ঢোল
চার কি পাঁচের ছাবালকে নিয়ে আলসের বিল হেঁটে আসে নোলন দাস। অঘ্রানের খড়খড়ে আলপথ বিপজ্জনক বড়। শীতঘুমে যাবার আগে তেনারা গর্তের মুখে ঘোঁৎ মেরে থাকেন। বান্দুরে আন্ধার বড্ড ঝক্কির। তা সলক হোক কি বা আন্ধার—বাপব্যাটার ভয় নাই তাতে। আলের ’পর পেটফোলা শুটকো নোলন খালিপায়ে থপথপায়ে চলে, যেন সে জুরাসিক-কালের মাংসাশী প্রাণী এক। ঢোলের দড়িখান কান্ধের হাড়ে আংটার মতো ঝোলে। নোলনের হাতে কাঠি। ঢোলে কাঠি পড়ে। পেছনে খড়ি—পাটখড়ির মতোই লিকলিকে— কাঁসর হাতে কুঁচেচিংড়ির মতো লাফায় খালি। বাপের তালে-তালে কাঁসরে ঠোক্কর দেয়। আড়াই-মাইল পথ জুড়ে তাল ওঠে পায়ে, মনে, সারা-শরীরে। ঢাক-কাঁসরের তালে-তালে প্রায় জল হারানো আলসের বিলও নাচে। হোগলা-শোলা-শ্যাওলা নাচে। হাগড়াকাঁটার ঝোপ নাচে। খড়ি সামান্য ঝুঁকে হাগড়াকাঁটা তোলে ক’টা। ক’টা জলে ছুঁড়ে মারে। ক’টা নিজের চুলে গাঁথে। কটা পকেটে রাখে। তাল থামলে পর বাপে তাড়ায়, ‘সন্দের আগে না-গিলি মান থাকবে নানে বাপ! তড়াসকে আয়।’ বিকেল মুছে সন্ধে হয়-হয়। আকাশ ও জলে রোদরঙের সমাপ্তি খেলা চলে। পৃথিবী যেন ভাঁপ-ওঠা ছাঁচপিঠের মতোই অপরূপ তখন। তখনই সান্দায় যাবে নলেন গুড়ের বাটিতে।
চেয়ারে ঝিম মেরে আছে দুজন। চোঙে পান্নালাল, ‘আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে মা...।’ চৌদিকে ব্যস্ততা। ঠাকুরমশাই এখনো আসে নাই। প্রয়োজন পড়ে নাই। রাত সাড়ে-বারোটায় তিথি, আসবে তাই দশটায়—বলেছে। মানসিক পুজো। বাপে বলেছিল, ‘মা, মা গো! নাতি-নাতনির মুখ দেইখে-পর মরতি চাই যে মা। দে মা দে...’
বড়দার বিয়ে বহুদিন, কিন্তু...! ম্যালা ডাক্তার, ম্যালা গুনিন তো হলো—কামের কাম কিছুতেই কিছু হয় নাই।
এক মাঝরাতে বাপ আমার বিছানা ছেড়ে দুহাত শূন্যে তুলে বাথানে উঠোনে এসে ধপ করে হাঁটুগেড়ে বসে! হুড়মুড়িয়ে আমরাও তারে ঘিরে দাঁড়াই এসে। মা ভয়ে মেচির মতো কান্দে খালি, ‘ওরে বগাই তোর বাপরে বুজি ভূতি পাইচে!’ বাপ ধীরে ধীরে চোখ খোলে। যেন সবে মাত্র অসুরের চক্ষুদান সম্পন্ন হয়েছে। সকলে তাঁর দিকে ভামের নাহান চেয়ে। বাপের অসুরচোখ ভয় ধরায়। অবশেষে নাটকীয় বিরামের পর বাপ আমার মুখ খোলে স্লো-মোশনে। খুলেই ‘বেম্মোকালী’ বলে তিনবার ডাক ছাড়ে। সে-রাতে ছুটে-আসা এক পড়শিজন বলে, ‘মা মা! মা ভর করিচে গো! ভিটেয় বেম্মোকালীর পুজো দিতি হয় যে।’ মা বলে, ‘অ্যাঁ? বেম্মোকালীর কতা অ্যাদ্দিন শুনিনি তো!’ পরদিন থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে পাড়ায়, পাড়া থেকে গোটা গাঁয়ে ব্রহ্মকালী নিয়ে আলোচনা-গবেষণা চলতে লাগল, আর এরই মধ্যে খবর এলো বউদি অন্তঃসত্ত্বা! ব্যস, ‘সবই মা-র কিরিপা!’ বাপে আমার দিন নাই রাত নাই ‘বেম্মোকালী বেম্মোকালী’ বলে লাফায় খালি। ঘোষণা দেয়—‘বাড়িতি পেত্তেক বচ্চর বেম্মোকালীর পুজো হবে!’
বাপের ইচ্ছে ছিল তানু চাটুজ্জেরে দিয়ে পুজো করানোর। ‘চলেন জ্যাঠা। যা চাবেন, দিবানি।’
‘না ঘ্যানা, তা হয় না! তুমি বরং বাপু শংকররে দিয়েই সারো।’ শুনে বাপের মুখটা শামুকের মতো কেমন গুটায়ে গেল! অগত্যা...
পুজোর দিন আসল। বিলপাড়ের পোলাপানেরা মিলে চালিভ্যান চেপে প্রতিমা আনতে ছুটলাম নয়াকামারগাঁ। ফেরা দুমাইল হেঁটে। মা চালিভ্যানে। বাপন তাতে চেপে মাকে ধরে থাকে। গদাই চালায়। আমরা পিছু পিছু হাঁটি। পথে ঢাক বাজে, কাঁসর বাজে—ঢং ঢডাং ঢং ঢডাং টুং টুটুং টুং টুটুং। ইতোমধ্যে শংকর ঠাকুরবাড়িতে হাজির। সঙ্গে ছোটঠাকুর। ঠাকুরমশাই আসতেই পুজোর তোড়জোড়। মৃন্ময়ী এলে ঢাক-কাঁসর-উলু আর ধূপধুনোয় ভরে ওঠে মণ্ডপ। সধবারা বরণ করে। এর কিছু পরেই শুরু হয় পুজো।
পুজো সারারাত। শংকরঠাকুর মন্ত্র পড়েন। লোকে বলে, তাঁর মন্ত্রোচ্চারণে একটা ইয়ে আছে! তবে ‘ইয়ে’ থাকলেও নাকি ‘তা’ নাই! আরও বলে, শংকর চক্রবর্তী হলো গিয়ে ‘নমোর বাওন’। বাকি ভটচায-চাটুজ্জে-বাড়ুজ্জে রামাবলী গায়ে বিলপাড়া ঘোঁষেন না! আর কালীঠাউর—মানে বেগোপাড়ার কালীচরণ চক্রবর্তী—একে কালো, তায় বেঁটে—নমোপাড়াতেও তার কদর কম। এদিকে সব হালের ছেলেপুলে রামাবলী জড়িয়ে নেমে পড়েছে পার্টটাইম জবে। তাদের পায়ে হাত দিতে ঠাম্মা-জেঠিমাদের বড়ই সংকোচ। লক্ষ্মী-সরস্বতী পুজো ছাড়া কোনো চাহিদা নেই তাদের।
মেজদা নিজে পৌরহিত্য করতে চায়। কিন্তু বাপের এক ধমকে সে কিনা চিটেধান! ‘অ্যাঁহ্, বড় বুজদার হইচো দেকতিচি! বাওন ছাড়া গাঁয়ে আমার মান-ইজ্জত থাকবেনে?’ মেজদা সংস্কৃত বোঝে ভালো। পুজোর বইপত্র কিনে মুখস্থ করে ফেলেছে। ঘরের রোজের পুজো ঘণ্টা বাজিয়ে করে। ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভেদাভেদ মানে না। তার ইচ্ছে সেও রামাবলী গাঁয়ে পুজো করবে। কিন্তু সমাজ তাকে মান্যতা দেয় না। যদিও অনেক পরে সে বুদ্ধের ভক্ত হয়ে পুজোআর্চনার পথ ছাড়ে। আরও বলে, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণির চশমা দিয়ে দেখে অধিকাংশই এক-একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে—সে সংগীত হোক কিংবা সাহিত্য, চলচ্চিত্র হোক কিংবা রাজনীতি। শিকারির উলটো দিকে দাঁড়িয়ে দেখলে সবটাই স্পষ্ট এবং অসহ্য! বাপে বলে, ‘বেজম্মা তুই, বেজম্মা! ত্যাজ্জো ত্যাজ্জো ত্যাজ্জো! হে মা ব্রহ্মকালী, পাপ নিয়ে না মা!’ সব পরিবারেই একটা-না-একটা ত্যারা থাকে। মেজদা তেমনই। যাহোক, মেজদার উপাখ্যান এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
আমি সংস্কৃত বুঝি না। ফলে শংকরঠাকুরের মন্ত্রগুণ নিয়ে আমার পক্ষে বলা বেমানান। তবে গলায় জোর আছে, বলতেই হবে। সেই গলায় কাঁপ লাগিয়ে মন্ত্র পড়ে। নোলনও দম লাগিয়ে কাঠি চালায়। খড়ি তখন চেয়ারে ঝিমায়ে পড়ে, ঘুমায়ে পড়ে। ঢোলে কাঠি পড়তেই ঘুমন্ত অবস্থায় কাঁসরে ঠোক্কর দেয় খালি। বেজে ওঠে কাঁসর—টুং টুটুং টুং টুটুং...। ক্রমে-ক্রমে মণ্ডপে ভিড় কমে আসে। উপোস থাকা মহিলারা অঞ্জলি দেয়। চলে যায়। পড়ে থাকে মা ও বউদি। মন্ত্র চলে। ঢাক-কাঁসর চলে। ঢং ঢডাং ঢং ঢডাং টুং টুটুং টুং টুটুং।
ভোর হয়-হয়। তার আগেই বরণ। এবং আলসের বিলে শিকদারগে আপায় বিসর্জন। বড়দার মাথায় মা ব্রহ্মকালী। পিছে পিছে আমরা। সঙ্গে ঢাক-কাঁসর। শিশিরে হাঁটু পর্যন্ত ভিজে যায় সকলের। নোলন লুঙি গোটায়ে ভাঁজ দেয় হাঁটুর ’পরে। খড়ির দড়ি-ভরা ঢলঢলে হাফপ্যান্ট। পাটখড়ির মতো তার পা দুখান ভিজে এক্কেবারে চ্যান! আমার বাপের মুখে তখন, ‘আচ্চে বচর...’ আর সকলের, ‘আবার হবে!’
‘বেম্মোকালী মায় কী?’
‘জ-অ-অ-অ-য়!’
‘আচ্চে বচর...’
‘আবার হবে!’
ভালোয় ভালোয় পুজো শেষ। বিল থেকে বাপ ফেরে। গায়ে জল। চোখে জল। বাপের পিছে গোটা বিলপাড়া, দাঁড়ায়ে।
এইবারে গোছানোর পালা। ঠাকুরমশাই নিজের ভাগটা গোছাতে থাকে। কাদাপায়ে নোলন বসে চেয়ারে। মলিন ধুতি ঠাকুরমশাইয়ের তো নোলনের লুঙি-জামা তস্য মলিন। ঠাকুরমশাই গরিব তো নোলন দাস পিঠ-ঠ্যাকা দরিদ্র। তবে ঠাকুরের পারিশ্রমিক যেখানে পাঁচশো, সঙ্গীর দুশো—নোলনের সেখানে মাত্র একশো। ছাবালটি যেন তার একেবারে দুধেভাতে! এদিকে ঢাক আবার তার নিজের না, পঞ্চাশ টাকায় ভোলারাম দাসের থেকে ভাড়ায় আনা।
পুজো শেষে ঠাকুরমশাই শাড়ি-গামছা পেল। চাল-ফল-মিষ্টি গুছিয়ে নিল। রাতজাগার জন্য কিছু বকশিশ পেল। অঞ্জলি দক্ষিণাও বেশ। পেল সকলের পা-ছুঁয়ে প্রণাম। প্রাণভরে আশীর্বাদ দিল। বয়াস্থাদের বড় ঘরে বিয়ের সম্ভাবনা বলে দিল। চাকরিপ্রার্থীদের দিল ভরসা। প্রদীপের আলোর পাশে বিদ্যুৎ-আলোর নিচে থাকা এই মানুষটি মৃন্ময়ী মায়ের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। মণ্ডপের একেবারে পেছনে চেয়ারে বসা নোলন দাস ও তার ছাবালের গায়ে সে-আলো পৌঁছোয় না।
সকালে ঠাকুরমশাইয়ের জন্য রিকশা আসে। নোলন দাস খিচুড়ি খেয়ে খই-কদমার টোপলা নিয়ে আলসের বিল বরাবর হাঁটা দেয়। টুং টুটুং টুং টুটুং...। ঢাকের মাঝে বাজে। অঘ্রানের কুয়াশায় হারিয়ে যায় দুজনে।
২
নোলন দাসের বাড়ি কালুপুরে, জিয়ালার পথে, দাসপাড়ায়। পাঁচ গাঁয়ে গরু মরলে খবর আসে। মরা গরু আলসের বিলের ভাগাড়ে ফেলে আসে। পাঁচ টাকা পায়। আর পায় গরুর ছালচামড়া-শিং-খুর। ভাগাড়ে বসেই ছাড়ায়। মাথার ’পর তখন গিজিগিজি শকুন ঘুরপাক খায়। অদূরে কয়েকটা কুকুরের দল অপেক্ষা করে। ঝগড়া করে। দখলের আগেই কামড়া-কামড়ি। এসবের মাঝে নোলন নিখুঁত শিল্পীর মতো কাজ সারে। পাশে দাঁড়িয়ে খড়ি ও বড়ি। বাপরে যথাসাধ্য সাহায্য করে। কুকুর ও শকুন প্রস্তুত। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী! তবু কুকুর পায় কেবল উচ্ছিষ্ট, হাড়গোড়। শকুনের অভিশাপে আগে বিলপাড়ের গরু মরত কি না জানিনে, তবে কুকুরের অভিশাপে সেইসব শকুনেরা কোথায় যে হারিয়ে গেল!
এছাড়া কারও শুয়োর মারতে হলে সেই নোলন! নিরীহ লোকটা হাজির। মুখে তার আরাবল্লী পর্বতের মতো নীরবতা। বাঁশঝাড়ের দিকে গাছে বাঁধা শুয়োরের বাঁ-বুকে পাশ থেকে বল্লম চালায় প্রাগৈতিহাসিক শিকারিদের মতন। অমনি আকাশ-ফাটা গোঙানি! থ্যাবড়ানো বল্লমবাজ নির্বিকার। পর্বতপাথর বেয়ে বেয়ে ঘাম ঝরে। বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম সরিয়ে বল্লম ধরে মোচড় দেয়। গোঙানি বাড়ে। শকুন-কুকুর ভয়ে মরা গরুর টানাটানি ছেড়ে পালায়। আকাশ জুড়ে শকুনের টহল। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ে জীবন। তারপর কাটাকুটি। খাওয়াখাওয়ি। আমাদের বর্ণ-শ্রেণি সমাজে শুয়োর কয়েকটি নিচুজাত ছাড়া ঘোর নিষিদ্ধ। তবু নিষেধ উপেক্ষা করেই শরীর স্পর্শ করে শরীর।
নোলন দাসের সঙ্গে বড়দার পরিচয় ফেরি করতে গিয়ে। গ্রামেগ্রামে সাইকেলে চেপে জামাকাপড় ফেরি করে বড়দা। নোলন দাসও কেনে। বাকিতে নেয়। শোধ দিতে পারে না। সাত-সাতটা ছেলেমেয়ে, তবু পোয়াতি বউ। এদিকে নিজের ঢোল নাই, জমি নাই। চালচুলো সবই ভোলারাম দাসের শ্বশুরবাড়িতে। আগে ভোলার বাড়িতেই থাকত। কিন্তু ভোলার বউ পূর্ণিমা জানে বরের নজর নোলনের বউয়ের ওপর। এদিকে বউটা তাকে ‘দিদি দিদি’ করে গলা শুকোয়। এটা-ওটা করে দেয়। গুল-দেয়া বড়ি-দেয়ার সঙ্গী। সেও একটা-দুটো পুরনো শাড়ি হাতে তুলে দেয়। বাচ্চাদেরও দেয় জামা।
একদিন নোলন দাসকে বড়দা ধরে, ‘ওদ্দা, আজ দিবা নেকি? ম্যালাদিনতে ফেলি রাখিচো।’
‘দেব দেব, ভাইদা। না-দিয়ে আর যাবানি কুথায়? তা হাতে তো কানাকড়ি কিচুই নাই। এট্টা খালি শুয়োর আছে, সেইডারে বেচে দিবানি।’
‘কবে পাবানি তালি?’
‘সামনের মাসে নিয়েনে।’
সামনের মাস আর আসে না নোলনের। শুয়োর বড় হতে থাকে। একদিন বেচে দেয়, তবু শোধ দেয় না। বড়দা ধরলে বলে, ‘মেয়েডা পার কল্লাম যে ভাইদা। তাও একশো বাঁচায়ে রাখিচি। এইডা ন্যাও।’ তবু তো কিছু পেলাম—ভেবে টাকাটা রাখে।
‘আর কত পাবানে?’
‘সাতশো বিরাশি।’
‘অ্যাঁ?’
‘ন’মাস পরে এই একশো ঠ্যাকালে, নুলোদা!’
এর দুমাস পর নোলন বড়দাকে পাঁচশো টাকা হাতে দিয়ে বলে, ‘আর কত ভাইদা?’
‘পালা কুথায়?’ অবাক হয় বড়দা।
‘আম গাছ বেচিচি। কী করব আর, তুমারে আর কত ঘুরাই কওদিন? ছেলো। দিলাম মায়া ছেইড়ে। ভালাজাতের আম হতো কলাম গো দা। কী সোয়াদ তার...’ বলতে বলতে চুপ হয়ে আসে। ওভাবে কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে ইতস্ততভাবে বলে ওঠে, ‘তা এট্টা পোস্তাব আচে যে ভাইদা।’
‘কী পোস্তাব?’
‘এইখানে না।’
‘তা?’
‘ওই, ভগার খোয়াড়ে চলেন, কচ্চি।’
ভগার খোঁয়াড়ে প্রস্তাব পাড়া হয়। নোলন কিছু শুয়োর পালতে চায়। বাচ্চা শুয়োর। এই দশ-বারোটা। ভাগে। বড়দার পয়সা, আর শ্রম নোলনের। এমনকি তা পালন হবে নোলনের বাড়ি। মোট খরচ দুহাজার। একটা বেচে পাঁচ হাজার ওঠে। পাঁচটা বেচলেই পঁচিশ!
‘ঠিকাচে। শুনলাম। বাড়ি গিয়ে ভাববানি।’
৩
পরের সপ্তাহে বড়দা দুহাজার টাকা নিয়ে আসে।
দুটো স্বপ্নগাছ আলসের বিলের দুই পাড়ে বড় হতে থাকে। বড়দা সেই সময় সাইকেল ছেড়ে একটা পুরনো বাজাজ এম-এইট্টি বাকিতে কিনেছিল কাজে সুবিধে হবে বলে। আমাকে পেছনে বসিয়ে একদিন নিয়ে গেল নোলনের বাড়ি। ইটখোয়ার তোবড়ানো রাস্তা। চলা দায়। এ-গ্রাম, ও-গ্রাম ঘুরে শেষমেশ পৌঁছলাম নোলন দাসের বাড়ি। বাঁশচটার খাঁচার মধ্যে আটটা বাচ্চা। একটা মারা গেছে। এই প্রথম শুয়োর ধরলাম। আদর করলাম। এরা বড় হলে টাকা হবে। প্রচুর টাকা। বড়দার এম-এইট্টির টাকা শোধ হবে। নোলনের দুকাঠা জমি হবে। আহা!
দুমাস কাটেনি। দাদার কাছে খবর পাই, ওরা বড় হচ্ছে। বলেই ভটভটিয়ে গ্রামে ছোটে। আমরা তার ছোটাছুটি দেখি। এম-এইট্টির মিলিয়ে-আসা শব্দ ও ধোঁয়া স্পর্শ করি। স্বপ্ন স্পর্শ করি।
এরই মধ্যে দুহাজার সালের সেপ্টেম্বর আসে। আলসের বিল ফুলতে থাকে প্রতিবারের মতো—ঠিক পুজোর আগে আগে। কিন্তু সেবার মহালয়ার আগের দিন বিনা বৃষ্টিপাতেই জল ফুলতে ফুলতে একতলা! বিহারের বাঁধগুলো আচমকা খুলে দেয়ায় নাকি এমন।
আমরা আমাদের সিঁড়িহীন ছোট্ট ছাদে তিনটি পরিবার মিলে ছিলাম দেড় মাস। বাকিরা স্কুলঘরে, রেললাইনে তাঁবুর নিচে কিংবা লাইন হেঁটে চাঁদপাড়ায়। উপরে হেলিকপ্টার। আকাশ ফুঁড়ে শুকনো চিড়ে আর জিয়োলিন ট্যাবলেট পড়ে এসে। প্যাকেটে। কখনো জলে পড়ে ভাসতে থাকে। কখনো বা গাছে ঝোলে। ক্ষুধা ঝাঁপিয়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ।
দেড় মাস পর ছাদ থেকে নেমে আসি আমরা। রাস্তায় তখনো জল। তখনো রাস্তায় লরির টিউবের ভেলা, কাঠ ও টিনের নৌকা—যশোর রোড পর্যন্ত। আরও দিন পনেরো পর রাস্তার জলও নেমে যায়। লগির গুঁতোয় রাস্তা খুবলে গেছে। সেই খোবলানো রাস্তায় ছাদ থেকে দড়ি ফেলে এম-এইট্টি নামায়। অনেক লাথি মারার পর স্টার্ট নেয়। কালো ধুঁয়োয় ভরে যায় রাস্তা। তারপর শুটকো গাধাটা মালিককে পিঠে চাপিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যেন অদৃশ্য হয় চরাচরে।
কালুপুরের নোয়াপাড়ায় পাকা রাস্তা শেষ। সেখানে এম-এইট্টি রেখে লুঙি তোলে। হাঁটু পর্যন্ত কাদা ভাঙে। অবশেষে পৌঁছায় দাসপাড়া। বড় গাছ ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই গ্রামে। দু-একটা কোঠাবাড়ি ছাড়া সবই উজাড়! রাস্তাঘাট কিছুই চেনার উপায় নেই। আকাশ থেকে কাদার আণবিক বোমা পড়েছে যেন।
গ্রামের লোক একজন-দুজন করে ফিরে আসছে ধীরে ধীরে। বড়দা মনসাতলে এসে দাঁড়াতেই দেখে কাদামাখা এক আদিম মানুষ নেংটি পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে। কাঁধে আড়ার বাঁশ। দূর ঝাড় থেকে সদ্য কেটে নিয়ে এসেছে বোধহয়। না-হলে কাদায় কাদায় এতটা মাখামাখি হতো না শরীর। ঠিক এইখানেই তো ছিল খাঁচাখান। আটটা বাচ্চা। নাদুসনুদুস হয়ে উঠেছিল গত ছ-সাত মাসে। কোথায় তারা? কোথায় ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে এখন? কেবল খাঁচাখান হাঁটুভাঙা প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের মতন পড়ে আছে কাদার ভিতর।
মাটিতে দু-পা গেঁথে গেছিল বুঝি লোকটার। হঠাৎ কাঁধ থেকে বাঁশ নিচে রাখে। কেঁদে ওঠে। ফোঁপায়। গোঙায়। যেন কেউ তার বুকে বল্লম চালিয়ে চলে গেছে। ফেটে গেছে ঢোল!
কেবল বড়দা ফোঁপাতে পারে না।
অমিতকুমার বিশ্বাস গল্পকার এবং শিক্ষক। নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করেন।