অনিন্দিতা আর চন্দনবৃক্ষের গল্প
বাঙালি ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের এমন সমন্বয় আমি আর কোথাও দেখিনি। আলোকসম্পাত, দেয়ালচিত্র, বসবার চেয়ার-টেবিল, আহার পরিবেশনার তৈজসপত্র--সবকিছুতেই আবহমান বাঙলার ছোঁয়া বিদ্যমান। এসব আমি খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখতে থাকি। বসে বসে দেখছি আর ভাবছি, বাঙালি পারে না কে বলে ? ভাবতে ভাবতে এই বাঙালি ভদ্রলোকের প্রতি আমার মনে সমীহভাব জেগে উঠে এই ভেবে যে, তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি আমার সংস্কৃতি আর দেশকে পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত করিয়েছেন, আমার দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।
আমার ভাবনার মাঝেই সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ নাকে সুড়সুড়ি দেয় এবং পরিষ্কার বাংলায় কারো কণ্ঠস্বরও শুনতে পাই।
শুভ অপরাহ্ন।
তাকিয়ে দেখি এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক আমার টেবিলের পাশে স্মিত দাঁড়িয়ে আমার উত্তরের অপেক্ষা করছেন। হাতের রেকাবিতে হালকা সবুজ পানীয়, ধারণা করি, গ্লাসে পুদিনা মিশ্রিত লেবুজলই হবে। এমন পানীয় আমার খুবই পছন্দের।
শুভ অপরাহ্ণ।
আমিও বাংলায় উত্তর দিই। ভদ্রলোক হাতের রেকাবি নামিয়ে রাখেন। আমার রুচির সঙ্গে ব্যাপারটা কাকতালীয় বিবেচনা করে বিষয়টা মুলতবি রেখে আমি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চোখে পুরো চশমা, গোঁফে পাক ধরেছে। স্বাস্থ্য বেশ ভালো। কত হবে বয়স ? আন্দাজ করি, পঞ্চাশ পেরিয়েছে।
কেমন আছেন ?
যেন কতদিনের চেনা, অনেক বছর পর তার সাথে আমার তারই রেস্টুরেন্টে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু তাকে আমার মনে পড়ছে না। তবু আমি সৌজন্য রক্ষা করি।
ভালো। আপনি ?
বাংলাদেশ থেকে এসেছেন নিশ্চয় ?
জ্বি।
আমার মনে হয় ভদ্রলোক হয়তো আমাকে চিনতে পেরেছেন। তবে আগে কখনো দেখা হয়েছে আমি মনে করতে পারি না। এমনও হতে পারে বহুকাল আগে দেখা হয়েছিল এমন কারো মুখের আদল আমার সঙ্গে ঘুলিয়ে ফেলছেন। বাংলাদেশের কতজনই তো হয়তো এখানে আহার করতে আসেন। তার সৌজন্য অথবা আন্তরিকতায় কখন কোথায় আগে আমাদের দেখা হয়েছিল, আদৌ দেখা হয়েছিল কি না এসব বিষয় গৌণ করি। বিদেশে-বিভূঁয়ে মান-বাংলায় কথা তো দূরের কথা বাংলা শোনার প্রত্যাশা করাও যেখানে অযৌক্তিক সেখানে এমন চমৎকার একজন বাঙালির সাহচর্য উপভোগ্য হবে সেটা আমার মতো বাঙালি ভালো করেই উপলব্ধি করেন।
আমাকে মাফ করবেন, আমি ওদিকটা একটু সামলে এসে আপনার সঙ্গে কথা বলছি। একটু ধৈর্যধারণ করে অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।
ঠিক আছে। আমার কোনো তাড়া নেই। আর তেমন খিদেও পায় নি।
আপনার তাড়া নেই জেনে খুশি হলাম। আর ব্যস্ততার অজুহাত কে না দেখায় বলুন? সে যাক, আরো কথা হবে, আপনি বসুন দয়া করে।
আমি আহার করতে আগত লোকজনকে দেখতে থাকি। সিংগাপুর যে কসমোপলিটান নগর সেটা রেস্তোরাঁয় খেতে আসা মানুষ দেখেই আন্দাজ করা যায়। এশিয়া আর ইউরোপকে সহজেই আলাদা করা যায়। এমন কি মঙ্গোলীয় গোত্রের চীনা-জাপানিও আলাদা করা যায়। আর ইন্দোচীনের জাতিসত্তাও পৃথক করা তো তেমন কঠিন নয়। তবে ইউরোপীয়দের দিকে তাকিয়ে সহসা তাদের দেশ আর জাতীয়তা বুঝবার উপায় নেই। কৃষ্ণকায় জনগোষ্ঠীকে আলাদা করা গেলেও কে আমেরিকান আর কে এখনো আফ্রিকায় বসবাস করে সেটা যেমন বোঝা যায় না, তেমনি এতসব জাতের মানুষ কে কোন দেশ থেকে এসেছে, কে কোন দেশের নাগরিক জানা-বোঝার সাধ্য অন্তত আমার মতো বুদ্ধুর একেবারেই নেই। আমি তবু কান পেতে তাদের কথা শুনবার চেষ্টা করি, ভাষা বুঝবার চেষ্টা করি, যদি কিছু আন্দাজ করতে পারি। কারো ভাষা না হয় বাদই দিলাম, একটা শব্দ বা ধ্বনিও বুঝতে পারি না। এমন অর্থহীন দুর্বোধ্য ঠেকে আমার কাছে। অথচ কোনো কোনো যুগলের মুখের অভিব্যক্তি আমাকে এতটাই বিমোহিত করে যে আমার মনে হয় কথা বলে ওরা স্বর্গীয় আনন্দ পাচ্ছে। আমি তাদের কথা শুনতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষার কথা ভাবি। কী অমোঘ চেতনাই না ধারণ করেছিল আমার পূর্বপুরুষগণ! মায়ের ভাষার মান রক্ষার জন্য প্রাণ দেবার ঝুঁকি নেবার প্রেরণা তারা কী করে পেয়েছিল? যে প্রজন্ম ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল তারাই যে আবার স্বাধিকারের জন্যও রক্ত দিতে পারে--প্রমাণ করে গেছে। কিন্তু তারপর? স্বাধীনতা অর্জনের চারদশকেও আরেকটা প্রজন্ম দেশগড়ার চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারল কই? একই সময়ে পরাধীনতার শেকলমুক্ত হয়ে সিংগাপুর-কোরিয়া পেরেছে, মালয়েশিয়া-ভিয়েতনাম পারছে তবু আমরা পারছি না। কেন?
ভদ্রলোক আবার ফিরে এসেছেন। তিনি এখন আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসেছেন। আমি বুঝতে পারি, তিনি এবার গল্প করার মন নিয়ে বসেছেন। কিন্তু তার সঙ্গে কী গল্প করব আমি? আমি কি তাকে বলব, আমার--মানে আপনি যে দেশ রেখে এসেছেন, নাকি ত্যাগ করে এসেছেন, অথবা বাধ্য হয়ে এসেছেন--সেটা আর এখন বাসযোগ্য নয়। তিনি তো তখন বলবেন, নিজের দেশকে খাটো করে দেখার অভ্যাস বাঙালি এখনো তাহলে ছাড়তে পারেনি। দেশকে খাটো করলে যে নিজেকেই ছোট করা হয় সেকথা কি আপনার মতো শিক্ষিত ভদ্রলোকও চল্লিশ বছর একটা রক্তরঞ্জিত স্বাধীন দেশে বাস করেও বুঝতে পারে না ? যদি তাই হয়, দেশে পাকিস্তানের দোসরদের সুপরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সুদূরপ্রসারি মতলব যদি এতদিনেও অনুধাবন করে দেশটাকে বাসযোগ্য করে তুলতে না পারেন, যদি আর স্বাধীন দেশ চালাবার জন্য এই সিংগাপুর কিংবা কোরিয়ার মতো নেতৃত্ব গড়তে না পারলেন তাহলে আপনার সঙ্গে গল্প করে আর কী হবে? আমি দেশ ছেড়ে এসেছিলাম, যখন দেশটাকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো। যখন অনাহারে আমার চোখের সামনে আমার স্বজন মরতে লাগল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও আমাকে একটা কাজ দিতে পারল না, রাগে ক্ষোভে আমি যখন বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম, আর তাতেও যখন মুক্তির বদলে আমার নামে হুলিয়া জারি হলো তখন আমার আর কী করবার ছিল বলুন? আমি না হয় বাধ্য হয়ে চলে এসেছিলাম, কিন্তু আপনারা যারা স্বাধীনতার ছায়াতলে উত্তরাধিকারসূত্রে স্থান পেয়ে গিয়েছিলেন তারা কী করলেন? বাদ দেন, ওসব পেছনের কথা। কেন? কেন আপনারা পারছেন না?
একটা মালয়েশিয়ান ছেলে নানারকম বাদাম আর অঙ্কুরিতবিচির সঙ্গে পুদিনাসহযোগে পরিবেশনকৃত সালাদ নিয়ে এসে টেবিলে রাখে। আমি দুটো বাটিতে তুলে একটা তার দিকে এগিয়ে দিই। তিনি আরো একটু টেনে কাছে নেন যেন।
কী ভাবছেন?
আমি উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোকের মুখের দিক তাকাই। আমি এতক্ষণ তার হয়ে আমার কথা ভেবেছি!
আমি নিশ্চিত আপনি কিছু ভাবছিলেন। তখন থেকে, আমার বসার স্থান থেকেই লক্ষ্য করছি, যদিও এদিকে দৃষ্টি দেয়া আমার পক্ষে কঠিন, দেখতেই পারছেন, কী ভীড় সামলে আমাকে কাজ করতে হয়, কত তাড়াহুড়ো করে আমাকে অর্থের লেনদেন সারতে হয়। বাঙালি বলেই হয়তো পারছি। আর কোনো জাতির কেউ হলে এমন বিচক্ষণতার সঙ্গে এমন একটা রেস্টুরেন্ট চালাতে পারবে বলে আমি মনে করি না। বাঙালি যেখানেই যায়, দেখবেন সফল হয়। বাঙালি বিফল হয়েছে এমন নজির কদাচ দেখতে পাবেন। কি ঠিক বলি নি?
আমি চুপ করে থাকি। আর আব্দুল মাজিদ মৃদু মৃদু হাসেন। তিনি আবার শুরু করেন।
বুঝতে পারছি, আপনি স্বল্পভাষী মানুষ। হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে ভালোবাসেন। এরকম মানুষ আমার খুব পছন্দের। কিন্তু আপনি অবশ্য মানবেন, বাণিজ্যের এ যুগে ভাবুক আর স্বল্পভাষী হলে চলে না। কথায় চিড়া ভেজে না বলে শুনেছিলাম, এ যুগে একথা সত্য নয়। এখন কথা দিয়ে চিড়া ভেজাতে হয়, চিড়া ভেজানো যায়। যারাই উন্নতি করতে পেরেছে, সফল হয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখুন তাদের সকলেই বিনা পয়সায় বলা যায়, কথার পুঁজিতেই আসলে ব্যবসা করে যাচ্ছে। আপনি দেখবেন, কেবল ব্যবসা নয়, সবখানেই কথা বলতে পারলেই সাফল্য আসে। কথা দিয়ে নেতা সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট করেন, কথা দিয়ে লেখক পাঠকের প্রিয় লেখক হয়ে উঠেন। বুদ্ধিবৃত্তি বলবেন তো? তাও কথাতেই প্রকাশ পায়, লিখিত হলেও সেটা ভাষাতেই প্রকাশ করতে হয়।
ভদ্রলোক যে একনাগাড়ে অনেক কথা বলতে পারেন, সেটা আমিও এতক্ষণে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। তবে যা বলেন তাতে সারবেত্তা আছে সেটাও অনুধাবন করতে পেরেছি। তিনি একজন সফল মানুষ তার কথায় এবং রেস্টুরেন্টের চেহারা থেকে সেটাও যে কেউ বুঝতে পারবে। আর ভদ্রলোকের জানাশোনার পরিধিও ব্যাপক। কোন প্রসঙ্গে কীভাবে আমি শুরু করব আমি সেটা ভেবে পাচ্ছি না। তখন একটা সহজ সূত্র খুঁজতে গিয়ে তার প্রবাসী জীবনের প্রসঙ্গটাই সুবিধাজনক মনে করলাম। তিনি আমার সম্পর্কে কিছু না বলায় নিশ্চিত হলাম তার সঙ্গে আগে দেখা হয়নি।
আমি হাসান, আরিফ হাসান। আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভালো লাগছে।
আমি মাজিদ, আব্দুল মাজিদ।
ধন্যবাদ।
কী পান করবেন? গরম না ঠাণ্ডা? চাইলে চা হতেও পারে।
চা হলে তো কথাই নেই।
জনাব মাজিদ ইশারায় একটা ছেলেকে ডাকলেন। মালয় ভাষায় সম্ভবত চা-এর কথা বললেন। ছেলেটি মালয় আন্দাক করি। তখন আমার চোখ বাঙালি ছেলে আছে কি না খুঁজতে থাকে। চোখ পুরোটা রেস্টুরেন্ট ঘুরে তার চেখের ওপর স্থির হয়। তিনি মৃদু হাসছেন।
আপনি বাঙালি খুঁজছেন তো?
আমি কোনো কারণে হতাশ হয়েছি সেটা তিনি ধরে ফেলেছেন। তার বিচক্ষণতায় অভিভূত। কিন্তু তার কাছে আমার বৌদ্ধিক দীনতা প্রকাশ পেয়ে যাক সেটা আমি চাই না। আমি আগের সিদ্ধান্তে অটল আছি।
আমার আন্দাজ আপনার প্রবাসজীবন সার্থক। কী বলেন আপনি?
আব্দুল মাজিদ মৃদু হাসলেন। তার হাসিতেও বুঝি সমৃদ্ধ আর সুখী প্রবাসজীবনের ছায়া দেখতে পাই। আমার তাতে আরো বেশি করে তার পরিবার, স্ত্রী আর সন্তান সম্পর্কে জানতে আগ্রহ জাগে।
একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, যদি আপনার আপত্তি না থাকে। আমার পরিবার, স্ত্রী আর সন্তান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী?
আপনার প্রত্তুৎপন্নিমত্ততায় আমি মুগ্ধ। আমি দুঃখিত। একান্তই আপনার ব্যক্তিগত অভিরুচি।
ভদ্রলোক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, দয়া করে আপনি আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলে আমি আহ্লাদিত হবো। সেটা আজ সন্ধ্যায় হতে পারে। আজ সন্ধ্যায় আমার বিশেষ কাজ নেই। এখনি সরবরাহের হিসেব গুটিয়ে আমি একটা বই, সেপিয়েন্স কিনতে যাব। আর বইটা নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে যাবো। বিকেলটা বই পড়ে কাটিয়ে আপনি এলে সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে ঠাণ্ডা বা গরম কিছু পান করতে করতে গল্প করে কাটানো যাবে। অথবা কালও হতে পারে, যদি আপনার ব্যস্ত সময়ের খানিকটা আমাকে দেন। তাতে অবশ্য আমার একটা নির্ধারিত সভা বাতিল করতে হবে। তাতে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। সেটা পরেও করা যাবে। আপনি আসছেন তো?
আপনাকে ধন্যবাদ। আমি সানন্দে রাজি। আজই আসতে পারি। আপনার ঠিকানাটা আমাকে একটা কাগজে লিখে দিন দয়া করে।
আমার গাড়ি আপনাকে হোটেল থেকে তুলে নেবে।
আমি আমার হোটেলের ঠিকানাটা জনাব আব্দুল মাজিদকে দিয়ে এবং তার ফ্ল্যাটের ঠিকানা সম্বলিত কাগজটা হাতে নিয়ে এ বেলার মতো আলাপের পাট চুকিয়ে করমর্দন করে বেরিয়ে পড়ি।
বাইরে এসে আমার মনে হয় এমনটা না করলেও কি হতো না? ভদ্রলোক কী ভাববেন আমাকে? তিনি কি মনে করবেন, বাঙালি বলেই কারো সম্পর্কে আমার এমন অযাচিত আগ্রহ? বাঙালিই কেবল তাদের মতো অন্যকে বিব্রত করতে পারে। কারো ব্যক্তিগত জীবন যাপনের বিষয়ে নাক গলাতে পারে। এমন কি তার স্ত্রী পুত্র-কন্যার বিষয়ে জানতে আগ্রহ দেখাতে পারে। তারা জানে না, অধিকাংশ নারীপুরুষ বিবাহিত জীবনের কথা ভাবেও না। তারা খবরও রখে না, উন্নত নগর রাষ্ট্রের ক’জন নাগরিক দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে আর বিয়ে করলেও খুব কমই টিকে থাকে। কিন্তু আমার ধারণা হয়, জনাব আব্দুল মাজিদ সেরকম কিছু হয়তো ভাববেন না। তিনি নিখাদ বাঙালির জীবন যে সিংগাপুরের মতো আধুনিক নগরেও যাপন করছেন সেটা দেখানোর বাঙালিসুলভ অহমিকা থেকেই আমাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন।
আমি ভাবতে থাকি ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটে কী নিয়ে যাওয়া যায়। আমার মনে পড়ে তিনি বই পড়তে পছন্দ করেন। পরিবারের কর্তাব্যক্তির পাঠভ্যাসের প্রভাব অন্য সদস্যদেরও ওপর পড়তে পারে। বিশেষ করে তার সস্তানদের ওপর। আমি জানি না, তার স্ত্রীর পেশা কী, আর সন্তানদের বয়স কত। সন্তান ছেলে না মেয়ে সেটাও জানি না। আমি অন্ধকারে ঢিল না ছুঁড়বার বদলে পিতার সংস্কৃতিবোধের পরিচিতির গণ্ডি থেকেই ওরা কী পছন্দ করবে সেটা আন্দাজ করতে হবে ভাবি। আমিও একটা বুকসপে ঢুকে পড়ি। সেখানে ঢুকে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বই খুঁজতে গিয়ে যা যা আবিষ্কার করি এগুলোর সবই নেতিবাচক প্রপাগাণ্ডা বলে আমরা জানি। শেষ পর্যন্ত মধুসূদন দত্তর আশার ছলনে ভুলি আর মুরাকামির দুটো সাম্প্রতিক উপন্যাস এবং একতোড়া ফুল কিনে নিয়ে হোটেলে ফিরে আসি।
ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে গেছে। অভ্যর্থনায় গেলেই আমাকে জানানো হয়, একজন গাড়ি পাঠিয়েছেন। ড্রাইভার আমার অপেক্ষায় আছে। আমাকে নিয়ে যেতে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে।
আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই নামছি।
ঠিক আছে। আমি ড্রাইভারকে সে কথা জানাচ্ছি।
গাড়িটা দামি আর আরামদায়ক। ড্রাইভারও সপ্রতিভ। সে আমার জন্য দরোজা খুলে দিল, আমি উঠে বসলে দরোজা লাগিয়ে নিজের সিটে বসে বেল্ট বেঁধে নিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি উঠে বসলেও গাড়ি স্টার্ট নিতে দেরি করছে। আমি ওর দিকে তাকালে ইশারায় দেখাল সে আমাকেও সিটবেল্ট বাঁধতে হবে। আমি এদেশের আইন অথবা নিয়ম জানতাম না বলেই যে ভুল করেছি সেটা সে সহজভাবেই নিল। আমি তাকে ধন্যবাদ দিলে সে শুকরান বললে আমি সেটা বুঝতেও পারলাম।
বিস্তৃত এলাকাজুড়ে আকাশচুম্বি ভবনসব দাঁড়িয়ে আছে। একটা আবাসিক এলাকায় গাড়ি প্রবেশ করল। সব ভবন একই রকম। প্রত্যেক ভবনের পাশে সবুজ চত্বর আর চারপাশে অচেনা গাছের সারি। শিশুদের খেলার জন্য নানা রকম শিশুতোষ আয়োজন। সবুজের পাশ ঘিরে পায়ে চলার পথ। আমার নিজের দেশের কথা ভেবে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। গাড়ি আমাকে নিয়ে ভবনে প্রবেশ করে তার পর লিফটের সামনে নামিয়ে দিয়ে গ্যারেজে চলে যায়। লিফটে আমি ৫১ তলায় নামি আর তখন আমাকে স্বাগত জানান স্বয়ং জনাব আব্দুল মাজিদ।
কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
বুঝতে না বুঝতেই তো এসে পড়লাম। অথচ বাংলাদেশে এটুকু পথ আসতে দু’ঘণ্টাও লাগতে পারত।
ওখানে যানজট মানুষকে ভোগায় খুব, তাই না?
হ্যাঁ। রাস্তায় চলার কোনো উপায়ই নেই।
আমরা ফ্ল্যাটে গিয়ে প্রবেশ করি। জনাব আব্দুল মাজিদ আমাকে রেখে ভেতরে চলে যান। বসার ঘরটা দেখেও আমার চোখ জুড়িয়ে যায়। কত রকম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যে রয়েছে। কী করে এতসব জোগাড় করলেন সেটা ভেবেও আমার বিস্ময় জাগে। লাতিন আমেরিকার মায়া সভ্যতা আর প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার নিদর্শন তো আছেই, এমন কি বাংলার হুঁকো আর মাছ ধরার বরশিও আছে। আমি ভাবি, এসব তো বাংলাদেশ থেকে কবে হারিয়ে গেছে, এমন কি জাদুঘরেও নেই।
জনাব আব্দুল মাজিদ রেকাবিতে দুটো মগ নিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করেন।
আসুন, চা পান করতে করতে কথা বলি।
চা হাতে নিয়ে আমি মনে মনে তার পরিবারের সদস্যদের আগমন প্রত্যাশা করি। সময় বয়ে যায়। আমার প্রত্যাশিত ব্যক্তিদের কেউ আসে না। চা প্রায় শেষ হয়ে আসে। তখন ভাবি, তারা কেউ বাসায় নেই। হয়তো আব্দুল মাজিদ তাদের প্রতীক্ষায় আছেন। আমার কুণ্ঠাবোধ হতে থাকে; এখন আমি আর তার পরিবার পরিজন সম্পর্কে আগ্রহ দেখাতে পারি না। বরং তার ব্যবসা নিয়ে কথা বলা সুবিধাজনক মনে করি। আমার ধারণা তিনি বাঙালিদের মধ্যে ব্যতিক্রম বলেই এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন। তিনি কি বাঙালি যুবকদের সহযোগিতা করেন?
আচ্ছা, বাঙালি ছেলেদের বুঝি আপনি কাজে নেন না?
আছে। আমাদের কারখানায় বেশ ক’জন বাঙালি কাজ করে। এই রেস্টুরেন্টের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ওদের অবদান কম নয়।
তারা কী কাজ করে ?
তারা নানা রকম খাবার বানায়। সেগুলো শহরের সবখানে সরবরাহ যায়।
কীভাবে?
খাবারের ভ্যান আছে। অনলাইনে প্রাপ্ত চাহিদার সরবরাহও ভ্যানেই মেটানো হয়। আর আব্দুল রেসিপি’স নামে শতাধিক কেন্দ্র আছে সেগুলোতে প্যাকেট লাঞ্চ বিক্রি হয়।
যে রেস্টুরেন্টে আমি গিয়েছিলাম এর নাম তো--অনিন্দিতা। একটুকরো বাংলাদেশ। বোধকরি, আপনার স্ত্রীর নামে নাম?
হ্যাঁ। আব্দুল মাজিদ কৌতুকছলে হাসেন, শুভ্র চন্দনচূর্ণ আমার স্ত্রীর খুব প্রিয় প্রসাধনী।
আর তখন একজন অবাঙালি নারী ঘরে প্রবেশ করেন। মধ্য বয়স হবে বোধ করি। কিন্তু পরিষ্কার বাংলায় ধর্মীয় রীতিতে আমাকে সম্ভাষণ জানান।
আস্সালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
কেমন আছেন ?
আমি ভালো। আপনি ভালো তো?
বেশ ভালো আছি। আব্দুল আপনার আসবার কথা আমাকে বলেছিল। কিন্তু আমি দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না, আমি বাসায় ফিরতে একটু দেরি করে ফেলেছি।
না না। সে কি আমি আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি।
খুব ভালো করেছেন। আপনি তো খুব ভালো বাংলা বলেন।
মাজিদ আমাকে শিখিয়েছে। কিন্তু আফসোস, আমি ওকে ফিলিপিনো শেখাতে পারি নি।
ফিলিপিনো শেখা কি খুব কঠিন?
আমার তো মনে হয়, বাংলার চাইতেও সোজা। শেখার ইচ্ছা থাকলে যে কোনো ভাষাই শেখা যায়।
আপনার সন্তানরা কোথায়? ওরা বাসায় নেই?
একটা আছে। আরেকটা বাইরে। আমি ফোন করে ওকে আসতে বলেছি। আপনি আসবেন সে জানে। তাই আজ সন্ধ্যায় আসবে।
আপনি বাংলাদেশে যান মাঝে মধ্যে?
দু’বার গিয়েছি। একবার বিয়ের আগে। আব্দুলের মাকে দেখতে। তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন। আরেকবার বড় ছেলেটা জন্ম নেবার পর। ওকে ওর দাদা দেখতে চেয়েছিলেন। ততদিনে আব্দুলের মা আর বেঁচে নেই। তারপর আর যাওয়া হয়নি।
আর যান নি কেন ?
আমাকে ব্যবসা দেখতে হতো। ভীষণ ব্যস্ততা ছিল।
আপনার কথা শুনতে চাই। বলবেন কি কিছু ?
কী বলব ?
এই যেমন, কীভাবে মাজিদ সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ?
তখন আমি ছোটো একটা রেস্টুরেন্ট চালাতাম। নিম্ন আয়ের মানুষ সেখানে খেতে আসত। যুবক আব্দুল আমার রেস্টুরেন্টে প্রায়ই খেতে আসত। আমি খেয়াল করতাম, একজন যুবকের জন্য যে পরিমাণ খাবার প্রয়োজন তার চাইতে সে অনেক কম খায়। ওকে জিজ্ঞেস না করেও আমি বুঝতে পারছিলাম, ওর অর্থকষ্ট যাচ্ছে। হয়তো ওর কাজ দরকার। রেস্টুরেন্টে কাজ করবে কি না জিজ্ঞেস করলে কী কাজ করতে হবে সেটা না জিজ্ঞেস করেই রাজি হয়ে যায়। আমি ওকে রেস্টুরেন্টের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কোনো কাজেই ওর অনীহা ছিল না। ওর মধ্যে এমন কিছু দেখতে পেলাম যা অন্যকোনো যুবকের মধ্যে আগে আমি পাইনি। ওকে দেখেই আমার ধারণা হয়েছিল, বাঙালি যুবকেরা অন্য যে কোনো জাতির তুলনায় নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। আমি আরো বেশি ওর প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে থাকি। দু’বছর পর ওকে আমি ব্যবসার অংশীদার হতে প্রস্তাব দিই। সে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ওকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়ে আমি বুঝতে পারি, সে আমার তুলনায় আরো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আর সুন্দর ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে পারে। ওর পরিকল্পনায় ব্যবসার উন্নতি ঘটত থাকে আর আমাদের সম্পর্কের বন্ধনও দৃঢ় হতে থাকে। একদিন আমি আব্দুলকে প্রপোজ করি। সে রাজি হলে আমরা ওর মায়ের আর্শীবাদ নিতে প্রথমবার বাংলাদেশে যাই। বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে আমরা বিয়ে করে ফেলি। আমাদের দুটি সন্তান। বড় ছেলেটির বয়স কুড়ি। আর ছোটটি সতের।
অভিনন্দন, ম্যাম। বাঙালি সম্পর্কে আপনার অটুট থাকুক। আর আপনাদের ভালোবাসার বন্ধন অক্ষয় হোক।
আপনাকে ধন্যবাদ। আসুন, একটু আপ্যায়নের ব্যবস্থা আছে। দয়া করে টেবিলে আসুন। খেতে খেতে আরো কথা বলা যাবে।
আমরা খাবার টেবিলে গিয়ে বসি। তখন একটি ছেলে এসে আমার পাশে বসে। মায়ের মুখের সঙ্গে ছেলেটির মুখ মিলে যায়। তবে গায়ের রং পেয়েছে বাবার। ওর মা ওকে ফিলিপিনো ভাষায় কিছু একটা বলেন। ছেলেটি তবু নীরব থাকে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ বোধ করি।
আমি ইংরেজিতে বলি, হে বালক, তুমি কেমন আছো? তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই।
ধন্যবাদ। আমি ভালো আছি। আমি সুদ্বীপ্ত। আপনি ভালো?
তোমাকেও ধন্যবাদ। তুমি কি তোমার দাদুর বাড়ি যাবে?
দাদুর বাড়ি! সেটা কোথায় ?
কেন? বাংলাদেশে।
সেটা কোথায় ?
দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারতের প্রতিবেশী দেশ।
আমি ভারতে বেড়াতে যেতে আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই তো জানি না।
তুমি ভারত সম্পর্কে জানো ?
হ্যাঁ, আমার একজন টিচার ভারতীয়। তিনি বলেছেন তার দেশটা অনেক সুন্দর।
তোমার বাবার দেশটাও অনেক সুন্দর। যেদিকে তাকাবে কেবল সবুজ আর সবুজ। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের উপকূলেই অবস্থিত। যাবে, তুমি দেখতে?
হয়তো যাবো, তবে এখন নয়। আরো কয়েক বছর পর।
এখন নয় কেন, কয়েক বছর পর কেন?
আমি এখন সতের পার করছি। স্কুলও শেষ করেছি। আঠারো হতে মাত্র এক বছর বাকি। তখন আমি আমার ইচ্ছা মতো একা একা ঘুরতে পারব, সব কিছু করতে পারব।
আচ্ছা। আঠারো হয়ে গেলে আর কী কী করতে চাও তুমি?
আমি আঠারো হয়ে গেলে একটা সিঙ্গেল এপার্টমেন্টে উঠতে চাই। একা থাকতে চাই। সেখানে আমার বন্ধুরা আসবে। তাদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে জীবন কাটাতে চাই।
তুমি তোমার মা বাবার সঙ্গে থাকতে চাও না?
সাবালক হয়ে গেলে আমি কেন মা বাবার সঙ্গে থাকব! কেউ তো এমনটা করে না।
দুঃখিত। আমি তোমাদের এখানকার রীতিনীতি জানতাম না। তুমি মনে কিছু করোনি তো?
ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি। অন্য দেশের রীতিনীতি না জানাই স্বাভাবিক। আমি কি তোমার দেশের প্রথা জানি? জানি না তো। প্রত্যেকেরই উচিত অন্য জাতির লোকাচারের প্রতি সম্মান দেখানো, তাই না?
নিশ্চয়ই। তা তুমি যে আলাদা থাকবে একটা ফ্ল্যাট দরকার হবে না?
তা তো হবেই। আমি সরকারের কাছে একটা ফ্ল্যাট চাইব। সরকার আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। আমি যখন কাজ করব তখন সরকারের দেয়া ধার শোধ করে দেব। আমার ভাই তো একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে। সে ওখানে ওর বান্ধবীকে নিয়ে থাকে। ওদের স্মাতক ডিগ্রি এখনো হয়নি। তবু একটা কোম্পানিতে ওরা দুজনই দিনে কয়েক ঘণ্টা কাজ করে। আমি অপেক্ষায় আছি, কবে ভাইয়ের মতো বড় হবো।
এডামের কথা শুনে এবং আমার অজ্ঞতা যে কত বেশি সেটা ভেবে চা শেষ করেও আমি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে থাকি। ওর মা সেটা বোধহয় বুঝতে পারেন।
এবার তাহলে আপনার পরিবারের কথা শোনা যাক।
আমাদেরও দুটি সন্তান। বড়টি ছেলে। সে স্মাতক শেষ করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। সে বিয়ে করেছে। ওর স্ত্রী ব্যাংকে কাজ করে। ওদের একটি ফুটফুটে বাবু আছে। ওকে আমার স্ত্রীর কাছে রেখে ওরা কাজে যায়। আর আমাদের মেয়েটির এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ হয়নি।
আপনার স্ত্রী কি আপনার সঙ্গেই থাকেন?
হ্যাঁ। আমরা একসঙ্গেই থাকেন। আর আমৃত্যু আমরা একসঙ্গেই থাকব।
আপনাদের ছেলে আর ওর স্ত্রী আপনাদের সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকে ?
হ্যাঁ। আমরা সবাই একসঙ্গেই থাকতে চাই। আমাদের ফ্ল্যাটটি অবশ্য তত বড় নয়। একটা বড় ফ্ল্যাটে যেতে হবে।
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। কী যেন ভাবেন। তারপর একসময় আমার পাতের দিকে তাকান। কথায় কথায় খাওয়ার কথা আমি ভুলেই গিয়ে ছিলাম। বিষয়টা অনিন্দিতা খেয়াল করেন।
আপনি তো কিছুই খাননি।
আমি নিচ্ছি। আর রাতে আমি স্বল্পই আহার করি। বরং আপনাদের সঙ্গে গল্প করতেই আমার ভালো লাগছে। অগ্রসর বিশ্বের যাপিত জীবন আর জীবনবোধ সম্পর্কে আমার জানাশোনা খুবই কম। আচ্ছা, যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
নির্দ্বিধায় জিজ্ঞেস করতে পারেন।
আপনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি আর আমার স্ত্রী একসঙ্গে থাকি কি না। এ কথা কেন জিজ্ঞেস করেছিলেন এ কথা?
দেখুন, আমার সন্তানরা বড় হয়ে গেছে। ওরা ওদের মতো আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে থাকবে। আমার বয়স পঞ্চাশ হয়ে গেছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী বছর ফিলিপাইন চলে যাবো। ম্যানিলা থেকে বহু দূরের একটি ছোটো দ্বীপে আমার গ্রাম, সেখানে আমার মা আছেন। আমি তার সঙ্গে বাকি জীবন কাটাতে চাই।
আব্দুল মাজিদ যাবেন না আপনার সঙ্গে ?
না, না। সে কেন যাবে? ওটা তো আর ওর দেশ নয়। আমি ওকে বলেছি, আমি চলে গেলে আবার বিয়ে করে নিতে। বাঙালিরা একা থাকতে পারে না, আবার বিয়ে ছাড়া কোনো নারীর সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে না। অথচ আব্দুল আমার পরামর্শ গ্রহণ করতেও চাইছে না। আমি ওকে বলেছি, চাইলে তুমি তোমার দেশে গিয়েও বিয়ে করতে পার। সে তাতেও রাজি নয়। কিন্তু আমি চাই, আব্দুল সুখে থাকুক।
মাজিদ সাহেবকে আপনার আর দরকার নেই!
এতগুলো বছর আব্দুল আমার সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছে। সে খুব ভালো মানুষ। আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি সব সময় ওর মঙ্গল কামনা করি। ওর সান্নিধ্য আমার কাছে বহুমূল্য চন্দনচূর্ণের সুবাসের মতো। কিন্তু আমাকে যে আমার মায়ের কাছে ফিরে যেতেই হবে।
আব্দুল মাজিদ আহার শেষ করে নিশ্চুপ বসে আমাদের কথা শুনছিলেন। আমি এখন তার দিকে তাকাই। তার কাশফুলের মতো গোঁফের নিচে মৃদু হাসি স্থির হয়ে আছে। আব্দুল মাজিদকে একটা চন্দন বৃক্ষই মনে হয়, যিনি পরিণত বয়সে অপরিমেয় অর্থমূল্য ধারণ করেছেন।