পুনর্জন্ম

ব্রিজটা পার হব। যাবেন?
তুমি বললে যাব।
না থাক। আপনি এপারে বসে আমার যাওয়া দেখেন। আমি একাই যাই।
যদি ট্রেন আসে?
আসুক। ঝাঁপ দেব।
পানি দেখেছ? শীতকাল। নেই বললেই চলে।
ভাবছেন কেন? কিচ্ছু হবে না।
যেও না। কী দরকার! আমার খুব টেনশন হবে।
হোক। আমার জন্য কিছুক্ষণের জন্য হলেও টেনশনে থাকুন।
কিছু হলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
কেলেঙ্কারী হওয়ার বাকি আছে কিছু! সেদিন আপনার দাদা সরাসরিই অভিযোগ করল।
কী বলল?
আমি ভুল পথে চলে যাচ্ছি! সংসারে মনোযোগ নেই! ছেলেমেয়ের কথা ভাবছি না! 
তাতো সত্যিই।
আপনিও বললেন!
সত্যিটা বলব না! আমার জন্য সংসার থেকে টাকা সরাচ্ছ। সেদিন গয়নাগুলোও বেচে দিলে।
আরে রাখেন গয়না। ওসবে আমার লোভ নেই। ওর মামা তো বোন নীতাকে তো চিনতেন, তার বিয়েতেও দুই ভরি দিয়েছিলাম।
নীতাতো মামাতো বোন, আত্মীয়! আমি কে!
আপনি আমার মুক্তি। দক্ষিণের হাওয়া। বদ্ধ ঘরের জানালা।
আরিব্বাস! কবিতার মতো শোনাচ্ছে।
বিশ্বাস করুন, এসব একেবারে আমার মনের কথা। এবার আপনাকে এভাবে না পেলে বেঁচে যে আছি টেরই পেতাম না।
আমিও। সব জায়গায় হেরে গেলেও এ একটা জায়গাতেই আমার জিত।
আপনার মনে আছে?
কী?
সেই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটার কথা। আপনি মাস্টার্সে, আমি থার্ড ইয়ার।
আঠারো বছর হয়ে গেল! তুমি তখনো শাড়িই পরতে। কপালে লাল টিপ, মাথায় সিঁদুর।
সেকেন্ড ইয়ারেই তো, আপনার দাদার সঙ্গে বিয়ে হলো। শাড়ি তো পরি সেই ফাইভ থেকে। ঠাকুরের দীক্ষা নেয়ার পর।
কালো একটা মেয়ে, কিন্তু শাড়িতে কী দারুন দেখাচ্ছিল সেদিন।
আপনি পরেছিলেন প্যান্ট-পাঞ্জাবি।
এবং সেদিনই আমাদের প্রথম কথা। তুমি ঘটকালি করতে এসেছিলে!
পলিটা বড়ো বোকা ছিল। আপনাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেল।
ওসব বাদ দাও। আমার আর পলির কোন ভাব-ভালোবাসা হয়নি। 
আমরা একত্রিত হলে তোমার কথাই বলতাম। পলি একদিন, কী বলেছিল জানো? আপনি আসলে মৈত্রেয়ীকে ভালোবাসেন। ওর একটা বোন ছিল, নামটা ভুলে গেছি, সে নাকি পলিকে বলেছিল, সেলিম ভাইয়ের চেহারাটা হিন্দুদের মতো! বোঝ!
আমি কিন্তু তখন কিছুই বুঝতে পারিনি! পলি বিয়েতে নিজে এসে নিমন্ত্রণ করেছিল। রাগ করে যাইনি।
পলি থাক্। অনুষ্ঠানটার কথা কী যেন বলছিলে ...।
অনুষ্ঠানেই আপনাকে প্রথম দেখলাম। আপনি তো ক্লাস-টিলাস তেমন একটা করতেন না। সারাক্ষণ কেবল পার্টি আর পার্টি।
ক্লাস আমার ভালো লাগত না। টিচারদের বকবকানিতে মাথা ধরে যেত। ক্লাসমেটগুলোকে খুব বোকা মনে হতো।
কিন্তু অনার্সে তো ঠিকই ফাস্ট হয়েছিলেন!
টিচারগুলোও বোকা ছিল নিশ্চয়ই। ভালো করে খাতা-টাতা দেখেনি। না হলে আমি তো সব আন্দাজেই লিখেছিলাম।
আন্দাজে বলছেন কেন! আপনি তো সাহিত্যটা জানতেন-ই। পরে আমরা সবাই টের পেয়েছি। আপনার বন্ধু মিষ্টুদি কি বলতেন জানেন? স্যারেরাও আপনার মতো ভালো বুঝতেন না।
মিষ্টুটা তো বোকাই ছিল। এখনো বোকার হদ্দ। না হলে কেউ মাস্টারি করে!
মাস্টারি একসময় আপনিও করতেন! আমিও করি!
আরও বেশিদিন করলে পাগল হয়ে যেতাম। একই পড়া, একই পদ্ধতি, ভালো মানুষের মুখোশ, মাই গড! তুমি এই যে এতদিন ধরে পড়াচ্ছ তোমার খারাপ লাগে না!
লাগে মাঝে মাঝে, আবার ভুলেও যাই। ওর একার আয়ে তো সংসার চলে না। ছেলে-মেয়ের পড়াশুনা, শ্বশুর-শাশুড়ি। জানেন-ই তো, দেবরের বউটা মারা যাবার পর ওর ছেলেটাও আমার কাছে।
তোমার ঠাকুর কিন্তু মেয়েদের চাকুির করার বিরোধী ছিলেন!
ঠাকুরের কোন্ নির্দেশটাই আর মানতে পেরেছি বলেন! ঠাকুর বলেছিলেন, নিষ্ঠা, ধর্ম, শুশ্রƒষা, সেবা, সাহায্য, সংরক্ষণ, প্রেষণ ও প্রজনন এই হচ্ছে নারীর বৈশিষ্ট্য। আমার তো সাতটা বৈশিষ্ট্যই হারিয়েছে। বাকি একটা রইল সাহায্য, দেখি ওটা করে ঠাকুরের মানটুকু রাখতে পারি কি না।
চাকুরির কথা না বললেও তোমার ঠাকুর নারীর শ্রমের কথা বলেছিলেন। অর্থে ও সম্পদে সচ্ছল হওয়ার কথা বলেছিলেন।
তাই তো চেষ্টা করে যাচ্ছি। জানেন, সুপ্রজনন আর যৌথভাবে মানুষের সেবা করার জন্যই আপনার দাদাকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু হলো না।
হলো না বলছ কেন! তোমার ছেলেমেয়েরা কতো লক্ষ্মীমন্ত! দাদা মাটির মানুষ। কতজনকেই তো দান-দক্ষিণা করছ! আমার সংসারটা তো বলতে গেলে তোমার দয়াতেই টিকে আছে!
ওসব বলবেন না। আপনার চেষ্টাতেই আপনি টিকে আছেন। তাছাড়া ভাবি খুব ভালো মেয়ে। চাহিদা নেই, অভিযোগ করেন না।
সেতো তোমার কাছে। আমার সঙ্গে সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান।
তা সব সংসারেই একটু-আধটু হয়। আমাদের মতো তো সারাক্ষণ লেগে থাকেন না। তাছাড়া আপনার তো সব সামলে নেয়ার ক্ষমতা আছে।
নারে মৈত্রেয়ী, নেই। সংসার মানুষকে ছোট করে দেয়।
জানেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি কোনদিন বিয়ে করবেন না। বিজনদার কাছে যেদিন শুনলাম আপনি বিয়ে করেছেন, কষ্টে আমার বুক ফেটে গিয়েছিল।
হাসপাতালে আমার মেয়ে হওয়ার খবরটা তোমাকে জানিয়েছিলাম। ভেবেছি আসবে। আসনি।
রাগ করে আসিনি। আপনার কেন মেয়ে হবে! আপনার তো সাধু-সন্ন্যাসী হওয়ার কথা!
ধুর! সাধু-সন্ন্যাসী হতে অনেক যোগ্যতা লাগে। কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম। ফেল মেরেছি।
তা কেন! আপনি এখনো সাধু-সন্ন্যাসীই আছেন। বাইরেরটাই সংসারির মতো। কোন জিনিসই আপনাকে স্পর্শ করে না। যে অসুবিধার ভিতর আপনি বাস করেন অন্য কেউ হলে পাগল হয়ে যেত।
আমিও পাগল হয়ে যেতাম। অনেকবার পালিয়েছি, সুইসাইড করার চেষ্টা করেছি। এবার তোমাকে পেলাম তো তাই একটু সুস্থির হয়েছি।
আপনার উপর আমার খুব রাগ হতো। ভাবতাম পলির জন্য হতাশ হয়ে আপনি চাকরি-বাকরি করছেন না। আপনাদের পরিবারটাকে তো জানতাম। কী সমস্যা তাদের! আর আপনি!
পলি-টলি কিছু না মৈত্রেয়ী। আমার কিছুই ভালো লাগত না। পার্টিটা ভেঙে গেল। বুঝে গেলাম, বিপ্লব-টিপ্লব সব মিছে। তাছাড়া এত ছোট পার্টি, মানুষ নামই জানে না। নেতারা শক্ত-শক্ত কথা বলে। রস নেই, সুর নেই
বিরক্তি ধরে গেল।
তারপর তো ঢাকা গেলেন।
ঢাকায় গিয়ে সুফি-বাউলদের একটা দলের সঙ্গে ভাব হলো। কিছুদিন মজে ছিলাম। পরে দেখলাম ওখানেও ফর্ম। পুনরাবৃত্তি। তারপর বিয়ে করলাম। মেয়েটা হলো। সংসারে আটকে পড়লাম।
আমার কথা মনে পড়তো আপনার?
সব সময়।
ফোন-টোন দিতেন না কিন্তু!
ইচ্ছে করেই দিতাম না। ভাবতাম, ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। বারবার সেই রাতটার কথা মনে পড়তো। দাদা সিলেট গেলেন, আমি, তুমি আর প্রকাশ বাসায়। আমি কিন্তু জানতাম না দাদা সিলেট যাবেন।
জানেন, ও যাবার আগে আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ছিল। ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়েও দিতে পারিনি। প্রকাশ তো তখন আমার বাসায়ই থাকে। মৃন্ময় আর চিন্ময় ছোট। আপনি বাসায় আসার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মাথা-ব্যথা চলে গিয়েছিল। এখনো আপনি সামনে আসলে আমার সব ব্যথা, মনখারাপ মুহূর্তের মধ্যে চলে যায়।
সে রাত নিয়ে তোমাদের পরে ঝামেলা হয়েছিল।
ও আমাকে চড় মেরেছিল পর্যন্ত!
কিন্তু তখন তো আমাদের সম্পর্কটা আজকের মতো ছিল না। আমার দিক থেকে যদিও ছিল তোমার দিক থেকে মোটেও না।
আজ বুঝি আমার দিক থেকেও ছিল। বুঝতে পারিনি। ঠাকুর বলেছেন, ‘যার যেখানে টান, তার সেখানে প্রাণ।’ আপনাকে দেখলে আমার প্রাণ নেচে উঠতো। মনে হতো, এই বুঝি আমার ঠাকুর এলেন।
আমার অনেক নীচতা আছে মৈত্রেয়ী। ঠাকুর-টাকুর বলে ঠাকুরকে অসম্মান করো না।
আমাদের ঋত্মিক শৈলেন কাকু কে চিনেন?
হ্যাঁ, বগুড়ায় তোমাদের এক গুরু ভাইয়ের দোকানে আলাপ হয়েছিল।
তিনি আমাকে কি বলেছেন জানেন, ‘সেলিমের সাথে কথা বলে মনে হলো, ঠাকুরকে আমাদের চেয়ে ওই ভালো বুঝেছে।
শৈলেন বাবু হয়তো ভুল বুঝেছেন মৈত্রেয়ী। তোমাকে বুঝতে গিয়েই আমাকে ঠাকুরে মজতে হয়েছিল।
ওই একই কথা, মজেছেন তো! ঠাকুর বলেছেন, ‘যে যাহারে ভালোবাসে সে তাহারি স্বভাব পায়।’
আমি তো তোমার স্বভাবে স্বভাবিত হতে পারিনি মৈত্রেয়ী। তুমি নিরামিষ খাও আমি আমিষ, তুমি পরিশ্রমী আমি অলস, তুমি কখনো মিথ্যে বলো না, আমি বলি, তুমি জীবনে ঘনিষ্ঠ হও আমি পালিয়ে বেড়াই।
এসব তো বাইরের, ভিতরের মানুষটাকে তো জানি। ওখানে সবকিছু একাকার। কেবল একটা ব্যাপার মনে হলে মাঝে মাঝে বুকে জ্বলুনি হয়।
কোন্ ব্যাপার বলতো!
আমার মনে হয়। কেবল আমি নই আপনি অন্য নারীতেও আসক্ত।
তোমার ভাবির কথা বলছ!
না। ভাবি তো আছেনই। অন্য কেউ। বুঝতে পারি না, টের পাই।
মিছে ভেবে কষ্ট পেয়ো না। জীবনানন্দের একটা লাইন আছে, শুনবে?
বলুন।
এখনো নদী মানে শুদ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো/এখনো নারী মানে তুমি, কতো রাধিকা ফুরাল।
সেই রাধিকাদের কয়েকজনের নাম বলুন না, শুনি।
মিছে বলি না, অনেক নারীর সঙ্গেই আলাপ হয়েছিল। ঘনিষ্ঠতাও। তবে প্রাণ কেড়েছিল একজন। অনন্তবালা দাসী। তুমি ছাড়া সে-ই একমাত্র নারী, যে আমার মন ছুঁয়েছিল।
তাকে ছেড়ে আসলেন কেন!
থাকতে চেয়েছিলাম। সেই ফিরিয়ে দিল। এক মধ্যরাতে চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘তোমার অন্য কোথাও মন বাঁধা ঠাকুর।’ অনন্তবালা আমাকে পরিহাস করে বৈষ্ণব ঠাকুর বলত।
সেই অন্য নারীটা কে! আমি তো!
হ্যাঁ। তোমার কথা বলেছিলাম অনন্তবালাকে।
শুনে কী বললেন তিনি?
ও তো বৈষ্ণবী। বলেছিল, ‘মনে রাখবে ঠাকুর পৃথিবীর সব বিখ্যাত প্রেমই পরকীয়া। পরকীয়া মানে কিন্তু পরের স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম নয়। অন্যের মাধ্যমে নিজের প্রেমকে অনুভব করার পন্থা।’
অনেক শক্ত কথা। আমাকে একদিন নিবেন ওনার কাছে।
আমি তো এখন ওখানে যাবো না মৈত্রেয়ী।
ওমা, কেন!
নিজের প্রেমকে এখনো আমি অনুভব করতে পারিনি। যেদিন পারবো সেদিন যাবো।
আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
আপনি ভাবিকে ভালোবাসেন?
তুমি দাদাকে বাস না?
বাসি তো।
আমিও বাসি। একসঙ্গে থাকলে ফাঁক-ফোকড় দিয়ে অনেক টান এসে জমা হয়।
এবার তাহলে ব্রিজটা পার হই। সাড়ে ছয়টা বাজে। বাসার সবাই ঘুম থেকে উঠে যাবে।
সাবধানে যাও।


যাজ্ঞবল্ক্যের স্ত্রী মৈত্রেয়ীর নামানুসারেই আমার নাম রাখা হয়েছিল কিনা জানি না। তবে ছোটবেলাতেই আমার সাধ হয়েছিল আমি তাঁর মতো হব। আমার স্বামী হবেন ব্রহ্মবাদি। আমি হব ব্রহ্মবাদিনী। আমি যেরকম সংসার ধর্ম পালন করব সেরকম ব্রহ্মবিদ্যারও অনুশীলন করব। মনে মনে সব সময় মৈত্রেয়ীর সেই দুটি শ্লোক আওড়াতাম, 
‘কথং তেন অমৃতা স্যাম,’ আর ‘যে নাহং নাহমৃতা স্যাং, কিমহং তেন বুর্থাম।’
সেই সময় আমাদের বাড়িতে শৈলেন কাকুর খুব যাতায়াত। ঠাকুরের ঋত্মিক তিনি। সবসময় ঠাকুরের কথা বলেন। নিরামিষ খান। পেঁয়াজ-রসুনটাও ছোঁন না। ধুতি পাঞ্জাবিতে মনে হয় যেন কার্তিক ঠাকুর। মাঝে মাঝে শৈলেন কাকিমাও আসেন। তিনিও ঠাকুরের ভক্ত। একদনি শৈলেন কাকু বলেলেন, 
- ঠাকুরের দীক্ষা নিবে মৈত্রেয়ী?
আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। দীক্ষা-টীক্ষা বোঝার মতো বয়সী নই। মা-কাকীমাদের মুখে রামায়ন-মহাভারত কিছু কিছু শুনেছি। সীতা, সাবিত্রী, মাধবী, কুন্তী, গান্ধারীর গল্প জানি। মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর জীবন কাহিনী ভেবে পুলকিত হই। অপেক্ষায় থাকি কবে আসবেন আমার পরাশর। বড়ো আদরে তাঁকে নদী পার করাবো।
পঞ্চম শ্রেণি বয়সী মেয়ের পক্ষে এসব ভাবনা নিশ্চয়-ই পাকামি ছিল। কিন্তু আমার সেরকম মনে হয়নি। গায়ত্রী তখন ফ্রক পরে, প্রকাশের সবে জন্ম হয়েছে। আমি শাড়ি ধরলাম। আমিষ ছাড়লাম। ততোদিনে আমার ঠাকুরের দীক্ষা হয়েছে। আমাদের বাড়ির পাশে পুকুর ছিল একটা। টলটলা পানি। সাঁতরে আমি এপাড়-ওপাড় হতাম। এরকম সাঁতরাতে সাঁতরাতেই একদিন আমার পিরিয়ড হয়ে গেল। আমি আতঙ্কিত হলাম। মা বললেন, তুমি বড় হয়ে গেছ। সাবধানে চলো। নিজেকে সামলে রেখো। তখন আমি সপ্তম শ্রেণি। বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা পড়ে গেল। কন্ট্রাকটারি করতে গিয়ে লস খেলেন। আমাদের পাকা বাড়ি কিন্তু চালচলনে গরিবীহাল এসে গেল। মামা বাড়ি যাই। শহরের ঘর-বাড়ি ভালো লাগে। কিন্তু গ্রামের মেয়ে তাল মেলাতে পারি না। মামিরা আগের মতো নেই। তিন মামার মধ্যে ছোট মামাই একটু ভালোবাসেন। তাঁর তখনো বিয়ে হয়নি। অন্যরাও হয়তো বাসতেন, ঠিক বুঝতে পারিনি। দরিদ্রতা যে খুবই বাজে জিনিস তখনই টের পেয়ে গেলাম। তবে পড়াশুনা নিয়ে সমস্যা হয়নি। ক্লাসে ফাস্ট হতাম, এটা তো ছিলই। বাবা-মাও কিছু বুঝতে দিতেন না। মা বলতেন, 
- অভাব যা টুকু আমাদের, তোমরা পড়।
গায়ত্রীটা অভাব সহ্য করতে পারত না। তার এটা চাই, ওটা চাই। প্রকাশের তখনো চাওয়ার বয়স হয়নি। আমার কিছুই লাগে না। তখন মনে হতো, যার ঠাকুর আছেন তার আর কী প্রয়োজন। এভাবেই এসএসসি দিয়ে ফেলি। পাসও করি ফার্স্ট ডিভিশনে।
মাঝে মাঝে ভাবি, এরকম তো কতো মেয়ের জীবনেই হয়। এসব নিয়ে আবার কাসুন্দি কেন! অভাব, প্রতিবন্ধকতা মেয়েদের জীবনেই প্রথমে আসে। মেয়েরা মেনেও নেয়। আমি মেনে নেই নি। ঠাকুর আমাকে পথ দেখিয়ে সামনে নিয়েছেন। দরিদ্রতা আমাকে ছুঁতে পারেনি। ঠাকুরের নামে আমি দারিদ্রতাকেই দরিদ্র করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কখনই বিয়ে করব না। আদর্শের অনুপ্রেরণায় উজ্জ্বল হব। মনে ঠাকুর ছাড়া আর কাউকেই ঠাঁই দেব না। আমার পারিপাশ্বিক জগতে আমি ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠা করে যাব। 
মাকে আত্মীয়ারা ভয় দেখান, এমন ব্রতচারিনী মেয়ে কোনো সংসারে টিকবে না। মা কিছু বলতেন না। আমার বিশ্বাস ও আচরণের প্রতি মায়ের স্নেহময় সমর্থন ছিল। বুঝি আস্থাও। বাবার এসব নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। তিনি সংসারের চাপে হেনস্থা হয়ে আছেন।
জীবনের এমন সব ঘাট-আঘাটায় ঠাকুর সব সময়ই আমার সঙ্গে ছিলেন। আমাকে তিনি উদ্দীপ্ত করেছেন। সাহস যুগিয়েছেন। আর ছিলেন শৈলেন কাকু। তিনি বলতেন, সকলের মা হয়ে থাকিস। তাহলে দেখবি সকলেই তোর আপনজন। তা দেখেছিও। কত ছেলে বন্ধু ছিল, কেউ কোনদিন অন্যরকম প্রস্তাব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়নি। পুরুষের কাছে আমার স্থান এখনো বিশিষ্ট, শ্রদ্ধাময়। একজন নারী পুরুষের কাছে তার অবস্থানটা সবসময়ই টের পায়। এই বিশিষ্ট ভাবটার কারণেই নাকি আমি শুভ মজুমদারের চোখে পড়েছিলাম! সম্পর্কে তিনি আমার মামা।
সম্পর্কটা অবশ্য তেমন কাছের নয়। আমার মেজ মামী ওর জ্যাঠতুত বোন। অনেক ত্যাগ থেকেই আমরা একে অপরকে চিনতাম। শুভ মজুমদারকে কিছুটা শ্রদ্ধা করতাম ভালো ছাত্র বলে। ঢাকা ভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়ে।
অনার্স ফাস্ট ক্লাস। মাস্টার্সেও পাবে। ধর্মে-কর্মে খুবই নিষ্ঠাবান। সৎ, রূপবান। আত্মীয়দের কাছে এরকম গল্প প্রচুর শুনেছিলাম। তা সেই শুভ মজুমদারই একসময় এল প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে। সরাসরিই। কোন রাখ-ঢাক না রেখে। আমি বলেছিলাম, না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ও বলল, কেন সম্ভব নয়, আমি কি তোমার যোগ্য নই!
আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। ওর যোগ্যতা নিয়ে আমার দ্বিধা ছিল না। দ্বিধা আমার নিজেকে নিয়ে। প্রথমত আমি ব্রহ্মচারিনী হব। দ্বিতীয়ত সম্পর্কে ও আমার মামা।
আমার পক্ষ থেকে সাড়া না পেলেও ও কিন্তু থেমে থাকেনি। দেখা করেছে, কথা বলেছে। একদিন গায়ত্রীর হাতে এক লম্বা চিঠি দিয়েছে। পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। চিঠিতে লিখেছে, ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। তবে আর দশটা ছেলে মেয়ে যে উদ্দেশ্যে বিয়ে করে সে রকম নয়। একসঙ্গে কাজ করার জন্য। আমার ঠাকুর আর তার দয়াময়ের চিন্তাকে একত্রিত করে একটা সুন্দর জগত তৈরি করার জন্য। আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। ওদের আনন্দ মহারাজ, লবচন্দ্র, শশীভূষণ কিংবা তার গুরুমা দীপালি পিসি সম্পর্কে তখন ভাসা ভাসা জানি। ভাবলাম, তবে হোক। বুঝি ওই আমার ছেলেবেলার পরাশর। আমি সত্যবর্তী হয়ে তার পায়ে প্রণত হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়েছিলাম। অন্য একটা ভাবনাও বুঝি প্রচ্ছন্ন ভাবে মাথার ভিতরে কাজ করেছিল।
তখন গায়ত্রীকে নিয়ে থানা শহরের একটা বাসায় মেস করে থাকি। এর আগে মামাদের বাসায় ছিলাম। আমার নিরামিষ খাওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। তাই চলে এলাম। দুটি টিউশনির আয় দিয়ে দু’বোন চলি। গায়ত্রী ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে, আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। বাবা থানা শহরের একটা দোকানে কাজ করেন।
মা প্রকাশকে নিয়ে বাড়িতে। প্রকাশটার লেখা-পাড়ায় মনোযোগ নেই। কাছে রাখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এ আয়ে সম্ভব নয়। আবার গায়ত্রীটাও বড় হচ্ছে। মাথার উপরে বিয়ের যোগ্য দুই মেয়ে নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তাটা টের পাই। আত্মীয়-স্বজনদের কানাঘুষায় মাঝে মাঝে বিরক্ত হই। আমার বিয়ে না হলে গায়ত্রীরও সম্ভব নয়। আমার ব্রহ্মচারিনী হওয়ার স্বপ্ন ফিকে হতে থাকে। তবে মনে মনে এই স্থির সিন্ধান্ত রাখি যে, ঠাকুরের চিন্তা ও প্রদর্শিত পথ থেকে কখনো বিচ্যূত হব না। এর মধ্যে একদিন শুভ মজুমদারের সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়। ঈশ্বর পাঠশালায় মাতৃ সম্মেলন ছিল। ঠাকুরের প্রধান ঋত্মিক রবি কাকু এসেছিলেন। আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। ঠাকুর থেকে কোড দিয়েছিলাম অনেক। সেই বক্তব্যের  প্রধান শ্রোতা শুভ মজুমদার। ওর উপস্থিতি আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
সম্মেলন শেষে ও বলল, আমার সঙ্গে যাবে? কথা আছে। আমি তো যেতেই চাই। বললাম, যাব।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে এই কথা-সেই কথা। ও বলল, তুমি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছ? আমি মাস্টার্স পরীক্ষার আগেই বিয়েটা সারতে চাই। এরকম সরাসরি প্রস্তাব যে ও দিতে পারে সে আমি ভেবেছিলাম। কী উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না। বিয়েতে আমার আপত্তি নেই। বাবা-মাও আমার মতের বিরুদ্ধে যাবেন না এ বিশ্বাস আমার আছে।  কিন্তু ওদের পরিবার?
    আমি বললাম, আপনি তো জানেন, আমি ঠাকুরের দীক্ষা নিয়েছি, নিরামিষ খাই। 
    ও হেসে বলল, জানি। জানি বলেই তো তোমাকে শ্রদ্ধা করি।
    কিন্তু পরে যদি সমস্যা হয়? আপনাদের তো নিরামিষের চল নেই!
তুমি তোমারটা নিয়েই থেকো। কেবল এইটুকু মনে রেখ তোমার ঠাকুরে আর আমার গুরুতে কোন ভেদ নেই।
তারপর আরও কতো কথা হলো। গায়ত্রী-প্রকাশকে নিয়ে আমার ভাবনার কথা। ও বলল, দুজনে মিলে সবার জন্য করব। বিয়ে মানে তো দু’জনের সম্বন্ধ নয়। দুটি পরিবারের একত্রিত হওয়াও। আমাদের আগে ছিল একটা করে পরিবার, এখন হবে, দুটি।
আমি খুশি হলাম। মনে যা কিছু শঙ্কা ছিল কেটে গেল। মনে মনে বললাম,  এসব যেন ঠিক থাকে ঠাকুর। আমি যেন ওর সত্যিকার সহযাত্রী হতে পারি। এর কিছুদিন পরেই আমাদের বিয়ে ঠিক হল। আমার কাকিমার বাপের বাড়ির সঙ্গে মজুমদারদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। কাকাতো বোন টুম্পা আর আমি এ সঙ্গেই পড়তাম। টুম্পা গেল মজুমদার বাড়ি। এলো মুখ কালো করে।
    তুই ভুল করতাছস না তো মৈত্রেয়ী?
    আমি চমকে উঠলাম। বললাম, কেন এমন বলছিস?
    শুভদার সঙ্গে কথা কইলাম। তুই যে নিরামিষ খাস, ঠাকুরের দীক্ষা লইছস সব     কইলাম। শুইনা শুভদা কি কইল জানিস?
    কি কইল?
    কইল হেও নাকি এইসব জানে।
    তবে তো ঠিকই আছে।
নারে ভাই ঠিক নাই। আমার ডর করতাছে। হেরা তোরে বুঝব না। শুভদা আরও কইল, বিয়ার পরে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ির নিয়মে চলতে হয়। মৈত্রেয়ীও একদিন নিরামিষ ছাড়ব।
আমি কেঁপে উঠলাম। মনে মনে বললাম, আমাকে তুমি দেখো ঠাকুর।
আবার অন্য ভাবনাও করি। টুম্পা ঠিকঠাক সব শুনেছেতো। গত দু’বছর শুভর সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে তো শুভকে এমন মনে হয়নি। আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর কোন জোর করেনি। হাতটাও ছোঁয়নি পর্যন্ত। আড়াল-আবডালতো কম পায়নি। ইচ্ছে হলে ছুঁতে পারত। আমি ওকে শুধু এইটুকু বলেছিলাম, মাতৃভাব উদয় হওয়া ছাড়া কোন নারীকে স্পর্শ করা পাপ। তো সেই শুভ টুম্পার কাছে এমন বলল কেন! ওতো জানেই মরে গেলেও আমি আমিষ খাবো না, ঠাকুরের ভাবনা থেকে বিচ্যূত  হবো না।
মনের এমন সব দোটানার মধ্যেই বিয়ে সম্পন্ন হলো। বৌভাত অনুষ্ঠানের  আগে শুভ বলল, প্রত্যেক পরিবারেবই কিছু নিজস্ব আচার আছে মৈত্রেয়ী। বউ মানুষের এগুলো মেনে চলতে হয়। তাছাড়া সাধনা বলো, উন্নতি বলো স্ত্রী পুরুষের একই পথ না হলে সফল হওয়া যায় না। তোমার ঠাকুরই বলেছেন, স্বামী চলবে ইষ্ট পানে, স্ত্রী চলবে স্বামীর পানে। তাছাড়া আবার বাবা চান না তার ছেলের বউয়ের সঙ্গে কোন মতান্তর ঘটুক। জানোই তো আমার আনন্দ মহারাজের অনুসারি।
আমি অবাক হয়ে শুভ মজুমদারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। টুম্পা তাহলে ঠিকই বলেছিল।
দুপুরে খাবার আয়োজন। অনেক আত্মীয় পরিজন। খেতে বসেছি। বয়স্ক একজন মহিলা এসে পাতে একবাটি মাংস আর মাছের তরকারি ঢেলে দিয়ে বলল, খাও মেয়ে, দয়াময়ের ভোগ, মঙ্গল হবে।
আমি তখন অনেক কষ্টে বমি চেপে রেখেছি। জীবনে কখন মাছ-মাংসের গন্ধ পেয়েছি তাও মনে নেই। পেঁয়াজ-রসুনটাও সইতে পারি না। দু’চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো। শ্বশুর মশায় এসে বললেন, খাও, কিছু হবে না।
আমি তখন মনে মনে কেবল ঠাকুরকে ডাকছি। রক্ষা করো, রক্ষা করো।
আমি কিন্তু আমিষ খাইনি। আজ অবধিও না। অনেক বকাঝকা, অনেক মনোমালিন্য গেছে, অনেক অপমান সইতে হয়েছে তারপরও নয়। দুই ছেলে এক মেয়ে আমিষ খায়, আমার বাবার বাড়িতেও আমিষের চল। তারপরও নয়। আমি চিরকাল নিরামিষাসি থাকব। এইটুকু ঠাকুরের চিহ্ন অন্তত আমার থাক।


সংসারটা সেলিমের ভালো চলে না। অনিয়মিত রোজগার, তাও সামান্য। চল্লিশ পেরুনো বয়সে চার বছরের মেয়ে। স্বাস্থ্যহীন। শ্রীহীন একটা ভাড়া বাসায় তিন জনের সংসার। জীবন-যাপনে ক্লান্ত সেলিম সব সময় মরে যাবার চিন্তায় নিমগ্ন থাকে। এমন নয় যে মেয়ে কিংবা স্ত্রীকে ভালোবাসে না। বাসে। দুজনই চূড়ান্তভাবে তার উপর নির্ভরশীল। তারপরও মাঝে মাঝে মৃত্যু চিন্তার চোরাস্রোত ভেতরে ভেতরে বইতে থাকে। চিন্তাটা সে অসুস্থ বলে নয়, প্রাত্যাহিক ও ভবিষ্যতের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবার জন্য। প্রাত্যাহিকের গ্লানিগুলো চাল-ডাল-তেল-নুন-বাসা ভাড়া কিংবা টিকে থাকার সাধারণ ব্যবস্থা সম্পর্কিত। পরিচিতমণ্ডল থেকে সারাক্ষণ লুকিয়ে থাকার গ্লানিও আছে। আর আছে বাবা-মা, ভাই-বোনদের জন্য কিছু না করতে পারার অনুশোচনা। ভবিষ্যত একেবারেই অন্ধকারে। কল্পনায় কোন নির্মাণ নেই। কেবল শূন্যতা। বেঁচে থাকাটা যে আরও অপমানজনক হবে একথাটা যেন সেলিম জেনে গেছে। কেবল জানা নয়, চোখ বুঝলেই দেখতে পায়। তবে আশ্চর্যের কথা হল, এসব গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তার বিশেষ কোন চেষ্টাও নেই। ভিতর থেকে এ বিষয়ে কোন তাগিদই সে অনুভব করে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এরকম জীবন-যাপন তার স্বপ্ন মাত্র। স্বপ্ন ভেঙে গেলেই সে তার নিজস্ব জগত ফিরে পাবে।
নিজস্ব জগতের একটা কাল্পনিক অবয়বও সে ভেবে রেখেছে। গায়ে গেরুয়া বসন, হাতে একতারা, সঙ্গে সাধনসঙ্গী এক। আর পরিপূর্ণ মাধুকরী জীবন। সে জীবনে কোন কাম নেই বাসনা নেই। কেবল চলা আর চলা। এটা নিছক কল্পনাই এও সেলিম জানে। বেঁচে থাকতে হলে, কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে যা কিছু অপরিহার্য তার যোগান থাকা লাগে। সহজ পথে হলে ভালো, না হলে অনেক জটিল ও কুটিল পন্থাও অবলম্বন করতে হয়। অস্তিত্ব এমনই, কোন পন্থাতেই সে নিজেকে অস্বীকার করে না।
বুঝ হবার পর থেকেই সেলিমের নিশ্চেষ্ট জীবন। ছাত্রজীবনে পড়াশুনাটা করেছে না করার মতো। মন ছিল প্রয়োজনহীন বই-পুস্তকে, সংগীতে কিংবা হরেক রকমের খেয়ালীপনায়। আর ছিল রাজনীতিতে। তাও কিছুদিন মাত্র। ঘোর কেটে গিয়েছিল। কলেজে চাকুরি পেয়েছিল, ভালো লাগেনি বলে ছেড়ে দিয়েছে। ঢাকায় গিয়ে কিছুদিন স্কুলে, প্রকাশনা সংস্থায়, সংবাদপত্রে ঘোরাঘুরি করেছে। নিজের মফস্বল শহরে এসে পত্রিকা করেছে। কোনটাতেই সফল হয়নি। তারপরে বিয়ে, প্রায় বুড়ো বয়সে একটি মেয়ে সন্তানের জনক। সারাজীবনে সফলতা বলতে এটুকুই। যদিও বিষয়টা একেবারেই জৈবিক, এজন্য কারোরই কোনদিন চেষ্টা করতে হয় না।
বছর তিনেক হলো সেলিম বেঁচে যাওয়ার জন্য মৃত্যুকে কামনা করছে। কিন্তু এ কামনা তাকে আরও যন্ত্রণা দেয়। মেয়েটার জন্য শংকিত হয়। স্ত্রীর জন্য বেদনায় মুষড়ে পড়ে। এরকম দোটানায় পড়ে সে যদি পাগল-টাগল হয়ে যায় তাও আরেক ভাবনার বিষয়। ভেবে ভেবে সেলিমের দিন যায়, কিছু করার তাগিদ হয় না।


আপনার কাছে আসলে মনেই হয় না আমি চল্লিশের বুড়ি!
আমারও।
অথচ আমার বড়ো বড়ো দুটো ছেলে। একটি মেয়ে!
হোক। আমার চোখে এখনো তুমি তরুণীই আছ।
বলছেন! জানেন, আমি জানতামই না আমার শরীর বলে কিছু আছে! আপনার গা ঘেঁষে দাঁড়ালে শরীর কেমন ঝনঝন করে ওঠে! এটা কী খারাপ কিছু? বলুন না প্লিজ!
খারাপ হবে কেন! মনটা তো শরীরের বাইরের কোন জিনিস নয়!
তারপরও। কেমন যেন সংকোচ লাগে!
সংকোচ থাকলে অনেক কিছুই করা যায় না মৈত্রেয়ী। যদি সংকোচ করতাম তাহলে তোমার স্বামী-শ্বশুরের সামনে বলতে পারতাম না, জগতের সবার চেয়ে আমি তোমাকে ভালোবাসি।
শুনে আমি এমন চমকে উঠেছিলাম, কী বলব আপনাকে!
    কিংবা সেই ভোরটার কথা মনে করো, তোমাকে প্রণাম করেছিলাম। সংকোচ থাকলে পারতাম।
    ছি! ছি! মনে হলে এখনো সারা শরীর কেঁপে ওঠে! কেন প্রণাম করেছিলেন বলুন তো!
    আরাধ্য সব সময়ই প্রণাম পাবার যোগ্য।
    আমি আপনার আরাধ্য!
যেদিন প্রথম আলাপ হয়েছিল সেদিন থেকেই। সংকোচের কারণে বলিনি। সংকোচকে তাই বড়ো ঘৃণা করি।
সে তো বুঝতেই পারি। এখন কোন কিছুতেই আপনার আর সংকোচ নেই। সেদিন দুপুরে কত সহজে জগন্নাথ মন্দিরে স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়ে দিলেন!
তোমার খারাপ লেগেছিল?
ওমা তা কেন! খুশিই হয়েছিলাম। এমন পরিচয় সত্যি হলে তো বেঁচেই যেতাম।
    তাহলে সত্যি বলিনি বলছ!
    বাস্তব তো তাই প্রমাণ করে।
    বাস্তবটাই সব নয় মেত্রেয়ী। ভাবেরও একটা বাস্তবতা আছে। ওখানেও এক  রকমের সত্য আছে।
ভাবনা তো বেশিক্ষণ থাকে না, বাস্তবটাই আসল। সকালে ভাবি ফোন করেছিল?
    কিছু বলল?
তেমন কিছু না। তবে গলা শুনে মনে হলো মন খারাপ। আপনার আরো একটু রোজগার বাড়ানো উচিত। 
এবার বাড়াব। একটা কাজ খোঁজার চেষ্টা করছি। যেকোন কাজ।
টিউশনি করবেন আরও একটা?
করব। সব করব। কেবল তুমি সঙ্গে থেকো।
থাকব। আপনি থাকবেন?
থাকব। আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
অনন্তবালা?
চলো একদিন ওর কাছে যাব। বলব, আমার অনুভব হয়েছে।
অনুভব হয়েছে আপনার!
হয়েছে।
কী অনুভব হয়েছে! বলুন না প্লিজ!
সেটা অনন্তবালাকেই বলব।
অনন্তবালা বড়ো ভাগ্যবতী। এখন কয়টা বাজে বলুন তো?
সাড়ে ছয়টা।
চলুন আপনার বাসায় যাই। ভাবি আর মেয়েকে দেখে আসি।
চলো।

menu
menu