একটি স্মারকগ্রন্থের জন্য লেখা চাই

হ্যালো, কেমন আছেন?
ভালো। কে বলছেন?
আমি নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর বলছি।
কোন নূরুদ্দিন? 
আমি একটু আধটু লেখালেখি করি। আপনার সঙ্গে আমার বেশ ক'বার আলাপ হয়েছে। আমি আপনার প্রায় সবগুলো বই পড়েছি। আপনি আমার প্রিয় লেখকদের একজন। ছোটো কাগজে আপনাকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। আপনার ভালো লেগেছিল বলেছিলেন। আমি যে জন্য ফোন করেছি—
কী নাম বললেন যেন?
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর। আমি দু'বার আপনার বাসায়ও গিয়েছিলাম। আমার একটা বই আপনাকে উৎসর্গ করব বলে আপনার অনুমতির জন্য গিয়েছিলাম প্রথমবার।
আমাকে যে বইটি উৎসর্গ করেছিলেন আপনার সেই বইটা বেরিয়েছিল কি?
জি। ওটা আপনার হাতে দিয়ে এসেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, সময় করে বইটা পড়বেন।
বইটার কী নাম বলুন তো। নামটা মনে করতে পারছি না। নূরুদ্দিন নামের লেখককেও মনে পড়ছে না। আজকাল ভুলে যাই, অনেক জরুরি বিষয় মনে রাখতে পারি না। থাক সে কথা, আমাকে উৎসর্গকৃত বইটার কী নাম ছিল?
অন্ধ সরীসৃপ। 
অন্ধ সরীসৃপ। নামটা তো ভালো। আচ্ছা, বলুন নূরুদ্দিন সাহেব, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?
আমার লেখা নিয়ে একটা লেখা যদি দিতেন, তাহলে কৃতার্থ হবো।
আপনার বইটা কোথায় রেখেছিলাম সেটা তো মনে নেই। আর এত জন বই দিতে আসে! আর সবই আজেবাজে লেখা। সকলেই মনে করে লিখলেই লেখক হওয়া যায়। আজকাল যে কেউ একটা বই ছাপিয়ে লেখক হয়ে যায়। প্রকাশককে টাকা দেয় আর প্রকাশক বই ছেপে লেখককে দিয়ে দেয়। তথাকথিত লেখক বই পেয়ে বিলি করে বেড়ায়। আর সবার আগে আমার কাছে এসে হাজির হয়। যেন আমি দু'কথা বললেই সে লেখক স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। যেন লেখা হলো কিনা সেটা কোনো বিষয় না।
আমি— 
আমি বলছি না আপনি সেরকম লেখক। কিন্তু এখন তো আমি আপনার বই খুঁজে বের করতে পারব না। আর লিখতেও পারব না। মেলা শেষে যত বই পাই সেগুলোর মধ্যে যাদের নাম আমার মনে থাকে সেগুলো বাদ দিয়ে বাকি সব আমি কাগজওয়ালা ডেকে এনে দিয়ে দিই। কিছু মনে করবেন না, আপনার বইটা হয়তো কাগজওয়ালার কাছে চলে গেছে।
ঠিকই বলেছেন। আমি মাঝে মাঝে ফুটপাতে বই বিক্রেতাদের সামনে আমার বই পড়ে থাকতে দেখতে পাই। হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখি কোনো খ্যাতিমান ব্যক্তিকে সেটা দিয়েছিলাম। অবশ্য আপনাকে দেয়া বই কোথাও এখনো পাইনি। 
এতে কষ্ট পাবেন না। লিখুন বেশি করে। আমাদের বয়স হয়েছে। তার পর আপনারাই তো লিখবেন। লেগে থাকলে আর পাঠক-সমালোচক আপনাকে চিনলে একদিন খ্যাতিও পাবেন।
জি। ঠিক কথাই বলেছেন। সেজন্যই আমি আপনার কাছে একটা লেখা চাই। 
আমি তো আপনার বইটা এখন আর খুঁজে বের করতে পারব না। আর এই কোভিডের সময় আপনিও তো আমাকে আরেকটা বই দিয়ে যেতে পারবেন না, তাই না?
হ্যাঁ। লকডাউন চলছে। আমার তো আর নিজের গাড়ি নেই, সে রকম পরিচয়ও নেই, অবশ্য থাকার কথাও নয়। থাকলে তো মাঝে মাঝে আপনাদের মতো পণ্ডিতদের নিয়ে সাহিত্যের আড্ডা দেয়া হতো। চেনাজানাটা ভালো করে হতো। 
আপনি ক'টা বই লিখেছেন?
কয়েকটা। 
কী লিখেন? 
গল্প-উপন্যাস। এটা-ওটাও লিখি।
এটা-ওটা মানে?
খাপছাড়া লেখা আর কি!
খাপছাড়া! 
যে লেখার কোনো খাপ থাকে না। ধারালো কিন্তু আবরণ নেই।
রম্য রচনা!
আসলে তা নয়। হাস্যরস নয়। মনে করুন, একটা চাকু, আরবীয় চাকু যেরকম তেমনও নয়, সাধারণ বাংলা চাকু, পুরোনো লোহা গলিয়ে কামারের বানানো। কোনো খাপ নেই। দামিও নয়। কোনো এক যুবক সেটা হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। কিন্তু কেউ জানি না কোথায় যাচ্ছে, কী করতে যাচ্ছে সে। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আর ভাবছি। কেউ ভাবছি, ছেলেটা খুন করতে যাচ্ছে। কেউ শুনে হাসছি, এমন চাকু দিয়ে কি আর খুন করা যায়! কেউ ভাবছি, ছাগল জবাই দেবে। কেউ কি ভাবে, একটা ভালো চাকু না হলে ছাগলও কষ্ট পায়? আজকালকার ছোকরারা এই সামান্য বিষয়ও বোঝে না। কেউ ভাবছি, ছোকরা মুরগি জবাই দেবে। আমি কিন্তু ভাবি, সত্যি তো।  এখন বাজারে যারা মুরগি বেচে তারা যাচ্ছে তাই ভাবে গলা কাটে। কেউ কেউ তো আবার গলা না কেটে টেনেই মাথা ছিঁড়ে ফেলে। আচ্ছা, চাকু-ছুরি এসব বাদ দেন। ওসব এখন আর আলোচনার বিষয় নয়। এখন উত্তরাধুনিক যুগ। এখন গুম, অর্থপাচার, বোটক্লাব নিয়ে  কথা হয়। করোনা অবশ্য এখনো পিছু ছাড়েনি, শয়তানের প্রতিরূপ করোনাকে বলা যায়, কত যে রূপ বদলায়! কার রূপ ধরে কখন আসবে কিচ্ছু বলা যায় না। এমন কি সিনেমার নায়িকা হয়েও সামনে হাজির হতে পারে। কাকে কখন মারতে আসবে, মেরে ফেলবে তারও ঠিক নেই। অনেক কথা বললাম। আচ্ছা, বরং আসল কথায় আসি। আমি আপনাকে ফোন করেছি—। 
আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগছে। এমন আলোচনা থেকে লেখার নতুন নতুন প্লট পাওয়া যায়। লকডাউন না থাকলে আপনাকে আজই বাসায় আসতে বলতাম, চা খেতে খেতে আরও কথা বলা যেত।
জি। আপনার সঙ্গে চা খেতে খেতে কথা বলতে পারলে আমারও খুব ভালো লাগত। অনেক দিন দেখা হয় না। আর দেখা হবে কিনা জানি না!
আচ্ছা, আমি আপনার বইটার ওপর একটা লেখা লিখে দেব। তবে এখনই পারব না, হাতে কিছু কাজ জমে আছে। আমাকে সময় দিতে হবে।
সময়টা খারাপ যাচ্ছে আপনিও জানেন। কখন কার কী হয়ে যায় কে বলতে পারে? তাই—  
আচ্ছা, আমি সময় পেলেই লিখে দেবক্ষণ। করোনা যাক, তখন আবার আমাকে মনে করিয়ে দেবেন। আর সাবধানে থাকবেন। 
তা তো থাকি। তবু হায়াত মওতের কথা কি বলা যায়? বলা যায় না, তাই আপনার লেখাটা তাড়াতাড়িই চাইছিলাম।
আমি এখন ভালো আছি। কোভিডে আক্রান্ত না হলে আরো ক'বছর বেঁচে থাকার আশা করছি। 
আপনি বেঁচে থাকুন, এটা কে না চাইবেন? আপনারা ক'জন আছেন বলেই তো আমাদের সাহিত্যাকাশে বাতি জ্বলে, আমরা সে আলোয় আলোকিত হতে পারি। তার পরও একে একে নিবিছে দেউটি। আপনি শতায়ু হোন। আপনার আয়ু নয়, আমি আমার নিজের কথাই আপনাকে বলতে চাইছিলাম।
বুঝলাম না। আপনার আবার কী কথা?
ইদানীং বেঁচে থাকাটা আমার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। সবসময় নিজেকে মনে হয়, পত্রপল্লবহীন এক নিষ্ফলা মাদার গাছ। গাছটা চেনেন নিশ্চয়। মনে হয় ফসলের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে কেবল মাটির রস শোষণ করছি। মরে গিয়ে স্বল্প পরিসর এই ভূমির কিছুটা হলেও আমি নতুন প্রজন্মের জন্য ছেড়ে দিয়ে যেতে পারি।
কীভাবে? 
আমি আসলে বেঁচে থাকতেই চাইছি না। 
ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা, তা কীভাবে মরতে ইচ্ছে করে আপনার? আত্মহত্যা করবার কথা ভাবনায় আসে?
আত্মহত্যা করতে চাইলে তো সহজেই করতে পারি। কিন্তু ভাবছি।
কী ভাবছেন?
কোভিডের কাছে আত্মসমর্পণ করব কিনা। কিন্তু তাতে সমস্যা বাড়বে।
কী সমস্যা?
আমার পরিবার, আত্মীয় স্বজনকে মৃত্যুর সময় কাছে পাবার অনিশ্চয়তা আমাকে ভাবায়। এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি, সন্তানদের বড় করেছি, আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে, আমি জানতে পারছি, অথচ ওদের আমি কাছেও ডাকতে পারব না, ওরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাছে আসতে চাইলেও আমি ওদের মঙ্গলের কথা ভেবে, ওদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন ভেবে কাছে আসতে বারণ করব। আমার মৃত্যুর পর আমার কথা ভেবে ওরা কষ্ট পাবে, আপনি বলুন, আমি এমন করে মরে গেলেও আমার আত্মা কি শান্তি পাবে?
তাহলে মরতেও চান আবার আত্মার শান্তি যাতে বিঘ্নিত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে চান?
না। ঠিক সেটা নয়। আমার আত্মার গতি কী হবে আমি তো জানি না!
তাহলে মৃত্যুর কথা ভাবছেন কেন?
ভাবছি, ওই যে বললাম, পরের প্রজন্মের মঙ্গলের জন্য। আমার তো বয়স হয়েছে। অবসরে আছি। তেমন কিছু লিখতেও আর পারছি না। প্রতিদিন আমাকে একগাদা ওষুধ গিলতে হয়, কেবল বেঁচে থাকার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য। তবু একে কি বেঁচে থাকা, সুস্থ থাকা বলা যায়? বলুন? বলা যায় না। নামমাত্র বেঁচে থেকে কেবল অর্থ আর সময়ের অপচয় করে যাচ্ছি।
সময়ের অপচয় বলছেন কেন?
আসলে এটা তো আমাদের, মানে বুড়োদের সময় নয়। এটা নতুন প্রজন্মের সময়। পুরোনো পশ্চাদপদ চিন্তার জন্য আমাদের আর বেঁচে থাকার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। 
নতুন চিন্তা কে করবে? চিন্তাবিদরা, বুদ্ধিজীবীরাই তো করবে।
তা তাঁরা করছেন কই? আপনিও কি করছেন আসলে?
আপনি আবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন। আপনি আমার কাছে আপনার লেখালেখি নিয়ে একটা লেখা চান, তাই তো?
জি। 
এটা কোথায় প্রকাশ হবে?
একটা স্মারকগ্রন্থে।
স্মারকগ্রন্থে!
জি। আমার নামে একটা স্মারকগ্রন্থ বের হবে। ওখানে আপনিও অতিথি থাকবেন দয়া করে। আমি সে কথা মনে রেখেই একটা উপন্যাস আপনাকে উৎসর্গ করে গেছি।
গেছি মানে? আপনি কি মৃত!
তা বলতে পারেন। বেঁচে থাকা প্রাণীর যে বৈশিষ্ট্য থাকে সেগুলো আমার মধ্যে আর নেই।
নাই মানে?
সৃজনশীলতা, প্রগতিশীলতা, নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখানোর সামর্থ্য—এসব আর কি। এসব না থাকলে কি মানুষ বেঁচে থাকে, বলুন?
আপনার স্মারকগ্রন্থ কখন বের হবে?
আমার শারীরিক মৃত্যুর পর।
কারা বের করবে?
আমার উত্তরসূরিগণ। কিন্তু ওরা একটা শর্ত দিয়েছে।
কী শর্ত?
ওরা বলেছে, মৃত্যুর পর যদি তুমি বেঁচে থাক, যদি তোমাকে পাঠক মনে রাখে, যদি তোমাকে নিয়ে তোমার লেখা নিয়ে পণ্ডিতগণ লিখেন তাহলে স্মারকগ্রন্থ বের করব।
আচ্ছা। এই শর্ত?
জি। এখন আপনিই বলুন, আমি বেঁচে থাকতে পারব কিনা। বেঁচে থাকার সাধ কার মেটে বলুন, হে গুণীজন! তাই তো আপনাদের মতো মহান ব্যক্তিকে কষ্ট দেওয়া, অগ্রিম স্মারকগ্রন্থে আপনার একটা লেখা আর মরণোত্তর আলোচনা সভায় আপনার উপস্থিতি চাই।
কিন্তু আপনি তো বেঁচে আছেন! আপনাকে নিয়ে পরিচিতজন স্মৃতিকথা কী করে লিখবেন?
আমি তো অসুবিধা আছে দেখি না।
তারা লিখবেন আপনি মরে গেছেন!
জি। আর আত্মা তো মরেই গেছে। দেহটা ধারণ করে আছি মাত্র। একটা কথা বলি, জনাব, আপনিও ভেবে দেখুন না, আমাদের প্রত্যেকেরই আত্মা কি মরে যায় নি? আমরা কি কেবল দেহটা ধারণ করে আছি বলে আপনার কখনোই মনে হয় না? যদি এমনটা কখনো মনে না হয়, তাহলে তো আপনি সত্যিই মরে গেছেন। তাই না?
আপনি থামুন। 
আচ্ছা, রাখছি। ভালো থাকুন।


নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর কথাসাহিত্যক। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ৬ টি। ভোরের জন্য প্রতীক্ষা, উত্তরসূরিগণ, রবীন্দ্রনাথ উপমা এবং আমি, মরণ চাঁদের রবীন্দ্রনাথ, মাননীয় মন্ত্রীর জন্য মানপত্র, পুষ্পিত ফাগুন সায়াহ্নের আগুন। উপন্যাস ১২ টি। উদ্বাস্তু, কেঁচো, জাল থেকে জালে, মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল, বিল ডাকিনি, A Tale of Rohingya, অচেনা নগরে অর্বাচীন কিশোর, দায়ভাগ, থাকে শুধু অন্ধকার, আদমসুরত, সোলেমন, অর্কিড । প্রবন্ধগ্রন্থ ১টি। ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ। গবেষণা গ্রন্থ Traditional Medicine in Bangladesh.

menu
menu