল লিফটে বা যে যেখানে পারে। কেউ কেউ তৈলাক্ত বাঁশের মতো সিঁড়ি মাড়াচ্ছে। দশতলা উঠে তিনতলা নামছে। ফের তিনতলা মাড়িয়ে সাততলা নামছে। যেটাই করুক, কোনোদিকে তাকানোর সুযোগ ওদের নেই। ছাদে উঠবে বা নিচে নামবে। নিচে নামবে বা উপরে উঠবে। পাঁচতলা মাড়াবে, দু’তলা নামবে। তাড়া খাওয়া ছুঁচোর মতো একই পথে ঘুরেফিরে আসবে, ফের পালাবে। তার হাসি পেলো যে, এমন অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে ওরা নিচে নামবে কিভাবে? এই আকাশছোঁয়া দালান থেকে নিচে নামা কি যা তা কথা! কে কবে নেমেছে এভাবে! তবে ওদের ভঙ্গি দেখে মনে হয়, এটা ওদের কাছে তেমন ব্যাপার না। ওরা কিছুই গ্রাহ্য করছে না। আগে কি করেছে বা করেনি সে কথা নিয়ে এখন ভাবছে না কেউ। ওরা এখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যা কখনও ওরা করেনি এবার তাই করবে। অন্তত নিজেদের সুবিধার খাতিরে যা যা করতে হয় আর কি!
স্রেফ নির্বাক দর্শকের মতো এইসব দৃশ্যের খানিকটা দেখছে, শুনছে তারও বেশি। একজন সমর্পিত মানুষের সুবিধা যে, কোনো উদ্বিগ্নতাই তাকে আর কব্জা করতে পারে না। সে হয় পুরোপুরি ভারমুক্ত। মধ্যাকর্ষণও বুঝি তাকে নিয়ে টানাটানি করতে চায় না। তার এখন কোনো উদ্বিগ্নতা নেই। বরং সে এখন স্মিত হেসে সকল কিছুকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। যেমন করে দৈব, গুজব বা ঐ জাতীয় কিছু বলে নগরপিতা বা মন্ত্রীমহোদয়গণ হরহামেশা পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেন। কাঁধ নেড়ে নেড়ে বাতাসে ঢেউ তুলেন। বাকপটুতার তোড়ে সবকিছুকে নিজের মতো করে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ান। এতে সুবিধা যে, এরপর আর কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। নিজের সাথে পরিষ্কার বোঝাপড়া করে ফেলে সে। কিসের জন্যে সে খামোকা ওসব অর্থহীন কর্ম করতে যাবে?
ওরা এখন উদ্ধারকারীর নাগালে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। ওরা দিকবিদিক ভুলে গেছে। আছাড় খেয়ে ফের উঠে দাঁড়াচ্ছে। কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো জটলা করছে। কোনকাজটি ঠিক হবে কেউ জানে না। ওরা একজন আর একজনকে ডিঙ্গিয়ে পালাতে চাইছে। রেসের ঘোড়ার মতো নাক উঁচু করে ছুটছে। জীবন বাঁচানোর চেষ্টার মতো পড়িমরি চেষ্টা আর কি আছে!
দেখতে দেখতে ফ্লোরটা খালি হয়ে গেলো। এখন সেই শুধু একাকী। টাইটানিকের বেহালা বাদক দলের মতো তার যেন কোনো তাড়া বা বিকার নেই। ডেস্কে বসে বসে সে কি প্রমাণ করার চেষ্ট করছে যে, সে কত অফিস অন্তপ্রাণ! কিছুই টলাতে পারে না তাকে কর্তব্য থেকে! গত বাইশ বছর থেকে তো সে এই বিপণন কোম্পনির কাজ করে যাচ্ছে। পা হারিয়ে আরও প্রতিমুহূর্তে নিষ্ঠাবান, নিজের হীনমন্যতাকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা। পা হারানোর পর থেকে তার প্রতিমুহূর্তের চিন্তা ছিলো কেউ যেন তাকে অবজ্ঞা করতে না পারে। তাই সবসময় সে সেটাই করেছে। সহকর্মীদের প্রতি কি সে বন্ধুভাবাপন্ন ছিলো না? ইমন, মারুফকে কি মাঝেমধ্যে টাকা হাওলাত দিয়ে সহযোগিতা করিনি? টি বয়টির কি চাকরি বাঁচায়নি। শাহীনের অপারেশনের সময় কি ওর কাজগুলো করে দেয়নি। কিন্তু এই অফিসের একটি লোকও তার দিকে তাকানোর কথা ভাবলো না! একটি অক্ষম লোক, হায় খোদা!
সে তো চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘুরেফিরে দেখতে পাচ্ছে না। তার জানার কথা না যে, নিচে ইতিমধ্যে হাজার হাজার উৎসুক মানুষ এসে ভিড় করেছে। কামাল আতাতুর্ক রোড ছাড়িয়ে গেছে সে জনস্রোত। তারা সবাই আকাশছোঁয়া দালানটির দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইলে ছবি বা লাইভ নিচ্ছে। নানামুখী চিৎকার, জটলা যার সবটাই প্রায় অর্থহীন শব্দজট। মানুষের ভিড় থামাতে ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। লোকজনের প্রচণ্ড দঙ্গল এখন আর এক সমস্যা। উদ্ধারকর্মীদের যাতায়াতের পথও ওরা দখল করে নিয়েছে। অথচ লোকজনকে রক্ষা করবে কিভাবে তার হুঁশ কারও নেই। হাজারবার বলেও জটলা সরানো যায় না, ফের জটলার ঢেউ ওঠে।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী পেঁচিয়ে ধরছে বনানীর গলি আকাশটাকে। টুকরো টুকরো হয়ে কাঁচ বা অন্যকিছু ছিটকে পড়ছে নিচে। দেখছে সবাই কেমন আটকে পড়া ইঁদুরের মতো ঘুলঘুলি দিয়ে হাত-মাথা বের করে দিচ্ছে। চেঁচাচ্ছে প্রাণপণে। কেউ কেউ ভেঙে ফেলেছে দেয়ালের পুরু কাচ। সেখানে দিয়ে নিচে তাকাচ্ছে। হাত নেড়ে নেড়ে উদ্ধার কর্মীদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। এরই মধ্যে দু’একজনে ইকারুসের মতো লাফ দিয়েও বসলো। কেউ আটকে গেলো বিদ্যুতের তারে, কেউ মারা পড়লো রাস্তায়।
দাউ দাউ আগুন বেড়েই চলছে। ধোঁয়া গ্রাস করছে পুরো টাওয়ারটিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ফায়ার সার্ভিসের মই ১৪ তলা পর্যন্ত হাত বাড়ালো। এর উপরে উঠার ক্ষমতা তাদের নেই। তার চেয়ে উঁচু মই পাবে কোথায়! তাই এখান থেকেই যতটুকু কাভার করা যায়। একনাগাড়ে পানি ছিটাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের লোকগুলো। পানির তোড়ে কাচ ভেঙে নিচে পড়ছে। তার উপরটা অধরাই থেকে গেলো, ওখানে যাবে কিভাবে, আর লম্বা মই নেই। হেলিকপ্টাগুলো টহল দিয়েই খালাস। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা জান বাজি রেখেছে।
দেখতে দেখতে ফ্ল্যাটের ভিতরটায় অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো। কামাল আতাতুর্ক রোডের আকাশের রঙও বদলাতে থাকে। চারপাশে কালো ধুঁয়ার ঢেউ। দূর প্রান্ত থেকে বিমানের কেমন বিকট আওয়াজ ভেসে আসছে। বিমান আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে নিচের পৃথিবীতে। তখন মাত্র বিকাল সোয়া ৫ টা। অন্যান্য দিন এমন সময় অফিস ফিরতি মানুষ ও যানবাহনে উপচে থাকে রোডটি। আজও মানুষ কিন্তু অন্যরকম এক জন অরণ্য। বনানীই এখন বাংলাদেশের সেন্টারপয়েন্ট।
শেষবারের মতো শিউলির নম্বরটি কোনোমতে বের করলেও কেটে দিলো। এ নিয়ে ছয় সাতবার সান্ত্বনা দিয়েছে পাগলপ্রায় বউটাকে। টাওয়ারের নিচে এসে হয়তো ছোটাছুটি করছে। একে ওকে বলে সাহায্য পাওয়ার জন্য মাথা আছড়াচ্ছে। কিন্তু শিউলি কি জানে তাদের দু’জনের মধ্যে দূরত্বটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বাড়ছে। শিউলি আর কখনও ছুঁতে পাবে না তাকে।
ধোঁয়ার প্রচণ্ড তাপে শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে! টারমিনেটরের মতো হাত বাঁকিয়ে ছোটভাইকে কল দিলো লোকটি। টেনে টেনে ক’টি বাক্য--যা তার রেখে যাওয়া পরিবারের প্রতি কর্তব্য-কর্ম বিষয়ক শেষ বাণী। বলতে বলতেই ঢলে পড়লো।