একটা কাসার পানের বাটা

নেত্রকোণা কোর্ট স্টেশনে নামতেই বিনা নোটিশে বৃষ্টি শুরু হলো। তবে গোমট আবহাওয়াটা যে একটা বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল সনজু। সারাদিন পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। কমলাপুর রেলস্টেশনে টাকা খোয়া যাবার পর মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। হাওর এক্সপ্রেস ছেড়েছে রাতে বারোটায়। লক্কর ঝক্কর করে সে ট্রেন নেত্রকোণা পৌঁছালো সকাল ছটায়। সঙ্গে ঠেলাঠেলি আর গালবাজিতো আছেই। বাড়ি পেছাতে আরো ঘণ্টা দুয়েকের পথ। পায়ে হেঁটে গেলে ঘণ্টা চারেক। পকেটে একটাও টাকা নেই, বাড়ছে ক্ষুধাও। এবার ট্রেনে চড়ে সনজুর একটা শিক্ষা হলো। টাকা পয়সা আসলে হাতের ময়লা। এটা গুছিয়ে রাখতে নেই। বছর তিনেক আগের পুরনো মানিব্যাগে এতো যতœ করে টাকাগুলো না রাখলেও চলতো। কালো চশমাওয়ালা টাউট পোলাগুলা এই ছেঁড়া ব্যাগে হাত দিত না। ওরা টাকার গন্ধ পেয়েছে। মনে মনে নিজেকেই গালি দেয় সনজু ‘মারানীর পুতেরা এই আবালরেই পুটকিডা মারলো।’ অথচ সনজু কখনো কাউকে প্রকাশ্যে এরকম গালি দিয়েছে বলে মনে পড়ছে না। বারবার সিনেমার ডায়ালগের মতো মনে হতে লাগলো টাকা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাটা। এক সময় ভুলে যায় কেনইবা সনজু ঢাকা এসেছিল। 

মালনী রোডের পাশের এক মসজিদের কাছে এসে টিউবওয়েলে চোখেমুখে জলঝাপটা দেয় সনজু। চুলগুলো এই কদিনে জটলা পাকিয়েছে ধুলোবালিতে। কলের নিচে জমে থাকা পানিতে দেখতে পায় নিজের মুখ। চোখ দুটো হলদেটে হয়ে গেছে। ঢকঢক করে এক আজলা পানি পান করে সনজু। পেটটা সত্যি সত্যি ভরে গেল। ক্ষিধেটা মরে গেল নিমিষে। ততক্ষণে বৃষ্টি থামলো বটে, গায়ের জামা কিছুটা ভিজে গেল। পাশেই বাসস্ট্যান্ড। অটোরিক্সাগুলো যাত্রী ডাকতে শুরু করেছে, ‘এ্যাই আটপাড়া, আটপাড়া, আর দুইজন। আসেন ভাই, টাইম শ্যাষ।’ সনজু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, বাসে যাবে নাকি অটোতে। 

দুই
ক্ষুধা আর ক্লান্তি নিয়ে টানা সাতদিন পর বাড়ি ফেরা সনজুর। বেলা তখন দুপুর গড়িয়ে ঘড়ির কাটায় বিকেল পাঁচটা ছুঁইছুঁই। সনজুর মা উঠানের মাটির চুলোয় রাতের রান্না বসিয়েছে। লাউপাতা দিয়ে পুটি মাছের শুঁটকি। লম্বা ঝুলের এই তরকারি নিত্যদিনের অংশ। ‘এই ছালুন মা আর কোথাও পাই না গো মা। এই ছালুনের যে কী তৃপ্তি, বুঝবা না মা।’ এই কথা বলে সনজু কতবার যে তার মাকে এক বিস্ময়কর মায়াজালে আবদ্ধ করেছে। সনজুর দিকে অপলক তাকিয়ে মা বলে—‘খা বাজান, পেট ভইরা খা। একটা চাকরি বাকরি দ্যাখ। সংসার তো চলে না রে বাজান। তর বাপতো সংসার বৈরাগী। দেইখাও না দেখার ভান করে। আমি সারাদিন ঘুরি, তরকারি টোকাই। আমার পেডেতো ভাত যায় না যদি কিছু খাওনের সময় তরার পাতো কিছু তুলতে না পারি।’ এতোগুলো কথা বলে সনজুর মা দম নেয়। সনজু নীরবে গোগ্রাসে গিলতে থাকে। সনজু এটাও জানে তাঁর মা সারাদিন কি কষ্টটাই না করে। লবণ আছেতো লাকড়ি নেই। লাকড়ি আছেতো তরকারি নেই। ঘরের মহাজন একজন। যার হিসেব নিকেশ করতে হয় একলা। অথচ খাবার মুখ একলা নয়, অনেকগুলো। গুটে কুড়ানি শেষ হয়তো শুরু হয় অন্যকাজ। 

সনজুর মা সারা বাড়ি ঘুরে লাউয়ের মাচা থেকে লাউয়ের ডগা, ক্ষেতের কয়টা অপরিপক্ক বেগুন কিংবা কোনোদিন বাড়ির দেউরিতে গজিয়ে বেড়ে ওঠা পুইশাঁক দিয়ে রান্নার আয়োজন চলে। সনজুর বাবার এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ঘরে বাজার আছে কি নেই। দিনশেষে একপাত ভাত জুটলেই হলো। ‘পোলা এখন বড় হইছে, বাজার সদাই তারাই করবনে। আমার কি, দিন গুজরান একবায় অয়লেই অয়।’ সনজুর মায়ের কথার বিপরীতে তাঁর বাবার এই জবাব আজ নতুন নয়। কোনো রাতে সনজুর মায়ের না খেয়ে থাকার চাপা অভিমান এই এক কথার জন্যই। বিলের বড় জমিটা বিক্রি করে বাকি জমি বন্ধক দিয়ে এক বছর হলো গৃহস্থালী কাজ ছেড়েছে সনজুর বাবা। এখন আর তেমন আয় রোজগার নেই সংসারে। 

তিন
মায়ের তরকারী রান্না করার এই দৃশ্যপট সনজুকে খুব আবেগী করে তুলে। মায়ের ঘর্মাক্ত মলিন মুখটা দেখে মনে পড়লো কেন সনজু ঢাকা গিয়েছিল। বাড়ি ফেরাটা যে একটা বড় অন্যায় হয়েছে সেরকমই মনে হতে লাগল সনজুর কাছে। জীবনটা অর্থহীন, ছন্দহীন ঠেকলো এই প্রথমবারের মতো। জীবনে এতো যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর থাকে তাও কখনো দেখেনি সনজু। মায়ের হাতে তিনবেলা খেয়েপড়ে জীবন দিব্যি চলে এতটুকুনই ছিল জীবনভাবনা, এতটুকুন সুখ প্রত্যাশা তার জীবনের। গায়ের জামাটা খুলে বারান্দার কাঠের জলচৌকিটা টেনে নেয় সনজু। মা উঠানে চুলায় শেষ কয়েকটা গোবর গুটি গুঁজে দিয়ে মুখোমুখি হয় সনজুর।

‘কি খবর, বাপজান, টেকা পয়সা যে দিসিলা লোকজনে কিছু কইলো।’

সনজু কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে-‘কাজল আর বাবলুরা কী চইল্যা গেছে।’ ‘হ্যাঁ বাজান, গেছে গা, বাবলুরা গেছে ট্রলারে। সাথের রিপন নাকি মইর‌্যা গেছে। তরে আমি ট্রলারে যাইতে দিতাম না। তুই উড়ুজাহাজে যাইবি।’ ‘না মা। আমিতো কিচ্ছুই কত্তে পারলাম না।’

‘কস কী বাজান!’
হ্যাঁ, হাছা কইতাছি মা।’
‘কী হইছে, খুইল্যা ক দেহি।’
‘যারারে টেহা দিছিলাম, হেরার ফোন বন্ধ। বাসার ঠিকানাত গিয়াও পাই নাই। তালা দেওয়া।’
‘হায় আ কী সর্বনাশ। তর বাপ হুনলে হাটফেল করব। আমরার কী অইব। ভিটামাটি বেইচ্চা আমরা তো ভিখারী অইয়া গেলাম গা।’

চার
সনজুর জ্বর এসেছে সন্ধ্যা থেকে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে সারা শরীর। মা পুরনো লুঙ্গি দিয়ে জলপট্টি দিয়েছেন কপালে। জ্বরের ঘোরে গোংরাচ্ছে আর বকাবাজি করছে। ‘মারানীর পুলা। আমার সাথে টাউটগিরি করছস। খোদায় গজব নাজিল করব। আল¬া তরারে ঢাডা দিব কপালে।’ মা এক মগ পানি নিয়ে চৌকিতে বসলো। ‘বাজান, বকিস না। একটু ঘুমা। তর বাপ আইলে কইতে অইবো। আমরার কষ্টের সংসারে এই গজব কেন দিল আল¬া। কী পাপ করছিলাম খোদার কাছে। কত পুলাপাইন মালয়শিয়া যাইতাছে টাউট দালাল ধইরা। তুই কেরে যাইতে পারলি না।’ কথাগুলো বলে সনজুর মা খিরকির দুয়ারটা টেনে দেয়। কুপির বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে ছোট পাটিতে শুয়ে পড়ে। রাতের খাওয়া কারও হয়ে ওঠে না। 

মাগরিবের পর থেকে উঠানের লেবু গাছের নিচে দুটা কুকুর বিলাপ করছে। এই বিলাপ করাটা তাদের অভ্যেস। সনজুর মা এই বিলাপ শুনে অভ্যস্থ। সনজুর মা গত পাঁচ বছর ধরে দেখে এসেছে খুব ক্ষিধে পেলে কুকুরগুলো এরকম বিলাপ করে, নয়তো খারাপ কোনো সংবাদের সংকেত পেলে। বকনা বাছুরটা যেদিন মারা গেলো সেদিন এরকম কেঁদেছিল কুকুরগুলো। খারাপ সংবাদতো পেয়েই গেলো সনজুর মা। আজ এমন করে কাঁদছে কেন। পাতিলের অনেকগুলো ভাত বাটিতে তুলে নিয়ে খেতে দেয়। কুকুরগুলো গো-গ্রাসে খেয়ে পায়ের চারপাশে ঘুরতে থাকে। একটু পর আবারো বিলাপ। ঘরে এসে সনজুর কপালে হাত দেয় তার মা। জ্বর কিছুটা কমেছে। কিন্তু অনেকটা অচেতন হয়ে শুয়ে থাকা সনজু গোংরাচ্ছে- ‘বাবা, আমি বাজারে দুকান দিবনে। তুমি চিন্তা কইর না। বিপদ থাকব না।   বিপদ থাকব না। আমি আরেকবার ঢাকা যাইতাম চাই। আমারে দুইশডা টেহা দিও বাবা। আমি এই দুই টাউটরে উচিত শিক্ষা দিতাম চাই। আমি খালি ঠকতাছি। আমি কি খালি ঠকেই যামু। ইস্টিশনেও আমার টাকা মাইরা নিছে টাউটে।’

পাঁচ
জুম্মাবাড়ির মসজিদে এশার আজান শোনা গেল। এই আজানটা সনজুর মায়ের খুব পছন্দ। সংগ্রামের আগের বছর থেকে এই আজান শুনে আসছে সনজুর মা। যেদিন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছে ফুলশয্যার রাতে ফজরের আজান তার কানে এসেছিল। সনজুর বাবা একটা আংটি আর একপাতিল মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। উঠান ভরা ধানের মাচা দেখে মনে আনন্দঝিলিক দিয়েছিল। জলেভাসা সাবান আর সুতি শাড়ি দিয়ে বিয়ে হয়েছিল। কত স্মৃতি। শ্রাবণের বৃষ্টিহীন রাতে জোৎস্না মেখে সারাগায়ে উঠানে পাটি পেতে শুয়ে পড়তো সনজুর বাবা। তখন কত শক্তি তাগড়া জোয়ান শরীরে। ফজরের পরপরই খেতে হালচাষ শুরু হতো। সকালে চিড়া দই কলা দিয়ে নাস্তা হতো। সনজু তখনো পেটে আসেনি। ছিমছাম সংসার। অভাব নেই, ভাবনা নেই।

জীবনের ফেলে আসা সোনালি অতীত আজ কেন যেন পীড়া দিতে শুরু করেছে সনজুর মুখটা দেখে। মানুষের জীবন এমন হয় কেন! এর কী কোন ব্যাখ্যা আছে! নাকি এমনই হয় মানুষের জীবন। কুকুরগুলো আবার জ্বালাতন শুরু করেছে। লেবুতলা থেকে সরিয়ে পুবের গোয়ালঘরের পাশে তাড়িয়ে দেয় কুকুরগুলোকে। এই গোয়াল ঘর নিয়ে কত স্মৃতি। সাতসাতটা দুধের গাভি ছিল সনজুর বাপের। সনজুর বাপ সকালে ধোনা নিয়ে বসতো দুধ দোহানোর জন্য। সনজুর মা তখন নতুন বউ। শাড়ির আচল টেনে সনজুর বাবার সঙ্গে দুধ দোহানোতে বসতো বাছুরকে ধরে রাখার জন্য। একবার বিলে পোনা মাছ ধরতে গিয়ে সনজুর বাবা জোকের কামড় খেয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে সনজুর মাকে বলে,‘একটু হুক্কার পানি ঢাল পায়ে। জোকে রক্ত খাইয়া গর্ত কইরা ফালাইছে। পানি ঢাইলা একটু কাপড় পুইড়্যা ছাইডা মাইখ্যা দেও। রক্ত বন্ধ হইয়া যাইব।’ ঘরে কোনো কাপড় না পেয়ে সনজুর মা পরনের কাপড়ের আছল ছিঁড়ে ছাই বানিয়েছিল। আহা কত স্মৃতি!

ছয়
রাত নয়টা বাজে। সনজুর বাবা কোনাপাড়ার বাজার থেকে ফিরেনি এখনো। সনজু অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই বদ অভ্যাসটা বহুদিনের। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। ঘরে যে এতোগুলো মানুষ তার জন্য না খেয়ে বসে থাকে তার চিন্তা থাকে না। আজো এমনটি হবে সেটা চিরাচরিত অভ্যেসের অংশ। পাশের বাড়ির মনফর আলী এসে খিড়কীতে ধাক্কা দিল। 

‘ভাবীসাব, দুঃসংবাদ আছে।’
‘আমার আর কী দুঃসংবাদ। সংবাদ যা পাওনেরতো সনজুই দিল। আমার আর কী বাকি আছে দুঃসংবাদের।’
‘না ভাবী, জয়নাল চাচাতো আর নাই।’
‘কী কস মনফর। সনজুর বাপের কী হইছে? তুই কিতা কস মনফর?’
‘চাচা হাটফেল করছে বাজারে বইসা। চা খাইতাছিল। সুজনের কাছে হুনছে সনজু টেহা মাইর খাইছে। চাচার লাশ আইতাছে ভ্যানে। আমি বেহেরেই খবর দিতাছি।’

ভ্যান এসে থামলো সনজুদের উঠানে। একটা লম্বাটে মানুষ গামছা দিয়ে ঢাকা। মুখটা পুরোপুরি খোলা। সনজুর বাবার পাকা গোফ। বাবা আছে প্রাণ নেই। নিথর দেহটা শুয়ে আছে। শুয়ে আছে অনেকগুলো মৃত স্বপ্ন। সনজু মালয়েশিয়া যাবে। বন্ধকী জমিগুলো ছুটাবে। হাতছাড়া জমিগুলোর জন্য আবার ছুটোছুটি করবে। সনজুকে বিয়ে করাবে জীথনের নূরু মেম্বারের মেয়ে সাথে। সনজুর মায়ের খুব শখ একটা কাঁসার পানের বাটা কেনার। নড়েবড়ে শনের ঘরটা টিন দিয়ে মুড়াবে!

কুকুর দুটো জড়োসড়ো হয়ে আবারো লেবুতলায় ফিরে এলো। বিলাপ তাদের থামছেই না ।

menu
menu