ভাইজান

চারবারের লাহান হনুফার শাদি ঠিক হইলো ভিন গেরামের আকবর মুন্সির লগে মাতব্বর সাবের কথার ওপর ভরসা কইরে। মোর খায়েস ছিইলো বিদেশির লগে শাদি দিমু আদরের হনুফারে। গা ভরা গয়না-গাটি ফিন্দি হনুফা যহন ইবা ওবা হাঁটি বেড়াইব। তহন মোর কইলজার কোণায় কোণায় শান্তির জল ভইরা যাইব। ভালা ফিন্দন, আদর যতন পাইলে ও তহন নদীর লাহান খলখল কইরা ছুটব। ফড়িংয়ের লাহান উড়ব। ওর উপের জেল্লা দিবো। চাঁদ তহন বুঝবো মোর একনা বোন হনুফা তার থেইকে কতনা ফকফকা। ঠিক যেবা বেহেস্তের হুর। কিন্তু মাতব্বর সাব কাইল কইলো 
—ও বাপ মাইনা লও শাদিখান। ওই চাওয়ালরে মুই ভালা কইরে জানি। হে সাতবার কোরান খতম দিছে। পূণ্যিবান চাওয়াল। মুই হনুফার লাইগা চান্দের টুকরা আনছি। মোর দূর সম্পর্কের খালাতো বোনের দেওরের সাত নম্বর চাওয়াল। ঘরে বুইড়া বাপ আর দুকনা বোন ছাড়া বেবাকতে বাইরে বাইরে। বংশখানও খান্দানি। জানস তো এই গেরামে ষোল বছরের মাইয়ারে কেউ শাদি করবার আহে না। তহন তোগো হনুফারে কি ঘরোত খুঁটি দিবি? রাইত পোহাইলেই তো ওর ষোলত পা দিবো। 
বড় আনছান করে মন তহন। কি জানি কি আছেক ওর কপালে। কাঠফাটা রোইদের মধ্যে খেতে নিড়ানি দিইতে দিইতে খুব জল তেষ্টা পাইছে। ফেলানির মাকে কইছিলাম একজগ জল দিয়া যাইও। কই হের তো ধূলাও দেখবার পাইতেছি না।
—এই লও তোমার খাওন আর পানি। 
—চমকাইয়া দিলা বউ। একটু সাড়া দিয়া আইবা না? বহো, কাছোত বহো দেহি। পানির জগখান ইবা দেও তো, গলা কাঠ হইয়া গেইছে। 
—এই ধরো, ধীরে খাইয়ো।  
—ধরো তুমি দুকনা খাও মোর লগে। 
—পিরিত করন লাগবো না, তুমি খাওতো। মুই বাড়ি গেইনু। ফেলানি  ইস্কুল থেকে আহোনের সময় ঘনাইছে। ফাকা বাড়িত ভয় পাইয়া যাইব। 
—আরে আরেকনা বহনা, একনা কথা হুনো। ঘরের চালের পাতার ছাউনিটা  আইজ রাইতে ঠিক করনের কথা ভাবছি। কি কও বউ? দিনে তো সময় করবার পারি না। ওদিকে সময় ঘনাই আইতাছে হনুফার শাদির। টেহা পয়সা জোগারের কামও করন লাগতাছে।
—তুমি হাছা কইছো। উয়া নিয়া মুইও ভাবছিলাম। কিন্তু ঠাঁই পাই নাই।  তয় মুই বাড়ি গেইনু। রাইতে চাল মেরামত করুম।
—আইচ্ছা যাও। কেরসিন আছে কিনা দেইখা নিও। যদি না থাকে তয় মফুর দোকান থেইকে আইনো।
হনুফার শাদির বাজার করতে শহরে যাবার লাগবো। বেবাক মাইনসের বেবাক লোক লস্কর আছে। মোর আপনার বলতে কেউ নাই তামাম দুনিয়ায়।  একলাই সকল সামলাবার লাগবু এইবার। হনুফারেও আনতে অইবো মালিকের বাসার থেইকে। আইজ বহুত বছর ওগো বাড়িত কাম করে হনুফা। বাপজান মরণের মাসেই মা মরলো। সেই ছোট দুকনা ভাইবোনের পাশে খাড়াই ছিলো তহনও মাতব্বর সাব। 
হের মাইয়ার বাসায় কামোত নিয়া দিছিলো হনুফারে। মোক রাখছিল তার গেরস্থের কামে। ডাঙ্গর হইতে হইতে মুই অন্যদেরও কাম করণ শুরু করলাম। মাতব্বর সাবের মাইয়া বিদেশ তার বরের কাছে চইলে গেছে। যাইবার কালে হনুফারে তার ননদের বাসাত রাখছে। এভা করি হনুফার কামের বাসার অদল-বদলের মতো ওর ভাষারও বদল হইছে। মালিক  ব্যাংকের অফিসার। ওর ভাষা ওই অফিসারের লাহান। হনুফার শাদির খরচা দিবো বলছিলো তিনি। আইজ সুযোগ বুইজে কথাডা পাড়ন লাগবো। পণ বাবদ পঞ্চাশ টেহা যদি তাইনে দিয়ে দেন। রক্ষা পাইমু একনা। 
—ও ফেলানির মাও। কই গেইলা? বেহান বেহান রওয়ানা না দিলে ফের  ফিরবার পারুম না। আহো, আহো দেহি।
—পাড়াডা মাথায় তুলতাছো কেবা। মুই একনা বাইরে গেছিনু। 
—কইয়া যাইবার পার নাই? কইলেই তো মুই ডাকতাম না।    
—কওনের সময় পাইছি?  
—সাবধানে থাইকো বউ। ফাগুন মাস। বেবাক খটখইটা হইয়া রইছে।  ফেলানির দিকে নজর রাইখো। আগুন নিয়া খেইলতে দিও না। খড়িঘরের ধারে আগুন নিও না। এ মৌসুমে আগুন লাগনের ঠিকঠিকানা নাই ক।
—তুমি ভাইবো না। নিজের দিকে নজর রাইখো।  
একদিনের কথা কইয়া আইলেও আইজ তিনদিন হনুফার মালিকের বাসাত। তারে টেহাটার কথা কওনে হে কইল 
—দিতে পারব। তবে দু’দিন দেরি হবে। তুমি আমার বাসায় থাকো। কোথাও বের হবে না। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে সরকার। কাল থেকে কার্যকর হবে। এ আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। সব ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, পুরো বাঙালি জাতি জীবন দিয়ে লড়বে আভাস পাওয়া যায়। দেশ তাই থমথমে। কি হয় কাল বুঝা যাচ্ছে না। সরকার জোর করে একটা জাতির ভাষাকে ছিনিয়ে নিতে পারে না। এ অন্যায়। আমরা সরকারি চাকরি করি। শুন হাবিব, তাই সব জায়গায় সব কথা বলতে পারি না। কিন্তু চাকরি কাল থাকলে থাকবে; গেলে যাবে। ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে নামব। আরে মন উজাড় করে যদি কথাই না বলতে পারি; তবে বেঁচে থেকে কি লাভ?  আমার দু’ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। গোপনে সব খবর তাদের থেকে পাই। আমি তাদের উৎসাহ দিয়েছি। তারা যেন পেছনে ফিরে না তাকায়। পাকি সরকারকে বাঙালি যদি এবার বুঝিয়ে দিতে পারে; কারও অস্তিত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যায় না। তবেই উচিত শিক্ষাটা হবে। কি বল হাবিব?
—মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেবাক সময় ধইরা। আতিক সাবের বেবাক কথা হুইনা  চোখ দু’খান চুপচুপা হইয়া উঠল। আহারে পাপিষ্ঠরা মায়ের লগেও তোগো লড়াই! মা’রে মা বইলাও ডাকবার দিবি না? মা, চাওয়ালরে কিবা কয় ওই পাপিরা? বোন, বউরে বা কিবা কয়? মাতব্বর, মালিক, টেহা, ফসল, পাখি, চাঁদ, আকাশ, ফুল, মাটি, কচুশাক, পাটপাতা, শানকি ভরা সাদা পান্তা আর মরিচ পোড়ারে কিবা কয়? এমনি তো বেবাক কথার স্কুল খোলন লাগব। হেই ইস্কুলে মোগোরেও পড়ন লাগব? পড়তে পড়তে কাম করুম কহন? কাম কইরবার না পাইরলে খাইমু কেবা করি? আহ্! এবা কিবা শুরু কইরলো সরকার? মুই তো পাগল হইয়া যাইমু। 
—এইযে হাবিব কি ভাবছো? ধরো এখানে একশো টাকা আছে। এগুলো দিয়ে হনুফার বিয়ের খরচ করবে। ভেবেছি পরে দিবো। কিন্তু না তোমাদেরকে আর রাখা ঠিক হবে না। তুমি হনুফার বিয়ের বাজার দুপুরের মধ্যে শেষ করে বিকেলেই রওয়ানা দিবে বাড়ির দিকে। হয়তো আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আর শোন; হনুফা খুব ভালো মেয়ে। তার জন্য আমাদের দরজা চিরদিন খোলা; মনে রেখো। 
—আইচ্ছা সাব, আপনারা হনুফার লাইগা দোয়া রাইখবেন। সাব একনা  কথা কইবার চাইছিলাম। 
—কী বল?
—না মাইনে ! মাইনে...
—আরে এতো ভাবনা চিন্তার কি আছে? বলে ফেলো না। 
মুই কি জিগাইমু সাবেরে ওই মিছিলখানোত মুইও থাইকবার পারুম কিনা? মোরও তো ভাষা লাগব। মুইও তো মার মুখোত শিখা ভাষাটা ছাড়া আর কোনো ভাষাই কথা কইবার পারি না। কিন্তু কিবা করি কই? মুই তো শিক্ষিতও না, মিছিলে কি বেবাক শিক্ষিত লোকই থাইকবো? মোর তো ছাতিখান ফালিফালি হইয়া যাইতাছে। কিবা করি। কি ভাষায় বেবাক কথা সাবেরে বুঝাইতাম?
—তুমি কি আরো টাকা চাও হাবিব? কি বলতে চেয়ে থেমে রইলে? 
—না সাব, থাওক। আপনাকে সালাম সাব। দোয়া রাইখবেন হনুফার  জন্যে।
—আচ্ছা। থাক তবে। আমার তাড়া আছে বেরুলাম। 
হনুফা তুইকি চিনস্ কোন হানে তোর মালিকের চাওয়ালরা পড়ে? 
—চিনি ভাইজান। কেন বলুন তো? 
—উচা গলা করিস না। গলা নামাইয়া ক’না। ওগোরে দেখবার খুব মন লয়রে! হেই কবে দেখছি। দূর থেইকে দেইখা একবার চোখ জুড়াইমু।
—শোনো আমরা এখন যেখানে আছি তার থেকে বিশ মিনিটের হাঁটা পথ পর  তাদের বিশ্ববিদ্যালয়। আধো অন্ধকারে একদল মানুষের সঙ্গে তারা স্টেশনে বসে রাত পার করছে। কারণ রাতের ট্রেন চলে গেছে অনেক আগেই। কাল সকালের আগে কিছুই করার নেই। গন্তব্যে যাবার তাড়ায় এতগুলো যাত্রি যে যেভাবে পারছে শুয়ে বসে রাত পার করছে। কোনই ভাবনা নেই কারো। শুধু ভাইজান চটফট করছে। একটু পরপর উঠে এদিক ওদিক হাঁটছে আর মাথার চুল ধরে টানছে। দাঁতে নখ কাটছে। যেদিন মা মারা গেল সেদিনও ভাইজানের এমন রূপ দেখেছি। কি হয়েছে জিজ্ঞাস করার সাহস নেই। বড় ভয় করে ভাইজানের টেনশানের সময় কিছু জিজ্ঞাস করতে। 
—হনুফা! ও হনুফা! ঘুমাই গেইলি?  
—না ঘুমাইনি, কিছু বলবেন? আপনার কি কোনো কষ্ট হচ্ছে ভাইজান? 
—কষ্ট হইতাছেরে বোইন, বহুত কষ্ট। মা মারা গেইছে আর যেবা কষ্ট  হইছিল; ঠিক হেবা কষ্টরে বোইন। মুই তো থির হইবার পারতাছি না। মুই কেমতে কথা কইমুরে বোইন। মোর কথা ছাতির থেইকে গলায় উইঠা আটকাইয়া থাকব। মুই তো হেই বেথায় তড়পাইতে তড়পাইতে মইরা যাইমুরে বোইন।
—ভাববেন না ভাইজান। সব ঠিক হয়ে যাবে। 
ভোরের ফ্যাকাশে আলো মেখে বসে থাকা হনুফা টের পেল তার হাতে টান পড়ছে। ভাইজান তাকে নিয়ে ছুটছে সামনের দিকে। ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার অপর প্রান্তে বড় এক কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। গাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে সামনে উঁকি দিয়ে দেখলো রাস্তায় অসংখ্য পুলিশ রাইফেল তাক করে আনাগোনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ছায়ামূর্তির মতো অনেক ছায়া ব্যতিব্যস্ত নড়ছে। একটা মানুষের চলাচলও নেই এছাড়া কোথাও। অনেকক্ষণ ঘাপটি মেরে থাকা রোদ তেতে উঠেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক। একদল কাক গাছে গাছে উড়ছে আর তাদের চিৎকারে মাতিয়ে তুলছে এলাকাটা। কিন্তু সেই স্বর ভীত শোনাচ্ছে।  ভাইজান চলেন ফিরে যাই। এখন তো আপনি তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। পরে এসে দেখা করবেন।
—একটু থাম না বোইন। এত্তোখান পথ আইনু এমনি ফিইরা যাইমু? তুই  এহানে ’ব’ মুই এক দৌড়ে যাইমু আর আইমু। মুই আইতে দেরি অইলে তুই লুকাই পড়িস ওই ঝোঁপের মোধ্যে। মুই তোরে বিচড়াই লইমু ।
‘ভাইজান’ ডাকতে ডাকতে ভাইজানের পিছু পিছু ছুটলেও লাভ হলো না কিছু। কারণ সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনো ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই,’ মিছিলের গগন ফাটা আর্ত আহ্বানের ভেতর মিলিয়ে গেলো আমার ডাক। বুকের ভেতর বেজে উঠলো সে ধ্বনি আমারও ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।’ গুলির পর গুলির শব্দের সঙ্গে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।’ হৃদয়ের দাবি থেকে উচ্চারিত ধ্বনি প্রতিধ্বনি হতে থাকলো পুরো এলাকা জুড়ে। কাকেরা নিশ্চুপ হয়ে গেল। কোকিলের স্বর কান্নার মতো শোনাতে শোনাতে থেমে গেলো। যেন ক্ষুধায় কান্নারত শিশুকে কোলে তুলে নিয়েছে তার মা। 
ভাইজানকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। থেমে গেছে গুলি। মৃদু মৃদু শোনা যাচ্ছে ‘বাংলা চাই, বাংলা চাই।’ যাই ভাইজানকে ডেকে আনি। বাড়ি যেতে হবে। রক্তে রক্তে ঢল নেমেছে পথে। তার সঙ্গে মিলেমিশে আছে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি। এতো গুলি ছুঁড়ল এক মুহূর্তেই? আহারে! কত মানুষ ফেস্টুন হাতে আহত হয়ে পড়ে আছে। কত মানুষ গোঙায়। কৃষ্ণচূড়া আর রক্ত রঙে লাল হয়ে আছে পুরো চত্বর। কিন্তু ভাইজান কই? ভাইজান! ও ভাইজান! আপনি কই? কালো সাদা চেকের শার্ট পরে ছিল ভাইজান। সামনে যে মানুষটা গোঙায় ওর পরায়ও কালো শার্ট। রক্তে ভেজার কারণে সাদা চেকগুলো আবছা দেখা যায়। তার হাতে একটি ফেস্টুন ‘মাতৃভাষা বাংলা চাই।’ বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল টর্নেডো। দৌড়ে তার কাছে গেলাম। আকাশমুখী করলাম মানুষটাকে। ডান হাত থেতলে গেছে মানুষের পায়ের চাপে চাপে। ডান হাতের বহু ফুটো করে দিয়েছে দু’টো বুলেট। ঠোঁট থেকে তখনো বেরুচ্ছে—হামার ভাষা বাংলা চাই…বাং—লা চা…” 
 ভাইজান! ও ভাইজান! ভাইজান গো! বলতে বলতে বুকে চেপে ধরি ভাইজানকে। সেখান থেকে উঠে আসে যেন ‘তোর ভাইজানের রক্তে ভেজা এ ফেব্রুয়ারি।’ এই ছাড়া ভাইজানের নিঃশ্বাসের শব্দ টের পাওয়া যায়। কাটা মুরগির মতো কষ্ট তড়পায় বুকের ভেতর।


রওশন রুবী, কবি ও কথাসাহিত্যিক, বাংলাদেশ

menu
menu