আটকুঁড়ী

ফজরের আজান কানে ঢুকলেই আছরা বিছানা ছাড়ে। নামাজ পড়ার জন্য না, এ তার চিরকালের অভ্যাস। চিক্যাস মুখ তোলার আগেই সারাদিনের পালা পালা কাজের কিছুটা এগিয়ে রাখতে হয়, তা নাহলে দিন কাবার হয়ে যায় । জা দাদ্যা কেউ নাই যে হাতে হিন্যা দিয়ে আছরাকে গাখানে পানি ঢালার কি মুখে ভাতের দুটো কাড়া গুঁজার ফুরসৎ দিবে! গোয়াল থেকে গোরুছাগল বের করা, ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া, গোবর জলে ছাচ দিয়ে ছঞ্চে, উসরা, গোলা, গোয়ালঘর, পালাঙ্গা, বাড়িতে ঢোকার সদরপথ তকতকে করে তোলে। সকালের জন্মলগ্নে রোজ খড়িমাটি দিয়ে উঠানের কোণে ইনিয়েবিনিয়ে কত রকমের যে আলপনা আঁকে, পাড়ার লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। সংসারের কাজে এও এক বড়ো বাতিক। এই নিয়ে অবশ্য আছরাকে শ্বশুরবাড়িতে কম কথা শুনতে হয় না। বেধর্মী মাগী, কুন জাতের পানির তৈরি আল্লা মালিকই জানে; আল্লা, বাছ্যা বাছ্যা শিরিক করা মেয়ে আমার ব্যাটার কপালে জুটাল্যা! শ্বাশুড়ি সারাক্ষণ বিড়বিড় করে, গালমন্দ দেয়। আছরা তবুও সেসব ছাড়ে না, বরং মুখ ভেংচিয়ে মুখের ওপরে বলে, বেধর্মী টেধর্মী কী গো, ল্যাওড়ার কথা! আমার ভালো লাগে আমি করব! লোকে যা ইচ্ছে বুলুক গ্যা! তার মাও নাকি আলপোনায় সারা বাড়ি সাজিয়ে রাখত। কতবার প্রতিবেশীর পুজোয় আলপোনার কাজ করেছে। আতব চাল ভিজিয়ে তার জলে সিঁদুর মিশিয়ে ধানের শিষ, পদ্ম, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি আরও কত কী আঁকত! মায়ের স্মৃতি সে আজও এভাবেই বয়ে বেড়ায়।
সকালের আহ্নিক সেরেই মুনিষ পাঠের খাবার নিয়ে ব্যস্ত হতে হয়। হাতেপাতে বিশতিরিশখান রুটি বানিয়ে স্বামীর হাতে পাঠিয়ে দেয় মাঠে। তারপর স্বামী-শ্বশুর শ্বাশুড়ির রান্নাবান্না নিয়ে বসে। রান্না শেষে উরান দেওয়া ভুঁই কিংবা আচটে ছাগলগুলো বেঁধে দিয়ে আসে। দুপুর গড়িয়ে পড়ার আগেই বিছুলি কাঁটতে হয়; এক পোণ আউড়, বোঝাখানিক গহমা, চুর করে মিশিয়ে নেয়। গোরুমোষের সব খাবার ভুসির ঘরের সামনে খামাল দিয়ে রাখতে হয়। গলাকাটা হাড়ির একহাড়ি জাও রান্না করে নামিয়ে রাখে। শ্বাশুড়ি সেই জাও সানির সঙ্গে মিশিয়ে দুধেল গাইকে খেতে দেয়। একজোড়া গাই সারাদিন ধরে তা খায়। গাইকে খোল মিশানো খড় আর নুনজাউ খাওয়ালে ভালো দুধ দেয়। দিনে দু’বার দুধ দোহন করে, সকালে পাঁচ লিটার বিকেলে দুই আড়াই লিটার। পড়তে পায় না, দুধ গোরুর বাট থেকে বের করতে না করতে পাড়ার মেয়ে বউরা এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এ পাড়ায় খাঁটি দুধ কেউ দেয় না, সবাই জল মেশায়। তাই আছরা নিজেদের খাওয়ার জন্য লিটার খানিক ঘরে রেখে সবটায় বেঁচে দেয়। স্বামীর খাটুনির শরীর, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে যত্ন করে বড়ো গ্লাসের এক গ্লাস দুধ হাতের আঙুলের বাঁধনে গলিয়ে দেয়। দিন গড়িয়ে পড়লে বস্তা খানিক আউড় কেটে রাখতে হয়, নইলে রাত বিরাতে গরুগুলোর পেট ন্যাংটা হয়ে এলে খুব হামলায় যে! সারাজীবন ধরে আছরার কাজেই কাজ, কীভাবে শুরু করবে তা যেন ঠিক করে উঠতে পারে না। জীবনভর কাজ করে গেল, কিন্তু সংসারের চাবি নিজের করে দাবি করেনি কখনো। আছরা বলে, শাশুড়ি থাকতে হাতে চাবি লিব ক্যানে গো! গিন্নিধন্নি হতে গেলে খুব ঝক্কি আছে।
সেই কবে রুব্বানের ঘরে বউ হয়ে এসেছিল তা মনে করতেই ঝটকা খেতে হয়। প্রথম প্রথম কী কষ্টটাই না সহ্য করতে হয়েছে, মায়ের টানে ক্যাবল বাপের বাড়ি ছুটে যেতে ইচ্ছে করত তার। তখন মায়ে একটা বকন গোরু আর একটা পাঠি ছাগল দিয়েছিল। পরের ঘরে গেলে মেয়েদের সংসারি হতে সময় লাগে। আছরার দাদি বলত, বাপের বাড়ি থাক্যা ভাতারের ঘরে মুন না বসাতে পারল্যা ছুড়িবোরা সংসারি হয় ন্যা। তাই একাড্ডা গোরু ছাগল দিতে হয়। গোরুছাগল পালতে পালতে সংসারের আর মরদের দিকে একাকচিন মুন বসে, মেয়ে মরদের শরীরের প্রতি টান গাঢ় হয়, নাহাল্যা, পরের ছেলে এমনই এমনই ভাত দিবে! আছরা কিন্তু চালাক মেয়ে, অল্পদিনের মধ্যেই ঘর বাহির সবেতেই মন বসিয়ে ফেলে। স্বামীর সঙ্গে মাঠে যেতে হয় না ঠিকই তবু সারাদিন স্বামীর ঘর-সংসারের কাজেই তলিয়ে রাখে নিজেকে। সংসারে এতো জমিজায়গা, ধানগম, গোরুছাগল তবু মন ক্যামন যেন সুখী হতে পারে না!
বিয়ের এতো বছর পরেও সে একটাও সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি। শ্বাশুড়ি কত জায়গায় না টেনে টেনে নিয়ে গেল, পানিপড়া, তেলপড়া, না কিছুতেই কিছু হলো না। শাহাবাজপুরের এক পীর তার সঙ্গে এক রাত কাটাতে বলেছিল, শ্বাশুড়ির যদিও কোনো আপত্তি ছিল না তবু আছরা তা করতে পারেনি। পরপুরুষের সঙ্গে সে কীকরে শুব্যা, ছিঃ ছিঃ! ভাবতেই তার গা গুলিয়ে আসে। থাক ছেলে বিইয়ে কাজ নাই আমার! কিন্তু সমাজ এবং পরিবারের কাছে তার চাপ আরও বাড়তে লাগল, জাভাগীরা চারপাঁচটা করে বিয়ান দিতে লাগল। বিয়ের মাসতিনেক পরে নাকি একবার পেট ধরেছিল আছরা। পাড়ার জাইয়েরা বলে, প্যাট খসে গেলছে। মাগির থল্যা ছোট ছেলে দাঁড়ায় ন্যা। আছরা এতে কোনো রাগ করে না, সে খিল খিল করে হেসে উঠে বলে, আজারে কথা, নাগো না; আমার প্যাট হলো আর আমিই বুঝতে পারনু ন্যা! দুই মাস ত্যানা কাছতে দেখেনি শ্বাশড়ি, তাতেই ওই রটাল! বুড়হি মানুষ কী করব বুলধিনি! সে মনে মনে আফসোস করে, এ জন্মে মা হওয়ার সুখ নাই তার কপালে! ভাগ্যের জন্য কাউকে সে দোষারোপ করেনি, আল্লাকেও না!
ঘরে একাকটা বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে কার সময় কাটে! আছরার খরালাগা মাঠের বুকে কোথাও পানি দাঁড়ায় না। তাই ঘর-সংসারের কাজ সেরে শূন্য ঘরে সময় কাটে না তার। উদাস চোখে মেঠোপথে চায়, মাঠুরে মানুষের চলাফেরা দেখে। দূরের মাঠে কত গোরুছাগল চরে, কত বাছুর, ছাগলছানা। কয়েকটি বালক জাল ঘাড়ে হাঁটতে থাকা বাপের পিছু নেয়। মাছ ধরতে যাবে। বাপ খ্যাদানি মারে; যা কহাছি, মাঠভর্তি কাদাপানি কুঠে পড়ে খামটাম হবি বুলনু, শুনতে পাছিস ন্যা নাকি! ছেলেরা আবদার ধরে, না আব্বা যাব! সাতসতের দেখে মনের কোণে কী কী ভাবনা আসে আছরার; এভাবেই কখন সারা দুপুর খিলখিল করে হাসতে হাসতে পার হয়ে যায় বাবলা গাছের কাঁটাল মাথার ওদিকে। মন অবশ হয়ে আসে। আছরা তক্তপোশের শরীরজুড়ে নিজেকে মেলে দ্যায়। হঠাৎ ছাগলের শীৎকারে মনোযোগ ভাঙে; চোখ যায় ঘুলঘুলির ফোকর গলে ওপারে। মেঠোপথের ঢাল যেখানে নেমে গিয়েছে লাঙল দেওয়া ঢেলাল খেতে, সেখানে মাটি কামড়ে গজিয়ে উঠেছে দুরবো ঘাস। ঘাসের ওপর তার সাদা ধাড়ি ছাগলটা লেপ্টে শুয়ে ভেবাচ্ছে। বিয়ের পরে পরেই দাদি তাকে দিয়েছিল। এই নিয়ে সাত বিয়ান। নামেই ধাড়ি, একটা ছানাও জীবিত নাই। আছরার মতোই কোনো ছানাই জন্ম দিতে পারেনি, আগের ছটায় একদেড় মাসের গাভিন থেকেই খসে গিয়েছে। কতবার শ্বাশুড়ি বলেছে, বউয়ের ছাগলডার পয় নাই, বালের ধাড়িকে গোস্ত করে খায়ে লিব। নাহালে বেঁচে দেওধিনি। আবা একটা পাঠির বাচ্চা কিনে লিব্যা! মনে মনে বলে, ছাগলও যা, মালকিনও তা। শুধু খাওয়া আর শুয়া, বিয়ানের বেলাই লবঢঙ্কা। কিন্তু আছরা বেঁচতে চায়নি, পেট খসে যাওয়ার পরে প্রতিবারই বলে, মা থামেন তো, আর একবার দেখি। একবার শ্বাশুড়িকে বলেছিল, মা আমারও তো বাচ্চা হয় ন্যা, আমাকেও বেঁচে দিবেন নাকি গোস্ত করে খাবেন! শ্বাশুড়ি রা কাড়ে না, রাগে গুই গুই করতে করতে গোয়ালের দিকে চলে যায়। সেই ধাড়াটা এবার পূর্ণ ছ’মাস পেট ধরেছে, বিয়োবে। মা ছাগলের শরীর থেকে বাচ্চার দুটো খুরওয়ালা পা বেরিয়ে এসেছে। শ্বাশুড়ি তা ধরে বের করার চেষ্টা করে কিন্তু পিচ্ছিল গর্ভরসে শক্ত করে ধরতে পারে না ছানার পা। শ্বাশুড়ি হুকুম করার আগেই সে দৌড়ে নিচে আসে। হাতে একবাটি ঘুঁটের ছায়। আছরা দেখে, গলগল করে গর্ভরস নেমে যাচ্ছে ঘাসের বুকে। অনেক টানাটানির পরে একটা ছানা বেরিয়ে আসে। শ্বাশুড়ির মুখ শিটকানিতে আছরার উল্লসিত মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে। হায় কপাল, ল্যাংড়া খুড়া খাসি গো! ভাব্যাছিনু, সুস্থসবল একটা খাসি হলে তুমাধেরকে কুরমানি দিতে বুলব। এই তুমার বিচার আল্লাহ!
শ্বাশুড়ির কথার ধাত শুনে আছরা শিহরিত হয়। মাথার মধ্যে চক্কর খেলে যায়, চোখের সামনে কালো আঁধার নেমে আসে। দীর্ঘদিন পালন করার পর এবার সেও যে বড়ো আশা করেছিল, তা অস্বীকার করতে পারবে না। কই হলো ! সে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। এইসময় ধাড়িটা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায়, ক্লান্ত, ব্যথিত শরীরেই সদ্য জন্ম দেওয়া খোড়া ছানার শরীর চেটে পরিষ্কার করিয়ে দিতে শুরু করে। আছরার শাশুড়ি মুখে ক্যাবল চুক চুক আওয়াজ করে; হায় হতভাগী! একেই বুল্যা মা জাত, যে মা হতে পারল ন্যা, তার জীবনে কী আছে! নাজায় বাচ্চা হয়েছে তাও দেখ, কি দরদ। আহারে, অবুলা জাতেরও তুমি এতো ছরাদ দেও কেনে আল্লা! আছরার শরীরের মধ্যে ক্যামন শিরশির করে ওঠে; মনে হয় আছরার শরীর থেকেই একটা পঙ্গু বাচ্চা বেরিয়ে এলো। বিষিয়ে ওঠে মনের আনাচে কানাচে; বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্যামন ব্যথা, ক্যামন আনন্দ তা এজীবনে তার আর জানা হলো না। আজ তার মনে হয়, তার এমন ল্যাংড়াখুড়া একটা ছেলেপিলেও যদি হতো, তবু মাতৃসুখে জর্জরিত হয়ে মরে যেতে পারত। মনের অলিতেগলিতে ক্যামন ভাবনার ছায়াপথে সব পথ অচেনা হয়ে আসে; এক ছুটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে, তারপর ওপরের ঘরে গিয়ে ওঠে। শ্বাশুড়ি বুঝতে পারে ব্যাপারটা; তার বুকের মাঝেও ক্যামন ফুপিয়ে ওঠে বাতাসের একটা ঢেউ, ছাগলের জন্য নাকি একমাত্র সন্তানহীনা বউমার জন্য তা বুড়ি বুঝতে পারে না। ক্যাবল আল্লাহ বলে এক পলক আকাশের দিকে চায়।
মরা বিলের পাশ দিয়ে সদ্য গজিয়ে উঠা নুলো রাস্তাটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্যাড়প্যাড়ির মাঠে নেমে গিয়েছে, কিছুটা খেই হারিয়ে আবার রাস্তাটা জেগে উঠেছে আলের মতো হয়ে। দেখলে মনে হয়; ঢেলামাটির এবড়োখেবড়ো পথ ভুল করে চিতিয়ে থাকা জলে নেমে গিয়ে পরে ভুল বুঝতে পেরে আবার ওপারে উঠে হাঁটতে শুরু করেছে। ওই মাঠেই আছরার স্বামী দিনভর কাজ করে। দিনের আলো ঝিমুনি ধরলে হালবলদ নিয়ে মাথাল মাথায় বাড়ি ফিরে। তখন নতুনভাবে কাজ শুরু হয়। মাঝেমধ্যে স্বামী ফিরতে দেরি করলে শ্বাশুড়ির হাতে হাত দিয়ে কত রকমের কাজ সে করে, গোরু বাছুরের গা ধুইয়ে দেয়, খেজুর আর তালপাতার পাটি বোনে, বাতিল কাপড় জোড়া দিয়ে দিয়ে কাঁথা বোনে। স্বামী ফিরলে ইঁদারা থেকে জল তুলে স্নানের ব্যাবস্থা করে দেয়। পিঠ, গলা, কোমর কচলিয়ে শরীরের খড়িমাটি, ময়লা তুলে রায়ের তেল মাখিয়ে দেয়। সেদিন রাতে স্বামীর সঙ্গে ক্যাবল ছাগলের বাচ্চা হওয়ার গল্প করে। সে এবাড়িতে বউ হয়ে আসার পরে, পাড়ার কত বাচ্চা কোলেপিঠে করে মানুষ করল। স্নান করানো, খাওয়ে দেওয়া, নাকের পোটা ফেলা, পটি করলে ছুচিয়ে দেওয়া। সেসব নিয়েও শাশুড়ি কম অশান্তি করেনি! বাচ্চারাও কি তাকে কম ভালোবেসেছে! কোনো কোনো বাচ্চা তার কাছে এসে বাড়ি যেতেই চাইত না; শেষে বাপমা সেধে এসে ভুগিয়ে ভুগিয়ে নিয়ে যেত। কোনদিন রাত হলে ঘুমিয়ে পড়ার পরে বাড়িতে নিয়ে যেত। তখন পাড়ার মানুষও খুব ভালোবাসত আছরাকে।
কিন্তু সময় যত যেতে থাকল, সন্তান না হওয়া মেয়ের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যেতে থাকল। পাড়ার বাচ্চাদের এ বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে গেল এক সময়। মায়েরা মনে করত, তাদের ছেলেমেয়েদের বশে এনে আঁটকুড়ী আছরা নিজের করে নেবে। মাগী এতোই অপয়া, ছাগলেরও বাচ্চা দাঁড়ায় না! আছরার মাও নাকি প্রথম জীবনে আঁটকুড়ী ছিল। বিয়ের পনের বছর পরে আছরা জন্মায়। তাই সদ্য বিবাহিতারাও তার ধারেকাছে ঘেষতে চায় না, পাছে ছোঁয়া লেগে তারা বাঁঝা হয়ে যায়। হঠাৎ ব্যা ব্যা আওয়াজে চমকে ওঠে আছরা। ছানাটা অন্য ছাগল বা ধাড়ির পায়ের তলায় পড়ল নাকি ভেবে স্বামীকে ডেকে বেরিয়ে আসে।
সদ্যজাত ছানাটি ছটফট করতে থাকে। সন্ধ্যার আগেও আছরা ধাড়ির বাটে মুখ লাগিয়ে দিয়ে ছানাকে দুধ খায়য়ে দিয়েছে। কিন্তু ছাগলছানা ঠিক মতো দুধ টানতে পারছে না! নুলো পায়ে দাঁড়াতেই পারে না ঠিক মতো তো বাঁটে মুখ লাগাবে কী! তাই সারা রাত ভ্যাবাতে থাকে। সারারাত ভেবিয়ে ভেবিয়ে শেষরাতে ছানাটা আর টিকল না! কারও চোখে ঘুম নেই; শ্বাশুড়ি, স্বামী সবাই ছঞ্চেতে বসে। ঢাড়ি ছাগলটা মরা ছানার গা তখনো চেটে যাচ্ছে নিরন্তর আর তার দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে নামছে! সদা লাস্যময়ী আছরা ধাড়িকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। দুটি অতৃপ্ত গর্ভ, তার মনে হলো, ধাড়িকে না, আছরা নিজেই নিজেকে ধরে কান্না করছে। তার জমিয়ে রাখা সব কষ্ট চোখ বেয়ে ধাড়ির শরীরে নেমে যেতে লাগল! তার এতো কষ্টে ভরা জীবনে কেউ কখনো চোখে পানি ঝরতে দেখেনি। আজ বিহানবেলায় ছঞ্চে ভর্তি মানুষ নামল। হয়তো তামাশা দেখতে, হয়তো আছরাকে সান্ত্বনা দিতে। আছরার বারবার মনে হলো, নিজের বাচ্চা মরলে বুঝি মানুষ এইভাবেই কাঁদে।
সেই থেকে আর ঘুমোতে পারেনি আছরা। ছঞ্চের শেষপ্রান্তে লগড়াগাছের নিচে বাচ্চাটা কবর দেয় স্বামীস্ত্রী। স্বল্পভাষী রুব্বান কখনো কোনো ব্যাপারে বউ কিংবা মাকে জোর করেনি, আজও করল না। বরং বউয়ের সঙ্গ দিল! আছরা নিজের শাড়ির আঁচল ছিড়ে ছানাটার গায়ে জড়িয়ে দেয়। যে শ্বাশুড়ি এতোদিন বাচ্চা না হওয়ার জন্য বেটার বউকে দোষারোপ করে এসেছে, পীরের কাছে রাত কাটাতে হুকুম করেছে, গালি দিয়ে বলেছে, বান্দির বিটি আল্লা বিল্লে মানে ন্যা, অর প্যাটে আল্লা ফল দিবে ক্যানে! আজ তারও কেমন যেন হঠাৎ হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। বুকের মধ্যে খচখচ করতে থাকে। ছেলের বউয়ের গলা ধরে হুহু করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারে না!
পরেরদিন সকালে ধাড়িকে ভালোভাবে গা ধুইয়ে দিয়ে এক কষাইকে ডেকে বেঁচে দিল শ্বাশুড়ি। আছরা বা রুব্বান কেউ কোনো আপত্তি জানাতে পারেনি; ধাড়িকে এবাড়িতে ধরে রাখার অধিকার বা মেয়াদ বুঝি শেষ হয়ে গিয়েছে। আছরা বুঝতে পেরে কোন কথা বাড়ায়নি। তারও বুঝি এবাড়ির মেয়াদ শেষ। কারণ ক’দিন পরেই রুব্বানের দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন শুরু হলো বাড়িতে। আছরা তো বিয়াতে পারল না! শাশুড়ি মনে করে, যে গাছ ফুলফল দেয় ন্যা, তাকে পুষে কী করব! কাট্ট্যা খড়ি করা ছাড়া তার কুনু দাম নাই। তাই ছেলের অমতেই নতুন বিয়ে ঠিক করে বসে।
ছেলের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য পয়সাওয়ালা শাশুড়ি বেশ ধুমধাম অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। সারা বাড়ির ভেতর ও বাইরেজুড়ে প্যান্ডেল খাটানো, বড়ো পালাঙ্গার এককোণে বড়ো ডাইস, নতুন বউ-বর বসবে। বিয়ের দু’দিন আগে থেকেই প্রচুর মানুষজন আসতে শুরু করে। এমন রৈ রৈ কাণ্ডের মধ্যেই কেউ কিছুই জানল না; আছরা বেপাত্তা হয়ে গেল। কোত্থাও পাওয়া গেল না। কোথাও যাওয়ার মতো ইহলোকে তার কেউ নেই। রাতের দিকে রুব্বানের মায়ের ঘরে একটা সাদা কাগজ পাওয়া গেল…
মা, কেটে লিখেছে, অন্যজুনার শাশুড়ি,
সালাম লিবেন। আপনাদের এই বেলাল্লাপনার শরিক হওয়ার কুনু ইচ্ছে আমার নাই। আপনারা জানেন, আমি কুনুদিনই আপনার বা আপনার ব্যাটার কুনু কাজে বা কথায় বাঁধা দিইনি, রাগ বা আপত্তিও করিনি। সেই বিহ্যার রাত থাক্যা বাড়ির যত কাজ আমি আমার মুনে করে মাথা পাত্যা লিয়ে করে আস্যাছি। শরীর যতই খারাপ হোক না করতে পারিনি, কারণ আপনারা মুনে করেন, বাঁঝা মানুষের নাকি রোগশোক থাকতে নাই! তাই মান্যা লিয়েছি, তাও আমাকে ন্যায় অন্যায় বুলেছেন, সব মুনে আছে।
এতদিন সব ঠিকঠাক ছিল, এবার আপনার ব্যাটার বিহ্যা দিছেন, দেন। আমার কিছু করার নাই; ইসলাম ধর্ম, এই সমাজ, পুরুষমানুষকে একাধিক বিহ্যার অধিকার দিয়্যাছে, ঠিক ভুল বিচার তিনার ওপর। যদি তাই দেয়, তাহালে পরথম বউয়ের হুকুম লিয়ে বিহ্যা করতে হতক, বুলেন এডেও কই হাদিশে বুল্যেনি? পুরুষ দোষ করলে কুনু পাপ নাই বুলেন? সাত খুন মাফ! মাগি মানুষ ধাপে ধাপে নানান ছোটখাটো দোষের মাশুল দিয়ে যাবে? চিরকাল পাপের ভয় দেখিয়ে অসহায় মেয়েদের কুরমানির পশু করে মুরুকখু সমাজ! আর তাতে হাত লাগিয়ে সাহায্য করে আপনাদের মুতন বেয়াদপ মেয়েরা। স্বামীর অকক্ষমতা লিয়ে বাইরে মুখখুলা গুনহা, তাই কুনুদিন বুলিনি; আজ বুলছি, আপনি বুল্যাছিলেন ন্যা, যে গাছে ফুলফল হয় ন্যা তাখে খড়ি করা ছাড়া কাজ নাই? শুধু গাছ লাগালে হয় ন্যা মা, গাছের গুড়ায় পানিও দিতে হয়। সে পানি দিওয়ার কুনু দম নাই আপনার ব্যাটার! যতই বিহ্যা দেন, ছেলেপিল্যা হবে ন্যা!
কথাডা শুনে কষ্ট পায়েন ন্যা। জানি কুনু ভুল করিনি, তাও মাফ চাহাছি, মাপ করেন। জানি আপনাদের জীবনে আমার কুনু প্রয়োজন নাই, আমাকে খুঁজে লাভও নাই।
ইতি,
আপনাদের আঁটকুড়ী, আছরা।
রাশিদুল বিশ্বাস গল্পকার। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদেরডোমকলে জন্মগ্রহন করেন। গ্রাম্য পরিবেশে বড়ো হয়ে উঠতে গিয়ে দেখেছেন মাঠচষা, খেতকুড়ানো, মাছধরা , খেতে না পাওয়া অসহায় মানুষের জীবনশৈলী, তা দেখতে দেখতে নিজের জীবনভাবনায় একাত্ম করে নিতেই কলম ধরেন। ইতোমধ্যে লেখকের দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।