অতীত জানালার হাওয়া
মাত্রই পেছনে ফেলে এসেছেন একজনকে, যে বলছে, সে নাকি তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে সোফিয়া, তেইশ মাস বয়সের সোফিয়া। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে লকিয়তুল্লা’র, ‘আল্লাহ তুমি এমন পরীক্ষায় কেন ফেললে আমাকে। তুমি তো আমার সোফিয়াকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলে, সহ্য করেছিলাম, বুকে পাথর চাপা দিয়ে ছিলাম, ধীরে ধীরে সেই স্মৃতিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম, কেন তুমি এ শেষ বয়সে আমাকে পরীক্ষার সামনে দাঁড় করালে? মাবুদ, তোমার খেলা বোঝা বড় দায়।’
লকিয়তুল্লা’র বৃদ্ধ মস্তিষ্ক তার সোফিয়ার স্মৃতিকে নবায়ন করেন, তেইশ মাস বয়সের সোফিয়া! নিজের নাম আর আব্বা শব্দ ছাড়া কিছু বলতে শেখেনি। লকিয়তুল্লা’র হাত ধরেই দাঁড়িয়ে ছিল বারডেমের গেটে। লকিয়তুল্লা’র মনোযোগ একটু আলগা হয়েছিলো। ঘুরে দেখে মেয়ে তার হাতে নেই—নেই তো নেই—কতো খোঁজাখুঁজি! কোথাও পাওয়া যায়নি। লকিয়তুল্লাও মেয়েকে ফিরে পায়নি। পেয়েছিল একটা চাকরি। মাসের পর মাস বারডেম হাসপাতালের গেটে বসে থাকতে দেখে ইব্রাহীম স্যার একদিন তাকে ডেকে পাঠালেন। সব কিছু শুনে চাকরির ব্যবস্থা করলেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলেন, কিন্তু হারানো মেয়ে তিনি দিতে পারবেন কিভাবে? তিনিই বা কেন দেবেন? এটা তো তার দোষ নয়, লকিয়তুল্লা নিজেই দোষী, মেয়ে তার হাত থেকেই হারিয়েছিল।
আজ এতগুলো বছর পর আবার হঠাৎ করে এসে এক মেয়ে দাবী করে বসে, সে নাকি লকিয়তুল্লা’র হারিয়ে যাওয়া মেয়ে, সোফিয়া। লকিয়তুল্লা মায়া নামক এক ভয়ংকর অস্বস্তির ভেতর পড়ে যান। লকিয়তুল্লা’র মন বলে, মেয়েটি যা বলছে তা যদি সত্য হতো! কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা।
লকিয়তুল্লা ভাবেন, ভাবতে ভাবতে ফিরে আসেন, ফিরে এসে দাঁড়ান সোফির সামনে। জিজ্ঞেস করেন, ‘কি এমন প্রমাণ আছে আপনার কাছে যে, আপনি বলছেন আপনি আমার হারিয়ে যাওয়া সোফিয়া?’
জাহিদের বুক থেকে দ্রুত মাথা তোলে সোফি—সদ্য নিভে যাওয়া আশার প্রদীপ আবার তার চোখেমুখে জ্বলে ওঠে। সে দ্রুত হাত চালায় তার ব্যাগে, সেখান থেকে একটা মাদুলি বের করে—লকিয়তুল্লা’র চোখের সামনে ঝুলতে থাকে রুপোর মাদুলিটা।
‘আমি হারিয়ে যাবার সময় এটা, এটা আমার গলায় পরানো ছিল, চিনতে পারছেন? চিনতে পারছেন, এটা? চিনতে পারছেন না? আব্বা!’
আব্বা ডাক শুনে লকিয়তুল্লা’র বুকের ভেতর এক অনির্বাচিত ঝড় ওঠে। লকিয়তুল্লা বিশ্বাস করতে চান, যে এই মেয়েটি যা বলছে তা সত্য হলে সমস্যা কি? কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন না। মাদুলিটা হাতে নেন তিনি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন। সোফিয়ার জন্মের পরে প্রথম বার পুতী’র মুখ দেখতে গিয়ে তিনি একটা রুপোর মাদুলি পরিয়ে দিয়েছিলেন লকিয়তুল্লা’র মা। চিনতে কষ্ট হয় মাদুলিটা, নেড়েচেড়ে দেখে নিশ্চিত হন যে এটাই লকিয়তুল্লা’র মায়ের মাদুলি, যেটা মা সোফিয়ার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটির মুখে আব্বা ডাক শোনার পর খুব করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে যে, এই মেয়েই তার হারিয়ে যাওয়া সোফিয়া। কিন্তু একটা মাদুলি দিয়ে তো সত্য মিথ্যা যাচাই করা যায় না? এমনও তো হতে পারে, এই মেয়ে এই মাদুলি কুড়িয়ে পেয়েছে। অতএব, আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে, ছুঁড়ে ফেলেন লকিয়তুল্লা। না, কিছুতেই একটা মাদুলি দিয়ে প্রমাণ হয় না যে, এই মেয়েই তার হারিয়ে যাওয়া সোফিয়া। কোথাকার কোন এক মেয়ে একটা মাদুলি দেখিয়ে বলল যে, সে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে, একবার আব্বা বলে ডাকল, অমনি লকিয়তুল্লা’র বিশ্বাস মোমের গলে যেতে আরম্ভ করলো? আবেগের মোমবাতির তাপে গলে যাচ্ছেন দেখে তিনি নিজেকে ধিক্কার দিতেও পিছ পা হলেন না। এই মেয়েকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেয়া যায় না। কিছুতেই না। লকিয়তুল্লা আবার ভাবেন, কেনই বা একটি মেয়ে এত দূর দেশ থেকে এসে নিজেকে তার হারানো মেয়ে সোফিয়া হিসেবে দাবী করবে? আর কিভাবেই বা সে এই সোনার মাদুলিটা পেল? লকিয়তুল্লা’র ভাবনা এক ধাপ মেয়েটিকে মেনে নেয়ার দিকে এগোয় তো তিন ধাপ পিছিয়ে যায়। এই শেষ বয়সে তাকে আবারও এমন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কি লাভ আল্লাহর?
এই মেয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলছে, শুনেই বোঝা যায় এই মেয়ে বাংলাদেশের নয়, চেহারাও তেমন কথায় বলে। এমন সংশয় বুকের ভেতরে চাপা দিয়ে রেখে লকিয়তুল্লা বলেন, ‘দেখি, আপনার পা দুটো দেখি?’ এ কথা বলেই সোফিয়ার পায়ের দিকে তাকালেন। কোন কিছু না বুঝেই সোফিয়া তার পায়ের গোড়ালি এগিয়ে দিলা লকিয়তুল্লা’র সামনে। লকিয়তুল্লা একটু ঝুঁকে গিয়ে সোফির বাম পা টা দেখার চেষ্টা করলেন। তিনি আঁতকে উঠলেন। এই মেয়ের বাম পায়ের ছোট আঙুলে নখ নেই, মানে পুরোটা চামড়া দিয়ে আবৃত! তার সোফিয়ারও তো এমনই ছিল। উঠে দাঁড়ালেন লকিয়তুল্লা। হ্যাঁ, এর চোখ তো রাহেলার চোখের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে, রাহেলার নাক, থুতনি, কপাল, ভ্রু। লকিয়তুল্লা সোফির হাত দুটো নিজে হাতে নিলেন। বাবার স্পর্শ তবে এমন নিশ্চিন্তের স্পর্শ হয়!
উৎসবের বাতাবরণে মুছে যায় যাপিত শোকের মুখ; এখনো এই মেয়েকে নিজের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধা কাজ করছে লকিয়তুল্লা’র ভেতরে। একটা দুইটা করে কথা বলা আরম্ভ করেছেন লকিয়তুল্লা। সেই শুরু থেকে তিনি দেখছেন একটি ছেলে। মনে অনেক প্রশ্নের মধ্যে এই প্রশ্নটিও খেলে বেড়াচ্ছে। এই ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে সোফি। ঘটনার বিহ্বলতায় জাহিদের কথা ভুলে গেছিলো সে। জাহিদও লকিয়তুল্লা এবং সোফির কথার ভেতরে ঢুকতে চায় নি।
‘ও হচ্ছে জাহিদ, জাহিদ হায়দার।’ বাক্যটি শেষ করে ফুল স্টপের মতো চুপ মেরে যায় সোফি।
তিনজন এক পা দুই পা করে লিফটের এগিয়ে গেল, সেখান থেকে তিন তলার ক্যান্টিনে ঢোকে ওরা। এখনো কেউ কারও সাথে সহজ হতে পারেনি। লকিয়তুল্লা’র মনে একটাই প্রশ্ন, যদি এই মেয়েই তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে সোফিয়া হয়েই থাকে, তবে কীভাবে সে নেদারল্যান্ড গেল?
সোফি বুঝতে পারছে বাবার মনের অবস্থা। তেইশ বছর পর কেউ এসে যদি বলে আমি আপনার হারানো মেয়ে, তাহলে যে কারও অবস্থা এমন হতে বাধ্য। একটা দোটানার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বুঝে উঠতে পারছেন না, তিনি কি সোফিকে মেয়ে হিসেবে মেনে নেবেন? নাকি অস্বীকার করবেন? মানুষের জীবনে এমন সময় আসে কখনো কখনো, যখন মানুষ অসহায় বোধ করে, যখন সামনে যা কিছু পায় তাই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। সোফির এই সাতাশ বছরের জীবনেও কি এমন পরিস্থিতি কম এসেছে?
নেদারল্যান্ডের মতো একটা সচ্ছল দেশের এক উচ্চবিত্ত পরিবারে বড় হতে থাকে সোফি-পিটার অ্যাডেনবার্গ আর আগাথা অ্যাডেনবার্গ দম্পতির একমাত্র সন্তান সে, অসম্ভব আদর যত্নে ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে সোফি।
‘সোফি, মা আমার, আমার আদরের মেয়ে, কাছে আসো, এই এখানে, এখানে বসো মা, আমার সুইট হার্ট, আমার বেবি, এখানে বসো, আমাদের দুইজনের মাঝে বসো’
আঠারতম জন্মদিনের অনুষ্ঠানের পার্টি শেষ করে যখন সবাই চলে গেছে তখন সোফির বাবা-মা তাকে কাছে ডেকে বসান। আজ জন্মদিন বলেই কি একটু বেশি আদর! দুই জনের মাঝে বসে সোফি। দুইজনের কপালেই চুমু খায় সে। ‘থ্যাংকস, মা। থ্যাংকস বাবা। জন্মদিনের এতো সুন্দর পার্টি এরেঞ্জ করার জন্য। এতো সুন্দর পার্টি আগে কখনো হয়নি আমার জন্মদিনে।’ আনন্দের আতিশয্যে ভেসে যাচ্ছে সোফি অ্যাডেনবার্গ। আজ তার বয়স আঠার।
‘তোমাকে একটা কথা বলতে চায় মা।’ পিটার অ্যাডেনবার্গ একবার আগাথা অ্যাডেনবার্গের দিকে তাকিয়ে কথা কয়টা বললেন।
‘কি কথা? বলো, ও জানি, বলবে আমি বড় হয়ে গেছি, যেন সাবধানে চলাফেরা করি, এই তো। চিন্তা করো না তোমরা’ সোফিকে আজ খুব প্রগলভতায় পেয়ে বসেছে।
‘না, সামথিং মোর সিরিয়াস, সোফির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেন আগাথা অ্যাডেনবার্গ, তার চোখে অশ্রু।’
‘হাই বেবি, কি হলো তোমার? কাঁদছ কেন? বলো, কি বলবে, বলো?’ সোফি আন্দাজ করতে পারে না। এমন খুশির দিনে এতো আনন্দঘন সময় পার করার পর কি হলো বাবা-মায়ের?
‘সোফি, মা, আমার, প্রায় তেইশ বছর পূর্বে আমি বাংলাদেশ নামক একটা রাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। সাংবাদিক হিসেবে সেখানে প্রায় দুই বছর কাজ করেছি। তোমার মা, সে-ও আমার সঙ্গে ওখানেই ছিল। বাংলাদেশ, খুব সুন্দর ছোট্ট দেশ। আসার সময় আমরা তোমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসি।’ কথাগুলো বলার সময় পিটার মেয়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, তাকে পড়ার চেষ্টা করেন। ‘দত্তক হিসেবে, সেই অর্থে নয় মা। তুমি হারিয়ে গেছিলে, মা, সোফি। এক ভালো মানুষ তোমার বাবা-মাকে খুঁজে না পেয়ে তোমাকে একটা অরফানেজ এ দিয়ে আসেন। সেটা ঢাকা শহর থেকে একটু দূরে সাভারে। আমরা তখন ঢাকা ছেড়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই তোমার মা সিদ্ধান্ত নেন, তিনি একটা বাচ্চাকে অ্যাডপ্ট করবেন। আমাদের বন্ধু আকরাম, সে ওই অরফানেজের খবর দেয়। আকরাম সাভারের সেই অরফানেজে আমাদের নিয়ে যায়, তুমি সেই সময় শুধু তোমার নামটাই বলতে পারতে। অরফানেজ কর্তৃপক্ষ অনেক চেষ্টা চালিয়েছিল তোমার মা বাবাকে খুঁজে বের করার, কিন্তু পায় নি। মা সোফি, তোমাকে নিয়ে আসার সময় এই মাদুলিটা ছিল তোমার গলায়। অফিসিয়াল কাগজপত্র ঠিক করে আমরা তোমাকে নিয়ে আসি এখানে। মা, তুমিই আমার একমাত্র মা, দ্যাখো মা, আমরা আর কো বাচ্চা নেইনি শুধু তোমার কথা চিন্তা করে, তুমি কষ্ট পাবে এই চিন্তা করে। মা, তোমাকে এই ব্যাপারটা জানানোর কোনো পরিকল্পনাই ছিল না, কিন্তু এটা জানা তোমার অধিকার। আমাদের বয়স হচ্ছে, তুমিই আমাদের একমাত্র সন্তান। মা, সোফি মা আমার!’ কথাগুলো একনাগাড়ে বলেন পিটার আমাদের, আগাথা নীরবে কেঁদেই চলেছেন। পিটার স্থির, শক্ত করে সোফির হাত দুটো আঁকড়ে আছে। তিনি কাঁদছেন না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মেঘ গলে বন্যা এসেছে, সোফিকে কিছুতেই সেটা বুঝতে দেবেন না তিনি।
বাবার কথাগুলো শুনতে শুনতে সোফি মা আগাথার হাত দুটো আরও শক্ত করে ধরে। যেন এই মানুষ দুইটা ছাড়া সমগ্র পৃথিবী তার থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে, যেন পায়ের তলার মাটি তুলার মতো ভেসে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে সোফি। নিশ্চুপ, নিজেকে ইস্পাত দৃঢ় করে তোলে সে। মা বাবার সামনে কোনোভাবেই ভেঙে পড়া যাবে না। এই নিঃস্বার্থ মানুষ দুই জনকে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে রাজি নয় সোফি। প্রয়োজনে নিজে কষ্ট সইবে, যদিও এমন নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি তাকে কোনোদিন হতে হবে, তা কল্পনার ভেতরেই আসেনি। শীতের সন্ধ্যার মতো চুপচাপ পুরো পরিবেশটা। নীরবতার মুখে চাবি দিয়ে সোফিই প্রথম মুখ খুলে, ‘মা, বাবা, আমার দিকে তাকাও, আমি সোফি অ্যাডেনবার্গ-পিটার অ্যাডেনবার্গ এবং আগাথা অ্যাডেনবার্গের একমাত্র সন্তান, একমাত্র...’ এই বলে সোফি মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরার পূর্বে টেবিলের উপর সোনার মাদুলিটা গলায় পড়ে নেয়। অ্যাডেনবার্গ পরিবারের তিন সদস্য কাঁদে, মন খুলে কাঁদো, একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদে, অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে। কিছু কিছু কান্না থামানোর দায় পৃথিবীর না নিলেও চলে।
সোফি সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ আসার। সেই সূত্রেই পরিচয় জাহিদের সঙ্গে। জাহিদ এখানকার ইউনিভার্সিটি অফ অ্যামস্টারডামে মাস্টার্স ইন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং- এর ছাত্র। জাহিদের কাছ থেকেই সে বাংলা শিখেছে। অবশ্য তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের গ-ি পেরিয়ে অন্য এক মাত্রা পেয়েছিলো খুব কম সময়ের মধ্যেই।
উষ্কখুষ্ক সত্য একে অপরের সামনে বসে আছে নীরবে নিভৃতে; হাসপাতালের ক্যান্টিনে বসে পুরো ঘটনা বাবা লকিয়তুল্লাকে খুলে বলে সোফি, যেভাবে বাবা পিটার অ্যাডেনবার্গ তাকে বলেছিল। খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনেন লকিয়তুল্লা। খুব ছোট বয়সের কিছু ছবিও সঙ্গে এসেছিলো সোফি। সেগুলো বাবা লকিয়তুল্লাকে দেখায়। বাবা সম্ভবত তার দোটানা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছেন ধীরে ধীরে। ছবিগুলো নিজের কাছেই রাখেন লকিয়তুল্লা, সোফির কাছ থেকে সোনার লকেটটাও নেন।
‘কোথায় উঠেছ?’ লকিয়তুল্লা বলেন। ‘শেরাটনে, হোটেল শেরাটনে’ সোফি বাবার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কথাগুলো বলে। ‘সঙ্গের ছেলেটি কে?’ জিজ্ঞাসাটা জাহিদের দিকে ছুঁড়ে মারলেন লকিয়তুল্লা।
‘ও, জাহিদ, আমার স্বামী বাবা’ সোফি জাহিদের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে। এসেই জাহিদ মা কে ফোন করেছিলো, মা আগে থেকেই সব কিছুই জানতেন, সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ঢাকাতে নেমেই হাতিরপুল কাজী অফিসে গিয়ে মায়ের উপস্থিতিতে সোফি আর জাহিদ রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে।
জাহিদ উঠে গিয়ে লকিয়তুল্লাকে সালাম করে, সোফিও বাবাকে সালাম করে। বাবা মানে লকিয়তুল্লা সালাম নিতে ইতস্তত করতে গিয়েও স্বাভাবিক থাকেন। সোফি-জাহিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন তিনি।
লকিয়তুল্লা তার কাঁঠাল বাগানের বাসার ঠিকানা একটা কাগজে লিখে জাহিদের হাতে দেন। পরের দিন বিকেলে তাদেরকে বাসায় যেতে বলেন তিনি। পুরো বিষয়টা লকিয়তুল্লা তার স্ত্রী রাহেলা এবং ছেলে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে নিতে চায়। লকেটটা নিশ্চয় চিনতে পারবে রাহেলা। এই মেয়ের ছোট বয়সের ছবিগুলোর সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে সোফিয়ার চেহারা। লকিয়তুল্লা চেয়ার ছেড়ে হাঁটতে থাকেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। জাহিদ এবং সোফি বসে থাকে হাসপাতালের ক্যান্টিনে। সোফি ভাবে জীবন কি অদ্ভুত! কি অদ্ভুত জীবন।
আনন্দের রঙিন তুলি আচমকা ছিটকে পড়ে চিত্রকরের ক্যানভাস থেকে; গত কয়েকটা দিন সোফি অ্যাডেনবার্গের সোফিয়া মণ্ডলের জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন, লকিয়তুল্লা মণ্ডলের, হয়তো জাহিদ হায়দারের। গত কয়েকটি দিন সোফির মা, তার ভাইবোন, সবার জীবনেরই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন, স্মরণীয় দিন। এই কয়েকটা দিন সোফি অ্যাডেনবার্গ, পিটার অ্যাডেনবার্গ ও আগাথা অ্যাডেনবার্গের জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন, স্মরণীয় দিন। পুরো বারডেম হাসপাতাল, কাঁঠালবাগানের বাসার আশপাশের সকলেই জেনে গেছে ব্যাপারটা। আলোচনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই দেখতে এসেছে সোফিকে। উৎসবের আমেজে ভরে উঠেছে পুরো বাড়ি। দীর্ঘকালীন পারিবারিক অপূর্ণতা আজ পুরো হয়েছে। লকিয়তুল্লার গ্রামের বাড়ি বাবুপুরেও নাকি হৈ চৈ পড়ে গেছে। তাদের গ্রামের হারানো মেয়েকে ফিরে পাওয়া গেছে। প্রায় তেইশ বছর পর মেয়ে ফিরে এসেছে তাও আবার নেদারল্যান্ড থেকে। মেয়ে নাকি মোমের পুতুলের মতো সুন্দর। সোফি মাঝে একদিন জাহিদদের উত্তরার বাসা থেকে ঘুরেও এসেছে। রাহেলা বানু তো মেয়েকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও ছাড়তে চান না, মেয়ে যদি আবার হারিয়ে যায়? লকিয়তুল্লা নফল নামাজ পড়েছেন—আল্লাহ সর্বশক্তির মালিক। লকিয়তুল্লা বারডেম থেকে ছুটি নিয়েছে দশ দিনের জন্য। তিনিও মেয়েকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চান না। মেয়েকে দেখার স্বাদ মিটছে না তার। ‘মেয়ে হারানোর শোক’ অসুখ থেকে ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন লকিয়তুল্লা আর রাহেলা বানু। জাহিদও তাড়াতাড়ি এই বাড়ির সবার সঙ্গে খুব সহজেই মিশে গেছে। সবাই কত আপন এরা—মনে হয় কত দিনের চেনা, আপান মানুষ আসলে এমনই হয়।
বাবার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী পরের দিন বিকেলেই তারা পৌঁছে গেছিল কাঁঠাল বাগানের বাসায়। কলিং বেল বাজাতেই একজন বয়োবৃদ্ধ নারী দরজা খুলে দেন, জড়িয়ে ধরেন সোফিকে। স্পর্শেই সোফি বুঝে যায়—ইনি সোফির মা, রাহেলা বানু। রাহেলা বানু মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন, তার কান্না থামতেই চায় না। একে একে সোফির ছোট বোন হালিমা আর লতিফার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মা। একমাত্র ভাই সোহাগ এসে বড় বোনকে জড়িয়ে ধরে। লকিয়তুল্লা দূরে দাঁড়িয়ে ভাবেন এই বুঝি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। এর চেয়ে মনোরম দৃশ্য এই পৃথিবী আর কোনোদিন দেখেনি, হয়তো আর কোনোদিন দেখবেও না।
এই বাড়িতে আসা প্রায় ছয়দিন হয়ে গেল। এই বাড়ি মানে সোফির নিজের বাড়ি। বাবা মা ভাই বোন সবাই মিলে কি যে আনন্দ হচ্ছে। বাবা কোথাও যান না- সব সময় সোফিকে নিয়েই বসে থাকেন। সোফির নেদারল্যান্ডের জীবনের গল্প শোনেন। সোফির বাবা-মার কথা শোনেন, বাবা-মা, মানে পিটার অ্যাডেনবার্গ ও আগাথা অ্যাডেনবার্গের কথা শোনেন। কীভাবে সোফি তার অতীত জীবনের কথা জানলো। জানার পর কেন তার এই দেশে এসে বাবা-মা-ভাই বোনকে খোঁজার ইচ্ছা হলো, কীভাবে জাহিদের সঙ্গে তার দেখা হলো? সোফির কী পড়াশোনা করেছে? সে আবার নেদারল্যান্ডে ফিরে যাবে কিনা? মানে সবকিছুর খুঁটিনাটি জানতে চান লকিয়তুল্লা। পিটার অ্যাডেনবার্গ ও আগাথা অ্যাডেনবার্গের সঙ্গে একবার দেখা করার খুব ইচ্ছা হয় লকিয়তুল্লা’র।
সোফির ছোট ভাই সোহাগ তার বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত দেয়। আগামীকাল রাতে সবার দাওয়াত। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই সোহাগের বন্ধুরা তাদের বাসায় চলে আসে, তাদের কারও কারও সঙ্গে তাদের স্ত্রীরাও এসেছেন। সোহাগ তাদের বন্ধুদের সঙ্গে সোফির পরিচয় করিয়ে দেয়। তার বন্ধুদের স্ত্রীদের সঙ্গেও। গল্পগুজবের এক ফাঁকে খাওয়া দাওয়া আরম্ভ হয়ে যায়। সবাই বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পূর্বে সোহাগের বন্ধু নীলিম সোহাগকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে যায়। কয়েক মিনিট পর সোহাগ ভীষণ গোমড়া মুখে, ক্রুদ্ধ চেহারায় বেরিয়ে আসে। বাকি বন্ধুরা দ্রুতই যে যার বাড়ি চলে গেলে সোহাগ বাবা মা, দুই বোনকে ডেকে পাশের ঘরে যায়। ঘরে সোহাগের উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা যায়। সোফি বা জাহিদ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কিছুক্ষণ পরেই সকলেই বের হয়ে আসে-সোহাগ চিৎকার করে বলে, ‘মিসেস সোফি অ্যাডেনবার্গ আপনি এখুনি এই বাসা থেকে বের হয়ে যান, আমরা আপনার কেউ নই। কোথা থেকে একটা মাদুলি আর কয়েকটা পুরনো ছবি নিয়ে এসে বললেই হলো। বাবা, এই জঘন্য মহিলাকে এখুনি বের করে দাও। না হলে আমি এদেরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেব।’ এক নাগাড়ে চিৎকার করে কথাগুলো বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠে সোহাগ।
কিছু বুঝে উঠতে পারে না সোফি। জাহিদও না। বাবা, মা চুপ করে আছেন। যে ভাই কিছুক্ষণ পূর্বেও সোফিকে নিয়ে গর্ব করে বন্ধুদের কাছে সোফির গল্প করছিলো, যে বোনেরা এই কয়েকদিনে একবারের জন্যও সোফিকে দূরে যেতে দেয়নি, এতো এতো ভালোবাসা দিয়েছে-তাদের হলোটা কী? আর বাবা মা? তাঁরাও চুপ। সোফি কিছু একটা বলতে যাবে এমন মুহূর্তেই সোহাগ আবার চিৎকার আরম্ভ করে, ‘ওরা মা বেরোচ্ছে না কেন?’ এই বলেই সোফির ঘর থেকে তার জিনিসপত্রসহ লাগেজটা টেনে হিঁচড়ে বের করে প্রায় ছুঁড়ে মারে সোফি আর জাহিদের দিকে। পৃথিবীর এতো দ্রুত রঙ রূপ পাল্টাতে পারে? এতো অপমান সহ্য করেও সোফি সোহাগকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে? ভাই, চিৎকার করছ কেন? কি দোষ আমার? বাবা? মা? জাহিদ সরে আসে সোফির দিকে, সোফির হাতটা শক্ত করে ধরে, মুহূর্তের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয় এখুনি বের হয়ে যাবে এই বাসা থেকে। আর এক মুহূর্তও নয় এখানে।
‘কি হয়েছে না বলেই কেন চিৎকার করছেন? বেরিয়ে যেতে বলছেন? ঠিক আছে আমরা চলে যাচ্ছি, কিন্তু কেন আপনারা এমন করছেন সেটা না জেনে আমরা বেরুবো না’
সোহাগ প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে জাহিদের হাতে দেয়। জাহিদ বুঝে যায় ব্যাপারটা। মোবাইলটা সোহাগের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘পুরো ঘটনা না শুনেই কি আপনারা সিদ্ধান্ত নিতে চান?
‘না, আমাদের কিচ্ছু শোনার প্রয়োজন নেই। বাবা, ওরা যদি এ বাসায় থাকে আমরা তোমাদের সঙ্গে থাকব না।’
লকিয়তুল্লা স্থির হয়ে গেছেন, কি বলবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। রাহেলা বানু একবার মেয়ের দিকে তাকান, একবার লকিয়তুল্লার দিকে তাকান, একবার দুই মেয়ের দিকে তো আরেকবার তাকান সোহাগের দিকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ়, শুধু কাঁদছেন তিনি।
‘আপনারা যা ভাবছেন বা যা দেখেছেন তা সত্যি নয়।’ আবারও বলে জাহিদ।
‘যান, যান, আপনার লেকচার শোনার মতো রুচি আমাদের নাই।’ গলার জোর বাড়িয়ে দিয়ে কথাগুলো বলে সোহাগ।
তেইশ মাস বয়সী মেয়েকে হারিয়ে শোকের সমুদ্রে ভেসেছিলেন লকিয়তুল্লা, সেই শোক সামলেও নিয়েছেন। মেয়েকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন। কিন্তু এই অবস্থায় কি বলবে লকিয়তুল্লা বুঝে উঠতে পারেন না। লকিয়তুল্লা, স্ত্রী রাহেলা বানুর দিকে তাকান-অবিশ্বাস এবং হারানোর বেদনা বুকে চেপে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
এই মেয়ে জীবনে আর কত শাস্তি পাবে। জন্মই কি তার দোষ? জাহিদ পরিপূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাসে সোহাগের সামনে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে বলে, ‘সোহাগ সাহেব আপনারা যা ভাবছেন তা ভুল। আমার স্ত্রী সোফি, আপনাদের সোফিয়া পর্ন অভিনেত্রী নয়। সে ওখানকার একজন নামকরা অভিনেত্রী, চরিত্রের স্বার্থে তাকে এমন অভিনয় করতে হয়েছে, ওখানকার পরিবেশে এটা এমন কোনো অন্যায় নয়। আর সে তো ওখানে আপনাদের পরিচয়ে বড় হয়নি, একটা খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেছে।’ এই কথা বলেই সোফির হাত ধরে বেরিয়ে আসে বাসা থেকে। পেছনে পড়ে থাকে তেইশ বছর বাদে নবায়ন হওয়া সম্পর্কগুলো।
শূন্য পৃথিবীর বিবর্ণ প্রান্তরে চূড়ান্ত আর্তনাদের মতো একটা কণ্ঠস্বর গড়াতে গড়াতে এগিয়ে আসে সোফির দিকে, ‘দাঁড়া...দাঁ...ড়া মা...’