ঘানি

দু’ঘণ্টা আগেই সকালের আলো ফুটেছে। আজ সিরাজুল সাহেবের জন্মদিন। পর পর দু’বার হার্ট এ্যাটাকের পর তার জন্মদিন পালন করবার মতো মানসিকতা নিজেরও নেই, পরিবারেরও কারোর নেই। বিগত তিন বছর ধরে রাত ১২:০০ টা বাজলে হুইল চেয়ারে বসে বারান্দায় গিয়ে একা একা আকাশ দেখেন আর বিলাপ করে আনমনে। গত বছর থেকে তাও টুকটাক কথা বলতে পারছে এর আগের দু’বছর প্রায় বাকশূন্য ছিল। কোনো কথা বলতো না শুধু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকতো। বাসায় ছেলে মেয়ের গেস্ট, বন্ধু-বান্ধব সবাই আসে যায়। অনেক উৎসব, দাওয়াত হৈ চৈ হয়। সিরাজুল সাহেব একাকী এক রুমে হুইল চেয়ারে বসে থাকে। মন চাইলে বারান্দায় যান। বাথরুমে গেলে ঘণ্টা বাজান। তাঁর ঘণ্টার ধ্বনি শুনে দৌড়ে আসে সালেহা। সালেহা তার কেয়ারটেকার। সবসময় তাকে পাওয়া যায় না। ওই বাথরুমে যাওয়া, গোসল করানো আর খাবার পৌছে দেয়া। আগে সালেহা সিরাজুল সাহেবকে খাইয়ে দিত এখন সে নিজেই কষ্ট করে একটু একটু করে খেতে পারে। তবে সালেহাকেও ইদানীং খুব বেশি পাওয়া যায় না। বাড়িতে কাজের চাপ বেশি । এর সাথে যোগ হয়ে নাতনি উর্বশীকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসার দায়িত্ব। এই একমাত্র নাতনী উর্বশীই তার রুমে এসে তাকে মাঝে মাঝে সঙ্গ দেয়। নতুবা অনেক আগেই দম বন্ধ হয়ে মরে যেত। 
উর্বশী আজ স্কুলে যাবে না। সে দাদুর রুমে ঢুকেই জানালার পর্দা সড়িয়ে দিল। সিরাজুল সাহেবের চোখে সূর্যের আলো এসে পড়ে। সে চোখে হাত দেয়। আর উর্বশীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। কারণ সে জানে আজকে তার জন্মদিনের কথা সবাই ভুলে গেলেও উর্বশী ভুলে যায়নি। প্রতিবছরই সে কিছুনা না কিছু সারপ্রাইজ দেয় দাদুকে। এবারও তার ব্যতিক্রম না। দাদুর চোখে হাত দিয়ে বলে—“দাদু, তুমি চোখ খুলবে না কিন্তু।” সিরাজুল সাহেবও একান্ত বাধ্যগতের মতো চোখ বন্ধ করে রাখে। উর্বশী পাশের রুম থেকে দৌড়ে এসে দাদুকে চোখ খুলতে বলে। দাদু চোখ খুলেই দেখে একটা খাঁচাবন্দি টিয়া পাখি। বন্দি পাখি সিরাজুল সাহেব পছন্দ না করলেও । নাতনিকে খুশি করার জন্য সারপ্রাইজড হওয়ার ভান করেন। নাতনিকে কাছে টেনে কপালে চুমু খান। উর্বশীর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। দাদু তার উপহারটা পছন্দ করেছেন। জানো দাদু পাখিটা না কথা বলতে পারে। এই পাখি তোর নাম বল দাদুকে। পাখি বলে—মুঁক্তি, মুঁক্তি। শব্দদু’টো যেন অন্তরে গিয়ে লাগে সিরাজুল সাহেবের। কারণ মুক্তি ছিল তার সহধর্মিনীর নাম। সে মারা গেছে প্রায় ২০ বছর আগে। ছোট ছেলে তখন মাধ্যমিক পাশ দিয়েছে, বড় ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। চাইলে তখন সে একটা বিয়ে করতে পারতো কিন্তু করেনি। ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এইতো কটা দিন। ছেলেগুলো পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিবে। তারপর দুঃখের দিন শেষ। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে চাকরি নিল, বিয়ে থা করল। কিন্তু নিজের কপাল থেকে যেন দুর্ভাগ্য আর পিছু ছাড়ে না। পর পর দুইবার হার্ট এটাক করল। ছেলে বউদের সাথে খিস্তি খেউর আর সংসারের অশান্তি যেন পিছুই ছাড়ছেনা তার। অসুস্থ হওয়ার পর একরুমে পড়ে থাকে। চাইলেও বাইরে যাবার উপায় নেই। হাঁটতে চলতে পারে না। ছোটবেলায় প্রথম যখন তার বাবা করিম মিয়ার ঘানিটানা গরুটা মারা গেল। তখন বাবার কান্নারত মুখ সে সইতে পারেনি। শেষ মেষ নিজের ঘাড়েই ঘানি তুলে নিয়েছিলেন। কখনো কখনো ঘানি টানতে টানতে আধমরার মতো পরে থাকতেন। মাঠে ছাগল চড়াতেন, স্কুলে যেতেন। পুরো দস্তুর সংসারী একটা ছেলে। কলেজে পড়ার সময় বাবাকে হারান। ছোট ভাই জব্বার মিয়া এখন ম্যাজিস্ট্রেট। আর তিনি সারা জীবন স্কুলে শিক্ষকতা করে কাটিয়েছেন। সংসারের প্রয়োজনে খুব কম বয়সেই তাকে পার্টটাইম চাকুরি, টিউশনি এসব  করতে হয়েছে। ছোট ভাই এখন কোন খোঁজ খবর নেয় না। পুরদস্তুর একা একটা মানুষ তিনি।
সালেহা সকালের নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকেন। সিরাজুল সাহেব হাতের ইশারায় আস্তে আস্তে বলে—‘এই পাখিটাকে একটু বারান্দায় টানিয়ে দেতো সালেহা।’ সালেহা পাখিকে খাঁচার মধ্যে খোঁচা দিয়ে বলে—‘ওই পক্ষী তোর নাম কী?’ টিয়া পাখিটির কর্কশ শব্দে বলে—মুঁক্তি, মুঁক্তি। একটু পরেই তার রুমে ঢুকে ছোট ছেলে শাহাদাত। সে একটি সরকারি চাকরি করে। তার বউ একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরি করে। বড় ছেলে বউ সন্তান নিয়ে কানাডায় থাকে। গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। থাকার মধ্যে এই তিনকাঠা বাড়িটাই অবশিষ্ট আছে। বড় ছেলে কোন খোঁজ খবর নেয় না। শাহাদাত বাবার কাছে এসে বসে। আব্বা, আমার ট্রান্সফার হইছে চুয়াডাঙ্গা। প্রতিদিন তো আর ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গা অফিস করা সম্ভব নয়। আমি মাসে দুই তিনবার আসবো। আপনার বউমা আর নাতনি তো থাকলোই। এই তো আবার আগামী বছর ঢাকায় পোস্টিং নেয়ার চেষ্টা করব। এই একটা বছর একটু কষ্ট করেন। ছেলের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকেন সিরাজুল। তার কিছুই বলার নেই। ছেলে বাসায় থাকলেও যে খুব একটা বাবার খোঁজ নেন তা কিন্তু না। তবুও ছেলে বলে কথা, দূরে যাবে তাই মন খারাপ। আস্তে আস্তে বলেন—চাকুরি যখন যেতেতো হবেই। বউ হাতের ঘড়ি পড়তে পড়তে রুমে ঢুকেন।  ‘আমি উর্বশীর মিসের সাথে কথা বলেছি, ওকে এই একবছর হোস্টেলে রাখব। মাঝে মাঝে এখানে আসবে। যা দিনকাল পড়েছে। মেয়ে বড় হয়েছে। ওর বাবা তাও সন্ধ্যার পরে অফিস থেকে আসলে একটু ভরসা পেতাম। ছেলে টিচার কার ভিতরে কী আছে আল্লাহ জানে। সিরাজুল সাহেব মন খারাপ করে ফেলেন। এই নাতনি ছাড়া তার মন ভালো করার অনুসঙ্গ কোথায়। কিন্তু করার কিছু নেই। তার মতো অক্ষমের কথা এই সংসারে অচল। তাকে যে ওল্ডহোমের আস্তাকুড়ে ফেলে আসেনি এটাই যেন তার সৌভাগ্য। 
পরদিন সবাই চলে যায়। উর্বশী চলে যায় হোস্টেলে, বাবা চলে যায় চুয়াডাঙা আর মা ব্যাংকে। যাওয়ার সময় উর্বশী দাদুকে বলে। দাদু আরও একটা অজানা কথা তোমাকে জানাই—এ পাখিটার নাম কিন্তু মুক্তি না, আমিই ওর নামটা দিয়েছি। আর  ও কিন্তু খুব সহজেই কথা শিখে ফেলে। তুমি চাইলে ওকে গানও শিখাতে পারো। যেমন ধরো—পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে কিংবা আইলারে নয়া দামান। দাদু একটু  মুচকি মুচকি হাসেন আর নাতনির কপালে চুমু খেয়ে আস্তে আস্তে বলেন—‘ফি আমানিল্লাহ’। 
বাড়িটা একা সুনসান হয়ে আছে। সালেহা ব্যস্ত সিরিয়াল নিয়ে। তাকে এখন আর কে পায়। বুড়োর খবর নেয়া না নেয়া নির্ভর করে তার মর্জির ওপর। দুপুর বেলায় হঠাৎ আকাশটা কালো হয়ে আসে। ঠান্ডা বাতাস ছুটেছে। সালেহা দৌড়ে আসে রুমে। দাদাজান দরজা জানালা লাগাইয়া দেই তুফান ছুটবো মনে হয়। সিরাজুল সাহেব মিটিমিট হাসেন। তার বউয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ঢাকায় প্রথম যখন তাদের বাড়িটা টিনসেড ছিল তখন ঝড় হলে মুক্তি খুব অস্থির হয়ে উঠতো বারান্দা থেকে কাপড় আনা, আর দরজা জানালা লাগানোতে। বৃষ্টি বাড়তে থাকে। জানালায় ঠুকঠাক শব্দে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। পাখিটাকে ঘরের ভেতরে রাখা হয়েছে। সিরাজুল সাহেব হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে পাখির কাছে যান। পাখিকে বলেন—‘বৃষ্টি আনন্দ’, ‘বৃষ্টি আনন্দ’। পাখিও দু’তিনবার শুনে বলতে থাকে—‘বৃষ্টি  আনন্দ’, ‘বৃষ্টি আনন্দ’। সিরাজুল সাহেব হো হো করে হেসে ওঠেন। তার চোখের সামনে পুরোনো দিনের সব কথাগুলো একে একে ভেসে উঠছে। তার বউ মুক্তির সাথে প্রথম দেখা হয় টিউশনি থেকে ফেরার পথে একটা যাত্রী ছাউনিতে দু’জনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বৃষ্টি থামতে থামতে সন্ধ্যা থেকে রাতে গড়ায়। দু’জনের আলাপ আর গল্পে তৈরি ঘনিষ্ঠতা। বৃষ্টি থামলে তাকে বাড়ি পৌছে দেন। মুক্তিও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একটি এমপিওভুক্ত স্কুলের হেডমাস্টার। তার স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে পরবর্তী সময়ে চাকরি নেন সিরাজুল ইসলাম। তারপর দু’জনের বিয়ে। বিনোদন বলতে তাদের ছিল বোটানিক্যাল, চিড়িয়াখানা, সিনেমা হল। কোনদিনও আজকালকার মতো কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনে ঘোরার সামর্থ্য ছিল না তাদের। তবে সখ যে ছিল না তা নয়। শ্বশুরের এই বাড়িটাই তার সম্বল। তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠি বলতে আর কেউ নেই। বউ মুক্তিও তাকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছে অনেক আগে। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো মাঝে মাঝে ধান কাটা আর মাছ ধরার মৌসুম হলে। স্বামী-স্ত্রী মিলে পুকুরে মাছ ধরতে নামতো। দু’জনে কাদায় মাখামাখি অবস্থা করে একপাতিল মাছ নিয়ে ঘরে ফিরতো। ধনে পাতার ঝোল দিয়ে শোল মাছ ভালো রান্না করতো সিরাজুলের মা। আজ মাও নেই। থাকলে হয়তো তার বুকে মাথা গুঁজে হুহু করে কান্না জুড়ে দিয়ে মনটাকে হালকা করা যেত। ছোটবেলায় জ্বর হলে মায়ের কাছে ঘুমাতেন সিরাজ। মায়ের আলতো হাত বুলানোতেই যেন তার জ্বর অর্ধেক ভালো হয়ে যেতো।   
সন্ধ্যা ৭টায় ব্যাংক থেকে ফেরেন ছোট বউ মাহমুদা। আজ আর তিনি একা নন তার সাথে একজনত্রিশোর্ধ্ব লোক এসেছেন। তাকে এর আগে কখনো এ বাড়িতে দেখা যায়নি। মাহমুদা সালেহাকে বলে—উনার নাম মাসুদ, আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড আজ রাতে আমাদের বাসায় খাবেন। মাহমুদাকে বিশাল এক বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দেন। সালেহা বলেন—এইসব তো আশেপাশের দোকানে পাওয়া যাইবো না। গরুর গোশ আনতে হইলে তো বাজারে যাওন লাগব।
তো যাওন লাগবে তো যা-না মানা করেছে কে? সালেহা একটু কপাল কুচকে মাহমুদার দিকে তাকায়। মাহমুদা ব্যাগ থেকে একহাজার টাকার দু’টো নোট বের করে সালেহাকে ধরিয়ে যেন। দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসেই বুক থেকে ওড়না সরিয়ে ফেলেন মাহমুদা। তাকে জড়িয়ে ধরেন তার বন্ধু মাসুদ। দু’জনে হাসাহাসি আর অশোভন শব্দে বাড়িটির নির্জনতা রোধ হয়। সিরাজ তার রুম থেকে মৃদু স্বরে সালেহাকে ডাকেন—‘সালেহা, সালেহা’। কিন্তু সালেহার কোনো সারা না পেয়ে ঘণ্টা বাজান। ঘণ্টার আওয়াজ মাহমুদার কানে গেলে মাহমুদা মাসুদকে বলেন—‘ওয়েট এ মিনিট আমি আসছি।’ দোতলায় গিয়ে রাগে গর্জে ওঠেন মাহমুদা—কি সমস্যা আপনার এতো খ্যাচখ্যাচ করছেন কেন। বৌমা আমার প্রেসার বেড়েছে বোধ হয়, প্রেসারের ওষুধও শেষ। সালেহাকে পাঠাবো বাইরে ওষুধ আনতে। আমি সালেহাকে বাইরে পাঠিয়েছি। —কেন বৌমা। —বাসায় গেস্ট এসেছে। —কে এসেছে বউ মা। —কে এসেছে তা জেনে আপনার কী? আমার কী কোন বন্ধু-বান্ধব থাকতে পারে না নাকি। —আজ শাহাদাত বাইরে গেলো আর আজকেই বন্ধু বান্ধব আসতে হলো। —কি বলতে চাচ্ছো তুমি বুড়ো। সিরাজ আর কোন কথা বাড়ায় না। সে বারান্দায় চলে  যায়। তার রুমের দরজাটি বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে যায় মাহমুদা। তারপর নিচের রুমে গিয়ে বন্ধুকে নিয়ে রঙ্গলীলায় মত্ত হয়ে ওঠে মাহমুদা। দোতলার বারান্দার নিচেই রুমের জানালা। জানালা ভেদ করে মৃদু কোকানির শব্দ ভেসে আসে। সিরাজুলের আর বুঝতে বাকী থাকে না নিচে কী হচ্ছে। সে জোরে জোরে হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দরজায় আঘাত করছে আর গর্জে উঠে বলছে বৌমা দরজা খোল, বৌমা দরজা খোলো। তার এত জোরে চিৎকার করে কথা বলাটি টিয়া-মুক্তি এই প্রথম শুনল। তার সাথে সাথে টিয়াও বলতে থাকল— ‘বৌঁমা দঁরজা খোঁলো, বৌঁমা দঁরজা খোঁলো’। ছেলের কপালে এমন দুশ্চরিত্র বউ জুটবে এমনটি তিনি মেনে নিতে পারছেন না। যে বউকে তিনি সারাজীবন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে করে এসেছেন। আজ তার এ কী রূপ দেখছেন। সে হুইল চেয়ার থেকে রাগে ক্ষোভে দাঁড়াতে চাইছেন। কিন্তু দাঁড়াতে পারছেন। টিয়া পাখি অনবরত বলে যাচ্ছেন—  ‘বৌঁমা দঁরজা খোঁলো, বৌঁমা দঁরজা খোঁলো’। সালেহা বাজার নিয়ে আসে। মাহমুদা আর মাসুদ মাতাল হয়ে টলতে থাকে এক অসুস্থ অস্বাভাবিক উন্মত্ততায়। সালেহা হাতে মোবাইল নেয় শাহাদাতকে ফোন দেয়ার জন্য। কিন্তু তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে এক আছাড়ে চূর্ন বিচূর্ণ করে দেয় মাহমুদা। তারপর হো হো করে হেসে ওঠেন। মাহমুদা ওপরের রুমে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দেন। সিরাজুল গর্জে উঠে পেপার ওয়েট ছুড়ে মারেন নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মাহমুদার উপর। মাহমুদা কপাল থেকে রক্ত ঝড়ছে। মাহমুদা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর বলে—আমি তোকে জেলের ঘানি টানাবো বুড়ো।  মাসুদ অবস্থা বেগতিক দেখে গায়ে জামা কাপড় চেপে পালিয়ে যাচ্ছে। সালেহা বলে খালুজান এইটা আপনি কী করলেন। মাহমুদা কপালে হাতে দিয়ে মূর্ছা যেতে যেত জ্ঞান হারান।  সালেহা ডাক্তার আনতে দৌড়ে যান। সিরাজ অবাক হয়ে দেখেন সে দাঁড়াতে পারছে তার পায়ে শক্তি ফিরে এসেছে। সে পাখির খাঁচাটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। কোথায় যাবেন জানে না। সদরঘাটে গিয়ে একটি লঞ্চে চেপে বসেন। রাত বাড়ছে চারিদিকে নদীর ঢেউ খেলা করছে। সিরাজ মুক্তির খাঁচা খুলে দেন। কিন্তু অবাক করা বিষয়। মুক্তি উড়ে যেতে চাইছে না। হয়তো কাল সকালে ছেলের কাছে গল্প ফেঁদে কোনো মুখরোচক গল্প বানিয়ে বলবে বউ। সালেহা কী সব ঘটনা শাহাদাতকে ঠিকঠাক বলতে পারবে। নাকি টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে রাখা হবে। ছেলে কী এই অসৎ বউয়ের সাথে ঘর করবে নাকি সংসারটা ভেঙে দিবে। নানামুখী চিন্তার বোঝা তার মাথায় এসে চাপে।  আর যদি তার আঘাতে মাহমুদা অক্কা পায় তাহলে তাকে আবারও ঘানি টানতে হবে—জেলের ঘানি। আজীবন তিনি ঘানি টানতে টানতে এখন ক্লান্ত। লঞ্চের ছাদে দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত করে শুয়ে আছে সিরাজুল। তার উপরে বিশাল আসমান । মেঘগুলো ছিড়ে ছিড়ে একটি আরেকটি থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।  সহসা সে দেখতে পেলো মুক্তির ওড়াওড়ি। সে শুয়ে শুয়ে হাতে তালি বাজাচ্ছে আর বলছে ওড় পাগলি ওড়। উড়ে যা। আর কতকাল এই খাঁচার বন্দি থেকে ঘানি টানবি। সামনে পদ্মা নদী। নদীর সোঁ সোঁ শব্দে সিরাজুলের চোখে ঘুম চলে আসে। অনেক বছর সে এভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেনি।


স্বপঞ্জয় চৌধুরী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, ঢাকা 

menu
menu