শিকার
ডাক্তার আজিজ শৌখিন মানুষ। রোমান্টিকও বলা যেতে পারে। কাঠের গব্দা গব্দা রদ্দা দিয়ে তৈরি টেবিল, টেবিলের চারদিকে চারটা হাতলওয়ালা অমসৃণ সেগুনকাঠের চেয়ার। দামি কাঠের এই এক গুণ, মসৃণতা ছাড়াও সুন্দর লাগে। ডাক্তার আজিজ নিজ হাতে টেবিলটা বানিয়েছে বারান্দায় বসে চা-কফি খেতে খেতে কেবল ঝুম বৃষ্টি আর জোছনা উপভোগ করার জন্য। চওড়া বারান্দার সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা লন, তার পরেই পাহাড়ের ঢাল, ঢালে লাগানো লেবুগাছের কচি পাতা বারান্দা থেকে দেখা যায়।
সামনের পাহাড়ে যেখানে লাল বাটনা আর কনকগাছের জড়াজড়ি সেখানে চাঁদ উঠেছে, বাইরে ঢলঢলে জোছনা। বারান্দার লাইট না জ্বালালেও চলে, তবু আলো জ্বলছে। এক্ষুনি একটা জরুরি আলোচনা সেরে ফেলতে হবে। জরুরি আলোচনার জন্য পরস্পরের চোখের অভিব্যক্তি দেখা জরুরি। ম্যানেজার মিরাজ হোসেন আর অ্যাকাউটেন্ট আবু হেনা ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করে। ডাক্তার আজিজ পাশের রুমে ঢাকায় জরুরি আলাপ করছে। আলাপ শেষে বৈঠক শুরু হবে।
মিটিং নিয়ে সবাই একসাইটেড। ডাক্তার আজিজ পঁয়ষট্টি কিন্তু দেখতে পঞ্চাশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে একবছর পড়ার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। বন্ধুরা উপহাস করে ডাক্তার আজিজ ডাকতে থাকে; সেই ‘ডাক্তার’ উপাধিটাই নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে।
ক্ষিপ্ত গতিতে ডাক্তার এসে চেয়ারে বসে, তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।‘বনমোরগ পাওয়া যাবে? তারা বনমোরগ খেতে চেয়েছেন’—কথাটা বলার সময় ডাক্তার হাতের এমন একটা ভঙ্গি করে যাত মনে হবে একটা বনমোরগ একাই ধরে ফেলবে।
‘পাহাড়ে মোরগের অভাব আছে? কতগুলো খাবে তারা?’
‘আহারে মিরাজ সাহেব, বিষয়টা হালকাভাবে নিচ্ছেন কেন? তারা বনমোরগ খেতে চেয়েছেন, পাহাড়ের দেশি মোরগ নয়। এখন বনমোরগ কীভাবে পাওয়া যায় সেটা বলেন।’
‘গাছপালা কেটে যেভাবে উজাড় করা হচ্ছে সেখানে পাহাড়ে বনমোরগ পাওয়া যাবে কীভাবে। দু-একটা যা-ও দেখা যায় তা আবার একেবারে ভিতরের দিকে, দুর্গম পাহাড়ে। এগুলো ধরা মুশকিল।’
মিরাজ কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আবু হেনা বলে,‘এগুলোতে মাংসই বা কতটুকু থাকে! এর মধ্যে কী স্বাদ আছে কে জানে।’
ডাক্তার গলা ভারী করে বলে,‘এসব কথা আমি জানি কিন্তু বনমোরগ কীভাবে পাওয়া যাবে সেটা বলেন।’
আবু হেনা আবার বলে, ‘আপনি কি বলেননি পাহাড়ে এখন বনমোরগ পাওয়া যায় না?’
‘বলেছি কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। এ নিয়ে বেশি তর্ক করা যায় না। এত টাকা যেখানে বিনিয়োগ করছে সেখানে কিছু উলটাপালটা আবদার তো করবেই।’
আবু হেনা মনে মনে ভাবে, আরও অনেক আবদার আছে নিশ্চয় তাদের। এসমস্ত লোকের আবদারের কোনো শেষ থাকে না। এরপর বলবে পাহাড়ি তরুণীর ব্যবস্থা করতে হবে। সমতলের কিছু লোক মনে করে পাহাড়ি তরুণীরা অতি সুলভ।
‘মদের কথা বলেছে। আমি বলেছি যত খুশি খেতে পারবেন, কোনো অসুবিধা নেই।’
আবু হেনা আবার বলে, ‘পাহাড়ি মেয়ের কথা বলেনি?’
ডাক্তার মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ বলেছে। আমি বলেছি মাফ করবেন, এ বিষয় ছাড়া যে-কোনো বিষয়ে আবদার করতে পারেন।’
‘বলেছি না, এ ধরনের সুযোগ হাতছাড়া করে নাকি!’
মিরাজ অস্পষ্ট স্বরে বলে,‘খচ্চরের বাচ্চা খচ্চর।’
‘এসব আলোচনা থাক, আমরা মূল ইস্যুতে আসি। টিটু ভাই আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। লোক একবোরে খারাপ না। এখন অনেকটা লুম্পেন হয়ে গেছেন। লুম্পেন বোঝেন তো?’
মিরাজ আর আবু হেনা চুপ করে থাকে।
ডাক্তার তাদের দুজনকে একবার দেখে নিয়ে বলে, ‘না বুঝলে থাক। সে-ই তো আমাকে খুঁজে বের করে প্রস্তাবটা দিলো। অন্য কাউকেও তো দিতে পারত। এখন আমাদের যে-করেই হোক তাদের ইমপ্রেস করতে হবে।’
পায়ের কাছে বসে থাকা বাকের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ডাক্তার আজিজ মার্কেটিং ম্যানেজার জিরন বিকাশ ত্রিপুরাকে কল করে।জিরন বোধ হয় আশপাশেই ছিল, তাই কল করার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের মতো এসে হাজির।
‘জিরন, আগামীকালের মধ্যে বনমোরগ শিকারি চাই।’
‘স্যার, বেলছড়িতে আমার চেনা একজন আছে। অনেকদিন যোগাযোগ নেই। আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাব।’
‘কখন জানাবে? আজ রাতেই জানাবে। আমাদের হাতে সময় কম, আট-দশটা বনমোরগ লাগবে।’
জিরন বিকাশ ত্রিপুরার সঙ্গে মিরাজ ও আবু হেনা চলে যাওয়ার পর ডাক্তার লাইট অফ করে দেয়। বরফের চাঁই দেওয়া গ্লাসে মদ ঢালতে থাকে। জোছনা এসে মদের স্বচ্চ গ্লাসে লুটোপুটি খায়। এতক্ষণ আমের মুকুলের মৌ-মৌ ঘ্রাণটা চাপা পড়ে যেতে থাকে দোচোয়ানির ঘ্রাণে। একটু পরেই ঘোরের মধ্যে চলে যায় ডাক্তার।
তাকে কে যেন বলে,‘ডাক্তার, আর দেবো?’
‘দাও’
‘একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘না, মোটেই বেশি হচ্ছে না। বেশি হলেইবা কী?’
২
লোকটার প্রশস্ত কপালের ওপরে কোঁকড়ানো খাড়া চুল। খাড়া নাক, শক্তপোক্ত শরীর। এমনিতেই গায়ের রং সাদা ফরসা, তার ওপর পরেছে কালো প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট। দূর থেকে দেখলে কলেজ স্টুডেন্টই মনে হয়, আরেকটু কাছে এলে মনে হয় স্কুলটিচার। এরকম একজন সুদর্শন লোক শিকারি বনমোরগ নিয়ে কেন ঘোরে?এক দেখায় বোঝার উপায় নেই চাকমা না মারমা জাতির লোক। ট্রেনের টিকিট কালেকটরদের মতো শরীরের সঙ্গে আড়াআড়ি একটা মোটা ফিতায় বাঁধা কালো কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগের নিচের দিকে মোরগের লেজের রঙিন পালক বের হয়ে আছে, তার নিচে দুইটা পা, পায়ের গোড়ালিতে অঙ্কুশের মাথার মতো ধারালো নখর।
‘আপনার নাম কী?’
‘খর্জকুমার ত্রিপুরা।’
‘এ ব্যাগে কী?’
‘এটা বনমোরগ, শিকারি মোরগ। এ মোরগ দিয়ে বনের মোরগ ধরি।’
‘বনমোরগকে কী বলেন আপনারা?’
‘বুলংনি তক। বন হচ্ছে বুলংনি, আর তক হচ্ছে মোরগ।’
‘পায়ের কাছে ধারালো এটা কী দেখা যাচ্ছে?’
‘এটা নখর, আমরা বলি যাকচিং। এটা খুব ধারালো। এ নখর দিয়েই আত্মরক্ষা করে।’
কথাটা বলে খর্জ ডাক্তার আজিজের ডান হাতের তর্জনীর মাথাটা এনে নখরের ওপরে রাখে।
‘বুঝতে পারছেন স্যার, কতটা ধারালো?’
‘মোরগটা কি দেখানো যাবে?’
‘জি না স্যার। শিকারি মোরগের আলো দেখা নিষেধ, নইলে তেজ কমে যায়।’
‘কীভাবে বনমোরগ ধরেন বলেন তো।’
খর্জ ত্রিপুরা ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে বনমোরগ ধরার গল্প বলে।
‘জঙ্গলের মধ্যে জালের মতো একটা ফাঁদে এই শিকারি মোরগটা রাখি। এর ডাকাডাকিতে বনের মোরগ ছুটে আসে একে মারার জন্য, আর তখন বন্য মোরগটা আটকা পড়ে যায়।’
‘শোনেন খর্জ, আমাদের ঢাকা থেকে বেশ দামি কয়েকজন মেহমান আসবেন, তারা বনমোরগ খেতে চেয়েছেন। আপনি তাদের জন্য কয়েকটা বনমোরগ দিতে পারবে?’
‘পারব স্যার। টাকা দিলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়, এটা তো সামান্য বনমোরগ।’
‘ভেরি গুড। আপনি ঠিক বলেছেন। আমি একমত।’
খর্জ ত্রিপুরাকে দেখতে বোকাসোকা মনে হলেও সে আসলে বোকা নয়।
‘আমাদের বেশ কয়েকটা, এই ধরেন দশ বারোটা লাগবে। দিতে পারবেন তো?’
‘পারব। এ নিয়ে সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে দাম একটু বেশি পড়বে।’
‘দাম নিয়ে চিন্তা করবেন না। সময় কিন্তু তিন দিন। আচ্ছা, আরও একদিন সময় দেওয়া হলো। আর কোনো কথা নয়। জিরন, খর্জবাবুকে কিছু টাকা দিয়ে দাও। বাকি টাকা মোরগ দেওয়ার পর দেবে।’
৩
পিছনের সিটে আরাম করে বসে বাক অনেক আগ্রহ নিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে। লম্বা জিহ্বাটা ঝুলে আছে। পাশের সিটে বাকের হার্নেস হাতে মহিম। বাক যখন রাস্তায় কুকুর দেখে ভুক ভুক করে গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় তখনই মহিম লাগাম টেনে ধরে।
ডাক্তার আজিজ গাড়ি চালায়। উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে কবুতরছড়ির দিকে। গাড়িটা দেখতে লক্করঝক্কর হলেও কলকব্জা মজবুত আছে। পুরানো জিনিসের এই একটা সুবিধা। মেইন রোড থেকে কবুতরছড়ির দিকে ঢুকতে উঁচু স্থানটায় গাড়ি যখন থামে তখন সূর্য পশ্চিম দিকের পাহাড়ের কিছুটা ওপরে। পাহাড়জুড়ে গাছপালায় উজ্জ্বল লাল রং ধরেছে। ডাক্তার খেয়াল করে তার শরীরের রংও রঙিন হয়ে গেছে। গাড়ি রেখে কবুতরছড়ির দিকে হাঁটতে থাকে সে। তার পাশে পাশে বাক দৌড়াচ্ছে আর দেশি কুকুর দেখলে তাকে ধরতে চাইছে।
পড়ন্ত বিকালের হালকা বাতাসে দৌড়াতে দৌড়াতে যে স্থানটায় এসে থামে তা ভারি সুন্দর। উঁচু উঁচু গাছের নিছে রাস্তার উভয়পাশে কয়েকটা দোকান। দোকানে পাহাড়ি নারী-পুরুষ আড্ডা দিচ্ছে। তারপর রাস্তাটা যে পাহাড়ের দুপাশ দিয়ে চলে গেছে, সেই পাহাড়ের চূড়ায় চাকমাদের বৌদ্ধমন্দির। ভগবান বুদ্ধের আবক্ষমূর্তি রাস্তা থেকে দেখা যায়। সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। এর আগে হাতের ডানে একটা পাহাড়ে যে বৌদ্ধমন্দিরটা আছে সেটা মারমাদের। বুদ্ধের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার আজিজ ভাবে, এমন দুর্গম ও নির্জন স্থানে কেন বৌদ্ধমন্দিরগুলো হয়ে থাকে? সাধনার জন্য কি নির্জনতা জরুরি? ভগবান কি কোলাহল অপছন্দ করেন?
কতদিন এবেন্তুর খোঁজখবর নেওয়া হয় না। ডাক্তার সোজা এবেন্তুর টি-স্টলে ঢুকে দেখে এবেন্তু নেই, তার মেয়ে রেবা চা বানাচ্ছে। সে ডাক্তারকে খেয়াল করেনি।
‘আরে বাবু তুই কখন আইছে! তুই এতদিন কোথায় আছ?’
‘এবেন্তু কই? তাকে দেখছি না যে?’
‘মা অসুস্থ, সাত দিন বিছানায় আছে, কেবল তোমারই কথা বলে।’
ডাক্তার আজিজ তড়িঘড়ি চা খেয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঝিরি ধরে এবেন্তু মারমার বাড়ির দিকে রওনা হয়।
এবেন্তু ঘরের সামনে মাচার ওপর পা মেলে বসে দাবায় টানা দিচ্ছে। তাকে যতটা অসুস্থ মনে করেছিল সেরকম অসুস্থ নয়, হয়তো এই কয়দিনে সুস্থ হয়ে উঠেছে।
‘তোমার এতদিনে আসার সময় হইছে, আমি যে অসুখে মারা যাচ্ছি’, বলে হাতের ইশারায় ডাক্তারকে মাচায় বসতে বলে।‘মেয়েকে বলেছি, বাবু আমার খবর নেয় না কেন?’
‘তোমার কী অসুখ হইছে এবেন্তু?’
‘ফিয়ারে, আমা ফিয়ারে।’
‘ফিয়ারে মানে জ¦র। জ¦র তো এখন নাই।’
‘জ¦র থাকবে কী করে, বৈদ্যের ওষুধ খাইছি।’
‘তোমার জ¦র এমনি ভালো হয়েছে, বৈদ্যের ওষুধে নয়। কয়টা দিন অপেক্ষা করো, তোমাদের এখানে সপ্তাহে একদিন একজন ডাক্তার বসানোর ব্যবস্থা করব।
‘তোর ডাক্তারের কাছে আমি গেলেই তো।’
ডাক্তার এবেন্তুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। পাহাড়ের আড়াল থেকে নরম কমলা রং ছড়িয়ে পড়ছে। গোধূলির আর বেশি সময় নেই। এত অল্প সময়ে আলো এতটা রং বদলাতে পারে সে আগে কোনোদিন খেয়াল করেনি।
এমন সময় জিরনের ফোন,‘স্যার বনমোরগের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’
৪
‘তা হলে আমাদের সব আয়োজন সম্পন্ন। যে বনমোরগ নিয়ে আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল সেটা হয়ে গেছে। আমাদের বাগানের ফল, খামারের গরুর দুধ, চাষের সবজি, কারখানার মিষ্টি, ঘি, দই, মধু সবই আমরা একটু একটু করে গেস্টদের সার্ভ করব। আগে থেকে সব যেন প্রস্তুত থাকে।’
কথাগুলো বলে ডাক্তার আজিজ পায়চারি করতে থাকে।
মানেজার মৃদু স্বরে ‘জি স্যার’ বলে সম্মতি জানালে ডাক্তার বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,‘এভাবে মিনমিন করে উত্তর দিলে বুঝব কী করে। আরও স্ট্রংলি জবাব দিতে হবে। আপনি কি বুঝতে পারছেন, যারা আসছেন তারা আমাদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় মিরাজ।
‘মাথা নাড়লে হবে না, আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি যাতে না হয় সেদিকে সতর্ক হতে হবে।’
‘আমাদের লিংটা যিনি ধরিয়ে দিয়েছেন, টিটু ভাই, তার কথা বোধ হয় আগেও বলেছি,তার ঘন ঘন চা-সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস। তার যেন চা-সিগারেটের কোনোত্রুটি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।’
‘আপ্যায়নের বাইরে আর কী ধরনের উদ্যোগ নিতে পারি তাদের ইমপ্রেস করার জন্য?’
আবু হেনা বলে, ‘আমরা একটা সময় যে ক্ষিরমোহন বানাতাম, মেহমানদের সৌজন্যে সেটা আবার বানাতে পারি না? গেস্টদের জন্য অল্প কয়েকটা আরকি।’
‘ইকজেক্টলি! আমিও এরকম ভাবছি। তা হলে জিরন কী করতে হবে?’
জিরন বলে, ‘নতুন কিছু করতে হবে না স্যার, কারিগরকে বললেই হবে। আমরা এই ক্ষিরমোহনের নতুন নামও দিতে পারি।’
এ সময় পাহাড়ের ঢালের দিক থেকে বাতাবিলেবুর ফুলের ঘ্রাণ আসে। বাতাবিলেবুর ফুলের ঘ্রাণটা যে অদ্ভুত মিষ্টি হতে পারে আগে কখনও মনে হয়নি। ডাক্তারের প্রিয় ঘ্রাণ ছাতিমের। এ ছাতিমের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য কত পাগলামিই না করেছে একসময়। তার স্ত্রী আসমার অসম্ভব প্রিয় ছিল ছাতিমের ঘ্রাণ। এ পাহাড়ে এসেছে পাঁচ বছর হয়ে গেছে অথচ একটা ছাতিমের চারা লাগালে এতদিনে কত বড়ো হয়ে যেত! কতবার মনে মনে ভেবেছে ঘরের সামনে পাহাড়ের ঢালুতে একটা ছাতিমগাছ লাগাবে। কিছু কিছু আলস্য ক্ষমার অযোগ্য, এটাও সেরকম।
‘ঘ্রাণটা তো খুব দারুণ। এদিকটায় বাতাবিলেবুর ঘ্রাণ কোত্থেকে আসছে? আমাদের বাতাবিলেবুর গাছ যে-কয়টা আছে সেগুলো তো গরুর শেডের পাশে।’
মিরাজ বলে, ‘স্যার, লোঙ্গার মধ্যে দুইটা বাতাবিলেবুর কলম লাগাইছিলাম গত বছর, তার একটাতে ফুল এসেছে।’
লম্বা করে একটা নিশ্বাস নিয়ে আজিজ বলে, ‘আমরা ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি।’
জিরন বলে, ‘স্যার, আমরা খামারে যতগুলো গাছ আছে সেগুলোর গায়ে চুন লাগিয়ে দিতে পারি, তারপর বৃক্ষরোপণের একটা ছোটো আনুষ্ঠান রাখতে পারি। এই ধরেন দেবদারু বৃক্ষ লাগাতে পারি।’
আবু হেনা বলে,‘দেবদারু কেন? মানুষ ফলের কিংবা ফুলের গাছ লাগায়। আমরা আম লাগাতে পারি; যেমন আম্রপালি, কাটিমন, সূর্যডিম এসব আরকি।’
দেশি মোরগের ঝাল ফ্রাই আর মদের গন্ধ মিলেমিশে একটা অদ্ভুত গন্ধ তৈরি হয়। পাহাড়ের ওয়াইনের গ্লাস, বরফের টুকরো, মুরগির ঠ্যাঙের চোবড়া পেরিয়ে জোছনা জানালা দিয়ে ডাক্তারের বিছানায় থাকা কোলবালিশ অবধি চলে যায়। জোছনায় ডুবে যেতে যেতে চোখ ভারী হয়ে আসে আজিজের। ঘুমের মধ্যে সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। জোছনার মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় কতগুলো বাচ্চার মাঝখানে সে বসে আছে, সবার হাতে নতুন বই, রঙিন বেলুন, গায়ে নতুন পোশাক।
৫
মাঝবয়সি একটা লোক বসে আছে ঘণ্টাখানেক থেকে, তার নাম সিরাজউল্লাহ। সে বিখ্যাত বাবুর্চি। মেজবান রান্নায় তার খ্যাতি আছে। সিরাজউল্লাহ বেঁটেখাটো মানুষ। চুলদাড়িতে ঘন করে মেহেদি দেওয়া, মাথায় নকশা করা বাহারি টুপি।
‘স্যার, বাবুর্চি এসে গেছে, আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’
‘বসতে বলো, আমি আসছি।’
ডাক্তারকে দেখে সিরাজউল্লাহ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আসসালামুআলাইকুম।’
প্রথম দেখায় সিরাজউল্লাহকে মনে হয় নিরীহ ধরনের মানুষ। তাকে হাতের ইশারায় বসতে বললেও সে বসে না।
‘আপনি বাবুর্চি সিরাজ? বসেন বসেন।’
সিরাজউল্লাহ তবু দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজের দাঁড়িয়ে থাকায় অস্বস্তি বোধ করে ডাক্তার আজিজ। এরপর খেয়াল করে সিরাজউল্লাহ তার সামনে চেয়ারে বসতে চাইছে না।
‘বসেন, চেয়ারে বসলে অসুবিধা নাই। এখন আর জমিদারি আমল নেই, এখন সবাই সমান।’
‘আপনি সম্মানী মানুষ, আপনার সামনে চেয়ারে বসা বেয়াদবি হবে। সবাই সমান না। আপনি আমি কি সমান? আপনার বিদ্যাবুদ্ধির সঙ্গে কোন আমার তুলনা চলে? আল্লাহপাক মানুষের হাতের পাঁচ আঙুল সমান করে বানায়নি, বানায়নি কাজের সুবিধান জন্য।’
‘আপিন দেখছি অনেক জ্ঞানের কথা জানেন।’
‘দশজনের খাবার পাক করি, দশজনের সঙ্গে কথা হয়। আর পাক করি তো সব খানদানি লোকজনের।’
এখন মনে হচ্ছে সিরাজ কেবল ধূর্ত নয়, বাচালও। তার মুখ থেকে ভকভক পানের জর্দার গন্ধ আসছে। এরকম ধূর্ত টাইপের লোকজন কখনও বাবুর্চি হতে পারে? রান্নার মতো শিল্পের সঙ্গে এ ধরনের লোকের যায় কী করে।
‘আপনি জোর করছেন সে জন্য চেয়ারে বসছি। তবে আদবকায়দার বিষয়টা থাকা দরকার আছে, না হলে সমাজের শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না।’
‘আসল কথায় আসি। আপনি শুনেছেন আমার কিছু স্পেশাল গেস্ট আসছেন। তাদের জন্য রান্না করতে হবে। স্পেশাল রান্না। গেস্টদের মধ্যে একজন ব্যারিস্টার, আরেকজন রিটায়ার্ড কর্নেলও আছেন। বুঝতেই পারছেন কত গুরুত্বপূর্ণ গেস্ট।’
ব্যারিস্টারের কথা শুনে সিরাজউল্লাহ থুতনিতে হাত দিয়ে কিছুক্ষ চুপ করে থাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,‘তাহলে তো বিরাট সম্মানী মানুষ। খানাপিনায় কোনোত্রুটি করা যাবে না।কী কী রান্না করতে হবে?’
‘তাদের খুশি করতে যা যা রান্না করা যায়।’
‘স্যার, খুশি হওয়ার বিষয়টা আলাদা। কেউ ডাল-আলুভর্তা খেয়ে খুশি হয়, কেউ পোলাও-কোরমা খেয়েও খুশি হয় না। বড়ো বড়োমেহমানদের অনেকে নাদান বান্দা, স্বয়ং আল্লাহপাকও তাদের খুশি করতে পারবেন না।’
‘সিরাজ মিয়া, আপনি আবারও জ্ঞানের কথা বলছেন।’
‘জি স্যার।’
‘তারা পাহাড়ে আসছেন, পাহাড়ের কিছু আইটেম রাখতে হবে।’
‘যত আইটেম রাখেন না কেন, ঢাকার মানুষ পোলাও-কোরমা না করলে দুর্নাম করবে।’
‘আচ্ছা সেটাও করবেন। বনমোরগ আছে, ভালো করে বনমোরগ রান্না করবেন। বনমোরগ ব্যারিস্টারের খুব পছন্দ।’
‘বনমোরগের মধ্যে খাওনের কী আছে, শক্ত হাড্ডি ছাড়া কিছুই নাই।’
সিরাজউল্লাহ হঠাৎ চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বলে,‘স্যার, ব্যারিস্টার লোকটা কি ছোটোখাটো ধরনের?’
‘হ্যাঁ, ছোটোখাটো ধরনের।’
‘চওড়া কপাল, চুল পিছনের দিকে আঁচড়ানো?’
‘হ্যাঁ, চুল পিছনের দিকে আঁচড়ানো। আপনি এসব বলছেন কীভাবে?’
‘আনুমান স্যার। আমার অনুমান করার ক্ষমতা আছে। দেখলাম আনুমানের ক্ষমতা ঠিক আছে কি না।’
‘আপনি সব ব্যাপারে অনুমান করেন?’
‘জি না স্যার, বেশি ব্যবহারে গুপ্তবিদ্যার পাওয়ার কমে যায়।’
সিরাজউল্লাহ কি আসলে ধূর্ত না বোকা তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় ডাক্তার। এ বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যায় রাতে জিরন যখন উদ্বিগ্ন হয়ে জানায়, ‘স্যার, সিরাজউল্লাহ জনিয়েছে সে রান্না করতে পারবে না। তার মেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি আছে। সে মেয়ের কাছে চলে গেছে। কবে ফিরবে ঠিক নাই।’
এ খবর শোনার পর আজিজ ভাবে, সিরাজউল্লাহ ব্যারিস্টারের কথা শুনে কি গুটিয়ে গেল? ব্যারিস্টারকে কি কখনও দেখেছে? এসব প্রশ্ন কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে তোলে। পরে সে চিন্তা করে, ব্যারিস্টার আজ কম্বোডিয়া তো কাল লাওস, পরদিন দুবাইতাকে দেখবে কীভাবে?’
সেই রাতে ডাক্তার আজিজ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে : খর্জ ত্রিপুরাকে কতগুলো বনমোরগ ধারালো নখর দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে, তার সাদা জামা রক্তে ভেষে যাচ্ছে। খর্জকে বাঁচাতে তার কাছে যাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই তার কাছে পৌঁছাতে পরাছে না।
৬
সন্ধ্যা নামার আগে আগে পাহাড়জুড়ে একধরনের বিষণ্নতা নামে। সেই বিষণ্নতা কাউকে যদি একবার পেয়ে বসে তা সহজেই কাটতে চায় না। ডাক্তার আজিজকে সে বিষণ্নতায় পেয়েছে। কপাল ভালো হলে সন্ধ্যার পর হু-হু করে যে বাতাস বইবে তখন কেটে যেতে পারে। বিষণ্ন মন নিয়ে বারান্দায় বসে দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ফাইল হাতে এসে হাজির মিরাজ। তার চুল এলোমেলো, চোখ দুইটা লাল, চোখেমুখে পাহাড়সমান হতাশা। মিরাজকে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে যায় ডাক্তার।
‘আপনার এ অবস্থা কেন মিরাজ সাহেব, শরীর খারাপ?’
‘স্যার, চিন্তায় আমি শেষ। রাতে আপনার ফোন পাওয়ার পর সারারাত ঘুম হয়নি। আপনি আরও পাঁচটা গরু বিক্রি করে দিতে বলেছেন। পনেরো দিন আগে পাঁচটা বিক্রি করে টাকা পাঠিয়েছি। এর মধ্যে দুধের ঘাটতিতে পড়ে দুইটা শোরুম বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘আপনার কথা ঠিক কিন্তু ওদেরকে আরও কিছু টাকা পাঠাতে হবে। ব্যারিস্টার দুবাই আছেন, জানেন নিশ্চয়। আজ সকালে কথা হয়েছে, পনেরো দিনের মধ্যে প্রথম কিস্তির টাকা আমারা পেয়ে যাবো বলেছেন।’
‘এ মাসে পাবো, সে মাসে পাবো বলে বলে এক বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে দফায় দফায় টাকা দিয়েছি। এছাড়া ব্যাংকের দুই মাসের কিস্তির টাকাও তাদের দিয়ে দিয়েছি। ব্যাংক থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে, এবার টাকা না এলে খেলাপি হয়ে যাবো, আবার কারখানাও বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘আপনি অত ভেঙে পড়বেন না। পনেরো দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে যাবেন।’
‘পনেরো দিন পরে যে টাকা আসবে তার গ্যারান্টি কী?’
‘কোনো কিছুরই তো গ্যারান্টি নেই। আজ আমি আছি, কাল না-ও থাকতে পারি, রাতে মারাও যেতে পারি, তখন? যাক, এবার টাকা আসবে। আপনি কয়েকটা গরু বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করেন। দরকার হলে শোরুম কিছুদিন বন্ধ থাকবে, টাকা এলে আবার চালু হবে।’
‘স্যার, একটা কথা বলব?’
‘আপনি কি বলবেন জানি, তবু বলেন।’
‘এরা দেড় বছর ধরে ঘোরাচ্ছে। ধরেন আরও এক বছর ঘুরিয়ে অবশেষে টাকা দিলো না বা পরে দেখা গেল এটা পুরোটাই ধাপ্পাবাজি, তখন কী হবে? আমাদের প্রতিষ্ঠান তো বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘বন্ধ হলে হবে। আমরা দেউলিয়া হয়ে যাবো, আমাদের জমি ব্যাংক নিয়ে যাবে। আর কী হবে? এই ক্যাপিটালিস্ট সোসাইটিতে অনেকে দেউলিয়া হয়ে, যাচ্ছে না? তাতে কি মানুষ থেমে আছে? আমার জমি নিয়ে যাবে, আর কী করবে? দরকার হলে রাস্তায় ভিক্ষা করব, জেলে যাবো, না খেয়ে থাকব। আমি লড়াকু মানুষ, রিস্ক নেওয়ার লোক, আমাকে আপনারা বুঝবেন না।’
মিরাজ চলে যাওয়ার পর ডাক্তার দেখে তার বারান্দা বরাবর পাহাড়ের ওপরে মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে। সন্ধ্যার বিষণ্নতা মুহূর্তে মিলিয়ে গিয়ে মন কেমন ফুরফুরে হয়ে ওঠে।
৭
বিকেল থেকে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ, যে-কোনো সময় ঝুম বৃষ্টি নামতে পারে। পাহাড়ের বৃষ্টি মানে তুমুল বৃষ্টি। অসহ্য গুমোট একটা পরিবেশ। এ গুমোট পরিবেশের একটাই বার্তা, কিছুক্ষণের মধ্যে নামছে ঝড়বৃষ্টি। ডাক্তার আজিজ ফ্যান ছেড়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়, এমন সময় শহীদুল এসে হাজির।
‘স্যার, জিনিকে কী করবেন? কাল রাতেও মগবুলের মেয়ের মোরগ চুরি করে খেয়েছে। এর আগের রাতে জিয়ানগর গিয়ে মুনিরের মুরগি ধরে এনেছে। পরশু আপনি খামারে ছিলেন না, সাইফুলের বউ লাঠি নিয়ে হাজির জিনিকে মারার জন্য। প্রতিরাতে সে কোনো না কোনো বাড়িতে হানা দেয় মুরগি খাওয়ার জন্য। হঠাৎ করে তার কী যেন হয়ে গেছে। এভাবে করতে থাকলে এলাকার মানুষ তো খ্যাপে যাবে।’
‘জিনি অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে, তার এখন প্রচুর খাবার দরকার। কিন্তু আমরা তো খাবার দিতে পারছি না। আমাদের নিজেদেরই খাবরের ব্যবস্থা নেই, তাকে খাওয়াব কী করে। তুমি একটা কাজ করো, কাউকে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।ক্ষুধা জিনিসটা এমন, মানুষও হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর সে তো একটা পশু মাত্র।’
‘আমি কথা বলেছি স্যার, সাহেদ স্যার নিতে চেয়েছেন।’
‘কোন শাহেদ?’
‘শাহেদ স্যার, খামারি। ওই যে আটবাড়ি রোডে যে খামারটা আছে তার মালিক।’
ডাক্তার আজিজের চোখেমুখে কিছুটা বিরক্তি। ‘আচ্ছা তাকে দিয়ে দাও।’
‘তার ম্যানেজারকে বলে রেখেছি, কল করলে এখনই নিয়ে যাবে।’
‘তুমি এখনই কল করো। তুমি তো সবই জানো জিনিকে খাওয়ানোর মতো পরিস্থিতি আমাদের এখন নেই। তুমি এখনই দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।’
‘বাককে কী করব?’
‘বাক এখনও ছোটো, সে থাক। পরিস্থিতি দেখি কোনদিকে যায়। না পারলে তাকেও দিয়ে দেবো।’
বলতে বলতেই সিএনজি এসে গেছে।
‘শাহেদ স্যারের লোক এসেছেন জিনিকে নিতে। জিনিকে সিএনজিতে তুলে দেবো। আপনি কি আসবেন?’
‘তুমি তুলে দাও শহীদুল, আমাকে দেখলে সে সিএনজিতে যেতে চাইবে না। আগে বাচ্চাগুলো তুলো দাও, তখন সে একাই উঠে যাবে।’
এতক্ষণ জিনি তার জন্য বানানো ঘরে চিত হয়ে শুয়ে বাচ্চাগুলোকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। শহীদুল আর শাহেদের লোককে দেখে এতটাই খ্যাপে যায় যে মনে হচ্ছে ঘর ভেঙে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।জিনির চিৎকার শুনে ডাক্তার আজিজ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তাকে দেখে জিনি আরও চিৎকার করে।
একে একে বাচ্চাগুলো সিএনজিতে তুলে জিনিকে নিয়ে যায় সিএনজির কাছে। জিনি এক লাফে সিএনজিতে উঠে চুপ করে বসে থাকে। একটাবারের জন্যও শব্দ করে না।
ডাক্তার আজিজ আবার রুমে এসে চুপচাপ বসে থাকে। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টির শব্দ। বারান্দায় এসে দেখে প্রচুর বৃষ্টি, মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় টিনের চাল ভেঙে পড়বে। বারান্দায় বসে অন্ধকারে ডাক্তার আজিজ বৃষ্টি দেখে। পায়ের কাছে বাক শুয়ে আছে; মেঘের গর্জন আর বিজলির আলোয় বাক কেঁপে কেঁপে ওঠে।
৮
ডাক্তার আজিজ রাতে ফেসবুকে দেওয়া একটা পোস্টের কমেন্টগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ে। তার সামনে মিরাজ, আবু হেনা, হারুন আর শহীদুল।
‘আবু হেনা সাহেব, হিসাবগুলো করেছেন? ওয়ার্কাররা কে কত পাবে হিসাব করেছেন?’
‘করেছি স্যার।’
‘আগামী মাসের এক তারিখ থেকে কারখানা চলবে না। কে কত পাবে হিসাব করে বুঝিয়ে দেবেন।’
‘কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে?’
‘হ্যাঁ যাবে। সমস্যা কী, টাকা এলে আবার চালু করব। যে কয়টা গরু আছে সেগুলো বিক্রি করে সবাইকে পাওনা দিয়ে বিদায় করে দেন। তাদের বলেনমাত্র কয়টা দিন ধৈর্য ধরতে হবে, টাকা এলে আবার নতুন করে শুরু করব।’
সবাই একে অন্যের চোখের দিকে তাকায়, কারও মুখে কোনো কথা নেই। কোনো কথা বলার শক্তিও যেন তারা হারিয়ে ফেলেছে।অস্ফুট স্বরে হারুণ বলে,‘কারখানা বন্ধ?’
মনে হলো বহুক্ষণ প্রস্তুতি নিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে এই ছোটো বাক্যটা বলেছে।
‘হ্যাঁ বন্ধ।’
ডাক্তার আজিজ মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে ম্যানেজারের দিকে তাকায়।এ সময় ম্যানেজারের ছলছল চোখ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে বলে,‘আরে আপনারা চিন্তা করছেন কেন? মানুষ দৌড়ের সময় কী করে প্রথমে পিছনের দিকে দৌড়ায়, তারপর সামনের দিকে দৌড় দেয়। সেরকমই আমাদের আরও ভালো কিছু করার জন্য সাময়িক পিছু হটতে হচ্ছে।’
‘ওরা যদি শেষ পর্যন্ত টাকা না দেয় তখন কী করবেন?’
‘কী আর করব, দেউলিয়া হয়ে যাবো। কত লোকই তো দেওলিয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার নতুন করে শুরু করব। না হলে শেষ হয়ে যাবো, আর বেশি কী হবে?’
৯
আর মাত্র কয়েকদিন পর বিজু উৎসব শুরু হবে। চারদিকে উৎসব উৎসব আমেজ। কিন্তু এখানে তার কোনো প্রভাব নেই। ফজরের আজান মাত্র শেষ হয়েছে। ডাক্তার আজিজের মনে হলো বাইরে কেউ একজন বসে আছে। তার অনুমান ঠিকই। দরজা খুলে দেখে দরজার সামনে টেবিলে পা তুলে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে হারুণ। হারুণের গায়ে ময়লা চাদর, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মনে হচ্ছে বহুদিন কয়েদখাটা আসামি।
‘হারুণ, তুমি! ঘুমাওনি? এখানে বসে আছো যে? আমাকে ডাকলে পারতে।’
‘ঘুম আসে না। ভাবলাম আপনি জেগে আছেন কিনা। মনে হলো আপনি ঘুমাচ্ছেন, সে জন্য ডাকিনি।’
‘সারারাত আমারও ঘুম আসেনি। আজানের আগে একটু তন্দ্রার মতো এসেছে, আজানের শব্দে আবার ভেঙে গেছে।’
‘ভাবছি একে একে সবাই চলে গেছে, খামার বন্ধ, কারখানা বন্ধ, শোরুমগুলো বন্ধ। এতবড়ো খামারে একা একা থেকে কী করব, খাবো কী? আবার চিন্তা করি আপনাকে একা রেখে কীভাবে যাই, কোথায় যাই।’
‘হারুণ, তুমি আমার সঙ্গে আমার আব্বার সময় থেকে আছ, জিরো থেকে কী করে আমার খামরের উত্থান হয়েছে তুমি দেখেছ। আবার দরকার হলে জিরো থেকে শুরু করব।’
‘এরা আপনাকে এভাবে ধোঁকা দিয়ে নিঃস্ব করে ফেলেছে! এক বছর থেকে দফায় দফায় টাকা দিয়ে গেলেন...’
‘শোনো হারুণ, আমার ব্যাবসা ভালোই চলছিল। আমি চেয়েছি বড়ো বিনিয়োগ এলে এলাকার মানুষের জন্য কিছু করব।’
‘আপনি ওদের বিশ্বাস করে ঠকেছেন। মানুষকে এভাবে বিশ্বাস করা ঠিক নয়।’
‘তুমি কী বলছ হারুণ! মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করবে না? আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না? তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?’
‘আমি মূর্খ মানুষ, আপনার লগে তর্ক করার জ্ঞান আমার নাই। তবে ছোটো জ্ঞানে একটা কথা বলব?’
‘বলো।’
‘বলছি, মানুষ কি মানুষ আছে?’
দুজনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। শেষে ডাক্তার বলে, ‘থাক সে কথা। তুমি রাতে কিছু খেয়েছ?’
‘না, কিছু খাইনি। ক্ষুধায় ঘুম আসেনি। ছোটোবেলায় আব্বা যখন বেঁচেছিল তখন মাঝে উপাস থাকছি, আব্বা খাবার জোগাড় করতে পারতেন না। এরপর এতবছর চলে গেছে কখনও উপাস থাকি নাই, ছেলেমেয়েদের কখনও উপাস রাখি নাই। এখন আবার ক্ষুধার জ্বালা কী বুঝতে পারছি। আল্লাহপাক বোধ হয় এই জিনিস কপালে লিখে রাখছেন।’
‘এত ভেঙে পড়ো না, মানুষের সব দিন এক রকম যায় না। একসময় ভালো ছিলাম, এখন খারাপ আছি, আবার ভালো হবে। আমি তো আছি, আবার নতুন করে শুরু করব। ড্রয়ার খুঁজে এই টাকা কয়টা পেয়েছি, তুমি দোকান থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসো একটু পরে গিয়ে, একসঙ্গে খাবো, আমিও রাতে কিছু খাইনি। ধরো আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে কষ্ট পাচ্ছি। তুমি একটু খেয়াল করে দেখো কত উন্নতি হচ্ছে চারদিকে তবু কত মানুষ একবলো আধবেলা খেয়ে-না-খেয়ে দিন গুজরান করছে।’
আরও কিছু সময় দুজন চুপ করে থাকে। বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না। ডাক্তার আজিজ বলে,‘আমার কেবল বাকের জন্য খারাপ লাগছে। কারও কাছে দিয়ে দিলেও পরতাম। কোথায় আছে কী খাচ্ছে কে জানো। রাগের মাথায় বলেছি, তুই বড়ো হয়েছিস এবার কোথাও চলে যা না, আমার অবস্থা খারাপ দেখিস না! তাজ্জব ব্যাপার, ছেলেটা এই লোঙ্গা দিয়ে কোথায় যে চলে গেলে আর দেখিনি। আমি ভাবতে পারিনি যে ছেলেটা এ কাজ করবে।’
‘সে কিন্তু দূরে কোথাও যায়নি, আশপাশে কোথাও আছে। দেখবেন কোনো একদিন এসে হাজির হবে।’
‘তুমি কী করে জানলে? তুমি কি কখনও তাকে দেখেছ?’
‘না দেখিনি, তবে আমার মন বলছে।’
‘আমরা ফান্ড পাবো কিনা এ ব্যাপারে তোমার মন কী বলছে?’
‘আমি আগেই জানতাম এরা টাকা দেবে না।’
‘কখন মনে হয়েছে?’
‘আরে প্রথম দিনই মনে হয়েছে। এরা প্রথম আসছে শ্রবণ মাসের ১৫ তারিখ। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি ছিল। আপনি ভোরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চট্টগ্রাম থেকে এসছেন। সেদিন প্রথম দেখেই বুঝেছি...’
‘কই কখনও তো কিছু বলোনি?’
‘বললে আপনার মন খারাপ হবে। আর টাকা আসলে তো সবার জন্যই ভালো।’
ডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,‘হারুণ, আর কেউ কি আছে?’
‘আছে, অং ছেলেটা আছে।’
‘অং মানে অংক্রাইনিও?’
‘জি, ওদের বিদঘুটে নাম মনে থাকে না। ছেলেটাকে কতবার বলেছি, তুই বাড়ি চলি যা, এখানে থেকে কী করবি? প্রথমে সে বলে বাড়ি যাবো যে বাড়ি কই? পরে বলে, মামা যতদিন আছে ততদিন থাকব। প্রথম প্রথম ছেলেটার ওপর বিরক্ত হয়েছি, পরে দেখি ছেলেটা অনেক ভালো, একটু পাগলামি আছে।’
১০
ডাক্তার আজিজের নিজ হাতে গড়া খামারের আজই শেষ রাত। রাত পোহালেই এই খামার, এই ঘর, এই গাছপালা ছেড়ে চলে যেতে হবে। শুধু পড়ে থাকবে এই ছোটো ঘরের বারান্দার হাসিঠাট্টা, তর্কবিতর্ক, স্বপ্ন। গত একবছরে একে একে সবাই চলেগেছে, একমাত্র হারুণ ছিল তার ছায়াসঙ্গী। সন্ধ্যায় সেও চলে গেছে।
পাহাড়ের উৎসব শেষ হতে চায় না। আজ পহেলা বৈশাখ। অনেকদিনের ইচ্ছা ছেলেমেয়েকে নিয়ে পাহাড়ে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করবে কিন্তু তা আর হলো না। সন্ধ্যার দিকে পূর্বদিকের পাহাড় আলোকিত করে যখন চাঁদ উঠছিল তখন হঠাৎ ছাতিমফুলের ঘ্রাণ এসে লাগে। এখন ছাতিমফুল ফোটার সময় নয়, আশপাশে ছাতিমের গাছও নেই। ছাতিমফুলের ঘ্রাণে আসমার উপস্থিতি টের পায়। ছাতিমগাছ না লাগানোর যে আফসোস ছিল সেটা এখন নেই, এখন সেই ছাতিমগাছটাকে রেখে চলে যেতে হতো। মনে হয় কাছাকাছি কোথাও আসমা অবস্থান করে তাকে দেখছে।
দিনে গরম হলেও পাহাড়ে রাত গভীর হতে হতে হালকা শীতল বাতাস বইতে থাকে। কিন্তুআজ এলামেলো বাতাস। কয়েক পেগ মদ গেলার পর মাথার দুই পাশের ধমনি দফদফ করে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি ধমনি ছিঁড়ে যাবে।ইচ্ছা করে আস্তে আস্তে হেঁটে আমগাছটার নিছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বুকভরে নিশ্বাস নেয়। দূর পাহাড়ের কনকগাছ কিংবা গর্জনগাছের ডালে আটকে থাকা চাঁদ দেখতে ইচ্ছা করে। খামারের একেবারে পিছনে উঁচু স্থানে গিয়ে কিছুসময় বসে থাকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কিছুতেই মাথা তুলতে পারে না।
ট্রুং...ট্রুং... ট্রুং...
নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে একটা পাখি অবিরাম ডেকে চলেছে। এ ডাকটা মাথার মগজে এসে লাগে। মাথার প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে ডাক্তার আজিজ এক পা দুই পা করে খামারটা ঘুরে দেখে। সবদিকে শূন্যতা। হাঁটতে হাঁটতে পেছনের পাহাড়ের উঁচু স্থানটাতে গিয়ে একটা গাছের গুঁড়িতে বসে। বিগত দুই বছরে কত লোক এলো-গেল, কত লোকের সঙ্গে পরিচয় হলো, কারও কথা এখন আর মনে পড়ে না। কেবল বাক আর জেনির কথা মনে পড়ে। বাকটা কোথায় আছে কীভাবে আছে বলতে পারবে না। আজ বাক থাকলে এখন পাশে বসে থাকত।
মাথার যন্ত্রণা আরও বেড়ে গেলে ডাক্তার আজিজ ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। আজানের আর বেশি দেরি নেই। হঠাৎ মনে হয় জানালায় কে যেন দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। জানালার একাট পাল্লা খোলা। ডাক্তার আজিজ জানালার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে। জানালায় পা তুলে বাক দাঁড়িয়ে আছে, চোখের মণি দুটো স্থির। ডাক্তার আজিজের চোখও বাকের দিকে স্থির হয়ে আছে। মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে যায়। হঠাৎ লাফিয়ে ঘরে ঢুকে ডাক্তারের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাক।
খোকন দাস গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামই তার লেখার বিষয়বস্তু। প্রকাশিত গল্পের বই : কাক ও অন্যান্য গল্প, খড়ের মানুষ। তিনি কর্মসূত্রে খাগড়াছড়িতে থাকেন।