বাবুরাম সাপুড়ে

রামরাজত্ব ডিঙিয়ে বিস্তর পথ হাঁটার পরে ক্লান্তির বলিরেখা ছুঁয়ে যায় তাকে; ক্লান্তপ্রায়—বুঝতে পারে না নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে চলেছে কিংবা কোথায় গিয়ে শেষ হবে ভবলীলা! এক জীবনে লীলা তো আর কম হলো না! না জানি আরও কত বাকি। বাকি পথটুকুন মনের জোরে পেরিয়ে আসে বাবুরাম। এ পথে নতুন সে। সে আসছে হিন্দুকূশ পর্বতের পাদদেশ থেকে। বেচারা পেশায় সাপুড়ে। দেশে দেশে সাপ ধরে এবং সাপখেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তন্ত্রমন্ত্রও জানে। কাঁধে ঝোলানো পুঁটলির অভ্যন্তরে শেকড়-বাকড় তাবিজ-কবজও আছে কিছু। দিনান্তের ক্লান্তি শেষে রাজবাড়ির আঙিনায় উপস্থিত হয়। রাজ-রাজড়াদের সম্মুখে সাপের ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করে। সাপের সঙ্গী হয়ে সাপুড়ে নিজেও নৃত্য করে। নেচে গেয়ে রাজা-রানির মনহরণের প্রচেষ্টা। সে জানে কেউ একজন খুশি হলে ভাগ্য খুলতে কতক্ষণ! তাছাড়া ভাগ্যান্বেষণেই তো গঙ্গারিডি রাজ্যে অনুপ্রবেশ করা। 

বাবুরামের ক্রীড়াকুশলতায় চারদিকে মারহাবা মারহাবা রব ওঠে। খুশি হযয় সবাই। উচ্ছ্বসিত রানি। রানির শখ পূরণে রাজাও দিলদরাজ; ইচ্ছে করলে এই গঙ্গারিডি রাজ্য সাপে সাপে সয়লাব করে দিতে সক্ষম। নতুন রানি হলে যা হয় আর কি। হাটকুড়ো নাম ঘুঁচানোর জন্য ইতিপূ্র্বে বারোজন রানিকে প্রাসাদে তুলেছেন কিন্তু  কাজের কাজ কিছুই হয়নি; ভাগ্য পোয়াবারো তো হয়ইনি উলটো যুক্ত হয়েছে ঘোড়ার ডিম। ঘোড়ার ডিম দিয়ে কি রাজপাট চালানো যায়! তাই নতুন রানির আবির্ভাব। রানির চাওয়া মাত্র দুটো সাপ—যে সাপের চোখ নেই কান নেই করে নাকো উৎপাত খায় শুধু দুধ-ভাত। 

রাজাকে সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কপাল বরাবর হাত উত্তোলন করে সাপুড়ে বারংবার কুর্নিশ  করে। আমতা আমতা করে জানায়—মাত্র দুটো সাপ, মহারাজ!

সাপ পেয়ে উচ্ছ্বসিত রানি পুলকিত, আহ্লাদিত; আহ্লাদ করে সাপ দুটোর নাম রাখতে চায় কিন্তু কী নাম রাখবে বুঝতে পারে না। বিশেষত সাপের ধর্ম এবং লিঙ্গ বিষয়ে তাহারা অজ্ঞাত। জ্ঞাত হওয়ার জন্য সাপুড়ে বাবুরামের শরণাপন্ন হয়—জাত-পাত সম্পর্কে কিছু কইবা না বাবা; তাছাড়া ইনারা ছাওয়াল না মিয়া এইটাও তো আমাদের জানা দরকার।
জাতপাত বিষয়ে কোনো সুরাহা হয় না লিঙ্গ বিষয়ে একগাল হেসে জানায়—বাবুসাব দুটোই মেয়ে, মেয়ে-ছাওয়াল; রানিমাও মেয়ে সাপ দুটোও মেয়ে—কী কন ঠিক করি নাই!

ঠিক-বেঠিক নিয়ে উজির আমরাদের তেমন মাথাব্যথা নেই; তারা চিন্তিত রাজ্যের উন্নতি বিষয়ে। আশেপাশের রাজ্যগুলোর তুলনায় গঙ্গারিডি আয়-উন্নতিতে অনেকখানি পিছিয়ে। এই পিছানোর জন্য তারা রাজার ভূমিকাকে দায়ী করে। আরে বাপু জনগণ নিয়ে এত ভাবতে গেলে রাজ্যের উন্নতি কেমন করে সম্ভব। নতুন নতুন কর ধার্য করার বিষয়ে এখন অবধি তারা রাজামশাইকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে রাজার স্পষ্ট মতামত—বাড়তি করের বোঝা ওরা কেমন করে বহন করবে! তাছাড়া ওরা তো আমারই সন্তান; পিতা হয়ে সন্তানের ওপর কেমন করে জুলুম করি।

উজির-নাজিররা জুলুম করার নিত্যনতুন কৌশল শেখায় কিন্তু বিজ্ঞ রাজামশাই কৌশলে এড়িয়ে যায়—যাক না কিছুদিন, দেখি সামনের মৌসুমে ফসলাদি কেমন হয়।

নাজির মনে মনে গোস্বা করে—শালা, নিজে একখানা পয়দা করতে  পারল না, আর জনগণকে কয় নিজস্ব সন্তান; যত্তসব আজগুবি কথা!

কথার পিঠে কথা লাগিয়ে রাজামশাই পরিস্থিতি সামাল দেয়। রানিমা মজেছে কিরণমালার প্রেমে। কিরণমালা মানে সাপ দুটো—একটির নাম কিরণ অপরটির নাম মালা। বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে বাবুরাম অনুনয় করে বলেছিল—রানিমা আর দুটো সাপ রাখেন, খুব ভালো হবে আপনার, খুব মঙ্গল হবে।

কী মঙ্গল হবে, শুনি।

দুধে-ভাতে থাকবেন। তাছাড়া অরুণ বরুণ কিরণ মালা একত্রে মানুষ হতে পারবে।

পরামর্শ মন্দ নয়। রাজার দুই সন্তানের স্থলে চার-চারটি সন্তান হবে এবং  তাদের নামগুলোও অসাধারণ—অরুণ বরুণ কিরণ মালা। রাজপাট চুকিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করে রাজামশাই আর আগের মতো রানির তরফ থেকে সাড়া পায় না। রানিমা ঘরকন্নায় ব্যস্তসমস্ত দিন কাটায়। মেয়েদের খাওয়ানো ঘুমপাড়ানো গোসল করানো—কাজের কি কোনো শেষ আছে! দিনে দিনে দিন যায় রাজার দুশ্চিন্তা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ছোটো রানির গর্ভেও কি কোনো সন্তান আসবে না! রাজজ্যোতিষী যতই সান্ত্বনার অভয় বাণী শোনাক আদতে শান্ত থাকতে পারেন না, অশান্ত মনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন এঁকে রাতভর চিলেকোঠায় পায়চারি করে। আর কোনো পিছুটান না, নতুন কোনো সুযোগের জন্য অপেক্ষা না, সোজা বনবাস অভিমুখে রওনা দিতে হবে। নির্ভার রাজা। নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল। বনবাসী হওয়ার পরিস্থিতি নিশ্চিত হলে রাজ্যজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। এমন প্রজাবৎসল রাজার করুণ পরিণতি কেউ মেনে নিতে পারে না। রানিমা যেন পাথরের প্রতিমূর্তি। বিমূঢ় হয়ে বসে রয়। জল-হাওয়া স্পর্শ করে না। কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বুক ভাসায়। ভাসা ভাসা চোখে মেয়ে দুটোর পানে তাকায়। ওরা কিছু বুঝতে পারে কি না, কে জানে! চেনাজানা চৌহদ্দি ছেড়ে রহিম-রূপবানের সঙ্গী হয়ে একজন প্রজাবৎসল রাজা বনবাসে রওনা হয়।

গাঙ্গেয় অববাহিকার বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে ফসলহীন। জলের অভাবে খেতসমূহ রক্তমুখো। মুখের হাসি হারিয়ে গেছে। বাউল কিংবা মাঝিয়ালের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় না ভাটিয়ালি-জারি-সারি-মুর্শিদি-মারফতি। ছিঁড়ে গেছে একতারার তার। রাজ্য জুড়ে নানাবিধ সংকট; অচলাবস্থা। সংকট নিরসনে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, আলোচনা-সমালোচনা হয়, পক্ষে-বিপক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন হয়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারে না। বিশেষত উত্তসূরির প্রশ্নে অথই অন্ধকার এসে সবাইকে গ্রাস করে—আহা, যদি একটা সন্তান থাকত!

পোড়া কপাল। পোড়া কপাল।

কপাল পোড়া না হলে কি এমন দুর্গতি হয়।

পোড়া কপাল জোড়া লাগাতে জনগণ হাতির শরণাপন্ন হয়—হাতিশালার পাগলা হাতিটাকে ছেড়ে দেয়া হোক। সে'ই উত্তরসূরি নির্বাচন করুক। যাকেই নির্বাচন করবে আমরা তাকে রাজা হিসেবে মান্য করব।

কিন্তু পাগলা হাতি উত্তরসূরি হিসেবে কিরণ ও মালাকে পিঠে করে নিয়ে এলে সংকটে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। রাজা হিসেবে মেনে নিতে আমজনতার আপত্তি না থাকলেও কতিপয় কৌতূহল মেধা ও মগজে ঘুরপাক খায়—

প্রথমত : কিরণ ও মালা অন্ধ, চোখ নেই তাদের, চক্ষুহীন মানুষের পক্ষে রাজকার্য পরিচালনা করা কেমন করে সম্ভব; কিংবা আদৌ কি সম্ভব!

দ্বিতীয়ত : মেয়েদের কান নেই। কান ছাড়া প্রজাদের অভাব-অভিযোগ কেমন করে শ্রবণ করবেন তারা!

অভিজ্ঞতার বিষয়ে কেউ কেউ মতামত দেয়—অভিজ্ঞতা কি মানুষ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হয়! কাজ করতে গিয়ে শিখতে হয়। তাছাড়া শেখানোর ব্যাপারে উজির নাজিররা তো আছেই, তারাই শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবে।

উজির নাজিরদের মনোজগতে ভিন্ন আরেকটি বিষয় আওলা মেঘের মতো ভাসমান—আহা মেয়েদের বিষ নেই যে, বিষ ছাড়া কি রাজকার্যে উন্নতি করা সম্ভব!

অসম্ভব। বিষ ছাড়া রাজকার্য পরিচালনা করা একেবারেই অসম্ভব। বিষের অভাবে পূর্বের রাজা প্রজাদের ওপর নির্দয় হতে পারেনি, রাজ্যের সীমানা বিস্তারের আগ্রহ জন্মায়নি।

আরে বাবা, ভালোবাসা দিয়ে প্রেমিকের মন জয় করা গেলেও রাজ্য জয় করা সম্ভব নয়।

কিন্তু কিরণ ও মালার পক্ষে কি রাজ্য জয় করা সম্ভব!অসম্ভব কি! জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই, শিখিয়ে-পড়িয়ে নিলে ওরাও ঠিক পারবে; দিনে দিনে এই গঙ্গারিডি রাজ্য উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছে যাবে।
শিকড়ে জলসিঞ্চন করার প্রত্যাশায় মন্ত্রীগণ সাপুড়ে বাবুরামের শরণাপন্ন হয়। পদচুম্বন করে মিনতি জানায়—রক্ষা করো সাপুড়ে, উদ্ধার করো আমাদের। তুমি দয়া না করলে সোনার রাজ্যপাট রসাতলে যাবে।
চক্ষু বন্ধ করে মাথার উপরে হাত উত্তোলন করে সাপুড়ে হাঁক—বোম বোম ভোলানাথ। ঘাবড়াও মাত। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
সমস্বরে মন্ত্রীগণ বিস্ময় প্রকাশ করে—সব সমস্যা!
হুম। সব সমস্যা।
তাহলে আর দেরি কেন সাপুড়ে জলদি করো। টাকা-পয়সা বাড়ি-গাড়ি ধন কিংবা নারী যা যা লাগে সব তোমাকে দেব আমরা।
বাবুরাম ক্রুদ্ধ হয়, ক্রুদ্ধস্বরে জানায়—ধন কিংবা নারীর কাঙাল নই আমি। পয়সা হলেই কি জগতে সবকিছু পাওয়া যায়।
মন্ত্রীগণ মনে মনে হোঁচট খায়। মুখ কাচুমাচু করে বলে—আমাদের তাহলে কী করতে হবে সাপুড়ে?
শ্মশানযাত্রা।
মানে!
অমাবস্যার রাত্রি ন্যাংটো হয়ে আমার সঙ্গে মহাশ্মশানে যেতে হবে।
যুদ্ধযাত্রার চেয়ে কঠিন কাজ শ্মশানযাত্রা। তবু তারা যেতে রাজি হয়—কিন্তু সেখানে গিয়ে আমাদের কাজ কী!
রক্তবর্ণ চোখে সাপুড়ে একে একে প্রত্যেকের পানে তাকায়—নৃত্য; মা কালীকে খুশি করতে নৃত্য করতে হবে আমাদের। পাঁঠা বলি দিতে হবে। এক কোপে কাটতে হবে চণ্ডালের মেয়ের মস্তক।
ওদের চোখেমুখে বিস্ময়ের ঘোর—বলো কী সাপুড়ে, আমরা কি পারব!
পারতেই হবে। রাজকার্যে চণ্ডালের মেয়ের হাড় খুবই জরুরি।
ওই হাড় কী কাজে লাগাব। 
রাজ্যের স্থানে স্থানে মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হবে। হাড়ের সঙ্গে যুক্ত হবে সর্পমণির আচানক শক্তি। আর ওই শক্তি কিরণ ও মালার আত্মায় যুক্ত হয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে; চোখ কান নাক মুখ সব খুলে যাবে।
কিন্তু বিষের কী হবে সাপুড়ে, বিষ ছাড়া রাজকার্য চালানো যে খুবই কষ্টকর।
কোনো কষ্ট থাকবে না আর, আমার কথা শুনলে ওরা বিষও পাবে— নীলবিষ।
নীলবিষ!
হ্যাঁ, নীলবিষ।
এ কেমন বিষ, সাপুড়ে?
ভয়ংকর; ভয়ংকর এক বিষ। খালি চোখে দেখা যাবে না কিন্তু বিষের যন্ত্রণায় সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
মন্ত্রীগণ খুশি হয়। এই ভালো, সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। লাঠিয়াল বাহিনী কঠোর নিরাপত্তায় সাপুড়ে বাবুরামকে গঙ্গারিডি রাজ্যের সীমানা পার করে দেয়। লোকটি এখানে থাকতে চায় না। প্রাসাদের সুখ নাকি তার সহ্য হয় না, নিজেকে অবরুদ্ধ মনে হয়। মন্ত্রীগণও এ বিষয়ে তেমন জোরাজুরি করে না। সাপুড়ের চলে যাওয়াই বরং উত্তম এবং নিরাপদ।

নতুন করে রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনী বিন্যস্ত করা হয়। রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে পূর্বের রাজার বিশ্বস্ত কিছু কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ নিয়ে খুব আক্ষেপ থাকলেও মন্ত্রিপরিষদের কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজার সিদ্ধান্তই এখানে চূড়ান্ত। নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া আছে কঠোরহস্তে ভিন্নমত দমন করতে হবে। গোপনীয়তা রক্ষার্থে মাটির অভ্যন্তরে কুঠি নির্মাণ করা হয়। মদনকুমারের সান্নিধ্যে মন্ত্রীবর্গের তত্ত্বাবধায়নে কিরণ মালার রাজনীতির জটিল ও কুটিল দীক্ষা আরম্ভ হয়। পর্যায়ক্রমে তারা দেশের রাজা হবে। এক-একবার মেয়াদকাল হবে পাঁচ বছর। পন্থার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় একজন ডানপন্থী হলে আরেকজন হবে বামপন্থী। মধ্যপন্থী বলে বিধানে কিছু নেই। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়—সিদ্ধান্ত এমন এক জিনিস যা হয় পক্ষে যায় না হয় বিপক্ষে। রাজ্যপাট টিকিয়ে রাখতে কিরণ মালাকে অবশ্যই কুশলী হতে হবে। বিরূপ পরিস্থিতি কৌশলে সামাল দিতে পারা, বাঘ ও মহিষকে একঘাটে পানি খাওয়াতে পারা, সাপ ও বাঘের গালে চুমা খেতে পারা একজন আদর্শ শাসকের মহৎ গুণ। কিরণ ও মালার মধ্যে নানান গুণের সমহার। আত্মিক অমিল সত্ত্বেও জনতার সম্মুখে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। কেউ কারও ছায়া মাড়াতে নারাজ। সময়ভেদে বদলে যায় শাসকের রাজধানী। জনতার মধ্যেও বিভেদের দেয়াল। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। যাক জান থাক মান। মান রক্ষার্থে নিত্য তারা খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়। খুনের লাল রক্তে রঞ্জিত হয় গাঙ্গেয় উপত্যকার উর্বরা মাটি। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে কেবল। কান্নার রোল পৌঁছে যায়  রাজ্যের ঘরে ঘরে। উন্নয়নের ছোঁয়া প্রত্যক্ষ করার জন্য গ্রামগঞ্জে যাওয়ার দরকার নেই, রাজকর্মচারীদের পানে তাকালেই আন্দাজ করা যায়—কী অভূতপূর্ব উন্নয়ন!

মেয়েদের এমন পরিবর্তন রানিমা মেনে নিতে পারেননি; মায়া-মমতা ভুলে দুঃখ বুকে চেপে নিরুদ্দেশযাত্রা করেছেন। কারও কারও মতে গহিন অরণ্যে তিনি হারানো স্বামীকে খুঁজে ফিরছেন। অথচ মেয়েদের পিছুটান নেই। শাসক হিসেবে কিরণ কিংবা মালা কেউ কারও চেয়ে কম নয়। উভয়েরই রয়েছে সুবিশাল সমর্থকগোষ্ঠী এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য। ইতিহাসের ধারা অনুযায়ী সম্মুখে এগিয়ে যায় রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানা। ঠুনকো অজুহাতে বিহার এবং উড়িষ্যার দখল নেয়। বেদখলের ভয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো সদা ত্রস্ত। উপেক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা। সামরিক ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। সর্বত্র আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস ওঠে। মেঠোপথ ধরে হাতে হারিকেন এবং কাঁধে বাস চাপিয়ে কৃষকরা যাতায়াত করে। ভিন্ন একদল মানুষও ওই পথ ধরে দূরগামী। কারা ওরা! কী চায়! কোথায় যায়! ফিসফিস করেই বা কী বলাবলি করে! আবছা অন্ধকারে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দুজন কৃষক জিজ্ঞেস করে—কোথায় চলেছেন, ভাই।

মুষ্টিবদ্ধ হাত এবং জোয়াল শক্ত করে বলে—আসামের কামরূপ-কামাক্ষায়। সুখপিপাসী একদল মানুষ ওরা। ওরা জেনে গেছে কিরণ ও মালার ক্ষমতার উৎস কোথায়! সাপুড়ে বাবুরামের সাক্ষাৎ পেলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে। সে-ই পারে শাসকের হাত থেকে জনতাকে মুক্তি দিতে।
কিন্তু কীভাবে।

তন্ত্রবলে কিরণ ও মালাকে বিষমুক্ত করবে। মুক্ত হবে জীবন ও জনপদ। পদে পদে মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও পথ হাঁটে। বাবুরামের আস্তানায় পৌঁছে আরেক দফা অবাক হয়—রানিমা আপনি, আপনি এখানে!
বুক চাপড়ে কাঁদে রানি—হয় গো বাবা, নিয়তি; নিয়তি আমাকে টেনে এনেছে। সুখের আশায় পথে নেমেছি আমি।
কিন্তু রাজপ্রাসাদ!
ওই প্রাসাদে আর সুখ নেই, বাবা। তোমাদের মতো আমিও অসুখী।

সুখ ফেরাতে বদ্ধপরিকর ওরা। বাবুরামও আপত্তি করে না, বিষ উত্তোলনে রাজি সে। নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে জনগণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমা মহৎ গুণ। বিষমুক্তির শর্তে ক্ষমা করতে আপত্তি নেই। বরং নতুন করে সুখানুভূতি ছুঁয়ে যায়। জেগে ওঠে চরাচর। সর্বত্রই যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার। নতুন করে রাজবাড়ির আঙিনায় দরবার বসে। লোকে লোকারণ্য। মন্ত্রীদের কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়েছে।
পালাবে কোথায়! সবকটাকে ধরে মা-কালীর ভোগে উৎসর্গ করব।

বাবুরামের হুংকার শোনে স্বল্পপ্রাণ মানুষগুলো ভয় পায়; আড়ালে আবডালে সরে দাঁড়ায়। বলা তো যায় না কখন কি অঘটন ঘটে যায়! ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা লক্ষ্য করে কিরণ ও মালার চক্ষুদ্বয় তির তির করে কম্পনরত। বিষমুক্তির লক্ষণ। জনতার চোখেমুখে মুক্তির আনন্দ।
বিষমুক্তি সমাপ্ত হলে পরীক্ষাপর্ব। জনসমক্ষে কিরণ ও মালার ছোবল হজম করে বাবুরাম এ কথা প্রমাণ করবেন যে—এ সাপের কান নেই চোখ নেই করে নাকো উৎপাত, খায় শুধু দুধভাত।

পর্বটি জনতার কাছে ভীতিকর হলেও বাবুরাম স্রেফ নস্যি মনে করে। জাত সাপুড়ে সে। তান্ত্রিকজগতের নমস্যপতি। জন্মাবধি সাপের সঙ্গে ঘরবসতি। ছোবলে ছোবলে শরীর ক্ষতবিক্ষত তথাপি বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করতে নানাবয়সী নানাপেশার নানাগোত্রের মানুষ অপেক্ষারত। উদ্ধত ফণা উঁচিয়ে দুটি আজদাহা সাপও অপেক্ষারত। না জানি কে হাসবে শেষ হাসি। হিংস্র বাঘের মতো লেজ সোজা করে কিরণ মালা এগিয়ে আসে। ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে ক্ষণকালের জন্য বাবুরামের মনের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়; অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সাপের কামড়ে সাপুড়ের মৃত্যু বিষয়ক প্রাচীনতম প্রবাদটি তার অন্তরে জগদ্দল পাথর হয়ে গেঁথে যায়!


পিন্টু রহমান কথাসাহিত্যিক এবং সম্পাদক। প্রকাশিত গল্পের বই : পাললিক ঘ্রাণ, পরাণপাখি, হাওরপাড়ের কইন্যা। উপন্যাস : কমরেড। সম্পাদিত ছোটকাগজ : জয়ত্রি। তিনি চুয়াডাঙায় বসবাস করেন।

menu
menu