পারদ

লোহায় যেমন জং ধরে কোনো কোনো মানুষের তেমনি জং ধরে। সেই মানুষকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া কষ্টসাধ্য। কখনো অসম্ভবও। কিছু আছে এত আগের, তাদের  জন্মই হয়নি। জুবু আর থুবু  দুই অস্তিত্ব। কারও পক্ষে সম্ভব না দুপক্ষকে এক করে। এক না করার কারণে, এদের গোপন কক্ষে, অন্ধকার  সাঁতরিয়ে কত লোক আসে আর যায়। ওরা অসুস্থ হুমড়ি খাওয়া প্রাণীর মতো। তবে সুস্থ হওয়ার চেষ্টাতেও খামতি নেই। কতরকম কবিরাজি বিদ্যায় তাদের আস্থা। মূল কথা চিকিৎসা প্রয়োজন। যদি নিজেদের চিকিৎসা নিজেরা করতে পারে তাহলে কার কী বলার আছে। মঙ্গল হলেই মঙ্গল।

একদিন অন্ধকার ঠেলে ঠুলে সাবির মার ঘরে গুনিন আসে। আগেও অনেকবার এসেছে। এসেছে কারণ সাবির সংসার যায় যায়। সংসার তো রক্ষা করতে হবে। তারা জানে গুনিন ছাড়া সম্ভব না। ভুজপত্রের ওপর জাফরান কালি দিয়ে আরবি বা ফারসি হরফে সাবির নাম আর সাবির স্বামীর নাম লিখে নদীতে ফেলা হয়েছিল, সঙ্গে আরো কী হেকমতি। ভুজপত্র স্রোতের উল্টো দিকেও যায়। সন্ধ্যার উনালোতে ভুজপত্র স্রোতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নদীর উৎসে রওয়ানা দেয়। ভাবের নদী উৎসেই তো যাবে, সাবি আর বকুর পরিচয়ের প্রথম দিনের উজ্জ্বল স্মৃতিতে। যাবে মন্থনে। দেখা যাক ভুজপত্র আর জাফরান, সন্ধ্যার উনালো ভেদ করে কি নিয়ে আসে। এখানকার সংসার ঘোর বর্ষার শটিকন্দের মতো বিস্তার ঘটায়। শত ভুলভালের ভেতরও তারা সাহস পেলে  ভরসা পেলে পরস্পরকে ক্ষমা করে দেয়।

তারপর অনেকদিন চলে যায়। ভুজপাতা জাফরান আর আলি গুনিনের মন্ত্র সাবির জন্য নতুন কোনো সংবাদ নিয়ে আসে না। 

বকাউলের ডাক নাম বকু। বকু আর সাবি, দুজন দুই প্রান্তে। জুবু আর থুবুর মতো। অথচ জুবুথুবু একত্রে থাকার কথা। ঝরো বৃষ্টির ভেতর কলাপাতা বা ছাতার মতো কচুপাতার নিচে, মাথা নিচু করে, বহুভঙ্গি ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে, একবারে জড়িয়ে থাকা যাকে বলে। অথচ সাবির নাম শুনলে বকু রাগে টং হয়ে যায়, বলে, মাগি খুব খারাপ, ওর লগে কিসের সংসার! মনু খালা, দুলু খালু, সাবির মা-তিন জনে হাল ছাড়তে নারাজ। সঙ্গে তো গুনিন আছেই। ওরা গুনিনকে  বলে, বাবা, আলি বাবা, ...কী হইলো বাবা? গুনিন সরাসরি জবাব দেয় না। চৈত্রের দুপুরে হঠাৎ বাতাসশূন্য মাঠের পাশে উঁচু শিলকড়ই গাছটা যেমন নিস্প্রাণ গুনিনের অবস্থাও তেমনি স্থির। চেষ্টার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে সে। তবু তার চোখে সাবির ভবিষ্যৎ শরতের কাকজ্যোস্নার মতো। গুনিন বলে, একটা প্রস্তাব আছে। 

‘কী প্রস্তাব?’  
‘হগ্গলের সামনে বলা যাবে না।’  

মনু খালা সাবির মা দুলু খালু প্রত্যেকে পরস্পর মুখ দেখে। গুনিন এবার বলে, হগ্গলের সামনে বলা যাবে, তবে বলতে হবে সাবির কানে কানে।

‘ ঠিক আছে বলেন, আপনের যেমন ইচ্ছা। ’

সাবি কান পাতে গুনিনের মুখের কাছে অথবা গুনিন মুখ নেয় সাবির কানের কাছে। কী কথা বলবে গুনিন! মাবুদ জানেন! তিনি কার কপালে কী রেখেছেন কে জানে! সাবির কানে কানে গুনিন তার প্রস্তাব পেশ করে। দীর্ঘ প্রস্তাব। প্রস্তাব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাবি বেহুশ। গুনিন বলে, মাথায় পানি দেন। বেশি করে দেন।

সাবির মা চিৎকার দেয়ার আগে মনু খালা একটা ঘূর্ণি তুলে কত কিছু খুঁজে, কিন্তু কিছুই তার আক্কলে ধরা দেয় না। একজন বেহুশ হলে পরে হাতের কাছে পানির পাত্র, জগ মগ বালতি নাগালের মধ্যে থাকলেও খুঁজে পাওয়া যায় না, যা কিছুক্ষণ পর যোগাড় হয়। প্লাস্টিকের বালতি ভরে পানি এনে মনু খালা সাবির মাথায় ঢালে। সাবির মা মেয়ের মাথায় হাত বুলায়। মেয়ে জন্ম দিয়ে মায়ের দায়িত্বের শেষ নেই। যৌবন মুখ দিলেই বিয়ে দাও। নায়-নাতকুর হলে পরে ওসবের সেবা কর। মেয়ের জামাইর সেবা কর-যতœ কর, মন রক্ষার জন্য সর্বদা তঠস্থ থাক। মেয়ের সংসার টিকছে না, গুনিন বাবার পায়ে ধরে বসে থাক। এসব ভাবতে ভাবতে সাবির মার চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়। মেয়েটা সারা দিন কাজ করল, একটু আগে আইল, খাওনের পরে শইলডা একটু বিছানায় লাগায়নি। এ সংসার তাকে মাটিতে শুআইয়া দিছে। 

গুনিন কী বলল? কোন কথা শুনে সাবি বেহুশ হল? সাবির মা বেহুশ হওয়া মেয়েকে হুশে আনতে একটা শিরীষ কাগজ যেন মহল্লাটির জংধরা প্রলেপের  সঙ্গে ঘর্ষণে লিপ্ত হয়। 

‘কি হইছে গো সাবির মা?’ 

এ প্রশ্ন পাশের দরজা থেকে, দূরের জানালা থেকে, সোয়ারেজ ড্রেনের ডান পাশের দোকানদারের গলাছিলা মুরগীর মতো টান টান গলা থেকে, সব্জি দোকানদারের চোখ থেকে, চা দোকান ফেরত কারো কারো মুখ ফসকে আসতে থাকে : 

‘কি হইছে গো সাবির মা?’ 

সাবি বেহুশ হয়েছে কেউ বলে না। গুনিন একে বেহুশ বলে কি না তাও বিবেচ্য বিষয়। গুনিন তখন বলে, ‘বেহাল হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে। মাথা গরম করার কিছু নাই’। কিন্তু এখানে সহজে সংবাদের গরম ছড়িয়ে যায়। ঘরগুলো পরস্পর হাঁটুভাঙা উটের মত উবু হওয়া, উৎপাতা, কানে কানে কথা বলায় নিমগ্ন। কী খায়, কী পরে, কী বলে-এই তিনমাত্রার কথা এখানকার বাসিন্দারা ইচ্ছে করলেও গোপন করতে পারে না। গোপন করেও না। সব উদোম কথা। গোপন কথা লাফিয়ে লাফিয়ে মাথা থেকে মাথায় ঢুকে। 

গুনিনকে কেউ মান্য করে কেউ সন্দেহ করে। কোনটা যে কার কাছে প্রবল বলা কঠিন। কোনটা যে কখন কোনটাকে ছাড়িয়ে যায়। তবে গুনিন সাহসি। মান্যতা ফুঁড়ে যদি কেউ গোপনে আঘাত করে এ নিয়ে তার ভাবনা নেই। এখানে গোপনে অনেক কিছু ঘটে। কিন্তু কেউ দুশমনি করে সামনে দাঁড়ালে সে লড়তে রাজি। 

হালি বাউলের কানে যখন সাবির অচেতন হওয়ার খবর যায়, বাউল তার দোতরা বন্ধ করে মাথা থেকে গামছা খুলে মুখের ঘাম মুছে। সাবিকে বেহুশ করে ফেলেছে গুনিন। হালি বাউল গুনগুনায়। দোতরা ছাড়া গুনগুনি :

 ‘গুনিন রে তোর মুখে মধু অন্তরে বিষ।তোর চক্ষু খারাপ, তুই  কার বুকে যে কখন হাত মারিস।’

আবার নিজে নিজে প্রশ্ন করে উত্তর দেয়, গুনিন কারে কয়? গুনে নিপতিত যিনি। গুন দান করেন যিনি। আমাদের আলি গুনিন কি দান করে? এসব চিন্তা করতে করতে হালি বাউল সোজা দাঁড়িয়ে যায়। 

গুনিন সাবির বুকে হাত দিয়েছে। হালি বাউলের চোখের নড়ন চড়ন দেখে ভক্তরা বুঝতে পারে তাদের একটা কিছু করতে হবে। ভক্তেরা জটলা করে দল বেঁধে আসে। 

‘কি হয়েছে সাবির মা।’ 

সাবির মা বলে, ‘বাবারে, মেয়েটার বেহাল হয়েছে। সারাদিন কাজ শেষে ফিরে আইল, তারপর কী হইয়া গেল।’ দলের সামনে বাদল, বাদল চমকে ওঠে। বাদল জানে, হালি বাউলের মাঝে মাঝে হাল হয়। হালে পড়লে বাউলের হুশ থাকে না। গান চললে গান। কথা চললে কথা। নীরব থাকলে নীরব। বাউলের কথা বড় ইঙ্গিত মার্কা। বুকে হাত দিয়েছে মানে স্বপ্নে হাত দিয়েছে। বাদল আবার হাল বেহালে ফিরে আসে।

সাবির মা বলল তার মেয়ের বেহাল হয়েছে। সাবির মা গুনিনের মুখ থেকে বেহাল শব্দটি নিজের অজান্তে নিয়েছে তা বাদল জানে না। বাদল চেয়ে দেখে সাবি চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পানিতে তার বুকের কাপড় ভিজে গেছে। গুনিন তার পাশে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাদলের ইচ্ছে করে গুনিনের মুখে কষে একটা লাথি লাগিয়ে হালি বাউলকে গিয়ে বলতে, সাঁইজী, হুতাইয়া দিয়া আইছি। কিন্তু হুতাইয়া দেয়া হালি বাউলের পছন্দ না। হালি বাউল মানবে না। সাবিকে কেন্দ্র করে যে কোন হৈ চৈ হালি বাউল বরদাশ্ত করবে না। সাবির প্রতি হালি বাউলের টান রয়েছে। কিসের টান? হালি বাউলের বিরুদ্ধে সাবি একবার বদনাম করেছিল।

তাতে নাকি হালি বাউলের উপকার হয়েছিল। বদনামে উপকার! সে আবার কেমন কথা! তখন হালি বাউল মাত্র এখানে আখড়া গেড়েছে। শিক্ষিত একটা লোক নিজের শিক্ষাভাবটা আড়াল করে এখানকার লোকজনের সঙ্গে মিশে গেছে। হালি বাউলের দুতরার টুন টুনা শুনে এই জংধরা লোকগুলো জেগে উঠল। লোক আসে। গুচ্ছ গুচ্ছ আসে। দোতরার সুরে এত মজা! পনেরো বিশ রাতেও  সমাগম কমে না। বাউল একদিন বলল, আগামী এক সপ্তাহ গান হবে না। লোকগুলোর ওপর যেন ঠাডা পড়ল। সাবি তখন গার্মেন্টসের কাজে ডুবন্ত। হালি বাউলের ঘোষণায় সাবির মনটা কেমন হয়ে গেল। সাবি বলল, কাজে যামু না। সাবির মা বলল, খামু কী ? 

খাওয়া না খাওয়ার চিন্তা মেয়ের মাথায় ঢুকে না। মেয়ে কেবল বলে, কাজে যামু না আমার কেমন জানি লাগে। সাবির মা নারকেলের শলার ঝাটা দিয়ে সাবিকে পিটাল। সাবি সোজা গিয়ে হাজির হল বাউলের আখড়ায়। টানা একসপ্তা বাউলের আখড়ায়, চা বানায়, ঘর পরিষ্কার করে, দোতরার তার ধরে টান দিয়ে অবাক হয়। টানা তারটা কেমন ঘেঁও করে ওঠে। এই ঘেঁও সাবির শরীরে ছড়িয়ে যায়, তখন তার মাথা ঝিমায়। বাউলের থালা বাসন গ্লাস কলসি চায়ের কাপসহ অনেক কিছু কেন মাটির তৈরি জানতে চায়। ইচ্ছে হলে ঘুমায় না হলে বাউলকে প্যাঁচালে ফেলে : ‘আপনের বউ নাই কেন?’ প্রশ্ন শুনে বাউল হাসে আর বলে, ‘বাউল দুই প্রকার, বউওয়ালা বাউল বউছাড়া বাউল।’ আর? ‘সংসারি বাউল সন্ন্যাসী বাউল।’ আর? ‘খাদের বাউল বদের বাউল।’ ‘খাদের বাউল কি?’ হালি বাউল বলে, ‘খাদের বাউল হলো, যে সবসময় মৃত্যু চিন্তা করে। খাদ মানে কবর। সাড়ে তিন হাত কবর মাথায় নিয়ে যে বাউল দুনিয়া বিচার করে।’ সাবি বলে, ‘বদের বাউল কি?’ সাবির এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না হালি বাউল। তবুও বলে, ‘তুমি বিবাহিতা হলে বলতাম।’ সাবি শুনে আর চোখের গোলক বড় করে। তার বুকের ভেতরে কি ঘটে কে বলবে। কিন্তু সাতদিন পর ফিরে এসে তার মাকে বলে,  ‘মা, বেটা হিজড়া।’ সাবির মা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে। শুধু মেয়েকে শান্ত করতে বলে,‘গান বাজনা করতে করতে বেটা হেন্দু’ হইয়া গেছে।’ 

হালি বাউল হিজড়া, এ বদনাম জংধরা লোকগুলোর আস্থা আরো প্রশস্ত করে। এখন মেয়েরা আখড়ার ভেতরে বসে গান শুনে। নারী পুরুষ পাশপাশি। মাঝে মাঝে মসজিদের ইমাম সাহেব বাউলের আখড়ায় পলক মেরে দেখে। বলে, ‘গান করেন ভাল কথা, একটু নামাজ টামাজ করেন।’ হালি বাউল বলে, ‘আমি তো সবসময় নামাজে থাকি।’ ইমাম সাহেব বলে, ‘সমাজ তো আপনার সবসময়ের নামাজ দেখে না।’ হালি বাউল বলে, ‘আপনে দেখেন কি না? ঠিক আছে; না দেখলেও বুঝেন কি না!’ ইমাম সাহেব বলে, ‘আমি বুঝলে কি হবে, শরিয়ত যে দিন আপনাকে পাকরাও করবে সেদিন আপনার এসব মারফতি কথায় ভর ধরবে না।’ হালি  বাউল বলে, ‘সে দিন আপনি দুঃখ পাবেন কি না?’ ইমাম সাহেব বলে, ‘যদি পাই ?’ ইমাম সাহেবের সরাসরি এমন প্রশ্নে হালি বাউল বলে, ‘সে দিন আমার মরণ হলেও আক্ষেপ থাকবে না।’ 

সেসব কথা মনের ভেতর ঘুরে ঘুরে এলেও সাবির কথা বেশি বেশি মনে পড়ে। সাবি বেহুশ! হালি বাউলের মন উচাটন। নিজে সংসার না করলেও অন্যের সংসারের প্রতি বাউল কেন এতো কাঁতর নিজেও বুঝতে পারে না। বকাউলকে অনেকবার বলেছে, মেয়েটাকে নিয়ে যাও। মনোযোগ দিয়ে কাজ করো। বকাউলের এক কথা,  সাবিকে গার্মেন্টসের কাজ ছাড়তে হবে। ‘কেন কাজ ছাড়তে হবে?’  ‘সাবি সোজা মাইয়া, প্যাচগোছ কম বুঝে। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য ছেলেরা পাগল হয়ে থাকে।’ হালি বাউল বলেছিল, ‘তুমি লেদমেশিনের কাজটা ঠিক মতো করলে সাবি আর গার্মেন্টসে যাবে না।’ বকাউল বলেছিল,  ‘আমি তাতে রাজি। কিন্তু মাগি তো গার্মেন্টস ছাড়ে না।’ হালি বাউল বলে,  ‘ছাড়বে কীভাবে, তার আছে কে! তোমার সংসার করতে হলে তার মাকেও ছাড়তে হবে! এমন নিষ্ঠুর তুমি!’ বকাউল বলে, ‘আমি কি শাশুড়ির ভারও লইবো?’  হালি বাউল ভেবে পায় না,সাবির মাকে কোথায় রাখা যায়। মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ নেই। নারকেলের শলার ঝাটা দিয়ে সাবির মা’তো সাবিকে মারে নি, মেরেছে নিজেকে। এখন তো মেয়ে চলে গেলে মারার লোকও পাবে না, আশ্রয়ও জুটবে না। হালি বাউল দোতরার পাশে হালে নিমজ্জিত হয় আথবা  দোতরাটি তার পাশে পড়ে গভীর নিস্তব্ধতাকে আহ্বান করে। বাদল দলবল নিয়ে ফিরে এলে হালি বাউল তাকে চলে যেতে ইশারা করে। তারপর আবার হালে পড়ে। সাবি গর্মেন্টসে যাওয়ার সময় অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে। আসার সময়ও বলে। বয়স তো বলার। গার্মেন্টসের ভেতরে দুপুরের খাবার সময়ও বলে। তার মোবাইল আছে। হয় তো সেল্ফিও  তোলে। সেই সেল্ফি আবার বকাউল দেখে। ছেলেরা এনে দেখায়। হয়তো সকলে দেখায় না। কেউ না কেউ দেখায়। তারপর বকাউল উত্তেজিত হয়ে সাবিকে ... করে।  বকাউলকে পুলিশে ধরে। বকাউলের হাতে হাতকড়া। বকাউল বলে, ‘এই মাগি আমার বউ কিন্তু আমার ঘরে থাকে না। গার্মেন্টসের পোলাপাইনদের  লগে প্রেম করে। কত পোলাপাইন তার জন্য পাগল।’

হালি বাউল হালের ভ্রমণে আরও দূরে যায়। গুনিন তাহলে কী বলেছে! যে কথা শুনে সাবি বেহুশ হয়ে গেল। সে তথ্য জানার জন্য বাদল একাই যথেষ্ট। কিন্তু একটা পাপ তো আমি (হালি বাউল) করে ফেলেছি। বকাউলের মুখ দিয়ে সাবিকে মাগি বলিয়েছি (যদিও বকাউল প্রকাশ্যে সাবিকে মাগিই বলে)। তখন হালি বাউল মনোযন্ত্রণায় শুকনো শিম পাতার মতো কুঁকড়ে যায়। হালি বাউল পশ্চিম দিকে মাথা নত করে সেজদায় পড়ে প্রভুর কাছে ক্ষমা চায়। ...যে মেয়েটি আমাকে হিজড়া বলেছিল, তাকে আমি তার স্বামীর কণ্ঠে মাগি বলালাম, এ বিরোধের বীজ আমার চিন্তার ভেতর রয়ে গেছে। ও আমাকে হিজড়া বলেছে এর প্রতিশোধ আমি নিজে নিয়েছি, প্রভু ক্ষমা করো? প্রভু, সাবিকে তার জামাইর সিনায় দাও। লেদমেসিনটায় দাও, লেদমেসিন, লে দম সিনায়, ল দম সিনায় ... ল দম সিনায়...

চোখের জলে হালি বাউলের নাক মুখ ভিজতে থাকে। কিন্তু এভাবে  সেজদায় দিনের বেলায় এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। কেউ ইচ্ছে করলে দেখে নিতে পারে। এমন সেজদা শুধু রাতে সম্ভব। হালি বাউল মস্তক তোলে বাদলকে দেখতে পায়। বাদল ছটফট করে। তার পেটে লাহাবি (আগুনি) কথা। এ কথা বলতে না পারলে  বাদল  আস্তা পুড়ে যাবে।
 

‘সাঁইজী ভয়াবহ খবর।’
‘কি খবর?’

 ... সাঁইজী,  হুশ  ফিরে এলেই সাবি বলে, আপনার এখানে আসবে। তার মা বলে, কেন?  সাবি বলে, যা বলব বাউলকে বলব। সাবির মা হাতে দা নিয়ে বলে, বেটারে হিজড়া কইয়া অপমান করলি এখন আবার বেটার কাছে যাবি; গুনিনের  বিরুদ্ধে কইতে। তোর তো কেউ আপন না। আমিও না! তখন সাবির মা বুঝে উঠার আগে সাবি টান মেরে দা নিয়ে গুনিনের দিকে তেড়ে যায়। 

হালি বাউলের মন বাদলের কথা থেকে পিছলে যায়। হালি বাউল বলে, ‘বাদল, গুনিনকে আনার ব্যবস্থা করো। জোর করো না। নিজে আসতে চাইলে..।’ 

হালি বাউলের কথা বলতে কষ্ট হয়। রাগে অভিমানে তার গলায় কষ ধরে গেছে। 

‘বাদল একটু চা করো তো।’
বাদল চা তৈরিতে ব্যস্ত হয়।

গুনিন লম্বা কাইকে পালাইছে। কেউ বলে চর্কি দৌড়ে পালাইছে। এমন দৌড়! পরানের মার ছোট ছেলেটার পায়ে দড়ি ছিল, পরানের মা গার্মেন্টসে যাওয়ার সময়  ছেলের পায়ে দড়ি দিয়ে যায়। তা না হলে রাস্তায় গিয়ে রিক্সার তলে ছেলেটা পড়বে। সেই দড়িতে পা লেগে গুনিন গইড় খেয়েছিল। ছেলেটার পায়ের চামড়া ছোলে যায়। গুনিন ওঠে আবার দৌড়ায়। গুনিন ঘুরে দাঁড়ায়নি কারণ সাবির হাতে দা ছিল। ঝক ঝকে দা। মাছ কাটার দা। দুলু খালুর দা। দুলু খালু বাজারে মাছ কাটে। বাজারে আনতে নিতে গামছা জড়িয়ে রাখতে হয় এ দা। সঙ্গে দা থাকলেও বুঝা যায় না। সাবধানে রাখতে হয়। যখন সারা দেশে আগুনে মানুষ পোড়ানোর মচ্ছব চলছিলো তখন দুলু খালুকে পুলিশে ধরেছিল। পুলিশ বলেছিল, মাছ কাটার জন্য এমন ঝক ঝকে দা; না কি মানুষের রগ কাটার জন্য, বেটা থানায় চল্। তুই প্রমাণ দিতে পারলে ছাড়ব। সেদিন হালি বাউল আর মসজিদের ইমাম থানায় গিয়েছিল দুলু খালুকে ছাড়িয়ে আনতে। তাদের দুজনকে দেখে থানার দারগা বলেছিল, ‘ওরে বাপ, সাপে নেউলে এক সাথে, আমি তো দা-ওয়ালাকে রাখতে পারব না। কিন্তু একটা কথা বলুন তো দুজনের প্রেম কী করে হল?’ হালি বাউল বলেছিল, ‘সাঁইয়ের অপার লিলে।’ ইমাম সাহেব বলেছিল, ‘আমি লিলামিলা বুঝি না, আল্লার মহিমা বুঝি। থানায় আসতে হবে আমি কি জানতাম।’  জীবন ক্ষুদ্র কিন্তু এর রহস্য বেশুমার।

ইমাম সাহেব এবং হালি বাউলকে থানার দারগা সেদিন চা খাইয়েছিল। দারোগা বলেছিল,  ‘আপনারা না এলে তো এই দুলাল মিয়াকে কোর্টে চালান করে দিতাম।’

চা খেতে খেতে হালি বাউল থানার চা খাওয়ার দৃশ্যে নিমজ্জিত হয়। দৃশ্য মুছে গেলে দায়ের চিহ্ন থেকে যায়। একটা ঝকঝকে দায়ের সামনে আলি গুনিন ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দাঁড়ালে কি খুন হয়ে যেত? পরানের মার ছেলের পা বাঁধা দড়িতে যদি প্যাঁচিয়ে আটকে যেত তখন কী হত। কি এমন কথা বলেছিল গুনিন এই মেয়েকে যে কারণে মরণদৌড় দিতে হলো।   

তিনদিন পর বাদল এসে খবর দেয়, সাবি গার্মেন্টসে যায় না। গুনিনকেও পাওয়া যায় না। গুনিন তার গ্রামের বাড়িতেও নেই। হালি বাউল মাথা নাড়ে। 

বাদলকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি তিন দিন কী করেছো? বাদল বলে, মানুষ কত কথা বলে, ঘুরে ঘুরে এসব শুনেছি। মানুষ কী বলে? বাদল বলে, ‘আমি এসব মুখে আনতে পারব না।’ ‘আরে মিয়া আমাকে হিজড়া বলার চেয়ে কঠিন কি না?’ বাদল  নিশ্চুপ। এ নিশ্চুপ অবস্থা ভাঙার জন্য হালি বাউল চেষ্টা করে না। এলাকার সমস্ত জং ধরা অবস্থার ওপর নিশ্চুপ আবহটি চেপে বসলে নতুন সংবাদ ছড়ে-সাবি বকুর সঙ্গে চলে গেছে। বকু সাবির মাকেও নিয়ে গেছে। বকু এখন মনোযোগ দিয়ে লেদ মেশিনের কাজ করে।

অনেকদিন পর গুনিনের দেয়া প্রস্তাবটি বিভিন্ন আকৃতিতে ভেঙে যায়।  প্রস্তাবটি শুনার পর কেউ কেউ বলে-যে মেয়ে হালি বাউলকে হিজড়া বলে, সে গার্মেন্টসের পুলাপানদের সঙ্গে হাসতে পারে, মোবাইলে সেল্ফি তুলতে পারে, হাঁটতে গিয়ে গায়ের সঙ্গে গা লাগতে পারে। কিন্তু বকু হারামজাদার সংসার ভাঙবে এমন কাজ করতে পারে না। কেউ বলে, এসব বকাউলের সাজানো নাটক। কেউ বলে, যা হবার ভালোর জন্য হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যক্তিই গুনিন কী বলেছে তা নিয়ে রা করে না অথবা করলেও উদোম কথার তিনমাত্রার ধরণ পেরিয়ে এই কথা অন্যকোনো আশ্রয়ে থাকে।

হালি বাউল লোকমুখের কথাগুলো জোড়াতালি দেয়। জোড়া পেয়ে কথাগুলো একেক সময় একেক রকম হয়ে যায়। হালি বাউল গুনিনের মুখে শুনতে চায়, আসলে সে কী বলেছিল। কিন্তু গুনিন নাকি হালি বাউলের ভয়ে এদিকে আসে না। 
হালি বাউল দোতরায় মন দিতে পারে না। একজন লোক তার ভয়ে এলাকায় আসে না। তার পেট চলে কি করে। ও তো একটা ভুলের কারণে দিশেহারা হয়ে যাবে। হালি বাউলের মনের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করে বাদল।

তারপর একদিন আকাশ কেমন অন্ধকার করে। চোখের কাছে হাত মেলে ধরলে হাত দেখা যায় না। অমারাত্রি। এলাকার সোয়ারেজের খোলামুখে, যেখানে সভ্যতার তরল গতির অন্তহীন তীব্র অখোশবু বাতাসকে মাতিয়ে রাখে সেখানে গুনিনকে রেখে হালি বাউলকে আখড়া থেকে বের করে আনে বাদল। বাউল যতবার বলে, ‘বাদল, আমাকে কোথায় নিয়ে চলছো।’ বাদল ততবার বলে, ‘আপনার দুতরায় জং ধরছে।’ বাউল বলে, ‘আমি এখানে থাকব না।’ বাদল বলে, ‘কেন থাকবেন না?’ বাউল বলে, ‘একজন লোক আমার কারণে এ এলাকায় আসে না। আমি চলে গেলে সে আসবে।’ বাদল, হালি বাউলের কথায় হাসে। বাউল বলে, ‘হাসছ কেন?’ বাদল বলে, ‘সাবিকে বলে ছিলেন, বাউল দুই প্রকার, বদের বাউল, খাদের বাউল। বাউল সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে এসব বলেছেন। সাবি আপনাকে হিজড়া বলাতে আপনার সুবিধা হয়েছিল। সাবি যদি সে দিন আপনার কাছে কিছু চাই তো, আপনি তখন কিসের বাউল হতেন?’ প্রশ্ন শেষ করে বাদল মনে মনে গুন গুনায় :

বদের বাউল আসল বাউল। 
খাদের বাউল মাটি।
হালি বাউল বোকা আউল। 
বেড় সরালে টাটি।
টাটির ভেতর নড়ে চরে
হলদে পোকার প্রাণ
কার কান্দনে কে কান্দে
যাবে হালি বাউলের মান

হালি বাউল বলে, ‘আমি যতটুকু বুঝি, তুমিতো বস্তির লোক না। পাশের মহল্লা থেকে আস, তুমি সাবিকে পছন্দ করো। কিন্তু সাবি গরিব ঘরের মেয়ে বলে তুমি সাহস করো নি। আর যে সাহস করেছে সে তাকে কষ্ট দেয়। তুমি এখন সাবির কোনো বিপদের কথা শুনলে দৌড়ে প্রথম হয়ে যাও। তুমি আমাকে সাবির নতুন ঠিকানায় নিয়ে চলছো! সাবি কি আবার নতুন কোন বিপদে পড়েছে?’ 
বাদল আবার নিশ্চুপ।

অন্ধকারের তিনটি পরত পাশা পাশি। কেউ কাউকে দেখে না। আলি গুনিনের মুখে কুলুপ আঁটা। কেউ কথা বলতে নিষেধ করেনি। কিন্তু বাদল যেন শব্দহীন ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছে, চুপ থাকবে। হালি বাউল প্রশ্ন করলে কথা বলবে। তিনজন তিজনকে দেখে এবং দেখে না। আজকে আবার কোথায় যেন  ট্রান্সমিটারে শব্দ হয়েছে। বিদ্যুৎহীন ঘন অন্ধকারের সঙ্গে লম্বা পথের বাঁকে সভ্যতার তরল অস্তিত্বের ওপর বাতাসের ঢেউ। তিনজনেই অভ্যস্থ। হালি বাউল হালে নিমজ্জিত।  ... কী হবে তাদের দেখা পেয়ে! সাবি বকু সাবির মার দেখা পেয়ে কী হবে! যে কথা বাতাসে ভেসে ভেসে থিতু হওয়ার পথে, সে কথার লেজ ধরে আবার কার মুখ বিবর্ণ করা হবে এখন।
হালি বাউল কঠিন পাথরের মতো পথ আগলায়।

... দাঁড়াও আলি।

এমন কণ্ঠে বাদলও দাঁড়িয়ে যায়। হালি বাউল যেন অন্ধকারেও দেখে। হালি বাউল বলে, ‘আলি, তুমি খারাপ প্রস্তাব করেছিলে সাবিকে।’ আলি গুনিন জমাট অন্ধকারে ঢোঁক গিলে ‘হাঁ’ বললেও বাদল এবং হালি বাউলের কানে সেই শব্দ পৌঁছে না। বাদল অনুমান করে, আলি গুনিন দায় স্বীকার করেছে। হালি বাউল বলে, তুমি সাবিকে বলেছিলে, ‘সাবি যদি কোনো পর পুরুষের সাথে রাত্রি যাপন করে। পরে গোসল না করে স্বামীর সাথে নিশি কাটায় তাহলে তার সংসার কোনো দিন ভাঙবে না। তুমি এই প্রস্তাব দাওনি?’ এ প্রশ্ন শুনে আলি গুনিন মাটিতে বসে যায়, ভাঙা ভাঙা বাক্যে বলে, ‘সাঁইজী আমি অনেকদিন আপনার আখড়ায় গেছি, কারও দিকে আড়চোখে তাকায়নি।’ বাদল অন্ধকারে ফনা তোলা ফানকের মতো হিসহিসায়, তার ডান পা আলি গুনিনের শরীর বরাবর উঠে গেলে হালি বাউল আন্দাজে বলে, ‘বাদল সাবধান! গুনিনের শরীরে কোনো আঁচড় যেন না লাগে।’ অন্ধকারে হালি বাউলের আন্দাজে বাদল চমকে যায়। বাদল ভাবে লোকটা শিক্ষিত হলেও  মনটা কাঁচা। অথচ কত শিক্ষিত মানুষের মন মরে গেছে। 

হালি বাউল তখন বলে,‘ গুনিন, তুমি টেস্ট করতে চেয়েছিলে মেয়েটার চরিত্র কেমন, তাই না? যখন তোমাকে দা নিয়ে দৌড় লাগাল তখন দেখলে সাবি পরীক্ষায় পাস কিন্তু এলাকার লোকজন রহস্যের কিনারা করতে পারল না। বাদল তোমাকে ওই এক সপ্তাহর মধ্যে পেলে জবাই দিত। পালিয়ে থেকে ভালোই করেছ।’

আলি গুনিন কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে, ‘সাঁইজী, বাদল ভাই যে দিন আমার ঘরে গিয়েছিল সেদিন আমি দরজার পিছে লুকিয়ে ছিলাম। আমি আল্লা আল্লা করছিলাম। ধরা পড়লে  আমি শুধু একটা আরজি করতাম; আমারে যেন আপনার কাছে আনা হয়। আমার বড় মেয়েটা বার বার বলছিল, ‘কি হয়েছে বাবা, বাদল কাকাকে দেখে তুমি লুকালে কেন!’ আমার সে দিন মরে যেতে ইচ্ছা হয়েছিল সাঁইজী। খোদার গজব কেন আমার ওপর পড়ল না।

‘তোমার হুস তো কম না! তাহলে তুমি এমন কথা কেন সাবিকে বলতে গেলে?’
এ প্রশ্ন শুনে আলি গুনিন কাঁদে। গুন গুন করে কাঁদে।

 হালি বাউল বলে, ‘কান্না থামাও। জানি, তোমার হাতে আর কোনো বিদ্যা ছিল না। এই বদ বিদ্যা তোমাদের বাপ দাদার আমল থেকে ব্যবহার করে আসছ। কিন্তু তোমার বাপ দাদার আমল কি এখন আছে?’ 

হালি বাউলের কথা এক বিন্দুও আলি গুনিনের কানে প্রবেশ করে না। সে যেন আরও জোরে চিৎকার করে কাঁদে। অভয় পাওয়া কান্না। অথবা বাদলের হাত থেকে মুক্তি পেতে নিশ্চয়তা আদায়ের কান্না। অন্ধকারের কান্না বড় নিদারুন। কেউ কাউকে দেখে না। এ কান্না বাদল এবং হালি বাউলকে স্পর্শ করে। যেন তিনজনই কাঁদে। একজনের ভেতর তিনজনের কান্না। 

তখন হালি বাউল বলে, ‘চল সাবিদের ঢেঁড়ায় চল। চল বাদল চল।’ 

যেতে যেতে হালি বাউল সাবির পূর্ণ নাম নিয়ে বলে, সাবিনা নাকি এখন গার্মেন্টসে যায়!
বাদল এবং  গুনিন একসাথে বলে, ‘হঁ... সাঁইজী।’

menu
menu