কাহিনিবিহীন একটা গল্প
আর দু’ চার দিন… খুব বেশি হলে হপ্তাখানেক। শীত পুরোপুরি চলে যাবে। শহরে হয়তো বসন্তের সকাল। কিন্তু এই সুন্দরপুরে ভোরের দিকটায় এখনো শিশির পড়ে। হাওয়ায় সারাদিন বিভিন্ন ফসলের, বিশেষ করে সর্ষের সুগন্ধ। সারাদিন ঝাঁক ঝাঁক পাখির ওড়াউড়ি। ঘনঘন কুহুতানে ঋতু বদলের ইশারা।
সুন্দরপুর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের বয়স বছর দশেক। সকাল থেকেই কলেজের বাইরে ক্যাংলা চেহারার একটা লোক ঘুরঘুর করছে। এলাকার কেউ নয়। তাকে ঘিরে আশেপাশের দোকানদারদের আপাত অলস কিন্তু পাহারাদারি চাউনি। রোদ একটু চড়লে, লোকটা পরনের সোয়েটার খুলে কোমরে বাঁধে। চালওলা শিবু সেই সুযোগে জিজ্ঞাসা করে, ‘দাদা, এখানে কাউকে খুঁজছেন নাকি?’ মাথা নেড়ে ‘না’ বলে লোকটা উদ্দেশ্যবিহীন পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করে।
বেলা সাড়ে বারোটায় শান্তশিষ্ট কলেজটায় হইহই রইরই। ঘণ্টা পড়ে… গোছা গোছা মেয়ে বাইরে আসে… ছুটি হয়েছে। একে একে, দুয়ে দুয়ে শিক্ষিকারাও বেরোতে থাকেন। ধীরে ধীরে ভিড় কমে, কলেজ আবার ঘুম ঘুম…।
লোকটা এতক্ষণ অদৃশ্য ছিল। ওড়না আর মাস্কে গলা-মুখ ঢাকা একজন কলেজ থেকে বেরিয়ে টোটোর দিকে এগোতেই সে যেন ভুঁই ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠে। আপন মনে এগিয়ে চলা মহিলাটি চমকে যায়। একপলক নির্বিকারভাবে লোকটিকে দেখে। ‘এখানে এসেছ কেন?’ জোরালো স্পষ্ট উচ্চারণ তার, ‘কী ভেবেছ, তোমার গল্পের চরিত্র আমি? আমাকে দিয়ে যখন যা খুশি বলানো, করানো যায়?’ লোকটা মুখ খোলার চেষ্টা করলে তাকে থামিয়ে নরম গলায় বলে, ‘এবার পাগলামো বন্ধ করো। ফিরে যাও। আমার ওপর রাগ কোরো না, তাহলে মরেও শান্তি নেই। সব শেষ হয়ে গেছে গো, আর কিছু হবে না… হতে পারে না।’
‘কী হয়েছে ম্যাডাম?’ কলেজের ঠিক মুখোমুখি জেরক্সের দোকান থেকে শঙ্কর পুরো দৃশ্যটা গোগ্রাসে গিলছিল। ‘আপনাকে বিরক্ত করছে নাকি?’ স্থানীয় লোক বলে কথা। ব্যাপারটার ল্যাজামুড়ো জানা তার হক। প্রতিবেশী দোকানদারদের নিয়ে সে এগিয়ে আসে, ‘ও দাদা, আপনি কে?’ ‘কী চান?’ ‘দিদিকে চেনেন?’ নানা জনের নানা প্রশ্ন। লোকটা নীরব। শেষমেশ ধৈর্যহারা হয়ে ভিড়ের কেউ চড় মারে… রাস্তায় একটা দাঁত পড়ে… দেওয়ালে একদলা রক্ত ছিটকায়… হট্টগোল তুঙ্গে…।
একটু পর জটলা ভাঙে… ক্ষণিকের জন্য থমকে যাওয়া সুন্দরপুর কলেজ রোড আবার সচল হয়। সেই অচেনা আগন্তুক-সহ চারজন একটা ট্যাক্সিতে ওঠে। অনেকগুলো শালিক বিচিত্র শব্দ করে তীরের বেগে ট্যাক্সিটার ছাদের সমান্তরালে উড়ে যায়। কলেজের আমবাগানে কোকিলের হুল্লোড়… কাঁচাপাকা টমেটোর সুবাস…।
***
অবোলা প্রাণীদের মধ্যে পাখপাখালি আমার খুব ভালো লাগে। দোকানে বসে বিক্রিবাটার ফাঁকে ফাঁকে ওদের উড়তে দেখলে একঘেয়েমি কাটে। ফি বছর চেনাদের সঙ্গে বহু নতুন পাখিও চোখে পড়ে। তবে এরা সবাই প্রত্যেকবার আসে না। কী জানি কেন! দিনকয়েক ধরে খেয়াল করছি না-চেনা পাখিদের বেশিরভাগই দল পাকিয়ে ঘুরছে। হয়তো ঋতু পরিবর্তন মানে ওদের জোড় বাঁধা… জোট বাঁধার পালা। আমার ছোট্ট বইয়ের দোকানের গা ঘেঁষে মণ্ডলদের বাগানে এবার গাদিয়ে কামরাঙা হয়েছে। মৌমাছি আর পাখির কনসার্ট সেখানে দিনভর।
জ্বর জ্বর লাগছে। কোনো কাজ গায়ে গচ্ছে না। অন্যদিন দুটোয় দোকান বন্ধ করে খেতে যাই, তিনটে বাজলে আবার খুলি। আজ দেড়টা নাগাদ ঝাঁপ ফেলে দিয়ে ভাবলাম আর ফিরব না। একটু বিশ্রাম দরকার। রাস্তায় পা দিতেই বেশ ক’টা ছাতারে আমাকে ঘিরে কাঁইকিচির করতে করতে হঠাৎ সাঁ করে উড়াল দেয়। আমি অসুস্থ বলে ওরাও ব্যস্ত হলো নাকি?
দিদির কলেজের পাশ দিয়ে আসছি… চারদিক কেমন থমথমে। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে… বড়সড় কোনো ঘটনা। লোকজনের চোখেমুখ হাবভাবও তা-ই বলছে। ‘কী ব্যাপার গো?’ পানভাণ্ডারের দেবুদার কাছে জানতে চাই, ‘হাওয়া গরম মনে হচ্ছে…।’ মুখভর্তি গুটখার পিক নিয়ে পানে খয়েরগোলা লেপতে লেপতে চোখের ইঙ্গিতে সে বাঁ-পাশের দেওয়াল দেখায়। ধপধপে সাদা চুনকামের ওপর পানের পিকের মতো দাগ। রঙটা পিকের চেয়ে বেশ গাঢ় আর আকারেও বড়। কিছু না-বুঝে তার দিকে চাইতেই মুখ খালি করে এক ঢোঁক জল খেয়ে ক্যারকেরে গলায় বলে, ‘এই… একটু আগেই এক হারামজাদাকে সবাই মিলে অ্যাইসা পিটিয়েছে… যাকে বলে হাতের সুখে… মুখটুখ ফেটে… না না মরেনি… ওদেরই কারোর ঠ্যালায় লোকটার মাথা ওই দেওয়ালে ঠুকে…।’
হালকা মাথাব্যথা ছিলই, এখন এত কথা শুনে ক্লান্তিতে সারা শরীর ভারি হতে থাকে। ইচ্ছে করে উড়ে বাড়ি চলে যাই। মাত্র ছ’মিনিটের দূরত্ব… কিন্তু যেন অনন্তকাল ধরে হাঁটছি। বাড়ির নিস্তব্ধতা আর ওষুধে প্রথমে বেশ আরাম হলেও সূর্য ডুবতেই ছটফটানি বাড়ে। আধো ঘুমে রাতভর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাই। অদ্ভুত! বোধহয় স্বপ্ন দেখেছি, তাই না?
কাল সারা রাত দিদি আবার কেঁদেছে, দুপুর থেকে জলও ছোঁয়নি, দরজা বন্ধ করে পড়ে রয়েছে… সকালে চা দিতে এসে মা জানায়। সত্যি, মাঝে মাঝে দিদির কী যে হয়! ওষুধপত্র তাবিজকবচ… মা কত কিছু করেছে… নিটফল জিরো। তবে মন্দের ভালো যে, বেশি নয়; দু তিনদিন এরকম থেকে দিদি নিজেই ঠিক হয়ে যায়। আগের মতো হাসে, কথা বলে, কলেজে ক্লাস নিতে যায়… যেন কিচ্ছু হয়নি। তিন বছর আগে ঝলসানো গলা-বুকসহ ওকে ও-বাড়ি থেকে নিয়ে আসার পরপরই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। আগে প্রয়োজনমাফিক কেউ খোঁজখবর নিত। এখন শুনছি কাগজপত্র তৈরি করছে। ছেলের ঠাকুমাবুড়ির নাকি বায়না… তার সংসারে আবার নতুন নাতবউ চাই।
নটা নাগাদ দোকানে যেতে গিয়ে চোখ আপনাআপনিই দেওয়ালটার দিকে গেল। পিকের মতো সেই দাগে একটা বড় গোলাপ ফুটে আছে। টকটকে লাল! ম্যাজিক নাকি? হঠাৎ কানের পাশে পাখিদের ডানা ঝাড়ার আওয়াজ… ঠিক যেরকম স্বপ্নে শুনেছি। ‘খুদে ছেলের কাণ্ড গো।’ অণিমাদি, কলেজের মালির বউয়ের কথায় ঘোর কাটে। ‘আজ কালের ছেলেপুলে… লেখাপড়ায় মোট্টে মন নেই… আঁকিবুকিতে যত পণ্ডিতি। দ্যাখো না, ঝকঝকে সাদা দেওয়ালে লাল রং দিয়ে কিসব কারুকার্য ফলিয়েছে।’ গনগনে রাগী স্বর ওর।
***
লাইনের অন্য ড্রাইভারদের মুখে ‘নেই… নেই’ বুলি শুনে কান পচে গেল। সবসময় অভাবের কাঁদুনি গেয়ে কী লাভ? রোজগারের ক্ষমতা থাকলে টাকা ঠেলে এসে ঘরে ঢুকবে। সেভেন-এইটে পড়ার সময় থেকে কাজ করা ধরেছি। এত বছর ধরে কত ধরনের কাজ যে করলাম। ভাতে টান পড়েনি কোনোদিন… আর পড়বেও না। শরীর আর মন না-চাইলেই শুধু ঘরে বসি। না-হলে সব সিজনে রোজই কাজ! ওপরওলার আশীর্বাদে ছেলেটাকেও ভালো স্কুলে দেওয়া যাবে। অবশ্য তা নিয়ে এখনই ভাবার কিছু নেই… সবে তিন মাসের। ধরে রেখেছিলাম আঁটকুড়ে হয়েই মরব। ঠাকুরের দয়ায় সে অপবাদ ঘুচেছে।
বউ আমার খুব সুন্দর। একবার তাকালে বারেবারে দেখতে ইচ্ছা করে। সবারই। আর আমায় ভীষণ ভালোবাসে। গাড়ি চালানোর সময় ওর কথা ভাবতে গিয়ে বহুবার বিপদের মুখে পড়েও বেঁচে গেছি। জানি, বউয়ের পয়েই। আমিও ওকে চোখে হারাই। তবে কিছুদিন ধরে কলেজের এই ম্যাডামকে দেখলেই… গোলমাল হ্যায় ভাই, সব গোলমাল হ্যায়। উফ্ কী ফিগার মাইরি! যেন সাপ। আর এত ঠাসানো চুল! গত আটমাস আমার টোটোয় ওনি একলা যাতায়াত করেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা—সবসময় গলাবন্ধ সালোয়ার-কামিজ আর মুখে মাস্ক। আপাদমস্তক এভাবে ঢাকা থাকলেও ওনাকে দেখামাত্রই শরীর চাঙা… টেপা হাসিতে চকচকে মুখ। আর গাড়িতে বসলেই ঠোঁটে নতুন সিনেমার গান… গুনগুনিয়ে। ওই কয়েক মিনিট আমি অন্য রসে টইটম্বুর। তখন, সত্যি বলছি, ইচ্ছে না-থাকলেও বারবার গাড়ির রিয়র মিররে নজর যায়। কমবয়সী মেয়ে কিন্তু কী ধাতুতে যে তৈরি! … কোনো কিছুতেই চ্যাত-বোধ নেই। উলটে নিজেকেই কেমন ছোটোলোক লাগে।
ওনাকে কখনো কথা বলতে বা হাসতে দেখিনি। মাসচুক্তির গাড়িভাড়ার টাকা দেওয়ার সময়েও না। মনে হয় ম্যাডাম খুব কড়া। ছাত্রীরা নিশ্চয়ই যমের মতো ডরায়। টোটোয় বসেও বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক একদিন রাতে বোধহয় ওর ঘুম হয় না কিংবা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে। ফোলা ফোলা লালচে চোখ দেখে টের পাই। যাক সে সব ওর নিজস্ব ব্যাপার। আমি জেনে কী করব?
আজ সকালে ম্যাডামের বাড়ি গিয়ে শুনি, অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। ভালো…খুব ভালো। বারোদিনের ভাড়া হয়েছিল, পেলাম। পয়সা নিয়ে আমার অত ইয়ে নেই। কপালে থাকলে আসবেই। কিন্তু আমের মুকুলের গন্ধ নাকে গেলেই যে ভয়ঙ্কর হাঁচি হয়, এর কোনো ওষুধ আছে নাকি?
***
এবার দারুণ ফলন হয়েছে আমাদের। গাজর, কড়াইশুঁটি, ক্যাপসিকাম। বাবা খুব খুশি… মুখে না-বললেও বুঝতে পারি। বিক্রিবাটা ভালো হলে সামনের বছর ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করে দেবে, বলেছে। কিন্তু আমার মন চায় না। আসলে স্কুল ব্যাপারটাই অপছন্দ। ছবি আঁকা… একমাত্র ছবি আঁকতেই ভালোবাসি আমি। একটু মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখলে চোখের সামনে কে যেন পর পর ছবি ধরে দেয়। মেঘে, চাঁদে, ডালে, পাতায়, রোদে, ছায়ায়, ভেজা দেওয়াল বা মাটি… সবখানে গল্প আর ছবি, না না, ছবি আর গল্প দেখতে পাই।
বন্ধুরা আমায় কত কী বলে যে খ্যাপায়!
ছবি আঁকার জন্য পেনসিল, তুলি নয়; আঙুলই আমার প্রিয়। এরাই সবচেয়ে ভালো রং বোঝে। স্কুলে আঁকার ক্লাসে কখনো সোজা দাগ কাটতে পারিনি বলে স্যারের বকা, মার কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু আমার তো কোনো লাইনই সোজা লাগে না, তাহলে আঁকব কী করে? একবার অনেক চেষ্টায় সোজা দাগ দিয়ে বাবার ছবি এঁকেছিলাম। দেখে বাবা প্রথমে বেদম হাসলেও একটু পরে রাগারাগি করে চলে যায়।
আগে বাবা এমন ছিল না। ছোট থাকতে আমার সঙ্গে প্রচুর কথা বলত। গরমের রাতে খোলা আকাশের তলায় শুয়ে কত গল্প শোনাত। সব মাকে নিয়ে। আমার ঘুম না-পাওয়া পর্যন্ত বাবাকেও জোর করে জাগিয়ে রাখতাম। সব নিমন্ত্রণে আমায় সঙ্গে নিয়ে যেত। ছুটির দিনে শহরে বেড়ানো। কিন্তু এখন? লেখাপড়া ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে বাবা কথা বলে না, ডাক্তারখানা ছাড়া কোথাও নিয়ে যায় না।
কাল স্কুল থেকে ফেরার পথে গার্লস কলেজের সামনে, একটা লোককে অনেকে মিলে খুব পিটাচ্ছে। পুরোটা দেখতে গিয়ে দেরি হয়ে যায়। লোকটার মাথা কলেজের দেওয়ালে ধাক্কা খেল… ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। আর আমি দেওয়ালের তাজা লাল ছোপে ছবি দেখতে পেলাম। প্রথমে পাখির ঠোঁট, তারপর মেঘ আর বৃষ্টি, সেটা বদলে হলো আগুনের শিখা, শেষে একটা লাল গোলাপ ওখানে পাপড়ি মেলে দেয়।
***
মৃত্যুর এক দশক পেরিয়ে গেছে কিন্তু বাবাকে লোকে ভোলেনি। কবি পরিমল চৌধুরী। এখনো জনপ্রিয়। কিন্তু আমি তাঁর লেখা পড়ি না। পড়ার টেবিলে তাঁর কবিতাসংগ্রহ যেমন তেমনভাবে ফেলে রাখি… মাসের পর মাস। তারপর কোনোদিন হয়তো সেগুলোর ধুলো ঝাড়ি। শুনেছি, বাবার সব লেখায় তাঁর প্রিয় নারীর উপস্থিতি। না, সে আমার মা নয়। শুধুমাত্র বাবার প্রেমিকা। আসলে সে কেউ-ই নয়। ফ্রয়েডের তত্ত্ব ধরলে এই সমস্ত কবিতা আদতে বাবার সেই স্বপ্ন, মা যা পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু এ-ধরনের সরলীকরণ করা কি উচিত? মানুষকে বোঝা এত্ত সহজ?
কবিতা আমি বুঝতে পারি না। আমার পছন্দ গল্প। সব জায়গায় তাকে পাওয়া যায়। যেদিকে তাকাবেন, দেখবেন গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গল্প তো হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো মাছের মতো—বাবাকে প্রায়ই কথাটা বলতাম, শুধু হাত বাড়াও আর কাগজে-কলমে আটকে ফেলো। শুনে তাঁর ঘরকাঁপানো হাসি…।
অবশ্য কিছু ঘটনা বেঁচে থাকার নিত্যতার সঙ্গে এমনভাবে জুড়ে যায় যে, বলা-কওয়ার বাইরে। বা এমনও বলতে পারি, যে জীবন আমরা কাটাই সেও এক গল্প আর সবাই নিজের নিজের সেই গল্পের চরিত্র। একবার ভাবুন তো, এমনই এক চরিত্র যদি গল্পবৃত্তের বাইরে বেরিয়ে উঁকি দেয়… তার উপসংহার নিয়ে কৌতূহলী হয়, তখন ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে? দারুণ, না?
বাবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন গোটা পৃথিবী আমাকে চিনবে… জানবে। কখনো না কখনো ঠিক নিজস্ব গল্পটা খুঁজে পাব, যা সারা বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেবে। সেই গল্প লিখে যেন তাঁকেই উৎসর্গ করি, এই ছিল বাবার ইচ্ছে। সেই আশা পূরণ হলেই মেয়ের থেকে তিনি সবচেয়ে বড়, সেরা উপহারটা পেয়ে যাবেন। কিন্তু বাবা থাকতে তো নয়ই, তিনি চলে যাওয়ার পরও এই স্বপ্নে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে পারিনি। হাড়সম্বল শরীর নিয়ে ও-বাড়ি থেকে চলে আসার পর ডাক্তার দেখেশুনে বলেছিল, আমার মাথা-মন আর শরীরেরও কী কী যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। ঠিকঠাক, মানে কোনোমতে দিন কাটানোর মতো হতে বেশ লম্বা সময় লাগবে। তখন, সেই শূন্য মগজেও এক-একবার মনে হতো সেই গল্প-মাছটা মুঠোয় এসেছে। মনে হতো, নিজেই যেন চরিত্র হয়ে সেই গল্পে জড়িয়ে গেছি। আর তক্ষুনি গল্পের ফাঁদ ছিঁড়ে বাইরে তাকানোর আপ্রাণ চেষ্টায় আবার শরীর বেতাল…।
আজ কলেজের দেওয়ালে লাগা রক্তিম দাগটাকে গল্পের খোসা ছাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছি কিন্তু হতচ্ছাড়া পাখিদের ক্যাঁচোরম্যাচোরের জ্বালায় শান্তিতে কোনো কাজ করার জো আছে? ভাবনাটা যেই দানা বাঁধতে শুরু করে, ওরা সবাই এমন চ্যাঁচায়… যেন বিলাপের আসর বসেছে। দ্যাখো তো, এত সাড়াশব্দে আমার চিন্তার, না না গল্পের সুতোটা, কোথায় যে হারিয়ে ফেললাম…। কী হবে এখন?
শম্পা রায় অনুবাদক প্রাবন্ধিক এবং সম্পাদক। মৌলিক লেখার পাশাপাশি অনুবাদকর্মেও সাবলীল। বিস্মৃত মণির সন্ধানে (প্রবন্ধ গ্রন্থ), অসীমান্তিক শ্যামল (সম্পাদিত গ্রন্থ), সম্পাদিত পত্রিকা (সুলেখা সান্যাল সংখ্যা)। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় থাকেন।