অদ্ভুত লোকটির খোঁজে
লোকটিকে হারানোর পর তাকে আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি।
নির্জন মেঠো পথ, পুরনো অলিগলি, প্রাচীন জাদুঘর, জনারণ্য খেলার মাঠ, ব্যস্ততম শহরের মোড় সর্বত্রই খুঁজেছি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো হদিস পাইনি। ঘনিষ্ঠ একজনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করলে, সে আমাকে উপদেশ দিল লোকাল পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য, সঙ্গে একটি সাধারণ ডায়েরি করার কথাও জানাল। আমি নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। সাধারণ ডায়েরির প্রসঙ্গটি বাদ দিলাম। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার বিষয়টি আমার মনঃপূত হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো প্রথমত আমি লোকটির নাম জানি না। দ্বিতীয়ত ঠিকানাও তার ভীষণ বিদঘুটে।
এমতাবস্থায় আমার নাম-ছবি এবং লোকটির ঠিকানা ব্যবহার করে পত্রিকায় দেয়া যায় কি না সে পরামর্শের জন্যই এই অবতারণা।
ভাববেন না আমি খামোখা নিজের নাম-ছবি ব্যবহার করে একটা তালগোল পাকাতে চাইছি। পুরো বিষয়টি জানলে হয়তো একটা যৌক্তিক কারণ খুঁজেও পেতে পারেন।
ঘটনাটি আপনাদের খোলাসা করে বলি—
আমি ফলবিক্রেতা শামস-উদ-দীন। লোকে আমাকে শামু নামে ডাকে। শহরের এক ব্যস্ততম গলির মোড়ে আমার দোকান। এটাকে দোকান না বলে ঝাপি বলাই ভালো। ফুটপাতে এক ঝাপ পরিমাণ জায়গা জুড়ে আমার বেসাতি। আমি প্রতিদিন সকালে এসে সেখানে নানাবিধ ফলের পসরা সাজিয়ে বসি। গভীর রাত করে পাততাড়ি গুটিয়ে তারপর বাসায় ফিরি। আমারটার মতো আরও ৪/৫টি দোকান আছে এখানে।
অন্যান্য দিনের মতো আজও সারাদিন বেচাবিক্রি করে রাতে বাড়ি ফেরার জন্য দোকান গুটাচ্ছিলাম, এমন সময় লোকটির আগমন ঘটল। লোকটিকে দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। নিজের দুহাতকে মুষ্টিবদ্ধ করে দুচোখ কচলিয়ে লোকটির দিকে তাকালাম। তাকে বড়ই অদ্ভুত ঠেকল আমার কাছে। অবিকল আমি, আমারই প্রতিমূর্তি যেন। শুধু ১০ বছর সময়ের হেরফের। অর্থাৎ বেঁচে থাকলে ১০ বছর পর আমাকে ঠিক ওরকমই দেখাবে। অন্যভাবে বললে, আমি যেন ভবিষ্যৎ থেকে এসে বর্তমানের আমির নিকট দাঁড়িয়ে আছি ফল কেনার জন্য।
অবিশ্বাস্য! কেবল লোকটিকে বয়স্ক দেখাচ্ছিল আর তার মুখে ঘন সাদা দাড়ি ছিল। আমি তার প্রতি এক অজ্ঞেয় আকর্ষণ অনুভব করলাম। আমার মনে হচ্ছিল লোকটি আমার আজন্ম চেনা। মন থেকে পরিচিতির অনুভূতি ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না কোনোমতে। আমার আচরণের মধ্যদিয়ে সেটা প্রকাশও পেয়ে যাচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে, কিছু বিসদৃশ আচরণও করেছিলাম তখন।
আসুন, আসুন, বসার একমাত্র টেবিলটি ফুটপাত বরাবর এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, বসুন। আমার কোনো খরিদ্দারের জন্য পারতপক্ষে আমি এটা করি না।
জি জনাব, কাউন্টারের কাছে ঘেঁষে এসে লোকটি হাসিমুখে বলল। আমি কিছু আঙুর আর আপেলের জন্য এখানে এসেছি। আপনার কাছে কি তাজা কিছু আছে?
আমি গলা পরিষ্কার করে মাথা নাড়লাম নিজের বিহ্বলতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই আছে, দয়া করে আপনার জন্য এগুলো নিয়ে আসতে একটু সময় দিন।
আমি মাথা গলিয়ে দিলাম পেছনে থাকা ছোট ভাঁড়ারের দিকে আর ঘাড় বাঁকা করে অলক্ষে তার দিকে দৃষ্টি রাখছিলাম। আসলে তার দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারছিলাম না কোনোক্রমে। অল্প সময়ের জন্য ভাবলাম, কীভাবে এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে এমন শক্তিশালী সংযোগ অনুভব করছি, যার সঙ্গে আগে কখনো দেখা হয়নি আমার।
ফলগুলো দেওয়ার সময় আমার হাত এক মুহূর্তের জন্য স্পর্শ করল তার হাতের সঙ্গে এবং আমি নিজের মধ্যে বিদ্যুতের ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। সে তার হাত পেছনে টেনে নিল।
ওগুলোর দাম ২০০ টাকা মাত্র, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম আমি।
লোকটি টাকা দেয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, ধন্যবাদ আমার বন্ধু। আমি এখানে বসে ফলগুলো খেয়ে ফেললে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?
লোকটি আমাকে এবার তুমি করে সম্বোধন করল। বুঝতে পারলাম সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে চলেছে। আর এটা হতে কিছুটা সময় লাগে। নিজেকে বললাম, অধৈর্য হয়ো না শামু, একটা চাঁদেরও গোল হতে ১৫ দিন সময় লাগে।
অনেকদিন হয়ে গেছে এভাবে খাওয়া হয়নি, ফলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল লোকটি।আমি মাথা নাড়লাম, লোকটির মোহনীয় আচরণ আমাকে অভিভূত করতে লাগল।অবশ্যই, দয়া করে আরামের সঙ্গে বসুন।
লোকটি টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গে খেতে শুরু করল। ধীরে ধীরে মুখের ভেতর জিহ্বা নেড়ে নেড়ে খাচ্ছিল সে। ততক্ষণে পাশের দোকানগুলোর ঝাপ বন্ধ হয়ে গেছে।
খাওয়ার কোনো এক ফাঁকে আমাদের মধ্যে কথোপকথন শুরু হলো। এখন ভেবে অবাক হচ্ছি যে, আমার মতো একজন নগণ্য মানুষ তার মতো জ্ঞানীর সঙ্গে কীভাবে এত সহজে কথা বলেছিলাম।
কথার এক ফাঁকে বললাম, আমার মনে হচ্ছে আপনি একজন মহান শিক্ষক আর প্রচুর ভ্রমণ করেছেন দেশে-বিদেশে এবং বলার মতো আপনার কাছে পর্যাপ্ত গল্প রয়েছে।
ঠিকই ধরেছ বন্ধু, আমি কিছু অদ্ভুত জায়গায় গিয়েছি, লোকটি একটি আপেলে কামড় দিয়ে বলল, কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল একটি শহর যেখানে কেবল কাক আর মানুষের আত্মারা বাস করে।
আমার ভ্রু কুঁচকে গেল, কাক আর মানুষের আত্মা! এটা কীভাবে সম্ভব?
লোকটি হেসে উঠল, আমি জানি এটা পাগলের মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু এটা সত্যি। এই শহরটিতে এমন লোকদের আত্মা বাস করে যারা এখান থেকে চলে গিয়েছিল কিন্তু কিছু কারণে তাদের সঙ্গে কিছু কাকও সহযাত্রী হয়েছিল। একসময় তারা মানুষের মতোই তাদের জীবনযাপন করেছিল। পরিবার, চাকরি এমনকি একটি সরকারও ছিল তাদের। তখন এটি দেখার মতো একটা দৃশ্য ছিল।
আমি মাথা নাড়লাম। লোকটির গল্প আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনুভব করলাম তার সঙ্গে যা ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না। রাত যত গড়িয়েছে আমরা কথা বলেছি আর হেসেছি। আর আমি নিজেকে সঁপে দিয়েছি তার সঙ্গে। এই অপরিচিত ব্যক্তিটির সঙ্গে আমার বন্ধন গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল।
দিনগুলো সপ্তাহে পরিণত হয় আর আমি ও লোকটি একসঙ্গে সময় কাটাতে থাকি। আমরা আমাদের প্রিয় খাবার থেকে শুরু করে গভীরতম ভয় পর্যন্ত সবকিছু নিয়ে কথা বলেছি। আমি এর আগে কারও সম্পর্কে এমন অনুভব করিনি আর এটাও বুঝতে পারছিলাম যে, আমি আমার বাকি জীবন এই লোকটির সঙ্গে কাটাতে চাই।
একদিন, যখন আমরা এক নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, লোকটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমার তোমাকে কিছু বলার আছে, সে বলল, তার চোখ গম্ভীর।
লোকটির সঙ্গে কথা বলার জন্য আমার হৃদয় ছটফট করছিল।
আমি সত্যিই এখানকার আশেপাশের কেউ নই, লোকটি বলল। আমি সেই অদ্ভুত শহর থেকে এসেছি যার কথা তোমাকে বলেছিলাম, কাক এবং মানুষের আত্মা নিয়ে।
আমার চোখ চমকে উঠল। কী! কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? আপনি এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে এখানে আছেন।
লোকটি মন খারাপ করে হাসল। হ্যাঁ, আমি জানি, তুমি এমনটিই ভাববে।
এরপর আমরা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা গাছের গুঁড়িতে এসে বসলাম। দিগন্তের শূন্যতা এসে ভর করল আমাদের ওপর। লোকটি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি অনেকদিন ধরে বিশ্বের মধ্যে ভ্রমণ করছি। আমি তোমার মতো কাউকে খুঁজে পেতে জীবন্ত পৃথিবীতে মাঝে মাঝে পরিদর্শন করি, যার সঙ্গে আমি সংযোগ অনুভব করি। কিন্তু অবশেষে আমাকে ফিরে যেতে হয় সেই অদ্ভুত জগতের কাছে। ব্যাপারটা ঠিক এমনই।
লোকটির কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যে মানুষটির পাকে আমি বাঁধা পড়েছি সে অন্য জগতের কেউ। তবে আমার মনে হচ্ছিল, সে যে জগতের বাসিন্দাই হোক সে আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না।
আপনি কোথা থেকে এসেছেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি বললাম। আসন্ন বিরহের ব্যথায় আমার হৃদয় হুহু করে উঠল। আমি শুধু জানি, আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং যাই হোক না কেন আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।
লোকটির মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং সে আমাকে শক্ত করে আলিঙ্গনে টেনে নিল। আমিও তোমাকে ভালোবাসি, নিচু কণ্ঠে বলল সে, আর এজন্য তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, একসঙ্গে থাকার সময়গুলোর আমরা সর্বাধিক ব্যবহার করব।
দিনগুলো সপ্তাহে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এবং লোকটি একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করতে লাগলাম। আমরা একসঙ্গে শহর অন্বেষণ, নতুন খাবারের খোঁজ, জাদুঘর পরিদর্শন এবং আমাদের পুরনো নির্জন জায়গাগুলোতে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাচ্ছিলাম।
কদিন ধরে মনের মধ্যে টের পাচ্ছিলাম অস্থিরতা বেড়ে গেছে আমার মধ্যে। বুঝতে পারছিলাম, আমাদের সময়গুলো খুবই সীমিত। একদিন লোকটি কথাচ্ছলে বলেছিল, সময়ের সৃষ্টি হয়েছে ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য। পরিবর্তে সে আমাকে তাগিদ দিয়েছিল নিজের কাছে থাকা প্রতিটি মুহূর্তকে সবচেয়ে বেশি উপভোগের দিকে মনোনিবেশ করতে। কিন্তু আমি এসব কথা হৃদয়ের গভীরে নিয়ে অস্থিরতার বিষবাষ্পকে থামাতে পারছিলাম না কোনোক্রমে।
একদিন সন্ধ্যায়, বলব যে অবিশ্বাস্য সেই সন্ধ্যায়, আমরা যখন পার্কের বেঞ্চে বসে সূর্যাস্ত দেখছিলাম, লোকটি মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকাল, আমার যাওয়ার সময় হয়েছে, এই হৃদয়বিদারক কথাটি সে বলল ফিসফিসে গলায়।
ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর চিন্তায় আমার মন ডুবে গেল। না, দয়া করে যাবেন না, অনুনয় করে বললাম, আমার সঙ্গে আরও কিছুকাল থাকুন।
লোকটি দুঃখে মাথা নাড়ল। আমাকে সেই জগতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি সর্বদা তোমার সঙ্গে থাকব, তোমাকে দেখব এবং তোমাকে রক্ষা করব।
কথা বলতে বলতে লোকটি ম্লান হতে শুরু করল। তার শরীর ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে উঠল। আমি তাকে স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম কিন্তু আমার হাত লোকটির শরীর দিয়ে চলে গেল আর ঠিক সেভাবেই তিনি চলে গেলেন।
আমি সেখানে সে পার্কের বেঞ্চে বসে থাকলাম। আমার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছিল। আমি এমন ক্ষতির অনুভূতি অনুভব করলাম যা আগে কখনো করিনি। কিন্তু মানুষটির চলে যাওয়ায় ব্যথাতুর হলেও এক প্রকার স্বস্তি অনুভব করলাম। আমি জানতাম যে, যাকে ভালোবেসেছি সে এখনো আমার সঙ্গে আছে, আমার ওপর নজর রাখছে আর সারা জীবনের জন্য সে আমায় পথ দেখাবে।
আর তাই, আমি আমার প্রিয় মানুষটির স্মৃতি লালন করে জীবনযাপন করছি, আমি আমার ব্যবসার দিকে মনোযোগ দিয়েছি, আমার পুরনো খদ্দেরদের কাছে তাজা ফল বিক্রি করছি কিন্তু সর্বদা যে ভালোবাসা হারিয়েছি আকাঙ্ক্ষার অনুভূতি নিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
সানাউল্লাহ নূর কথাসাহিত্যিক। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। প্রকাশিত বই : জবাসংহিতা। কর্মসূত্রে তিনি কুমিল্লায় বসবাস করেন।