যুদ্ধের বিরুদ্ধে

পলকের ভেতর শেষ শহরটাও ক্ষেপণাস্ত্রে গুড়িয়ে গেলে ড্রিমল্যান্ড দখলে চলে এলো রেডল্যান্ড যোদ্ধাদের। নেকড়েদের ন্যায় মৃত আর ধ্বংসস্তূপের উপর বুনো উল্লাসে উপচে পড়তে থাকল কামানের জয়োধ্বনিগুলো। প্রথমবারের মতো রেডল্যান্ডের রক্তাভ লাল পতাকা পতপতিয়ে উড়ল ড্রিমল্যান্ডের মাটিতে। এই নিয়ে দুইশ চৌদ্দটা দেশ দখল করল তারা। পুরো পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় আনতে আর অবশিষ্ট রইল তেরোটা দেশ। 
ড্রিমল্যান্ডের মতো দেশকে যখন দখল করা গেল, তবে অবশিষ্ট তেরোটা দেশ দখল করা আমাদের কাছে মুড়িমুড়কির মতো ব্যাপার। সরকারি সংসদভবনের প্রজেক্টরের বিশাল স্ক্রিনে রেডল্যান্ড যোদ্ধাদের বিজয়দৃশ্য দেখতে দেখতে উপস্থিত সাংসদবৃন্দের উদ্দেশ্যে গর্বে বুক ফুলিয়ে বাক্যটায় দাঁড়ি টানলেন প্রেসিডেন্ট ফুয়াং ফু। 
পৃথিবীটা একদিন আমাদের করতলে লাটিমের মতো বনবনিয়ে ঘুরবে। প্রেসিডেন্ট ফুয়াং ফুয়ের খুশিটা আরেকটু স্ফিত করবার উদ্দেশ্যে বললেন আর সকলের ঠোঁট ফেড়ে মদের ঝরণার ন্যায় ঝরতি বেসামাল হাসিগুলো যেন উৎসবাকারের রূপ নেয়, সেই অপেক্ষায় কিছুক্ষণ মুখিয়ে থাকলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। 
কাকতালীয়ভাবে তাই হলো। সঙ্গে সঙ্গে সারা সংসদভবনে উৎসব নয়, যেন একটা তামাশার বিষ্ফোরণ হলো। এতে ভবনের রক্তাভ ইটগুলোও ভয়ে ভড়কে গিয়ে যেন পৃথিবীর পিঠে খসে পড়তে চাইল। এমনভাবে খসে পড়তে চাইল, যেভাবে ঝড়ো হাওয়ায় গাছের সবুজ পাতাও ঝরে পড়ে। 
মাননীয় স্পিকার নিজের ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক কণ্ঠটা মুখ বন্ধ করে স্বররজ্জুর আদি থেকে একটা হাওয়া চাপ দিয়ে বের করে খ্যাঁকাড়ি দিয়ে উঠলে সাংসদবৃন্দ কোনো এক গভীর মনোযোগ নিয়ে তার দিকে তাকালেন। 
আজ যুদ্ধ সংক্রান্ত বাজেট অধিবেশনের চূড়ান্ত দিনে আপনাদের জানাই রক্তিম শুভেচ্ছা। আপনারা জেনে অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত হবেন যে, পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র আমরাই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের পাশাপাশি যুদ্ধকেও মৌলিক চাহিদা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছি। যুদ্ধ আমাদের জন্মগত অধিকার, যোদ্ধা হওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এবং আমরাই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের চেয়ে যুদ্ধে দ্বিগুণ খরচ করে থাকি। কারণ, আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী। আমরা মনে করি, কেবল যুদ্ধই পারে জীবনের সমূহ শান্তিময় পৃথিবীর সন্ধান এনে দিতে। অতএব, আগামী ২০২০-২০২১ অর্থ-বছরে যুদ্ধের জন্য এক মিলিয়ন কোটি ডলার বাজেট ধার্য করা হয়েছে, যা বিগত বছরের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়বার অপেক্ষায় মুখিয়ে আছে। এ বিষয়ে আমি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফুয়াং ফুকে তার সমাপনী বক্তৃতা বলবার জন্য অনুরোধ করছি। 
সামনে হোয়াইটল্যান্ড, ব্লাকল্যান্ড, ব্লুল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধ আছে। সেই যুদ্ধের জন্য নতুন একশটা যুদ্ধবিমান, একশটা কামানগাড়ি, একশোটা হেলিকপ্টার, এক মিলিয়ন মিশাইল, বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ও একশটা যুদ্ধজাহাজ প্রয়োজন। এগুলো আমাদের নির্মাণ করতে হবে। এবং বিগত মাসে কাউল্যান্ডের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি ভঙ্গের যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি সাধন হয়েছে, তা পুষিয়ে উঠতে যে খরচ হবে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এছাড়া আমাদের অন্যান্য শহরে আরো দশটা ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণ করতে হবে। সব মিলিয়ে এক মিলিয়ন কোটি ডলার বাজেট আমার কাছে ন্যায় সঙ্গত মনে হয়েছে। সংসদে বাজেট অধিবেশনের চূড়ান্ত দিনে কথাগুলো খুব আনন্দ আর গর্বের সঙ্গে বলেই মাইক্রোফোন থেকে মুখ সরিয়ে কাচের গ্লাসটা তুলে দুয়েক ঢোক পানি পান করলেন ভদ্রতার সঙ্গে। 
উপস্থিত সাংসদবৃন্দ প্রবল করতালির মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের সমাপনী ভাষণকে সম্ভাষণ জানালেন এবং সকলেই সমবেতস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলে ওঠলেন। 
হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে। হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে। মাননীয় স্পিকার আনন্দের সঙ্গে দুবার বললেন। তারপর বাজেট ফাইলে সিগনেচার করে ঘোষণা দিলেন যে, আগামী ২০২০-২০২১ অর্থ-বছরে যুদ্ধখাতে এক মিলিয়ন কোটি ডলার বাজেট পাশ করা হলো।


সুদীর্ঘ কাঁটাতারের প্রাচীর বিষাক্ত সাপের ন্যায় বয়ে গেছে সীমান্তচিহ্ন হিসাবে। তার একপাশে রেডল্যান্ড, আরেকপাশে হোয়াইটল্যান্ড। 
উশকোখুশকো চুল। মুখভর্তি দাড়ি। পরনে পুরনো ছেঁড়া একটা আলখেল্লা। মুখাবয়ব থেকে যেন ঠিকরে পড়ছে প্রাচীন বিষণ্নতার আভা। সুদীর্ঘ কাঁটাতারের প্রাচীর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পিচপথ ধরে ধীর-গতিতে হেঁটে যাচ্ছেন কোনো এক চল্লিশোর্ধ্ব লোক। 
এই লোকটিকে দেখে রেডল্যান্ডের নাগরিক বলে মনে হচ্ছে না। সীমান্ত টহলরত প্রথম যোদ্ধা সকালের রঙচায়ে আয়েশী ভঙ্গিমায় চুমুক দিয়ে গো-হাড্ডির ন্যায় শক্ত একটা টোস্ট বিস্কুটে তার বিদঘুটে দাঁতগুলো বসিয়ে বলেই চেঁচিয়ে ওঠল। 
কে এই অচেনা লোকটি? আগে কখনো সাক্ষাৎ হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। সীমান্ত টহলরত দ্বিতীয় যোদ্ধা তার সরকারি রাইফেলটার খুব যত্নআত্নি নিতে নিতে একটু নরোম সুরে বলল। 
পাগলটাগল হবে হয়তো। ব্যাটার সুরত দেখেও বোঝো না। ইদানিং তুমি তোমার বিবেচনাশক্তিও হারিয়ে ফেলেছ বোধহয়। রঙচা আর হাড্ডিসার টোস্ট বিস্কুটে সকালের নাস্তাটা সেরে চায়ের পেয়ালাটা ঝুড়িতে ছুঁড়েই কথাটা ইয়ার্কিচ্ছলে বলল প্রথম যোদ্ধা। 
ওই অর্থহীন যুদ্ধে যেদিন আমি বাবামাকে হারিয়েছি, সেদিনই আমার জীবন থেকে সব হারিয়ে গেছে, রাবেত। দ্বিতীয় যোদ্ধা এমনভাবে বলল যেন রাবেতের ইয়ার্কিচ্ছলে বলা পূর্বের কথাটা তাকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে তুলেছে। 
দুঃখিত, ইয়ারেল। আমি আসলে ইয়ার্কি করেছি। তোমার এমন বিষণ্ন-মলিন মুখাবয়ব দেখবার উদ্দেশ্যে নয়। ইয়ারেলের বিষণ্ন-মলিন মুখাবয়বের দিকে দোষীদের মতো তাকিয়ে বলল রাবেত। 
এই যে শোনছেন? পেছন থেকে লোকটিকে ডাকল ইয়ারেল। 
লোকটি পায়ের গতি থামিয়ে পথে থমকে দাঁড়ালেন। আমাকে ডাকছ? ইয়ারেল ও রাবেতের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বসলেন লোকটি। 
প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ইয়ারেল ও রাবেত লোকটির কাছে সশস্ত্রে ছুটে এলো। জি, এখানে আপনি, আমি ও সে ছাড়া তো আর কেউ নেই মনে হচ্ছে। আর আমরা তো আমাদের ডাকতে যাব কোন প্রয়োজনে। রাবেত লোকটিকে সন্দেহের ভঙ্গিমায় তাকিয়ে বলল। 
আপনি যদি হোয়াইটল্যান্ডের নাগরিক হোন, তাহলে আর একপা না এগুয়ে যেখান থেকে এসেছেন সোজা সেখানে চলে যান। আর সেটা বোধহয় আপনার জন্য মঙ্গলই হবে। ইয়ারেল বলল।
আমি তোমাদের হারিয়ে যাওয়া কেউ। এ শহর আমার। আমাকে অচেনা না ভেবে আত্মীয় ভাবো। লোকটি ধীরে আর স্পষ্টস্বরে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন। 
লোকটির কথা শুনে ইয়ারেল ও রাবেত আশ্চর্যের ফুল হয়ে ফুটতে শুরু করল রেডল্যান্ডের ধূসর মাটিতে। তার প্রতি বেগানা বিপুল মায়াফুল ফুটল তাদের নির্মোহ বুকবাগানে। আপনি মনে হয় ক্ষুধার্ত? ইয়ারেল আন্তরিকভাবে তাকে জিজ্ঞেস করল। 
আমার চেয়ে বোধহয় রেডল্যান্ড ও হোয়াইটল্যান্ডের হৃদয় চিড়ে বিষাক্ত সাপের মতো বয়ে যাওয়া তোমাদের ওই সুদীর্ঘ প্রচীন কাঁটাতার অনেক ক্ষুধার্ত। ওর খাবারের মতো জঘন্য খাবার পৃথিবীতে আর হয় না। কাঁটাতারে কতকাল মানুষকে মানুষের হৃদয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবে পৃথিবীতে। মনে রেখো, কোনো একদিন এইসব কাঁটাতার কৃষ্ণচূড়া, অপরাজিতা অথবা রক্তকরবী হয়ে ফুটবে পৃথিবীর উদ্যানে উদ্যানে। 
লোকটি ইয়ারেল ও রাবেতের উদ্দেশ্যে কবিতার মতো একের পর এক পংক্তি উচ্চারণ করে গেলে তারা পরস্পরকে অবিশ্বাস করতে থাকে নিজেদের চেতনার প্রতি। আর তারা ভাবতে থাকে যে, তারা জেগে নেই। অথবা তারা ঘুমের ঘোরে বেশি মদ খেয়ে ফেলেছে। নিজেরাই একে-অপরের শরীরে আঘাত করে কুঁকিয়ে উঠলে পরক্ষণই সেই মিথ মিথ্যে প্রমাণিত হলো। আর তারা ধরে নিল যে, লোকটি তাদের কাছে কোনো মধ্যরাতের দুঃস্বপ্ন নয়, সতেজ আর সত্যি। 
তাদের পেছনে ফেলে লোকটি কাঁটাতারের পিচপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শহরাভিমুখে এগুতে থাকলেন। বর্ডার পেরিয়ে লোকটি আস্তে আস্তে শহরের ভিড়ে মিলিয়ে গেলেন। 


শহরের প্রধান ফটকে যোদ্ধাদের ভাস্কর্যগুলো যেন বিপুল বিভায় দাঁড়িয়ে আছে অযুত বছরে ধরে। ফটক পেরুলে অসংখ্য মোড় আর স্ট্রিটের সঙ্গে সাক্ষাত হলো লোকটির। মোড়ে মোড়ে কামানগুলো এমনভাবে তাক করা যেন এক্ষনি গুড়িয়ে দেবে তাকে-সমতে অভ্যাগত সমূহ অচেনা। স্ট্রিট ঘেঁষা দেয়ালে দেয়ালে উদ্ভাসিত যুদ্ধের বিভৎস দৃশ্য। অপ্রতাশিত এইসব তার কোমল দৃষ্টিকে স্পর্শ করলেই অনাকাঙিক্ষতভাবে তিনি আঁৎকে ওঠলেন। ওইসব দৃশ্য থেকে যেন বিপুল বিভ্রমের উড়াল শহরটাকে ছেয়ে দিয়েছে। 
মনে হচ্ছে শহরটা আগের মতো নেই, তা না হলে নিজের বাড়িটাই খুঁজে পাচ্ছি না কেন? আপনমনে লোকটি বলে ওঠলেন। সামনে একটা যুদ্ধবাজার। যুদ্ধবাজার পেরিয়ে ডানদিকের মোড় ঘুরলেই বায়ে যোদ্ধা কলোনি। যোদ্ধা কলোনির ১০১ নম্বর বিল্ডিঙের দোতলায় লোকটি থাকতেন সপরিবারে। যুদ্ধবাজারটা আগের চেয়ে আয়তনে অনেক বেড়ে গেছে বোধহয়। অনেকদিন পর এসব দেখছি, হয়তো তাই এমন লাগছে। আপনমনে আবারও ভাবলেন লোকটি। তারপর এক—পা দু—পা করে সামনে এগোন। বাজার পেরিয়ে ডানদিকের মোড়  ঘুরে বাঁদিকে কোনো কলোনি দেখা গেল না। কেবল ধু-ধু বিরানভূমি পড়ে আছে চিৎ হয়ে আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে। লোকটি ইতিউতি তাকান। তাকে দেখে একজন বৃদ্ধা এগিয়ে এলেন। 
—আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি? 
—হ্যাঁ, যদি আপনি মন থেকে চান। লোকটি বৃদ্ধার আন্তরিকতায় খুশি হয়ে বললেন। আসলে আমি কিছু একটা খুঁজছি।  
যোদ্ধা কলোনি খুঁজছেন, তাই না? কী খুঁজছেন বলার আগেই বৃদ্ধা লোকটিকে অবাক করে দিয়ে বললেন।
বৃদ্ধার কথায় লোকটি চোখ ছানাবড়া করে কেবল মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বাচক সম্মতি জানালেন। 
বিগত কয়েকমাস আগে ব্লাকল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের এক বিশাল যুদ্ধ বেঁধেছিল। এই যুদ্ধ বাঁধার পেছনে অবশ্য ব্লাকল্যান্ডের কোনো হাত ছিল না। তারা চেয়েছিল যুদ্ধটা না হোক কিন্তু প্রেসিডেন্ট ফুয়াং ফু চেয়েছিলেন হোক। আর হয়েও গেল। কত মানুষ সে যুদ্ধে প্রাণ হারাল তার সঠিক পরিসংখ্যান আজও বের করা সম্ভব হয়নি বলে জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো সংবাদমাধ্যকে জানিয়েছে। আমিও অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও ডানপাহীন এই পঙ্গু জীবনটা যেন আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমৃত্যু। 
—তাহলে কি কলোনিটাও যুদ্ধে উড়ে গেছে?  
বৃদ্ধা ‘হ্যাঁ’ বলে স্টিচে ভর করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যুদ্ধবাজারের ভিড়ে হারিয়ে গেলে লোকটি অপার শূন্যতায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। অনেককিছু মনে করতে চেয়েও না পেরে কেবল আকাশের দিকে চোখ তুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন জিরাফের ন্যায়। তারপর শহরের পিচপথে পুনর্বার নেমে পড়লেন। যেন একটা পাখি পাখায় গুলিবিদ্ধ হবার পর আকাশে উড়বার চেষ্টা করছে। 
শহরটা আর আগের মতো নেই। কতসব পাল্টে গেছে। সেই রোজ গার্ডেন, ড্রিম রিভার, স্পোর্টস মাঠ, রোবায়েত চাচার চায়ের দোকান—কিছুই নেই। এখন রোজ গার্ডেন বদলে হয়েছে ন্যাশনাল কমিউনিটি পার্ক। স্পোর্টস মাঠ বদলে হয়েছে ওয়ার ট্রেনিং অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার। ড্রিম রিভার বদলে হয়েছে ফ্যান্টাসি কিংডম অ্যান্ড হেরিটিয়েজ। রোবায়েত চাচার দোকান বদলে হয়েছে কাচঘেরা এসির হাওয়ায় ওড়ানো লাইফ অ্যান্ড ওয়্যার কপিশপ। এখানে আগের মতো পুরুষ-রমণীরা আঙুলে আঙুল ডুবিয়ে অন্তহীন ভালোলাগার ক্যানভাসে তাকিয়ে থাকে না। কবি ও কবিতার জম্পেশ আড্ডা বসে না। কফিতে চুমুক দিতে দিতে এখানে এখন লোকজন যুদ্ধের গল্প শোনতে আসে। যোদ্ধাদের মুখাবয়ব দেখবার মতো প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফেরে।  
লোকটি হাঁটতে হাঁটতে হারানো স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়ান। হাঁটতে হাঁটতে কোনো এক আর্টিস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো তার। আর্টিস্ট তখন গভীর অনুধ্যানে নিজেকে হারিয়ে রক্তের বিভৎসদৃশ্যাবলি আঁকছে। 
—তুমি কি রক্তরঙ ছাড়া আর কোনো রঙ চেনো না? আর্টিস্টকে জিজ্ঞেস করলেন লোকটি।  
—রক্তরঙই জীবন, জীবনটাই রক্তাভ। আঁকতে আঁকতেই প্রতিত্তুরে বলল  আর্টিস্ট। 
—রক্তরঙই জীবন নয়, জীবনটা রক্তাভও নয়। জীবনটা বর্ণিল। লাল, নীল,  সবুজ, হলুদ, বেগুনি, সাদা ও কালোর সমন্বয়েই জীবন। কিন্তু তোমরা কেবল লালকে ভালোবাসতে শিখছ। 
লোকটির কথায় আর্টিস্টের রক্তের নেশা কেটে গেল। সে সবুজ রঙ দেখতে ব্যাকুল হয়ে ওঠল। লোকটি তার ঝোলা থেকে থোকা থোকা সবুজ বের করে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে আর্টিস্ট সবুজের প্রেমে পড়ে গেল। এই তো জীবন, জীবনের রঙ। আর্টিস্ট অধীর ও উন্মুখতায় বলল। তারপর সে সবুজে সবুজে সারা শহর ছেয়ে দিল। রক্তের বদলে হেসে উঠল সবুজের শাশ্বত সৌন্দর্য ও সুষমা। 
দূরের কোনো এক কনসার্টের আয়োজন থেকে ভেসে আসছে জন্মান্ধ যুদ্ধের লিরিক্যাল মিউজিক। 
‘ওই যে যুদ্ধের ডাক এলো
জীবনকে রক্তে রাঙিয়ে তোলো
ফিরে না আসাদের শোকে
না কেঁদে যুদ্ধে যাই চলো

ওই যে যুদ্ধের ডাক এলো... 
………………………………………’
এসব বানোয়াট জীবনের গল্প ছাড়া কোনো মিথ নয়। তোমরা যারা একে মিথ ভেবে দ্রবণের মতো মিশে যাবে তাহলে মিথ্যে সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই অপেক্ষা করছে না তোমাদের জন্য, ধরে নাও। এটাই সত্য ও শাশ্বত। লোকটি কনসার্টে উপস্থিত গায়ক ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বাক্যগুলো বিজ্ঞ ধনুর্বিদের মতো ছুঁড়ে মারলেন তাদের বোধের বুকপিণ্ডে। 
যুদ্ধের পক্ষে গান গেয়ে শহরবাসীকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখাই আমাদের শিল্পকর্ম। এছাড়া আমরা আর কোনো গান জানি না। এসব ছাড়া গাইবার শক্তি ও সাহস আমাদের নেই। এটাই এখানকার রেওয়াজ। সাংবিধানিক। গায়কেরা নিরীহ প্রাণির মতো ভঙ্গিমা করে বলল যেন তারা সত্যিই নিরুপায় ও অসংখ্য অসহায়।
যাতে আমাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কোনোরকম সংকোচবোধ না হয় কিংবা মনের ভেতরে কোনো ধরনের দ্বিধা কাজ না করে, সেজন্য আমরা এই কনসার্টের রক্তাভ সুরে ডুব দিই প্রত্যহ বিকেলে। বিকেলের পর বিকেল সাঁতরাই আর নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলি কোনো এক আসন্ন যুদ্ধের বিবরে। এই ঐতিহ্য অযুত বছর ধরে চলে আসছে আমাদের রেডল্যান্ডে। উপস্থিত শ্রোতারা লোকটিকে তাদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করল কান্না ও করুণা-সমেত।
কাঁটাতার, ধর্মের ডিভাইডেশন ও যুদ্ধ মানুষের বিপক্ষে সবচেয়ে বিদঘুটে ক্ষেপণাস্ত্র। এসব মিথ্যে আর বানোয়াট স্বপ্নে বুদবদি তুলে তোমরা কী তোমাদেরকেই নিঃশেষ করে দিচ্ছ না দিনের পর দিন! পৃথিবী একটাই। সেই পৃথিবী মানুষের। একজন মানুষের না, দুজন মানুষের না, সকল মানুষের। তাহলে কেন সেখানে কাঁটাতারের প্রাচীর বসিয়ে পৃথিবীকে ডিভাইড করছ। মানুষ হয়ে কেন মানুষের বিরুদ্ধে সশস্ত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছ। লোকটি শহরবাসীকে সাহস-স্ফিত কণ্ঠে বললেন।  

এমতসময় সজল চোখে একদল লোক এসে সমবেত হলো। 
আপনারা কাঁদছেন কেন? লোকটি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। 
লোকগুলো বৃদ্ধ আর বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ হয়ে গেছে প্রায়। লোকটির মুখের দিকে তাকাতেই তাদের অর্ধেক দুঃখ যেন কমে গেল। কে আপনি? একজন অবাক হয়ে বলল। 
লোকটি কিছু বললেন না। নীরবতার সুতা পেচিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন। আপনাদের কথা বলুন। আপনারা কিসের শোকে চোখ মুছছেন? 
আমাদের ছেলেমেয়েদের বয়স আগামী এপ্রিলে একুশ ছোঁবে। আর একুশ ছুঁলেই তারা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। এভাবে আমরা আমাদের অনেক সন্তানকে হারিয়েছি। ফিরে আসার কথা দিয়েও তারা আর কখনোই ফিরে আসে না। এবার লোকগুলোর ভেতর ভেঙে গাঙের জলের মতো কথার জোয়ার বইতে শুরু করল বাইরে। 
—কোথায় যায় তারা? যুদ্ধে? লোকটি জানতে চাইলেন। 
—জি জনাব, যুদ্ধে। যুদ্ধে যায় জনাব। সকলে বিত্রস্তস্বরে জবাব দিল।  
—যেতে না দিলেই হয়। লোকটি নীরবতার সুতা আলগা করতে করতে বলেন।  
—আমরা নিরুপায়। আরেকজন অসহায় প্রাণির মতো ভঙ্গিমা করে বলল।
—কেন? লোকটি আবার জানতে চাইলেন। 
এখানকার নিয়ম এটা। এখানে বয়স একুশ হলেই যুদ্ধে যোগদান করা বাধ্যতামূলক, সে নারীই হোক কিংবা পুরুষই। যারা যুদ্ধে যেতে অনীহা প্রকাশ করবে, তাদের ঠিকানা হবে কারাগারের অন্ধকার-আচ্ছন্ন সেলগুলো। উন্মুখ ও অধীরতায় ঝাঁপিয়ে কথাগুলো বলছিল দুয়েকজন। আর অন্যরা কেবল জিরাফের মতো তাকিয়ে থাকল লোকটির নিষ্পাপ মুখাবয়বের দিকে।
—প্রতিবাদ কর না কেন? লোকটি নির্ভয়ে বললেন। 
—এখানে প্রতিবাদের প্রতিদান মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। কেউ একজন বলল।  
—জাগো তোমরা। লোকটি সাহস-স্ফিত কণ্ঠে আবার বললেন।  
—আমরা কি ঘুমিয়ে আছি?   
—হ্যাঁ, তোমরা অনন্তকাল ধরে ঘুমিয়ে আছ কিন্তু টের পাচ্ছ না। রক্তে তোমাদের পূর্বপুরুষের দ্যুতি নেই। তোমাদের প্রতিবাদের ভাষায় যেন অন্তহীন মরীচিকা জমেছে। আর তোমাদের চারপাশে তোমাদের চেয়ে মৃতরাই অধিক জেগে আছে বোধহয়। 
—আমরা জেগে নেই! সকলেই সমবেতস্বরে বলে ওঠল।  
—হ্যাঁ, তোমরা জেগে নেই। তাই আমি চাইছি, তোমরা জাগো, জেগে  ওঠো। তোমাদের মরে যাওয়া স্বজনদের প্রতিশোধ নাও। তোমরা জাগলেই জীবিত ও মৃতদের শক্তির মেলবন্ধনে জন্ম নেবে অনন্ত অনিন্দ্য। 
—আপনি কে বলুন তো?  
—আমি তোমাদের হারিয়ে যাওয়া কেউ। আমি তোমাদের আত্মা থেকেই  উৎসারিত অনন্তর আত্মীয়।
—তুমি কবি। কেবল কবিরাই পারে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে রুখে দাঁড়াতে।  মিথ্যের বিরুদ্ধে মিথ হয়ে ফুটতে, প্রতিবাদের পারফিউম ছড়াতে। 
—হে আমার ভাইবোনগণ, আমি কবি কি না জানি না। তবে শব্দের সবুজ  বিভায় আমি মুছে দিতে এসেছি তোমাদের সকল অসুন্দর, গহীনের ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে লোকটির কথা। দলে দলে শহরবাসী জাগতে শুরু করে অনন্ত আঁধার ফুঁড়ে সোনালি সূর্যের সম্ভাবনা হয়ে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিল, মিটিং আর স্লোগানে উপচে পড়ল সারা শহর। সকালের আলো নামে কোনো এক দৈনিকে লোকটির ছবি-সমেত একটি জ্ঞানগর্ভ ইন্টারভিউ প্রকাশ হলে প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেই পত্রিকা অফিস ক্ষেপণাস্ত্রে গুড়িয়ে দেয়া হলো। যুদ্ধের বিরুদ্ধে সবধরনের সংবাদ, প্রতিবেদন কিংবা ডকুমেন্টরি প্রচার ও প্রকাশে কারফিউ জারি করা হলো। তবু কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংবাদ ছাপতে থাকল। আবার কিছু পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল প্রেসিডেন্টের ভয়ে এসব থেকে বিরত থাকলেও গোপনে গোপনে নিন্দা জানাতে পিছিয়ে থাকল না। আর্টিস্টরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছবি এঁকে এঁকে সারা শহর ছেয়ে দিল। শহরের মোড়ে মোড়ে গায়কেরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কনসার্টের আয়োজন করল। কয়েকজন আর্টিস্ট ও গায়ককে এই অপরাধে ফাঁসকাষ্ঠে ঝোলানো হলো।
শহরবাসী মিছিল করতে করতে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে এসে সমবেত হলো। ব্যানার, ফেস্টুন, প্লেকার্ড নিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ‘উই ডোন্ট ওয়ান্ট ওয়্যার বাট পিচ, স্টপ ওয়্যার, নো মোর লুজ, স্টপ ব্লাডিং ফ্রোম আওয়ার বোডি’বিবিধ স্লোগানে গর্জে ওঠল। প্রেসিডেন্ট ফুয়াং ফুয়ের নির্দেশে সবধরনের সভা, সমাবেশের উপর সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হলো। সামরিক বাহিনীর নৃশংসতায় শহরের অনেক মানুষ প্রাণ হারাল। তবু তারা দমে থাকল না। লোকটির নেতৃত্বে পুনর্বার গর্জে ওঠল যুদ্ধের বিরুদ্ধে। এমতাবস্থায় শহরবাসীর প্রতিবাদের চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ল প্রেসিডেন্ট। শেষমেশ নিরুপায় হয়ে তারা লোকটিকে ধরে আনল প্রেসিডেন্টের বাসভবনে। 
—তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি এই শহরের কেউ নও। কে তুমি? প্রেসিডেন্ট লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন খুব বিরক্তির স্বরে। ভাঁজ হয়ে বাঁকানো জড়োসড়ো কপালের চামড়াগুলোও যেন সেটাই বলে দিচ্ছে উপস্থিতিদেরকে।
—আমি কবি। লোকটি নির্ভয়ে বললেন প্রেসিডেন্টকে।  
কবি! লোকটির প্রত্যুত্তর শুনে প্রেসিডেন্ট প্রথমে চমকে ওঠলেন। তারপর মুখটা শুয়োরের ন্যায়ে কুচকিয়ে হায়েনার মতো হাসিতে ফেটে পড়লেন। তুমি মনে হয় ভুলে গেছ যে, পৃথিবীতে কবিদের এখন কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ মানুষের ভেতর থেকে প্রেম মরে গেছে। এখন প্রত্যেক মানুষের ভেতরে একজন যোদ্ধা বাস করে। আর সে কামানের আওয়াজ ও রক্তরঙ ছাড়া কবিতার পংক্তি ভালোবাসে না। 
কবিদের প্রয়োজন পৃথিবীতে ফুরিয়ে যায়নি। প্রেম কখনো মরতে পারে না। প্রত্যেক মানুষের ভেতর যোদ্ধা নয়, একজন কবি বাস করে। আর সে কবিতার শব্দ ও সবুজ রঙই ভালোবাসে। লোকটি খুব আশ্বস্ততার সঙ্গে বললেন। 
—তুমি আমাদের শহরে এসেছ অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে, তাই না? প্রেসিডেন্ট আবার প্রশ্ন ছুড়ে বসলেন কবিকে।  
—অশান্তি তো সেইদিন থেকে শুরু হয়েছে, যেদিন থেকে তোমরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছ মানুষের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে। অথবা তোমাদের বিরুদ্ধে তোমরাই। কবি বললেন। 
তোমাকে এ দেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব প্রদান করা হবে। অথবা তুমি যা চাইবে তাই...। এর বিনিময়ে কেবল তুমি যুদ্ধের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা মানুষগুলোকে আবার ঘুমের অতলে তলিয়ে দেবে। ফুঁসে উঠা আগুনের স্ফূরণকে নিভিয়ে শহরে পূর্বের পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে।
কবি সত্য ও সুন্দরের পক্ষে কথা বলে। মিথ্যে ও কুৎসিতের বিরুদ্ধে সে ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়েও শক্তিধর। আর যুদ্ধ তো সেই হন্তারক, যারা মানুষের ভেতরের মানুষকে হত্যা করে নেকড়েতে রূপান্তর করে দেয়। কবি প্রেসিডেন্টকে নৈরাশ্যে ডুবিয়ে সটান বুকে বললেন। 
—এই কে আছ, ওকে নিয়ে যাও আর কারাগারের অন্ধকার সেলে নিক্ষেপ কর। পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে প্রেসিডেন্ট উত্তেজনায় উপচে পড়লেন উপস্থিতিদের মাঝে।  


এদিকে কবির গ্রেপ্তারে শহরবাসীর ক্ষোভে শহর আরও উত্তাল হয়ে ওঠল। মানুষের সমুদ্রে ভাসতে থাকল রাজধানী রেডপোর্ট। হরতাল, অবরোধ আর কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়ল সারা দেশ। অস্ত্র কারখানার শ্রমিকরা দলে দলে যুদ্ধের বিরুদ্ধের মিছিলে শামিল হলো। যুদ্ধসরঞ্জামাদি না কেনায় যুদ্ধ বাজার বন্ধ হয়ে গেল। সবকিছু অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে শহরবাসীকে শান্ত করবার কথা ভাবলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। 
শহরবাসীকে শান্ত করুন আগে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রেসিডেন্টকে বিনয়ের সঙ্গে বললেন। 
ভাষণের ব্যবস্থা কর। টিভি চ্যানেলগুলোকে মেসেজ পাঠাও, তারা যেন এক্ষুনি তাদের লোকজন পাঠিয়ে টেলিকাস্টের ব্যবস্থা করে। এজন্য তাদের উপযুক্ত সম্মানি দেয়া হবে। প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি রুডেলফকে নির্দেশ দিলেন ফুয়াং ফু। 
—ইয়েস স্যার। আপনার নির্দেশমতেই কাজ হবে। রুডেলফ আজ্ঞাবহের ন্যায় মাথা নুইয়ে প্রত্যুত্তর করলেন। 
কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলো তাদের লোকজন পাঠালেন লাইভ টেলিকাস্টের জন্য। ইতোমধ্যে বাসভবনে সকল মন্ত্রী এসে হাজির হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আধ ঘণ্টার ভেতরে একটা ভাষণের খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেললেন। সেটা চূড়ান্ত করলেন তার একান্ত প্রেস সচিব রুডেলফ। টিভি চ্যানেলগুলো ব্রেকিং নিউজ হিসাবে প্রচার করতে থাকল ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন প্রেসিডেন্ট ফুয়াং ফু’। যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা অধীর ও উন্মুখ হয়ে রইলেন প্রেসিডেন্টের ভাষণ শোনার জন্য। নতুন কিছু উন্মোচনের অপেক্ষায় থাকলেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের সামনে প্রজেক্টরের ব্যবস্থা করা হলো। রঙিন স্ক্রিনে প্রেসিডেন্ট ফুয়াং ফুকে দেখে বিক্ষোভকারীরা গর্জে ওঠল। তাদের গর্জনে যেন শহরসমেত সবকিছু ভেঙে যেতে চাইল। যুদ্ধের অমিয় বাণী ‘নো ওয়্যার নো লাইফ’ দিয়ে শুরু হলো প্রেসিডেন্টের ভাষণ। 
প্রিয় রেডল্যান্ডবাসী, কোনো এক বিশাল যুদ্ধের হৃদপিণ্ড ফুঁড়ে আমাদের জন্ম। অযুত বছর ধরে রক্ত-ক্ষরিত যুদ্ধের সুদীর্ঘ পথে হাঁটতে হাঁটতে অর্জিত হয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা। পৃথিবীবাসীরা জানে, আমরা যোদ্ধার জাতি, যারা জন্মগতভাবেই যোদ্ধা। আমাদের শিরায় শিরায় বইছে অকুতোভয় শহিদদের রক্তধারা। কামানের আওয়াজ শুনে আমাদের ঘুম ভাঙে প্রতিদিন। আমাদের শপিংমলগুলোতে কাপড়চোপড়, খেলনা কিংবা প্রসাধনসামগ্রীর চেয়ে যুদ্ধের জুতা, রাইফেল ও বন্দুকের দোকানে ভিড় থাকে অধিক। আমাদের দর্জিরা সবসময় ব্যস্ত থাকেন যুদ্ধের ইউনিফরম বানাতে। মুচিরা নির্ঘুমভাবে নিরন্তর বানিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধজুতা। শ্রমিকরা অস্ত্রকারখানায় ব্যস্ত অস্ত্র বানাতে। বিজ্ঞানীরা যুদ্ধবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণাগারে নিমগ্ন। 
আপনারা জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হবেন যে, ইতোমধ্যে আমরা দুইশো চৌদ্দটা দেশ দখল করেছি। আর মাত্র তেরোটা দেশ দখল করতে পারলেই পুরো পৃথিবীটা আমাদের করতলে লাটিমের ন্যায় বনবনিয়ে ঘুরবে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষাৎ পেতে আর অপেক্ষার আয়নায় তাকিয়ে তাকতে হবে না অনেকদিন। 
আমরা কি না করেছি আপনাদের জন্য। যুদ্ধভাতা চালু করেছি। শহিদদের পরিবারদের জন্য আজীবন শহিদভাতা চালু করেছি। চাল, ডাল, তেল, লবণ, আটা, মাছ, মাংস, শাক-শবজি, ডিম, দুধের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় সদাইপাতি বিনামূল্যে রেসনের ব্যবস্থা করেছি। উৎসবগুলোতে সরকারিভাবে পোশাক বিতরণের প্রকল্প চালু করেছি। এছাড়া, শহর, শহরের রাস্তাঘাট, সরকারি দপ্তরসমূহ, ক্যান্টনমেন্টসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য গবেষণাগারগুলোর নাম বিভিন্ন যুদ্ধে যারা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের নামে করেছি। এর বিনিময়ে কেবল আমরা চেয়েছি, আমাদের গৃহগুলো যোদ্ধাদের বিভায় ঝলকে ওঠুক। আমাদের ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি হোক। যাতে পৃথিবীর অন্যান্য যুদ্ধরাষ্ট্রগুলোর ক্ষেপণাস্ত্রের নির্মম ক্ষুধা ও নেকড়ীয় থাবা থেকে আমাদের রেডল্যান্ডকে রক্ষা করতে পারি। সর্বপরি, আপনি, আমি মানে আমরা নিরাপদ থাকতে পারি। খামোখা আপনারা উন্মাদ এক কবির কথায় মাতালের মতো ঢলে পড়ছেন আমার বিপক্ষে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমি আশা করছি, আপনারা আপনাদের এই নিরর্থক আন্দোলন বন্ধ করে নিজ নিজ ঘরে ফিরবেন এবং শহরকে আগের পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে সাহায্য করবেন।  
‘পৃথিবীতে একমাত্র সংগ্রামশীল প্রাণিরাই টিকে থাকে’ ডারউইনের বাণী দিয়ে প্রেসিডেন্ট তার ভাষণের ইতি টানলেন। 
কামানের আওয়াজ শুনে শিশুদের ঘুম ভাঙুক—আমরা আর চাই না। বিক্ষোভকারীদের ভেতর থেকে কেউ কেউ বলল। 
আজ থেকে আমরা কোনো যুদ্ধের ইউনিফরম বানাতে আমাদের সেলাই মেশিনগুলোকে বিরক্ত করব না। দর্জিরা বললেন। 
আমরাও কোনো যুদ্ধজুতা বানাতে স্ত্রীদের অনিন্দ্য রাতগুলো বিনষ্ট করব না। মুচিরা বললেন। 
মারণাস্ত্র উৎপাদন না করে আমরা এখন থেকে বেশি বেশি সবুজ শাক-শব্জি, ধান, গম চাষ করব, যাতে পৃথিবীতে কেউ অনাহারে প্রাণ না হারায়। লাঙল, জোয়াল কাঁধে আর কাস্তে হাতে শ্রমিকরা বললেন। 
কীভাবে মানুষের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া মনুষ্যত্ববোধ ফিরিয়ে আনা যায়, আমরা তা নিয়েই গবেষণা করব। কোনো যুদ্ধ নিয়ে নয়। যুদ্ধ কোনো বিজ্ঞান নয়। এতদিনে তারা যা যা করেছে, সেসব ভুল করেছে বলে অনুশোচনায় ভুগতে ভুগতে বিজ্ঞানীরা বললেন।  
ব্যানার, ফেস্টুন, প্লেকার্ডে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ‘উই ডোন্ট ওয়ান্ট ওয়্যার বাট পিচ, স্টপ ওয়্যার, নো মোর লুজ, স্টপ ব্লাডিং ফ্রোম আওয়ার বোডি’লেখায় বিবিধ স্লোগানে আবারও গর্জে ওঠল রেডল্যান্ডবাসীরা।
আমাদের কবির মুক্তি চাই। সমবেতস্বরে সকল বিক্ষোভকারী বলে ওঠল। আর বারবার একই ধ্বনি সমুদ্রের গর্জনের মতো প্রেসিডেন্টের বাসভবনসমেত পুরো রেডপোর্টকে ভাসিয়ে নিতে চাইল। সেনাবাহিনীর মুহুর্মুহু হামলাও বিক্ষোভকারীদের পায়ে বেড়ি পড়িয়ে আন্দোলন বন্ধ করতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে প্রেসিডেন্ট দিশেহারা হয়ে পড়লেন। 
ওরা জেগে উঠেছে শক্তির সবুজে। দেখো, ওরা ছুটে আসছে সমুদ্রের গর্জনের ন্যায়। যুদ্ধ এবার হাঁটুমুড়ে পরাস্থ হবে, প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের করুণ মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে লোকটি বললেন। 
—নো ওয়্যার নো লাইফ। প্রেসিডেন্ট বললেন। 
—নো পিচ, নো লাইফ। লোকটি বললেন। 
—কবি, আমি তোমাকে খুন করব। প্রেসিডেন্ট জেনারেলের হাত থেকে রিভলবারটা শকুনের মতো ছোঁ মেরে কবির বুকে তাক করে বিত্রসস্ততায় বললেন।  
কবি নির্ভয়ে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে। পেছনে জাগ্রত শক্তির সবুজ ছুটে আসছে সমুদ্রের গর্জনের ন্যায়। যেন সমূহ রক্তাভ দৃশ্য ভাসিয়ে নেবে বিক্ষোভের জোয়ারে। প্রেসিডেন্টের প্রকম্পিত তর্জনী ট্রিগারে চাপ লাগলে একটা ধাতবপিণ্ড ব্যারলের বিবর ফসকে কবির বুকাভিমুখে ছুটে গেল হন্তারকের ন্যায়। তখনো তিনি নির্ভয়ে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকলেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে। বুলেট তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বেড়িয়ে গেল। তখনো তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে। 
—একী! কে তুমি! 
—পৃথিবীর যাবতীয় বন্দুক আমার বুকের জন্য যথেষ্ট নয়। কবি বললেন।  
—আসলে কে—কে তুমি? প্রেসিডেন্ট মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কবিকে।   
কবি তার রক্তাক্ত বুকপকেট থেকে একটা কার্ড বের করে প্রেসিডেন্টের দিকে ছুড়ে মারলেন ‘এই আমার পরিচয়’ বলে। প্রেসিডেন্ট পাতাকুড়ানিদের মতো কার্ডটা কুড়িয়ে বিরবির করে পড়েই হতভম্ব হয়ে কবির মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার মুখমণ্ডল থেকে ঝরছে অপার বিস্ময়বৃষ্টি। তুমি সেই কবি, যাকে আজ থেকে অযুত বছর বছর আগে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিতা লেখার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তারপর থেকে এই রেডল্যান্ডে কেউ কবি হবার বাসনায় জন্মেনি। 
কারণ কবিরা মিথ্যে লিখতে জানে না। সত্য ও মিথ্যাকে বিভাজন করে দেখানোর সৎ-সাহস একমাত্র তাদেরই আছে। কেবল তারাই পারে সমূহ কুৎসিত ও বিভৎসতার বিরুদ্ধে কলম ধরতে। আর কবিতা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সৌন্দর্য। কবি চিৎকার করে বললেন। 
তাহলে তুমি মরোনি। প্রেসিডেন্ট চিৎকার করে বললেন। 
সে বেঁচে আছে। জেনারেল চিৎকার করে বললেন।  
উনি জীবিত আছেন। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গণ সমবেতস্বরে চিৎকার করে বললেন। 

চাদ্দিক থেকে জাগ্রত শক্তির সবুজ ছুটে আসছে সমুদ্রের গর্জনের ন্যায়। জীবিত ও মৃতদের শক্তির মেলবন্ধনে জন্মালো এক অনন্ত অনিন্দ্য…


রেজাউল ইসলাম হাসু, কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং সম্পাদক, বাংলাদেশ 

menu
menu